‘মুক্ত-মনা’-এর ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮ তারিখের সংখ্যায় অভিজিৎ রায়ের মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে অবৈজ্ঞানিকতার অভিযোগ [এবং তৎসহ ৪ সেপ্টেম্বর ও ২৬ অক্টোবরের সংখ্যায় তাঁর কিছু সমালোচনার উত্তর] পাঁচ বছর বাদে সেদিন হঠাৎ করে আমার দৃষ্টিগোচর হল। আমরা শ্বেতকেশধারীরা এখনও আধুনিক অনেক কেতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি বলে মুদ্রিত বইয়ের বাইরে ই-পাঠে ততটা সহজ যাতায়াত করে উঠতে পারছি না। ফলে সেখানকার অনেক কিছুই আমার অন্তত নজরের বাইরে থেকে যাচ্ছে। কেউ ধরিয়ে দিলে চেষ্টা চরিত্র করে পড়ে নিই। এটাও তেমন করেই বাংলাদেশের দু-একজন শুভানুধ্যায়ীর সৌজন্যে আমার হাতে (আসলে চোখে) এসে গেল। এবং পড়ে বেশ অবাক হলাম। অবাক এই কারণে হইনি যে মার্ক্সবাদী চিন্তাধারাকে অবৈজ্ঞানিক বলা হয়েছে। অবাক হয়েছি অন্য একটা কারণে। আমি অনেক দিন ধরেই অভিজিৎ রায়ের লেখার খুব ভক্ত। বিজ্ঞান বিষয়ক লোকপ্রিয় লেখায় ওনার হাত খুব পাকা। আমি নিজেও যেহেতু বিজ্ঞানের লোকপ্রিয়করণের কাজে অনেক দিন ধরে যুক্ত আছি, জানি কাজটা কত কঠিন। হিগ্‌স বোসন নিয়ে গত বছর ওনার মুক্তমনায় প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে আমার একটা লেখাতেও আমি কিছু মালমশলা হাতিয়েছিলাম এবং যথাস্থানে তার ঋণস্বীকৃতিও দিয়েছিলাম। তাই, এই বিষয়ে উনি যে যুক্তিধারা অবলম্বন করেছেন তাতেই আমি বেশ আশ্চর্য হয়ে গেছি। মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে বহু মানুষ বহু দিন ধরেই অনেক নিন্দা সমালোচনা করে আসছেন। তার দার্শনিক বৈজ্ঞানিক ভিত্তিকে আক্রমণ করে তার তাত্ত্বিক যৌক্তিকতাকে খণ্ডন করে যাচ্ছেন। অভিজিৎ রায়ের দু কিস্তি রচনাতেও অন্তত ছাব্বিশ জনের উল্লেখ রয়েছে যাঁরা মার্ক্সবাদকে ভুল প্রমাণ করেছেন। মুশকিল হচ্ছে, তার পরেও তাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য আবার অভিজিৎ বাবুকে কলম ধরতে হয়েছিল, যাতে প্রমাণ হয়, মার্ক্সবাদকে ভ্রান্ত সাবিত করার কাজটা এতদিনেও শেষ করা যায়নি। এর পরেও কাজটা শেষ হয়েছিল কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কেন না, হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই দেখতে পাব, আবার কেউ নতুন করে মার্ক্সবাদকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করতে চলেছেন, নতুন করে যুক্তির ঘুঁটি সাজাচ্ছেন।

লক্ষ করে দেখলাম, অভিজিৎ বাবুর সমালোচনার অভিমুখ শুধু এ নয় যে মার্ক্সবাদ একটি অচল, ভ্রান্ত মতবাদ; তাঁর প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় এই যে মার্ক্সবাদ একটি বৈজ্ঞানিক দর্শন নয়। মার্ক্সবাদকে বিজ্ঞান বলা যায় না। মার্ক্সীয় তত্ত্বের অনেক কিছুই অনেক দিন আগেই ভুল প্রমাণিত হয়ে গেছে। মার্ক্সবাদীরা ধর্মীয় গোঁড়ামির অনুরূপ গোঁড়ামি করে একে এখনও বৈজ্ঞানিক মতবাদ বলে ঘোষণা করে চলেছে। তিনি মনে করেন, মার্ক্সীয় মতবাদের একটা মানবিক আবেদন আজও আছে, তাকে অস্বীকার করা যায় না বা করার প্রশ্নও ওঠে না। কিন্তু একে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারা আর কোনোমতেই বলা যায় না।
এমনিতে এত পুরনো একটা লেখার পক্ষে বিপক্ষে এতকাল পরে মতামত দেবার কোনো মানে হয় না। কিন্তু যেহেতু মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে অনেকেই এই ধরনের সমালোচনা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গণ মাধ্যমে করে চলেছেন, এবং যেহেতু তার মধ্যে এই রচনাটি যুক্ত-তর্কের দিক থেকে একটু উন্নত গোছের, ভেবে দেখেলাম, এর প্রত্যুত্তর আরও অনেকের সমগোত্রীয় লেখার উত্তর হিসাবে কাজ করতে পারে। তাই এই নিবন্ধের অবতারণা।

কোথায় ভুল?
আমি আমার এই আলোচনার শুরুতেই একটা কথা পরিষ্কার করে নিতে চাই, মার্ক্সবাদকে যিনি ভুল প্রমাণ করতে চাইবেন তাকে প্রথমেই বলতে হবে কোথায় তিনি ভুল ধরতে চান। এর তত্ত্ব কি ভুল প্রমাণিত হয়েছে, নাকি এর প্রয়োগ ব্যর্থ হয়েছে? অথবা তিনি কি মার্ক্সবাদের প্রয়োগের ব্যর্থতা দেখিয়ে এর তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করতে চান? প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ এইজন্য যে অতীতের সমালোচকদের মতোই অভিজিৎ বাবুর রচনায়ও দেখলাম আগাগোড়াই এই দুটো ভিন্ন প্রশ্নের মধ্যে বারে বারে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে।
অর্থাৎ, আমার বক্তব্য হল, মার্ক্সবাদকে তিনভাবে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করা যায়।
১) এর তত্ত্বটাই আদতে ভুল; সুতরাং প্রয়োগে তো আর সঠিক কিছু হতে পারে না; কিংবা,
২) এর তত্ত্ব ঠিক থাকলেও যারা এর প্রয়োগ করেছে তারা এত ভুল করেছে যে একে আর গ্রহণ করা যায় না; অর্থাৎ, এর তত্ত্ব এতটাই কল্পবিলাসিতা যে এর প্রয়োগ তথা সঠিক প্রয়োগ হওয়া সম্ভবই নয়;

৩) এর প্রয়োগের ব্যর্থতাই প্রমাণ করেছে যে এর তত্ত্বটাও ভুল।
সতর্কভাবে লক্ষ করলেই বোঝা যাবে, এই তিনটি দৃকপাত (approach)-এর মধ্যে কিন্তু পার্থক্য রয়েছে। দুঃখের কথা হল, অধিকাংশ সমালোচকই এই তিনটি দৃকপাতকে মিলিয়ে-গুলিয়ে ফেলেন এবং একই সঙ্গে একবার এটা আর একবার ওটার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকেন। অভিজিৎ বাবুর ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। যাঁরা এইভাবে যুক্তিতর্ক করেন, তাঁরা বুঝতে পারেন না, একটা তত্ত্ব বা মতবাদকে ভুল প্রমাণ করার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বা তৃতীয় দৃকপাত কখনও কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে না। প্রথম দৃকপাতই একমাত্র এই ব্যাপারে আমাদের সঠিক পথ দেখাতে পারে।

ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি।
ধরুন, মেনে নেওয়া গেল যে মার্ক্সবাদের প্রয়োগ ব্যর্থ হয়েছে। কেন না, এ তো দেখাই গেছে, যে সমস্ত দেশে একদিন মার্ক্সবাদ মেনে নিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই সব দেশে তা এক সময় তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। এটাও না হয় মেনে নেওয়া গেল যে পূর্বতন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে কমিউনিস্ট পার্টির তরফে অনেক অত্যাচার নির্যাতন হয়েছে, ইত্যাদি। তাতেই বা আসলে কী প্রমাণ হয়? এই সব ঘটনা নীচে উল্লিখিত দুটোর যে কোনো একটা কারণে ঘটে থাকতে পারে। [ক] মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রের তত্ত্বটাই এমন যে যেখানেই সমাজতন্ত্র নির্মিত হবে সেখানেই ঠিক এই সমস্ত ঘটনাই ঘটবে। এবং এই কারণেই রাশিয়ায় বা চিনে আমরা যা যা ঘটতে দেখেছি তা ঘটেছিল। [খ] না, মার্ক্সীয় তত্ত্বে এরকম কোনো অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হওয়ার কথা নেই। কিন্তু যারা একে প্রয়োগ করেছে দেশে দেশে, তারা এর আসলে অপপ্রয়োগ ঘটিয়েছে। তার ফলেই ইতিহাস-দৃষ্ট দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাগুলি ঘটেছে।

আবার আমি সতর্ক পাঠককে বলছি, প্রয়োগের ব্যর্থতা দেখিয়ে মার্ক্সবাদকে মতবাদ হিসাবে ভ্রান্ত প্রমাণ করতে গিয়ে এই দুটো যুক্তির মধ্যে যে কোনো একটা আপনাকে বেছে নিতেই হবে। আপনি যদি [ক]-যুক্তিধারা মেনে নেন, তাহলে আপনার আর কষ্ট করে সমাজতন্ত্রের প্রয়োগ পর্যন্ত যাওয়ার দরকারই হচ্ছে না। মার্ক্সের তত্ত্বটাকে ধরেই আপনি তাকে ভুল প্রমাণ করে দিতে পারছেন। আপনি দাবি করতে পারেন, যেখানেই এর প্রয়োগ হবে সেখানেই এই রকম পরিণতি দেখা দেবে। তাছাড়া যে তত্ত্ব বা মতবাদকে যুক্তিতর্ক দিয়েই ভুল বলে সাব্যস্ত করা যায়, তার প্রয়োগের ভালোমন্দ নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতেই বা যাব কেন?

পক্ষান্তরে, আপনি যদি [খ]-যুক্তি স্বীকার করেন, তাহলে রাশিয়ায় বা চিনে বা রুমানিয়ায় যা কিছু ঘটেছে তার জন্য তো আপনি মার্ক্সবাদকে বা মার্ক্সকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করতে পারেন না। মার্ক্সবাদ বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা কিনা তাও এর দ্বারা মীমাংসা করা যায় না। স্বয়ং বিজ্ঞানকেই যেখানে অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে, প্রকৃতিবিজ্ঞানের উপকারী আবিষ্কারকে মানবজাতির ক্ষতিসাধনে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানে মার্ক্সীয় সমাজতাত্ত্বিক সঠিক চিন্তাকে তো ভুল রাস্তায় অপপ্রয়োগ করা যেতেই পারে। হয়ত সেটাই ঘটেছে বাস্তবে।
এই কারণেই আমি বলেছিলাম, প্রথমেই আমাদের ঠিক করে নিতে হবে আমরা মার্ক্সবাদকে ভুল বা অবৈজ্ঞানিক প্রমাণ করার কাজে কীভাবে এগোব। আমি আশা করেছিলাম, নিয়মিত বিজ্ঞান লেখক হিসাবে শ্রীরায় এই বৈজ্ঞানিক যুক্তিবিচার পদ্ধতি সম্বন্ধে সচেতন হবেন। সস্তার সহজ পথে তিনি হাঁটবেন না। কিন্তু না! মার্ক্সবাদ এমনই একটা স্পর্শকাতর অভিপাদ্য যে এ নিয়ে শুধু যে মার্ক্সবাদীরাই ধর্মীয় গোঁড়ামি বা ওই জাতীয় আচরণ করে বসেন তা নয়, যাঁরা গোঁড়ামি মুক্ত মনে একে বিরোধিতা করতে যাচ্ছেন বলে ভাবেন তাঁরাও শেষ অবধি বৈজ্ঞানিক বিচারধারায় আস্থা রাখতে পারেন না। হয়ত মনের অগোচরে তাঁদেরও এই আশঙ্কা থাকে যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কাজটা সুষ্ঠভাবে হাসিল হবে না।

কোনটা ভুল?

লেনিনের কথার সূত্র ধরে সকলেই জানেন,অভিজিৎ বাবুও তাঁর প্রবন্ধে শুরুতেই পরোক্ষভাবে মেনে নিয়েছেন, মার্ক্সীয় মতবাদের মধ্যে তিনটি প্রধান অংশকে লক্ষ বা চিহ্নিত করা যায়:
(১) দার্শনিক অধিকাঠামো,
(২) সমাজতাত্ত্বিক ইতিহাস, এবং
(৩) রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, যাঁরা আজ মার্ক্সবাদকে ভুল প্রমাণ করতে চান, তাঁরা এর কোন অংশকে ভুল বলতে চাইছেন? ব্যাপারটা যদি এমন হয়, তাঁরা সমস্তটাকেই ভুল সাব্যস্ত করছেন, তাহলে এক কথা। সেটাও কেউ চাইলে করতেই পারেন। সেক্ষেত্রে তাঁকে সেটা খোলসা করে বলে রাখতে হবে। আবার কারোর মনে হতে পারে, মার্ক্সীয় দর্শনের বিরুদ্ধে আপত্তি করার কিছু নেই, কিন্তু মার্ক্স ইতিহাসকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বা অর্থনীতির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তার মধ্যে গলদ আছে। এমনকি যাঁরা মার্ক্সীয় দর্শনকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন, তাঁদের মধ্যেও একদলের মতে মার্ক্স তাঁর মতবাদকে কোথাও বস্তুবাদ বা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হিসাবে উপস্থাপন করেননি, মার্ক্সবাদকে এই অভিধা দিয়ে গেছেন প্লেখানভ, লেনিন এবং স্তালিন, ইত্যাদি; কারোর মতে, মার্ক্সীয় দ্বন্দ্বতত্ত্ব শুধুমাত্র সমাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, প্রকৃতির ক্ষেত্রে তাকে প্রয়োগ করাটাই ভুল হয়েছে, এবং এই ভুলের জন্য তাঁরা এঙ্গেল্‌সকেই মূলত দায়ী করেন। বিপরীত দিকে আর এক দল আছেন যাঁরা মনে করেন, মার্ক্সের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বা ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা নামে যে মতবাদ অনেক দিন ধরে সমাজে চালু আছে তাও মার্ক্সের নিজস্ব চিন্তা নয়, সেও নাকি এঙ্গেল্‌স ও পরবর্তীকালের মার্ক্সবাদীরা মার্ক্সের নামে বাজারে ছেড়েছেন। এছাড়া, লেখক যাঁদের নাম বলেছেন, বম-বাওয়ার্কে, জেভন্স, প্রমুখ—তাঁরা আবার মার্ক্সীয় দর্শন দ্বন্দ্বতত্ত্ব সমাজতত্ত্ব ইতিহাস ব্যাখ্যা ইত্যাদি নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাননি। তাঁরা সরাসরি মার্ক্সের অর্থনৈতিক তত্ত্বকে সমালোচনা করেছেন, মুল্যের শ্রম-তত্ত্বকে আক্রমণ করেছেন, পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ড আর তৃতীয় খণ্ডের প্রতিপাদ্যের মধ্যে পরস্পর-বিরোধিতা আবিষ্কার করেছেন, এবং এইভাবে মার্ক্সের অর্থনৈতিক তত্ত্বকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করে গেছেন।
শ্রীরায় এরকম স্পষ্ট ভাষায় না বললেও তাঁর সমগ্র লেখা পড়ে মনে হল, তিনি মার্ক্সীয় দর্শন থেকে শুরু করে তার ইতিহাস বিশ্লেষণ এবং আর্থসামাজিক ব্যাখ্যা—এক কথায় সব কিছুকেই ভ্রান্ত সাব্যস্ত করতে চান। যদি আমার এভাবে মনে করে নেওয়াটা ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে আমি তাঁর প্রবন্ধ থেকে তাঁর প্রধান প্রতিপাদ্য সিদ্ধান্তগুলিকে এইভাবে সাজিয়ে নিতে পারি:

