‘মুক্ত-মনা’-এর ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮ তারিখের সংখ্যায় অভিজিৎ রায়ের মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে অবৈজ্ঞানিকতার অভিযোগ [এবং তৎসহ ৪ সেপ্টেম্বর ও ২৬ অক্টোবরের সংখ্যায় তাঁর কিছু সমালোচনার উত্তর] পাঁচ বছর বাদে সেদিন হঠাৎ করে আমার দৃষ্টিগোচর হল। আমরা শ্বেতকেশধারীরা এখনও আধুনিক অনেক কেতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি বলে মুদ্রিত বইয়ের বাইরে ই-পাঠে ততটা সহজ যাতায়াত করে উঠতে পারছি না। ফলে সেখানকার অনেক কিছুই আমার অন্তত নজরের বাইরে থেকে যাচ্ছে। কেউ ধরিয়ে দিলে চেষ্টা চরিত্র করে পড়ে নিই। এটাও তেমন করেই বাংলাদেশের দু-একজন শুভানুধ্যায়ীর সৌজন্যে আমার হাতে (আসলে চোখে) এসে গেল। এবং পড়ে বেশ অবাক হলাম। অবাক এই কারণে হইনি যে মার্ক্সবাদী চিন্তাধারাকে অবৈজ্ঞানিক বলা হয়েছে। অবাক হয়েছি অন্য একটা কারণে। আমি অনেক দিন ধরেই অভিজিৎ রায়ের লেখার খুব ভক্ত। বিজ্ঞান বিষয়ক লোকপ্রিয় লেখায় ওনার হাত খুব পাকা। আমি নিজেও যেহেতু বিজ্ঞানের লোকপ্রিয়করণের কাজে অনেক দিন ধরে যুক্ত আছি, জানি কাজটা কত কঠিন। হিগ্স বোসন নিয়ে গত বছর ওনার মুক্তমনায় প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে আমার একটা লেখাতেও আমি কিছু মালমশলা হাতিয়েছিলাম এবং যথাস্থানে তার ঋণস্বীকৃতিও দিয়েছিলাম। তাই, এই বিষয়ে উনি যে যুক্তিধারা অবলম্বন করেছেন তাতেই আমি বেশ আশ্চর্য হয়ে গেছি। মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে বহু মানুষ বহু দিন ধরেই অনেক নিন্দা সমালোচনা করে আসছেন। তার দার্শনিক বৈজ্ঞানিক ভিত্তিকে আক্রমণ করে তার তাত্ত্বিক যৌক্তিকতাকে খণ্ডন করে যাচ্ছেন। অভিজিৎ রায়ের দু কিস্তি রচনাতেও অন্তত ছাব্বিশ জনের উল্লেখ রয়েছে যাঁরা মার্ক্সবাদকে ভুল প্রমাণ করেছেন। মুশকিল হচ্ছে, তার পরেও তাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য আবার অভিজিৎ বাবুকে কলম ধরতে হয়েছিল, যাতে প্রমাণ হয়, মার্ক্সবাদকে ভ্রান্ত সাবিত করার কাজটা এতদিনেও শেষ করা যায়নি। এর পরেও কাজটা শেষ হয়েছিল কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কেন না, হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই দেখতে পাব, আবার কেউ নতুন করে মার্ক্সবাদকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করতে চলেছেন, নতুন করে যুক্তির ঘুঁটি সাজাচ্ছেন।
লক্ষ করে দেখলাম, অভিজিৎ বাবুর সমালোচনার অভিমুখ শুধু এ নয় যে মার্ক্সবাদ একটি অচল, ভ্রান্ত মতবাদ; তাঁর প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় এই যে মার্ক্সবাদ একটি বৈজ্ঞানিক দর্শন নয়। মার্ক্সবাদকে বিজ্ঞান বলা যায় না। মার্ক্সীয় তত্ত্বের অনেক কিছুই অনেক দিন আগেই ভুল প্রমাণিত হয়ে গেছে। মার্ক্সবাদীরা ধর্মীয় গোঁড়ামির অনুরূপ গোঁড়ামি করে একে এখনও বৈজ্ঞানিক মতবাদ বলে ঘোষণা করে চলেছে। তিনি মনে করেন, মার্ক্সীয় মতবাদের একটা মানবিক আবেদন আজও আছে, তাকে অস্বীকার করা যায় না বা করার প্রশ্নও ওঠে না। কিন্তু একে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারা আর কোনোমতেই বলা যায় না।
এমনিতে এত পুরনো একটা লেখার পক্ষে বিপক্ষে এতকাল পরে মতামত দেবার কোনো মানে হয় না। কিন্তু যেহেতু মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে অনেকেই এই ধরনের সমালোচনা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গণ মাধ্যমে করে চলেছেন, এবং যেহেতু তার মধ্যে এই রচনাটি যুক্ত-তর্কের দিক থেকে একটু উন্নত গোছের, ভেবে দেখেলাম, এর প্রত্যুত্তর আরও অনেকের সমগোত্রীয় লেখার উত্তর হিসাবে কাজ করতে পারে। তাই এই নিবন্ধের অবতারণা।
কোথায় ভুল?
আমি আমার এই আলোচনার শুরুতেই একটা কথা পরিষ্কার করে নিতে চাই, মার্ক্সবাদকে যিনি ভুল প্রমাণ করতে চাইবেন তাকে প্রথমেই বলতে হবে কোথায় তিনি ভুল ধরতে চান। এর তত্ত্ব কি ভুল প্রমাণিত হয়েছে, নাকি এর প্রয়োগ ব্যর্থ হয়েছে? অথবা তিনি কি মার্ক্সবাদের প্রয়োগের ব্যর্থতা দেখিয়ে এর তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করতে চান? প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ এইজন্য যে অতীতের সমালোচকদের মতোই অভিজিৎ বাবুর রচনায়ও দেখলাম আগাগোড়াই এই দুটো ভিন্ন প্রশ্নের মধ্যে বারে বারে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে।
অর্থাৎ, আমার বক্তব্য হল, মার্ক্সবাদকে তিনভাবে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করা যায়।
১) এর তত্ত্বটাই আদতে ভুল; সুতরাং প্রয়োগে তো আর সঠিক কিছু হতে পারে না; কিংবা,
২) এর তত্ত্ব ঠিক থাকলেও যারা এর প্রয়োগ করেছে তারা এত ভুল করেছে যে একে আর গ্রহণ করা যায় না; অর্থাৎ, এর তত্ত্ব এতটাই কল্পবিলাসিতা যে এর প্রয়োগ তথা সঠিক প্রয়োগ হওয়া সম্ভবই নয়;
৩) এর প্রয়োগের ব্যর্থতাই প্রমাণ করেছে যে এর তত্ত্বটাও ভুল।
সতর্কভাবে লক্ষ করলেই বোঝা যাবে, এই তিনটি দৃকপাত (approach)-এর মধ্যে কিন্তু পার্থক্য রয়েছে। দুঃখের কথা হল, অধিকাংশ সমালোচকই এই তিনটি দৃকপাতকে মিলিয়ে-গুলিয়ে ফেলেন এবং একই সঙ্গে একবার এটা আর একবার ওটার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকেন। অভিজিৎ বাবুর ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। যাঁরা এইভাবে যুক্তিতর্ক করেন, তাঁরা বুঝতে পারেন না, একটা তত্ত্ব বা মতবাদকে ভুল প্রমাণ করার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বা তৃতীয় দৃকপাত কখনও কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে না। প্রথম দৃকপাতই একমাত্র এই ব্যাপারে আমাদের সঠিক পথ দেখাতে পারে।
ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি।
ধরুন, মেনে নেওয়া গেল যে মার্ক্সবাদের প্রয়োগ ব্যর্থ হয়েছে। কেন না, এ তো দেখাই গেছে, যে সমস্ত দেশে একদিন মার্ক্সবাদ মেনে নিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই সব দেশে তা এক সময় তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। এটাও না হয় মেনে নেওয়া গেল যে পূর্বতন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে কমিউনিস্ট পার্টির তরফে অনেক অত্যাচার নির্যাতন হয়েছে, ইত্যাদি। তাতেই বা আসলে কী প্রমাণ হয়? এই সব ঘটনা নীচে উল্লিখিত দুটোর যে কোনো একটা কারণে ঘটে থাকতে পারে। [ক] মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রের তত্ত্বটাই এমন যে যেখানেই সমাজতন্ত্র নির্মিত হবে সেখানেই ঠিক এই সমস্ত ঘটনাই ঘটবে। এবং এই কারণেই রাশিয়ায় বা চিনে আমরা যা যা ঘটতে দেখেছি তা ঘটেছিল। [খ] না, মার্ক্সীয় তত্ত্বে এরকম কোনো অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হওয়ার কথা নেই। কিন্তু যারা একে প্রয়োগ করেছে দেশে দেশে, তারা এর আসলে অপপ্রয়োগ ঘটিয়েছে। তার ফলেই ইতিহাস-দৃষ্ট দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাগুলি ঘটেছে।
আবার আমি সতর্ক পাঠককে বলছি, প্রয়োগের ব্যর্থতা দেখিয়ে মার্ক্সবাদকে মতবাদ হিসাবে ভ্রান্ত প্রমাণ করতে গিয়ে এই দুটো যুক্তির মধ্যে যে কোনো একটা আপনাকে বেছে নিতেই হবে। আপনি যদি [ক]-যুক্তিধারা মেনে নেন, তাহলে আপনার আর কষ্ট করে সমাজতন্ত্রের প্রয়োগ পর্যন্ত যাওয়ার দরকারই হচ্ছে না। মার্ক্সের তত্ত্বটাকে ধরেই আপনি তাকে ভুল প্রমাণ করে দিতে পারছেন। আপনি দাবি করতে পারেন, যেখানেই এর প্রয়োগ হবে সেখানেই এই রকম পরিণতি দেখা দেবে। তাছাড়া যে তত্ত্ব বা মতবাদকে যুক্তিতর্ক দিয়েই ভুল বলে সাব্যস্ত করা যায়, তার প্রয়োগের ভালোমন্দ নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতেই বা যাব কেন?
পক্ষান্তরে, আপনি যদি [খ]-যুক্তি স্বীকার করেন, তাহলে রাশিয়ায় বা চিনে বা রুমানিয়ায় যা কিছু ঘটেছে তার জন্য তো আপনি মার্ক্সবাদকে বা মার্ক্সকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করতে পারেন না। মার্ক্সবাদ বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা কিনা তাও এর দ্বারা মীমাংসা করা যায় না। স্বয়ং বিজ্ঞানকেই যেখানে অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে, প্রকৃতিবিজ্ঞানের উপকারী আবিষ্কারকে মানবজাতির ক্ষতিসাধনে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানে মার্ক্সীয় সমাজতাত্ত্বিক সঠিক চিন্তাকে তো ভুল রাস্তায় অপপ্রয়োগ করা যেতেই পারে। হয়ত সেটাই ঘটেছে বাস্তবে।
এই কারণেই আমি বলেছিলাম, প্রথমেই আমাদের ঠিক করে নিতে হবে আমরা মার্ক্সবাদকে ভুল বা অবৈজ্ঞানিক প্রমাণ করার কাজে কীভাবে এগোব। আমি আশা করেছিলাম, নিয়মিত বিজ্ঞান লেখক হিসাবে শ্রীরায় এই বৈজ্ঞানিক যুক্তিবিচার পদ্ধতি সম্বন্ধে সচেতন হবেন। সস্তার সহজ পথে তিনি হাঁটবেন না। কিন্তু না! মার্ক্সবাদ এমনই একটা স্পর্শকাতর অভিপাদ্য যে এ নিয়ে শুধু যে মার্ক্সবাদীরাই ধর্মীয় গোঁড়ামি বা ওই জাতীয় আচরণ করে বসেন তা নয়, যাঁরা গোঁড়ামি মুক্ত মনে একে বিরোধিতা করতে যাচ্ছেন বলে ভাবেন তাঁরাও শেষ অবধি বৈজ্ঞানিক বিচারধারায় আস্থা রাখতে পারেন না। হয়ত মনের অগোচরে তাঁদেরও এই আশঙ্কা থাকে যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কাজটা সুষ্ঠভাবে হাসিল হবে না।
কোনটা ভুল?
লেনিনের কথার সূত্র ধরে সকলেই জানেন,অভিজিৎ বাবুও তাঁর প্রবন্ধে শুরুতেই পরোক্ষভাবে মেনে নিয়েছেন, মার্ক্সীয় মতবাদের মধ্যে তিনটি প্রধান অংশকে লক্ষ বা চিহ্নিত করা যায়:
(১) দার্শনিক অধিকাঠামো,
(২) সমাজতাত্ত্বিক ইতিহাস, এবং
(৩) রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, যাঁরা আজ মার্ক্সবাদকে ভুল প্রমাণ করতে চান, তাঁরা এর কোন অংশকে ভুল বলতে চাইছেন? ব্যাপারটা যদি এমন হয়, তাঁরা সমস্তটাকেই ভুল সাব্যস্ত করছেন, তাহলে এক কথা। সেটাও কেউ চাইলে করতেই পারেন। সেক্ষেত্রে তাঁকে সেটা খোলসা করে বলে রাখতে হবে। আবার কারোর মনে হতে পারে, মার্ক্সীয় দর্শনের বিরুদ্ধে আপত্তি করার কিছু নেই, কিন্তু মার্ক্স ইতিহাসকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বা অর্থনীতির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তার মধ্যে গলদ আছে। এমনকি যাঁরা মার্ক্সীয় দর্শনকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন, তাঁদের মধ্যেও একদলের মতে মার্ক্স তাঁর মতবাদকে কোথাও বস্তুবাদ বা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হিসাবে উপস্থাপন করেননি, মার্ক্সবাদকে এই অভিধা দিয়ে গেছেন প্লেখানভ, লেনিন এবং স্তালিন, ইত্যাদি; কারোর মতে, মার্ক্সীয় দ্বন্দ্বতত্ত্ব শুধুমাত্র সমাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, প্রকৃতির ক্ষেত্রে তাকে প্রয়োগ করাটাই ভুল হয়েছে, এবং এই ভুলের জন্য তাঁরা এঙ্গেল্সকেই মূলত দায়ী করেন। বিপরীত দিকে আর এক দল আছেন যাঁরা মনে করেন, মার্ক্সের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বা ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা নামে যে মতবাদ অনেক দিন ধরে সমাজে চালু আছে তাও মার্ক্সের নিজস্ব চিন্তা নয়, সেও নাকি এঙ্গেল্স ও পরবর্তীকালের মার্ক্সবাদীরা মার্ক্সের নামে বাজারে ছেড়েছেন। এছাড়া, লেখক যাঁদের নাম বলেছেন, বম-বাওয়ার্কে, জেভন্স, প্রমুখ—তাঁরা আবার মার্ক্সীয় দর্শন দ্বন্দ্বতত্ত্ব সমাজতত্ত্ব ইতিহাস ব্যাখ্যা ইত্যাদি নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাননি। তাঁরা সরাসরি মার্ক্সের অর্থনৈতিক তত্ত্বকে সমালোচনা করেছেন, মুল্যের শ্রম-তত্ত্বকে আক্রমণ করেছেন, পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ড আর তৃতীয় খণ্ডের প্রতিপাদ্যের মধ্যে পরস্পর-বিরোধিতা আবিষ্কার করেছেন, এবং এইভাবে মার্ক্সের অর্থনৈতিক তত্ত্বকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করে গেছেন।
শ্রীরায় এরকম স্পষ্ট ভাষায় না বললেও তাঁর সমগ্র লেখা পড়ে মনে হল, তিনি মার্ক্সীয় দর্শন থেকে শুরু করে তার ইতিহাস বিশ্লেষণ এবং আর্থসামাজিক ব্যাখ্যা—এক কথায় সব কিছুকেই ভ্রান্ত সাব্যস্ত করতে চান। যদি আমার এভাবে মনে করে নেওয়াটা ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে আমি তাঁর প্রবন্ধ থেকে তাঁর প্রধান প্রতিপাদ্য সিদ্ধান্তগুলিকে এইভাবে সাজিয়ে নিতে পারি:
(১) মার্ক্সের দ্বন্দ্বতত্ত্ব ভুল; মার্ক্স নাকি নিজেও বলেছেন, সাম্যবাদী সমাজে দ্বন্দ্ব থাকবে না;
(২) মার্ক্স ইতিহাসের গতিধারা বিশ্লেষণ করে সমাজবিপ্লব সম্পর্কে যা যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তার একটাও বাস্তব তথ্যের সাথে মেলেনি। সমাজতন্ত্র থেকে সাম্যবাদী সমাজের দিকে অগ্রসর হওয়ার বদলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাই ভেঙেচুরে গেছে;
(৩) মার্ক্স পুঁজিবাদের সম্পর্কে যা কিছু বলে বা ভেবেছিলেন তাও বর্তমানকালে ভুল প্রমাণিত হয়েছে; শ্রমিক শ্রেণির চরিত্র বা সংগঠন বদলে গেছে, ইত্যাদি;
(৪) উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাত করে পুঁজিপতিদের মুনাফা লাভ করার মার্ক্সীয় তত্ত্ব বাস্তব দুনিয়ার হালহকিকত নাকি ভ্রান্ত সাব্যস্ত করেছে; মূল্যের শ্রমতত্ত্ব অনেক দিন আগেই ভুল প্রমাণিত;
(৫) মার্ক্সের মতবাদ কার্ল পপারের অপ্রতিপাদনীয়তার নিয়মকে অগ্রাহ্য করে; সেই অর্থে মার্ক্সবাদকে আর কোনোমতেই বৈজ্ঞানিক মতাদর্শ হিসাবে মেনে নেওয়া যায় না; ইত্যাদি; ইত্যাদি।
এইভাবে দেখলে মনে হয়, মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে এযাবত যা কিছু অভিযোগ তোলা হয়েছে, যা যা সমালোচনা করা হয়েছে, রায় তার সব কিছুকেই স্বীকার করে নিয়েছেন এবং সঠিক বলে মেনে নিয়েছেন। তার ভিত্তিতে তিনি ধরে নিয়েছেন, এত সব খণ্ডন ও সমালোচনার পরেও যাঁরা মার্ক্সবাদ মেনে চলেন বা মার্ক্সবাদকে একটা বৈজ্ঞানিক মতাদর্শ হিসাবে স্বীকার করেন তাঁরা একটা ধর্মীয় অন্ধ বিশ্বাসের মতো করেই মার্ক্সবাদকে দেখেন। তিনি চেষ্টা করছেন তাঁদের ঘুম ভাঙানোর, তাঁদের মধ্যে যুক্তিবোধ জাগ্রত করার।
আমি এই নিবন্ধে অভিজিৎ বাবুর বক্তব্যের প্রথমটি বাদ দিয়ে বাকি চারটি বিন্দুর সমালোচনাকে বিচার বিশ্লেষণ করে আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি অনুযায়ী মার্ক্সবাদের সপক্ষে কিছু কথা বলতে চাই। আশা করি, রায় সেগুলোও বিবেচনা করে দেখবেন। প্রথমটি, অর্থাৎ, দর্শনের প্রসঙ্গটি নিয়ে আলাদাভাবে বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে। অন্য কোনো খানে।
পপারের কষ্টিপাথর
আমি আমার কথার সূচনা করতে চাই কার্ল পপারের বিখ্যাত বৈচারিক মাপকাঠির কথা সামনে রেখেই। পপার যে কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বিচার প্রসঙ্গে একটি মাপকাঠি প্রয়োগের কথা বলেছিলেন, যা বিজ্ঞানের ইতিহাসে অপ্রতিপাদনীয়তার নিয়ম (falsifiability criterion) হিসাবে খ্যাত। পপার ১৯৩৪ সালে তাঁর জার্মান ভাষায় রচিত বিখ্যাত বই, ইংরেজি অনুবাদে যেটি এখন সারা পৃথিবীতে সুপরিচিত (The Logic of Scientific Discovery), তাতে এই নিয়মটিকে তুলে ধরেন।
এর পেছনে একটা লম্বা ইতিহাস আছে যেটিও এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা দরকার। বিজ্ঞানের দর্শনে যা অভিজ্ঞতাবাদ (empiricism) বা পরবর্তীকালে প্রত্যক্ষবাদ (positivism) নামে খ্যাত, তার তরফে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বিচারের জন্য প্রদত্ত মাপকাঠিটি ছিল প্রতিপন্নতা (verifiability)। পপার এতে আপত্তি তুললেন। বললেন, একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যতগুলো পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষার ফলাফলের দ্বারাই সঠিক প্রতিপন্ন হোক না কেন, যদি একটা কোনো পর্যবেক্ষণ বা ফলের দ্বারাও অপ্রতিপন্ন হয়, তা তৎক্ষণাৎ ভ্রান্ত প্রমাণিত হবে। সুতরাং কতবার প্রতিপন্ন হয়েছে তার থেকেও বড় প্রশ্ন হল এ পর্যন্ত তাকে ভুল প্রমাণ করার মতো কিছু পাওয়া গেছে কিনা। যতক্ষণ তা না পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণই তাকে সঠিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসাবে মেনে চলতে হবে। এইভাবে, প্রতিপন্ন হওয়ার চেয়েও অপ্রতিপন্ন না হওয়ার উপরেই তিনি বিজ্ঞানের তত্ত্বকে গ্রহণ করার ভিত্তি করতে চেয়েছেন। এটুকু বলেই পপার থামেননি। তাঁর মতে, বিজ্ঞানীকেই তাঁর তত্ত্বের ভিত্তিতে বলতে হবে, কী কী পর্যবেক্ষণ বা ফল পেলে তাঁর প্রদত্ত তত্ত্ব ভ্রান্ত সাব্যস্ত হবে। এই একই বিষয়কে তিনি আবার একটু অন্যভাবেও রাখলেন। যে কোনো তত্ত্বকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মর্যাদা পেতে হলে তার ভিত্তিতে এমন কিছু সিদ্ধান্তের কথা বলতে হবে যা পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব, বা পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা সম্ভব। পরীক্ষার ফল এবং/অথবা পর্যবেক্ষণের সাথে পুর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত না মিললে তত্ত্বটিকে বর্জন করে নতুন তত্ত্বের সন্ধান করতে হবে। আধুনিক বিজ্ঞানের দর্শনে পপারের এটি একটি অত্যন্ত মূল্যবান অবদান। পপার মার্ক্সবাদ বিরোধী বলে অধিকাংশ মার্ক্সবাদীও সাধারণত তাঁর এই অবদানের স্বীকৃতি দিতে চান না।
কিন্তু এর পর আরও কিছু কথা আছে। পপারের এই অপ্রতিপাদনীয়তার নিয়মকে মেনে নেবার মানে এটা নয় যে প্রতিটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে প্রাপ্য মর্যাদা পাওয়ার জন্য নিজেকে আগে ভ্রান্ত প্রমাণ করতে হবে। কিংবা এটাও নয় যে, যে সমস্ত তত্ত্ব এযাবত ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে সেগুলিই একমাত্র বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব; আর যেগুলি এখনও অবধি ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হয়নি বা যাদেরকে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করা যায়নি সেগুলি বিজ্ঞানে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। পপার শিশুও ছিলেন না, অপরিণত-মস্তিষ্কও ছিলেন না যে তাঁর নীতিটির এরকম একটা আজগুবি তাৎপর্য দাঁড় করাবেন। আর তার চেষ্টা করলে তাঁর এই নীতিটি বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীদের উৎসাহিতও করতে পারত না।
পপারের মার্ক্সবাদ বিরোধী যুক্তিগুলি আমি এখানে আলোচনা করব না। করতে হলে প্রবন্ধ অনেক বড় হয়ে যাবে এবং মূল লক্ষ্য থেকে সরে যেতে থাকবে। পরে অন্য কোনো সুযোগে তা করা যাবে। আপাতত আমার বিচার্য, মার্ক্সবাদ পপারের এই নিয়মকে অস্বীকার করে, না মেনে চলে।
কিন্তু তার আগে বুঝে নেওয়া দরকার, মার্ক্সীয় তত্ত্বের মৌলিক সিদ্ধান্ত বলতে কী বোঝায়। মার্ক্স এবং এঙ্গেল্স আশা করেছিলেন, শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে, তথা ইংলন্ড ফ্রান্স জার্মেনি হল্যান্ডে আগে শ্রমিক বিপ্লব হবে। বিপ্লব আগে হল রাশিয়ায়। তারপর মঙ্গোলিয়ায়, চিনে, ভিয়েতনামে। পপারীয় মাপকাঠিতে কি মার্ক্সবাদ ভ্রান্ত সাব্যস্ত হল?
না। হল না। কারণ, ওটা মার্ক্সবাদের একটা কোনো তাত্ত্বিক বা মৌলিক সিদ্ধান্ত নয়। ওটা ছিল মার্ক্স এবং এঙ্গেল্সের একটা তাৎক্ষণিক ধারণা, ইউরোপের সমসাময়িক ঘটনাবলির একটা অধিপাঠ (reading), বড় জোর একটা উপসিদ্ধান্ত। অনেকটা আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সেই কুখ্যাত ল্যাম্বডার মতো।
তাহলে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে মার্ক্সীয় মতবাদের তত্ত্বগত মৌলিক সিদ্ধান্ত বলতে কী বোঝায়? উদাহরণ হিসাবে নীচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিন্দু উল্লেখ করছি (সংক্ষেপে উপস্থাপন করার জন্য স্বভাবতই এই বিবৃতিগুলিকে সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না বলে শ্রীরায় এবং পাঠকদের কাছে আগাম মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি):
ক) উৎপাদিকা শক্তি আর উৎপাদন সম্পর্কের নিরন্তর দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে মানব সমাজের বিকাশ বিবর্তন স্থিতি ও বিপ্লব ঘটে চলেছে। যতক্ষণ একটা সমাজ কাঠামো তার অভ্যন্তরস্থ উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সাথে উৎপাদন সম্পর্কের সামঞ্জস্য বজায় রাখতে পারে, সেই সমাজ বিকশিত হতে থাকে ও স্থায়িত্ব লাভ করে। যখন এই সামঞ্জস্য ভেঙে যায়, সেই সমাজের স্থায়িত্বও নষ্ট হতে থাকে, তার মধ্যে তখন নতুন সমাজ কাঠামো গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই নতুনের সাথে পুরাতনের দ্বন্দ্ব সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে একটা সময় সেই সমাজ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে পালটে যায়।
খ) ব্যক্তি সম্পত্তির উদ্ভব এবং সমাজ শ্রেণি বিভক্ত হওয়ার পর থেকে এই দ্বন্দ্ব শ্রেণি সংগ্রামের রূপে প্রকাশিত হতে থাকে। রাষ্ট্র গড়ে ওঠে শাসক শ্রেণির শাসনের প্রধান হাতিয়ার হিসাবে। সেদিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সমস্ত ধরনের রাষ্ট্রই এক শ্রেণির দ্বারা অন্যান্য শ্রেণির উপর দমন পীড়নের যন্ত্র। কোনো রাষ্ট্রই শ্রেণী-নিরপেক্ষ শাসন যন্ত্র নয়। সমাজ পরিবর্তন প্রথমত এবং প্রধানত এই রাষ্ট্রচরিত্রের পরিবর্তন, বা আরও সঠিক ভাবে বলতে গেলে, এক শ্রেণির বিশেষ ধরনের রাষ্ট্রের পরিবর্তে অন্য শ্রেণির অন্য ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা।
গ) যে কোনো একটা সমাজব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি বুঝতে হলে তার দুটো অংশকে চিহ্নিত করতে হবে (অনেকটা যেন তার শারীরসংস্থা এবং শারীরবৃত্ত): উৎপাদন সম্পর্কের নিরিখে তার অর্থনৈতিক ভিত এবং সেই ভিতের আধারে নির্মিত তার উপরকাঠামো। দাস-মালিক সমাজের উপরকাঠামোর সাথে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের উপরকাঠামো মিলবে না; রাজা-প্রজা ভিত্তিক সামন্তী সমাজের উপরকাঠামোর সঙ্গেও তেমনই পুঁজিতন্ত্রের সামাজিক সংগঠন এক রকম হবে না।
ঘ) উৎপাদন চক্রে বাড়তি মূল্য কোত্থেকে আসছে—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে জানতে হবে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিজড়িত উপাদানগুলির মধ্যে এমন কী আছে যা উৎপন্ন দ্রব্যে নিজের মূল্যের তুলনায় কিছু বাড়তি মূল্য যোগ করতে পারে। এই প্রশ্নের সমাধান করতে গিয়েই অ্যাডাম স্মিথ ডেভিড রিকার্ডো প্রমুখ বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ মূল্যের শ্রম তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। এটা না বুঝলে শুধু পুঁজিবাদের বর্তমান স্তর নয়, সওদাগরি পুঁজির বিকাশও ব্যাখ্যা করা যায় না। মার্ক্স এই তত্ত্বকেই আরও বিকশিত করে পুঁজিপতিদের শোষণ ও মুনাফার ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সমাজতন্ত্রেও বর্ধিত পুনরুৎপাদনের সমস্যা ব্যাখ্যা করেছিলেন।
ইত্যাদি ইত্যাদি …।
এই সব জায়গায় পপারের সূত্র কাজে লাগানো যাক। দেখা যাক, মার্ক্সবাদ অপ্রতিপাদনীয়তার নিয়ম মেনে চলে কিনা। সতর্ক পাঠক মাত্রই লক্ষ করবেন, উপরের প্রতিটি বিবৃতি অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট। এর কোনোটার মধ্যেই “এ-ও হয় ও-ও হয়” জাতীয় অস্পষ্টতার কোনো সুযোগ নেই। প্রত্যেকটি সিদ্ধান্তকেই চলমান গবেষণায় প্রাপ্ত নিত্য নতুন তথ্যের আলোকে যাচাই করে নেওয়া সম্ভব। প্রতিটি সিদ্ধান্তকেই ব্যতিক্রান্ত তথ্যের দ্বারা বাতিল করা সম্ভব। সে চেষ্টা যে হয়নি বা হচ্ছে না তাও নয়। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত, এই রকম কোনো চেষ্টাই এখন অবধি সুফলপ্রসু হয়নি। হয়নি যে, তার দোষ তো আর মার্ক্সবাদের নয়। আর, আগেই বলেছি, ভুল প্রমাণিত হয়নি বলে বৈজ্ঞানিক চিন্তা বলা যাবে না—এরকম ধারণা পপারীয় সূত্রে নেই এবং থাকতেও পারে না।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
উপরে প্রদত্ত প্রথম সিদ্ধান্তকে নিয়ে বিচার করে দেখা যাক। মার্ক্স এঙ্গেল্স একভাবে সমাজ বিবর্তন ব্যাখ্যা করে তাঁদের এই তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন। এখন যদি দেখা যায়, (α) কোনো একটা পর্যায়ে উৎপাদিকা শক্তির উল্লেখযোগ্য বিকাশ হয়েছে, কিন্তু সমাজ কাঠামোর কোনো আনুষঙ্গিক পরিবর্তন হয়নি; কিংবা, বিপরীতক্রমে, (β) সমাজ কাঠামোয় যথেষ্ট বিবর্তন ঘটে গেছে, কিন্তু উৎপাদিকা শক্তি কম-বেশি একই জায়গায় আছে—তৎক্ষণাৎ মার্ক্সবাদের একটা প্রধান থিসিস বাতিলযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়ে যাবে। ঊনবিংশ শতাব্দের তুলনায় বিংশ শতাব্দে পুরাতত্ত্ব অনেকখানি বিকশিত হয়। মাটির নীচে খোঁড়াখুড়ি করে প্রাচীন ইতিহাসের অনেক কিছু তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ ল্যুইস হেনরি মর্গ্যানের গবেষণার ভিত্তিতে এঙ্গেল্স তাঁর সময়ে আদিম সাম্যবাদী গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজকে যে দুটি প্রধান পর্যায়ে ভাগ করেছিলেন, যার প্রত্যেকটির আবার তিনটি করে উপস্তর ছিল বলে তিনি দেখিয়েছিলেন, পুরাতাত্ত্বিক গবেষণার আলোকে বর্তমানে সেগুলি প্রায় নিখুঁতভাবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক পর্যায়ে সুনির্দিষ্টভাবে ভাগ করে ফেলা সম্ভব হয়েছে। এই কাজ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে: পুরাতত্ত্ববিদ এবং ঐতিহাসিকদেরও আজ মানবসমাজের প্রাচীন পর্যায়গুলিকে সেই উৎপাদনের হাতিয়ারগুলির বিকাশের মাপকাঠিতেই চিহ্নিত করতে হচ্ছে। মর্গ্যান বা এঙ্গেল্স যাকে অসভ্য পর্যায় বলেছিলেন, আজ পুরাতাত্ত্বিকরা তাকেই বলছেন পুরা প্রস্তর যুগ। ওঁরা যাকে বলেছেন বর্বর পর্যায়, আজ তাকেই বলা হচ্ছে নবপলীয় যুগ। আর সভ্যতার বিকাশের সন্ধিক্ষণকে চিহ্নিত করা হচ্ছে ধাতু যুগের উন্মেষ কাল হিসাবে। আরও কিছু দূর এগিয়ে নগর সংস্কৃতির বিকাশ আর ব্রোঞ্জ যুগ মিলেমিশে আছে। তেমনভাবেই মিলে গেছে শ্রেণিবিভাজনের সূচনার সঙ্গে লৌহ যুগের আবির্ভাব। সমাজ সংগঠনের অগ্রগতি এবং উৎপাদনের হাতিয়ারের বিকাশ একেবারে যেন হাত ধরাধরি করে সমান্তরালভাবে চলেছে।
অন্যগুলোকেও এই ভাবে এক এক করে যাচাই করে নেওয়া যেতে পারে।
এছাড়া সমাজবিজ্ঞানে যে কোনো পূর্বাভাসের বাস্তবে মেলা না মেলার ব্যাপারে বোঝা দরকার, এখানে কোনো কিছুই অঙ্কের মতো নিখুঁত হিসাব নিকাশ করে বলা সম্ভব নয়। তার মধ্যে বিপ্লব একটা অত্যন্ত বড় মাপের পরিঘটনা। ১৮৫০-৬০-এর দশকে রাজনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে মার্ক্স বা এঙ্গেল্সের যা মনে হয়েছিল তাঁরা বলেছিলেন। পরবর্তী পরিস্থিতির কিছু সহরাশি (parameter) সামান্য এদিক ওদিক হয়ে যাওয়ার কারণেই হয়ত তাঁদের সেই সব অনুমান বাস্তবায়িত হয়নি। এতে তাঁদের তত্ত্বের কোনো ভুল ধরা পড়ে না। বড় জোর কেউ বিচার করে দেখতে পারেন, তাঁরা পরিস্থিতির মূল্যায়ন সঠিকভাবে করতে পেরেছিলেন কিনা। বা কোন কোন সহরাশির পরিবর্তনের ফলে সেই পূর্বাভাস মেলেনি।
আরও ভাবুন, টস করার সময় যিনি বলেন হেড পড়বে, যদি টেল পড়ে তাতে কি তাঁর বলার মধ্যে কোনো ভুল হয়েছিল বলে বলা যায়? কিংবা মনে করুন, সকালে আকাশে ঘন কালো মেঘের সমাবেশ দেখে আপনি বললেন, আজ মনে হচ্ছে ভারি বৃষ্টি হবে। আপনার মনে মেঘ-বৃষ্টির কার্যকারণ সম্পর্ক নিশ্চয়ই কাজ করেছিল। আর তারপর বেলার দিকে হাওয়া এসে মেঘ ভাসিয়ে নিয়ে গেল, ঝলমলে রোদ উঠল, বৃষ্টি আর হল না। এতে কি আপনার ভেবে রাখা বৃষ্টি-সংক্রান্ত তত্ত্বটা ভুল প্রমাণিত হল? এই ধরনের পূর্বানুমান অহরহ লোকে করছে আর তা মিলছে না। তাতে কোনো তত্ত্বের কিছু যায় আসে না। তত্ত্বটাকে তত্ত্বের জায়গায় গিয়েই বিচার করতে হয়। বিজ্ঞানের অন্য সব ক্ষেত্রে আমরা এটা মনে রাখতে পারি। শুধু মার্ক্সবাদের বেলাতেই কেন যেন এই কথাটা মনে থাকে না।
পরিশেষে লেখককে আধুনিক গবেষণার আরও একটি ধারার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। তিনি পপারের কথা বলেছেন। বিজ্ঞানের দর্শনের আলোচনা এবং মার্ক্সবাদের পর্যালোচনা তো আর পপারেই থেমে নেই। তারপরে তা আরও এগিয়েছে। সেই তথ্যও পাঠকদের জানানো উচিত। যেমন, ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর মাইকেল বুরাওয় ঠিক এই আলোচ্য প্রসঙ্গেই ১৯৯০ সালে যে মূল্যবান গবেষণা পত্রটি লিখেছিলেন, সেটি তাঁকে পড়তে অনুরোধ করি। [Michael Burawoy, “Marxism as Science: historical challenges and theoretical growth”; American Sociological review, Vol. 55 (December 1990), pp. 775-93; অন-লাইন পাওয়া যায়] প্রফেসর বুরাওয়ের বাইরে যথেষ্ট নামডাক না থাকলেও তাঁর বায়োডাটা বলে দিচ্ছে ভদ্রলোক নিতান্ত উপেক্ষণীয় নন। মার্ক্সবাদী চিন্তার আলোকে সমাজতত্ত্ব চর্চা ও গবেষণা করেন বলেই হয়ত তাঁর সেরকম প্রচার হয়নি। বিশ্বের মার্ক্সবাদীদেরও তাঁর এই প্রবন্ধ থেকে কিছু শেখার আছে। তাঁদেরও উচিত এই ভদ্রলোকের রচনার সাথে নিজেদের পরিচিত হওয়া এবং অন্যদের পরিচিত করানো।
কয়েকটি খণ্ডন প্রচেষ্টার ফলাফল
অভিজিৎ রায় কিছু কিছু ভুল প্রমাণের উল্লেখ করেছেন তাঁর প্রবন্ধে। এবার এখানে সে সম্বন্ধে দু-চার কথা আলোচনা করা প্রয়োজন। লেখকের দেওয়া দু-একটি উদাহরণ তুলে ধরে বিচার করে দেখা যাক, কোন কোন প্রশ্নে মার্ক্সবাদকে ভুল সাব্যস্ত করার চেষ্টা হয়েছে এবং তা কতদূর ফলপ্রসু হয়েছে।
যেমন, কলকাতার সমাজতাত্ত্বিক ডঃ রামকৃষ্ণ মুখার্জীর গবেষণার উল্লেখ করে অভিজিৎবাবু বলেছেন, আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক শ্রেণির সংখ্যা বৃদ্ধির পরিবর্তে মানসিক শ্রমদাতার সংখ্যা বাড়ছে এবং তারা এক ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম দিচ্ছে। শ্রমিকরাও এখন কর্পোরেট সংস্থার স্টক কিনে শেয়ার হোল্ডার হচ্ছে, ডিভিডেন্ড পাচ্ছে। এর দ্বারা মার্ক্সের কথিত পুঁজিপতি ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে আয় বৈষম্য বৃদ্ধির ধারণা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে এবং পুঁজিবাদও ধ্বংসের বদলে আরও সুস্থিতি অর্জন করছে।
আপাতত এই বিবরণ সত্য বলে ধরে নিয়েই কয়েকটা প্রশ্ন উত্থাপন এবং তার উত্তর পাশাপাশি নথিভুক্ত করা যাক:
শ্রমিক মালিক উৎপাদন সম্পর্ক কি মার্ক্স-উত্তর বিগত একশ তিরিশ বছরে এতে পালটে গেছে? — না। তা যায়নি।
পুঁজিবাদের সর্দার রাষ্ট্র মার্কিন মুলুকে সর্বোচ্চ এবং নিম্নতম আয়কারীর মধ্যে কি এর ফলে বৈষম্য কমে আসছে? না। বরং ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক হিসাবনিকাশ করে জানাচ্ছেন, আমেরিকান অর্থনীতিতে এই আয়-বৈষম্য ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে: “The income gap between the richest 1 percent of Americans and the rest of the country widened to a record level, a university analysis of tax filings indicates. The incomes of the top 1 percent increased 19.6 percent in 2012—accounting for 19.3 percent of total household income, breaking a 1927 record—while the bottom 99 percent incomes grew only 1 percent, Emmanuel Saez of the University of California, Berkeley, said in the “Striking it Richer: The Evolution of Top Incomes in the United States” analysis. “In sum, top 1 percent incomes are close to full recovery while bottom 99 percent incomes have hardly started to recover,” Saez said. His analysis, which he did in conjunction with the Paris School of Economics and Oxford University, is based on Internal Revenue Service data.”