(১) মার্ক্সের দ্বন্দ্বতত্ত্ব ভুল; মার্ক্স নাকি নিজেও বলেছেন, সাম্যবাদী সমাজে দ্বন্দ্ব থাকবে না;

(২) মার্ক্স ইতিহাসের গতিধারা বিশ্লেষণ করে সমাজবিপ্লব সম্পর্কে যা যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তার একটাও বাস্তব তথ্যের সাথে মেলেনি। সমাজতন্ত্র থেকে সাম্যবাদী সমাজের দিকে অগ্রসর হওয়ার বদলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাই ভেঙেচুরে গেছে;

(৩) মার্ক্স পুঁজিবাদের সম্পর্কে যা কিছু বলে বা ভেবেছিলেন তাও বর্তমানকালে ভুল প্রমাণিত হয়েছে; শ্রমিক শ্রেণির চরিত্র বা সংগঠন বদলে গেছে, ইত্যাদি;

(৪) উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাত করে পুঁজিপতিদের মুনাফা লাভ করার মার্ক্সীয় তত্ত্ব বাস্তব দুনিয়ার হালহকিকত নাকি ভ্রান্ত সাব্যস্ত করেছে; মূল্যের শ্রমতত্ত্ব অনেক দিন আগেই ভুল প্রমাণিত;

(৫) মার্ক্সের মতবাদ কার্ল পপারের অপ্রতিপাদনীয়তার নিয়মকে অগ্রাহ্য করে; সেই অর্থে মার্ক্সবাদকে আর কোনোমতেই বৈজ্ঞানিক মতাদর্শ হিসাবে মেনে নেওয়া যায় না; ইত্যাদি; ইত্যাদি।

এইভাবে দেখলে মনে হয়, মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে এযাবত যা কিছু অভিযোগ তোলা হয়েছে, যা যা সমালোচনা করা হয়েছে, রায় তার সব কিছুকেই স্বীকার করে নিয়েছেন এবং সঠিক বলে মেনে নিয়েছেন। তার ভিত্তিতে তিনি ধরে নিয়েছেন, এত সব খণ্ডন ও সমালোচনার পরেও যাঁরা মার্ক্সবাদ মেনে চলেন বা মার্ক্সবাদকে একটা বৈজ্ঞানিক মতাদর্শ হিসাবে স্বীকার করেন তাঁরা একটা ধর্মীয় অন্ধ বিশ্বাসের মতো করেই মার্ক্সবাদকে দেখেন। তিনি চেষ্টা করছেন তাঁদের ঘুম ভাঙানোর, তাঁদের মধ্যে যুক্তিবোধ জাগ্রত করার।
আমি এই নিবন্ধে অভিজিৎ বাবুর বক্তব্যের প্রথমটি বাদ দিয়ে বাকি চারটি বিন্দুর সমালোচনাকে বিচার বিশ্লেষণ করে আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি অনুযায়ী মার্ক্সবাদের সপক্ষে কিছু কথা বলতে চাই। আশা করি, রায় সেগুলোও বিবেচনা করে দেখবেন। প্রথমটি, অর্থাৎ, দর্শনের প্রসঙ্গটি নিয়ে আলাদাভাবে বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে। অন্য কোনো খানে।

পপারের কষ্টিপাথর
আমি আমার কথার সূচনা করতে চাই কার্ল পপারের বিখ্যাত বৈচারিক মাপকাঠির কথা সামনে রেখেই। পপার যে কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বিচার প্রসঙ্গে একটি মাপকাঠি প্রয়োগের কথা বলেছিলেন, যা বিজ্ঞানের ইতিহাসে অপ্রতিপাদনীয়তার নিয়ম (falsifiability criterion) হিসাবে খ্যাত। পপার ১৯৩৪ সালে তাঁর জার্মান ভাষায় রচিত বিখ্যাত বই, ইংরেজি অনুবাদে যেটি এখন সারা পৃথিবীতে সুপরিচিত (The Logic of Scientific Discovery), তাতে এই নিয়মটিকে তুলে ধরেন।
এর পেছনে একটা লম্বা ইতিহাস আছে যেটিও এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা দরকার। বিজ্ঞানের দর্শনে যা অভিজ্ঞতাবাদ (empiricism) বা পরবর্তীকালে প্রত্যক্ষবাদ (positivism) নামে খ্যাত, তার তরফে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বিচারের জন্য প্রদত্ত মাপকাঠিটি ছিল প্রতিপন্নতা (verifiability)। পপার এতে আপত্তি তুললেন। বললেন, একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যতগুলো পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষার ফলাফলের দ্বারাই সঠিক প্রতিপন্ন হোক না কেন, যদি একটা কোনো পর্যবেক্ষণ বা ফলের দ্বারাও অপ্রতিপন্ন হয়, তা তৎক্ষণাৎ ভ্রান্ত প্রমাণিত হবে। সুতরাং কতবার প্রতিপন্ন হয়েছে তার থেকেও বড় প্রশ্ন হল এ পর্যন্ত তাকে ভুল প্রমাণ করার মতো কিছু পাওয়া গেছে কিনা। যতক্ষণ তা না পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণই তাকে সঠিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসাবে মেনে চলতে হবে। এইভাবে, প্রতিপন্ন হওয়ার চেয়েও অপ্রতিপন্ন না হওয়ার উপরেই তিনি বিজ্ঞানের তত্ত্বকে গ্রহণ করার ভিত্তি করতে চেয়েছেন। এটুকু বলেই পপার থামেননি। তাঁর মতে, বিজ্ঞানীকেই তাঁর তত্ত্বের ভিত্তিতে বলতে হবে, কী কী পর্যবেক্ষণ বা ফল পেলে তাঁর প্রদত্ত তত্ত্ব ভ্রান্ত সাব্যস্ত হবে। এই একই বিষয়কে তিনি আবার একটু অন্যভাবেও রাখলেন। যে কোনো তত্ত্বকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মর্যাদা পেতে হলে তার ভিত্তিতে এমন কিছু সিদ্ধান্তের কথা বলতে হবে যা পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব, বা পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা সম্ভব। পরীক্ষার ফল এবং/অথবা পর্যবেক্ষণের সাথে পুর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত না মিললে তত্ত্বটিকে বর্জন করে নতুন তত্ত্বের সন্ধান করতে হবে। আধুনিক বিজ্ঞানের দর্শনে পপারের এটি একটি অত্যন্ত মূল্যবান অবদান। পপার মার্ক্সবাদ বিরোধী বলে অধিকাংশ মার্ক্সবাদীও সাধারণত তাঁর এই অবদানের স্বীকৃতি দিতে চান না।
কিন্তু এর পর আরও কিছু কথা আছে। পপারের এই অপ্রতিপাদনীয়তার নিয়মকে মেনে নেবার মানে এটা নয় যে প্রতিটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে প্রাপ্য মর্যাদা পাওয়ার জন্য নিজেকে আগে ভ্রান্ত প্রমাণ করতে হবে। কিংবা এটাও নয় যে, যে সমস্ত তত্ত্ব এযাবত ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে সেগুলিই একমাত্র বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব; আর যেগুলি এখনও অবধি ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হয়নি বা যাদেরকে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করা যায়নি সেগুলি বিজ্ঞানে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। পপার শিশুও ছিলেন না, অপরিণত-মস্তিষ্কও ছিলেন না যে তাঁর নীতিটির এরকম একটা আজগুবি তাৎপর্য দাঁড় করাবেন। আর তার চেষ্টা করলে তাঁর এই নীতিটি বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীদের উৎসাহিতও করতে পারত না।
পপারের মার্ক্সবাদ বিরোধী যুক্তিগুলি আমি এখানে আলোচনা করব না। করতে হলে প্রবন্ধ অনেক বড় হয়ে যাবে এবং মূল লক্ষ্য থেকে সরে যেতে থাকবে। পরে অন্য কোনো সুযোগে তা করা যাবে। আপাতত আমার বিচার্য, মার্ক্সবাদ পপারের এই নিয়মকে অস্বীকার করে, না মেনে চলে।
কিন্তু তার আগে বুঝে নেওয়া দরকার, মার্ক্সীয় তত্ত্বের মৌলিক সিদ্ধান্ত বলতে কী বোঝায়। মার্ক্স এবং এঙ্গেল্‌স আশা করেছিলেন, শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে, তথা ইংলন্ড ফ্রান্স জার্মেনি হল্যান্ডে আগে শ্রমিক বিপ্লব হবে। বিপ্লব আগে হল রাশিয়ায়। তারপর মঙ্গোলিয়ায়, চিনে, ভিয়েতনামে। পপারীয় মাপকাঠিতে কি মার্ক্সবাদ ভ্রান্ত সাব্যস্ত হল?
না। হল না। কারণ, ওটা মার্ক্সবাদের একটা কোনো তাত্ত্বিক বা মৌলিক সিদ্ধান্ত নয়। ওটা ছিল মার্ক্স এবং এঙ্গেল্‌সের একটা তাৎক্ষণিক ধারণা, ইউরোপের সমসাময়িক ঘটনাবলির একটা অধিপাঠ (reading), বড় জোর একটা উপসিদ্ধান্ত। অনেকটা আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সেই কুখ্যাত ল্যাম্বডার মতো।
তাহলে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে মার্ক্সীয় মতবাদের তত্ত্বগত মৌলিক সিদ্ধান্ত বলতে কী বোঝায়? উদাহরণ হিসাবে নীচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিন্দু উল্লেখ করছি (সংক্ষেপে উপস্থাপন করার জন্য স্বভাবতই এই বিবৃতিগুলিকে সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না বলে শ্রীরায় এবং পাঠকদের কাছে আগাম মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি):

ক) উৎপাদিকা শক্তি আর উৎপাদন সম্পর্কের নিরন্তর দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে মানব সমাজের বিকাশ বিবর্তন স্থিতি ও বিপ্লব ঘটে চলেছে। যতক্ষণ একটা সমাজ কাঠামো তার অভ্যন্তরস্থ উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সাথে উৎপাদন সম্পর্কের সামঞ্জস্য বজায় রাখতে পারে, সেই সমাজ বিকশিত হতে থাকে ও স্থায়িত্ব লাভ করে। যখন এই সামঞ্জস্য ভেঙে যায়, সেই সমাজের স্থায়িত্বও নষ্ট হতে থাকে, তার মধ্যে তখন নতুন সমাজ কাঠামো গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই নতুনের সাথে পুরাতনের দ্বন্দ্ব সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে একটা সময় সেই সমাজ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে পালটে যায়।

খ) ব্যক্তি সম্পত্তির উদ্ভব এবং সমাজ শ্রেণি বিভক্ত হওয়ার পর থেকে এই দ্বন্দ্ব শ্রেণি সংগ্রামের রূপে প্রকাশিত হতে থাকে। রাষ্ট্র গড়ে ওঠে শাসক শ্রেণির শাসনের প্রধান হাতিয়ার হিসাবে। সেদিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সমস্ত ধরনের রাষ্ট্রই এক শ্রেণির দ্বারা অন্যান্য শ্রেণির উপর দমন পীড়নের যন্ত্র। কোনো রাষ্ট্রই শ্রেণী-নিরপেক্ষ শাসন যন্ত্র নয়। সমাজ পরিবর্তন প্রথমত এবং প্রধানত এই রাষ্ট্রচরিত্রের পরিবর্তন, বা আরও সঠিক ভাবে বলতে গেলে, এক শ্রেণির বিশেষ ধরনের রাষ্ট্রের পরিবর্তে অন্য শ্রেণির অন্য ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা।

গ) যে কোনো একটা সমাজব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি বুঝতে হলে তার দুটো অংশকে চিহ্নিত করতে হবে (অনেকটা যেন তার শারীরসংস্থা এবং শারীরবৃত্ত): উৎপাদন সম্পর্কের নিরিখে তার অর্থনৈতিক ভিত এবং সেই ভিতের আধারে নির্মিত তার উপরকাঠামো। দাস-মালিক সমাজের উপরকাঠামোর সাথে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের উপরকাঠামো মিলবে না; রাজা-প্রজা ভিত্তিক সামন্তী সমাজের উপরকাঠামোর সঙ্গেও তেমনই পুঁজিতন্ত্রের সামাজিক সংগঠন এক রকম হবে না।

ঘ) উৎপাদন চক্রে বাড়তি মূল্য কোত্থেকে আসছে—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে জানতে হবে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিজড়িত উপাদানগুলির মধ্যে এমন কী আছে যা উৎপন্ন দ্রব্যে নিজের মূল্যের তুলনায় কিছু বাড়তি মূল্য যোগ করতে পারে। এই প্রশ্নের সমাধান করতে গিয়েই অ্যাডাম স্মিথ ডেভিড রিকার্ডো প্রমুখ বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ মূল্যের শ্রম তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। এটা না বুঝলে শুধু পুঁজিবাদের বর্তমান স্তর নয়, সওদাগরি পুঁজির বিকাশও ব্যাখ্যা করা যায় না। মার্ক্স এই তত্ত্বকেই আরও বিকশিত করে পুঁজিপতিদের শোষণ ও মুনাফার ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সমাজতন্ত্রেও বর্ধিত পুনরুৎপাদনের সমস্যা ব্যাখ্যা করেছিলেন।
ইত্যাদি ইত্যাদি …।

এই সব জায়গায় পপারের সূত্র কাজে লাগানো যাক। দেখা যাক, মার্ক্সবাদ অপ্রতিপাদনীয়তার নিয়ম মেনে চলে কিনা। সতর্ক পাঠক মাত্রই লক্ষ করবেন, উপরের প্রতিটি বিবৃতি অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট। এর কোনোটার মধ্যেই “এ-ও হয় ও-ও হয়” জাতীয় অস্পষ্টতার কোনো সুযোগ নেই। প্রত্যেকটি সিদ্ধান্তকেই চলমান গবেষণায় প্রাপ্ত নিত্য নতুন তথ্যের আলোকে যাচাই করে নেওয়া সম্ভব। প্রতিটি সিদ্ধান্তকেই ব্যতিক্রান্ত তথ্যের দ্বারা বাতিল করা সম্ভব। সে চেষ্টা যে হয়নি বা হচ্ছে না তাও নয়। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত, এই রকম কোনো চেষ্টাই এখন অবধি সুফলপ্রসু হয়নি। হয়নি যে, তার দোষ তো আর মার্ক্সবাদের নয়। আর, আগেই বলেছি, ভুল প্রমাণিত হয়নি বলে বৈজ্ঞানিক চিন্তা বলা যাবে না—এরকম ধারণা পপারীয় সূত্রে নেই এবং থাকতেও পারে না।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
উপরে প্রদত্ত প্রথম সিদ্ধান্তকে নিয়ে বিচার করে দেখা যাক। মার্ক্স এঙ্গেল্‌স একভাবে সমাজ বিবর্তন ব্যাখ্যা করে তাঁদের এই তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন। এখন যদি দেখা যায়, (α) কোনো একটা পর্যায়ে উৎপাদিকা শক্তির উল্লেখযোগ্য বিকাশ হয়েছে, কিন্তু সমাজ কাঠামোর কোনো আনুষঙ্গিক পরিবর্তন হয়নি; কিংবা, বিপরীতক্রমে, (β) সমাজ কাঠামোয় যথেষ্ট বিবর্তন ঘটে গেছে, কিন্তু উৎপাদিকা শক্তি কম-বেশি একই জায়গায় আছে—তৎক্ষণাৎ মার্ক্সবাদের একটা প্রধান থিসিস বাতিলযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়ে যাবে। ঊনবিংশ শতাব্দের তুলনায় বিংশ শতাব্দে পুরাতত্ত্ব অনেকখানি বিকশিত হয়। মাটির নীচে খোঁড়াখুড়ি করে প্রাচীন ইতিহাসের অনেক কিছু তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ ল্যুইস হেনরি মর্গ্যানের গবেষণার ভিত্তিতে এঙ্গেল্‌স তাঁর সময়ে আদিম সাম্যবাদী গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজকে যে দুটি প্রধান পর্যায়ে ভাগ করেছিলেন, যার প্রত্যেকটির আবার তিনটি করে উপস্তর ছিল বলে তিনি দেখিয়েছিলেন, পুরাতাত্ত্বিক গবেষণার আলোকে বর্তমানে সেগুলি প্রায় নিখুঁতভাবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক পর্যায়ে সুনির্দিষ্টভাবে ভাগ করে ফেলা সম্ভব হয়েছে। এই কাজ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে: পুরাতত্ত্ববিদ এবং ঐতিহাসিকদেরও আজ মানবসমাজের প্রাচীন পর্যায়গুলিকে সেই উৎপাদনের হাতিয়ারগুলির বিকাশের মাপকাঠিতেই চিহ্নিত করতে হচ্ছে। মর্গ্যান বা এঙ্গেল্‌স যাকে অসভ্য পর্যায় বলেছিলেন, আজ পুরাতাত্ত্বিকরা তাকেই বলছেন পুরা প্রস্তর যুগ। ওঁরা যাকে বলেছেন বর্বর পর্যায়, আজ তাকেই বলা হচ্ছে নবপলীয় যুগ। আর সভ্যতার বিকাশের সন্ধিক্ষণকে চিহ্নিত করা হচ্ছে ধাতু যুগের উন্মেষ কাল হিসাবে। আরও কিছু দূর এগিয়ে নগর সংস্কৃতির বিকাশ আর ব্রোঞ্জ যুগ মিলেমিশে আছে। তেমনভাবেই মিলে গেছে শ্রেণিবিভাজনের সূচনার সঙ্গে লৌহ যুগের আবির্ভাব। সমাজ সংগঠনের অগ্রগতি এবং উৎপাদনের হাতিয়ারের বিকাশ একেবারে যেন হাত ধরাধরি করে সমান্তরালভাবে চলেছে।

অন্যগুলোকেও এই ভাবে এক এক করে যাচাই করে নেওয়া যেতে পারে।
এছাড়া সমাজবিজ্ঞানে যে কোনো পূর্বাভাসের বাস্তবে মেলা না মেলার ব্যাপারে বোঝা দরকার, এখানে কোনো কিছুই অঙ্কের মতো নিখুঁত হিসাব নিকাশ করে বলা সম্ভব নয়। তার মধ্যে বিপ্লব একটা অত্যন্ত বড় মাপের পরিঘটনা। ১৮৫০-৬০-এর দশকে রাজনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে মার্ক্স বা এঙ্গেল্‌সের যা মনে হয়েছিল তাঁরা বলেছিলেন। পরবর্তী পরিস্থিতির কিছু সহরাশি (parameter) সামান্য এদিক ওদিক হয়ে যাওয়ার কারণেই হয়ত তাঁদের সেই সব অনুমান বাস্তবায়িত হয়নি। এতে তাঁদের তত্ত্বের কোনো ভুল ধরা পড়ে না। বড় জোর কেউ বিচার করে দেখতে পারেন, তাঁরা পরিস্থিতির মূল্যায়ন সঠিকভাবে করতে পেরেছিলেন কিনা। বা কোন কোন সহরাশির পরিবর্তনের ফলে সেই পূর্বাভাস মেলেনি।

আরও ভাবুন, টস করার সময় যিনি বলেন হেড পড়বে, যদি টেল পড়ে তাতে কি তাঁর বলার মধ্যে কোনো ভুল হয়েছিল বলে বলা যায়? কিংবা মনে করুন, সকালে আকাশে ঘন কালো মেঘের সমাবেশ দেখে আপনি বললেন, আজ মনে হচ্ছে ভারি বৃষ্টি হবে। আপনার মনে মেঘ-বৃষ্টির কার্যকারণ সম্পর্ক নিশ্চয়ই কাজ করেছিল। আর তারপর বেলার দিকে হাওয়া এসে মেঘ ভাসিয়ে নিয়ে গেল, ঝলমলে রোদ উঠল, বৃষ্টি আর হল না। এতে কি আপনার ভেবে রাখা বৃষ্টি-সংক্রান্ত তত্ত্বটা ভুল প্রমাণিত হল? এই ধরনের পূর্বানুমান অহরহ লোকে করছে আর তা মিলছে না। তাতে কোনো তত্ত্বের কিছু যায় আসে না। তত্ত্বটাকে তত্ত্বের জায়গায় গিয়েই বিচার করতে হয়। বিজ্ঞানের অন্য সব ক্ষেত্রে আমরা এটা মনে রাখতে পারি। শুধু মার্ক্সবাদের বেলাতেই কেন যেন এই কথাটা মনে থাকে না।

পরিশেষে লেখককে আধুনিক গবেষণার আরও একটি ধারার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। তিনি পপারের কথা বলেছেন। বিজ্ঞানের দর্শনের আলোচনা এবং মার্ক্সবাদের পর্যালোচনা তো আর পপারেই থেমে নেই। তারপরে তা আরও এগিয়েছে। সেই তথ্যও পাঠকদের জানানো উচিত। যেমন, ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর মাইকেল বুরাওয় ঠিক এই আলোচ্য প্রসঙ্গেই ১৯৯০ সালে যে মূল্যবান গবেষণা পত্রটি লিখেছিলেন, সেটি তাঁকে পড়তে অনুরোধ করি। [Michael Burawoy, “Marxism as Science: historical challenges and theoretical growth”; American Sociological review, Vol. 55 (December 1990), pp. 775-93; অন-লাইন পাওয়া যায়] প্রফেসর বুরাওয়ের বাইরে যথেষ্ট নামডাক না থাকলেও তাঁর বায়োডাটা বলে দিচ্ছে ভদ্রলোক নিতান্ত উপেক্ষণীয় নন। মার্ক্সবাদী চিন্তার আলোকে সমাজতত্ত্ব চর্চা ও গবেষণা করেন বলেই হয়ত তাঁর সেরকম প্রচার হয়নি। বিশ্বের মার্ক্সবাদীদেরও তাঁর এই প্রবন্ধ থেকে কিছু শেখার আছে। তাঁদেরও উচিত এই ভদ্রলোকের রচনার সাথে নিজেদের পরিচিত হওয়া এবং অন্যদের পরিচিত করানো।

কয়েকটি খণ্ডন প্রচেষ্টার ফলাফল
অভিজিৎ রায় কিছু কিছু ভুল প্রমাণের উল্লেখ করেছেন তাঁর প্রবন্ধে। এবার এখানে সে সম্বন্ধে দু-চার কথা আলোচনা করা প্রয়োজন। লেখকের দেওয়া দু-একটি উদাহরণ তুলে ধরে বিচার করে দেখা যাক, কোন কোন প্রশ্নে মার্ক্সবাদকে ভুল সাব্যস্ত করার চেষ্টা হয়েছে এবং তা কতদূর ফলপ্রসু হয়েছে।

যেমন, কলকাতার সমাজতাত্ত্বিক ডঃ রামকৃষ্ণ মুখার্জীর গবেষণার উল্লেখ করে অভিজিৎবাবু বলেছেন, আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক শ্রেণির সংখ্যা বৃদ্ধির পরিবর্তে মানসিক শ্রমদাতার সংখ্যা বাড়ছে এবং তারা এক ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম দিচ্ছে। শ্রমিকরাও এখন কর্পোরেট সংস্থার স্টক কিনে শেয়ার হোল্ডার হচ্ছে, ডিভিডেন্ড পাচ্ছে। এর দ্বারা মার্ক্সের কথিত পুঁজিপতি ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে আয় বৈষম্য বৃদ্ধির ধারণা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে এবং পুঁজিবাদও ধ্বংসের বদলে আরও সুস্থিতি অর্জন করছে।
আপাতত এই বিবরণ সত্য বলে ধরে নিয়েই কয়েকটা প্রশ্ন উত্থাপন এবং তার উত্তর পাশাপাশি নথিভুক্ত করা যাক:

শ্রমিক মালিক উৎপাদন সম্পর্ক কি মার্ক্স-উত্তর বিগত একশ তিরিশ বছরে এতে পালটে গেছে? — না। তা যায়নি।

পুঁজিবাদের সর্দার রাষ্ট্র মার্কিন মুলুকে সর্বোচ্চ এবং নিম্নতম আয়কারীর মধ্যে কি এর ফলে বৈষম্য কমে আসছে? না। বরং ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক হিসাবনিকাশ করে জানাচ্ছেন, আমেরিকান অর্থনীতিতে এই আয়-বৈষম্য ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে: “The income gap between the richest 1 percent of Americans and the rest of the country widened to a record level, a university analysis of tax filings indicates. The incomes of the top 1 percent increased 19.6 percent in 2012—accounting for 19.3 percent of total household income, breaking a 1927 record—while the bottom 99 percent incomes grew only 1 percent, Emmanuel Saez of the University of California, Berkeley, said in the “Striking it Richer: The Evolution of Top Incomes in the United States” analysis. “In sum, top 1 percent incomes are close to full recovery while bottom 99 percent incomes have hardly started to recover,” Saez said. His analysis, which he did in conjunction with the Paris School of Economics and Oxford University, is based on Internal Revenue Service data.”
[বিশদে দেখুন এখানে ]

বিষয়টিকে শুধু মাত্র গত বছরের আকস্মিক ঘটনা বলে মনে করার কারণ নেই। দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতাও এই একই পরিঘটনা তুলে ধরছে: “For starters, between 1993 and 2012, the real incomes of the 1% grew 86.1%, while those of the 99% grew 6.6%, …”
সুতরাং মার্ক্সীয় সিদ্ধান্তের কোনো ব্যত্যয় এখানে দেখা যাচ্ছে কি? — না।

কিংবা, এই প্রবণতা শুধু আমেরিকারও নয়। সমাজতন্ত্র পরিত্যাগ করে পুঁজিবাদী রাস্তায় চলতে গিয়ে আজ চিনেও সর্বোচ্চ সম্পত্তিবান পাঁচ শতাংশ পরিবারের হাতে মোট জাতীয় সম্পদের শতকরা ২৩ ভাগ জমা পড়ছে, আর সর্বনিম্ন পাঁচ শতাংশ পরিবারের হাতে আছে মাত্র ০.১ শতাংশ সম্পদ। তাহলে মার্ক্সবাদকে কি ভুল প্রমাণ করা গেল?

(৪) প্রশান্ত মহাসাগরের দুই পাড়ে দাঁড়িয়ে না থেকে এবার একটু বিশ্ব ভ্রমণ করে আসা যাক: ও-ই-সি-ডি অন্তর্ভুক্ত বাইশটি দেশের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন পরিবারগুলির আয় বৈষম্য পঁচিশ বছর আগেকার সাত গুণ থেকে বেড়ে ২০১১ সালে দশ গুণ হয়েছে। জার্মানি ডেনমার্ক সুইডেন ইত্যাদি দেশেও মোটামুটি একই সময়ে এই পার্থক্য পাঁচ গুণ থেকে বেড়ে ছয় গুণ হয়েছে। সারা বিশ্বকে ধরলে মাত্র এক শতাংশ মহোচ্চ-ধনী পরিবারের হাতে রয়েছে ৪০ শতাংশ সম্পদ; পৃথিবীর মাত্র তিনজন মহোচ্চ ধনবান ব্যক্তির হাতে যে বিপুল সম্পত্তি জমা আছে তার পরিমাণ গরিবতম ৪৮টি দেশের মোট জাতীয় সম্পদের চেয়েও বেশি। (তথ্য সূত্রঃ উইকিপিডিয়া; মূল উৎসগুলি সেখানে ঢুকে দেখলেই পাওয়া যাবে)

এই তথ্যগুলি দেখাচ্ছে, ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির সাংগঠনিক পরিকাঠামো ও ব্যবস্থাপনায় যতই পরিবর্তন হয়ে থাকুক না কেন, তা মার্ক্স বর্ণিত শ্রেণি-বৈষম্যের ছবিকে বদলে দিতে পারেনি। বরং দুই স্তরের মধ্যে আপেক্ষিক বৈষম্য অনেক গুণ বেড়ে গেছে। আর একথা তো সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায় যে আপেক্ষিক পার্থক্য এত ব্যাপকভাবে বেড়ে গেলে সরল পারিসংখ্যানিক নিয়মেই তার মধ্যে জনগণের একটা অংশের ক্ষেত্রে পরম পার্থক্যও বৃদ্ধি পায়। এই সব কথা অস্বীকার করলে মার্ক্সবাদীদের মার্ক্সভক্তির তুলনায় সমালোচকের ধনতন্ত্রভক্তির মধ্যেই বরং ধর্মীয় অন্ধতার লক্ষণ বেশি করে চোখে পড়বে।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের কথা ধরুন। প্রতিটি কারখানার পেছনে আছে বৃহৎ পুঁজি—আধুনিক ভাষায় যাদের পরিচয় কর্পোরেট সংস্থা। তারা যে কী বিপুল মুনাফা উপার্জন করছে এই সব শিল্প সংস্থা থেকে তা নিশ্চয়ই আমার অভিজিৎবাবুকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না। ১৯৭৮ সালে দুটি কারখানা ১২০০০ ডলার পণ্য রপ্তানি করে যে শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল আজ তা ৫৮০০ কারখানায় ২১০০,০০,০০,০০০ ডলার পণ্য রপ্তানি করে। বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে ২৬টি দেশের মধ্যে (চিনের পরেই) দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও পোশাক শ্রমিকদের মজুরিতে পৃথিবীর সর্বনিম্ন স্থানে পড়ে রয়েছে। মাথাপিছু মাসিক মজুরি ৩৭-৫০ ডলার (৩০০০ টাকা) ধরলে বিশ্বের মাপকাঠিতে দারিদ্র্য সীমার আশেপাশেই তাদের অবস্থান। তারা পোশাক উৎপাদনে ৩১ শতাংশ মূল্য সংযোজন করে নিজেরা পায় ৭ শতাংশ। আরও মনে রাখবেন, ১৯৭৮ সালে এদের মজুরি ছিল ৪৫০ টাকা, ২০০৬-এর আগে পর্যন্ত ছিল ৯৩০ টাকা, ২০০৬-এ হয় ১৬৬২ টাকা এবং ২০১০ সাল থেকে ৩০০০ টাকা মজুরি বহাল রয়েছে।
[ভ্যানগার্ড; বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-এর মুখপত্র; ১৩ অক্টোবর ২০১৩; এবং কমরেড সুব্রত সরকারের সৌজন্যে প্রাপ্ত তথ্য; মূল উৎস, বাংলাদেশ মজুরি বোর্ড-এর আকাশপত্র]

এই সব দেখার পরেও পুঁজিবাদের স্বভাব বদলে গেছে বলবেন? এই ক্ষেত্রে মার্ক্সবাদের বক্তব্য কি ভুল মনে হচ্ছে? পুঁজিপতিদের লাভের হার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকরা হাতে এত পয়সা পাচ্ছে যে তারা মধ্যবিত্ত হয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে? শুধু প্রদীপকেই দেখছেন, কবিগুরু বলার পরেও তার নীচের পিলসুজকে দেখবেন না বলে ঠিক করেছেন?