[বিশদে দেখুন এখানে ]
বিষয়টিকে শুধু মাত্র গত বছরের আকস্মিক ঘটনা বলে মনে করার কারণ নেই। দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতাও এই একই পরিঘটনা তুলে ধরছে: “For starters, between 1993 and 2012, the real incomes of the 1% grew 86.1%, while those of the 99% grew 6.6%, …”
সুতরাং মার্ক্সীয় সিদ্ধান্তের কোনো ব্যত্যয় এখানে দেখা যাচ্ছে কি? — না।
কিংবা, এই প্রবণতা শুধু আমেরিকারও নয়। সমাজতন্ত্র পরিত্যাগ করে পুঁজিবাদী রাস্তায় চলতে গিয়ে আজ চিনেও সর্বোচ্চ সম্পত্তিবান পাঁচ শতাংশ পরিবারের হাতে মোট জাতীয় সম্পদের শতকরা ২৩ ভাগ জমা পড়ছে, আর সর্বনিম্ন পাঁচ শতাংশ পরিবারের হাতে আছে মাত্র ০.১ শতাংশ সম্পদ। তাহলে মার্ক্সবাদকে কি ভুল প্রমাণ করা গেল?
(৪) প্রশান্ত মহাসাগরের দুই পাড়ে দাঁড়িয়ে না থেকে এবার একটু বিশ্ব ভ্রমণ করে আসা যাক: ও-ই-সি-ডি অন্তর্ভুক্ত বাইশটি দেশের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন পরিবারগুলির আয় বৈষম্য পঁচিশ বছর আগেকার সাত গুণ থেকে বেড়ে ২০১১ সালে দশ গুণ হয়েছে। জার্মানি ডেনমার্ক সুইডেন ইত্যাদি দেশেও মোটামুটি একই সময়ে এই পার্থক্য পাঁচ গুণ থেকে বেড়ে ছয় গুণ হয়েছে। সারা বিশ্বকে ধরলে মাত্র এক শতাংশ মহোচ্চ-ধনী পরিবারের হাতে রয়েছে ৪০ শতাংশ সম্পদ; পৃথিবীর মাত্র তিনজন মহোচ্চ ধনবান ব্যক্তির হাতে যে বিপুল সম্পত্তি জমা আছে তার পরিমাণ গরিবতম ৪৮টি দেশের মোট জাতীয় সম্পদের চেয়েও বেশি। (তথ্য সূত্রঃ উইকিপিডিয়া; মূল উৎসগুলি সেখানে ঢুকে দেখলেই পাওয়া যাবে)
এই তথ্যগুলি দেখাচ্ছে, ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির সাংগঠনিক পরিকাঠামো ও ব্যবস্থাপনায় যতই পরিবর্তন হয়ে থাকুক না কেন, তা মার্ক্স বর্ণিত শ্রেণি-বৈষম্যের ছবিকে বদলে দিতে পারেনি। বরং দুই স্তরের মধ্যে আপেক্ষিক বৈষম্য অনেক গুণ বেড়ে গেছে। আর একথা তো সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায় যে আপেক্ষিক পার্থক্য এত ব্যাপকভাবে বেড়ে গেলে সরল পারিসংখ্যানিক নিয়মেই তার মধ্যে জনগণের একটা অংশের ক্ষেত্রে পরম পার্থক্যও বৃদ্ধি পায়। এই সব কথা অস্বীকার করলে মার্ক্সবাদীদের মার্ক্সভক্তির তুলনায় সমালোচকের ধনতন্ত্রভক্তির মধ্যেই বরং ধর্মীয় অন্ধতার লক্ষণ বেশি করে চোখে পড়বে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের কথা ধরুন। প্রতিটি কারখানার পেছনে আছে বৃহৎ পুঁজি—আধুনিক ভাষায় যাদের পরিচয় কর্পোরেট সংস্থা। তারা যে কী বিপুল মুনাফা উপার্জন করছে এই সব শিল্প সংস্থা থেকে তা নিশ্চয়ই আমার অভিজিৎবাবুকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না। ১৯৭৮ সালে দুটি কারখানা ১২০০০ ডলার পণ্য রপ্তানি করে যে শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল আজ তা ৫৮০০ কারখানায় ২১০০,০০,০০,০০০ ডলার পণ্য রপ্তানি করে। বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে ২৬টি দেশের মধ্যে (চিনের পরেই) দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও পোশাক শ্রমিকদের মজুরিতে পৃথিবীর সর্বনিম্ন স্থানে পড়ে রয়েছে। মাথাপিছু মাসিক মজুরি ৩৭-৫০ ডলার (৩০০০ টাকা) ধরলে বিশ্বের মাপকাঠিতে দারিদ্র্য সীমার আশেপাশেই তাদের অবস্থান। তারা পোশাক উৎপাদনে ৩১ শতাংশ মূল্য সংযোজন করে নিজেরা পায় ৭ শতাংশ। আরও মনে রাখবেন, ১৯৭৮ সালে এদের মজুরি ছিল ৪৫০ টাকা, ২০০৬-এর আগে পর্যন্ত ছিল ৯৩০ টাকা, ২০০৬-এ হয় ১৬৬২ টাকা এবং ২০১০ সাল থেকে ৩০০০ টাকা মজুরি বহাল রয়েছে।
[ভ্যানগার্ড; বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-এর মুখপত্র; ১৩ অক্টোবর ২০১৩; এবং কমরেড সুব্রত সরকারের সৌজন্যে প্রাপ্ত তথ্য; মূল উৎস, বাংলাদেশ মজুরি বোর্ড-এর আকাশপত্র]
এই সব দেখার পরেও পুঁজিবাদের স্বভাব বদলে গেছে বলবেন? এই ক্ষেত্রে মার্ক্সবাদের বক্তব্য কি ভুল মনে হচ্ছে? পুঁজিপতিদের লাভের হার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকরা হাতে এত পয়সা পাচ্ছে যে তারা মধ্যবিত্ত হয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে? শুধু প্রদীপকেই দেখছেন, কবিগুরু বলার পরেও তার নীচের পিলসুজকে দেখবেন না বলে ঠিক করেছেন?
তথ্য প্রযুক্তি উপভাগের কথাই ধরা যাক। সেখানে কি কায়িক শ্রমের বদলে মানসিক শ্রম দিয়ে কাজ হচ্ছে? ডঃ মুখার্জী কোথায় কাদের নিয়ে গবেষণা করেছেন আমার খুব ভালো করে জানা নেই। তবে এটুকু বলতে পারি, তিনি এই উপভাগের ভেতরে ঢুকে সেখানকার কর্মচারীদের সঙ্গে মেলামেশা করে কথাবার্তা বলে তাঁর উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন কিনা তাতে আমার সন্দেহ আছে। প্রথাগত অর্থে গবেষণা না করলেও আমার এদের অনেকের সাথে আলাপ পরিচয় আছে। এই উপভাগে মোটা অর্থে দুই ধরনের লোক কাজ করে। একদল করে পরিদর্শনের কাজ, অন্যদের কাজ ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা দেখাই তাদের নিজেদের কাজ। সেই অর্থে তাদের কাজের চরিত্র মূলত মানসিক শ্রম ভিত্তিক। কিন্তু আর এক দল, যারা আট-দশ ঘন্টা টেবিলে বসে কাজ করে, কম্পিউটার-ইন্টারনেটের সাহায্যে, তাদের কাজটা কোনোমতেই মানসিক নয়, প্রবলভাবে শারীরিক পরিশ্রমের কাজ, সেই সাথে সমপ্রবলভাবে মানসিক শ্রমযুক্ত কাজ। এদের অনেকে সারাদিনে একবারও প্রস্রাবখানায় যেতে পারে না, বাড়ি থেকে যে টিফিন নিয়ে যায় তা খাওয়ার সময় পায় না, এই পরিস্থিতির মধ্যে এদের কাজ করতে হয়। তার মধ্যে, প্রভু দেশ (আমেরিকা) রাত জাগবে না বলে এদের অধিকাংশকে কাজ করতে হয় রাতের বেলা, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। দিনে এরা ঘুমিয়ে কাটায়, সামাজিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। দেশি কলকারখানায় যে শিফট প্রথা চালু আছে এখানে তার কোনো সুযোগ নেই। একে যদি অভিজিৎবাবু বলেন পুঁজিবাদী সমাজের মার্ক্সেতর বিকাশের লক্ষণ, এবং এই শ্রমিকরা উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটাচ্ছে, তাহলে আমাদের আবার সমাজ দর্শনের অ আ ক খ থেকে আলোচনা শুরু করতে হবে।
মেরুকরণ বনাম মধ্যবিত্ত
অভিজিৎ রায় আরও অনেকের মতোই মনে করেন, মার্ক্স–এঙ্গেল্স কথিত সমাজের জনগোষ্ঠীর মালিক ও শ্রমিক এই দুই শ্রেণিতে ক্রমবর্ধমান মেরুকরণের বদলে এক বিরাট সংখ্যক মধ্যবর্তী মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটেছে। মার্ক্স–এঙ্গেল্সরা নাকি মনে করেছিলেন, তাঁদের এই আভাসিত মেরুকরণ ও তার ফলস্বরূপ সম্পদ বন্টনে ব্যাপক বৈষম্যের কারণে শোষণের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে, শ্রমিক শ্রেণির দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে, সমাজে অচিরেই এক বৈপ্লবিক অস্থিরতার সৃষ্টি হবে এবং তার ধাক্কায় একটার পর একটা পুঁজিবাদী সমাজ ভেঙে পড়বে। এর কোনোটাই ঘটেনি। ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিও ভেঙে পড়েনি। পপারের সূত্রে তিনিও দাবি করেছেন, এই দেখুন, মার্ক্সবাদ একদিন তার তত্ত্বের ভিত্তিতে যে পূর্বাভাস দিয়েছিল তা আজ ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে আজ অবধি বিপ্লব হয়নি, ভবিষ্যতে হবে বলে মনেও হচ্ছে না। অথচ মার্ক্সবাদীরা এটা মানতে চাইছে না। তারা বেদ বাইবেল কোরাণের মতো করে এখনও মার্ক্সের সেই সব বস্তা পচা রচনাকে ধ্রুব সত্য জ্ঞানে আঁকড়ে ধরে বসে আছে।
কথাটা সত্যিই ভেবে দেখার মতো। বললাম এক, হল আর এক রকম; তারপরেও কীভাবে বলব, আগের কথাটা ঠিক আছে? আমিও মনে করি, এমনটা ঘটে থাকলে সত্যিই মার্ক্সবাদ ভ্রান্ত সাব্যস্ত হয়ে গেছে। তাই প্রথমেই দেখা দরকার, মার্ক্স এঙ্গেল্স সত্যিই এমনটা বলেছিলেন কিনা।
মার্ক্স পুঁজিবাদকে নিয়ে চুলচেরা অতি-বিশদ বিচার বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর ‘পুঁজি’ নামক গ্রন্থে। সেও এক মহাগ্রন্থ, যার মোট ছয়টি খণ্ড। প্রথম তিনটি খণ্ড ‘ক্যাপিট্যাল’ নামে সুপরিচিত, পরের তিনটি খণ্ড ‘থিওরিজ অফ সারপ্লাস ভ্যাল্যু’ (একত্রে ‘পুঁজি’ গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ড) নামে স্বল্প পরিচিত। সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার পৃষ্ঠার সুবিশাল বই। এর পাশাপাশি আছে পুঁজি গ্রন্থ লেখার আগে মার্ক্সের প্রায় হাজার দু-এক পৃষ্ঠার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, যা অনেক পরে গ্রুন্ডরিসে (Grundrisse) নামে (জার্মান ভাষায় ১৯৩৯-৪১ সালে ও ইংরেজিতে ১৯৭৩ সালে) প্রকাশিত হয়েছে। এর সবটাই পড়ে ফেলেছি বলে সততার সাথে দাবি করতে পারব না, তবে অনেকটাই পড়ে নিয়েছি। যতটা পড়তে পেরেছি তার সবকিছুই অবিকল মনে আছে এই দাবিও করছি না। তথাপি অনেক দিন ধরে মার্ক্সবাদ নিয়ে তত্ত্বগত চর্চার মধ্যে থাকার ফলে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলি এখনও মনে আছে বলেই আমার ধারণা। আমি কিন্তু মনে করতে পারছি না, মার্ক্স এই সব গ্রন্থের ঠিক কোথায় তাঁর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে শ্রেণী-মেরুকরণ থেকে তক্ষুনি বিপ্লবের দাবি করেছেন। আমাকে যদি শ্রীরায় দেখাতে পারেন আমি সত্যিই বাধিত হব।
তবে কি মার্ক্স বা এঙ্গেল্স এরকম কথা কোথাও বলেননি? কার্ল পপার থেকে শুরু করে অভিজিৎ রায় পর্যন্ত সব্বাই স্রেফ মিথ্যে কথা বলছেন?
না, তাও নয়। বলেছেন। মার্ক্স এঙ্গেল্সরা ওই কথাগুলি বলেছেন ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’তে।
কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো কি মার্ক্সবাদের কোনো তাত্ত্বিক রচনা?
একেবারেই নয়। এমনকি মার্ক্স এঙ্গেল্সরা নিজেরাই এক সময় স্বীকার করেছেন, ওই বইতে অন্তত দু-তিনটি জায়গায় কিছু বড় রকমের তত্ত্বগত গলদ আছে। শ্রেণির উৎপত্তির প্রশ্নে ভুল আছে, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রশ্নে (অর্থাৎ, বিপ্লবের সবচেয়ে মৌল প্রশ্নে) ভুল আছে, ইত্যাদি। ১৮৮২ সালের একটি ভূমিকায় এঙ্গেল্স বলছেন, ইউরোপের বিপ্লবের কেন্দ্র রাশিয়ায় সরে যাচ্ছে। আকর্ষণীয় ঘটনা হচ্ছে, যাঁরা ইংলন্ড ফ্রান্স জার্মানিতে বিপ্লব হয়নি বলে মার্ক্স-এঙ্গেল্সের ভবিষ্যদ্বাণীতে ভুল ধরেছেন, তাঁরা কিন্তু রাশিয়া সম্পর্কে এঙ্গেল্সের ভবিষ্যদ্বাণী পরে সঠিক প্রমাণিত হওয়াটাকে কোনো পাত্তা দেননি।
যাই হোক, এই ম্যানিফেস্টো হচ্ছে একটি ঘোষণা পত্রের মতো। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্টরা সংগঠিত হচ্ছে, তাদের হাতে একটা ঘোষণাপত্র চাই—যেখানে কম কথায় লেখা থাকবে কী তারা করতে চায়, কীভাবে করতে চায়, ইতাদি। সেটাই ১৮৪৮ সালে প্রথম ম্যানিফেস্টো নামে বেরোয়। আর এরকম লেখায় যে মৌলিক তত্ত্বকথা আনুপুঙ্খিক বিচার-বিশ্লেষণ খুব একটা থাকবে না, এটা যে বেশ একটু সংগ্রামী আহ্বান সম্বলিত হবে, যুক্তি তর্কের চেয়ে রণহুঙ্কারই বেশি পরিমাণে থাকবে, এ আর বেশি কথা কী? ধ্রুপদী মার্ক্সীয় সাহিত্যে এটা আজ অবধিও যে সম্ভ্রম জাগায় তা এর তাত্ত্বিক সম্পদের জোরে নয়, এর সংগ্রামী আবেদনের জোরে। এই সংগ্রামী আহ্বানের কারণেই এর বিশেষ কয়েকটি শ্লোগানধর্মী বিবৃতি আজও সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে অমর হয়ে আছে।
যাঁরা তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে বসবেন তাঁদের এই সব প্রাসঙ্গিক প্রাথমিক বিষয় ভুলে গেলে চলে না। এটাও তাঁদের চোখে না পড়ে পারে না যে পরবর্তী কালের মার্ক্সবাদী চিন্তানায়কদের আলোচনায়, প্লেখানভ, লেনিন এবং মাওয়ের প্রধান প্রধান রচনায়, তাঁদের তাত্ত্বিক যুক্তি তর্কের সমর্থনে ম্যানিফেস্টোর উল্লেখ প্রায় নেই বললেই চলে। সুতরাং কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে কেউ যদি মনে করেন, তিনি মার্ক্স এঙ্গেল্সের তাত্ত্বিক রচনা থেকে প্রদত্ত পূর্বাভাসগুলিকে খুঁজে বের করছেন, তুলে ধরছেন, এবং ভুল খুঁজে পাচ্ছেন, তাহলে তাঁকে আবার মতবাদিক বিতর্কের প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তি করে দিতে হবে। তবে এতে তাঁর দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, একবার সেই ক্লাশে ভর্তি হলে তিনি সেখানে সহপাঠী হিসাবে পাবেন বার্ট্রান্ড রাসেল, কার্ল পপার, লুই ফিশার, জর্জ অরওয়েল, প্রমুখ অনেক ভি ভি আই পি-কে। গর্বও হতে পারে তাঁর। সেই ক্লাশে হয়ত শিক্ষকতা করতে আসবেন মিখাইল বাকুনিন। যিনি এসেই বলবেন, “ওহে, শোনো ছাত্ররা, মার্ক্সের মোটা মোটা বইগুলিতে কিছু নেই। ওর যা বলার সমস্ত সার কথা বলে রেখেছে ওদের ম্যানিফেস্টোতে। ওইটা তোমরা ভালো করে পড়, ওখান থেকেই যা কিছু প্রশ্ন করার কর।” যদি খেলতে হয় বুকে ঘুঁষি মারো, যদি মারতে হয় বেল্টের নীচে পা চালাও। যেখানে দুর্বল জায়গা … ।
যাই হোক, আবার তত্ত্বের কথায় ফিরে আসি।
মধ্যবিত্তের বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণা বিশ শতকের শুরু থেকেই চলছে। এর অন্যতম কারণ এবং লক্ষ্য মার্ক্সবাদকে ভুল প্রমাণ করা। মেরুকরণের প্রবণতা দুর্বল হয়ে পড়েছে, সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির আনুপাতিক সংখ্যা কমে যাচ্ছে। নতুন শ্রমিক শ্রেণি উঠে আসছে, তারা আর সর্বহারা নয়, তাদের বাড়ি আছে, (ইউরোপ আমেরিকা হলে) গাড়ি আছে, অতএব পিছুটান আছে, শৃঙ্খল ছাড়াও হারানোর অনেক কিছু আছে। সুতরাং ধ্রুপদী ঘরানায় মার্ক্সীয় বিপ্লব আর সম্ভব নয়। এই সব কথা আমরা অনেক কাল ধরেই শুনে আসছি।
তারপরেও বর্তমানে সারা পৃথিবীর মধ্যবিত্তের সংখ্যা এবং আনুপাতিক অংশ কত?
এই সময়ে বিশ্ব জনসংখ্যা মোটামুটি ৭১২ কোটি। আর, ২০১০ সালের ও-ই-সি-ডি-র একটা হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সারা বিশ্বের মধ্যবিত্ত জনগণের সংখ্যা ১৮৪.৫ কোটি। [Homi Kharas, Emerging Middle Class in developing Countries; OECD Development Centre, Working Paper No. 285; January 2010] অর্থাৎ, বিশ্ব জনসংখ্যার কমবেশি ২৫-২৬ শতাংশ। তা-ও, এই হিসাবে মধ্যবিত্তদের আয়ের বন্ধনী যথেষ্ট বড় করে ধরা হয়েছে (যারা প্রতিদিন দশ থেকে একশ মার্কিন ডলার পর্যন্ত খরচ করতে পারে)। এই সীমানা আর একটু ছোট করে দিলেই (যেমন দৈনিক ২০ থেকে ৫০ ডলার খরচ করার ক্ষমতা) সংখ্যাটা অর্ধেকেরও নীচে চলে যাবে। আর, তাছাড়া, এই গড় হিসাব যদি উন্নততর বিশ্বকে ধরে নেওয়া যায়, তখন দেখা যাবে পরম সংখ্যায় বাড়লেও জনসংখ্যার অনুপাতে মধ্যবিত্তের আকার হ্রাস পাচ্ছে। যেমন, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭০-৯৪ সালের হিসাবে (অর্থাৎ, দীর্ঘ মেয়াদে) দেখা গেল, বার্ষিক ২৫০০০-৫০০০০ ডলার উপার্জনকারী (অর্থাৎ, যাদের দৈনিক আয় ৬৮-১৩৭ ডলার) জনগণের সংখ্যা ২.৫ কোটি থেকে ৩ কোটিতে পৌঁছলেও মোট জনসংখ্যার তুলনায় তা ৩৮ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নেমে গেছে। অন্যদিকে ভারতের মতো বড় এবং অতি-জনসখ্যা অধ্যুষিত দেশে বিশ্বায়ন এবং মনমোহনী সংস্কারের বাইশ বছর পরেও এরকম মধ্যবিত্তের সংখ্যা এখনও মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশের বেশি নয়। সুতরাং পুঁজিবাদের মার্ক্স-উত্তর কালে মধ্যবিত্তের অবস্থার এমন কোনো বিস্ময়কর পরিবর্তন হয়নি যার জন্য সেই মধ্যবিত্তদের বৃহত্তর অংশের মধ্যে পুঁজিবাদ সম্পর্কে নতুন করে মোহ জন্ম নেবে। বরং মোহভঙ্গের ঘটনাই বেশি করে ঘটছে।
পুঁজিবাদের শোষণে জর্জরিত হয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও জনগণ কেন বিপ্লব করতে এগিয়ে আসছে না? এতে কি মার্ক্সবাদ ভ্রান্ত সাব্যস্ত হচ্ছে না?
না।
হত, যদি মার্ক্স বা অন্য কোনো প্রামাণ্য মার্ক্সবাদী নেতা কোথাও এরকম দাবি বা ঘোষণা করতেন যে জনগণের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তারা বিপ্লব করবেই করবে। আগেই বলেছি, আমি অন্তত এখনও পর্যন্ত তাঁদের এরকম কোনো প্রামাণ্য তাত্ত্বিক লেখা হাতে পাইনি এবং পড়িনি যেখানে মার্ক্স বা এঙ্গেল্স বা লেনিন এই জাতীয় একটা দাবি বা ঘোষণা করেছেন। যা তাঁরা বলেননি, তা ঘটা না ঘটার সাথে তাঁদের তত্ত্বের ঠিক ভুল প্রমাণ-অপ্রমাণের কী সম্পর্ক আছে?
আবার বলছি, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লাভ নেই। কারণ সেটা কোনো তাত্ত্বিক রচনা নয়। ওটা হল একটা নবীন মতাদর্শের আগমনী বার্তা, তার ভিত্তিতে এক নতুন ধরনের শ্রেণি সংগ্রামের এবং সমাজ বিপ্লবের আহ্বান। ওই রচনা থেকে দুটো কথা এখান ওখান থেকে উদ্ধার করে কেউ যদি বলেন, “এই দেখুন, ১৮৪৮ সালেই মার্ক্স আর এঙ্গেল্স বলেছিলেন, বিপ্লব প্রায় হব-হব, অথচ কই, বেশিরভাগ দেশেই তো বিপ্লব হল না, তাহলে আর মার্ক্সবাদের কী রইল?” তাঁকে আবার সেই প্রাথমিক ক্লাশে পাঠাতে হবে। তত্ত্বগত রচনা এবং তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ কাকে বলে শিখে আসতে। তবে তো ভুল ধরার ক্ষমতা তৈরি হবে। মার্ক্সবাদের অধিকাংশ সমালোচক এই প্রাথমিক প্রস্তুতি ছাড়াই মতবাদিক সমালোচনা করতে এবং ভুল ধরতে নেমে পড়েন। তাঁরা ভাবেন, বিজ্ঞানের দর্শনের বিষয়ে মন্তব্য করতে হলে পড়াশুনা করতে হয়, অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করতে হলে উপযুক্ত প্রস্তুতি নিতে হয়; কিন্তু মার্ক্সবাদ সম্পর্কে কিছু (পক্ষে বা বিপক্ষে) বলতে হলে কোনো প্রস্তুতির দরকার নেই। অভিজিৎবাবুর সম্পর্কে এরকম ভাবতেও আমার কষ্ট হচ্ছে। তবুও বলছি, তিনিও প্রস্তুতি ছাড়াই মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে খেলতে মাঠে নেমে পড়েছিলেন।
পুঁজিবাদের নব চরিত্র
একথা ঠিক, মার্ক্সের সময়কাল থেকে পুঁজিবাদের অনেক বৈশিষ্ট্যই পরিবর্তিত হয়েছে। প্রাক-একচেটিয়া থেকে একচেটিয়া পুঁজিবাদের জন্ম হয়েছে, পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র অর্জন করেছে, আলাদা আলাদা ভাবে শিল্প ও ব্যাঙ্কের বদলে পুঁজির বিচলন এই দুটো ক্ষেত্রে মিলেমিশে গেছে, লগ্নি পুঁজির জন্ম হয়েছে। তার মধ্য দিয়ে পুঁজি আরও শক্তিশালী দ্রুতচল এবং বহুগামী হয়েছে।
মার্ক্সবাদীরা কি এই ব্যাপারে উদাসীন থেকেছেন? তাঁরা কি মার্ক্সের যুগের পুঁজিবাদের ব্যাখ্যাতেই সন্তুষ্ট থেকে এই সমস্ত নতুন বৈশিষ্ট্যগুলিকে দেখতে বুঝতে পর্যালোচনা করতে অস্বীকার করেছেন?
আদৌ না। রুডলফ হিলফারডিং, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, নিকোলাই বুখারিন, পল সুইজি, আর্নেস্ট ম্যান্ডেল, ক্রিস হারম্যান, প্রমুখ মার্ক্সবাদীরা এগিয়ে এসেছেন ধাপে ধাপে এই নতুন বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিচার করতে। তার ফলে এক অত্যন্ত বিশাল ও সমৃদ্ধ নতুন চিন্তাসম্পৃক্ত মার্ক্সবাদী সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। তাঁরা সবাই ঠিকঠাক বুঝেছেন কিনা, কে কোন দিক থেকে কতটা বুঝেছেন, বা সমস্ত দিক সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বুঝেছেন কিনা—এই প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। এঁরা যে যা ব্যাখ্যা করেছেন তার সঙ্গে যে কেউ মতপার্থক্য ব্যক্ত করতেও পারেন। কিন্তু মার্ক্সবাদীরা মার্ক্সের পুঁজি গ্রন্থকে বাইবেল বানিয়ে নতুন সমস্যার মোকাবিলায় তত্ত্বগত চিন্তার যাবতীয় দায়িত্ব অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করেছেন—এই অভিযোগ উপরোক্ত তথ্য জেনে-শুনে মার্ক্সবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে তোলাই যায় না।
এই প্রসঙ্গে বলি: অভিজিৎ রায় মার্ক্সের মূল্যের শ্রমতত্ত্বের বিরুদ্ধে বম-বাওয়ার্কের সমালোচনার কথা তুলেছেন। অস্ট্রিয়ান অর্থনীতিবিদ ইউগেন বম ফন বাওয়ার্ক মার্ক্সের মূল্যতত্ত্বের বিরুদ্ধে সমালোচনাটি জার্মান ভাষায় লিখেছিলেন ১৮৯৬ সালে, যা দু বছর পরে ইংরেজিতে অনুদিত হয়ে বেরয় [Eugen Böhm von Bawerk, Karl Marx and the Close of His System, 1898]। তাঁর হয়ত-বা জানা নেই, সেই সমালোচনার জবাব দিয়েছিলেন অন্তত তিনজন মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ: প্রথমে জার্মানিতে হিলফারডিং [Rudolf Hilferding, Böhm-Bawerk’s Criticism of Marx, 1904], কিছুদিন পরে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে বুখারিন [Nikolai Bukharin, Economic Theory of the Leisure Class, 1927], এবং অনেক পরে ইংলন্ডের রোনাল্ড মিক [Ronald Meek, Studies in the Labour Theory of Value, 1956, 1973]।
তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে মার্ক্সের মূল্যতত্ত্বকে বিভিন্ন দিক থেকে পুনর্বিচার করে দেখে তাকে সমর্থন করেছিলেন। মুক্তমনার লেখককে আগে মুক্তমনে বিচার করে দেখতে হবে, সেই জবাবগুলোতে বম-বাওয়ার্কের (এবং অন্যদের) উত্থাপিত সমস্ত প্রশ্নের মীমাংসা হয়েছিল কিনা; মার্ক্সবাদীরা মূল্যের শ্রমতত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রান্তীয় উপযোগিতা স্কুলের উত্থাপিত সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে পেরেছিলেন কিনা। একমাত্র তারপরই তিনি এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
বলতে পারেন, মার্ক্সের মূল্যতত্ত্ব বাতিল যোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। তার আগেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটা একপেশে হয়ে যাবে বলেই আমার ধারণা। এই বিচার শেষ করার আগে বা না করে ওঠা পর্যন্ত তিনি বড় জোর বলতে পারেন, এই বিষয়ে অনেক বিতর্ক আছে। আর, মার্ক্সের সমর্থনে বললে গোঁড়ামি, এবং বম-বাওয়ার্কের পক্ষে বললে মুক্তচিন্তা—এরকম সরল সিদ্ধান্ত আর যিনিই গ্রহণ করুন, অভিজিৎ বাবু করবেন বলে আমার এখনও বিশ্বাস হয় না।
পুঁজিবাদের বিবর্তন হয়ে চলেছে। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শিল্প-বিপ্লবোত্তর কারখানা ভিত্তিক যে পুঁজিবাদের দেখা মিলেছিল ইউরোপে অষ্টাদশ শতাব্দের শেষ ভাগ থেকে, যেখানে এক জায়গায় শুধু শত শত নয়, হাজার হাজার শ্রমিককে জড়ো করে উৎপাদন করা হত, বিশ শতকের শেষ চতুর্থাংশ থেকে পুঁজিবাদ সেই কাঠামো পালটে ফেলতে শুরু করে। সেই পরিবর্তনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নীচে উল্লেখ করা হল:
[১] সচেতনভাবে কিংবা অসচেতনভাবে তারা এক জায়গায় শ্রমিকদের কেন্দ্রীভূত জমায়েত ভেঙে দিয়ে উৎপাদনের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে থাকে—প্রথমে নিজের নিজের দেশে, তারপর অন্য দেশেও। এর মধ্যে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য যেমন ছিল, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও লুকানো ছিল;
[২] বড় বড় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি তার আগে পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে স্বাধীনভাবে শিল্পবিকাশের যে কোনো প্রচেষ্টাকে সাধ্য মতো বাধা দিত। তারা চাইত, এই দেশগুলি তাদের শিল্পে কাঁচামাল ও সস্তা শ্রম যোগান দেবার অনুন্নত বলয় হয়ে টিকে থাকুক। ১৯৭০-পরবর্তীকালে, বিশেষ করে যখন থেকে শিল্প দুষণ বিশ্বজোড়া উষ্ণায়ন ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পেল, তখন থেকেই উন্নত বিশ্ব ব্যস্ত হয়ে পড়ল দুষণের উৎসগুলিকে প্রথমে নিজ নিজ দেশের পশ্চাদপদ অঞ্চলে ও পরে বিশ্বের অন্যান্য পশ্চাদপদ দেশে স্থানান্তরিত করে দিতে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক এবং আইএমএফ-এর পঞ্চাশ-ষাটএর দশক এবং ১৯৭০-উত্তর পরামর্শগুলি পড়লে লেখক এই দুই কালে সাম্রাজ্যবাদীদের দু-রকম মনোভাব সম্বন্ধে অনেক আকর্ষণীয় তথ্য পাবেন। এই সময় থেকেই এক ধরনের ‘করিয়ে আনা’ (out-sourcing) শুরু হয়েছিল। আর এই কার্যক্রমগুলিকেই অনুন্নত দেশের শাসকশ্রেণি শিল্পায়ন ও উন্নয়ন বলে চালাতে চেয়েছে;
[৩] এইভাবে উৎপাদন-ব্যবস্থাকে ছড়িয়ে দিতে হলে আগে যত জন ম্যানেজার-জাতীয় লোক লাগত, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি লোক লাগছে। ম্যানেজারদের এই বর্ধিত চাহিদাকে মেটানোর প্রয়োজনেই সারা পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য (এবং অসংখ্য ধরনের) ম্যানেজমেন্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল। উচ্চ বেতনহার ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা (perks) দিয়ে তাদের মধ্যে শ্রেণিগতভাবে পুঁজির থলির প্রতি মনস্তাত্ত্বিক বশ্যতা জাগিয়ে তুলে বাকি শ্রমিক ও কর্মচারীদের থেকে একটা আলাদা উচ্চাকাঙ্ক্ষী গোষ্ঠী হিসাবে তৈরি করা হচ্ছে। এরাই রায়-কথিত সেই মধ্যবিত্তদের একটা বড় অংশ;
[৪] এদের প্রদেয় মোটা মাইনের অঙ্ককে ভারমুক্ত করতে অন্যদিকে শ্রমিকদের প্রদেয় বেতনহার এবং/অথবা টাকার অঙ্ক কমানোর নানা রকম চক্রান্ত করা হচ্ছে। যথা: (ক) ক্রমাগত উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এক একটি কারখানায় শ্রমিক সংখ্যা ক্রমাগত কমানো, (খ) কিছু কিছু করে স্থায়ী পদ বিলোপ ও খালি পদে যত দিন সম্ভব নিয়োগ বন্ধ রাখা, (গ) উৎপাদন সরিয়ে নিয়ে গিয়ে অন্য দেশের সস্তা শ্রম কিনে কাজে লাগানো, (ঘ) অস্থায়ী ও চুক্তিশ্রমিক নিয়োগের মধ্য দিয়ে বহু সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত করা, (ঙ) স্থায়ী শ্রমিকদের এতকাল প্রদত্ত সুযোগসুবিধা ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করা, (চ) ক্রমবর্ধমান বেকারি ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে দরকষাকষি করে মজুরি যতদূর পারা যায় (মূল্যবৃদ্ধির সাপেক্ষে) কমিয়ে রাখা, ইত্যাদি।
[৫] সারা বিশ্বে উৎপাদনকে ছড়িয়ে দিতে হলে আর একটা জিনিসও চাই। সেটা হল দক্ষ শ্রমিকের যোগান। যারা নব নব যন্ত্রপাতি চালাতে পারবে, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করতে পারবে। এই কারণেই ১৯৭০-পরবর্তীকালে আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া দেশগুলিতে হঠাৎ করে প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সংখ্যা হু-হু করে বাড়তে থাকে। (কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে) এই ধরনের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তীর্ণ ছাত্ররা সরকারি উন্নতমানের কলেজ থেকে পাশ করা ছাত্রদের মতো প্রযুক্তিবিদের যোগ্যতা দেখাতে না পারলেও দক্ষ শ্রমশক্তি হিসাবে ভালোই কাজ করতে পারবে। এরাও রায়-কথিত মধ্যবিত্তের আরেকটা বর্তমানে ক্রমবর্ধমান অংশ;
[৬] উৎপাদন বিক্ষেপন, প্রযুক্তির বিকাশ এবং ভোগবাদ—এই তিনের টানাপোড়েনে আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পরিষেবা ক্ষেত্র ক্রমাগত স্ফীত হয়ে চলেছে। বছর তিরিশ-চল্লিশ আগেও পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে প্রথম (কৃষি) ও দ্বিতীয় (শিল্প) উপভাগই ছিল উৎপাদনের সিংহভাগ। তৃতীয় (পরিষেবা) উপভাগ ছিল নিতান্তই নগণ্য, বাকি দুই ভাগের উপরে একটি ক্ষীণ আস্তরণ মাত্র। পরিবহন, ডাক, দূরসংযোগ, ইত্যাদি। বিগত পঞ্চাশ-ষাট বছরে উপরের তিনটি ঘটনা যুক্ত হয়ে এই উপস্তরের বেধ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ১৯৮০-র দশকে ডেস্কটপ পিসি এবং ১৯৯০-র দশক থেকে ইন্টারনেট এসে যাওয়ার পর বিনোদন ব্যবসা এক বিরাট প্রতিষ্ঠান রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৯০-উত্তরকালে বিশ্বায়ন-ব্যবস্থার প্যাঁচকলে শিক্ষা স্বাস্থ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা ইত্যাদিরও ব্যাপক ব্যবসায়ীকরণ শুরু হয়; সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে পরিষেবা ক্ষেত্রের আকার আয়তন। আর ইন্টারনেটে করিয়ে-আনা শুরু করার মাধ্যমে আই-টি সেক্টরের নামে তৃতীয় বিশ্বে প্রথম বিশ্বের অনেক কাজ স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে সেই সব দেশে কৃষি ও শিল্পের হরপ্পা-দশার মধ্যেও পরিষেবা উপভাগের বিরাট ব্যাপ্তি হতে থাকে;
[৭] এইভাবে একদিকে নতুন ধরনের এক শ্রমিক-গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে, যাদের বনেদি শিল্প শ্রমিকদের সাথে পুরোপুরি মিলিয়ে বিচার করা যায় না। যাদের চাকুরি গত অবস্থা, শর্তাবলি, রোজগার, ছুটি, পারস্পরিক যোগাযোগ, ইত্যাদি বিষয়গুলি একেবারেই অন্যরকম। আর একদিকে এসেছে আর একদল স্বনিযুক্ত ছোট ব্যবসায়ী, যারা অসংখ্য রকমের পরিষেবা প্রদান করে বাঁদিকে নাগরিক জীবনযাত্রা ডানদিকে বড় শিল্পের উৎপাদন—এই দুটোকে একসাথে চালু রেখেছে। এদের মানসিকতা হচ্ছে শ্রমিকদের মতো, আর অবস্থানটা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের মতো। এই শ্রমদাতাদের আর্থসামাজিক অবস্থানটা হচ্ছে বৃহৎ পুঁজিকে ঘিরে একটা বাফারের মতো, যাদের পরিষেবা, মানসিকতা, চলাফেরা, দাবিদাওয়া, রোজগার, ইত্যাদি পুঁজিবাদকে বহু দিক থেকে সেবাও দেয় সুরক্ষাও দেয়;
ইত্যাদি … ।
শ্রীরায় যদি প্রশ্ন তোলেন, বিভিন্ন দেশের মার্ক্সবাদী দলগুলি এই সব নতুন সমস্যাগুলির দিকে নজর দিচ্ছে কিনা, এর বিচার বিশ্লেষণ করে তাদের রাজনৈতিক লাইনে কোথাও কিছু নতুন কথা ঢোকাচ্ছে কিনা, তার একটা মানে হয়। যেখানে যে দল দিচ্ছে না, তাকে এইদিকে দৃষ্টিপাত করার জন্য তিনি আবেদন করতে পারেন। না করে থাকলে সমালোচনাও করতে পারেন। যারা এই সমস্ত নতুন সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে তাদের নীতি নির্ধারণ বা বিশ্লেষণ সম্পর্কে মতপার্থক্য থাকলে তা নিয়ে মন্তব্য করতেও পারেন। [মার্ক্সবাদীদের তরফে এরকম একটি বিশ্লেষণের নমুনা দিলাম: Chris Harman, “The workers of the world”; International Socialism; 2, 96 (Autumn 2002)]। কিন্তু যদি বলেন, এই সব বৈশিষ্ট্যের উদ্ভবের ফলে পুঁজিবাদের চরিত্র বদল হয়ে গিয়েছে, তাহলে বড্ড মুশকিল।
আমার এই কথাটা বোঝানোর জন্য সবটা মিলবে না জেনেও একটা সহজ উদাহরণ দিই।
ন্যাংটো শিশু একটু বড় হয়ে হাফ প্যান্ট পরে, কথা বলে, হাঁটে, দৌড়ায়। তারপর আরও বড় হয়ে সে স্কুলে যায়, পরীক্ষা দেয়, পাশ করে, কলেজে যায়, ডিগ্রি অর্জন করে। আরও বড় হয়ে সে হয়ত চাকরি বা ব্যবসা করে, বিয়ে-থা করে, সংসার প্রতিপালন করে, নিজে মা-বাবা হয়, ইত্যাদি। এইভাবে একদিন সে বৃদ্ধ হয়, দিদিমা বা দাদু হয়, ইত্যাদি … । কিন্তু সমস্ত সময় ধরেই সে তার অস্মি-সত্তা নিয়ে থাকে, নিজের কাছেও, অপরের কাছেও। তার কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য (চরিত্র, আচরণ, মুদ্রা দোষ, ভাষা, বাচনভঙ্গি …) বজায় থাকে। যা দিয়ে যে কোনো লোকে তাকে চিনতে পারে, তার সম্বন্ধে অন্যের কাছে বলতে পারে।
পুঁজিবাদও ঠিক সেই রকম।
আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে যখন ইউরোপ থেকে ওরা বেরিয়েছিল পৃথিবীর নানা প্রান্তের বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ করবে বলে, সেখান থেকে সোনা রুপো কয়লা লুটেপুটে আনবে বলে, দাস ব্যবসা করবে বলে, আর আজ যখন আমেরিকা বৃটেন ফ্রান্স জার্মানির ন্যাটো জোট ইরাক আফগানিস্তান লিবিয়া মিশর সিরিয়ার উপর খনিজ তেলের ভাণ্ডারগুলি দখলের উদ্দেশ্যে হামলা চালাচ্ছে বা চালাতে চাইছে—লক্ষ করে দেখুন তাদের দস্যু-স্বভাবে এতটুকু পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন কিনা।
গোটা উনবিংশ শতাব্দ ধরে ইউরোপ আমেরিকায় শিল্প শ্রমিকরা রক্তক্ষয়ী লড়াই করেছে আট ঘন্টার কাজের দাবি আদায় করার জন্য। মালিকরা কোথাও কোনো দেশে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, স্বেচ্ছায়, খুশি মনে গণতন্ত্র ভ্রাতৃত্ব সাম্য মৈত্রীর প্রেমভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই দাবি মেনে নেয়নি। আপনি পুঁজিবাদী দেশগুলিতে যে সমস্ত শ্রমিক স্বার্থরক্ষাকারী পদক্ষেপের কথা বলেছেন তারও সবই চালু হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির এক সময়কার উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ফলে আতঙ্কিত হয়ে নিজ নিজ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ঠেকানোর জন্য। তারা কেউ কখনই কল্যাণ-রাষ্ট্র হয়নি, কল্যাণীয়াসু মুখোশ পড়েছিল মাত্র।
তাছাড়া গণ আন্দোলনেরও একটা ক্রমবর্ধমান চাপের প্রশ্ন তো ছিলই।
আর আজ লক্ষ করে দেখুন, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে সেই সেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সেই কল্যাণ-মুখোশ খুলে ফেলে একটার পর একটা সামাজিক সুরক্ষা-কবচগুলি ফিরিয়ে নিতে চাইছে। কর্পোরেট সংস্থাগুলি চাপ দিচ্ছে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা চাপ দিচ্ছে, একদল দালাল অর্থনীতিবিদও সেই সুরে ঢাক পেটাচ্ছেন। সমস্ত পুঁজিবাদী সংস্থা এখন আট ঘন্টার কর্মসময় লঙ্ঘন করতে চাইছে, শ্রমিক কর্মচারিদের দিয়ে দশ বারো ঘন্টা করে রোজ কাজ করাতে চাইছে। উপরে উল্লিখিত ম্যানেজার-টেকনোক্র্যাটদের সে এখন প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই কাজে আটকে রাখছে ইন্টারনেট-ল্যাপটপ-ডাটা কার্ডের মাধ্যমে। গান বাজনা সিনেমা গল্প বেড়ানো সব কিছু বাদ দিয়ে অথবা সব কিছুর মধ্যেই কোম্পানির সঙ্গে সংযোগ রেখে চলতে হবে, কাজের নির্দেশ পেলে সেইমতো সেবা করে যেতে হবে। হাতুড়ি পেটানো, মেশিনের হ্যান্ডেল ঘোরানোর বদলে কি-বোর্ডের বোতাম টেপার মধ্যে কিছু পরিবর্তন নিশ্চয়ই আছে, অভিজিৎবাবু। কিন্তু সেটা শ্রমের বাহ্যিক রূপের বদল; শারীরিক ধকলেরও বদল নয়, শোষণের চরিত্রেরও বদল নয়। বরং এর মধ্য দিয়ে শোষণের হার মাত্রা সূক্ষ্মতা ও জটিলতা আরও বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বহু গুণ বেড়েছে শারীরিক ধকলের মাত্রা।
বুঝবার সুবিধার্থে আবার একটা সহজ উদাহরণ দিই।
একজন ব্যাঙ্ক কর্মচারির কথা ভাবুন যিনি ক্যাশ কাউন্টারে বসে টাকা গুণে দেন এবং নেন। বিশ পঁচিশ বছর আগে তাঁকে চার ঘন্টা এই কাজ করতে হত। টাকার দামের সাপেক্ষে মানুষের লেন-দেনের পরিমাণ অনেক কম ছিল। কম্পিউটার ছিল না। কাগজে খাতায় লিখে কাজ করতে গিয়ে তাঁকে সেই সময় যে সংখ্যক খদ্দেরকে সামলাতে হত, আজ কিন্তু তার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। কেন না, যান্ত্রিক সুবিধার কারণে খদ্দের পিছু সময় দানের পরিমাণ কমে গেছে। প্রত্যেক খদ্দের পিছু টাকার লেন-দেনের পরিমাণও অনেক বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে কাউন্টারের সময় আরও অন্তত এক ঘন্টা বর্ধিত করা হয়েছে। এই সব মিলিয়ে বিশ বছর আগে এরকম একজন কর্মচারিকে প্রতিদিন যে পরিমাণ টাকা গুণতে হত আজ তা চার থেকে দশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক কিছু বাড়তি সমস্যাও আছে। টাকার লেন-দেন বাড়ার কারণে পাঁচশ এবং হাজার টাকার নোট বাজারে এসে গেছে বিপুল পরিমাণে। তাতে জাল নোটের সমস্যা যুক্ত হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। শেডের নীচে গরমে দাঁড়িয়ে হাতুড়ি পেটানোর চাইতে বাতানুকুল কক্ষে বসে করা এই খাটনিকে খালি চোখে আরামদায়ক মনে হতে পারে। কিন্তু ভুক্তভোগীই একমাত্র জানে, শরীর এবং মনের উপর এর দীর্ঘমেয়াদি ধকল কী সাংঘাতিক। এই রকম সমস্যাকে খুঁজে পাওয়া যাবে রেল বা বিমান পরিষেবা ক্ষেত্রের টিকেট বিক্রিরত কর্মচারিদের ক্ষেত্রেও।
এইভাবে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্র ধরে ধরে অনুসন্ধান চালালে এবং বিচার করলে দেখা যাবে, আধুনিক পুঁজিবাদের এই বিরাট সৌধ দাঁড়িয়ে আছে লক্ষ কোটি মানুষের অদৃশ্য কান্না ঘাম রক্ত অশ্রুর গ্রহ-সমান জেলির উপরে। উন্নত বিশ্বে চাকরি-বাকরির অর্থকরী অনেক সুবিধার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে এক সারাক্ষণের অনিশ্চয়তা—এই বুঝি চাকরি চলে গেল। হ্যাঁ, অনেক জায়গায় হয়ত বেকার ভাতার ব্যবস্থা আছে। বিনা পয়সার গণ-লঙ্গরখানা আছে। তাতে সাময়িকভাবে খাওয়াদাওয়ার হয়ত কিছুটা সুরাহা হতে পারে। কিন্তু আপনি মনে মনে কল্পনা করুন, যে মানুষটা দুদিন আগে একটা কোম্পানির উঁচু পদে কাজ করতেন, তাঁকে যখন ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে রাষ্ট্রের দানছত্রের টেবিলে গিয়ে দাঁড়াতে হয় তখন তাঁর মনের অবস্থা কী রকম হয়! এর ফলে আমেরিকায় জাপানে ম্যানেজারি পদে কর্মরত ব্যক্তিদের দু-তিন মাস অন্তর অন্তর মনোচিকিৎসাবিদের ক্লিনিকে গিয়ে মানসিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য পরামর্শ নিতে হয়। মার্ক্সবাদের বিকল্পই বটে!
সমাজতন্ত্র: রাশিয়া
সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে কী হয়েছিল তা নিয়ে অভিজিৎবাবু অনেক কথা বলেছেন, অনেক মৃত্যুর হিসাব দিয়েছেন। সোভিয়েত রাশিয়া সহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে সমাজতন্ত্র হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ার পর থেকে এই সব প্রশ্ন আরও বেশি করে জনমানসে ঢেউ তুলছে। মুশকিল হচ্ছে, এই সব ঘটনা ও তথ্যের মধ্যে এত রকম সত্য মিথ্যা মিলেমিশে আছে যে সংক্ষেপে আলোচনা করার অনেক অসুবিধা আছে। যে কোনো তরফেই অতিকথন অথবা অবমূল্যায়নের অভিযোগ উঠে যেতে পারে।
তথাপি, প্রশ্ন যখন উঠেছে এবং তা নিয়ে আলোচনা করতে যখন বসেছি, তখন দায় তো এড়িয়ে যেতে পারি না। অসুবিধামূলক প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায় না। নৈতিক দায় এবং রণনৈতিক কৌশল—কোনো দিক থেকেই তা যুক্তিসম্মত বা অভিপ্রেত নয়। তাই আমি এখানে এই বিষয়েও দু-চার কথা বলব। তবে এখানেও সংক্ষেপনের কারণে বিষয়ের প্রতি সুবিচার করতে না পারার জন্য আগাম মার্জনা ভিক্ষা করে নিচ্ছি।
সোভিয়েত রাশিয়া দিয়েই শুরু করা যাক।
১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব সফল হয়ে বলশেভিকরা ক্ষমতায় পাকাপাকিভাবে বসে যাওয়ার পর যখন ব্রিটিশ ফরাসি জার্মান ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য ক্ষেত্রের পুঁজি বাজেয়াপ্ত করে নিল, সাম্রাজ্যবাদীরা বুঝে গেল এরা সহজে এবং এমনি এমনি চলে যাবে না। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে চতুর্দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে এবং কোলচাক দেনিকিন প্রমুখ ভেতরের প্রতিবিপ্লবী শক্তিগুলির অভ্যুত্থানগুলিকে মদত দিয়ে চেষ্টা করল সোভিয়েত ব্যবস্থাকে উৎখাত করতে। লেনিনকে গুলি করে হত্যা করার চেষ্টা হল। এগুলো যে বাস্তব ঘটনা এবং এখান থেকেই যে হিংসার সূত্রপাত—এটা নিরপেক্ষ মন নিয়ে বিচার করতে বসলে যে কোনো বিশ্লেষককেই স্বীকার করতে হবে।
একথাও সত্য যে রুশ বিপ্লবের পরে পরেই শিক্ষা এবং বিজ্ঞানের পেছনে যে বিপুল অর্থ ও কর্মশক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল, উন্নতকে উন্নততর করার বদলে অনুন্নতকে উন্নত করার দিকেই যে পরিমাণ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল, তার দ্বিতীয় উদাহরণ শুধু সেই কালে নয়, পরেও আজ পর্যন্ত কোনো বুর্জোয়া রাষ্ট্র দেখাতে পারেনি। এই অভূতপূর্ব কর্মোদ্যোগের ফলও মিলেছিল অবিলম্বেই। সমকালীন বিজ্ঞানের এক একটা অসমাধিত জটিল সমস্যার সমাধান আসতে লাগল সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে, যা ছিল দু-চার বছর আগে ইউরোপের এক পশ্চাদপদ অংশ। ১৯২২ সালেই আলেকজান্দার ফ্রিদম্যান আইনস্টাইনের সেই ল্যাম্বডাকে উড়িয়ে দিয়ে প্রসারণশীল বিশ্বের ধারণা নিয়ে এলেন; ১৯২৪ সালে ওপারিন নিয়ে এলেন প্রাণের উৎপত্তির এক ভৌত-রাসায়নিক তত্ত্বকল্প, যার সম্ভাব্যতা সিকি শতাব্দ বাদেই পরীক্ষামূলকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে; পাভলভের “নীরবতার স্তম্ভ” গবেষণাগার নির্মিত হয়ে শর্তাধীন পরাবর্তের গবেষণা তখন পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে চলেছে, যার ভিত্তিতে উচ্চতর স্নায়বিক ক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞান এবং অবশেষে চিন্তার বাস্তব শারীরতাত্ত্বিক ভিত্তি জানা যাবে; প্রায় সেই সময়ে মার্ক্সীয় দর্শনের আলোকে মনস্তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজতে শুরু করলেন লেভ ভাইগতস্কি; নিকোলাই ভ্যাভিলভ তখন সারা পৃথিবী ঢুঁড়ে কৃষিজ উদ্ভিদের উৎসভূমি খুঁজে বেড়াচ্ছেন; মার্কভ বার্নস্টাইন কোমোগোরভ গ্নেডেঙ্কো প্রমুখ গণিতবিদরা গণিত রাশিবিজ্ঞান ও সম্ভাব্যতা তত্ত্বে সর্বোচ্চ পর্যায়ের গবেষণা করে যাচ্ছেন; চেতভেরিকভ ১৯২৬ সালে জিনতত্ত্বের সাথে ডারউইনের বিবর্তনবাদের সংযোজন করে ফেলেছেন (যা পরে, ১৯৩০ সালে ফিশারের কাজ হিসাবে বিশ্বে পরিচিত হয়); ১৯৩২ সালে পাভলভ অবশেষে প্রস্তাবনা করলেন তাঁর প্রথম সঙ্কেততন্ত্র ও দ্বিতীয় সঙ্কেততন্ত্রের তত্ত্ব, মানুষের কথা ও চিন্তার বাস্তব ভিত্তি যার আলোকে বুঝতে আর কোনো অসুবিধা রইল না; … ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনি আরও কত কিছু … ।
হ্যাঁ, শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে এরকম অগ্রগতি সত্ত্বেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিচ্ছিল। লেনিন যে যোগ্যতা ও দক্ষতার সঙ্গে দলের ভেতরে ও বাইরে সমস্ত বিতর্ক ও মতবিরোধকে সামলে সকলকে সঙ্গে নিয়ে সমাজতন্ত্রকে রক্ষা ও বিকশিত করার কাজে এগোতে পেরেছিলেন নানা কারণেই জোসেফ স্তালিন সেই কুশলতা দেখাতে পারেননি। তার উপর নেপ-নীতির ভিত্তিতে অর্থনীতিকে খানিকটা চাঙা করে নিয়ে যখন সোভিয়েত রাষ্ট্র কুলাক উচ্ছেদ ও শিল্পায়নের কর্মসূচি নিয়ে এগোতে শুরু করল তখন যে পরিমাণ নাশকতামূলক চক্রান্ত চলেছিল তাকে রুখতে গিয়ে দল ও রাষ্ট্র যেন নাকানিচুবানি খেতে থাকে। অবশেষে লেনিনগ্রাদের সদর দপ্তরে কিরভকে দিনের বেলায় হত্যা করে যাওয়ার পর স্তালিন-নেতৃত্ব দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে পড়েন যে কোনো মূল্যে নাশকতা বন্ধ করার জন্য। এইখান থেকেই শুরু হয়ে যায় নাশক-হিংসার বদলে রাষ্ট্রীয়-প্রতিহিংসার রক্তাক্ত অধ্যায়। প্রকাশ্য ও গোপন শত্রু নিধন করার সঙ্গে সঙ্গে বহু নিরীহ নির্দোষ মানুষকেও নাৎসি জার্মানির দালাল সন্দেহে গ্রেপ্তার বিচার ও হত্যা চলতে থাকে। এই পুরো পর্বটাই এক সাদা-কালো-ধূসর ইতিহাস—যার কিছু আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, কিছু কিছু জানি অত্যন্ত ভাসা ভাসা ভাবে, আর কিছু বিষয় একেবারেই জানি না।
এই না জানার পেছনে অন্যতম কারণ দুদিক থেকেই একতরফা প্রচার। স্তালিন জমানায় যা জেনেছি তা যেমন একতরফা, স্তালিনোত্তরকালে যা জানা গিয়েছে তার মধ্যেও একপেশে খবরই ছিল।
আজও বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি থেকে যে সমস্ত গবেষণা হচ্ছে তার বেশিরভাগই সমাজতন্ত্রকে হেয় প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে পরিচালিত। সত্যানুসন্ধানের কোনো প্রচেষ্টাই তাতে নেই। পক্ষান্তরে যে মুষ্টিমেয় কিছু মার্ক্সবাদী নেতা একালেও স্তালিন-জমানার পক্ষে লিখছেন—যেমন, আমেরিকায় স্যাম মারসি, ইংলন্ডে উইলিয়াম ব্ল্যান্ড, সুইডেনে মারিও সৌসা, ভারতে প্রভাস ঘোষ—তাঁরাও অনেক প্রশ্নে ভালো আলোচনা করার পরেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে ধূসর এলাকাগুলি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করে যাচ্ছেন।
একথা যুক্তিগ্রাহ্য ঠিকই যে ১৯৩০-এর দশকে ব্যাপক গ্রেপ্তারি বিচার ও শাস্তিদানের ঘটনার পর ১৯৪১ সালে জার্মান আগ্রাসনের পুরো সময়কাল জুড়ে রাশিয়ায় পঞ্চম বাহিনীর কোনো উৎপাত ছিল না, যা সেই ঝোড়ো দিনগুলিতে ইউরোপের সমস্ত দেশ হিটলারের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে মোকাবিলা করেছে। অনেক ভুলভ্রান্তি সত্ত্বেও একথা তো সত্যি যে নাৎসি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রায় একা হাতে লড়াই করে সোভিয়েত রাশিয়া সেদিন সারা ইউরোপ এবং মানবসভ্যতাকে রক্ষা করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি দুর্বল দেশের উপরে হামলা চালানোর ব্যাপারে অন্তত কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়েছিল। আজ যেভাবে আমেরিকা ইরাক আফগানিস্তান লিবিয়ার দখল নিয়েছে, ইরান উত্তর কোরিয়া সিরিয়া কিউবার বিরুদ্ধে তড়পাচ্ছে, নিজেরা কৃষিতে ব্যাপক হারে ভর্তুকি দিয়ে ভারত-বাংলাদেশকে চাপাচাপি করছে কৃষিতে ভর্তুকিদান বন্ধ করতে, সমাজতান্ত্রিক শিবির দুর্বলভাবে টিকে থাকলেও এসব জিনিস ওরা করতেই পারত না। সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের পক্ষ থেকে যাঁরা লিখছেন, তাঁরা এই সব ব্যাপার বেমালুম চেপে যাচ্ছেন।
কিন্তু বিপরীত দিক থেকে স্তালিন আমলের পক্ষ নিয়ে যাঁরা কলম ধরেছেন, তাঁরাও একই ভাবে অনেক কিছুই হয় দেখতে পাচ্ছেন না, অথবা দেখেও না দেখার ভাণ করছেন। তিনটি বিখ্যাত মস্কো বিচারের (১৯৩৪-৩৮) পর যখন পার্টির পুরনো নেতা ও সদস্যদের এক বিরাট অংশ বহিষ্কৃত সাজাপ্রাপ্ত এবং/অথবা নিহত, পরবর্তী পার্টি কংগ্রেসে (১৯৩৯) তার কারণ মাত্রা গুরুত্ব ও ফলাফল নিয়ে স্তালিন বা অন্য নেতাদের নীরবতা সম্পর্কে তাঁদের কোনো বক্তব্য নেই। ভ্যাভিলভের বিচার শাস্তি ও মৃত্যু, বুখারিন এবং বরিস হেসেনের বিচার ও হত্যা, ভাইগতস্কির অকাল মৃত্যুর পর তাঁর তত্ত্বের চর্চারোধ, ইত্যাদি বহু ঘটনারও কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা বা বিশ্বাসঘাতকতার তথ্যগত সমর্থন আজ অবধি তাঁরা কেউ দিতে পারেননি। বিচারের সময় অভিযুক্তদের নিজমুখে স্বীকারের যে একমাত্র তথ্য তাঁরা দিতে পারছেন, সামগ্রিক পরিস্থিতির এবং পরবর্তী ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে তার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রায় শূন্য। তার তাঁরা লাইশেঙ্কো পরিঘটনারও কোনো রকম ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না বা দিচ্ছেন না। তাঁরা সকলেই স্তালিন-প্রশ্ন এমনভাবে আলোচনা করে যাচ্ছেন যেন এই সব কোনো ঘটনাই কোথাও কোনোদিন ঘটেনি।
আমাদের মধ্যে যাঁরা আপাতত সরাসরি কোনো পক্ষের হয়ে সাফাই গাইবার ওকালতনামায় স্বাক্ষর দিইনি, তাঁদের অত্যন্ত সতর্ক হয়ে এই সব স্পর্শকাতর বিষয়ে মতামত দিতে হবে। ধরুন, ইউক্রেনের কোথাও একটা গণকবর খুঁজে পাওয়া গেল। এটা স্তালিন জমানার কীর্তি না জার্মান সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ড—আমরা বুঝব কীভাবে? এই জিনিস বুঝবার জন্য অনুমিত ঘটনার আগে পরে আরও অনেক তথ্য জানা দরকার। তা না হলে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতিটি হবে নিম্নরূপ: ‘স্তালিন আমলে অনেক গণহত্যা হইয়াছিল; এক্ষণে একটি গণ কবর পাওয়া গিয়াছে; সুতরাং এই গণ কবরটি স্তালিন আমলের তেমন একটি গণহত্যার সাক্ষ্য।’ এরকম যুক্তির মানে হল, যাকে প্রমাণ করতে হবে তাকেই প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করা। তর্কশাস্ত্রে এর একটা ভালো লাতিন নাম আছে: “Petitio principi”। সমস্ত বড় পশ্চিমি নৈয়ায়িকরা প্রলোভন এড়িয়ে এর খপ্পরে পড়তে বারণ করে দিয়েছেন।
চিনের দুর্ভিক্ষ
রাশিয়া তো খানিকটা হল। এবার চিন সম্পর্কেও দুচার কথা বলতে হবে। একে আমাদের প্রতিবেশি দেশ। তার উপর আমাদের সাথে সেই সুদূর অতীতকাল থেকে চিনা সভ্যতার যোগসূত্র স্থাপিত হয়ে আছে। চিনের ভালোমন্দ সম্পর্কেও আমাদের অপার কৌতুহল থাকাটা কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
চিন সম্পর্কে আমি অন্য বিষয়ে আলোচনা করব না। শুধু লেখক যে বিষয়টির উত্থাপন করেছেন তার সাথে বিজড়িত কিছু প্রসঙ্গ এখানে তুলে ধরব। প্রসঙ্গ চিনের ১৯৫৮-৬০ সালের দুর্ভিক্ষ। এই প্রসঙ্গটি দুটো কারণে ইদানীংকালে বুর্জোয়া প্রচার যন্ত্রে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। একদিকে চিনের ভেতর থেকে তেং শিয়াও-পিং নেতৃত্ব মাও সে-তুঙের সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে নিন্দা করতে গিয়ে মাওয়ের সমস্ত কার্যকলাপকেই মসিলিপ্ত করতে চেয়েছে; তারই অঙ্গ হিসাবে এই দুর্ভিক্ষকেও সমকালীন “বৃহৎ উল্লম্ফন কর্মসূচি” (great leap forward)-এর পরিণাম হিসাবে তুলে ধরেছে। মাওয়ের আদর্শগত শুদ্ধতা নিয়ে অতি বাড়াবাড়ি এবং তজ্জনিত অবিমৃষ্যকারিতার ফলেই নাকি এই বিপর্যয় ঘটেছিল। তাদেরই বিভিন্ন ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী এই সব রটনাকে ঘটনার রঙে এঁকে পশ্চিমি প্রকাশকদের হাতে তুলে ধরছে এবং তারাও খুশি মনে এই সব অপলাপকে সাক্ষাত প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীর বিবরণ হিসাবে ছাপিয়ে বিক্রি করে বেশ দু পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে। অপরদিকে বাঙালির গর্ব নোবেল জয়ী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর এক গম্ভীর রচনায় দাবি করেছেন, স্বাধীন ভারতে যে চিনের মতো বড় কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি তার কারণ ভারতের আর চিনের শাসন ব্যবস্থার পার্থক্য। ১৯৪৭-উত্তরকালে ভারতে গড়ে উঠেছে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন আর চিনে ছিল কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণে একদলীয় একনায়কত্ব। ভারতে বিরোধী রাজনীতি আর মুক্ত প্রেস—এই দুইয়ের চাপে সরকারকে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি যাতে না হয় তা দেখে রাখতে হয়। চিনে বিরোধী দলও নেই, মুক্ত গণমাধ্যমও নেই। কমিউনিস্ট পার্টি নিশ্চিন্তে দুর্ভিক্ষ হতে দিতে এবং তা প্রচারে গোপন রাখতে পেরেছে। এই দুটো উৎস মিলিয়ে দুর্ভিক্ষের গল্পটিও বেশ জমে উঠেছিল। অভিজিৎবাবুও হয়ত সেই সব উৎস থেকেই গল্পটা সংগ্রহ করেছেন এবং কোনো রকম যাচাই না করে তাঁর আলোচ্য প্রবন্ধে নিশ্চিন্ত মনে তা সন্নিবেশ করে ফেলেছেন।
আসলে চিনে সেদিন কী ঘটেছিল?