তথ্য প্রযুক্তি উপভাগের কথাই ধরা যাক। সেখানে কি কায়িক শ্রমের বদলে মানসিক শ্রম দিয়ে কাজ হচ্ছে? ডঃ মুখার্জী কোথায় কাদের নিয়ে গবেষণা করেছেন আমার খুব ভালো করে জানা নেই। তবে এটুকু বলতে পারি, তিনি এই উপভাগের ভেতরে ঢুকে সেখানকার কর্মচারীদের সঙ্গে মেলামেশা করে কথাবার্তা বলে তাঁর উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন কিনা তাতে আমার সন্দেহ আছে। প্রথাগত অর্থে গবেষণা না করলেও আমার এদের অনেকের সাথে আলাপ পরিচয় আছে। এই উপভাগে মোটা অর্থে দুই ধরনের লোক কাজ করে। একদল করে পরিদর্শনের কাজ, অন্যদের কাজ ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা দেখাই তাদের নিজেদের কাজ। সেই অর্থে তাদের কাজের চরিত্র মূলত মানসিক শ্রম ভিত্তিক। কিন্তু আর এক দল, যারা আট-দশ ঘন্টা টেবিলে বসে কাজ করে, কম্পিউটার-ইন্টারনেটের সাহায্যে, তাদের কাজটা কোনোমতেই মানসিক নয়, প্রবলভাবে শারীরিক পরিশ্রমের কাজ, সেই সাথে সমপ্রবলভাবে মানসিক শ্রমযুক্ত কাজ। এদের অনেকে সারাদিনে একবারও প্রস্রাবখানায় যেতে পারে না, বাড়ি থেকে যে টিফিন নিয়ে যায় তা খাওয়ার সময় পায় না, এই পরিস্থিতির মধ্যে এদের কাজ করতে হয়। তার মধ্যে, প্রভু দেশ (আমেরিকা) রাত জাগবে না বলে এদের অধিকাংশকে কাজ করতে হয় রাতের বেলা, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। দিনে এরা ঘুমিয়ে কাটায়, সামাজিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। দেশি কলকারখানায় যে শিফট প্রথা চালু আছে এখানে তার কোনো সুযোগ নেই। একে যদি অভিজিৎবাবু বলেন পুঁজিবাদী সমাজের মার্ক্সেতর বিকাশের লক্ষণ, এবং এই শ্রমিকরা উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটাচ্ছে, তাহলে আমাদের আবার সমাজ দর্শনের অ আ ক খ থেকে আলোচনা শুরু করতে হবে।

মেরুকরণ বনাম মধ্যবিত্ত

অভিজিৎ রায় আরও অনেকের মতোই মনে করেন, মার্ক্স–এঙ্গেল্‌স কথিত সমাজের জনগোষ্ঠীর মালিক ও শ্রমিক এই দুই শ্রেণিতে ক্রমবর্ধমান মেরুকরণের বদলে এক বিরাট সংখ্যক মধ্যবর্তী মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটেছে। মার্ক্স–এঙ্গেল্‌সরা নাকি মনে করেছিলেন, তাঁদের এই আভাসিত মেরুকরণ ও তার ফলস্বরূপ সম্পদ বন্টনে ব্যাপক বৈষম্যের কারণে শোষণের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে, শ্রমিক শ্রেণির দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে, সমাজে অচিরেই এক বৈপ্লবিক অস্থিরতার সৃষ্টি হবে এবং তার ধাক্কায় একটার পর একটা পুঁজিবাদী সমাজ ভেঙে পড়বে। এর কোনোটাই ঘটেনি। ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিও ভেঙে পড়েনি। পপারের সূত্রে তিনিও দাবি করেছেন, এই দেখুন, মার্ক্সবাদ একদিন তার তত্ত্বের ভিত্তিতে যে পূর্বাভাস দিয়েছিল তা আজ ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে আজ অবধি বিপ্লব হয়নি, ভবিষ্যতে হবে বলে মনেও হচ্ছে না। অথচ মার্ক্সবাদীরা এটা মানতে চাইছে না। তারা বেদ বাইবেল কোরাণের মতো করে এখনও মার্ক্সের সেই সব বস্তা পচা রচনাকে ধ্রুব সত্য জ্ঞানে আঁকড়ে ধরে বসে আছে।
কথাটা সত্যিই ভেবে দেখার মতো। বললাম এক, হল আর এক রকম; তারপরেও কীভাবে বলব, আগের কথাটা ঠিক আছে? আমিও মনে করি, এমনটা ঘটে থাকলে সত্যিই মার্ক্সবাদ ভ্রান্ত সাব্যস্ত হয়ে গেছে। তাই প্রথমেই দেখা দরকার, মার্ক্স এঙ্গেল্‌স সত্যিই এমনটা বলেছিলেন কিনা।

মার্ক্স পুঁজিবাদকে নিয়ে চুলচেরা অতি-বিশদ বিচার বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর ‘পুঁজি’ নামক গ্রন্থে। সেও এক মহাগ্রন্থ, যার মোট ছয়টি খণ্ড। প্রথম তিনটি খণ্ড ‘ক্যাপিট্যাল’ নামে সুপরিচিত, পরের তিনটি খণ্ড ‘থিওরিজ অফ সারপ্লাস ভ্যাল্যু’ (একত্রে ‘পুঁজি’ গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ড) নামে স্বল্প পরিচিত। সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার পৃষ্ঠার সুবিশাল বই। এর পাশাপাশি আছে পুঁজি গ্রন্থ লেখার আগে মার্ক্সের প্রায় হাজার দু-এক পৃষ্ঠার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, যা অনেক পরে গ্রুন্ডরিসে (Grundrisse) নামে (জার্মান ভাষায় ১৯৩৯-৪১ সালে ও ইংরেজিতে ১৯৭৩ সালে) প্রকাশিত হয়েছে। এর সবটাই পড়ে ফেলেছি বলে সততার সাথে দাবি করতে পারব না, তবে অনেকটাই পড়ে নিয়েছি। যতটা পড়তে পেরেছি তার সবকিছুই অবিকল মনে আছে এই দাবিও করছি না। তথাপি অনেক দিন ধরে মার্ক্সবাদ নিয়ে তত্ত্বগত চর্চার মধ্যে থাকার ফলে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলি এখনও মনে আছে বলেই আমার ধারণা। আমি কিন্তু মনে করতে পারছি না, মার্ক্স এই সব গ্রন্থের ঠিক কোথায় তাঁর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে শ্রেণী-মেরুকরণ থেকে তক্ষুনি বিপ্লবের দাবি করেছেন। আমাকে যদি শ্রীরায় দেখাতে পারেন আমি সত্যিই বাধিত হব।

তবে কি মার্ক্স বা এঙ্গেল্‌স এরকম কথা কোথাও বলেননি? কার্ল পপার থেকে শুরু করে অভিজিৎ রায় পর্যন্ত সব্বাই স্রেফ মিথ্যে কথা বলছেন?
না, তাও নয়। বলেছেন। মার্ক্স এঙ্গেল্‌সরা ওই কথাগুলি বলেছেন ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’তে।

কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো কি মার্ক্সবাদের কোনো তাত্ত্বিক রচনা?
একেবারেই নয়। এমনকি মার্ক্স এঙ্গেল্‌সরা নিজেরাই এক সময় স্বীকার করেছেন, ওই বইতে অন্তত দু-তিনটি জায়গায় কিছু বড় রকমের তত্ত্বগত গলদ আছে। শ্রেণির উৎপত্তির প্রশ্নে ভুল আছে, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রশ্নে (অর্থাৎ, বিপ্লবের সবচেয়ে মৌল প্রশ্নে) ভুল আছে, ইত্যাদি। ১৮৮২ সালের একটি ভূমিকায় এঙ্গেল্‌স বলছেন, ইউরোপের বিপ্লবের কেন্দ্র রাশিয়ায় সরে যাচ্ছে। আকর্ষণীয় ঘটনা হচ্ছে, যাঁরা ইংলন্ড ফ্রান্স জার্মানিতে বিপ্লব হয়নি বলে মার্ক্স-এঙ্গেল্‌সের ভবিষ্যদ্বাণীতে ভুল ধরেছেন, তাঁরা কিন্তু রাশিয়া সম্পর্কে এঙ্গেল্‌সের ভবিষ্যদ্বাণী পরে সঠিক প্রমাণিত হওয়াটাকে কোনো পাত্তা দেননি।

যাই হোক, এই ম্যানিফেস্টো হচ্ছে একটি ঘোষণা পত্রের মতো। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্টরা সংগঠিত হচ্ছে, তাদের হাতে একটা ঘোষণাপত্র চাই—যেখানে কম কথায় লেখা থাকবে কী তারা করতে চায়, কীভাবে করতে চায়, ইতাদি। সেটাই ১৮৪৮ সালে প্রথম ম্যানিফেস্টো নামে বেরোয়। আর এরকম লেখায় যে মৌলিক তত্ত্বকথা আনুপুঙ্খিক বিচার-বিশ্লেষণ খুব একটা থাকবে না, এটা যে বেশ একটু সংগ্রামী আহ্বান সম্বলিত হবে, যুক্তি তর্কের চেয়ে রণহুঙ্কারই বেশি পরিমাণে থাকবে, এ আর বেশি কথা কী? ধ্রুপদী মার্ক্সীয় সাহিত্যে এটা আজ অবধিও যে সম্ভ্রম জাগায় তা এর তাত্ত্বিক সম্পদের জোরে নয়, এর সংগ্রামী আবেদনের জোরে। এই সংগ্রামী আহ্বানের কারণেই এর বিশেষ কয়েকটি শ্লোগানধর্মী বিবৃতি আজও সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে অমর হয়ে আছে।

যাঁরা তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে বসবেন তাঁদের এই সব প্রাসঙ্গিক প্রাথমিক বিষয় ভুলে গেলে চলে না। এটাও তাঁদের চোখে না পড়ে পারে না যে পরবর্তী কালের মার্ক্সবাদী চিন্তানায়কদের আলোচনায়, প্লেখানভ, লেনিন এবং মাওয়ের প্রধান প্রধান রচনায়, তাঁদের তাত্ত্বিক যুক্তি তর্কের সমর্থনে ম্যানিফেস্টোর উল্লেখ প্রায় নেই বললেই চলে। সুতরাং কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে কেউ যদি মনে করেন, তিনি মার্ক্স এঙ্গেল্‌সের তাত্ত্বিক রচনা থেকে প্রদত্ত পূর্বাভাসগুলিকে খুঁজে বের করছেন, তুলে ধরছেন, এবং ভুল খুঁজে পাচ্ছেন, তাহলে তাঁকে আবার মতবাদিক বিতর্কের প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তি করে দিতে হবে। তবে এতে তাঁর দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, একবার সেই ক্লাশে ভর্তি হলে তিনি সেখানে সহপাঠী হিসাবে পাবেন বার্ট্রান্ড রাসেল, কার্ল পপার, লুই ফিশার, জর্জ অরওয়েল, প্রমুখ অনেক ভি ভি আই পি-কে। গর্বও হতে পারে তাঁর। সেই ক্লাশে হয়ত শিক্ষকতা করতে আসবেন মিখাইল বাকুনিন। যিনি এসেই বলবেন, “ওহে, শোনো ছাত্ররা, মার্ক্সের মোটা মোটা বইগুলিতে কিছু নেই। ওর যা বলার সমস্ত সার কথা বলে রেখেছে ওদের ম্যানিফেস্টোতে। ওইটা তোমরা ভালো করে পড়, ওখান থেকেই যা কিছু প্রশ্ন করার কর।” যদি খেলতে হয় বুকে ঘুঁষি মারো, যদি মারতে হয় বেল্টের নীচে পা চালাও। যেখানে দুর্বল জায়গা … ।

যাই হোক, আবার তত্ত্বের কথায় ফিরে আসি।
মধ্যবিত্তের বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণা বিশ শতকের শুরু থেকেই চলছে। এর অন্যতম কারণ এবং লক্ষ্য মার্ক্সবাদকে ভুল প্রমাণ করা। মেরুকরণের প্রবণতা দুর্বল হয়ে পড়েছে, সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির আনুপাতিক সংখ্যা কমে যাচ্ছে। নতুন শ্রমিক শ্রেণি উঠে আসছে, তারা আর সর্বহারা নয়, তাদের বাড়ি আছে, (ইউরোপ আমেরিকা হলে) গাড়ি আছে, অতএব পিছুটান আছে, শৃঙ্খল ছাড়াও হারানোর অনেক কিছু আছে। সুতরাং ধ্রুপদী ঘরানায় মার্ক্সীয় বিপ্লব আর সম্ভব নয়। এই সব কথা আমরা অনেক কাল ধরেই শুনে আসছি।

তারপরেও বর্তমানে সারা পৃথিবীর মধ্যবিত্তের সংখ্যা এবং আনুপাতিক অংশ কত?

এই সময়ে বিশ্ব জনসংখ্যা মোটামুটি ৭১২ কোটি। আর, ২০১০ সালের ও-ই-সি-ডি-র একটা হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সারা বিশ্বের মধ্যবিত্ত জনগণের সংখ্যা ১৮৪.৫ কোটি। [Homi Kharas, Emerging Middle Class in developing Countries; OECD Development Centre, Working Paper No. 285; January 2010] অর্থাৎ, বিশ্ব জনসংখ্যার কমবেশি ২৫-২৬ শতাংশ। তা-ও, এই হিসাবে মধ্যবিত্তদের আয়ের বন্ধনী যথেষ্ট বড় করে ধরা হয়েছে (যারা প্রতিদিন দশ থেকে একশ মার্কিন ডলার পর্যন্ত খরচ করতে পারে)। এই সীমানা আর একটু ছোট করে দিলেই (যেমন দৈনিক ২০ থেকে ৫০ ডলার খরচ করার ক্ষমতা) সংখ্যাটা অর্ধেকেরও নীচে চলে যাবে। আর, তাছাড়া, এই গড় হিসাব যদি উন্নততর বিশ্বকে ধরে নেওয়া যায়, তখন দেখা যাবে পরম সংখ্যায় বাড়লেও জনসংখ্যার অনুপাতে মধ্যবিত্তের আকার হ্রাস পাচ্ছে। যেমন, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭০-৯৪ সালের হিসাবে (অর্থাৎ, দীর্ঘ মেয়াদে) দেখা গেল, বার্ষিক ২৫০০০-৫০০০০ ডলার উপার্জনকারী (অর্থাৎ, যাদের দৈনিক আয় ৬৮-১৩৭ ডলার) জনগণের সংখ্যা ২.৫ কোটি থেকে ৩ কোটিতে পৌঁছলেও মোট জনসংখ্যার তুলনায় তা ৩৮ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নেমে গেছে। অন্যদিকে ভারতের মতো বড় এবং অতি-জনসখ্যা অধ্যুষিত দেশে বিশ্বায়ন এবং মনমোহনী সংস্কারের বাইশ বছর পরেও এরকম মধ্যবিত্তের সংখ্যা এখনও মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশের বেশি নয়। সুতরাং পুঁজিবাদের মার্ক্স-উত্তর কালে মধ্যবিত্তের অবস্থার এমন কোনো বিস্ময়কর পরিবর্তন হয়নি যার জন্য সেই মধ্যবিত্তদের বৃহত্তর অংশের মধ্যে পুঁজিবাদ সম্পর্কে নতুন করে মোহ জন্ম নেবে। বরং মোহভঙ্গের ঘটনাই বেশি করে ঘটছে।

পুঁজিবাদের শোষণে জর্জরিত হয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও জনগণ কেন বিপ্লব করতে এগিয়ে আসছে না? এতে কি মার্ক্সবাদ ভ্রান্ত সাব্যস্ত হচ্ছে না?