প্রথমত, ওই তিন বছর চিনে ব্যাপক ও ভয়াবহ খরা হয়েছিল, যার ফলে ফসল উৎপাদন প্রচণ্ড মার খেয়ে যায়। বস্তুত, ১৯৬০ সালে গোটা উত্তর চিনের শতকরা ৬০ ভাগ জমিতে কোনো বৃষ্টিপাত হয়নি। আর অভিজিৎবাবু নিশ্চয়ই জানেন, অন্য সব খবর কমিউনিস্ট একনায়কত্বের প্রশাসনিক দাপটের জোরে চেপে দেওয়া বা বিকৃত করা গেলেও বৃষ্টিপাতের খবরের উপর কাঁচি চালানো যায় না।
দ্বিতীয়ত, ১৯৫৯ সালে পীত নদীতে যে বিপুল বন্যা হয়, যাকে বিংশ শতাব্দের সব চাইতে মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলা হয়ে থাকে, তাতেও কম পক্ষে ২০ লক্ষ লোক মারা যায়।
তৃতীয়ত, স্তালিন মূল্যায়ন ও অন্যান্য মতাদর্শগত প্রশ্নে চিনের মাও-নেতৃত্বের সঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ার ক্রুশ্চভ-নেতৃত্বের যে ব্যাপক মতপার্থক্য দেখা দেয় তার জেরে, মাওকে কোনোভাবেই ক্রুশ্চভের দাপটের কাছে মাথা নোয়ানো যাবে না বুঝতে পেরে, রাশিয়া একতরফাভাবে চিন থেকে সমস্ত সোভিয়েত সাহায্য হঠাৎ করে প্রত্যাহার করে নেয়। আর সেই সময় চলছিল সমগ্র সাম্যবাদী শিবিরের বিরুদ্ধে আমেরিকার প্রবল আর্থিক বয়কট নীতি, যার ফলে বিদেশ থেকে চিনে খাদ্যশস্য আমদানি করা বা অন্য কোনো দেশের থেকে সাহায্য গ্রহণ করাও সম্ভব হচ্ছিল না।
চতুর্থত, এই দুর্বিপাকের সুযোগ নিয়ে লিউ শাও-চি তেং শিয়াও-পিং প্রমুখ পুঁজিবাদের পথিকরা, যাদের বিরুদ্ধে মাও বৃহৎ উল্লম্ফন নীতির মধ্য দিয়ে আদর্শগত লড়াই চালাতে চাইছিলেন, শুধু যে সেই লড়াইকেই বিপথগামী করে দিতে সচেষ্ট হয় তা নয়, একই সঙ্গে উৎপাদনের নানা উপভাগে গণ্ডগোল লাগিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলে মাও-নেতৃত্বকে মলিন করতে চেয়েছিল। এই সমস্ত ঘটনার মিলিত ফল হিসাবেই সেই তিন বছরে একটানা খাদ্য সঙ্কটে চিনে প্রায় দেড় কোটি লোক মারা গিয়েছিল। [Henry C. K Liu, “The Great Leap Forward not all bad”; Asia Times Online Co. Ltd., 1 April 2004]
হাল আমলে চিনের সেই দুর্ভিক্ষের উপরে যে সমস্ত বই বেরিয়েছে, যাতে চিনা সমাজতন্ত্রকে যতটা পারা যায় কালো কালিতে দেখানো হয়েছে, সেইগুলিকে এক সঙ্গে বিচার করে বিশিষ্ট ভাষাবিদ নোয়াম চমস্কি তাঁর একটি রচনায় কিছু মূল্যবান বিশ্লেষণ ও মন্তব্য করেছেন। তার একটা অংশে আছে শুধুই অঙ্কের হিসাব। তাও আবার সেই অঙ্কগুলি অমর্ত্য সেনেরই দেওয়া। আমি সেই জায়গাটুকু শ্রীরায়ের অবগতির জন্য (একটু ভাষাগত সংক্ষেপন করে) উদ্ধার করতে চাই:
“অধ্যাপক সেনের কথার উপর নির্ভর করে আমরা তো চিনকে অনেক গালাগালি করলাম। বইপত্তর গোটানোর আগে সেন আরও কী কী বলেছেন সেটা যদি একবার দেখে নিতাম। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ভারত আর চিনের অবস্থা কম বেশি একই ছিল। কিন্তু তারপর নাগরিকদের শিক্ষা ও অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষার সঙ্গে মৃত্যুহার ও রুগ্নতা হ্রাস এবং আয়ুষ্কাল বৃদ্ধির ক্ষেত্রে চিনের অবস্থা ধীরে ধীরে ভারতকে অনেক দূর ছাড়িয়ে গেছে। ভারত যদি চিনের ব্যবস্থাপত্তর গ্রহণ করত তাহলে ১৯৮০-র দশকে এসে ভারতে মৃত্যুর ঘটনা বছরে গড়ে ৩৮ লক্ষ কম হত। তার মানে, স্বাধীনতা-উত্তর প্রতি ৮ বছরে ভারতে যত লোক স্রেফ খাদ্যাভাবে বা অস্বাস্থ্যের কারণে মারা যায়, তা চিনের ওই তিন বছরের কেলেঙ্কারির চাইতেও অনেক বেশি (যদিও সেটি ছিল শতাব্দের নিকৃষ্টতম দুর্ভিক্ষ)।” [Noam Chomsky, Rogue States: The Rule of Force in World Affairs, Pluto Press 2000: p. 177]
তবে চমস্কির রসবোধ অসাধারণ। আড্ডার মজলিশে বসলে চট করে থামতে জানেন না। সেনের বই থেকে আরও কী কী কথা খুঁজে বের করেছেন দেখুন।
“চিনের শাসকরা তাদের জনসাধারণের জন্য খাদ্য শিক্ষা স্বাস্থ্য চিকিৎসা ইত্যাদির যে ঢালাও ব্যবস্থা করেছিল ভারতে তার কিছুই নেই। প্রবৃদ্ধির হারের সাথেও এর কোনো সম্বন্ধ নেই। কেন না, বিচার্য সময়কালে ভারত ও চিনের প্রবৃদ্ধির হার ছিল মোটামুটি একই। এটা ছিল সামাজিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা ব্যবস্থার ফল।”
কী বুঝছেন অভিজিৎবাবু? স্বয়ং অমর্ত্য সেনই যে এই সব কথা বলেছেন, আগে কি জানতেন?
সেনবাবুর শ্যেন চক্ষু সেখানেই থামেনি। আরও লক্ষ করেছে,
“কিন্তু চিনের এই সামাজিক রক্ষা কবচগুলি ১৯৭৯ সাল থেকে, অর্থাৎ, খোলা বাজার অর্থনীতি চালু হওয়ার পর থেকে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে, সেই সাথে চিনে মৃত্যু হার বেড়ে যায়, আয়ুষ্কাল সামান্য হলেও কমে যায়। মেয়েদের গড় আয়ু অন্তত দু বছর কমে যায়। নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে, নারী-পুরুষের অনুপাত হ্রাস পায়। কেন না, বাজার ভিত্তিক অর্থনীতি এইসব সামাজিক সুরক্ষার জন্য অনুৎপাদক অর্থব্যয়ে রাজি নয়।” [Ibid, pp. 177-78]
বাকি কথাটা আর অনুবাদে না দিয়ে চমস্কির নিজস্ব চমকপ্রদ ভাষাতেই পেশ করি:
“We therefore conclude that in India the democratic capitalist “experiment” since 1947 has caused more deaths than in the entire history of the “colossal, wholly failed … experiment” of Communism everywhere since 1917: over 100 million deaths by 1979, and tens of millions of more since, in India alone.” [Ibid, p. 178]
একজন সাদা চামড়ার সাহেব আমাদের একজন খ্যাতিমান বাঙালির বই থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন, দেখেও আনন্দ আর গর্ব হয় বৈকি! ভেবে দেখুন, যদি এই আনন্দ ও গর্ব আমার সাথে শেয়ার করতে রাজি থাকেন, তাহলে কিন্তু চিন সম্পর্কে, মাও সম্পর্কে এবং চিনের দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে আপনার মতটাকে সামান্য সংশোধন করতে হবে। তাতে যদি বৈদিক ঋষিদের মতো আমাদেরও এক আধবার “অসতো মা সদ্গময়ো” হয়, তাতেই বা ক্ষতি কী?
পোল পোত বনাম র্যাম্বো
সত্য আবিষ্কারে ধনতান্ত্রিক মুক্ত দুনিয়ার আগ্রহের অনেক নমুনাই তো আমরা জানি। আপাতত তার আর একটা নমুনার কথা বলি। কাম্পুচিয়া প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করলে এর একটা নতুন দিক আমাদের কাছে উন্মোচিত হতে পারে। তার ফলে আরও অনেক কিছু বুঝতে আমাদের সুবিধা হবে।
১৯৭৪ সালে কাম্পুচিয়ায় মার্কিন আধিপত্যের পতন ঘটে এবং পোল পোতের নেতৃত্বে খেমের রুজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তারপর পোল পোত প্রশাসন কাম্পুচিয়ায় কিছু সামাজিক-অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি নেয়। রাজধানী নমপেন শহর তখন লুম্পেনে ভর্তি, নারীদের এক বিরাট অংশকে গ্রাম থেকে পয়সার লোভ দেখিয়ে তুলে এনে দখলদার বাহিনী দেহব্যবসায় নামিয়ে দিয়েছিল। তাদেরকে সরিয়ে গ্রামাঞ্চলে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে উৎপাদনমূলক কাজে নিযুক্ত করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে এবং পাশাপাশি নমপেন শহরকে নতুনভাবে পুনর্গঠিত করতে গিয়ে তাঁদের ব্যাপক জনসংখ্যার স্থানান্তরণের ব্যবস্থা করতে হয়। তার মধ্যে হয়ত কিছু যান্ত্রিকতা বা জবরদস্তিও ছিল। কিন্তু আমেরিকান আগ্রাসনকারীদের এটা একদম মনঃপুত হয়নি। তারা বুঝে ফেলে, পোল পোতের এই কর্মসূচি একবার সফল হয়ে গেলে আর তাদের পক্ষে ভবিষ্যতে কোনো প্রকারে ওখানে ঢোকা সহজ হবে না।
শুরু হল খেমের রুজের বিরুদ্ধেও একই রকম অপপ্রচার। লক্ষ লক্ষ খুনের গল্প। হলিউডে তৈরি হল সিনেমা—র্যা ম্বো ওয়ান, র্যা ম্বো টু। দেখলে গা একেবারে শিউড়ে ওঠে। এই খুনের গল্প তো অভিজিৎবাবু সহ দুনিয়ার প্রায় সকলেই জানেন। কিন্তু আর একটা ছোট গল্প, যেটা আমি এখানে বলতে চাইছি, কত জন জানেন?
ব্রিটেন থেকে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ-এর ইতিহাসের অধ্যাপক ম্যালকম কডওয়েল ১৯৭৮ সালে গিয়েছিলেন কাম্পুচিয়ায় সরেজমিনে তদন্ত করে দেখতে ওখানে সত্যি সত্যিই কী ঘটছে। নমপেন থেকে যাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, কী কাজে লাগানো হয়েছিল—এই সব তিনি স্বচক্ষে দেখে দেখে স্টোরি তৈরি করে দিচ্ছিলেন। চার কিস্তি লেখা পাঠানোর পর এক রাতে (পর দিন তাঁর দেশে ফেরার বিমান ধরার কথা ছিল) নম পেনের এক বিখ্যাত আন্তর্জাতিক অতিথিশালায় তাঁকে একদল আততায়ী মাঝরাতে গুলি করে মেরে ফেলে। (বহুকাল বাদে, ২০০৫ সালে একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক তাঁর বইতে জানিয়েছেন, খুব সম্ভবত ভিয়েতনাম থেকে ওই আততায়ীরা এসেছিল; কডওয়েলের হত্যাকাণ্ডের তিন দিন পরেই ভিয়েতনাম কাম্পুচিয়া আক্রমণ করেছিল)। কেন জানেন? যে সমস্ত রিপোর্ট তিনি পাঠাচ্ছিলেন তাতে পোল পোত বিরোধী অপপ্রচারের ছাল চামড়া ছাড়িয়ে আনছিলেন। খোঁজ নিয়ে দেখুন, এই নিহত অধ্যাপকের কথা, তাঁর খুন হওয়ার ঘটনা, তাঁর চার কিস্তি লেখার মালমশলা—কটা লোক আজ জানেন? ভারত-বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলিরও খুব বেশি নেতা-কর্মী সম্ভবত আজকে আর এসব জানেন না বা মনেও করতে পারেন না।
তার চেয়েও মজার কথা কি জানেন? আজ যারা পোল পোতের নিন্দায় মুখর তাঁরাও লিখতে বাধ্য হচ্ছেন, “In May 1975, one month after the Khmer Rouge evacuated the capital, the Swedish author Per Olov Enquist wrote: “The brothel has been emptied and the clean-up is in progress. Only pimps can regret what is happening.” If that was blatant wishful thinking, it’s an unpalatable truth that the pimps have returned. A potent mix of Developing World poverty, cheap flights and sexual licence has made Cambodia a magnet for sex tourists and paedophiles. The upmarket hotels around the riverside are full of western and Japanese businessmen, and a certain kind of furtive middle-aged traveller, stubble-chinned and plump-stomached, is a conspicuous presence in the bars and clubs frequented by young and under-age prostitutes.” [Andew Anthony, “Lost in Cambodia”; The Observer; 10 January 2010;
অন-লাইনে পাওয়া যায়; মোটা হরফ আরোপিত] এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন খেমের রুজ এবং পোল পোতকে ওরা কেন এত খারাপ বলে?
আপাতত শেষ কথা
অতএব আমাদের সাবধানে পা ফেলতে হবে। সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে আমরা যে বেশি স্পর্শকাতর তার কারণ আমরা এর কাছে অনেক কিছু প্রত্যাশা করেছি। আমরা ব্রিটিশ আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের কাছে ভালো কিছুই প্রত্যাশা করিনি। আমরা জানতাম, তারা আমাদের দেশ ভাগ করেছে, কোরিয়াকে ভেঙেছে, ভিয়েতনামকে দু টুকরো করার চেষ্টা চালিয়েছে। চিন থেকে এক টুকরো বেগুনি (তাইওয়ান) ছিঁড়ে নিয়ে গিয়ে তাকেই দু দশক ধরে রাষ্ট্রসংঘে আসল চিন বলে চালিয়েছে, প্যালেস্টাইনকে ভেঙে ইস্রায়েল বানিয়ে শেষে প্যালেস্টাইনকেই ভিখিরি করে ফেলেছে, তারাই জার্মানি এবং বার্লিন শহরকে দুভাগ করে গোটা দায় চাপিয়ে দিয়েছে স্তালিনের ঘাড়ে। আমার এক বন্ধু ১৯৯১ সালে জানালেন, পূর্ব বার্লিন থেকে পশ্চিম বার্লিন যাওয়ার সময় তিনি একটি উঁচু তোরণের মাথায় একটা ঘোষণা-বাক্য পড়ে হতভম্ব হয়ে যান: “You are now entering the American territory.” আরও অনেক লোকই তো এটা দেখেছে, কতজন জানতে চেয়েছে, এও কি স্তালিনের কাজ? অর্থাৎ, আমি বলতে চাই, সাবধান না হলে সহজেই ওদের অপপ্রচারের ফাঁদে পড়ে যাব, এবং ওদের কথাগুলো নিজেদের কথা ভেবে বলতে থাকব।
এই পর্ব আমি এখানেই শেষ করতে চাই। যদি পাঠকদের কোনো ক্ষুদ্র অংশেরও আগ্রহ থাকে তাহলে মার্ক্সীয় দর্শনের অন্যান্য দিক, বিজ্ঞান, দ্বন্দ্বতত্ত্ব, ইত্যাদি নিয়ে আরও দুচার কথা হয়ত ভবিষ্যতে বলতে পারি। আমি মনে করি, মার্ক্সবাদ নিয়ে মার্ক্সবাদীদেরও অনেক কিছু নতুন করে ভাববার আছে। মার্ক্সবাদী দলগুলিকেও নানা উৎস থেকে, এমনকি বিভিন্ন অদলীয় উৎস থেকেও, তথ্য, যুক্তি, জ্ঞান, সংগ্রহ করবার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। মার্ক্সবাদের যাঁরা সমালোচনা বা নিন্দা করেন তাঁরা সকলেই তো ধনতন্ত্রের দালাল বলে তা করেন না। বিভ্রান্ত হয়ে, অথবা কিছু কিছু মার্ক্সবাদীর অন্যায় আচরণ দেখে আস্থা হারিয়ে তাঁরা মার্ক্সবাদ বিরোধী প্রচারের স্রোতে ভেসে যান। তাঁদেরকে আমাদের যুক্তি দিয়ে সত্যের অভিকর্ষ দিয়ে গোত্রান্তর ঘটাতে হবে। মিথ্যার পাশাপাশি, অপপ্রচারের পাশাপাশি, সারা দুনিয়া জুড়ে জ্ঞানের চর্চা চলছে, সত্যের সাধনা হচ্ছে। সোক্রাতেস ব্রুনো চার্বাকরা সহজে মরেন না। সহজে তাঁরা হারও মানেন না। খোলা মন নিয়ে তাঁদের খুঁজে নিতে হবে। সকলের সাথে মিলিত হতে হবে। একমাত্র তখনই আমরা প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া শ্রেণির সম্মিলিত অপপ্রচারের ফানুসটা ফাটিয়ে দিতে পারব।
অভিজিত বাবু এবং আশোক বাবু দুজনের লেখার সঙ্গে সাইড ডিশ হিসেবে মন্তব্যগুলিও পড়লাম। নিজে ঋদ্ধ হলাম। এরকম লেখা আরও পড়তে চাই।
মার্ক্সবাদ বৈজ্ঞানিক মতবাদ’? নাকি নয় ? এসব প্রশ্ন নিরর্থক। মার্ক্সবাদ সমাজ বিকাশের একটা তাত্বিক ধারণার প্রসার করতে চেয়েছিল। যা আসলে বর্তমানের মুক্ত গণতান্ত্রিক চেতনার আলোকে অনেক পশ্চাৎবর্তী ভাবনা। মার্ক্সবাদি মতবাদের যুগোপযোগী সংস্কার করতে না পারলে – প্রাচীন সাম্যবাদী সমাজ, বলপ্রয়োগের মতবাদ ইত্যাদির মতো একটি প্রাচীন মতবাদ হিসেবেই ছাত্র পাঠ্য বই-এর উপাদান হয়েই রয়ে যাবে।
ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত হয়ে, ব্যক্তি স্বাধীনতাকে ও বাক স্বাধীনতাকে গুরুত্ব না দিলে মার্ক্সবাদ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে। সমকালীন পৃথিবীর চালচিত্র দেখেও যদি মার্ক্সবাদীরা সচেতন না হয়, তাহলে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘অন্ধ হলে তো প্রলয় বন্ধ হবেনা’।
নিচে আমেরিকার সম্পদ বন্টনের একটা ভিডিও চিত্র শেয়ার করলাম। অভিজিৎ রায়, বিপ্লব পাল এবং তাদের অনুসারীদের জন্যে, তারা ডাটা বোঝেন না। তাই সচিত্র প্রতিবেদন।
http://www.utrend.tv/v/9-out-of-10-americans-are-completely-wrong-about-this-mind-blowing-fact/
এদেশের সমাজতন্ত্রীদের একটা বড় সমস্যা হল তারা জ্ঞানের ভারে মটমট করে। মার্ক্সবাদ বলি আর মানবমুক্তি বলি, সবারই উদ্দেশ্য হল সবাই মিলে একসাথে খেয়ে পড়ে ভালো থাকা, আর সেটা সম্ভব করতে হলে কি করা দরকার বা কিভাবে সেটা করা যেতে পারে সেইসব দরকারী তথ্যগুলো সবাইকে জানানো, এদেশে সমাজতন্ত্রীদের কথা বলা উচিত এই এঙ্গেলে। সমাজতন্ত্র বা পুঁজিবাদ এগুলো সবই একেকটা সিস্টেম। বিশাল, জটিল একেকটা সিস্টেম। এবং এগুলো কোনটাই সার্বজনীন নয়, প্রতি নিয়ত পরিবর্তনশীল। অনেক আগেও মানুষ এভাবে বাঁচতোনা, ভবিষ্যতেও আমাদের জীবনযাত্রা এখনকার মত থাকবেনা। কিন্তু যেটা থেকে যাবে তা হল আরেকটু ভালভাবে বাঁচার আকাঙ্খা। আমাদের এটা দেখা উচিত কোন সিস্টেমটা মানুষের জন্য বেশী অধিকার দিতে পারে। দার্শনিক আলোচনা করতে গিয়ে কে কবে কখন কিভাবে কি করেছিল এসব তথ্য নিয়ে কথা বলতে গেলে সেটা আমাদের শেষ পর্যন্ত কোথও নিয়ে যাবেনা। কেননা এগুলো সব একেকটা তথ্য। এভাবে তথ্যের বিপরীতে তথ্য দিয়ে যেতে থাকলে কথা বলে লাভ কি আর সমাজতন্ত্রর সপক্ষে লিখেই বা লাভ কি? সমাজতন্ত্রীদের উচিৎ দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনের চেষ্টা করা। কেননা অর্জিত জ্ঞান কার কাজে লাগবে সেটা ঠিক করে দেয় আমি নিজেকে কোন দলের মনে করি তার উপর। কিভাবে চিন্তা করলে বা কাজ করলে সবাইকে আরো বেশী অধিকার দেয়া সম্ভব সেটা নিয়ে কথা বলা, সব মানুষের অধিকার যে সমান তা নিয়ে আওয়াজ তোলা, এটাই না সমাজতন্ত্রীদের কথা বলার উদ্দেশ্য হওয়ার কথা।
বর্তমান ব্যাবস্থাটা হল মনোপলি খেলার মত। সবাই যদি একই পরিমান সম্পদ নিয়েও খেলা শুরু করে তারপরেও খেলা শেষ না হতেই দেখা যাবে কারো কাছে সম্পদের পাহাড় জমে গেছে আর কেউ নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে। এখানে খেলোয়াড়দের কোন দোষ নেই, খেলার নিয়মটাই এরকম। খেলোয়াড় চাইলেও এটা ঘটবে, না চাইলেও। কারন সিস্টেমটাই প্রতিযোগিতামূলক। এখানে মানুষজন একে অপরকে প্রতিপক্ষ ধরেই নিতে হয়। এখানে শেখানোই হয় সবাই সমান না, তাহলে সবার অধিকার সমান হবে কেন? এরকম কোন সিস্টেম সব মানুষের অধিকার কিভাবে দিতে পারবে?
কিছু কাজ আছে, শুধু শখের বশে পড়াশোনা করে ঠিকমতো শেখা যায়না। হাতে কলমে কাজ করে শিখতে হয়। এটা দোষ নয়, অত সময় কোথায় আমাদের? যাঁদের সমাজতন্ত্রের জন্য প্রত্যক্ষ কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই, আপনাদের ভাষায় বুর্জোয়া, শুধু বুর্জোয়া কেন, বহু সমাজতন্ত্রর সমর্থককেও দেখেছি ব্যাক্তিগত সম্পত্তি সম্পর্কে একটু বা ভাসাভাসা ধারনা নিয়ে, সমাজতন্ত্রের প্রতি এক ধরনের আবেগ থেকে শ্রেনীচেতনা, সমানাধিকার এসব নিয়ে গলা ফাটাতে। কোন মানুষের সম্পদকেন্দ্রিক ধারনা পুরোটাই দাড়িয়ে আছে ব্যাক্তিগত সম্পত্তিজাত ধারনার উপর। পর্যাপ্ত জ্ঞান, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এসব থাকা স্বত্তেও অনেক সমাজতন্ত্রী সাথে আজকের যুগের বহু জ্ঞানীগুণী ব্যাক্তিরও এর সাথে পরিচয় নেই। দোষটা তাদের না, একটা জিনিষ শিখতে হলে তার সাথে পরিচয় থাকতে হবে তো। আর ব্যাক্তিগত সম্পত্তি এমনি জিনিষ, জানা থাকার পরও এর থেকে বেরিয়ে আসা কত কঠিন তা যারা চেষ্টা করেছে তারা মাত্রই জানেন।
কিছু উদাহরণ দিয়ে আলোচনা করা যাক। যদিও বৃত্তের বাইরে চিন্তা করার অভ্যাস যাদের নেই তাদের কাছে এসব উদ্ভট লাগবে কিন্তু চেষ্টা করতে দোষ কি? যেমন ধরা যাক আমাদের পরিবারের গঠন। আমাদের পরিবার কাঠামোগুলো এমন কিন্তু সবসময় ছিলনা। এখনো আদিম সমাজগুলো যে দেখা যায় সেগুলোতে আমাদের এইসব পরিচিত গন্ডীর বাইরে অনেক রকম পরিবার কাঠামো দেখা যায়। বেশী দুর যাবার দরকার নেই, আমাদের আদিবাসী সমাজের পরিবারগুলো কিন্তু আমাদের মত নয়(বিশেষত মাতৃপ্রধান গোষ্ঠীগুলোর কথা বলছি)। তাই বলে তারা যে আমাদের থেকে খারাপ আছে তাও কিন্তু নয়। আবার আমরা যদি আরো পেছনে যাই তাহলে আরো উদ্ভট পরিবারের ধরন খুজে পাব। যাই হোক, পয়েন্টে আসি। একথা সবাই জানে আমরাও অনেক আগে এদের মতই ছিলাম, এখন নেই; পার্থক্যটা কোথায়? সোজা করে বললে আমরা অনেক কিছু সম্পর্কে ওদের থেকে অনেক বেশী জানি, অনেক কিছু বানাতে পারি, যা ওদের থেকে আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করেছে। সমাজতন্ত্রীরা যাকে বলে বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান আর উৎপাদন। এই উৎপাদন আবার আমাদের সবকিছু এমনকি পরিবার কাঠামোকেও নিয়ন্ত্রণ করে। খুব কম কথায় ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যাবেনা বলে আমি উদাহরনে চলে যাচ্ছি। বেশীদিন আগে নয়, এই ষাটের দশকেও মুস্লিম পরিবারের মেয়েরা কাজ করতে বাইরে যাচ্ছে এটা কল্পনারও বাইরে ছিল, তা সে যতই গরিব হোকনা কেন। কিন্তু এখন কট্টর মুস্লমান পরিবারেও মেয়েদের কাজে যাওয়া নিয়ে তখনকার মত চিন্তাভাবনা করেনা। কারন এক কথায় বলতে গেলে শিল্পায়ন। উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন। আবার উন্নত বিশ্বে একপতিপত্নী পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে তার কারন হিসেবে মুল্যবোধের অবক্ষয়, নারী স্বাধীনতা ইত্যাদি অনেক কিছুকে দোষ দিলেও আসলে কারনটা এটাই যে সেসব সমাজের মানুষগুলোর একসাথে থাকার আর প্রয়োজন নেই। সমাজতন্ত্রীদের ভাষায় এদের উৎপাদন পদ্ধতি এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে তার সাথে এই পরিবারের গঠন আর খাপ খাওয়াতে পারছেনা। এখন সবাই “স্বাধীন” থাকতে চায় আর একসাথে থাকতে গেলে “স্বাধীনতা” একটু হলেও বিসর্জন দিতে হয়, ফলাফল ভাঙন। আগে সমাজে এমন অবস্থা ছিলনা যে কেউ একাই পরিবার ছাড়া টিকে থাকতে পারবে, তাই আগে বিচ্ছেদও ছিল কম। এখনো যে সমাজে মেয়েদের কাজের সুযোগ কম সেখানে বিচ্ছেদের হার কম। তাই বলে সেইসব মেয়েরা ভালো আছে তাও নয় কিন্তু সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। মূল বক্তব্য হল এখন যে রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে বড় হওয়া আমরা মনে করি “আমার” বাবা “আমার” মা “আমার” সন্তান এরাই শুধু মানুষ, বাকি সব হাভাতে, আর তাই “আমার” বাবা-মা-সন্তানের বিপদেই দৌড়ে যাই আর “অন্যের” বিপদে ভাবি তার বাবা-মা / সন্তান তাকে দেখবে, এটা শুধুই একটা মানসিক গঠন যেটা এইরকম সমাজে বড় হবার কারনে আমরা অর্জন করেছি। এই সমাজের গঠনটা আবার ঠিক হয়েছে তা কত বেশী জিনিষ তৈরী করতে পারছে তার উপর,অর্থাৎ তার উৎপাদনের উপর। এর বাইরে অন্যভাবেও সমাজ গঠন করা যায় যেখানে সবাইকে আত্মীয় ভাবা সম্ভব। সম্ভব বলছি কেন, এরকম সমাজ আছে অনেক, ছোট হয়ত, কিন্তু আছে( এ বিষয়ে আমার পছন্দের একটি বই উইল ডুরান্টের “সভ্যতার জন্ম”) এখন এই যে আমি আপন-পর আলাদা ভাবছি আর দুই দলের জন্য দুই রকম সিদ্ধান্ত নিচ্ছি সেটা এরকম একটা প্রি কনসেপ্ট থেকেই, যা দাঁড়িয়ে আছে ব্যাক্তিগত সম্পত্তিজাত ধারনার উপর। এখন আমি যদি মনে করি যে না, আমার বাবা-মা-সন্তানই হোক, আর “পরের” বাবা-মা-সন্তানই হোক, সবাই মানুষ, সবার অধিকার সমান এবং আমি তাদের অধিকার দিতে চাই; তাহলে আমার আচরন হবে একরকম আর আমি যদি মনে করি আমি উমুকের থেকে বেশী মেধাবী, আমি তুমুকের থেকে বেশি শক্তিশালী, আমার অধিকার অনেক বেশী, তাহলে আমার আচরন হবে আরেক রকম। প্রথম দল খুজবে কি করলে সবার সমানাধিকার নিশ্চিত করা যায় আর দ্বিতীয় দল খুজবে কিভাবে নিজের “অধিকারটুকু” হস্তগত করা যায়। আরেকজনকে কিছু দিতে হলে নিজের কিছু ছাড় দিতে হবে আর এখানেই যত সমস্যা।
বিবর্তন বা জীববিজ্ঞান বিষয়ে আমার একজন প্রিয় লেখক হলেন বন্যা আহমেদ। তার একটা লেখায় আছে কিভাবে স্বার্থপরতা থেকে পরার্থপরতার উদ্ভব হয়। যারা বর্তমান পৃথিবীর দুরবস্থার কথা জানেন এবং বুঝতে পারেন এর কারন আমাদের অদূরদর্শিতা ও স্বেচ্ছাচারীতা; তারা নিশ্চই এটাও উপলব্ধি করতে পারেন যে প্রজাতি হিসেবে আমাদের টিকে থাকা নির্ভর করবে এই বিষয়টির উপর। অর্থাৎ পৃথীবিকে বাসযোগ্য রেখে এর মাঝে টিকে থাকতে চাইলে আমাদের সমাজগুলোকে আমাদের নিয়মগুলোকে কার্ল সাগানের মত কারো দেখানো বিজ্ঞানভিত্তিক সভ্যতা গড়ার মধ্য দিয়েই রাখতে হবে, কোন আম্লীগ/ বিম্পি, বা কোন ডেমোক্রেট/ রিপাবলিকানের দেখানো পথে নয়। খুব সহজ করে একটা বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজের ডকু এখানে আছে। আগ্রহী কেউ দেখতে পারেন
httpv://www.youtube.com/watch?v=4Z9WVZddH9w
আসলে অর্থনীতি,সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এগুলো বিজ্ঞানের নবীনতম শাখা। এই কিছুদিন আগেও সমাজবিজ্ঞানীরা একে প্রকৃতিবিজ্ঞানের অংশ বলেই স্বীকার করতে চাইতনা, ডকিন্সের “সেলফিস জিন” বেরোনোর আগে মনোবিজ্ঞানকে জীব্বিজ্ঞানে ব্যাবহারের কোন ভালো টুল আমাদের ছিলোনা, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই বিষয়গুলো নিয়ে যতই গবেষণা হচ্ছে, যতই মানুষ জানতে পারছে, এদের মাঝে পার্থক্য ঘুচে গিয়ে বিষয়গুলো ততই প্রকৃতিবিজ্ঞানের কাছাকাছি চলে আসছে। আর তা হওয়ার ফলে সমাজে যে পরিবর্তনগুলো আসছে তা মানুষের সমানাধিকারের পক্ষেই যাচ্ছে। যেমন গুগল যখন মালিকানা শেয়ার কর্মচারীদের মাঝে ভাগ করে দিচ্ছে, বা ফেসবুক ডিজনিকে চাপ দিচ্ছে, বা ওপেন সোর্সভিত্তিক কাজ, বা মুক্ত সফটও্যার, সব ব্যাক্তি মালিকানাকে ভেঙ্গেই দিচ্ছে বরং। আর এটা তো ঠিক বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থা নিয়ে বেশীরভাগ মানুষই খুশী নেই, ভালো নেই। আর অসুখী মানুষ, অভাবী মানুষ নিজেদের প্রয়োজনেই অধিকার আদায়ের রাস্তা খুজবে। সেটা হুবহু মার্ক্স বা লেনিনের পথ ধরে হাটবেনা এটা সত্য কিন্তু তা মানুষের সমানাধিকারের দিকেই যাবে…
[৬] আমি আমার প্রথম লেখায় দেখাতে চেয়েছি, মার্ক্সীয় সমাজবিজ্ঞানের কয়েকটি মৌল তত্ত্ব রয়েছে। তার মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ চারটে প্রতিপাদ্য আমি উল্লেখ করে দেখিয়েছিলাম, সেগুলো বিরুদ্ধ তথ্যের সন্ধান পেলে ভুল-প্রমাণ সাপেক্ষ। মন্তব্যের জবাবে সেকথা আমি আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করলাম, আপনারা দুজনের কেউই সেই মূল প্রতিপাদ্য তত্ত্বগুলিকে ভুল প্রমাণ করে দেখানোর রাস্তায় গেলেন না। তার বদলে কিছু অন্য দূর-প্রাসঙ্গিক কথা টেনে আনলেন। ক্রমবর্ধমান গরিবি, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন আয়ের বর্গের মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধি, মধ্যবিত্তের আকার হ্রাস-প্রাপ্তি, ইত্যাদি বিষয়গুলি মার্ক্সবাদের পুঁজিবাদী শোষনের চরিত্র বিশ্লেষণ করে গৃহীত কিছু সিদ্ধান্ত। পুঁজির কেন্দ্রীভবন, একচেটিয়া পুঁজির জন্ম ও বিকাশ, লগ্নি পুঁজির জন্ম ও বিকাশ, পুঁজির সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র অর্জন – এগুলোও মার্ক্সবাদের আরও কয়েকটি মার্ক্স-উত্তর মৌলিক তত্ত্বগত সিদ্ধান্ত। সারা বিশ্বের অবস্থার সাপেক্ষে বাস্তব তথ্য সংগ্রহ করে (আজকের দিনে যেটা খুব কঠিন নয়) এর প্রত্যেকটাই ভুল প্রমাণ করা সম্ভব। শিল্প, কৃষি, পরিষেবা সেক্টর একটা একটা করে ধরে দেখুন – শ্রমিক মালিক সংঘাত আছে কিনা, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধিতে মালিকের আগ্রহ বাড়ছে কিনা, আয়ের বিচারে জনসংখ্যার নিম্নতর পঞ্চাশ শতাংশের মুদ্রার অঙ্কে আয় বাড়লেও বাজার সাপেক্ষে সেই আয়ের ক্রয়-সামর্থ্য বাড়ছে কিনা। এই সব বিষয়ের কোনোটাই সাদা-হাঁস কালো-হাঁস খুঁজবার মতো জটিল নয়। সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক সঙ্কট কালে বিগত তিন চার বছর ধরে সারা পৃথিবী জুড়ে বিদ্যায়তনিক অর্থনীতিবিদরাই পুঁজিবাদের সঙ্কটের মধ্যে আবার মার্ক্সবাদের ভবিষ্যদ্বাণীর ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। আমি দুচারটে দৃষ্টান্ত দিয়েছি। আপনারা নিশ্চয়ই আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন ই-মাধ্যমের এইসব খবরাখবর। তার সবই হয়ত নির্ভরযোগ্য নয়, আবার সবই তো আর বাজে খবরও নয়।
[৭] আর বাক্যব্যয় করছি না। আশা করি, ঘটনার ঘুর্ণিচক্রে কখনও কোথাও হয়ত আপনাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যাবে। সময় সুযোগ করে চা কফি খেতে খেতে মুখোমুখি ঝগড়া করতে হয়ত ভাল লাগবে। Historical determinism/historicism – যে কোনো ভাবেই যদি তা ঘটে সেদিন বাকি কথা বলব।
প্রীতি ও শুভেচ্ছা নেবেন। ধন্যবাদ সহ –
অশোক মুখোপাধ্যায়
@অভিজিত রায় ও বিপ্লব পালঃ
আপনাদের সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনারা আমার টেকনিক্যাল অক্ষমতাকে যেভাবে সহ্য করে চলেছেন তাতে আমি যথার্থই মুগ্ধ। হয়ত আরও একবার আপনাদের এই সহন শক্তি দেখাতে হবে এই মন্তব্যটিকে আপলোড করে দেবার জন্য। তবে আমিও মনে করি আপাতত আমাদের এই বিতর্ক সাময়িক অবসর নেওয়া ভাল। কেন না, একটা পর্যায়ের পর আমরা যে যার যুক্তির আবর্তের মধ্যেই চক্রাকারে ঘুরতে থাকব। সাধারণ পাঠকদের তাতে বিরক্তি বাড়বে বই কমবে না। রাজনৈতিক বিশ্ব এখন একমেরু হয়ে গেলেও মতবাদিক বিশ্ব না হয় আরও কিছুদিন দুইমেরু হয়ে থাকুক।
বিপ্লববাবুর কাছে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ, তিনি আমার জ্ঞানের স্বল্পতা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বলে। সত্যিই আমরা বয়স্ক ব্যক্তিরা অনেক সময় নিজেদের স্বল্প-বিদ্যাবুদ্ধির কথা ভুলে গিয়ে কিছু দুরূহ বিষয়ে বেফাঁস মন্তব্য করে ফেলি, প্রতিপক্ষের মাপ না নিয়েই আস্তিন গুটিয়ে কপাডি কপাডি বলতে বলতে বিপক্ষের কক্ষে ঢুকে পড়ি। মার্ক্সবাদের সপক্ষে যুক্তি করতে গিয়েও আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে আমার এ ব্যাপারে মন্তব্য করার মতো যথেষ্ট জ্ঞান এবং উপলব্ধি নেই। আপনার চোখে ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি যে এটা আমাকেও ধরিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি এর জন্য আপনার সবিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য।
[১] অভিজিতবাবু যখন ম্যানিফেস্টোকে ছেড়ে দিয়ে জার্মান ইডিওলজি বইটিকে তুলে ধরেন, তিনি সম্ভবত খেয়াল করেননি, ওটা ম্যানিফেস্টোরও আগে, ১৮৪৫ সালে, লেখা এবং মার্ক্স-এঙ্গেল্সের জীবদ্দশায় একটা অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি। ফলে ওখানেও যে অনেক ভুল বক্তব্য আছে এটা নিশ্চয়ই খুব অস্বাভাবিক নয়।
[২] পেশাগত বিচলন (vocation mobility) সম্পর্কে মার্ক্সের সেই সময়ের কথা যতই অপরিণত ও হাস্যকর শোনাক (জিনিসটা আসলে অতটা সরল নয়), বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমাগত বিকাশের ফলে আজ উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতেও অনেকেই এক পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় সহজেই যুক্ত হয়ে যেতে পারছেন। এমনকি ভারতের মতো পিছিয়ে পড়া দেশেও আমি দু-চারজনকে জানি যাঁরা ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপনায় সরে গেছেন। কোশাম্বি পদার্থবিজ্ঞান থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও মুদ্রাবিদ্যায় হাত পাকিয়েছেন। বছর দু-এক আগে স্বপ্ন নিয়ে একটা লোকপ্রিয় বিজ্ঞানের লেখা তৈরির সময় আবিষ্কার করলাম মার্কিন মুলুকের এক স্নায়ুশারীরতাত্ত্বিককে, যিনি কিছু দিন আগেও ছিলেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। পপার নিজেই পদার্থবিজ্ঞানে পাঠ নিয়ে মনোবিজ্ঞানে পিএইচ-ডি করেছেন, তারপর সারাজীবন দর্শনে কাজ করেছেন। এই ধরনের ঘটনাগুলির সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করলে কিছু সাধারণীকরণ যে করা যায়, মার্ক্সের বক্তব্যে তারই একটা অতি-প্রাথমিক ইঙ্গিত রয়েছে।
[৩] পপারের মার্ক্সবাদ বিরোধিতার মতোই মার্ক্সবাদীরাও সাধারণভাবে পপারের ঘোরতর বিরোধী (আপাতত কোন বিরোধিতার মধ্যে যুক্তিবাদ আর কোনটায় ধর্মীয় গোঁড়ামি রয়েছে সে বিষয়ে আমি কিছু বলছি না)। তবে, অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে একটা তথ্য দিয়ে রাখি, মার্ক্সবাদী হিসাবে মোল্লাতন্ত্রী হলেও বিজ্ঞান-দর্শনের আলোচনায় আমার বহু লেখাতেই পপারের প্রসঙ্গ সপ্রশংস উল্লেখে বারবার উঠে আসে। আমার বইপত্র বা প্রবন্ধগুলো তেমন বাজার সফল নয় বলে হয়ত আপনাদের চোখে তার কোনোটাই আজও পড়েনি। আমি ব্যক্তিগত জ্ঞানচর্চায় হংসপন্থী। যেখান থেকে যা পাই কুড়িয়ে নিয়ে স্বীকৃতিসহ মার্ক্সবাদের দার্শনিক পরিকাঠামোয় জুড়ে দেবার (হয়ত অক্ষম) চেষ্টা করি। আবার কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কোপেনহেগেন ভাষ্যের বিরুদ্ধে বস্তুবাদী ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে যেহেতু পপার আমাকে খুবই সাহায্য করেন, তাঁর বিজ্ঞান-দর্শন বিষয়ক প্রায় যাবতীয় রচনাই আমি পড়ে ফেলেছি। বছর পাঁচ-ছয় আগে ডঃ অজিত কুমার রায়ের পরামর্শে আমি আপনাদের আকাশপত্রে পল ডেভিসের একটা প্রবন্ধের সমালোচনা করে বিজ্ঞান ও ধর্ম বিষয়ক একখানা ইংরেজি লেখা ই-মেল করে পাঠিয়েছিলাম (সেটা যে কোনো কারণেই হোক প্রকাশিত হয়নি—ত্রুটি আমার দিক থেকেও হয়ে থাকতে পারে)। তারও শুরুটাই ছিল কার্ল পপারের প্রধান অবদানটির উল্লেখ সহকারে। তবে, পড়া মানেই তো আর বোঝা নয়। বোঝার ক্ষমতাও সবার সমান নয়। অল্প বুঝেছি, অনেকটাই হয়ত বুঝিনি।
[৪] তাতে আমার মনে হয়েছে, সমাজ বিজ্ঞান যতই ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদভিত্তিক অবস্থা থেকে সরে এসে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করবে, নৈর্ব্যক্তিক বাস্তববাদী জ্ঞান্তন্ত্র হয়ে উঠবে, ততই তার মধ্যে মিতবিজ্ঞানের মতোই পূর্বানুমান করার ক্ষমতা বাড়বে। Historical determinism-এর দাবি এইটুকুই। এর বেশিও নয়, কমও নয়। শুধু লক্ষ্য হলে সে এক রকম ব্যক্তিগত সদিচ্ছা, তার মধ্যে বিজ্ঞানের পদ্ধতিটা নেই। এই পদ্ধতি বর্জিত পূর্বাভাস দেবার প্রবণতা – তাকে যদি পপার historicism বলতেন, আমার আপত্তি হত ছিল না। কিন্তু তিনি শুধু সমাজ বিজ্ঞানে নয়, মিতবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও পূর্বানুমানের বিরোধী। কেন না, তিনি causality মানতে পারেন না, তার বদলে কেবলমাত্র universal law-কে স্বীকার করেন। তার ভিত্তিতে causal explanation পর্যন্ত মানতে পারেন। এই দার্শনিক অবস্থা থেকেই তিনি মানব সমাজের ক্ষেত্রেও পূর্বানুমানের নীতিগত বিরোধী হয়ে পড়েন। [Karl Popper, The Open Society and its Enemies; Princeton, 1950; p. 448] অথচ, কী পরিহাস দেখুন, সেই পপারই আবার তাঁর বইয়ের শেষদিকে গিয়ে বলছেন, নিয়মের ভিত্তিতে একটা ঘটনা থেকে আর একটি ঘটনার সংঘটনের কথা ধরে নেওয়া যেতেই পারে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এটাই determinism; আর সমাজ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এটাই historical determinism.
[৫] পপার যদি মার্ক্সবাদের সমালোচনার সময় historicism এবং historical determinism-এর মধ্য গুলিয়ে না ফেলতেন, তাহলে তিনি দেখতে পেতেন, মার্ক্সবাদের লক্ষ্য বা প্রধান লক্ষ্য মানব সমাজ সম্পর্কে ভবিষয়দ্বাণী করা নয়। মানব সমাজের বিকাশ ও বিবর্তন সম্পর্কে কোনো যুক্তি-তথ্যসিদ্ধ নিয়ম আছে কিনা তা খুঁজে দেখা। সেই নিয়ম অনুযায়ী কিসের পরে কী ঘটতে পারে তার অনুমান করা। এই পূর্বানুমান হচ্ছে আগের নিয়ম সংক্রান্ত জ্ঞানের একটা derivative. এই নিয়মটি মার্ক্স যা বলেছিলেন তার ঠিক ভুল নিয়ে আলোচনা করার পরিবর্তে পপার ধরেই নিলেন, মার্ক্সবাদ বিপ্লব করতে চায়, পুঁজিবাদ উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র আনতে চায়, তাই সে বর্তমান অবস্থা দেখে নিয়ে মানব সমাজের ভবিষ্যতের ব্যাপারে পূর্বাভাস দিতে চায়। এটাই তার লক্ষ্য। অতএব মার্ক্সবাদ historicism-এর খপ্পরে পড়েছে।
বিজ্ঞান,সমাজতন্ত্র এবং পুঁজিবাদ সামাজিক বিবর্তনের ফল।সময়ের প্রয়োজনে এবং জীবন এবং জীবনবোধকে উন্নত করার তাগিদ থেকেই মানুষ প্রগতির পথে অগ্রসর হয়েছে।শোষনমুক্ত সমাজ নির্মান করার তাগিদ থেকেই মার্ক্স দ্বান্দিক বস্তুবাদের প্রায়োগিক সফলতা দেখতে চেয়েছিলেন।কিন্তু বিভিন্ন সামাজিক ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দের ফলে সমাজতান্ত্রিক মতবাদ পুঁজিবাদি আগ্রাসনের সামনে টিকে থাকতে পারেনি।আমরা জানি কোন বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক মতবাদই পরম সত্য নয়।আমরা কোন পথে অগ্রসর হব এবং কোন মতবাদকে নিজের জীবনে প্রয়োগ করব তা আমাদের ব্যক্তিসত্তা এবং পারিপার্শিক প্রথার দ্বান্দিক বিশ্লেষন থেকে ঠিক করতে হবে।আমাদের খুঁজে বের করতে হবে আমরা কি চাই এবং আমাদের কি করতে হবে।মানুষ শোষন যেমন করতে পারে তেমনি শোষনমুক্তির পথও দেখাতে পারে।আমরা কি প্রশংসার দাস হব না নতুন পথের সন্ধান করব সেই সিদ্ধান্ত আমাদেরকেই নিতে হবে।
এটা দেখে ভালো লাগল যে আমার প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার দু-একদিনের মধ্যেই অনেক মন্তব্য এসে গেছে মুক্তমনার খোলা পাতায়। অভিজিতবাবু এবং বিপ্লব পাল বেশ বড় মন্তব্য করেছেন এবং অনেকেই ছোট ছোট প্যারাগ্রাফ লিখে পাঠিয়েছেন। প্রত্যেকের মন্তব্য ধরে ধরে আলাদা আলাদা ভাবে হয়ত আমার পক্ষ থেকে কিছু লেখা সমীচিন হত। কিন্তু অন্য কিছু কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ার দরুন সেই চেষ্টা না করে আমি সাধারণভাবে দু চার কথায় আমার অবস্থান আর একবার কিছুটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করব।
প্রথমত, আমিও মনে করি, একটি জীবন্ত মতাদর্শ হিসাবে মার্ক্সবাদের পক্ষে বিপক্ষে লেখা চলতেই থাকবে আরও অনেক দিন ধরে। আর বিতর্ক উস্কে দিলে তো কথাই নেই। এটা শুধু বাঙালি বা মার্ক্সবাদী বা বাঙালি মার্ক্সবাদীদের একক সমস্যা বোধ হয় নয়। যেখানে যে কোনো ভাষায় এক পক্ষ লিখলেই আর এক পক্ষ তার উত্তর দেয়—এটাই আমি অন্তত হয়ে আসতে দেখছি বহুকাল ধরে। সব কাগজে বা আকাশপত্রে তো আর এত বড় করে তর্ক চালাতে দেয় না। তাই হয়ত এক পক্ষের বক্তব্য যতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে, অন্য পক্ষ ততটা করতে পারে না। মুক্তমনাকে ধন্যবাদ যে তাঁরা তাঁদের পাতা এরকম একটা বিতর্কিত বিষয়ে দুই পক্ষের সবার জন্য বেশ চওড়া করে খুলে রেখেছেন।
দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞান বললে তার একটা যেমন সাধারণ বৈশিষ্ট্য বোঝায়, যা তার থাকতে হবে, তেমনই বিভিন্ন বিজ্ঞানের মধ্যে যে পার্থক্য থাকে তাও মনে রাখতে হয়। পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়ন বা জীব বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পরীক্ষার যে সুযোগ এবং গুরুত্ব, জ্যোতির্বিজ্ঞান বা ভূতত্ত্বের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ এবং গুরুত্ব নেই। সমাজবিদ্যা বা মানবিকী বিদ্যায় যাদের বিজ্ঞান হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, তাদেরও প্রত্যেকের পরস্পরের মধ্যে এবং মিত বিজ্ঞানের শাখাগুলির সাথে পার্থক্য আছে। গণিতের প্রয়োগকে কেন্দ্র করেও এই পার্থক্য একইভাবে বিদ্যমান। এই বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে মার্ক্সবাদকে বিজ্ঞান বলা বা না বলারও একটা সাধারণ মাপকাঠি থাকতে হবে। সেটা কী?
আইনস্টাইন তাঁর নিজের তত্ত্ব সম্পর্কে বলেছেন, হাজার পর্যবেক্ষণেও আমার তত্ত্ব সঠিক বলে প্রমাণিত হবে না, কিন্তু একটা পর্যবেক্ষণেই তা ভুল সাব্যস্ত হয়ে যেতে পারে। পপারের মাপকাঠিরও এটাই সারাৎসার। ভুল-ঠিকের প্রশ্ন সজীব থাকাটাই বিজ্ঞানের প্রথম এবং প্রধান লক্ষণ। পপারের প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে আমরা অনেকেই এখানেই থেমে যাই। তাঁর বাকি কথাগুলো মনে রাখি না। ভুলের স্বীকৃতি থেকে আসে বিজ্ঞানের দ্বিতীয় সাধারণ লক্ষণ—ভুল সংশোধন। যিনি ভুল করেছেন তিনিও পরে ভুলটা ধরে সংশোধন করতে পারেন, তিনি না পারলে অন্যরাও করে দিতে পারে। আর এই পথ বেয়ে বিজ্ঞানের তৃতীয় সাধারণ লক্ষণ হল তার জ্ঞানের বিকাশ। ভুলের সংশোধন করার মধ্য দিয়ে যেমন বিকাশ হয়, নতুন সমস্যার সমাধান করতে গিয়েও বিকাশ হয়। ধর্মীয় চিন্তার কোনো ভুল বা ঠিক হওয়ার প্রশ্ন নেই। সংশোধন বা বিকাশেরও প্রশ্ন নেই। এইজন্য তার পক্ষে বিজ্ঞানের অবস্থানে যাওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং মার্ক্সবাদের ক্ষেত্রেও এই তিনটি লক্ষণ বহাল আছে কিনা—এই প্রশ্নটা বিচার করে দেখতে হবে।
আমি আমার সমালোচনায় বলেছি, মার্ক্স এবং এঙ্গেল্স নিজেরাই বলেছেন, তাঁদের ম্যানিফেস্টোতে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ এবং সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। লেনিনের রচনাবলির তো প্রতিটি খণ্ডেই কিছু না কিছু ভুলের স্বীকৃতি পাওয়া যাবে। মার্ক্সবাদের চৌহদ্দির মধ্যে ভুল এবং ভুলের সংশোধন দুটোই যথেষ্ট পরিদৃশ্যমান। অন্যদিকে, নতুন সমস্যা বা বৈশিষ্ট্যকে বুঝতে গিয়ে অনেকেই যে এর বিকাশ ঘটিয়েছেন তারও আমি কিছু উদাহরণ দিয়েছি। আমার ধারণা, এই দিক থেকে মার্ক্সবাদ একটা বৈজ্ঞানিক মতবাদ হওয়ার সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণই এযাবত প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে।
আমি এও দেখিয়েছি, সমাজ ইতিহাস অর্থনীতির বিবর্তনের ক্ষেত্রে মার্ক্সবাদ যে মূল তত্ত্বগত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে (আমার মূল প্রবন্ধে এরকম চারটি সিদ্ধান্তের কথা বলা আছে), তার প্রতিটিই ভুল প্রমাণ-সাপেক্ষ। দুএকটি ক্ষেত্রে কী কী তথ্য পেলে সেগুলো ভুল প্রমাণ হবে তাও আমি দেখিয়েছি। পপার তাঁর রচনাবলিতে এইভাবে তাঁর নিজের অবদত্ত পদ্ধতি প্রয়োগ করে মার্ক্সবাদকে ভুল প্রমাণ করার কোনো চেষ্টাই করেননি। তিনি ম্যানিফেস্টো এবং ডায়লেকটিক্স নিয়ে পড়েছিলেন। Historical determinism-এর বিরুদ্ধে তাঁর আপত্তি যে একটা সীমা পর্যন্ত মান্য এবং তা নিয়ে বাড়াবাড়ি যে জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সৃষ্টি করে একথা তিনি না বুঝলেও পরবর্তীকালে অনেকেই তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই আপত্তির জেরেই তিনি কারণকার্য সম্পর্ক পর্যন্ত বিজ্ঞানে মানতে অস্বীকার করেছিলেন তাও আজ খুব অজানা নয়। অথচ সেই তিনিই আবার হাইজেনবার্গের নীতির দার্শনিক ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে অনিশ্চয়তাবাদের বিরোধিতা করে গেছেন। আমি এখানে দার্শনিক প্রশ্নে ঢুকব না। আপাতত শুধু এইটুকু বলে নিতে চাই, কারণকার্য সম্পর্ক মানলে আমাদের নির্ধারণবাদও একটা মাত্রায় মেনে নিতে হয় এবং আমরা প্রকৃতি সমাজ ও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অহরহ এর প্রয়োগ করে থাকি। অর্থনীতি বলুন, সমাজতত্ত্ব বলুন, রাজনীতি বলুন—সব জায়গাতেই ‘এটা হলে এর ফলে কী হতে পারে’ তা আমরা বলবার এবং বুঝবার চেষ্টা করে থাকি। মার্ক্স যখন পুঁজিবাদ ধ্বংস হয়ে সমাজতন্ত্র আসবে বলে অনুমান করেছিলেন, তার মধ্যেও কেউ ভুল ধরতে পারেন। কিন্তু সেটা historical determinism-এর কারণে নয়। যে যে কারণ থেকে যে যে ফল হতে পারে বলে তিনি ভেবেছিলেন তার মধ্যেই ভুল খুঁজতে হবে। পরমাণু শক্তির ব্যবহারের ফলে তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ থেকে মানুষের কী কী দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে, অথবা জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিণামে একটা দেশ কী ধরনের সামাজিক অর্থনৈতিক সমস্যার সামনে পড়তে পারে বলে আমরা যখন বলি, তার মধ্যেও পূর্বাভাস থাকে, determinism থাকে। সুন্দরবন ধ্বংস করে তাপবিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করলে পরিবেশ ভারসাম্য কীভাবে বিনষ্ট হতে পারে বলে যাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন তাঁরাও আসলে সেই determinism-এর প্রয়োগ করছেন। কেউ তাতে আপত্তি করতে পারেন। বলতে পারেন, তোমরা যে ভয় পাচ্ছ তা নিতান্তই অমূলক। এসব কিছুই ঘটবে না। কেন ঘটবে না তাও তিনি ব্যাখ্যা করতে পারেন। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এরকম যুক্তি কেউ দেবেন না—আজ তাপবিদ্যুত কেন্দ্র হলে বিশ বছর বাদে কী হবে তা আগে থেকে বলা যায় না। পপার বলেছেন …।
পপারের আর একটা সমস্যা হয়েছিল, তিনি historical determinism–কে historicism ধরে নিয়ে তার সাথে historicity-কে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। ভূতত্ত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা, নৃতত্ত্ব, ইত্যাদি সহ বিবর্তমান সমস্ত বিজ্ঞানের মধ্যেই আনুপূর্বিকতা একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য। সেই কারণে এই সব তত্ত্বকেও তাদের আনুপূর্বিক বিকাশের ইতিহাস বাদ দিয়ে বোঝা যায় না। পপার-পরবর্তীকালে লাকাতো অন্তত এই কথাটা নানাভাবে বোঝাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এই কথার সূত্র ধরেই বুরাওয়ে তাঁর প্রবন্ধে মার্ক্সবাদের বিভিন্ন ধারার মধ্যে তুলনা করে দেখাতে চেয়েছিলেন, যাঁরা মার্ক্সবাদকে তার ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে বুঝতে চায় তাঁরা মার্ক্সবাদের বৈজ্ঞানিকতাকেও অস্বীকার করে বসে। ফলে অভিজিতবাবু যেমন বলেছেন, বুরাওয়ে সেইভাবে পপার, লাকাতো, কুহ্ন, পলিয়ানি প্রমুখর যুক্তি মেনে নিয়ে তাঁর উপসংহারে উদ্ধৃত বাক্যটি বলেননি। বরং ওঁদের বক্তব্যকে উপস্থাপন করে তারপর একে একে তাঁদের মার্ক্সবাদ বিরোধী বক্তব্যকে খণ্ডন করেছেন। অবশেষে, উপসংহারে পৌঁছে তিনি মার্ক্সবাদীদের বিভিন্ন ধারার মধ্যে ইউরোপের যে গোষ্ঠী (তাঁর ভাষায় analytical Marxism) মার্ক্সবাদকে তার সামাজিক ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চায় তাঁদের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। অন্যদিকে আর একদল (তাঁর ভাষায় post-Marxism), যাঁরা মার্ক্সবাদী আন্দোলনকে তার আভ্যন্তরীন ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে শ্রেণিহীন বা শ্রেণিঊর্ধ্ব আন্দোলনের মধ্যে সীমিত থাকতে চান, তাঁরাও শেষ পর্যন্ত একে এক অক্ষম তত্ত্বে পরিণত করেন। বুরাওয়ের নিজের কথায়, “But in attempting to consummate the truth of all previous Marxisms, analytical Marxism takes Marxism out of history, eclipsing the historical challenges that have been the “motor” of its theoretical growth. Insulating itself from its own historicity while making fetishes of clarity and rigor, analytical Marxism atrophies as science.” দ্বিতীয় দলের বিরুদ্ধে তাঁর বক্তব্য, “Without heuristics post-Marxism is rudderless. It has no internal history and therefore fails to grow as a science.”
স্পষ্টতই, এখানে বুরাওয়ে দেখাচ্ছেন, এরকম হলে সত্যিই মার্ক্সবাদ বিজ্ঞানের মর্যাদা পেতে পারত না। তাহলে তাঁর নিজের অবস্থান কী? সেটা তিনি তাঁর প্রবন্ধের শুরুতেই যে সারাংশ দিয়েছেন তাতে পরিষ্কার: “This paper examines Marxism’s claim to be a science. The first part considers possible models of science and argues that the most coherent is Imre Lakatos’s methodology of scientific research programs. In his conception scientific knowledge grows on the basis of a hard core of postulates which are protected from refutation by the development of a series of auxiliary theories. Such a research program is progressive rather than degenerating if successive theories are consistent with the core, explain anomalies and make predictions, some of which are realized. In the second part I argue that with some qualifications the history of Marxism–from Marx and Engels, to German Marxism, to Russian Marxism, and finally to Western Marxism–conforms to the model of a progressive research program.” ইমরে লাকাতো সমাজবিজ্ঞানের জন্য যে মডেল প্রস্তাবনা করেছেন, লাকাতোর আপত্তি সত্ত্বেও বুরাওয়ের মতে সেই মডেলে (কিছু সতর্কতা সহ) মার্ক্সবাদকে বিজ্ঞান হিসাবে গ্রহণ করা যায়। আমি আশা করব, অভিজিতবাবু সময় পেলে বুরাওয়ের প্রবন্ধটি আদ্যন্ত আর একবার পড়ে মিলিয়ে নেবেন আমার কথাটা।
আইটি উপভাগ সম্পর্কে অভিজিতবাবুর মন্তব্য পড়ার পর আমি আমার পুরনো যোগাযোগদের সাথে আর একবার কথা বলেছি। আমি মেনে নিচ্ছি, আমি অত্যন্ত একতরফাভাবে তাদের কাজের ব্যাপারটা লিখেছিলাম। অভিজিতবাবু ঠিকই বলেছেন, সকলে রাত জেগে কাজ করে এটা সত্য নয়। বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের পরিষেবা দিয়ে থাকে, তাদের পরস্পরের কাজের ধরন বা কর্মীদের কাজ যেমন এক নয়, একটা বিশেষ কোম্পানিরও সমস্ত কর্মীর কাজ ঠিক এক প্রকার নয়। আমার এত বিস্তারিতভাবে জানা ছিল না এবং না জেনে মন্তব্য করাটা ভুল এবং অন্যায়ই হয়েছে। তথ্যটা ধরিয়ে দেবার জন্য আমি আন্তরিকভাবেই অভিজিতবাবুকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
তবে সাধারণভাবে আমার যে বক্তব্য, আই টি উপভাগের কর্মীদের কাজের মধ্যেও পুঁজিবাদী উৎপাদনের এবং শোষণের সমস্ত বৈশিষ্ট্যই বজায় রয়েছে, সেটা পরিবর্তন করার পক্ষে কোনো তথ্য এখনও পাইনি।
আমার মূল লেখাটাও বড়। জবাবি লেখাও বড় হয়ে যাচ্ছে। তাই আর এগোচ্ছি না। রাশিয়া চিন এবং কাম্পুচিয়া নিয়ে শুধু একটা কথা বলে রাখি। আমার বক্তব্য এ নয় যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে কোনো অন্যায় অত্যাচার বা জবরদস্তি হয়নি। এখানে শুধু নয়, আমার অন্য অনেকগুলো লেখাতেও আমি এরকম বেশ কিছু ঘটনার কথা আলোচনা করেছি। আবার আমি এও দেখাতে চেয়েছি, শুধু একদিক থেকে দেখলেই হবে না। একতরফা প্রচার দুদিক থেকেই হয়েছে এবং হচ্ছে। সেই দিকটা খেয়াল না রাখলে আমরা যে কেউ সহজেই সাম্রাজ্যবাদীদের প্রচারের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারি। মুক্তমনার সকলের কথা আমি বলতে পারি না। কিন্তু অভিজিতবাবু যেহেতু এখনও মার্ক্সবাদের সামাজিক মানবিক ভূমিকা আছে বলে মনে করেন, তাঁকে অন্তত এই ব্যাপারে সাবধান হতে অনুরোধ করব। আশা করি এতে কোনো অসদুদ্দেশ্য আছে বলে ধরে নেবেন না।
আমার প্রবন্ধ ধৈর্য সহ পড়া এবং মন্তব্য করার জন্য সকলকে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।
@অশোক মুখোপাধ্যায়,
অনেক ধন্যবাদ অবশেষে আপনার লেখাটি এবং প্রাসঙ্গিক সমালোচনাগুলো নিয়ে কথা বলার জন্য।
আমার মনে হয় এ নিয়ে লেবু ইতোমধ্যেই কচলে তিতা করে ফেলা হয়েছে। এটাই হয়তো এ বিষয়ে আমার শেষ উত্তর হবে। পাঠকেরা দু’দলের বক্তব্যই পড়ার সুযোগ পেয়েছে। আমার মনে হয় এখন তাদের উপরেই ছেড়ে দেয়া উচিৎ আমাদের বিতর্ক থেকে আসা ফলাফলের কোনটি সঠিক এবং কোনটি ভুল বিষয়ে শেষ সিদ্ধান্ত নেবার।
আমি আগেই বলেছি এ ব্যাপারে আমার অবস্থান প্রায় আপনার বিপরীত জায়গায়। আপনি মার্কসবাদকে মহাবিজ্ঞানময় কিছু মনে করেন, দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি সেটা মনে করি না। এখন, আমি জানি প্রতিটি ডগমারই অনুগত বাহিনী আছে, যারা পৃথিবীর বাস্তবতা বিপরীত হলেও সেটাকে আরাধ্য মনে করে যাবেন। মার্ক্সের ব্যাপারেও আমি একই চিন্তাধারার প্রতিফলন দেখতে পাই। পৃথিবীর বাস্তবতা ভিন্ন হলেও (সমাজের গতিপথ নিয়ে মার্ক্সের বহু ভবিষ্যদ্বাণীর ব্যর্থতা, সমাজতান্ত্রিক সিস্টেমে সবসময়ই স্ট্যালিন, মাও, চওসেস্কু, পলপটের মত ‘কাল্ট ফিগার’ এবং স্বৈরাচারী শাসকের জন্ম হওয়া, সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্রের নামে গণতন্ত্র উচ্ছেদ করে ‘পার্টি স্টেট’ কায়েম করা, এবং সর্বোপরি সারা বিশ্বে এক সময় এই তত্ত্বের প্রয়োগের হাতে কলমে পাওয়া ফলাফল – সকল রাষ্ট্র থেকে সমাজতন্ত্রের অবসান এবং পুঁজিবাদে প্রত্যাবর্তন সহ বহু ফলাফলের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে) সেটাকে হয়তো ‘বিজ্ঞান’ ভেবে যাবেন। খুব বেশি করণীয় কিছু দেখছি না আপাততঃ।
তবে, মাঝামাঝি একটা জায়গায় হয়তো যাওয়া যেত। সে চেষ্টা আমি করেছিলাম। মার্ক্সবাদকে বিজ্ঞান না বানিয়েও মানবতাবাদী কিংবা মরাল সিস্টেমে প্রয়োগ করা যায়, অনেকটা দেরিদা যেমন প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু মনে হয় না সেটা গ্রহনযোগ্য মনে হয়েছে আপনার কাছে। যতক্ষণ না মার্সবাদকে ‘পরিপূর্ণ বিজ্ঞান’ বলে স্বীকার না করা হচ্ছে, ততক্ষণ মনে হয় না এই সমস্যা থেকে উত্তরণের কোন পথ খোলা আছে।
কিছু ব্যাপারে মন্তব্য করে ছেড়ে দেব –
আমার তা মনে হয়নি। আমি জানিনা আপনি পপারের পুরো ইতিহাস এবং কাজের পুরোটুকু জানেন কিনা। একটু বলি। পপার নিজেও অস্ট্রিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির সাথে একসময় জড়িত ছিলেন, সেখানে তার আটজন বন্ধুকে পুলিশের গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে মৃত্যুবরণ করতে দেখেন। পপার যখন পার্টি নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ করলেন, পার্টি থেকে তখন বলা হল, ‘বিপ্লবকে সফল করতে হলে এ ধরণের মৃত্যু অপরিহার্য’। পপার এর পর থেকে বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন, এবং সেটাই মার্ক্সীয় দর্শনের সবচেয়ে শক্তিশালী সমালোচনাই হাজির করেনি, বিজ্ঞানের দর্শনকেও নতুন ভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।
আমি পপারের পাঁচটি বড় বড় অবদানের কথা আমি উল্লেখ করব যেটা পপারের আগে কোন দার্শনিক সেভাবে সমাধান করতে পারেননি-
১) বিজ্ঞান কিভাবে তত্ত্বের পক্ষ সমর্থন নয়, বরং ক্রমাগতভাবে তত্ত্ব বাতিলের মাধ্যমে (ফলসিফিকেশন) অগ্রসর হয় সেটার যৌক্তিক ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন। তিনি আরো প্রস্তাব দিয়েছিলেন কোন কোন ক্রাইটেরিয়াগুলো বিজ্ঞানকে অপবিজ্ঞান থেকে পৃথক করতে পারে (ফলসিফায়াবিলিটি)।
২) ডেভিড হিউম থেকে শুরু করে পরবর্তী দার্শনিকদের জন্য ‘প্রবলেম অব ইন্ডাকশন’ যে ধাঁধা তৈরি করেছিল, সেটার একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান করেন পপার।
৩) ‘লজিকাল পজিটিভিজম’ এর বিপরীতে জোড়ালো যুক্তি পপার হাজির করেছেন, যা এর আগে পশ্চিমে ছিলই না
৪) তিনি তার ‘দ্য ওপেন সসাইটি এন্ড এনিমিস’ বইয়ে হেগেল এবং মার্ক্সের কাজের পদ্ধতিগত সমালোচনা হাজির করেন। তার এই সমালোচনার ধার এতটাই এতটাই প্রবল ছিল যে রুশ দার্শনিক ঈশা বার্লিন মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন – ‘আমি জানি না কি করে একজন যুক্তিবাদী মানুষ মার্ক্সের ব্যাপারে পপারের এহেন সমালোচনা পাঠ করেও নিজেকে মার্ক্সিস্ট বলে দাবী করতে পারেন’।
পরবর্তী কালে লাকাতোস সহ অনেকে পপারের কাজের কিছু জায়গায় সংশোধনী হাজির করলেও পপারের সমালোচনার কাঠামোটি অটুট আছে বলেই আমি মনে করি।
৫) এবং সর্বোপরি পপারের পরবর্তীকালের সংযোজনা – ‘অবজেক্টিভ নলেজ’ এর তত্ত্ব।
আমার কখনোই মনে হয়নি পপার হিস্টোরিসিজম এবং হিস্ট্রিসিটিতে গুলিয়েছেন, বরং আমার মতে মার্ক্সিস্টরাই তার যুক্তির কাঠামোটি ধরতে পারেননি, এবং ভেবে নিয়েছেন যে পপার গুলিয়েছেন। বস্তুত হিস্ট্রিসিজম শব্দটিই পপারের সংযোজন (অনেক মার্ক্সিস্ট সেটাকে হিস্ট্রিজম ভেবে সমালোচনা করেছেন); পপার এর উপর একটি পরিপূর্ণ বইই লিখেছেন – ‘পভার্টি অব হিস্ট্রিসিজম’ নামে। পড়ে দেখতে পারেন।
এবারে মার্ক্সের প্রসঙ্গে আসা যাক। আপনি বলতে চাইছেন, কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে অনেক ভুল ভাল আছে, কাজেই সেখানকার সবকিছুকে আক্ষরিকভাবে না নিতে। বলেছেন –
আমার বক্তব্য হচ্ছে, মার্ক্সের কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর বাইরেও তার ক্যাপিটাল, জার্মান আইডিওলজি প্রভৃতিতে এমন কিছু কথা বলেছেন যে তার সমাজ এবং অর্থনীতি সম্বন্ধে তার অদূরদর্শিতা এবং সারল্যই তুলে ধরে। মার্ক্সের সমাজ নিয়ে বাস্তবতা যে কত সরল ছিল, তার জার্মান আইডিওলজিতে বর্ণিত এই একটি প্যারাগ্রাফই বড় প্রমাণ –
.. in communist society, where nobody has one exclusive sphere of activity but each can become accomplished in any branch he wishes, society regulates the general production and thus makes it possible for me to do one thing today and another tomorrow, to hunt in the morning, fish in the afternoon, rear cattle in the evening, criticize after dinner, just as I have a mind, without ever becoming hunter, fisherman, shepherd or critic (The German Ideology, London: Lawrence & Wishart, 1965, pp. 44-45.).