না।

হত, যদি মার্ক্স বা অন্য কোনো প্রামাণ্য মার্ক্সবাদী নেতা কোথাও এরকম দাবি বা ঘোষণা করতেন যে জনগণের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তারা বিপ্লব করবেই করবে। আগেই বলেছি, আমি অন্তত এখনও পর্যন্ত তাঁদের এরকম কোনো প্রামাণ্য তাত্ত্বিক লেখা হাতে পাইনি এবং পড়িনি যেখানে মার্ক্স বা এঙ্গেল্‌স বা লেনিন এই জাতীয় একটা দাবি বা ঘোষণা করেছেন। যা তাঁরা বলেননি, তা ঘটা না ঘটার সাথে তাঁদের তত্ত্বের ঠিক ভুল প্রমাণ-অপ্রমাণের কী সম্পর্ক আছে?
আবার বলছি, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লাভ নেই। কারণ সেটা কোনো তাত্ত্বিক রচনা নয়। ওটা হল একটা নবীন মতাদর্শের আগমনী বার্তা, তার ভিত্তিতে এক নতুন ধরনের শ্রেণি সংগ্রামের এবং সমাজ বিপ্লবের আহ্বান। ওই রচনা থেকে দুটো কথা এখান ওখান থেকে উদ্ধার করে কেউ যদি বলেন, “এই দেখুন, ১৮৪৮ সালেই মার্ক্স আর এঙ্গেল্‌স বলেছিলেন, বিপ্লব প্রায় হব-হব, অথচ কই, বেশিরভাগ দেশেই তো বিপ্লব হল না, তাহলে আর মার্ক্সবাদের কী রইল?” তাঁকে আবার সেই প্রাথমিক ক্লাশে পাঠাতে হবে। তত্ত্বগত রচনা এবং তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ কাকে বলে শিখে আসতে। তবে তো ভুল ধরার ক্ষমতা তৈরি হবে। মার্ক্সবাদের অধিকাংশ সমালোচক এই প্রাথমিক প্রস্তুতি ছাড়াই মতবাদিক সমালোচনা করতে এবং ভুল ধরতে নেমে পড়েন। তাঁরা ভাবেন, বিজ্ঞানের দর্শনের বিষয়ে মন্তব্য করতে হলে পড়াশুনা করতে হয়, অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করতে হলে উপযুক্ত প্রস্তুতি নিতে হয়; কিন্তু মার্ক্সবাদ সম্পর্কে কিছু (পক্ষে বা বিপক্ষে) বলতে হলে কোনো প্রস্তুতির দরকার নেই। অভিজিৎবাবুর সম্পর্কে এরকম ভাবতেও আমার কষ্ট হচ্ছে। তবুও বলছি, তিনিও প্রস্তুতি ছাড়াই মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে খেলতে মাঠে নেমে পড়েছিলেন।

পুঁজিবাদের নব চরিত্র

একথা ঠিক, মার্ক্সের সময়কাল থেকে পুঁজিবাদের অনেক বৈশিষ্ট্যই পরিবর্তিত হয়েছে। প্রাক-একচেটিয়া থেকে একচেটিয়া পুঁজিবাদের জন্ম হয়েছে, পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র অর্জন করেছে, আলাদা আলাদা ভাবে শিল্প ও ব্যাঙ্কের বদলে পুঁজির বিচলন এই দুটো ক্ষেত্রে মিলেমিশে গেছে, লগ্নি পুঁজির জন্ম হয়েছে। তার মধ্য দিয়ে পুঁজি আরও শক্তিশালী দ্রুতচল এবং বহুগামী হয়েছে।

মার্ক্সবাদীরা কি এই ব্যাপারে উদাসীন থেকেছেন? তাঁরা কি মার্ক্সের যুগের পুঁজিবাদের ব্যাখ্যাতেই সন্তুষ্ট থেকে এই সমস্ত নতুন বৈশিষ্ট্যগুলিকে দেখতে বুঝতে পর্যালোচনা করতে অস্বীকার করেছেন?

আদৌ না। রুডলফ হিলফারডিং, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, নিকোলাই বুখারিন, পল সুইজি, আর্নেস্ট ম্যান্ডেল, ক্রিস হারম্যান, প্রমুখ মার্ক্সবাদীরা এগিয়ে এসেছেন ধাপে ধাপে এই নতুন বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিচার করতে। তার ফলে এক অত্যন্ত বিশাল ও সমৃদ্ধ নতুন চিন্তাসম্পৃক্ত মার্ক্সবাদী সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। তাঁরা সবাই ঠিকঠাক বুঝেছেন কিনা, কে কোন দিক থেকে কতটা বুঝেছেন, বা সমস্ত দিক সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বুঝেছেন কিনা—এই প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। এঁরা যে যা ব্যাখ্যা করেছেন তার সঙ্গে যে কেউ মতপার্থক্য ব্যক্ত করতেও পারেন। কিন্তু মার্ক্সবাদীরা মার্ক্সের পুঁজি গ্রন্থকে বাইবেল বানিয়ে নতুন সমস্যার মোকাবিলায় তত্ত্বগত চিন্তার যাবতীয় দায়িত্ব অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করেছেন—এই অভিযোগ উপরোক্ত তথ্য জেনে-শুনে মার্ক্সবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে তোলাই যায় না।

এই প্রসঙ্গে বলি: অভিজিৎ রায় মার্ক্সের মূল্যের শ্রমতত্ত্বের বিরুদ্ধে বম-বাওয়ার্কের সমালোচনার কথা তুলেছেন। অস্ট্রিয়ান অর্থনীতিবিদ ইউগেন বম ফন বাওয়ার্ক মার্ক্সের মূল্যতত্ত্বের বিরুদ্ধে সমালোচনাটি জার্মান ভাষায় লিখেছিলেন ১৮৯৬ সালে, যা দু বছর পরে ইংরেজিতে অনুদিত হয়ে বেরয় [Eugen Böhm von Bawerk, Karl Marx and the Close of His System, 1898]। তাঁর হয়ত-বা জানা নেই, সেই সমালোচনার জবাব দিয়েছিলেন অন্তত তিনজন মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ: প্রথমে জার্মানিতে হিলফারডিং [Rudolf Hilferding, Böhm-Bawerk’s Criticism of Marx, 1904], কিছুদিন পরে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে বুখারিন [Nikolai Bukharin, Economic Theory of the Leisure Class, 1927], এবং অনেক পরে ইংলন্ডের রোনাল্ড মিক [Ronald Meek, Studies in the Labour Theory of Value, 1956, 1973]।

তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে মার্ক্সের মূল্যতত্ত্বকে বিভিন্ন দিক থেকে পুনর্বিচার করে দেখে তাকে সমর্থন করেছিলেন। মুক্তমনার লেখককে আগে মুক্তমনে বিচার করে দেখতে হবে, সেই জবাবগুলোতে বম-বাওয়ার্কের (এবং অন্যদের) উত্থাপিত সমস্ত প্রশ্নের মীমাংসা হয়েছিল কিনা; মার্ক্সবাদীরা মূল্যের শ্রমতত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রান্তীয় উপযোগিতা স্কুলের উত্থাপিত সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে পেরেছিলেন কিনা। একমাত্র তারপরই তিনি এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

বলতে পারেন, মার্ক্সের মূল্যতত্ত্ব বাতিল যোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। তার আগেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটা একপেশে হয়ে যাবে বলেই আমার ধারণা। এই বিচার শেষ করার আগে বা না করে ওঠা পর্যন্ত তিনি বড় জোর বলতে পারেন, এই বিষয়ে অনেক বিতর্ক আছে। আর, মার্ক্সের সমর্থনে বললে গোঁড়ামি, এবং বম-বাওয়ার্কের পক্ষে বললে মুক্তচিন্তা—এরকম সরল সিদ্ধান্ত আর যিনিই গ্রহণ করুন, অভিজিৎ বাবু করবেন বলে আমার এখনও বিশ্বাস হয় না।

পুঁজিবাদের বিবর্তন হয়ে চলেছে। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শিল্প-বিপ্লবোত্তর কারখানা ভিত্তিক যে পুঁজিবাদের দেখা মিলেছিল ইউরোপে অষ্টাদশ শতাব্দের শেষ ভাগ থেকে, যেখানে এক জায়গায় শুধু শত শত নয়, হাজার হাজার শ্রমিককে জড়ো করে উৎপাদন করা হত, বিশ শতকের শেষ চতুর্থাংশ থেকে পুঁজিবাদ সেই কাঠামো পালটে ফেলতে শুরু করে। সেই পরিবর্তনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নীচে উল্লেখ করা হল:

[১] সচেতনভাবে কিংবা অসচেতনভাবে তারা এক জায়গায় শ্রমিকদের কেন্দ্রীভূত জমায়েত ভেঙে দিয়ে উৎপাদনের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে থাকে—প্রথমে নিজের নিজের দেশে, তারপর অন্য দেশেও। এর মধ্যে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য যেমন ছিল, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও লুকানো ছিল;

[২] বড় বড় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি তার আগে পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে স্বাধীনভাবে শিল্পবিকাশের যে কোনো প্রচেষ্টাকে সাধ্য মতো বাধা দিত। তারা চাইত, এই দেশগুলি তাদের শিল্পে কাঁচামাল ও সস্তা শ্রম যোগান দেবার অনুন্নত বলয় হয়ে টিকে থাকুক। ১৯৭০-পরবর্তীকালে, বিশেষ করে যখন থেকে শিল্প দুষণ বিশ্বজোড়া উষ্ণায়ন ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পেল, তখন থেকেই উন্নত বিশ্ব ব্যস্ত হয়ে পড়ল দুষণের উৎসগুলিকে প্রথমে নিজ নিজ দেশের পশ্চাদপদ অঞ্চলে ও পরে বিশ্বের অন্যান্য পশ্চাদপদ দেশে স্থানান্তরিত করে দিতে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক এবং আইএমএফ-এর পঞ্চাশ-ষাটএর দশক এবং ১৯৭০-উত্তর পরামর্শগুলি পড়লে লেখক এই দুই কালে সাম্রাজ্যবাদীদের দু-রকম মনোভাব সম্বন্ধে অনেক আকর্ষণীয় তথ্য পাবেন। এই সময় থেকেই এক ধরনের ‘করিয়ে আনা’ (out-sourcing) শুরু হয়েছিল। আর এই কার্যক্রমগুলিকেই অনুন্নত দেশের শাসকশ্রেণি শিল্পায়ন ও উন্নয়ন বলে চালাতে চেয়েছে;

[৩] এইভাবে উৎপাদন-ব্যবস্থাকে ছড়িয়ে দিতে হলে আগে যত জন ম্যানেজার-জাতীয় লোক লাগত, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি লোক লাগছে। ম্যানেজারদের এই বর্ধিত চাহিদাকে মেটানোর প্রয়োজনেই সারা পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য (এবং অসংখ্য ধরনের) ম্যানেজমেন্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল। উচ্চ বেতনহার ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা (perks) দিয়ে তাদের মধ্যে শ্রেণিগতভাবে পুঁজির থলির প্রতি মনস্তাত্ত্বিক বশ্যতা জাগিয়ে তুলে বাকি শ্রমিক ও কর্মচারীদের থেকে একটা আলাদা উচ্চাকাঙ্ক্ষী গোষ্ঠী হিসাবে তৈরি করা হচ্ছে। এরাই রায়-কথিত সেই মধ্যবিত্তদের একটা বড় অংশ;

[৪] এদের প্রদেয় মোটা মাইনের অঙ্ককে ভারমুক্ত করতে অন্যদিকে শ্রমিকদের প্রদেয় বেতনহার এবং/অথবা টাকার অঙ্ক কমানোর নানা রকম চক্রান্ত করা হচ্ছে। যথা: (ক) ক্রমাগত উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এক একটি কারখানায় শ্রমিক সংখ্যা ক্রমাগত কমানো, (খ) কিছু কিছু করে স্থায়ী পদ বিলোপ ও খালি পদে যত দিন সম্ভব নিয়োগ বন্ধ রাখা, (গ) উৎপাদন সরিয়ে নিয়ে গিয়ে অন্য দেশের সস্তা শ্রম কিনে কাজে লাগানো, (ঘ) অস্থায়ী ও চুক্তিশ্রমিক নিয়োগের মধ্য দিয়ে বহু সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত করা, (ঙ) স্থায়ী শ্রমিকদের এতকাল প্রদত্ত সুযোগসুবিধা ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করা, (চ) ক্রমবর্ধমান বেকারি ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে দরকষাকষি করে মজুরি যতদূর পারা যায় (মূল্যবৃদ্ধির সাপেক্ষে) কমিয়ে রাখা, ইত্যাদি।

[৫] সারা বিশ্বে উৎপাদনকে ছড়িয়ে দিতে হলে আর একটা জিনিসও চাই। সেটা হল দক্ষ শ্রমিকের যোগান। যারা নব নব যন্ত্রপাতি চালাতে পারবে, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করতে পারবে। এই কারণেই ১৯৭০-পরবর্তীকালে আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া দেশগুলিতে হঠাৎ করে প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সংখ্যা হু-হু করে বাড়তে থাকে। (কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে) এই ধরনের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তীর্ণ ছাত্ররা সরকারি উন্নতমানের কলেজ থেকে পাশ করা ছাত্রদের মতো প্রযুক্তিবিদের যোগ্যতা দেখাতে না পারলেও দক্ষ শ্রমশক্তি হিসাবে ভালোই কাজ করতে পারবে। এরাও রায়-কথিত মধ্যবিত্তের আরেকটা বর্তমানে ক্রমবর্ধমান অংশ;

[৬] উৎপাদন বিক্ষেপন, প্রযুক্তির বিকাশ এবং ভোগবাদ—এই তিনের টানাপোড়েনে আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পরিষেবা ক্ষেত্র ক্রমাগত স্ফীত হয়ে চলেছে। বছর তিরিশ-চল্লিশ আগেও পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে প্রথম (কৃষি) ও দ্বিতীয় (শিল্প) উপভাগই ছিল উৎপাদনের সিংহভাগ। তৃতীয় (পরিষেবা) উপভাগ ছিল নিতান্তই নগণ্য, বাকি দুই ভাগের উপরে একটি ক্ষীণ আস্তরণ মাত্র। পরিবহন, ডাক, দূরসংযোগ, ইত্যাদি। বিগত পঞ্চাশ-ষাট বছরে উপরের তিনটি ঘটনা যুক্ত হয়ে এই উপস্তরের বেধ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ১৯৮০-র দশকে ডেস্কটপ পিসি এবং ১৯৯০-র দশক থেকে ইন্টারনেট এসে যাওয়ার পর বিনোদন ব্যবসা এক বিরাট প্রতিষ্ঠান রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৯০-উত্তরকালে বিশ্বায়ন-ব্যবস্থার প্যাঁচকলে শিক্ষা স্বাস্থ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা ইত্যাদিরও ব্যাপক ব্যবসায়ীকরণ শুরু হয়; সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে পরিষেবা ক্ষেত্রের আকার আয়তন। আর ইন্টারনেটে করিয়ে-আনা শুরু করার মাধ্যমে আই-টি সেক্টরের নামে তৃতীয় বিশ্বে প্রথম বিশ্বের অনেক কাজ স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে সেই সব দেশে কৃষি ও শিল্পের হরপ্পা-দশার মধ্যেও পরিষেবা উপভাগের বিরাট ব্যাপ্তি হতে থাকে;

[৭] এইভাবে একদিকে নতুন ধরনের এক শ্রমিক-গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে, যাদের বনেদি শিল্প শ্রমিকদের সাথে পুরোপুরি মিলিয়ে বিচার করা যায় না। যাদের চাকুরি গত অবস্থা, শর্তাবলি, রোজগার, ছুটি, পারস্পরিক যোগাযোগ, ইত্যাদি বিষয়গুলি একেবারেই অন্যরকম। আর একদিকে এসেছে আর একদল স্বনিযুক্ত ছোট ব্যবসায়ী, যারা অসংখ্য রকমের পরিষেবা প্রদান করে বাঁদিকে নাগরিক জীবনযাত্রা ডানদিকে বড় শিল্পের উৎপাদন—এই দুটোকে একসাথে চালু রেখেছে। এদের মানসিকতা হচ্ছে শ্রমিকদের মতো, আর অবস্থানটা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের মতো। এই শ্রমদাতাদের আর্থসামাজিক অবস্থানটা হচ্ছে বৃহৎ পুঁজিকে ঘিরে একটা বাফারের মতো, যাদের পরিষেবা, মানসিকতা, চলাফেরা, দাবিদাওয়া, রোজগার, ইত্যাদি পুঁজিবাদকে বহু দিক থেকে সেবাও দেয় সুরক্ষাও দেয়;
ইত্যাদি … ।

শ্রীরায় যদি প্রশ্ন তোলেন, বিভিন্ন দেশের মার্ক্সবাদী দলগুলি এই সব নতুন সমস্যাগুলির দিকে নজর দিচ্ছে কিনা, এর বিচার বিশ্লেষণ করে তাদের রাজনৈতিক লাইনে কোথাও কিছু নতুন কথা ঢোকাচ্ছে কিনা, তার একটা মানে হয়। যেখানে যে দল দিচ্ছে না, তাকে এইদিকে দৃষ্টিপাত করার জন্য তিনি আবেদন করতে পারেন। না করে থাকলে সমালোচনাও করতে পারেন। যারা এই সমস্ত নতুন সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে তাদের নীতি নির্ধারণ বা বিশ্লেষণ সম্পর্কে মতপার্থক্য থাকলে তা নিয়ে মন্তব্য করতেও পারেন। [মার্ক্সবাদীদের তরফে এরকম একটি বিশ্লেষণের নমুনা দিলাম: Chris Harman, “The workers of the world”; International Socialism; 2, 96 (Autumn 2002)]। কিন্তু যদি বলেন, এই সব বৈশিষ্ট্যের উদ্ভবের ফলে পুঁজিবাদের চরিত্র বদল হয়ে গিয়েছে, তাহলে বড্ড মুশকিল।

আমার এই কথাটা বোঝানোর জন্য সবটা মিলবে না জেনেও একটা সহজ উদাহরণ দিই।
ন্যাংটো শিশু একটু বড় হয়ে হাফ প্যান্ট পরে, কথা বলে, হাঁটে, দৌড়ায়। তারপর আরও বড় হয়ে সে স্কুলে যায়, পরীক্ষা দেয়, পাশ করে, কলেজে যায়, ডিগ্রি অর্জন করে। আরও বড় হয়ে সে হয়ত চাকরি বা ব্যবসা করে, বিয়ে-থা করে, সংসার প্রতিপালন করে, নিজে মা-বাবা হয়, ইত্যাদি। এইভাবে একদিন সে বৃদ্ধ হয়, দিদিমা বা দাদু হয়, ইত্যাদি … । কিন্তু সমস্ত সময় ধরেই সে তার অস্মি-সত্তা নিয়ে থাকে, নিজের কাছেও, অপরের কাছেও। তার কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য (চরিত্র, আচরণ, মুদ্রা দোষ, ভাষা, বাচনভঙ্গি …) বজায় থাকে। যা দিয়ে যে কোনো লোকে তাকে চিনতে পারে, তার সম্বন্ধে অন্যের কাছে বলতে পারে।
পুঁজিবাদও ঠিক সেই রকম।

আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে যখন ইউরোপ থেকে ওরা বেরিয়েছিল পৃথিবীর নানা প্রান্তের বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ করবে বলে, সেখান থেকে সোনা রুপো কয়লা লুটেপুটে আনবে বলে, দাস ব্যবসা করবে বলে, আর আজ যখন আমেরিকা বৃটেন ফ্রান্স জার্মানির ন্যাটো জোট ইরাক আফগানিস্তান লিবিয়া মিশর সিরিয়ার উপর খনিজ তেলের ভাণ্ডারগুলি দখলের উদ্দেশ্যে হামলা চালাচ্ছে বা চালাতে চাইছে—লক্ষ করে দেখুন তাদের দস্যু-স্বভাবে এতটুকু পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন কিনা।

গোটা উনবিংশ শতাব্দ ধরে ইউরোপ আমেরিকায় শিল্প শ্রমিকরা রক্তক্ষয়ী লড়াই করেছে আট ঘন্টার কাজের দাবি আদায় করার জন্য। মালিকরা কোথাও কোনো দেশে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, স্বেচ্ছায়, খুশি মনে গণতন্ত্র ভ্রাতৃত্ব সাম্য মৈত্রীর প্রেমভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই দাবি মেনে নেয়নি। আপনি পুঁজিবাদী দেশগুলিতে যে সমস্ত শ্রমিক স্বার্থরক্ষাকারী পদক্ষেপের কথা বলেছেন তারও সবই চালু হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির এক সময়কার উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ফলে আতঙ্কিত হয়ে নিজ নিজ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ঠেকানোর জন্য। তারা কেউ কখনই কল্যাণ-রাষ্ট্র হয়নি, কল্যাণীয়াসু মুখোশ পড়েছিল মাত্র।

তাছাড়া গণ আন্দোলনেরও একটা ক্রমবর্ধমান চাপের প্রশ্ন তো ছিলই।
আর আজ লক্ষ করে দেখুন, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে সেই সেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সেই কল্যাণ-মুখোশ খুলে ফেলে একটার পর একটা সামাজিক সুরক্ষা-কবচগুলি ফিরিয়ে নিতে চাইছে। কর্পোরেট সংস্থাগুলি চাপ দিচ্ছে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা চাপ দিচ্ছে, একদল দালাল অর্থনীতিবিদও সেই সুরে ঢাক পেটাচ্ছেন। সমস্ত পুঁজিবাদী সংস্থা এখন আট ঘন্টার কর্মসময় লঙ্ঘন করতে চাইছে, শ্রমিক কর্মচারিদের দিয়ে দশ বারো ঘন্টা করে রোজ কাজ করাতে চাইছে। উপরে উল্লিখিত ম্যানেজার-টেকনোক্র্যাটদের সে এখন প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই কাজে আটকে রাখছে ইন্টারনেট-ল্যাপটপ-ডাটা কার্ডের মাধ্যমে। গান বাজনা সিনেমা গল্প বেড়ানো সব কিছু বাদ দিয়ে অথবা সব কিছুর মধ্যেই কোম্পানির সঙ্গে সংযোগ রেখে চলতে হবে, কাজের নির্দেশ পেলে সেইমতো সেবা করে যেতে হবে। হাতুড়ি পেটানো, মেশিনের হ্যান্ডেল ঘোরানোর বদলে কি-বোর্ডের বোতাম টেপার মধ্যে কিছু পরিবর্তন নিশ্চয়ই আছে, অভিজিৎবাবু। কিন্তু সেটা শ্রমের বাহ্যিক রূপের বদল; শারীরিক ধকলেরও বদল নয়, শোষণের চরিত্রেরও বদল নয়। বরং এর মধ্য দিয়ে শোষণের হার মাত্রা সূক্ষ্মতা ও জটিলতা আরও বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বহু গুণ বেড়েছে শারীরিক ধকলের মাত্রা।

বুঝবার সুবিধার্থে আবার একটা সহজ উদাহরণ দিই।
একজন ব্যাঙ্ক কর্মচারির কথা ভাবুন যিনি ক্যাশ কাউন্টারে বসে টাকা গুণে দেন এবং নেন। বিশ পঁচিশ বছর আগে তাঁকে চার ঘন্টা এই কাজ করতে হত। টাকার দামের সাপেক্ষে মানুষের লেন-দেনের পরিমাণ অনেক কম ছিল। কম্পিউটার ছিল না। কাগজে খাতায় লিখে কাজ করতে গিয়ে তাঁকে সেই সময় যে সংখ্যক খদ্দেরকে সামলাতে হত, আজ কিন্তু তার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। কেন না, যান্ত্রিক সুবিধার কারণে খদ্দের পিছু সময় দানের পরিমাণ কমে গেছে। প্রত্যেক খদ্দের পিছু টাকার লেন-দেনের পরিমাণও অনেক বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে কাউন্টারের সময় আরও অন্তত এক ঘন্টা বর্ধিত করা হয়েছে। এই সব মিলিয়ে বিশ বছর আগে এরকম একজন কর্মচারিকে প্রতিদিন যে পরিমাণ টাকা গুণতে হত আজ তা চার থেকে দশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক কিছু বাড়তি সমস্যাও আছে। টাকার লেন-দেন বাড়ার কারণে পাঁচশ এবং হাজার টাকার নোট বাজারে এসে গেছে বিপুল পরিমাণে। তাতে জাল নোটের সমস্যা যুক্ত হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। শেডের নীচে গরমে দাঁড়িয়ে হাতুড়ি পেটানোর চাইতে বাতানুকুল কক্ষে বসে করা এই খাটনিকে খালি চোখে আরামদায়ক মনে হতে পারে। কিন্তু ভুক্তভোগীই একমাত্র জানে, শরীর এবং মনের উপর এর দীর্ঘমেয়াদি ধকল কী সাংঘাতিক। এই রকম সমস্যাকে খুঁজে পাওয়া যাবে রেল বা বিমান পরিষেবা ক্ষেত্রের টিকেট বিক্রিরত কর্মচারিদের ক্ষেত্রেও।

এইভাবে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্র ধরে ধরে অনুসন্ধান চালালে এবং বিচার করলে দেখা যাবে, আধুনিক পুঁজিবাদের এই বিরাট সৌধ দাঁড়িয়ে আছে লক্ষ কোটি মানুষের অদৃশ্য কান্না ঘাম রক্ত অশ্রুর গ্রহ-সমান জেলির উপরে। উন্নত বিশ্বে চাকরি-বাকরির অর্থকরী অনেক সুবিধার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে এক সারাক্ষণের অনিশ্চয়তা—এই বুঝি চাকরি চলে গেল। হ্যাঁ, অনেক জায়গায় হয়ত বেকার ভাতার ব্যবস্থা আছে। বিনা পয়সার গণ-লঙ্গরখানা আছে। তাতে সাময়িকভাবে খাওয়াদাওয়ার হয়ত কিছুটা সুরাহা হতে পারে। কিন্তু আপনি মনে মনে কল্পনা করুন, যে মানুষটা দুদিন আগে একটা কোম্পানির উঁচু পদে কাজ করতেন, তাঁকে যখন ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে রাষ্ট্রের দানছত্রের টেবিলে গিয়ে দাঁড়াতে হয় তখন তাঁর মনের অবস্থা কী রকম হয়! এর ফলে আমেরিকায় জাপানে ম্যানেজারি পদে কর্মরত ব্যক্তিদের দু-তিন মাস অন্তর অন্তর মনোচিকিৎসাবিদের ক্লিনিকে গিয়ে মানসিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য পরামর্শ নিতে হয়। মার্ক্সবাদের বিকল্পই বটে!

সমাজতন্ত্র: রাশিয়া

সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে কী হয়েছিল তা নিয়ে অভিজিৎবাবু অনেক কথা বলেছেন, অনেক মৃত্যুর হিসাব দিয়েছেন। সোভিয়েত রাশিয়া সহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে সমাজতন্ত্র হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ার পর থেকে এই সব প্রশ্ন আরও বেশি করে জনমানসে ঢেউ তুলছে। মুশকিল হচ্ছে, এই সব ঘটনা ও তথ্যের মধ্যে এত রকম সত্য মিথ্যা মিলেমিশে আছে যে সংক্ষেপে আলোচনা করার অনেক অসুবিধা আছে। যে কোনো তরফেই অতিকথন অথবা অবমূল্যায়নের অভিযোগ উঠে যেতে পারে।
তথাপি, প্রশ্ন যখন উঠেছে এবং তা নিয়ে আলোচনা করতে যখন বসেছি, তখন দায় তো এড়িয়ে যেতে পারি না। অসুবিধামূলক প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায় না। নৈতিক দায় এবং রণনৈতিক কৌশল—কোনো দিক থেকেই তা যুক্তিসম্মত বা অভিপ্রেত নয়। তাই আমি এখানে এই বিষয়েও দু-চার কথা বলব। তবে এখানেও সংক্ষেপনের কারণে বিষয়ের প্রতি সুবিচার করতে না পারার জন্য আগাম মার্জনা ভিক্ষা করে নিচ্ছি।

সোভিয়েত রাশিয়া দিয়েই শুরু করা যাক।
১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব সফল হয়ে বলশেভিকরা ক্ষমতায় পাকাপাকিভাবে বসে যাওয়ার পর যখন ব্রিটিশ ফরাসি জার্মান ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য ক্ষেত্রের পুঁজি বাজেয়াপ্ত করে নিল, সাম্রাজ্যবাদীরা বুঝে গেল এরা সহজে এবং এমনি এমনি চলে যাবে না। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে চতুর্দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে এবং কোলচাক দেনিকিন প্রমুখ ভেতরের প্রতিবিপ্লবী শক্তিগুলির অভ্যুত্থানগুলিকে মদত দিয়ে চেষ্টা করল সোভিয়েত ব্যবস্থাকে উৎখাত করতে। লেনিনকে গুলি করে হত্যা করার চেষ্টা হল। এগুলো যে বাস্তব ঘটনা এবং এখান থেকেই যে হিংসার সূত্রপাত—এটা নিরপেক্ষ মন নিয়ে বিচার করতে বসলে যে কোনো বিশ্লেষককেই স্বীকার করতে হবে।