অর্থাৎ মার্ক্স ভেবেছিলেন আদর্শ কমিউনিস্ট সমাজে কোন ‘ডিভিশন অব লেবার’ বলে কিছু থাকবে না, থাকবে না কোন বিশেষ কাজে পেশাদারিত্ব বা স্পেশালাইজেশন। ওখানে মানুষেরা সকালে শিকার করবে, বিকেলে মাছ ধরবে, সন্ধ্যায় গরু চড়াবে, সান্ধ্যকালীন আহারের সময় সমাজ-সাহিত্যের সমালোচনা করবে। এভাবেই জীবন কাটবে।
এভাবে কোন কালে কোন সমাজ চলেছে? পেশাদারিত্ব সমাজ বিবর্তনের অত্যাবশ্যকীয় নিয়ামক। যে যেই কাজে ভাল, কিংবা উৎসাহী বলে প্রমাণিত, সে সেই কাজেই নিজের সময় ব্যয় করে দক্ষতা অর্জন করে। কাজেই কোন সমাজেই রাখাল গরু চড়ান ফেলে মাছ ধরতে যায় না, কোন কোম্পানিতেই মার্কেটিং ম্যানেজারকে দিয়ে সকালে মার্কেটিং করানোর পর বিকেলে সফটওয়্যার ডেভেলপারের কোড লেখানো হয় না, ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপককে সন্ধ্যায় নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের দায়িত্ব দিয়ে দেয়া হয় না। সমাজের কাঠামোই তাহলে ভেঙে পড়বে। অথচ মার্ক্সের ‘ইউটোপিয়ান’ চিন্তায় সেটাই ছিল বাস্তব।
শুধু সমাজ নয়, আমি আমার প্রবন্ধেই বলেছি, মার্ক্সের ইকোনমিক থিওরি অনেক সরল – সেই রিকার্ডোর ‘লেবার থিওরি ভ্যালুর’ উপর নির্মিত। আজকের সমাজ অনেক জটিল। আধুনিক অর্থনীতিতে মার্ক্সের তত্ত্বকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ‘মার্জিনাল ইউটিলিটি’ তত্ত্ব দিয়ে। আসলে সাপ্লাই-ডিমান্ডের গাণিতিক মডেল, গেম থিওরি, ট্রেন্ড এনালাইসিস, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত না করলে আজকের ‘গ্লোবালাইড পৃথিবীর’ বাস্তবতা ঠিকভাবে উঠে আসবে না। এ প্রসঙ্গে আমি আলেকজান্দার সলঝনেৎসিনের মার্ক্সবাদ এবং সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে কয়েকটি লাইন ঊল্লেখ করেছিলাম –
‘Marxism, a primitive superficial economic theory, is not only inaccurate, not only unscientific, has not only failed to predict a single event in terms of figures, quantities, time-scales or locations (something that modern economic theory with complex mathematical model using computers today do with laughable ease in the course of social forecasting although never with the help of Marxism) -is absolutely astounds one by economic and mechanistic crudity of its attempts to explain the most subtle of creatures, the human beings, and that even more complex synthesis of millions of people of the society. Only the cupidity of some, the blindness of others, and a craving of faith on the part of still others can serve to explain this grim humor of the twentieth century.’
এর বাইরে আছে মার্ক্সের নানাধরনের ভবিষ্যদ্বণীর ব্যর্থতা। এগুলোকে ছোটকরে দেখার উপায় নেই, কারণ আমার মতে তার এই ভবিষ্যদ্বানীগুলো তার তত্ত্ব থেকেই উঠে এসেছিল। কাজেই ব্যর্থতার দায়ভাগ কিছুটা তত্ত্বের কাঁধেও বর্তায় বই কি। মার্ক্স এর রচনা থেকে যে সমস্ত অমোঘ ভবিষ্যদ্বানীর উল্লেখ আমরা পাই –
– ভবিষ্যৎ সমাজের অভিমুখ পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র থেকে সাম্যবাদের দিকে ঘটবে।
– সাম্যবাদী সমাজে ‘dialect will cease to operate’ এবং ধারনা করেছেন ‘স্টেটের উইদার এওয়ে’ ঘটবে -‘In good time, the dictatorship of proletariat will wither away and the sunlit uplands of true socialism will be reached’।
-শ্রমিক এবং মালিকের মধ্যে উপার্জন গ্যাপ বাড়বে।
– বহু উৎপাদক প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে প্রোলেতারিয়েতের খাতায় নাম লেখাবে।
– শ্রমিকের উপার্জন একটি নির্দিষ্ট স্তরে সীমাবদ্ধ থাকবে।
– ‘অন্তর্গত সঙ্ঘাত বা ইন্টারনাল কন্ট্রাডিকশনের কারণে পুঁজিতন্ত্রের পতন ঘটবে
– উন্নত পুঁজিবাদী দেশেই বিপ্লব আগে ঘটবে।
বলাবাহুল্য এই ভভিষ্যদ্বানীগুলো মার্ক্সের দেখানো পথে ঘটেনি। আর এ ভবিষ্যদ্বানীগুলো কেবল কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো থেকে নয়, ক্যাপিটাল, জার্মান আইডিওলজি সহ বহু রচনাতেই উল্লিখিত আছে। যেমন, ক্যাপিটালেই আছে, কীভাবে শোষণ, দুর্বিপাক, দাসত্ব প্রভৃতির মাধ্যমে কিভাবে ওয়ার্কিং ক্লাসের ‘রিভোলট’ ঘটবে (monopolize all advantages of this process of transformation, grows the mass of misery, oppression, slavery, degradation, exploitation; but with this too grows the revolt of the working class,…) ইত্যাদি। ‘ল অব ক্যাপিটালিস্ট অ্যাকুমুলেশন’, ‘ল অব কনসেন্ট্রেশন অব ক্যাপিটাল’, ‘ল অব ইঙ্ক্রিজিং মিজারি’ র সারমর্ম মার্ক্সের ‘ক্যাপিটালে’ ই পাওয়া যায় যার মাধ্যমে পুঁজিতন্ত্রের বিনাশ ঘটবে বলে মার্ক্স ভেবেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল, অন্তর্গত সংঘাত বা ইন্টারনাল কন্ট্রাডিকশনের মাধ্যমে পুঁজিতন্ত্রের পতন ঘটেনি, নানামুখী অন্তর্গত সংঘাতের ফলশ্রুতিতে বরং সমাজতন্ত্রেরই পতন ঘটেছে। সারা দুনিয়ার বাস্তবতাই এর প্রমাণ।
আমি বিনীতভাবে দ্বিমতপোষণ করছি। ‘সব রাজহাঁসই সাদা’ এই ধরণের তত্ত্বের পক্ষে কেবল সাদা হাঁস খুঁজে খুঁজে বের করলেই তত্ত্ব শক্তিশালী হয় না, বরং কেউ যদি কোথাও কালো রাজহাঁস এনে দেখিয়ে বলে দেখুন – আপনার ‘সব রাজহাঁসই সাদা’ এই তত্ত্ব আসলে ধোপে টেকে না – তখন কিন্তু পূর্বতন যুক্তির কাঠামোটাই ভেঙ্গে পড়ে। পপার সেটাই বলার চেষ্টা করেছিলেন। মার্ক্সের তত্ত্বের বেশ কিছু জায়গায় ফলসিফায়াবেলিটির অভাব রয়েছে বলে মনে করা হয়। যেমন মার্ক্সের অর্থনৈতিক তত্ত্বে যেভাবে শ্রমিকদের ‘increasing misery’ পরিমাপের কথা বলা হয়েছে তা ফলসিফায়াবেল নয়। এ প্রসঙ্গে রুপার্ট উডফিন বলেন, ‘…Increasing misery can be explained without reference to value. We don’t know if it is significant and have no way to finding out.’। একই ধরনের কথা মার্ক্সের এলিনেশন থিওরীর জন্যও খাটে, যেখানে মার্ক্স বলেছেন – ‘We have only the illusion of happiness, because it is an essential part of our nature to be in a proper relationship to these things.’। এখানেও সমস্যা – ‘আমরা সুখে আছি নাকি এটা ইল্যুশন অব হ্যাপিনেস’ – এগুলো বস্তুনিষ্ঠভাবে নির্ণয়ের কোন উপায় নেই। ‘ডায়েলেক্টিক্স’ ব্যাপারটাও ফলসিফায়েবল কিনা তা বিবেচনার দাবী রাখে। পপারের মতে এটি ‘mystical, unverifiable nonsense’। বিজ্ঞান cause and effect নিয়ে কাজ করে, ডায়ালেটিক্স দিয়ে নয়।
মার্ক্সের তত্ত্বের সবকিছু প্রতিটিই ভুল প্রমাণ-সাপেক্ষ নয়, সেজন্যই কোন কিছু ভুল প্রমাণিত হলে কয়েনের হেড টেল পড়ার উপমা নিয়ে এসে এক ধরণের গোঁজামিল দেয়ার চেষ্টা করা হয়, যদিও মার্ক্সের তত্ত্বের মূল ভিত্তিটাই ইকোনমিক ডিটারমিনিজম এবং হিস্ট্রিকাল ডিটারমিনিজম।
যা হোক, আমি বলেছিলাম যে, মার্ক্সের তত্ত্বের নানা অসঙ্গতির সমালোচনা বহুদিন ধরেই হচ্ছে একাডেমিয়ায়। যেমন, পশ্চিমে যখন মার্ক্সের বহুল প্রত্যাশিত ‘ইনএভিটেবল রিভলুশন’ হল না, তখন মার্ক্সের তত্ত্বের অসঙ্গতি খুঁজতে এন্টোনিও গ্রামসি হেজিমনি (Hegemony) তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন। তিনি তার তত্ত্বে দেখান যে, শুধুমাত্র শ্রেনী সংগ্রামকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মার্ক্স সাংস্কৃতিক বিবিধ উপাদানই অস্বীকার করেছেন। মার্ক্সের এই ভ্রান্তি তাকে শেষ পর্যন্ত ঠেলে দিয়েছিলো অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাবাদের (economic determinism) দিকে। গ্রামসি দেখান যে, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক এবং বাহ্যিক শক্তি (economic and physical force) সামাজিক পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট নয়, সাংস্কৃতিক উপাদানকে গোনায় ধরা অপরিহার্য। এরপর ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সাথে যুক্ত পোস্ট মডার্নিস্ট চিন্তাবিদেরা – এডোর্নো, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, মার্কুস, ম্যাক্স হর্কেইমার, জার্গেন হ্যাবারম্যাস সহ অনেকেই মার্ক্সবাদের ‘ভবিষ্যদ্বানী’র ব্যর্থতার পেছনে অভিযুক্ত করেন সংস্কৃতিকে গুরুত্ব না দেওয়াকে। এডোর্নো তো স্পষ্ট করেই বলেন – ‘Marx’s failure to see this arose because of his failure to take culture seriously’। লুইস এলথুজার আবার মার্ক্সের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাবাদকে বাতিলের পাশাপাশি মার্ক্সের ‘হিউম্যানিজম’কেও প্রত্যাখ্যান করেন যা সূচিত করে মার্ক্সের অপরিহার্যতাবাদের (Marx’s essentialism) বিনাশ। আমি অনুরোধ করব লেখককে মার্ক্সবাদের পোস্ট মডার্নিস্ট সমালোচনাগুলো ভালভাবে পড়ে দেখতে। মার্ক্সবাদবিড়ধীদের লেখা না হয় নাই পড়লেন, অন্ততঃ অ্যান্থনি গিডেন্স, টম বটোমর, ডেভিড হেলড, নিকোস পেলনজাস, আন্দ্রেই গর্জ, গ্রামসি, এডোর্নো, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, মার্কুস, ম্যাক্স হর্কেইমার, জার্গেন হ্যাবারম্যাস, রুয়ার্ট উডফিন, পিটার সিঙ্গার, আর্নেস্ট ভ্যান দেন হ্যাগ, ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা, আর্নেস্টো লাক্লাউ, স্যান্টাল মুফদের সমালোচনাগুলো পরা আবশ্যক আধুনিক সমাজের গতিপ্রকৃতি এবং সনাতন মার্ক্সিয় বিশ্লেষণের ব্যর্থতাগুলো বুঝতে হলে।
যা হোক লেখাটি এবং আপনার বক্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। জ্ঞানার্জনের এই পথটি খোলা থাকুক।
@অভিজিৎ,
মনে হয় না লাভ হবে। সঠিক ভুল এরই মধ্যে নির্ধারিত হয়ে গেছে, তবে মনে হয় না আপনি এমন কাউকে বা কোন পক্ষের চোখ খোলাতে পারবেন যারা কিনা আসলে চোখ খুলতেই চাইছেন না!
@অশোক মুখোপাধ্যায়,
আপনার এই মন্তব্যটির মধ্যে প্রচুর যৌত্বিক দুর্বলতা এবং কিছুটা বোঝার অভাব লক্ষ্য করছি। অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তির কাঠামো উদোর পিন্ডি বুদোর ঘারে চেপেছে।
এটি আপনি কোথায় পেলেন? POVERTY OF HISTORICISM গ্রন্থের শুরুতেই তিনি ডেটারমিনিজম এবং হিস্টরিসিজমের মধ্যে পার্থক্য করেছেন এবং উভয়কেই আলাদা ভাবেই দুষেছেন। মোটেও গোলান নি। উনি এই ভাবে হিস্টরিসিজমকে সংজ্ঞায়িত করেছেন ঃ
“an approach to the social sciences which assumes that historical prediction is their principal aim…
এখানে মোটিভটার কথাই মুখ্য।
আবার ভুল করছেন। স্যোশাল সায়েন্সে প্রাকৃতিক সায়েন্স না। পপার যেসব কারনে হিস্টরিসিজমের বিরোধিতা করেছেন, তা দার্শনিক মহলে যাই হোক না কেন, বিজ্ঞানী মহলে বিশেষ ভাবে গ্রাহ্য। পপারের মূল বিরোধিতার কারন ছিল
১) সমাজ বিবর্তনের এলিমেন্টগুলি অসংখ্য-বিজ্ঞানের ভাষায় লিখলে কমপ্লেক্স সিস্টেম। তার বিবর্তন কি হবে তা ওই ভাবে নির্নয় করা যায় না
২) ভবিষয়তের আবিস্কারগুলি কি হবে, সেটাও নির্নয় করা যায় না-অথচ মার্কসবাদ মেনে নিলে, এই আবিস্কার গুলিই বিবর্তনের চালকা শক্তি। কালকে যদি কৃত্রিম ফটোসিন্থেসিস আবিস্কার হয়, কৃষিকাজ বলেই কিছু থাকবে না। রোবোটিক্সের উন্নতিতে শ্রমিক শ্রেনী বলেও কিছু থাকবে না। আবার সেই উন্নতি নাও হতে পারে। এগুলির ভবিষয়ত বানী সায়েন্স ফিকশন হতে পারে সায়েন্স না।
৩) বিবর্তনের অভিমূখ বায়োলজি বা সোসাল সায়েন্সেও random . Deterministic evolution বলে কিছু হতে পারে না। তাহলে বিবর্তনের সংজ্ঞা পালটে যাবে।
মূল কথা কোন জটিল সিস্টেমের ভবিষত বাণী করা অসম্ভব। যেকোন বিজ্ঞানী এটাই বলবেন এবং সেটা জটিল সিস্টেমের সংজ্ঞার মধ্যেই নিহিত।
তত্ত্বে ভবিষয়ত বানী থাকা, আর সেই ভবিষয়তবাণী সত্য বলে ধরে নিয়ে কোটি কোটি লোককে হত্যা করার মধ্যে অনেক তফাত। তাছারা একে ডেটারমিনিজম বলে না। এই সব ভবিষয়ত বানী নন ডেটার মিনিস্টিক মাল্টিমডেল রিয়ালিটি।
আমি একট উদাহরন দিই। ব্যাঙ্কিং এর কাজের জন্য, কোন দেশে বিপ্লব হবে কি হবে না, রাজনৈতিক অস্থিরতা আগামী ১০ বছরে কি হবে, এসব নিয়ে ভবিষয়ত বানীর গণিতিক মডেল আছে। আমরা প্রায় ১২০ টার কাছা কাছি প্যারামিটার [ হাঙ্গার ইন্ডেক্স, লিটারাসি, মিডিয়া ফ্রিডম ইত্যাদি ইত্যাদি] ধরে এসব ভবিষয়ত বানী টানি। আরো অনেক অনেক কারনেই এই ধরনের ভবিষয়তবানী লাগে। তার মানে কি এগুলি ডেটারমিনিস্টিল সিস্টেমের উদাহরণ?
মোটেও না। সামাজিক এবং পলিটিক্যাল সিস্টেম কাওটিক বলে, এর মাল্টিপল বা একাধিক পথ থাকতে পারে সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিবর্তনে। যেমন শুধু যদি ৩০ টা ইকোনোমেট্রিক প্যারামিটার নিয়ে কেও মিশরের রাজনৈতিক ভবিষয়ত ২০০৮ সালে বার করার চেষ্টা করত, তাহলে দেখত [ বা অনেকেই দেখেছে] মিশরের বিপ্লবের সম্ভাবনা নেই। কিন্ত যারা মডেলে স্যোশাল মিডিয়া ফাক্টর গুলো নিয়েছিল, তারাই এর আভাস পেয়েছিল। আবার সাউথ সুদানের জন্ম শুধু অর্থনৈতিক প্যারামিটার মডেলেই আসে। আমি যেটা বলতে চাইছি, সেটা হচ্ছে -এই ধরনের ভবিষতবানীর ক্ষেত্রে একাধিক “পাথ ওয়ে” বা বিবর্তনের বৃক্ষকে আমরা দেখি-এবং তার যেকোন একটি ঘটতে পারে ( তাও একটা নির্দিষ্ট সম্ভাবনা দেওয়া হয়)-আবার নাও পারে। সমাজ বিজ্ঞানে ডেটারমিনিস্টিক মডেল বলে কিছু হয় না-যা কিছু ঘটতে পারে, তার সাথে একটা “সম্ভাবনা” লাগানো হয়-যার অর্থই হচ্ছে ডেটারমিনিজম থেকে দূরে সরে আসা।
মার্কস কি কখনো বলে গেছেন যে এই ধনতান্ত্রিক থেকে সমাজতন্ত্রের আসার সম্ভাবনা এত % যদি এই সোশ্যাল পারামিটার গুলির ভ্যালু এই এই হয়? হলে এটা হিস্টরিসিজম বা ডেটারমিনিস্টিক মডেলেই আসত না।
আপনার প্রথম বক্তব্য সত্য হলেও দ্বিতীয়টি সম্পূর্ন ভুল। ওপেন সোর্সের ক্ষেত্রে যেহেতু কোন কোম্পানী মিন্স অব প্রডাকশন [ আই পি বা ইন্তেলেকচুয়াল প্রপার্টি] নিয়ন্ত্রন করছে না, এই সব ক্ষেত্রে যারা স্বাধীন কনসাল্টান্ট তারা অনেক বেশী রোজগার করছে-এবং অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কাজ, তাদের নিজেদের পপার্টি। সুতরাং এই পরিবর্তনটি না দেখতে পেলে মুশকিল আছে।
আমি মনে করি অশোক বাবু দর্শন এবং বিজ্ঞানের বেসিক জিনিসগুলোই বোঝেন নি ঠিক ঠাক ভাবে। এসব বেসিক বুঝলে, মার্কসবাদ নিয়ে এত শোরগোল করার কিছু নেই। বর্তমান পৃথিবীতে এত্ বিগ ডেটা আসছে, এত প্রেডিক্টিভ মডেলিং হচ্ছে, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মডেলিং এর শেষ নেই-সেখানে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির উন্নতিতে কেও মার্কস পড়তেই পারেন-কিন্ত সমাজ এবং অর্থনীতি কোন দিকে যাবে, তার জন্যে আমরা বিগ ডেটা এনালাইটিক্সের ওপরই ভরসা করব। মার্কসের ওপর না।
@লেখক,
আপনার পোস্ট করা লেখাটি টেকনিক্যাল ভুলের কারনে ছাপানো হল না। সম্পূর্ন লেখাটি হেডারে চলে আসার কারনে সেটা এলোমেলো হয়ে যায়। তারপরেও লেখাটি ছাপানো সম্ভব ছিল, কিন্তু আপনার লেখাটি মন্তব্য আকারে এখানে অর্থ্যাৎ এই পোস্টে দেয়াটি বেশি যুক্তিযুক্ত। তাতে করে লেখার সাথে আপনার নিজের এবং পাঠকের ইন্টারেকশনের ধারাবাহিকতা থাকে। যদিও আপনি একটি মন্তব্যও করেন নি। ব্লগের মূল আকর্ষনই হল লেখকের সাথে পাঠকের সরাসরি যোগাযোগ। যেকোন কারনেই হোক সে কাজটি আপনি সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন যেটাকে আমরা খুব একটা উৎসাহিত করি না। আপনার লেখাটি এখনে মন্তব্য আকারে দিয়ে দিতে পারেন। তাতে করে পাঠের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।
ধন্যবাদ
-মুক্তমনা মডারেটর
প্রথমে একটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু । কিছু মানুষ আজকাল ধুয়া তোলে, “পুঁজিবাদ,
সমাজতন্ত্র বুঝিনা, আমি চাই মানুষের পেটে ভাত থাক”! খুবই ভাল কথা সন্দেহ
নেই, কিন্তু এর বাস্তবতা কতখানি
আপনি নিজে যদি একবেলা পেটভরে খাবার খান, তবে যে অন্য আরেকজন কে বঞ্চিত
করেই খাবারটা খাচ্ছেন এটা বোঝেন কি? যেখানে দুনিয়াতে বিলিওন মানুষ না
খেয়ে থাকে আর বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মরে, সেখানে আপনি যদি ৩ বেলা শুধু
মাত্র ভাত খেয়েও থাকেন তবু কি সেটা স্বার্থপরতা নয়? আপনি কি আরেকজন কে
বঞ্চিত করেই খাবারটা খাচ্ছেন না? একটু পৃথিবীর মোট জিডিপি কে জনসঙ্খ্যা
দিয়ে ভাগ করেই দেখুন না যে ১% এর সম্পদ কেড়ে নিলেই কি বাকি ৯৯% এর পেট
ভরে যাবে?
সেখানে কিছু প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মারক্সিস্ট শুধু যে ৩ বেলা খাবার খান
তা নয়, শীত কালে খুবই আরামদায়ক পোশাক পড়েন, অনেকের হয়ত গাড়িও আছে। যেখানে
কত লোক কঠিন শীতের ভেতরে খালি গায়ে ফুটপাতে শুয়ে হিহি করে কাঁপছে, আর
মৃত্যুর প্রহর গোনার পাশাপাশি এই বসে আছে যে কখন কেউ তাদের একটা গরম
কাপড় দিয়ে যাবে?
তাহলে এখানে আপনারা নিজেরা এত আরাম করেন, আর মুখে সমানাধিকারের বুলি
আওড়ান, কিন্তু কাজের কাজ কতটা করছেন এখানে?
আধুনিক পুঁজিবাদের এই বিরাট যদি দাঁড়িয়ে থাকে লক্ষ কোটি মানুষের অদৃশ্য
কান্না ঘাম রক্ত অশ্রুর গ্রহ-সমান জেলির উপরে, তবে এদের জন্য কতটা কি
করেছেন আপনারা?
অন্তত ইন্টারনেট বিলটা ( মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য আর পানি সবচেয়ে
গুরত্ব পুর্ন, ইন্টেরনেট ছাড়াই মানুষ দিনের পর দিনে খুব ভাল ভাবেই
বেঁচেছে, আমি ইন্টারনেট ব্যবহারের বিরুদ্ধে না, আমি শুধু এই অপ্সহন
মার্ক্সিস্ট দের জন্যেই তুলে রাখছি) না দিয়ে তো সেটাও তাদেরকে সব
মারক্সিস্ট দিয়ে দিতে পারেন, যেন সবাই একটা করে কম্বল পায়, সেটা করেন না
কেন?
বড়বড় আর্টকেল ছাপিয়ে আর শীতের ভিতরে হিটিং সিস্টেমে ঘুমিয়ে, গরমের দিনে
এসি গাড়িতে চড়ে ( সবাই না অনেকেই), বড় বড় মানবতার বুলি আওড়ানো যত সহজ,
এইগুলো বিসর্জন দিয়ে কাজটা বাস্তবের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা ঠিক ততটাই
কঠিন। এই সহজ জিনিসটা কেন যে অনেক মানুষ অনুধাবন করতে পারেন না কে জানে।
এখানে আমি সবিনয়ে প্রশ্ন করতে চাই যে মার্ক্সবাদের পুজারী হিসাবে কি
নিজেরা সত্যি এই ৯৯% এর ভিতর পড়েন? আপনাদের জগত কাপানো বিপ্লবী চে
গুয়েভারা হাভানা চুরুট ঠোটে নিয়ে পোজ দেয়া ছবি বা আইকন কি আপনাদের চোখ
খুলে দিতে পারে না? ফিদেল ক্যাস্ত্রোর কোহিবা চুরুট ফোঁকাটা নিশ্চয়ই ভুলে
জান নি কেউ? একটা হাভানা চুরুটের দাম কত? আর কিউবানদের উপার্জন কত সেটা
কি আপনারা জানেন না? নাকি বলবেন যে উনারা রাষ্ট্রীয় কাজে এবং জনগনের
সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছেন, তাই কিছু বাড়তি সুবিধা তাদের প্রাপ্য?
সেখানে আমার প্রশ্ন হল যে সেই কিছুটা সুযোগসুবিধা আসলে কত বেশি হতে পারে?
চিরকাল সমাজতন্তের নামে যে রাষ্ট্রীয় ধনতন্ত্রের জন্ম হয়েছে, এবং সেখানে
দেশের সব সম্পদ যে ১% মানুষের চেয়েও অনেক কম লোকের হাতে থাকে সেটা কি
সত্যি আপনারা বোঝেন না? আদর্শবাদ কি আপনাদেরকে এতটাই চিন্তাশুন্যহীন
রোবটে পরিনত করেছে?
মানুষের বেঁচে থাকতে দরকার খাদ্য, বস্ত্র বাসস্থান আর চিকিৎসা। ক্ষুধা
যেখানে সর্বগ্রাসী, সেখানে না হয় আরেকটি মৌলিক চাহিদা যেটা কিনা শিক্ষা
সেটা বাদ দিয়ে গেলাম। তো আপনারা মার্ক্সবাদীরা তো এখানে বলবেন যে আপনারা
তো এই বঞ্চিত মানুষদের জন্যেই কাজ করেন।
তবে আমি বিনীত প্রশ্ন করতে চাই যে আসলে কি কাজ করেছেন এবং কতখানি করেছেন,
এর একটা প্রমান সহ বিস্তারিত বর্ননা দিচ্ছেন না কেন? নাকি বলবেন যে এ
নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছেন আর লেখালেখি করছেন যেন জনসচেতনতা বারে?
সেক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হল, ” ফেসবুক, বা কোন ফোরামে লম্বা লম্বা লেখা
দিয়ে, আর আবেগপুর্ন কিছু বাগাড়ম্বর করার চাইতে আমার মনে হয় পারলে এই
সময়টা সরাসরি সেই বঞ্চিত মানুষদের পিছনেই ব্যয় করুন না কেন?
আর কিছু না ছাড়তে পারেন, প্রথমে সাইবার লাইফের ঝড় থামান, আপনারা জানেন কি
যে ১ এম বি পি এস আনলিমিটেড ইন্টারনেট কিনতে আপনি যে টাকা বাংলা লায়ন বা
কিউবি কে,দেন সেই টাকা দিয়ে ১ মন মোটা চাল পাওয়া যাবে সাথে কিছু কলাইয়ের
ডাল, একটা দরিদ্র পরিবার এতে অন্তত নুনভাত খেয়েও একটা মাস কাটাতে পারবে?
সেখানে নিজেরা এত খরচ করে বাকি ১% ( চিন্তা করবেন না আমি কিন্তু ৯৯%
লোকের একজন; নেহায়েত সৎ মধ্যবিত্ত মানুষ যাকে কিনা খুব হিসাব করে খরচ
করতে হয়) এর টাকা কেড়ে নিয়ে তথাকথিত জনতার সম্পদ জনতাকে ফিরিয়ে দিয়ে কি
সত্যি পৃথিবী কে ক্ষুধা মুক্ত করতে পারবেন? আর পারলেও সেটা কতদিন? জানেন
কি যে ভিক্ষা বৃত্তি করে পেটের ভাত জুটলেও ভিক্ষুকের সংখ্যা কমে না?
এবার অশোক বাবুর প্রতি,
এই তথ্য পেলেন কোথায় যেটা কিন্তু জানান নি। আর পেলেও কেন এইসব তথ্য শুধু
মারক্সিস্ট রাই পায়? আমাদের মত খেটে খাওয়া মধ্যবিত্ত মানুষরা পায়না কেন?
কই আমাকে তো এমন ভাবে কাজ করতে হয় না। যদিও আমি বাংলাদেশেই থাকি।
তবে আমার দু এক জন বন্ধু আর আত্মীয় আরেক পুঁজিবাদী বা তাদের দোসর ইউকে বা
অস্ট্রেলিয়া থাকেন। তাদের মুখ থেকে কেন আমি এই আজব কথা শুনি না? নাকি আমি
মারক্সিস্ট না বলেই আমাকে সত্য কথা বলেন না তাঁরা??
দয়া করে কি এইসব প্রশ্নের জবাব দিবেন? খুবই সোজা প্রশ্ন, পেটে ভাতের সাথে
জড়িত প্রশ্ন,শিক্ষিত মধ্য বিত্তের ৯টা থেকে ছয়টা পর্যন্ত অফিস করে যদি
তাঁরা কিছু সঞ্চয় করেন, তবে সেটা বাড়তি আর অদরকারি হিসাবে জনতার সাথে
শেয়ার করার নামে লুট করার প্রশ্ন , যা মোটেই কোন আদর্শবাদ কে ধারন করে
না, বিজ্ঞানকেও না, শুধুই ধারন করে দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এই
ব্লগের যেসব লোক কে আপনারা অনেকেই দ্বি চারি বলছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
চাইবার অপরাধে (!) ?, সেখানে আসল দ্বিচারিতা কি আপনারা জনগণের সেবক
মার্ক্সবাদীরাই করছেন না??
অভিজিৎ।
ভুল, ছোটবেলা থেকে দেয়ালে দেয়ালে লেখা দেখে বড় হলাম, ‘মার্ক্সবাদ সত্য কারন উহা বিজ্ঞান’। দুবছর থেকে আনাচেকানাচে লেখাগুলো যদিও শ্বেতকেশের মতোই ফিকে হয়ে আসছে, তবুও মার্ক্সবাদ ১০০ শতাংশ বিজ্ঞান। হোমিওপ্যাথি আর এস্ট্রলজি যদি বিজ্ঞান হয় তবে মার্ক্সবাদ কেন বিজ্ঞান হবে না? শুধু একটাই মার্ক্সবাদের বিপক্ষে বলা যায়, অন্যান্য বিজ্ঞানের প্রয়োগ যখন ইঁদুর টিদুর দিয়ে শুরু হয়, তখন মার্ক্সবাদ সরাসরি মানুষ দিয়ে শুরু করা হয়েছে।
ওহো, আরেকটা বাজে কথা। নোয়াম চমস্কি কি চীনে বাস করে লিখতে পারতেন? না মুক্তমনার মত ব্লগ চীনে প্রকাশ করা যায়?
@অজয় রাউত,
:hahahee: :lotpot:
চীনে যেতে পারেন, কিংবা সুব্রত বাবু আর অশোকবাবুরা রাশিয়ার জামানায় স্ট্যালিনের সমালোচনাকারী বুদ্ধিজীবিদের ঢালাওভাবে কি ব্যবস্থা করেছিলেন সেটারও খোঁজ নিতে পারেন। আন্দ্রেই সিনায়েভস্কি ও ইউলি দানিয়েলের বিচারের প্রহসন, সলঝনিৎসনের উপর অত্যাচার, লাইসেঙ্কুর মত ঠগ বিজ্ঞানীকে প্রমোট করতে গিয়ে নিকোলাই ভাভিলভ হত্যা, শাখারভ, গ্যামো, কার্পেচেঙ্কো, সালমোন লেভিট, ম্যাক্স লেভিন, ইস্রায়েল আগলের মর্মান্তিক দশার ইতিহাস সব কিছুই খুব ভাল মতোই নথিকৃত। মুশকিল হচ্ছে এগুলো বললেই বলা হবে আমরা ‘সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল’ কিংবা ‘১% পার্সেন্ট ভার্সাস ৯৯% আন্দোলন’ বুঝি না। বড়ই মজা।
@অভিজিৎ,
‘১% পার্সেন্ট ভার্সাস ৯৯% আন্দোলন’
এটার কি হল? মহান নভেম্বর বিপ্লব আর মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মত কি আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে?
অভিজিৎ রায়ের আমার পড়া সব থেকে দুর্বল একটা লেখার জবাব এত ধৈর্য নিয়ে দিয়েছেন অশোকদা, তার জন্যে তাঁর ধন্যবাদ প্রাপ্য। এই লেখাগুলো পড়ার পর এতটাই অসহায়বোধ করছিলাম যে, এই লেখার অগোছাল এবং অবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় মার্ক্সবাদকে অবিজ্ঞান প্রমাণের চেষ্টার জবাব দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কী হতে পারে বুঝিনি (আমার অক্ষমতাও)। মার্ক্সবাদকে বিজ্ঞান বলা যায় কী না, না কি এটা শুধুই একটি বিজ্ঞান মনষ্ক দৃষ্টিভঙ্গী তা নিয়ে দ্বিধা আমারও রয়েছে। কিন্তু তাই বলে অভিজিৎ রায়ের এই লেখা? আমি আশা করেছিলাম, অভিজিৎ রায় প্রথমত আলোচনা করবেন, বিজ্ঞান হতে গেলে কী অর্জন করতে হয় একটা দর্শনকে, বা একটা দার্শনিক আলোচনাকে আদৌ বিজ্ঞানের মর্যাদা দেয়া যায় কি না? বিজ্ঞান তাকে বলা যায় না প্রমাণের পর আসত- আসলে মার্কসবাদের মাঝে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর কোথায় কোথায় ঘাটতি রয়েছে। অথচ এর কোনটাই না করে জনাব অভিজিৎ এখান থেকে খাবলি দিয়ে কিছু ওখান থেকে খাবলি দিয়ে কিছু এনে, কিছু রুপার্ট মার্ডক থেকে, কিছু ক্রুশ্চেভাইট প্রচারণা থেকে একটা খিচুরি বানিয়ে লেখা তৈরি করলেন, যেটা আসলেই অভিজিৎ রায়ের সাথে মানানসই নয়। অশোকদা তেমন একটা লেখা থেকে আসল প্রশ্নগুলো আলাদা করে তার জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছেন, তার এমন বৈজ্ঞানিক বিচারধারা্ লেখাটির বিষয়ে ঢোকার আগেই ভীষণ প্রশংসাযোগ্য।
অশোকদা যেটা উল্লেখ করতে পারতেন, যেটা অভিজিৎ রায়ের লেখায় সবথেকে দৃষ্টিকটু ভাবে রয়েছে- শিরোনামের সাথে এর বিষয়বস্তুর গড়মিল। কেন সেটা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। আর একটা বিষয় অশোকদা হয়তো জানেন না। আমি যতদূর জানি- অভিজিৎ রায়, বিপ্লব পাল এনারা বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকীস্তানি আগ্রাসণকে তারা ঠিক মনে করেন না। অথচ এনারাই, এনাদের দ্বিচারিতা দেখেন, রাশিয়ায় কুলাকদের সমর্থন করে বসলেন। আমার কাছে তাদের দ্বিতীয় অবস্থানটাই তাদের দর্শন সম্মত মনে হয়। কিন্তু প্রশ্ন জাগে তাহলে বাংলাদেশে রাজাকারদের বিরোধীতা আপনারা করেন কেন? সেটা কী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গত বলে? সংখ্যালঘুরা সেই যুদ্ধে বেনিফিশিয়ারি ছিল না বলে?
বিষয়টাকে আমার নিতান্তই স্বার্থপরতা মনে হয়েছে, বিজ্ঞানের খুটিনাটি জানায় আপনাদের অসম্ভব ভালো দখল মেনে নিয়েই বলছি। কোন আদর্শবোধ আপনাদের বিরোধেও নেই। সমর্থনেও নেই। সংখ্যালঘু পরিচয় যেমন রাজাকারদের বিচারে সমর্থন যোগায়। ঠিক একই কারণে, শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতির দর্শনে বিরোধ যোগায়, নিজেদের এলিট পরিচয়ের কারণে। আপনারা প্রত্যেকেই ভালো ক্যারিয়ারের মানুষ, অত্যন্ত নিরাপদ জীবন যাপন করেন। ফলে ভবিষ্যৎ জীবনের অনিশ্চয়তা আপনাদের ভাবায় না। ভাবায় যা খুশী করতে পারবার স্বাধীনতা, যা খুশী বলতে পারবার স্বাধীনতা থাকা না থাকার প্রশ্ন।এই কারণেই আপনারা কোন তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ইমার্জেন্স দেখেন, মিলিওনার হতে দেখেন কিন্তু ১% পার্সেন্ট ভার্সাস ৯৯% আন্দোলন দেখেন না।
যে কোন রকমের আদর্শবোধই যেহেতু কিছু দায়িত্ববোধের কথা বলে। কিছু নর্মস, রেগুলেশনের কথা বলে, তাই আপনারা সমস্ত আদর্শবোধের বিরুদ্ধে। সেটা কী ধর্মীয় দর্শন কি মার্ক্সীয় দর্শন। বিজ্ঞানের খুটিনাটির উপর এত চমৎকার দখল থাকার পরও চুড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীতে ভোগেন যে, যে কোন সত্যই যে পারিপার্শিকের সাপেক্ষে যাচাই করে নিতে হয় তা ভুলে যান। যে কারণে ধর্মের ঐতিহাসিক ভূমিকা আপনাদের চোখ এড়িয়ে যায়, হযরত মুহম্মদকে শুধুই লম্পট দেখেন। মার্ক্সবাদেও ধর্ম খুঁজে পান। অভিজিৎ রায়দের পুরো লেখা পর্যালোচনা করে রায়দের মার্ক্সবাদ বিরোধীতায় এমন টেন্ডিন্সি ছাড়া আর কিছুই পাইনি। যেদিন তারা সত্যিকারের কিছু বুদ্ধি বৃত্তিক প্রশ্ন হাজির করবেন, খুৎ খুঁজে বের করে দেখাবেন, নির্মোহভাবে আলোচনা তুলবেন সেদিন নিশ্চয়ই এই ধারণা আমার ভাঙবে।
@সুব্রত সরকার,
অপবাদ দেয়ার আগে একটু প্রমাণ দেখাবেন না? আচ্ছা ধর্মের ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়ে কার্ল মার্ক্স কিছু বলেছেন? আমাদেরকে সেখান থেকে একটু জ্ঞান দান করেন, আমরা জেনে কৃতার্থ হই।
কী সব আবুল-তাবুল বলছেন আপনি? আরেকটু খোলাসা করে বলুন তো দাদা।
@সুব্রত সরকার,
আমার ‘সব থেকে দুর্বল একটা লেখা’ যেভাবে পাঁচ বছর পরেও গাত্রদাহ তৈরি করে, যেভাবে অপ্রাসঙ্গিক সব বিশেষণে বিশেষিত করে ‘সবল’ সমস্ত মন্তব্য করেন, তাতে বোঝা যায় আসলেই লেখাটা কতটা ‘দুর্বল’ ছিল।
নিজের প্রশংসা করার জন্য বলা নয়, কিন্তু মার্ক্সিজম এবং পোস্টমডার্নিস্ট মার্ক্সিজমের দৃষ্টিকোণ থেকে যে সমালোচনা আমি করেছি, তার উল্লেখ বাংলায় আগে ছিল না, অন্তত ইন্টারনেটে। এটা আমি এখনো শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি। এমনকি মার্ক্সিজমে বিশ্বাসী অনেকেই আমার সাথে একমত না হয়েও আমার লেখাটির গুরুত্ব অস্বীকার করেননি। যেমন, আজকেও দেখলাম ফেসবুকে :
[img]http://blog.mukto-mona.com/wp-content/uploads/2013/11/saiful_marx.png[/img]
আপনি নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছেন যে ভদ্রলোক আমার লেখার সাথে একমত নন, কিন্তু তা বলে সেটাকে ‘সব থেকে দুর্বল একটা লেখা’ বলেও অভিহিত করছেন না। বরং বলছেন, ‘বাঙলা ব্লগে মার্ক্সবাদের এত চমৎকার, সুলিখিত সমালোচনা আমি অন্তত দেখি নি এখনও। তার এই লেখার সূত্রে অনেক জেনেছি, জেনে নেয়া ঝালাই করতে পেরেছি।’ প্রতিপক্ষকে বিশেষিত না করেও মন্তব্যের খণ্ডন করা যায় কিন্তু। আরো দেখুন আপনার ‘অশোকদা’ও কিন্তু প্রকারান্তরে আমার লেখাটির গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন। সেটা উনি তার লেখাতে বলেছেনও। ‘যেহেতু তার মধ্যে এই রচনাটি যুক্ত-তর্কের দিক থেকে একটু উন্নত গোছের’ সেজন্য তিনি পাঁচ বছর পর হলেও লেখাটির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। দুর্বল এলেবেলে লেখার জন্য কলম ধরে সময় নষ্ট কেউই করতে চায় না, তাও আবার পাঁচ বছর পরে, তাইনা?
যাক দ্বিধা যে আছে, তা জেনেই আমি খুশি। আমারও লেখাটির সূচনা ছিল এ ধরনের দ্বিধা থেকেই। কিন্তু আমি যেটা করিনি বছরের পর বছর এই ‘দ্বিধান্বিত’ অবস্থাতেই পড়ে থাকতে, যেটাতে অনেকেই থাকতে চান দেখতে পাচ্ছি।
কেন আমি তা করব, বলুন তো ? আমি তো এখানে বিজ্ঞান কাকে বলে, এর সংজ্ঞা কি – এ নিয়ে গাউছলাজম মাইছভান্ডারির মতো সংজ্ঞা শেখানোর ‘ইশকুল খুলে’ বসিনি। বিজ্ঞান কি, বিজ্ঞান হতে গেলে কী অর্জন করতে হয়, তা যে কোন স্কুলের বইয়েই পাওয়া যায়। আমি আশা করেছিলাম আমার পাঠকদের সেই প্রাথমিক জ্ঞানটুকু আছে। বিজ্ঞান কি, উহা কত প্রকার এ থেকে সবসময় লেখা শুরু করতে হবে কেন? আমি যখন কোরান, বেদ বা বাইবেলের মিথকে অবৈজ্ঞানিক বলে খণ্ডন করি – কই তখন তো আপনারা বলেন না প্রথমে বিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে হবে, বলতে হবে বিজ্ঞান কি ভাবে কাজ করে ইত্যাদি, তারপর হবে খণ্ডন, বলেন কি? আমি যখন হিগস নিয়ে কিংবা আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়ে লিখি তখন ধরে নেই, বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে এই প্রাথমিক জ্ঞানটুকু আমার পাঠকের আছে। কেন মার্ক্সবাদের ক্ষেত্রে সেটার ব্যতিক্রম হবে? যাহোক তারপরেও আপনাদের সম্মানার্থে বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে বলেছিলাম। সম্ভবত আপনার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। আমার লাইসেঙ্কুইজম নিয়ে লেখাটিতে খুব পরিষ্কারভাবেই ব্যাখ্যা করেছিলাম বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে, দেখে নিতে পারেন। পাশাপাশি আমার মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান লেখাটার আনুষঙ্গিক ব্যাখ্যায় ফলসিফায়াবিলিটি এবং ফলসিফিকেশন অংশটিও দেখে নিতে পারেন বিজ্ঞানের কাজ ভালমতো বোঝার জন্য (এখানে)। আমি খুব ভাল করেই বিজ্ঞানের সংজ্ঞা, প্রকৃতি এবং কাজ ব্যাখ্যা করেছি, এবং তার সাথে তুলনা করে বলেছি মার্ক্সবাদকে কেন আমি বিজ্ঞান মনে করি না। হল?
রুপার্ট মার্ডক ? ক্রুশ্চেভাইট প্রচারণা ? এগুলো কোথায় পেলেন বলুন তো? আমার লেখায় তো সেগুলো ছিল না। আমার লেখাটি আমি পুনর্বার পড়লাম। আপনার কাছে কি ওহি জাতীয় কিছু নাজিল হয়েছিল নাকি? নাকি ডঃ রুপার্ট উডফিনকে রুপার্ট মার্ডক ভেবেছেন? আর কার্ল পপারকে ক্রুশ্চেভাইট? বলা যায়না কিছুই। 🙂
আমি জানতাম না যে, ‘বাংলাদেশে রাজাকারদের বিরোধিতা’ করতে হলে স্ট্যালিনের নৃশংসতা আর অবিমৃশ্যকারিতাগুলোকেও ঢালাওভাবে সমর্থন করতে হবে। আপনার কোন ধারণা আছে স্ট্যালিনের সময় নৃশংসতার প্রকোপটুকু সম্বন্ধে? কুলাকদের নিয়ে ত্যানা প্যাঁচানো বাদ দিয়ে যদি কেবল তথ্যে চোখ রাখেন, তাহলেই দেখবেন কুলাকদের ‘শ্রেণীশত্রু’ আখ্যা দিয়ে তিন মিলিয়ন কুলাকদের হত্যা করা হয়েছিল। আর শ্রম-শিবির আর গুলাগে ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে যে অগণিত লেখক বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল সেটারই বা কি হবে?
আপনাকে একটু স্মরণ করিয়ে দেই লেখা থেকে। আমি বলেছিলাম, ক্ষমতায় এসে এক সন্দেহ-বাতিকগ্রস্ত প্রবল ক্ষমতাশালী স্বৈরশাসকে পরিণত হন স্ট্যালিন। রাস্তা ঘাট শহর বন্দরের নাম স্ট্যালিনের নামে নামাঙ্কিত করা হয়। রাস্তায় রাস্তায় গড়ে তোলা হয় বিশাল বিশাল স্ট্যালিনের মূর্তি। চারিদিকে কেবল ‘পশ্চিমা চর’ আর ‘বুর্জোয়া দালাল’ খুঁজে ফিরতেন স্ট্যালিন। নিজের সামান্য সমালোচনাও সহ্য করতেন না তিনি। যে কোন জায়গায় কারো ব্যর্থতা মানেই তার কাছে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’। নির্দয়ভাবে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করতেন তিনি একের পর এক। ধর্মান্ধ এবং প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রের মত কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে সাহিত্য রচনার গৎবাঁধা ছক বাৎলে দেওয়া হয়েছিলো, এর অন্যথা হলে তাদের ‘কমিউনিস্ট ধর্মানুভূতিতে’ আঘাত লাগত। ‘মুহম্মদ বিড়াল’ নিয়ে নির্দোষ কৌতুকেও যেমন ইসলামের অনুসারীদের পিত্তি জ্বলে যায়, তেমনি স্ট্যালিনকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে কমিউনিস্ট অনুসারীদের গায়ে লাল লাল ফোস্কা পড়তো। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ব্যঙ্গাত্মক রচনার জন্য সিনাভস্কি-দানিয়েলের বিচারের প্রহসনে। জেলখানায় সাত বছর বন্দি রাখা হয়েছিলো সিনাভস্কিকে, দানিয়েলের কপালে জুটেছিলো পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ড। সলঝনিৎসনের উপন্যাস ‘ফার্স্ট সার্কেল’ (First Circle)-এ দেখানো হয়েছিলো কিভাবে উপন্যাসের নায়ক শেষ পর্যন্ত স্ট্যালিনের শ্রমশিবিরে নিজেকে খুঁজে পায়। সলঝনিৎসনকে সে সময় দেশ ত্যাগ করতে কিংবা নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। আঁদ্রে শাখারভকে গোর্কিতে নির্বাসন দেওয়া হয়। পশ্চিমা বিশ্বে তো প্রতিবাদ হয়েছিলোই এমনকি পূর্ব ইউরোপের খোদ কমিউনিস্ট ব্লকেও সে সময় এ নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা হয়। যেমন, নরওয়েজিয়ান কম্যুনিস্ট পার্টির Friheten পত্রিকায় খ্যাতনামা কমিউনিস্ট মার্টিন নাগ তখনই বলেছিলেন,
‘সোভিয়েত রাষ্ট্রের সাহিত্য-শিল্প বোঝার ক্ষমতা নেই। ব্যাঙ্গাত্মক রচনা তারা বোঝে না। শিল্প সাহিত্যের শত্রু স্ট্যালিন এ অবস্থা তৈরি করেছে। সোভিয়েত শিল্প-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের নিকট রাষ্ট্রের দেওয়া স্ট্যাম্প থাকে, তারা শুধু বিভিন্ন স্থানে সে স্ট্যাম্প দিয়ে সিল মারেন। ভবিষ্যতে মুক্ত সোভিয়েত সাহিত্যে সিনাভস্কির ব্যাঙ্গাত্মক রচনা সম্পূর্ণ আকারে প্রকাশিত হবে।’
মার্টিন নাগের ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গিয়েছে অক্ষরে অক্ষরে। অথচ সে সময় মার্টিন নাগ সমালোচিত হয়েছিলেন ‘কমিউনিজম বিরোধী’ এবং ‘পশ্চিমা দালাল’ অভিধায়। পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ায় স্ট্যালিন মার্কসীয় মতবাদের সংগে সংগতিপূর্ণ করার লক্ষ্যে বংশাণুবিদ্যাকে বিকৃত করতেও পিছপা হননি । এই উদ্দেশ্যে তিনি লাইসেঙ্কো নামক এক ঠগ বিজ্ঞানীকে নিয়োগ করেন। যখন ভাভিলভ প্রমুখ বিজ্ঞানীরা লাইসেঙ্কোর তত্ত্বের ভুল ধরিয়ে দেন তখন স্ট্যালিন তাদেরকে গুলগে পাঠিয়ে দেন। তার মৃত্যুকে করা হয় ত্বরান্বিত। স্ট্যালিনের প্রতিহিংসার স্বীকার হয়ে আরো প্রাণ হারান কার্পেচেঙ্কো, সালমোন লেভিট, ম্যাক্স লেভিন, ইস্রায়েল আগলের মত বিজ্ঞানী। শুধু লাইসেঙ্কো নয়, স্ট্যালিন জামানায় লেপিশিঙ্কায়া নামের আরেক ঠগ বিজ্ঞানীকে প্রমোট করা হয়েছিল – সেই ‘পুঁজিবাদী’ জেনেটিক্স’ সরাতে। বিজ্ঞানকে অবশ্যই শ্রমজীবী বা প্রলেতারিয়েতের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে, তা নইলে চলবে না – এটাই বিজ্ঞান সম্পর্কে কমিউনিস্টদের ‘বৈজ্ঞানিক থিওরি’।
আইনস্টাইন আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রদান করার পর, ব্যাপারটা ‘মার্ক্সিজমের সাথে সংগতিপূর্ণ’ মনে না করায় ‘সোভিয়েত এন্সাইক্লোপিডিয়া’ প্রকাশ করা হয় রিলেটিভিটিকে ‘নস্যাৎ’ করে। তারা বলেছিলেন –
‘‘Einstein’s theory of relativity cannot be considered accepted since it was not accepted by the proletariats’.
এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে পদার্থিবিদ জর্জ গ্যামোকে পালাতে হয়েছিলো রাশিয়া ছেড়ে। গ্যামোর সময় রাশিয়ায় বিজ্ঞানীদের কি দশা হয়েছিল তা নিয়ে বিস্তৃতভাবে আমি লিখেছিলাম এখানে। জেনেটিক্সকে যেমন ‘পুঁজিবাদী বিজ্ঞান’ হিসেবে অভিহিত করে হটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, ঠিক তেমনি আবার একটা সময় বিগ ব্যাং এরও বিরুদ্ধাচরণ করা হয়েছিল কমিউনিস্ট রাশিয়ায়। বলা হয়েছিল বিগ ব্যাং এর ধারণা মার্ক্সিস্ট ভাবধারার সাথে একেবারেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়, ওটা ‘বুর্জোয়া বিজ্ঞান’। যে সমস্ত বিজ্ঞানীরা বিগ ব্যাং তত্ত্বের পক্ষে কথা বলতেন তাদের উপর নেমে এসেছিল রাষ্ট্রীয় নির্যাতন। যেমন, ১৯৩৭ সালে নিকোলাই কোজারভ নামের এক বিজ্ঞানী ছাত্রদের মাঝে বিগ ব্যাং মডেল নিয়ে আলোচনা করায় তাকে ধরে শ্রমশিবিরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। অত্যাচার করা হয়েছিল ভসেভলদ ফ্রেডরিকস এবং মাতভেই ব্রনস্টেইন নের মত বিজ্ঞানীদের উপরেও, করণ তারা বিগ ব্যাং তত্ত্বের সমর্থক ছিলেন। গ্যামো রাশিয়া ছেড়ে পালানোর পর তাকে বিশ্বাসঘাতক ‘আমেরিকান মুরতাদ’ (Americanized apostate) হিসেবে চিহ্নিত করে বিচারের প্রহসনও করা হয়েছিল। স্ট্যালিনের আমলে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে হত্যার ব্যাপারগুলো যদি বাদও দেই, বিজ্ঞানী আর সাহিত্যিকদের উপর অত্যাচারের কালো ইতিহাস কি মিথ্যা, নাকি স্রেফ পুঁজিবাদী প্রচারণা? বস্তুত স্ট্যালিনের সময় সীমাহীন নিপীড়ন, নির্যাতন আর অত্যাচারের সময়টুকু আজ ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়ে আছে ‘দ্য গ্রেট টেরর’ (The Great Terror) বা ‘গ্রেট পার্জ’ (Great Purge) হিসেবে।
আপনাকেই বরং প্রশ্ন করা যেতে পারে – যেভাবে আপনারা স্ট্যালিন, মাও চওসেস্কুর মত স্বৈরশাসক দুর্নীতিবাজদের খুন, রাহাজানি, গণহত্যা সহ সমস্ত অপকর্মগুলো ঢালাওভাবে চোখ বুজে ডিফেন্ড করেন, সেখানে কীভাবে আর কোন মুখে রাজাকার আর যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো মুখ রাখেন?
আমাকে কুলাকপন্থি বললে আপনাকে এখন থেকে স্ট্যালিনের ‘গুলাগপন্থি’ বলে ডাকা হবে, কেমন?
না, স্ট্যালিনের কাজ অমানবিক ছিল বলে। তার আমলে সীমাহীন নির্যাতন আসলে গণহত্যার পর্যায়েই পড়ে। সেজন্য।
আমার যুক্তিকে খণ্ডন না করে আমার ‘এলিট’ শ্রেণী না মধ্যবিত্ত শ্রেণী তা নিয়ে পড়ে গেছেন। আমি চাই আমার বক্তব্যের খণ্ডন, আমার ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে আপনাদের অহেতুক কল্পনা বা অনুমান নয়। আর যুক্তির বিচারেও এগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। এই ধরনের আক্রমণ এক ধরণের ফ্যালাসি। Circumstantial Ad Hominem, এবং কিছুটা Red herringও।
আপনার বক্তব্য অনেকটা এরকমের –
“Bill claims that 1+1=2. But he is a Republican, so his claim is false.”
যে কোন ছোট বাচ্চাও এই ‘যুক্তি’ দেখে হাসবে। বিল রিপাবলিকান হলেই তার ১+১ =২ এর দাবী মিথ্যা হয়ে যায় না। তাই না? বিলকে ভুল প্রমাণ করতে হলে তার যুক্তি খণ্ডন করতে হবে। এখন উপরের উদাহরণে ‘Bill’-এর জায়গায় ‘অভিজিৎ’ আর Republican এর জায়গায় ‘এলিট পরিচয়’ বসালেই আপনি বুঝতে পারতেন তার যুক্তির দুর্বলতা কোথায়।আমি এলিট শ্রেণী হই, আর শ্রমিক শ্রেণী হই, কিংবা হই কুলাক শ্রেণী, আমি মার্ক্সবাদ সম্বন্ধে যে কথাগুলো বলেছি সেটার খণ্ডন দেখলেই উপকৃত হতাম।
আরো একটা বিষয় আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেই। আমি আগেই বলেছি, আমি আমেরিকায় আইটিতে কাজ করি, সাধারণ একজন সফটওয়্যার কর্মী হিসেবে। আপনার অশোকদা’কে ডিফেন্ড করতে গিয়ে বোধ হয় আপনার খেয়ালও নেই যে আপনি আসলে আশোকদার বিপরীত কথা বলছেন। উনি বলেছেন এই সেকটরে যারা এ লেভেলে কাজ করেন, তারা নাকি খুব কষ্টে আছে, ‘সাড়া রাত জগে কাজ করতে হয় মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। বেতন পায় না, ‘প্রস্রাবখানায়ও যেতে পারে না’ ইত্যাদি। আর অন্যদিকে আপনি বলছেন, ‘এলিট পরিচয়ের কারণে’ নাকি আমরা খুব ভাল আছি, নিরাপদ জীবন যাপন করছি, ‘ভবিষ্যৎ জীবনের অনিশ্চয়তা’ নাকি আমাদের ভাবায় না। তো কোনটা ঠিক?
ভুল কথা। আপনি যত ইচ্ছে অন্ধ সেজে থাকুন, সমস্যা নেই – আমার লেখায় যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত আছে। খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. রামকৃষ্ণ মুখার্জির সহ বরেণ্য অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ হাজির করেছি। এগুলো আপনি দেখতেও পাবেন না জানি। আর পশ্চিমের যে কোন দেশের দিকে তাকালেই দেখা যায় ‘সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং’, ‘এমার্জিং মার্কেট’ প্রভৃতির কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণী একটি বাস্তবতা, তা অর্থনীতি জানা যে কোন লোকই জানে। এমনকি খোদ এশিয়াতেই অন্তত ৫২৫ মিলিয়ন লোক নিজেদের মধ্যবিত্ত বলে মনে করে। চায়নাতে কি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান আপনারা দেখছেন না? এমনকি ‘দরিদ্র’ আফ্রিকাতেও প্রায় ৩২৩ মিলিয়ন লোক নিজেদের মধ্যবিত্ত বলে মনে করে। এমনকি স্রেফ ভারতেই মিলিয়নের উপর লোক মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করছে। আর আপনারা লাল বইয়ে চোখ ডুবিয়ে রেখে পৃথিবীর তাবৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে স্রেফ ‘উধাও’ করে দিচ্ছেন। ডগমার শিকর কতদূর বিস্তৃত আপনাদের কথা শুনলেই বোঝা যায়।
🙂 মার্ক্সবাদী হলে বোধ করি এমনটা হত না। ‘অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি’ থেকে বেরুতে হলে মার্ক্সিস্ট হতে হবে, এটা প্রায় নিশ্চিত।
বোকার মত কথা হল। হযরত মুহম্মদকে শুধুই লম্পট হিসেবে দেখা হয় না, সেরকম কোন লেখাই আমি আসলে লিখিনি। কিন্তু মুক্তমনার বিভিন্ন লেখক তাদের লেখায় হয়তো দেখিয়েছেন যে মুহম্মদের জীবনের বিভিন্ন কাজ (যেগুলোর উল্লেখ নাই বা করলাম) অন্তত পয়গম্বর-সুলভ নয়। এটা কি ঠিক নয়? যে পয়গম্বরদের ‘ঈশ্বর প্রেরিত-পুরুষ’ বলে মনে করা হয়, যাকে ‘সর্বযুগের জন্য আদর্শ’ বলে মনে করা হয়, তার কাজ শিক্ষা, যুক্তি, মানবতা, প্রগতির কষ্টিপাথরে যাচাই করা হবে না? নাকি কেউ পয়গম্বর হিসেবে দাবী করলে, ধর্মের ‘ধর্মের ঐতিহাসিক ভূমিকা’র প্রেক্ষাপটে যে কোন সংশয়বাদী বিশ্লেষণ বাতিল করে দিতে হবে?
এটা অবশ্য ঠিক বলেছেন। তবে আমি আমার মনগড়া কিছু বলি নি। আমার বহু আগে – লুইস ফুয়ের, বার্ট্রান্ড রাসেল, গিবন প্রমুখ দার্শনিক, বিজ্ঞানী, এবং ঐতিহাসিকেরা বিশ্লেষণ হাজির করে দেখিয়েছেন কমিউনিজমের সাথে বিজ্ঞানের চেয়ে ধর্মের সাযুজ্যই বেশী।আপনি কি পাননা? আমি তো তা পাই। আমার লেখাতেই বহু উদাহরণ দিয়েছি। যে ভাবে কমিউনিজম সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিল তা ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত ঈশ্বর কর্তৃক পরকালে স্বর্গের স্বপ্নময় আবেদনের কথা মনে করিয়ে দেয়। ধার্মিকরা যেমন কোরান, বেদ, বাইবেল, হাদিস প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থের মধ্যে মহাসত্য খুঁজে পান, এবং মুহম্মদ, যীশু এবং অন্যান্য ধর্মপ্রচারকদের বানীকে শিরোধার্য করে রাখেন, এবং তাদের দেখানো পথেই নিজেদের চালিত করতে চান- ঠিক সেভাবেই কমিউনিস্টরা অনেকটা মার্ক্স, লেলিন, স্ট্যালিন, ট্রটস্কি, মাও এবং তাদের লেখা লাল বইগুলোকে দেখতেন। Das Capital ছিল যেন তাদের কোরান কিংবা বেদগ্রন্থ আর Communist manifesto তাদের হাদিস; মার্ক্সবাদ ছিল তাদের ‘রাষ্ট্র ধর্ম’ – ‘Opium of the proletariats’, যে ব্যবস্থায় পুরোহিতগিরি করেন স্ট্যালিন, মাও, চওসেস্কুর মত ‘পয়গম্বরেরা’ ! ধর্মের অনুসারীরা যেভাবে নিজ নিজ ধর্ম প্রতিষ্ঠার নামে ঢালাওভাবে বিধর্মীদের উপর অত্যাচার করেছে, ঠিক তেমনি কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা এবং বিপ্লবের নামেও লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, গুলাগে প্রেরণ করা হয়েছে অনেক প্রগতিশীল মানুষকে, ‘শ্রেণীশত্রু’ কিংবা ‘পুঁজিবাদের দালালের’ তকমা এঁটে নির্যাতন করা হয়েছে কিংবা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাহিত্যিক এবং রাজনীতিবিদদের নির্যাতন, নির্বাসন, কারাগারে নিক্ষেপ, শ্রম-শিবিরে প্রেরণ, মস্তিষ্ক ধোলাই ইত্যাদি সেই মধ্যযুগীয় ধর্মের কৃষ্ণ ইতিহাস ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। ‘কাফের নিধন’, কিংবা ‘নির্যবন করো সকল ভুবন’-এর মত ‘বুর্জোয়াদের খতম কর’ ধ্বনি দিয়ে শ্রেণীহীন সমাজ গড়বার প্রেরণা ছিলো বহু জায়গায় কমিউনিজমের অপরিহার্য শ্লোগান। ক্রুসেড, জ্বিহাদ ধর্মযুদ্ধের মতই ছিলো তাদের এই শ্রেণীসংগ্রামের লড়াই। লেলিনের সময় আমাদের ‘র্যাব’ বা ‘রক্ষীবাহিনীর’ মত যে বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনী CHEKA গঠন করা হয়েছিলো, যার ফলশ্রুতিতে ১৯২৩ সালের মধ্যে বলি হয়েছিলো ৫ লক্ষ লোক। এই হত্যা আর নির্যাতন আরো প্রকট আকার ধারণ করে স্ট্যালিনের জামানায়, তার কিছু নমুনা তো আগেই দিয়েছি। মাও, চওসেস্কু, পলপট সবার জন্যই ব্যাপারগুলো সত্য। এ নিয়ে ইন্টারনেটেও বহু ভাল লেখা আছে। যেমন, যুক্তিবাদী সাইট infidels.org থেকে Daniel G. Jennings এর Communism is Religion লেখাটি আপনি পড়ে নিতে পারেন।
আর এতদূরেও যাওয়ার দরকার নেই, আপনার শেষ দিককার কিছু মন্তব্যের সাথে ধর্মবাদীদের ঢালাও মন্তব্যের তুলনা করুন, উত্তর পেয়ে যাবেন।
উহু, আপনার ধারনা ভাঙ্গার দরকার নেই। কিছু লোক সব সময়ই জেগে জেগে ঘুমিয়ে থাকবে। তাদের ঘুম ভাঙ্গবে না, দরকারও নেই। এই যুগেও কিছু লোক বিশ্বাস করে পৃথিবীটা সমতল। আমি বছর পাঁচেক আগে বাংলাদেশে গিয়ে দেখেছিলাম মুহাম্মদ নুরল ইসলাম নামে এক ভদ্রলোক একটি বই লিখেছেন, ‘পৃথিবী নয়, সূর্য ঘোরে’। হ্যাঁ এই একবিংশ শতাব্দীতেও এই বই লেখা হয়েছে, যখন মানুষ মঙ্গল গ্রহে যাবার স্বপন দেখছে, আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমণের কথা ভাবছে, হিগস কোনার সন্ধান পাচ্ছে, আমাদের গ্যালাক্সির বাইরে কোন দ্বিতীয় পৃথিবী আছে কিনা তার সন্ধান করছে। আর মহাবিজ্ঞ লেখক লিখে চলেছেন, ‘পৃথিবী নয়, সূর্য ঘোরে’। এর কারণ হচ্ছে, লেখক মহাসত্য-গ্রন্থ কোরাণ, হাদিস চষে কোথাও পৃথিবী ঘূর্ণনের পক্ষে একটি আয়াতও খুঁজে পাননি। বরং তার মতে কোরানে সূর্যের ঘূর্ণনের স্বপক্ষে বহু আয়াত আছে (৩১:২৯, ১৩:২, ৩৯:৫, ৩৬:৩৮, ২১:৩৩, ২:২৫৮, ১৮:৮৬, ২০:১৩০ ইত্যাদি), আর সেই সাথে আছে পৃথিবী যে নিশ্চল সেটা বর্ণনা করে নানা আয়াত (২৭:৬১, ৩৫:৪১, ৩০:২৫, ৩১:১০, ২:২২ ইত্যাদি) । কাজেই বিজ্ঞান যাই বলুক, তার দুনিয়ায় পৃথিবী এখনো স্থির। তার ঘুম কি আমার পক্ষে ভাঙানো সম্ভব? সম্ভব না। ঠিক একইভাবে কমিউনিস্ট রাজ্যে নির্যাতন নিপীড়ন আর সর্বোপরি তাসের ঘরের মতো চীন, রাশিয়া আর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো থেকে কমিউনিজমের বিদায়ের পরও যারা এখনো মার্ক্সবাদকে ‘বিজ্ঞান’ ভেবে জেগে জেগে ঘুমাতে চান, ‘ইমাম মাহদীর’ মত ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে মার্ক্সবাদের আগমন, কিংবা ‘যীশুর পুনরুত্থানের’ মত আগামী পৃথিবীতে মার্ক্সবাদের পুনরুত্থানের স্বপ্ন দেখেন, মার্ক্সবাদকে বিজ্ঞান ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন, তাদের ঘুম ভাঙানোর দায়িত্ব আমার নয়।
@অভিজিৎ,
মার্ক্সবাদীদের জন্য আরেকটা বৈজ্ঞানিক লিংক 😛 দিলাম।
মন্তব্য গুলো বেশ আকর্ষনীয় লাগছে;
(C) (^) (D) (B) (F) (I)
সবার জন্য যার যা পছন্দ তুলে নিন
@কাজী রহমান,
ওহ আর একটা কথা, টাইটেলে মার্ক্সবাদের সপক্ষে না বলে মার্ক্সবাদের পক্ষে বললে বোধ হয় ভালো হত। ব্যপার অনেকটা আমার পক্ষে আমার স্বপক্ষে’র মত হয়েছে বলে মনে হয়।
@কাজী রহমান, আমার সবগুলাই পছন্দ 🙁 , তবু যদি একটা নেবার অপশন থাকে তবে ফুলটাই নেব! নেন আপনিও একটি (F)
@দারুচিনি দ্বীপ,
তাও ভালো যে এখানে শুধু আপনিই একা বন্ধু ভেবে পাল্টা কিছু একটা বলেছেন। নিজেকে হঠাৎ সল্লুর দোকানের টি বয়ের মত লাগছিল। এখন ভালো লাগছে। শুভ ইচ্ছেগুলো অনেক কাল শুভেচ্ছা নিয়ে বেঁচে শুভেচ্ছা থাকুক। ধন্যবাদ আপনাকে :-s
@কাজী রহমান,
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে 🙂 । আপনিও অনেক ভাল থাকুন।
@ লেখক, আপনার লেখা পুরোটা পড়িনি এখনো, সময় নিয়ে পড়ব আশা রাখি।
তবে আপাতত একটা কথা ছিল!