একথাও সত্য যে রুশ বিপ্লবের পরে পরেই শিক্ষা এবং বিজ্ঞানের পেছনে যে বিপুল অর্থ ও কর্মশক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল, উন্নতকে উন্নততর করার বদলে অনুন্নতকে উন্নত করার দিকেই যে পরিমাণ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল, তার দ্বিতীয় উদাহরণ শুধু সেই কালে নয়, পরেও আজ পর্যন্ত কোনো বুর্জোয়া রাষ্ট্র দেখাতে পারেনি। এই অভূতপূর্ব কর্মোদ্যোগের ফলও মিলেছিল অবিলম্বেই। সমকালীন বিজ্ঞানের এক একটা অসমাধিত জটিল সমস্যার সমাধান আসতে লাগল সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে, যা ছিল দু-চার বছর আগে ইউরোপের এক পশ্চাদপদ অংশ। ১৯২২ সালেই আলেকজান্দার ফ্রিদম্যান আইনস্টাইনের সেই ল্যাম্বডাকে উড়িয়ে দিয়ে প্রসারণশীল বিশ্বের ধারণা নিয়ে এলেন; ১৯২৪ সালে ওপারিন নিয়ে এলেন প্রাণের উৎপত্তির এক ভৌত-রাসায়নিক তত্ত্বকল্প, যার সম্ভাব্যতা সিকি শতাব্দ বাদেই পরীক্ষামূলকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে; পাভলভের “নীরবতার স্তম্ভ” গবেষণাগার নির্মিত হয়ে শর্তাধীন পরাবর্তের গবেষণা তখন পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে চলেছে, যার ভিত্তিতে উচ্চতর স্নায়বিক ক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞান এবং অবশেষে চিন্তার বাস্তব শারীরতাত্ত্বিক ভিত্তি জানা যাবে; প্রায় সেই সময়ে মার্ক্সীয় দর্শনের আলোকে মনস্তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজতে শুরু করলেন লেভ ভাইগতস্কি; নিকোলাই ভ্যাভিলভ তখন সারা পৃথিবী ঢুঁড়ে কৃষিজ উদ্ভিদের উৎসভূমি খুঁজে বেড়াচ্ছেন; মার্কভ বার্নস্টাইন কোমোগোরভ গ্নেডেঙ্কো প্রমুখ গণিতবিদরা গণিত রাশিবিজ্ঞান ও সম্ভাব্যতা তত্ত্বে সর্বোচ্চ পর্যায়ের গবেষণা করে যাচ্ছেন; চেতভেরিকভ ১৯২৬ সালে জিনতত্ত্বের সাথে ডারউইনের বিবর্তনবাদের সংযোজন করে ফেলেছেন (যা পরে, ১৯৩০ সালে ফিশারের কাজ হিসাবে বিশ্বে পরিচিত হয়); ১৯৩২ সালে পাভলভ অবশেষে প্রস্তাবনা করলেন তাঁর প্রথম সঙ্কেততন্ত্র ও দ্বিতীয় সঙ্কেততন্ত্রের তত্ত্ব, মানুষের কথা ও চিন্তার বাস্তব ভিত্তি যার আলোকে বুঝতে আর কোনো অসুবিধা রইল না; … ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনি আরও কত কিছু … ।
হ্যাঁ, শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে এরকম অগ্রগতি সত্ত্বেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিচ্ছিল। লেনিন যে যোগ্যতা ও দক্ষতার সঙ্গে দলের ভেতরে ও বাইরে সমস্ত বিতর্ক ও মতবিরোধকে সামলে সকলকে সঙ্গে নিয়ে সমাজতন্ত্রকে রক্ষা ও বিকশিত করার কাজে এগোতে পেরেছিলেন নানা কারণেই জোসেফ স্তালিন সেই কুশলতা দেখাতে পারেননি। তার উপর নেপ-নীতির ভিত্তিতে অর্থনীতিকে খানিকটা চাঙা করে নিয়ে যখন সোভিয়েত রাষ্ট্র কুলাক উচ্ছেদ ও শিল্পায়নের কর্মসূচি নিয়ে এগোতে শুরু করল তখন যে পরিমাণ নাশকতামূলক চক্রান্ত চলেছিল তাকে রুখতে গিয়ে দল ও রাষ্ট্র যেন নাকানিচুবানি খেতে থাকে। অবশেষে লেনিনগ্রাদের সদর দপ্তরে কিরভকে দিনের বেলায় হত্যা করে যাওয়ার পর স্তালিন-নেতৃত্ব দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে পড়েন যে কোনো মূল্যে নাশকতা বন্ধ করার জন্য। এইখান থেকেই শুরু হয়ে যায় নাশক-হিংসার বদলে রাষ্ট্রীয়-প্রতিহিংসার রক্তাক্ত অধ্যায়। প্রকাশ্য ও গোপন শত্রু নিধন করার সঙ্গে সঙ্গে বহু নিরীহ নির্দোষ মানুষকেও নাৎসি জার্মানির দালাল সন্দেহে গ্রেপ্তার বিচার ও হত্যা চলতে থাকে। এই পুরো পর্বটাই এক সাদা-কালো-ধূসর ইতিহাস—যার কিছু আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, কিছু কিছু জানি অত্যন্ত ভাসা ভাসা ভাবে, আর কিছু বিষয় একেবারেই জানি না।

এই না জানার পেছনে অন্যতম কারণ দুদিক থেকেই একতরফা প্রচার। স্তালিন জমানায় যা জেনেছি তা যেমন একতরফা, স্তালিনোত্তরকালে যা জানা গিয়েছে তার মধ্যেও একপেশে খবরই ছিল।

আজও বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি থেকে যে সমস্ত গবেষণা হচ্ছে তার বেশিরভাগই সমাজতন্ত্রকে হেয় প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে পরিচালিত। সত্যানুসন্ধানের কোনো প্রচেষ্টাই তাতে নেই। পক্ষান্তরে যে মুষ্টিমেয় কিছু মার্ক্সবাদী নেতা একালেও স্তালিন-জমানার পক্ষে লিখছেন—যেমন, আমেরিকায় স্যাম মারসি, ইংলন্ডে উইলিয়াম ব্ল্যান্ড, সুইডেনে মারিও সৌসা, ভারতে প্রভাস ঘোষ—তাঁরাও অনেক প্রশ্নে ভালো আলোচনা করার পরেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে ধূসর এলাকাগুলি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করে যাচ্ছেন।

একথা যুক্তিগ্রাহ্য ঠিকই যে ১৯৩০-এর দশকে ব্যাপক গ্রেপ্তারি বিচার ও শাস্তিদানের ঘটনার পর ১৯৪১ সালে জার্মান আগ্রাসনের পুরো সময়কাল জুড়ে রাশিয়ায় পঞ্চম বাহিনীর কোনো উৎপাত ছিল না, যা সেই ঝোড়ো দিনগুলিতে ইউরোপের সমস্ত দেশ হিটলারের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে মোকাবিলা করেছে। অনেক ভুলভ্রান্তি সত্ত্বেও একথা তো সত্যি যে নাৎসি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রায় একা হাতে লড়াই করে সোভিয়েত রাশিয়া সেদিন সারা ইউরোপ এবং মানবসভ্যতাকে রক্ষা করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি দুর্বল দেশের উপরে হামলা চালানোর ব্যাপারে অন্তত কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়েছিল। আজ যেভাবে আমেরিকা ইরাক আফগানিস্তান লিবিয়ার দখল নিয়েছে, ইরান উত্তর কোরিয়া সিরিয়া কিউবার বিরুদ্ধে তড়পাচ্ছে, নিজেরা কৃষিতে ব্যাপক হারে ভর্তুকি দিয়ে ভারত-বাংলাদেশকে চাপাচাপি করছে কৃষিতে ভর্তুকিদান বন্ধ করতে, সমাজতান্ত্রিক শিবির দুর্বলভাবে টিকে থাকলেও এসব জিনিস ওরা করতেই পারত না। সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের পক্ষ থেকে যাঁরা লিখছেন, তাঁরা এই সব ব্যাপার বেমালুম চেপে যাচ্ছেন।

কিন্তু বিপরীত দিক থেকে স্তালিন আমলের পক্ষ নিয়ে যাঁরা কলম ধরেছেন, তাঁরাও একই ভাবে অনেক কিছুই হয় দেখতে পাচ্ছেন না, অথবা দেখেও না দেখার ভাণ করছেন। তিনটি বিখ্যাত মস্কো বিচারের (১৯৩৪-৩৮) পর যখন পার্টির পুরনো নেতা ও সদস্যদের এক বিরাট অংশ বহিষ্কৃত সাজাপ্রাপ্ত এবং/অথবা নিহত, পরবর্তী পার্টি কংগ্রেসে (১৯৩৯) তার কারণ মাত্রা গুরুত্ব ও ফলাফল নিয়ে স্তালিন বা অন্য নেতাদের নীরবতা সম্পর্কে তাঁদের কোনো বক্তব্য নেই। ভ্যাভিলভের বিচার শাস্তি ও মৃত্যু, বুখারিন এবং বরিস হেসেনের বিচার ও হত্যা, ভাইগতস্কির অকাল মৃত্যুর পর তাঁর তত্ত্বের চর্চারোধ, ইত্যাদি বহু ঘটনারও কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা বা বিশ্বাসঘাতকতার তথ্যগত সমর্থন আজ অবধি তাঁরা কেউ দিতে পারেননি। বিচারের সময় অভিযুক্তদের নিজমুখে স্বীকারের যে একমাত্র তথ্য তাঁরা দিতে পারছেন, সামগ্রিক পরিস্থিতির এবং পরবর্তী ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে তার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রায় শূন্য। তার তাঁরা লাইশেঙ্কো পরিঘটনারও কোনো রকম ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না বা দিচ্ছেন না। তাঁরা সকলেই স্তালিন-প্রশ্ন এমনভাবে আলোচনা করে যাচ্ছেন যেন এই সব কোনো ঘটনাই কোথাও কোনোদিন ঘটেনি।

আমাদের মধ্যে যাঁরা আপাতত সরাসরি কোনো পক্ষের হয়ে সাফাই গাইবার ওকালতনামায় স্বাক্ষর দিইনি, তাঁদের অত্যন্ত সতর্ক হয়ে এই সব স্পর্শকাতর বিষয়ে মতামত দিতে হবে। ধরুন, ইউক্রেনের কোথাও একটা গণকবর খুঁজে পাওয়া গেল। এটা স্তালিন জমানার কীর্তি না জার্মান সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ড—আমরা বুঝব কীভাবে? এই জিনিস বুঝবার জন্য অনুমিত ঘটনার আগে পরে আরও অনেক তথ্য জানা দরকার। তা না হলে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতিটি হবে নিম্নরূপ: ‘স্তালিন আমলে অনেক গণহত্যা হইয়াছিল; এক্ষণে একটি গণ কবর পাওয়া গিয়াছে; সুতরাং এই গণ কবরটি স্তালিন আমলের তেমন একটি গণহত্যার সাক্ষ্য।’ এরকম যুক্তির মানে হল, যাকে প্রমাণ করতে হবে তাকেই প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করা। তর্কশাস্ত্রে এর একটা ভালো লাতিন নাম আছে: “Petitio principi”। সমস্ত বড় পশ্চিমি নৈয়ায়িকরা প্রলোভন এড়িয়ে এর খপ্পরে পড়তে বারণ করে দিয়েছেন।

চিনের দুর্ভিক্ষ

রাশিয়া তো খানিকটা হল। এবার চিন সম্পর্কেও দুচার কথা বলতে হবে। একে আমাদের প্রতিবেশি দেশ। তার উপর আমাদের সাথে সেই সুদূর অতীতকাল থেকে চিনা সভ্যতার যোগসূত্র স্থাপিত হয়ে আছে। চিনের ভালোমন্দ সম্পর্কেও আমাদের অপার কৌতুহল থাকাটা কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।

চিন সম্পর্কে আমি অন্য বিষয়ে আলোচনা করব না। শুধু লেখক যে বিষয়টির উত্থাপন করেছেন তার সাথে বিজড়িত কিছু প্রসঙ্গ এখানে তুলে ধরব। প্রসঙ্গ চিনের ১৯৫৮-৬০ সালের দুর্ভিক্ষ। এই প্রসঙ্গটি দুটো কারণে ইদানীংকালে বুর্জোয়া প্রচার যন্ত্রে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। একদিকে চিনের ভেতর থেকে তেং শিয়াও-পিং নেতৃত্ব মাও সে-তুঙের সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে নিন্দা করতে গিয়ে মাওয়ের সমস্ত কার্যকলাপকেই মসিলিপ্ত করতে চেয়েছে; তারই অঙ্গ হিসাবে এই দুর্ভিক্ষকেও সমকালীন “বৃহৎ উল্লম্ফন কর্মসূচি” (great leap forward)-এর পরিণাম হিসাবে তুলে ধরেছে। মাওয়ের আদর্শগত শুদ্ধতা নিয়ে অতি বাড়াবাড়ি এবং তজ্জনিত অবিমৃষ্যকারিতার ফলেই নাকি এই বিপর্যয় ঘটেছিল। তাদেরই বিভিন্ন ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী এই সব রটনাকে ঘটনার রঙে এঁকে পশ্চিমি প্রকাশকদের হাতে তুলে ধরছে এবং তারাও খুশি মনে এই সব অপলাপকে সাক্ষাত প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীর বিবরণ হিসাবে ছাপিয়ে বিক্রি করে বেশ দু পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে। অপরদিকে বাঙালির গর্ব নোবেল জয়ী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর এক গম্ভীর রচনায় দাবি করেছেন, স্বাধীন ভারতে যে চিনের মতো বড় কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি তার কারণ ভারতের আর চিনের শাসন ব্যবস্থার পার্থক্য। ১৯৪৭-উত্তরকালে ভারতে গড়ে উঠেছে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন আর চিনে ছিল কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণে একদলীয় একনায়কত্ব। ভারতে বিরোধী রাজনীতি আর মুক্ত প্রেস—এই দুইয়ের চাপে সরকারকে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি যাতে না হয় তা দেখে রাখতে হয়। চিনে বিরোধী দলও নেই, মুক্ত গণমাধ্যমও নেই। কমিউনিস্ট পার্টি নিশ্চিন্তে দুর্ভিক্ষ হতে দিতে এবং তা প্রচারে গোপন রাখতে পেরেছে। এই দুটো উৎস মিলিয়ে দুর্ভিক্ষের গল্পটিও বেশ জমে উঠেছিল। অভিজিৎবাবুও হয়ত সেই সব উৎস থেকেই গল্পটা সংগ্রহ করেছেন এবং কোনো রকম যাচাই না করে তাঁর আলোচ্য প্রবন্ধে নিশ্চিন্ত মনে তা সন্নিবেশ করে ফেলেছেন।

আসলে চিনে সেদিন কী ঘটেছিল?

প্রথমত, ওই তিন বছর চিনে ব্যাপক ও ভয়াবহ খরা হয়েছিল, যার ফলে ফসল উৎপাদন প্রচণ্ড মার খেয়ে যায়। বস্তুত, ১৯৬০ সালে গোটা উত্তর চিনের শতকরা ৬০ ভাগ জমিতে কোনো বৃষ্টিপাত হয়নি। আর অভিজিৎবাবু নিশ্চয়ই জানেন, অন্য সব খবর কমিউনিস্ট একনায়কত্বের প্রশাসনিক দাপটের জোরে চেপে দেওয়া বা বিকৃত করা গেলেও বৃষ্টিপাতের খবরের উপর কাঁচি চালানো যায় না।

দ্বিতীয়ত, ১৯৫৯ সালে পীত নদীতে যে বিপুল বন্যা হয়, যাকে বিংশ শতাব্দের সব চাইতে মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলা হয়ে থাকে, তাতেও কম পক্ষে ২০ লক্ষ লোক মারা যায়।

তৃতীয়ত, স্তালিন মূল্যায়ন ও অন্যান্য মতাদর্শগত প্রশ্নে চিনের মাও-নেতৃত্বের সঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ার ক্রুশ্চভ-নেতৃত্বের যে ব্যাপক মতপার্থক্য দেখা দেয় তার জেরে, মাওকে কোনোভাবেই ক্রুশ্চভের দাপটের কাছে মাথা নোয়ানো যাবে না বুঝতে পেরে, রাশিয়া একতরফাভাবে চিন থেকে সমস্ত সোভিয়েত সাহায্য হঠাৎ করে প্রত্যাহার করে নেয়। আর সেই সময় চলছিল সমগ্র সাম্যবাদী শিবিরের বিরুদ্ধে আমেরিকার প্রবল আর্থিক বয়কট নীতি, যার ফলে বিদেশ থেকে চিনে খাদ্যশস্য আমদানি করা বা অন্য কোনো দেশের থেকে সাহায্য গ্রহণ করাও সম্ভব হচ্ছিল না।

চতুর্থত, এই দুর্বিপাকের সুযোগ নিয়ে লিউ শাও-চি তেং শিয়াও-পিং প্রমুখ পুঁজিবাদের পথিকরা, যাদের বিরুদ্ধে মাও বৃহৎ উল্লম্ফন নীতির মধ্য দিয়ে আদর্শগত লড়াই চালাতে চাইছিলেন, শুধু যে সেই লড়াইকেই বিপথগামী করে দিতে সচেষ্ট হয় তা নয়, একই সঙ্গে উৎপাদনের নানা উপভাগে গণ্ডগোল লাগিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলে মাও-নেতৃত্বকে মলিন করতে চেয়েছিল। এই সমস্ত ঘটনার মিলিত ফল হিসাবেই সেই তিন বছরে একটানা খাদ্য সঙ্কটে চিনে প্রায় দেড় কোটি লোক মারা গিয়েছিল। [Henry C. K Liu, “The Great Leap Forward not all bad”; Asia Times Online Co. Ltd., 1 April 2004]

হাল আমলে চিনের সেই দুর্ভিক্ষের উপরে যে সমস্ত বই বেরিয়েছে, যাতে চিনা সমাজতন্ত্রকে যতটা পারা যায় কালো কালিতে দেখানো হয়েছে, সেইগুলিকে এক সঙ্গে বিচার করে বিশিষ্ট ভাষাবিদ নোয়াম চমস্কি তাঁর একটি রচনায় কিছু মূল্যবান বিশ্লেষণ ও মন্তব্য করেছেন। তার একটা অংশে আছে শুধুই অঙ্কের হিসাব। তাও আবার সেই অঙ্কগুলি অমর্ত্য সেনেরই দেওয়া। আমি সেই জায়গাটুকু শ্রীরায়ের অবগতির জন্য (একটু ভাষাগত সংক্ষেপন করে) উদ্ধার করতে চাই:

“অধ্যাপক সেনের কথার উপর নির্ভর করে আমরা তো চিনকে অনেক গালাগালি করলাম। বইপত্তর গোটানোর আগে সেন আরও কী কী বলেছেন সেটা যদি একবার দেখে নিতাম। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ভারত আর চিনের অবস্থা কম বেশি একই ছিল। কিন্তু তারপর নাগরিকদের শিক্ষা ও অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষার সঙ্গে মৃত্যুহার ও রুগ্নতা হ্রাস এবং আয়ুষ্কাল বৃদ্ধির ক্ষেত্রে চিনের অবস্থা ধীরে ধীরে ভারতকে অনেক দূর ছাড়িয়ে গেছে। ভারত যদি চিনের ব্যবস্থাপত্তর গ্রহণ করত তাহলে ১৯৮০-র দশকে এসে ভারতে মৃত্যুর ঘটনা বছরে গড়ে ৩৮ লক্ষ কম হত। তার মানে, স্বাধীনতা-উত্তর প্রতি ৮ বছরে ভারতে যত লোক স্রেফ খাদ্যাভাবে বা অস্বাস্থ্যের কারণে মারা যায়, তা চিনের ওই তিন বছরের কেলেঙ্কারির চাইতেও অনেক বেশি (যদিও সেটি ছিল শতাব্দের নিকৃষ্টতম দুর্ভিক্ষ)।” [Noam Chomsky, Rogue States: The Rule of Force in World Affairs, Pluto Press 2000: p. 177]

তবে চমস্কির রসবোধ অসাধারণ। আড্ডার মজলিশে বসলে চট করে থামতে জানেন না। সেনের বই থেকে আরও কী কী কথা খুঁজে বের করেছেন দেখুন।

“চিনের শাসকরা তাদের জনসাধারণের জন্য খাদ্য শিক্ষা স্বাস্থ্য চিকিৎসা ইত্যাদির যে ঢালাও ব্যবস্থা করেছিল ভারতে তার কিছুই নেই। প্রবৃদ্ধির হারের সাথেও এর কোনো সম্বন্ধ নেই। কেন না, বিচার্য সময়কালে ভারত ও চিনের প্রবৃদ্ধির হার ছিল মোটামুটি একই। এটা ছিল সামাজিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা ব্যবস্থার ফল।”

কী বুঝছেন অভিজিৎবাবু? স্বয়ং অমর্ত্য সেনই যে এই সব কথা বলেছেন, আগে কি জানতেন?
সেনবাবুর শ্যেন চক্ষু সেখানেই থামেনি। আরও লক্ষ করেছে,

“কিন্তু চিনের এই সামাজিক রক্ষা কবচগুলি ১৯৭৯ সাল থেকে, অর্থাৎ, খোলা বাজার অর্থনীতি চালু হওয়ার পর থেকে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে, সেই সাথে চিনে মৃত্যু হার বেড়ে যায়, আয়ুষ্কাল সামান্য হলেও কমে যায়। মেয়েদের গড় আয়ু অন্তত দু বছর কমে যায়। নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে, নারী-পুরুষের অনুপাত হ্রাস পায়। কেন না, বাজার ভিত্তিক অর্থনীতি এইসব সামাজিক সুরক্ষার জন্য অনুৎপাদক অর্থব্যয়ে রাজি নয়।” [Ibid, pp. 177-78]

বাকি কথাটা আর অনুবাদে না দিয়ে চমস্কির নিজস্ব চমকপ্রদ ভাষাতেই পেশ করি:

“We therefore conclude that in India the democratic capitalist “experiment” since 1947 has caused more deaths than in the entire history of the “colossal, wholly failed … experiment” of Communism everywhere since 1917: over 100 million deaths by 1979, and tens of millions of more since, in India alone.” [Ibid, p. 178]

একজন সাদা চামড়ার সাহেব আমাদের একজন খ্যাতিমান বাঙালির বই থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন, দেখেও আনন্দ আর গর্ব হয় বৈকি! ভেবে দেখুন, যদি এই আনন্দ ও গর্ব আমার সাথে শেয়ার করতে রাজি থাকেন, তাহলে কিন্তু চিন সম্পর্কে, মাও সম্পর্কে এবং চিনের দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে আপনার মতটাকে সামান্য সংশোধন করতে হবে। তাতে যদি বৈদিক ঋষিদের মতো আমাদেরও এক আধবার “অসতো মা সদ্গময়ো” হয়, তাতেই বা ক্ষতি কী?

পোল পোত বনাম র‍্যাম্বো

সত্য আবিষ্কারে ধনতান্ত্রিক মুক্ত দুনিয়ার আগ্রহের অনেক নমুনাই তো আমরা জানি। আপাতত তার আর একটা নমুনার কথা বলি। কাম্পুচিয়া প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করলে এর একটা নতুন দিক আমাদের কাছে উন্মোচিত হতে পারে। তার ফলে আরও অনেক কিছু বুঝতে আমাদের সুবিধা হবে।

১৯৭৪ সালে কাম্পুচিয়ায় মার্কিন আধিপত্যের পতন ঘটে এবং পোল পোতের নেতৃত্বে খেমের রুজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তারপর পোল পোত প্রশাসন কাম্পুচিয়ায় কিছু সামাজিক-অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি নেয়। রাজধানী নমপেন শহর তখন লুম্পেনে ভর্তি, নারীদের এক বিরাট অংশকে গ্রাম থেকে পয়সার লোভ দেখিয়ে তুলে এনে দখলদার বাহিনী দেহব্যবসায় নামিয়ে দিয়েছিল। তাদেরকে সরিয়ে গ্রামাঞ্চলে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে উৎপাদনমূলক কাজে নিযুক্ত করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে এবং পাশাপাশি নমপেন শহরকে নতুনভাবে পুনর্গঠিত করতে গিয়ে তাঁদের ব্যাপক জনসংখ্যার স্থানান্তরণের ব্যবস্থা করতে হয়। তার মধ্যে হয়ত কিছু যান্ত্রিকতা বা জবরদস্তিও ছিল। কিন্তু আমেরিকান আগ্রাসনকারীদের এটা একদম মনঃপুত হয়নি। তারা বুঝে ফেলে, পোল পোতের এই কর্মসূচি একবার সফল হয়ে গেলে আর তাদের পক্ষে ভবিষ্যতে কোনো প্রকারে ওখানে ঢোকা সহজ হবে না।

শুরু হল খেমের রুজের বিরুদ্ধেও একই রকম অপপ্রচার। লক্ষ লক্ষ খুনের গল্প। হলিউডে তৈরি হল সিনেমা—র্যা ম্বো ওয়ান, র্যা ম্বো টু। দেখলে গা একেবারে শিউড়ে ওঠে। এই খুনের গল্প তো অভিজিৎবাবু সহ দুনিয়ার প্রায় সকলেই জানেন। কিন্তু আর একটা ছোট গল্প, যেটা আমি এখানে বলতে চাইছি, কত জন জানেন?

ব্রিটেন থেকে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ-এর ইতিহাসের অধ্যাপক ম্যালকম কডওয়েল ১৯৭৮ সালে গিয়েছিলেন কাম্পুচিয়ায় সরেজমিনে তদন্ত করে দেখতে ওখানে সত্যি সত্যিই কী ঘটছে। নমপেন থেকে যাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, কী কাজে লাগানো হয়েছিল—এই সব তিনি স্বচক্ষে দেখে দেখে স্টোরি তৈরি করে দিচ্ছিলেন। চার কিস্তি লেখা পাঠানোর পর এক রাতে (পর দিন তাঁর দেশে ফেরার বিমান ধরার কথা ছিল) নম পেনের এক বিখ্যাত আন্তর্জাতিক অতিথিশালায় তাঁকে একদল আততায়ী মাঝরাতে গুলি করে মেরে ফেলে। (বহুকাল বাদে, ২০০৫ সালে একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক তাঁর বইতে জানিয়েছেন, খুব সম্ভবত ভিয়েতনাম থেকে ওই আততায়ীরা এসেছিল; কডওয়েলের হত্যাকাণ্ডের তিন দিন পরেই ভিয়েতনাম কাম্পুচিয়া আক্রমণ করেছিল)। কেন জানেন? যে সমস্ত রিপোর্ট তিনি পাঠাচ্ছিলেন তাতে পোল পোত বিরোধী অপপ্রচারের ছাল চামড়া ছাড়িয়ে আনছিলেন। খোঁজ নিয়ে দেখুন, এই নিহত অধ্যাপকের কথা, তাঁর খুন হওয়ার ঘটনা, তাঁর চার কিস্তি লেখার মালমশলা—কটা লোক আজ জানেন? ভারত-বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলিরও খুব বেশি নেতা-কর্মী সম্ভবত আজকে আর এসব জানেন না বা মনেও করতে পারেন না।

তার চেয়েও মজার কথা কি জানেন? আজ যারা পোল পোতের নিন্দায় মুখর তাঁরাও লিখতে বাধ্য হচ্ছেন, “In May 1975, one month after the Khmer Rouge evacuated the capital, the Swedish author Per Olov Enquist wrote: “The brothel has been emptied and the clean-up is in progress. Only pimps can regret what is happening.” If that was blatant wishful thinking, it’s an unpalatable truth that the pimps have returned. A potent mix of Developing World poverty, cheap flights and sexual licence has made Cambodia a magnet for sex tourists and paedophiles. The upmarket hotels around the riverside are full of western and Japanese businessmen, and a certain kind of furtive middle-aged traveller, stubble-chinned and plump-stomached, is a conspicuous presence in the bars and clubs frequented by young and under-age prostitutes.” [Andew Anthony, “Lost in Cambodia”; The Observer; 10 January 2010;
অন-লাইনে পাওয়া যায়; মোটা হরফ আরোপিত] এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন খেমের রুজ এবং পোল পোতকে ওরা কেন এত খারাপ বলে?

আপাতত শেষ কথা
অতএব আমাদের সাবধানে পা ফেলতে হবে। সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে আমরা যে বেশি স্পর্শকাতর তার কারণ আমরা এর কাছে অনেক কিছু প্রত্যাশা করেছি। আমরা ব্রিটিশ আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের কাছে ভালো কিছুই প্রত্যাশা করিনি। আমরা জানতাম, তারা আমাদের দেশ ভাগ করেছে, কোরিয়াকে ভেঙেছে, ভিয়েতনামকে দু টুকরো করার চেষ্টা চালিয়েছে। চিন থেকে এক টুকরো বেগুনি (তাইওয়ান) ছিঁড়ে নিয়ে গিয়ে তাকেই দু দশক ধরে রাষ্ট্রসংঘে আসল চিন বলে চালিয়েছে, প্যালেস্টাইনকে ভেঙে ইস্রায়েল বানিয়ে শেষে প্যালেস্টাইনকেই ভিখিরি করে ফেলেছে, তারাই জার্মানি এবং বার্লিন শহরকে দুভাগ করে গোটা দায় চাপিয়ে দিয়েছে স্তালিনের ঘাড়ে। আমার এক বন্ধু ১৯৯১ সালে জানালেন, পূর্ব বার্লিন থেকে পশ্চিম বার্লিন যাওয়ার সময় তিনি একটি উঁচু তোরণের মাথায় একটা ঘোষণা-বাক্য পড়ে হতভম্ব হয়ে যান: “You are now entering the American territory.” আরও অনেক লোকই তো এটা দেখেছে, কতজন জানতে চেয়েছে, এও কি স্তালিনের কাজ? অর্থাৎ, আমি বলতে চাই, সাবধান না হলে সহজেই ওদের অপপ্রচারের ফাঁদে পড়ে যাব, এবং ওদের কথাগুলো নিজেদের কথা ভেবে বলতে থাকব।

এই পর্ব আমি এখানেই শেষ করতে চাই। যদি পাঠকদের কোনো ক্ষুদ্র অংশেরও আগ্রহ থাকে তাহলে মার্ক্সীয় দর্শনের অন্যান্য দিক, বিজ্ঞান, দ্বন্দ্বতত্ত্ব, ইত্যাদি নিয়ে আরও দুচার কথা হয়ত ভবিষ্যতে বলতে পারি। আমি মনে করি, মার্ক্সবাদ নিয়ে মার্ক্সবাদীদেরও অনেক কিছু নতুন করে ভাববার আছে। মার্ক্সবাদী দলগুলিকেও নানা উৎস থেকে, এমনকি বিভিন্ন অদলীয় উৎস থেকেও, তথ্য, যুক্তি, জ্ঞান, সংগ্রহ করবার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। মার্ক্সবাদের যাঁরা সমালোচনা বা নিন্দা করেন তাঁরা সকলেই তো ধনতন্ত্রের দালাল বলে তা করেন না। বিভ্রান্ত হয়ে, অথবা কিছু কিছু মার্ক্সবাদীর অন্যায় আচরণ দেখে আস্থা হারিয়ে তাঁরা মার্ক্সবাদ বিরোধী প্রচারের স্রোতে ভেসে যান। তাঁদেরকে আমাদের যুক্তি দিয়ে সত্যের অভিকর্ষ দিয়ে গোত্রান্তর ঘটাতে হবে। মিথ্যার পাশাপাশি, অপপ্রচারের পাশাপাশি, সারা দুনিয়া জুড়ে জ্ঞানের চর্চা চলছে, সত্যের সাধনা হচ্ছে। সোক্রাতেস ব্রুনো চার্বাকরা সহজে মরেন না। সহজে তাঁরা হারও মানেন না। খোলা মন নিয়ে তাঁদের খুঁজে নিতে হবে। সকলের সাথে মিলিত হতে হবে। একমাত্র তখনই আমরা প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া শ্রেণির সম্মিলিত অপপ্রচারের ফানুসটা ফাটিয়ে দিতে পারব।