আমার মনে হয় সাধারন মানুষ যেখানে সমানাধিকারের নামে মোটামুটি ক্রীতদাসের জীবন যাপন করে, সেখানে চে গুয়েভারা, ফিদেল ক্যাস্ট্রোরা কোহিবা চুরুট ফোঁকেন জনসেবার ক্লান্তি দূর করার জন্য!!
অসাধারণ একটা লেখা পড়লাম। তত্ত্ব ও তার প্রয়োগের যে সম্মন্ধ লেখক সেটা প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন। বিপ্লব বাবুর আশা মত পুঁজিপতিরা খোল করতাল নিয়ে প্রেম বিলাতে আসবে এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মার্কসবাদী অর্থনীতি আজ হোক কাল হোক মানুষকে গ্রহণ করতেই হবে। পুঁজিবাদের প্রাণ ভোমরা যে ভোগবাদ তার ফলে সুধু মানুষ নয় মাতা ধরিত্রিও আজ বিপন্ন। তবে এটা হয়ত ঠিক কম্মুনিসম এর এক দলীয় শাসন মানুষ প্রত্যাখান করেছে। তার মানে এই নয় মার্ক্সবাদ অচল।
এরকম হীনমন্য মানসিকতার লোকেদের লেখা মুক্তমনায় না আসলেই ভাল ।
মার্ক্সবাদী একটা সময়ে যেমন দেশের উন্নতি এনেছে তেমনি দেশের মধ্যে অনাচার সৃষ্টির সাক্ষীও রেখেছে। আমাদের দেশে এসবের চর্চা আসলে কোন ভাল ফল বয়ে আনেনি। বরং মার্ক্সবাদী মনোভাব আমাদের দেশ থেকে শেখ মুজিবের মত নেতা কে কেড়ে নিয়েছে।
মার্কসবাদকে বিজ্ঞান দাবি করা আর কোরানে বিজ্ঞান খুঁজে পাওয়ার দাবির মধ্যে বিশেষ তফাৎ আছে কি? এই দুই ধরণের দাবিদারদের একটি কমন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কোনো বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনাও এরা সহ্য করতে পারে না এবং নিজেদের অবস্থানের সত্যতা প্রমানে ফাঁপা বুলির ফুলঝুড়ি ছড়ায়।
আমার এক বন্ধু বলে, এই জাতীয় বামপন্থী ও মমিনদের কথাবার্তা ও আচরনের ধরণে দারুন মিল আছে। এবং মস্কোপন্থীদের সে বলে মমিনস্কি এবং চীনপন্থীরা তার কাছে মংমিন।
প্রথমেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি কষ্ট করে আমার সেই পাঁচ বছর আগেকার লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়বার জন্য, এবং এ নিয়ে আপনার অভিমত প্রকাশ করা জন্য। আপনার উপস্থাপনা নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যেভাবে ব্যক্তিআক্রমণ না করে প্রত্যুত্তর দিয়েছেন সেটা সবার জন্যই শিক্ষণীয়।
মার্ক্সের ব্যাপারে আপনার অবস্থান এবং আমার অবস্থান পুরোপুরি বিপরীত না হলেও অনেকটাই প্রায় দুই মেরুর কাছাকাছি। তাই লেখার প্রত্যুত্তর দিতে হলে লাইন বাই লাইন দিতে হবে। সেই সময় এবং শক্তি কোনটাই আমার আপাততঃ নেই। আর তার দরকারো নেই। পৃথিবীর বাস্তবতাই নির্ধারণ করে দিয়েছে প্রকৃত সত্য। আমাদের সুশীল তর্ক বিতর্কে এর পরিবর্তন ঘটবে খুব সামান্যই।
দু একটি কথা বলি আপাতত: –
তা আমার বক্তব্যের এত বড় খণ্ডনের পর নিশ্চয় আবার মার্কসবাদ বিজ্ঞান হয়ে গেছে? 🙂 সাড়া পৃথিবীতে ঘটা চাক্ষুষ ঘটনাবলী আর বিজ্ঞানের বই পত্তরগুলোতে যদিও আমি এর প্রমাণ পাচ্ছি না যদিও।
যাহোক, আমি বলিনি যে মার্ক্সবাদ সবক্ষেত্রেই ‘অচল’ একটি মতবাদ। বরং আমার লেখাটি যদি আবার একটু মন দিয়ে পড়তেন তবে হয়তো দেখতেন, আমি স্পষ্ট করেই বলেছি যে সমস্ত সমাজব্যবস্থায় শ্রেণী বৈষম্য এবং শ্রেণী নিপীড়ন বিদ্যমান সে সমস্ত ব্যবস্থায় মার্ক্সের শিক্ষা এবং তত্ত্ব যে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ তা নিঃসংশয়ে বলা যায়। আমার অবস্থান অনেকটা দেরিদার মতো বলতে পারেন। পোস্ট মডার্নিস্ট মার্ক্সিস্ট দেরিদা তার Specters of Marx (1994) বইয়ে বলেন, তিনি মার্ক্সের তত্ত্ব নয়, মার্ক্সিজমের এই মুক্তিকামী ‘স্পিরিট’টিকে তিনি সমর্থন করেন। তিনি মার্ক্সিজমকে বিজ্ঞান নয়, বরং ‘লিঙ্ক অব এফিনিটি, সাফারিং এন্ড হোপ’ হিসবে এখন দেখতে চান। আমিও তা চাই। সেটা করা যায় বিজ্ঞান না বানিয়েও। আর সবকিছুকে বিজ্ঞান হতেই বা হবে কেন?
না মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান নয়। ছিলোও না কখনো। সরি। আপনি পপারকে এবং মার্ক্সবাদের ভবিষ্যদ্বাণীর ব্যাপারটা খণ্ডন করতে গিয়েও যা বলেছেন তা থেকে বোঝা যায় এনিয়ে আপনার ধারণা সঠিক নয়। এই যে আপনি বলেছেন –
আপনি নিজেই ভাল করে জানেন, আপনার উপরের উক্তিটি কত বড় গোঁজামিল। মার্ক্সের থিসিসের স্তম্ভই হচ্ছে ‘হিস্ট্রিকাল ডিটারমিনিজম’। ডিটারমিনিজম মানে নিশ্চয় আপনি বোঝেন। নিশ্চয়তাবাদ। এখানে হেড, টেলের মত অনিশ্চয়তার কোন বালাই নেই। বরং যেটা আমি আমার লেখায় বলেছি, সেটা এখনো প্রবলভাবেই বাস্তব। মার্ক্স ভেবেছিলেন ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্র, এবং সমাজতন্ত্র থেকে সাম্যবাদ – এভাবে সমাজের বিকাশ ঘটবে। ঘটেনি। মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণীর আরেকটি বড় বিপর্যয় হল – মার্ক্স ভেবেছিলেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এডভান্সড পুঁজিবাদি রাষ্ট্রগুলোতে আগে হবে – কারণ সে সমস্ত দেশেই শ্রমিকেরা হবে ‘সবচেয়ে শোষিত’। কিন্তু সে সমস্ত দেশে বিপ্লব আগে হয় নি। এ প্রসঙ্গে পপার লেখেন –
‘It has been predicted revolution would happen first in the technically highest developed countries, and it is predicted that the technical evolution of the ‘means of production’ would lead to social, political, and ideological movements, rather than other way round… But (so-called) socialist revolutions came first in one of the backward countries.’।
এমনকি রাশিয়ায় যখন বিপ্লব হয়েছিলো, তখন রাশিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়ালি ডেভেলপ্ট ছিলো না মোটেই। তাদের ইন্ডাস্ট্রির উন্নতি হয়েছে বিপ্লব-পরবর্তী যুগে। সমাজতন্ত্রের পতনের পর ব্যাপারটা আরো বেশি দৃশ্যমান। সমাজতন্ত্রে আঁকড়ে পড়ে থাকা তার্কিকেরা ‘সমাজতন্ত্রের পুনরুত্থানের’ নিদর্শন হিসবে যে দেশ গুলোর – নেপাল, ভেনিজুয়ালা প্রভৃতি দেশের উদাহরণ হাজির করেন সেগুলো কোনটিই কিন্তু ‘শীর্ষ পুঁজিবাদী’ দেশ নয়। বাস্তবতা হচ্ছে – কট্টর পুঁজিবাদী দেশগুলোতে বিপ্লব হচ্ছে না – হবেও না বোধ হয়। কারণ বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ধ্বংস না হয়ে যে টিকে গেছে – সেই টিকে থাকার পেছনে ‘অন্তর্নিহিত বিবর্তন’টি মার্ক্স গোনায় ধরেন নি, কিংবা ধরতে চাননি।
এখন আপনার কথা থেকে মনে হচ্ছে ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে পৃথিবী যাক, আর সমাজতন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রেই যাক – মার্কবাদ ঠিকাছে। এটা অনেকটা ধর্মবাদীদের দেওয়া গোঁজামিল হল না? সূর্য পঙ্কিল জলাশয় ডুবুক আর পৃথিবী সমতল বলা আয়াত থাকুক না কেন, উহা বৈজ্ঞানিক। সাধে কি অনেকেই মার্ক্সবাদের সাথে ধর্মের এত সাযুজ্য খুঁজে পান?
কোন কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হতে হলে এর একটা ক্রাইটেরিয়া লাগে ভুল প্রমাণিত হবার। আপনি আমাকে ‘খণ্ডন’ করে এতবড় থিসিস লিখলেন, কিন্তু আমি দেখলাম না আপনি কোন ক্রাইটেরিয়া দিয়েছেন যে, এই অমুক ব্যাপারটা ভুল হলে মার্ক্সবাদ ভুল হত কিংবা হবে। তা না করে ‘যত পরস্পরবিরোধী ঘটনাই ঘটুক না কেন, এটা মার্ক্সবাদের মধ্যেই পড়ে’ টাইপের যুক্তি হাজির করেছেন। এইজন্যই মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান নয়, অপবিজ্ঞানের পর্যায়ে চলে গেছে। আপনার প্রবন্ধ নয়, বরং কার্ল পপারের ফলসিফায়াবিলিটি এবং ফলসিফিকেশন এর ব্যাপারটাই অনেক প্রাসঙ্গিক এবং যৌক্তিক।
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, লেখাটি আপনি পুরোটা পড়ে দিয়েছেন, নাকি স্রেফ উনি মার্ক্সবাদী, নিশ্চয় উনি মার্ক্সবাদকে বিজ্ঞান বলবেন ভেবে দিয়েছেন। হ্যা আমি প্রফেসর বুরাওয়ের এই পেপারটা বহু আগেই পড়েছি, আপনি উদ্ধৃত করার অনেক আগেই। কিন্তু আমার মনে হয়নি উনি মার্ক্সবাদকে বিজ্ঞান বলেছেন। বরং ল্যাকাতোস, খুন, পপার পোলায়নি প্রমুখের কাজের উল্লেখ হাজির করেছেন কিভাবে তারা মার্ক্সবাদকে ‘বিজ্ঞান নয়’ বলেই রায় দিয়েছেন। প্রফেসর বুরাওয়ের নিজেও তার সিদ্ধান্ত হিসেবে পেপারে এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন –
“I argue that Marxism loses it scientific character when it denies its own historicity, that is when Marxism renounces the dialogue between its own historically emergent rationality and the external historical challenges it confronts. In other words, Marxism is most successful as a science when there is balanced reciprocity between its internal and external histories.”
আপনার কি মনে হয়, প্রফেসর বুরাওয়ের উপসংহার আমার লেখার বিরুদ্ধে যাচ্ছে?
আপনি বহু জায়গাতেই ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, বিশেষতঃ সফটওয়ার ইন্ডাস্ট্রি সম্বন্ধে আপনার সিদ্ধান্ত দুর্বল।
আপনার সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি সম্বন্ধে ভাল ধারণা আছে বলে মনে হয় না। আমি নিজেই আইটি কোম্পানিতে ডেভেলপার হিসেবে বহুদিন কাজ করেছি। কোন কোম্পানিতেই আমি দেখিনি কাউকে সাড়া রাত জগে কাজ করতে হয় মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। প্রস্রাবখানায়ও নাকি যেতে পারে না। কই আমি তো তা দেখলাম না, এত বছর চাকরীর পরেও। বরং এই সব সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিতে ঠিক পাঁচটা বাজার সাথে সাথে অফিস খালি হয় যায়। নিয়মিত লাঞ্চ, কফি ব্রেক সবই থাকে। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি।
ভুল ধারণা। বরং এই সফটওয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা লোকজনই পশ্চিমে গড়ে তুলেছে বিরাট বড় একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যাদের সামাজিক চাহিদা প্রভাব ফেলছে দেশগুলোতে।
আছে। সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির আসলে অনেক ডিভিশন। যারা প্রডাকশন সাপোর্ট তাদের প্রায় সবাই শিফটে কাজ করে। আমার নিজের কোম্পানিতেই আমি দেখেছি। ডেভেলপার বা প্রোগ্রামারদের কাউকেই রাত জেগে কাজ করতে হয় না। হ্যা, ডেলিভারি বা রিলিজের সময় মাসে দুই একবার রাত জাগতে হয় বটে, কিন্তু সেরকম রাত জাগলে সবাই এর পরের দিন ‘কম টাইম’ পায়, ‘ডে অফ’ পায়, আর বোনাস, বাড়তি পয়সার অনুদান, এগুলোতো আছেই।
ঠিক তাই। সেটাই উচিৎ । সেই কাঁচামাল আর শোষণের পুরোন তরিকায় আর চলছে না যে!
আর সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি গুলোতে শ্রমিক এবং কাঁচামালের সনাতন ধারনাই পালটে দিয়েছে, তা আমি আমার মূল প্রবন্ধেই বলেছি। সেটার সমর্থনে ড. রামকৃষ্ণ মুখার্জির যে বক্তব্য হাজির করেছিলাম সেটা এখানেও প্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। তিনি মনে করেন, ধণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিশীলিত রূপ গ্রহণ করার ফলে শ্রমশক্তির এক উল্লেখযোগ্য অংশ কায়িক শ্রম দানের পরিবর্তে বুদ্ধিজনিত শ্রমদান (মেন্টাল লেবার) করছে এবং তারাই মধ্যবিত্তসূলভ জীবন জাপন করছে। প্রতিবছরই তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে এইচ ওয়ান ভিসায় আমেরিকায় আসছে আজার হাজার ‘মেন্টাল লেবারের’ দল, যারা তৈরি করেছে এক দৃশ্যমান বলিষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেনী। বলা বাহুল্য, এই মধ্যবিত্ত শ্রেনীর বুদ্ধিমত্তা ও মানসিকতা আপামোর জনগণের কাছে সাধারণ মানদন্ড হিসেবে পরিগণিত হয়েছে এবং সমাজে তাদের আধিপত্য বিস্তৃত হবার মধ্য দিয়ে তাদের স্বার্থ অনুযায়ী সামাজিক কাঠামো পরিবর্তিত হয়েছে। মার্ক্সের সনাতন ধারণায় সমগ্র উৎপাদিকা শক্তিকে কেবলমাত্র কায়িক শ্রমদানকারী শ্রমিকের মাধ্যমে মূল্যায়ন করেছিলেন – যা আজকের দুনিয়ার সাপেক্ষে অনেকটাই বাতিলযোগ্য। আমার মনে হয়না আপনি আমি রামকৃষ্ণ মুখার্জির এই বিশ্লেষণের খণ্ডন করতে পেরেছেন।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতির ব্যাপারটা তাহলে চোখে ধরা পড়ছে? তা অনুপস্থিতিটা হল কেন? স্রেফ পুঁজিবাদের আগ্রাসন, নাকি নিজেদেরই ব্যর্থতা? সেই আশি নব্বইয়ের দশকেই সমাজতন্ত্রের দুর্গ বলে খ্যাত বিভিন্ন দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়েছে। রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপের দেশ গুলো, চায়না … কোথাওই আর সমাজতন্ত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। আর অন্যদিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিভিন্ন সমস্যার শিকার হয়েও খুব ভালভাবেই টিকে গেছে। শুধু টিকে যায়নি, সমাজের নির্দিষ্ট শ্রেণীর ক্রয়ক্ষমতা, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মান উন্নত থেকে উন্নতর হয়েছে, এবং মালিক এবং শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত মানুষের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সহজ ব্যাপারটা বোঝার জন্য কোন তত্ত্ব লাগে না। সাড়া পৃথিবীর বাস্তবতাই এর প্রমাণ।
কিন্তু সেই অশ্রুর গ্রহ-সমান জেলি থেকেই আবার ‘প্রগ্রেসিভ ইনকাম ট্যাক্স’ পাচ্ছি, শিশুশ্রমের বিলোপ দেখেছি, শিশুদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষা দেখেছি। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে পৃথিবীতে টিকে গেছে আর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে পতন হয়েছে এর একটা কারণ তো আছে। কেবল ‘লক্ষ কোটি মানুষের অদৃশ্য কান্না ঘাম রক্ত’ আর ‘অশ্রুর গ্রহ-সমান জেলি’ র উপমা হাজির করলেই তো পার পাওয়া যাবে না।
বহুজাতিক কোম্পানির কর্মী বা শ্রমিকেরা আজ কোম্পানির স্টক কিনতে পারছে, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের মাধ্যমে তারা নিজের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারছে অনেক ভালভাবে – পুঁজিবাদী সমাজেই। পুঁজিবাদী সমাজের বিবর্তন হিসেবে আমরা সুইডেন, নরওয়ে, ক্যানাডার মত ‘ওয়েল ফেয়ার স্টেটও দেখেছি – যা শ্রমিকদের জীবন এবং মান নিয়ন্ত্রণ করে, এমনকি চাকরী চলে গেলে পর্যাপ্ত ভাতা পর্যন্ত দেয় বছরের পর বছর, রাষ্ট্র সেখানে নিজ উদ্যোগে বৃদ্ধ, পঙ্গু, অক্ষম এবং বিকলাঙ্গদের দেখভাল করে। সেগুলো কি আপনার চোখে পড়ছে না? একারণেই ডঃ রুপার্ট উডফিন বলেন –
‘Marx assumed that 19th century laissez-faire capitalism, with individuals and families owning whole enterprises, would continue. He did not anticipate that middle classes, who he thought to be crushed out of existence by the two of the monolithic classes of capital and labor, would in fact grow from strength to strength. Thanks to the introduction of the joint stock company, many people can become co-workers, often through third parties such as pension funds or saving schemes. Increasing numbers of shareholders have an interest in preserving capitalism. Other became managers, paid by shareholders to manage their investment. The later group, far from joining the proletariat as Marx expected, felt superior to the class from whence they had been drawn.
The concentration of capital does lead to the ‘collectivization’ of workers. But, against Marx’s prediction, it allowed workers to form their own associations – Trade Unions. Trade unionism is not dedicated to overthrowing the system, but to improving wages and conditions. The political philosophy of ‘welfare state’ social democracy grew powerful in 20th century. So much for Marx’s idea of government only ever serving the interest of rich! ’।
মার্ক্স যেখানে ধারনা করেছিলেন নিপীড়ন আর শোষণ বাড়বে – সেখানে পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখতে পাওয়া যাবে – এ সমস্ত পুঁজিবাদী সমাজে বহুদিন ধরেই শিশুশ্রমকে অবৈধ করা হয়েছে, সামাজিক বৈষম্যকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, শ্রমিকদের গুনগত মান বৃদ্ধি পেয়েছে, কায়িক শ্রম এবং দৈনিক শ্রমের সময় কমে এসেছে, মজুরী, ভাতা এবং আনুষঙ্গিক সুবিধা অনেক বৃদ্ধি পেয়ছে, নারীরা বাইরে কাজ করছে। পার্কেস সেই ষাটের দশকেই বলেছিলেন –
‘Low wages, long hours and child labor have been characteristic of capitalism not, as Marx predicted, in its old age, but in its infancy’
এমনকি আমেরিকার মত অশ্রু ঘাম রক্ত আর জেলির দেশেও ওবামার ‘ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার’ চালু হতে যাচ্ছে। কেবল উপমার জোরে তো আর লড়াইয়ে জেতা সম্ভব নয়; যেখানে সাড়া পৃথিবীর বাস্তবতাই আপনার থিওরির বিপক্ষে।
আরো অনেক বিষয়েই আপত্তি করা যায়, কিন্তু এ নিয়ে আর কথা বাড়াচ্ছি না। আমার মূল লেখা এবং আনুষঙ্গিক আরো দুটো লেখাতেই (এখানে এবং এখানে) বহু পয়েন্টের উল্লেখ আছে। পাঠকেরা লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়লেই অনুধাবন করতে পারবেন যে আপনার এই লেখাটি সেগুলোর সত্যিকার খণ্ডন হিসেবে দাঁড়াতে পারে কিনা। আর স্ট্যালিন, পলপট মাও প্রমুখের গনহত্যার কীর্তিগুলো যেভাবে সাফাই গেয়ে শ্বেত সফেদ বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে সে নিয়ে বলাটাই বালখিল্য। তাদের সেই নৃশংসতা খুব ভাল্ভাবেই ওয়েল ডকুমেন্টেড (এ প্রসঙ্গে পড়তে পারেন, The Black Book of Communism: Crimes, Terror, Repression, From the Gulag to the Killing Fields: Personal Accounts of Political Violence and Repression in Communist States, Mao: The Unknown Story প্রভৃতি দ্রঃ)। কেবল চমস্কির উপমায় চিড়ে ভিজবে না। চমস্কির স্ট্যান্ডের প্রতি আমি সংবেদনশীল, কিন্তু ইতিহাসের পর্যালোচনায় তিনি বহু সময়ই যুক্তির চেয়ে আবেগকে প্রাধান্য দিয়েছেন, পরষ্পরবিরোধিতাও করেছেন ঢের, তার বহু নজিরই আছে নেটে। এখানে একটি-
http://www.paulbogdanor.com/chomskyhoax.html
যাহোক, আমি আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদকে যে কারণে বাতিল করি, ঠিক সেকারণেই বাতিল করি সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদকেও (আবার দয়া বলবেন না যে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী ছিল না – বরং সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ছিলো পুঁজিবাদী বিশ্বের মতই সমান আগ্রাসী। পোল্যান্ড (১৯৩৯), হাঙ্গেরী (১৯৫৬), চেকোশ্লাভাকিয়া (১৯৬৮), আফগানিস্তান (১৯৭৯)-এর উপর রাশিয়ার নির্লজ্জ আগ্রাসনের ইতিহাস কারো অজানা নয়, অজানা নয় তীব্বতের প্রতি চীনের মনোভাবও), ঠিক সেকারণেই অপছন্দ করি স্ট্যালিন আর পলপটদের গণহত্যাও। একটার বিপরীতে আরেকটার সাফাই গাওয়ার কোন অর্থ নেই।
তারপরেও আপনার লেখার গুরুত্ব আছে। সেই গুরুত্ব আমি স্বীকার করেই নিচ্ছি। কিন্তু আপনার প্রায় কোন বক্তব্যের সাথে একমত হতে পারা গেল না, সেজন্য দুঃখপ্রকাশ করছি।
ভাল থাকুন। আর হ্যা, মুক্তমনায় স্বাগতম। আপনার শক্তিশালী লেখা আমাদের ব্লগকে ভিন্নমাত্রা দিবে এ আস্থা আমার আছে।
@অভিজিৎ,
অসাধারণ উত্তর অভিজিৎ ভাই। কথাটা জানানোর জন্যেই কেবল অনেক দিন পর লগ ইন করলাম।
পুঁজিবাদের ‘শোষণ’ চরিত্র সম্পর্কে শত বছর ধরে দুর্নাম করার পরেও যে পুঁজিবাদী সমাজ বরং উত্তরোত্তর শোষণের বিপরীত দিকেই গেছে এই ব্যাপারটা আপনার মন্তব্যে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। তবে এটা কিন্তু ঠিক যে শিল্পবিপ্লবের প্রাক্কালে পুঁজিবাদকে স্রেফই একটা শোষণযন্ত্র মনে হয়েছিলো মার্ক্স ও অন্যান্যদের। এর বিকাশমুখী চরিত্রটা বোঝার মত শিল্পবিপ্লবোত্তর যথেষ্ট উপাত্ত ওনাদের কাছে ছিলো না। উপাত্তের সাথে তত্ত্বকে যে যাচাই ও পরিবর্তন করে নেবে, সে তৎকালীন মার্ক্সীয় বিশ্লেষণ থেকে অবশ্যই উঠে আসবে, এমন কি মার্ক্স বেঁচে থাকলে স্বয়ং তিনি নিজেও হয়তো তাই করতেন।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে স্বাভাবিকভাবেই, যারা পুঁজিবাদকে কেবলই শোষণযন্ত্র ভেবেছিলেন, তারা কোথায় ভুলটা করেছেন, পুঁজিবাদের এই বিকাশমুখী চরিত্রটারই বা ব্যাখ্যা কী? এর উত্তর পাবার জন্যে আমাদেরকে অর্থনীতি ও গেইম থিওরি সাহায্য করতে পারে। যেমন জিরো সাম গেইম ও নন-জিরো সাম গেইমের ধারণাগুলো।
সংক্ষেপে বলা চলে, বাজার তথা বিনিময়কে জিরো সাম গেইম হিসেবে ভাবাটাই ছিলো মার্ক্সপন্থীদের প্রধান ভুল। বিনিময় যদি জিরো সাম গেইম হয় (বিনিময়কারী দুই জনের লাভের যোগফল শূন্য), তাহলে বিনিময়কে শোষণই বলা চলে। কিন্তু এটা এখন প্রমাণিত যে বিনিময় জিরো সাম গেইম নয়। একটা বিনিময়ে দুইজনেরই লাভবান হবার সুযোগ থাকে। ফলে দুইজনের লাভের যোগফল ধনাত্মক। লাভ বলতে আগের চেয়ে উন্নত অবস্থায় থাকা। হয়তো একজনের লাভ আরেকজনের চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে, কিন্তু তারপরেও দুইজনেই বেটার অফ থাকছে বিনিময়ের মাধ্যমে।
বিনিময়ের এই নন-জিরো সাম বৈশিষ্ট্যের কারণেই পুঁজিবাদ তার নানা সমস্যা নিয়েও এগিয়ে চলছে। এক অর্থে মানব সভ্যতার সমগ্র ইতিহাসই বিনিময়ের ইতিহাস। উৎপাদনের বিনিময়, চিন্তার বিনিময়, আবিষ্কারের বিনিময়।
অন্য কোনো প্রাণীর কর্টেক্স বিনিময়ের এই বৈশিষ্ট্যটা অনুধাবন করতে পারে না, এক মাত্র মানুষকেই এটা অনুধাবন করতে পারতে দেখা যায়। ফলে মানুষ লুট করার বদলে বিনিময় করায় উত্তরোত্তর আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এটাই মানুষকে আরও বিকশিত করেছে, পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রেখেছে।
আর পুঁজিবাদ কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা নির্ভর নয় সমাজতন্ত্রের মতো। কারণ বিনিময় জিনিসটা একেবারে ব্যক্তি লেভেলে ওয়ান-টু-ওয়ান পর্যায়ে ঘটা সম্ভব কোনো অথোরিটির প্রয়োজন ছাড়াই। ফলে পুঁজিবাদকে কাবু করাও কঠিন।
প্রতিটা মানুষকে চোখে চোখে যদি না রাখা যায়, কেউ না কেউ কোথাও না কোথাও বিনিময় করবেই। আর বিনিময়ে বেটার অফ থাকা যাচ্ছে দেখলে অন্যরাও আগ্রহী হয়ে বাজার গঠন করে ফেলবে।
এমন কি জর্জ অরওয়েলের বিগ ব্রাদারের দেশেও শহরতলীতে গোপনে বিনিময় চলতো, কারণ প্রতিটা মানুষকে চোখে চোখে দেখে রাখা সম্ভব না। অনেক ক্ষেত্রে সেটাই ছিলো দরিদ্রতম মানুষদের বেঁচে বর্তে থাকার উপায়।
ফিদেল ক্যাস্ত্রোর কিউবাতেও যখন রেশনের অভাব দেখা দেয়, মানুষ খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকে কালোবাজারের সহায়তায়, যেটা হলো অথোরিটিকে ফাঁকি দিয়ে করা একপ্রকার বিনিময়। ক্যাস্ত্রোও পারছেন না সেই বিনিময়কে ঠেকিয়ে রাখতে। কারণ পুঁজিবাদ তথা বিনিময় ডিস্ট্রিবিউটেড সিস্টেম।
@রূপম (ধ্রুব),
আপনার মন্তব্যটাও দারুণ। উত্তর দেব দেব করেও দেয়া হয়নি। আজ আলোচনা করব বলে ভাবছি।
এটা সঠিক হতেই পারে। আরেকটা ব্যাপার আমার প্রায়ই মনে হয়, যেটা আমি আমার লেখায় উল্লেখ করেছিলাম। যারা কেবল শোষন দিয়েই সিস্টেমকে সংজ্ঞায়িত করেন, তারা বোঝেন না একটি ‘সিলিকন ভ্যালি’ কিংবা গুগল তৈরির পেছনে কি পরিমাণ মেধা, চিন্তা, সৃজনশীলতা আর সাহস কাজ করে । তারা এ সব প্রতিষ্ঠান বিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতিই কেবল বদলে দেয়নি, সেই সাথে বদলে দিয়েছে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের চিরায়ত ধারনাগুলোও।
আসলে মার্ক্সের ইকোনমিক থিওরী অনেক সরল – সেই রিকার্ডোর ‘লেবার থিওরি ভ্যালুর’ উপর নির্মিত। আজকের সমাজ অনেক জটিল। আধুনিক অর্থনীতিতে মার্ক্সের তত্ত্বকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ‘মার্জিনাল ইউটিলিটি’ তত্ত্ব দিয়ে। আসলে সাপ্লাই-ডিমান্ডের গানিতিক মডেল, গেম থিওরী, ট্রেন্ড এনালাইসিস, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত না করলে আজকের ‘গ্লোবালাইড ওয়ররল্ডের’ বাস্তবতা ঠিকভাবে উঠে আসবে না বোধ হয়।
চমৎকার বলেছেন। আসলেই আধুনিক অর্থনীতি ‘জিরো সাম গেম’ নয় (এখানে)। সেজন্যই পুঁজিবাদী দেশে ধনিরা ধনি হয়, পাশাপাশি দরিদ্রদের অর্থনৈতিক অবস্থা কিংবা গড়পরতা মান সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর চেয়ে ভাল থাকে। এটাও একতা কারণ যার কারণে সেসমস্ত রাষ্ট্রগুলোতে বিপ্লব হয়নি। আপনার কাছে এ নিয়ে কোন ভাল প্রবন্ধ বা বইয়ের হদিস থাকলে দিতে পারেন। আমি খুব আগ্রহ নিয়েই পড়ব।
বুলস আই!
🙂
@অভিজিৎ,
আমি বলবো ম্যাট রিডলির নতুন বই The Rational Optimist: How Prosperity Evolves এ ব্যাপারে অবশ্য পাঠ্য। তবে খুব সম্ভবত বইটা আপনি ইতোমধ্যে পড়ে ফেলেছেন। 🙂
আমেরিকান গণতন্ত্র দেখে যারা মুগ্ধ তাদের সাথে মার্ক্সবাদ নিয়ে তর্ক করে কি কোন লাভ আছে? পৃথিবীতে একটা মাত্র দেশ যারা মানুষের উপর আনবিক বোমা পরীক্ষা করেছে, তাও প্রথম পরীক্ষার মানবিক বিপর্যয় দেখেও তারা দ্বিতীয়দিন আর একটা শহরের সমস্ত মানুষকে হত্যা করতে পারে, যারা মারণাস্ত্রের মিথ্যা কথা বলে এক প্রাচীন সভ্যতাকে শেষ করে দিতে পারে, একটা মাত্র দেশ যারা মানুষের উপর নাপাম বোমা নিক্ষেপ করার মতো নিষ্ঠুর হতে পারে – এই নৃশংশতার কাহিনীর শেষ নেই। এদের কাছে কমিউনিজমের “ক্রাইম লিষ্ট” থাকে, আমেরিকান “গণতান্ত্রিক ক্রাইম লিষ্ট” তাদের কাছে থাকে না। একজন মন্তব্যকারী লিখেছেনঃ “মার্কসবাদ এবং তার ওপর হওয়া সমস্ত্ ক্রিটিক্যাল এসেসমেন্ট বুঝতে প্রথাগত দর্শনে জ্ঞান থাকা বিশেষ জরুরী। এটা না থাকলে মার্কস নিয়ে অন্ধের হস্তি দর্শন অব্যাহত থাকবে।” অথচ বোঝা গেল সমগ্র প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টি অনুধাবন না করেই তিনি যে সমস্ত আলোচনাই তিন/চার বছর আগেই সেরে রেখেছেন তার ফিরিস্তি শোনাচ্ছেন আমাদের। এরই “মুক্তমনা”- য় কোন এক বিতর্কে মন্তব্যও দেখেছি যে নেহেরু নাকি ভারতবর্ষকে “সমাজতান্ত্রিক” রাষ্ট্র বানিয়েছিলেন।
@অজিত কুমার রায়,
সোভিয়েত ইউনিয়ানের সমালোচক, কমিনিউজমের সমালোচক হলেই কেও আমেরিকান গণতন্ত্রের ভক্ত হয়?
চমস্কি একজন কট্টর আমেরিকান সমালোচক-তিনি লেনিন বা কমিনিউজমের সমালোচনা করেন নি?
এই উপমহাদেশে এই ধরনের দুর্বল বুদ্ধির মানুষ এত বেশী-মাঝে মাঝে মনে হয়, ছায়ার সাথে যুদ্ধ করছি! কেও মমতার সমালোচনা করলেই সেই ব্যাটা সিপিএম, হাসিনার সমালোচনা মানেই সেই রাজাকার এই ধরনের পাতলা মন্তব্য হাস্যকর।
আমেরিকান গণতন্ত্র কেন, সব গণতন্ত্রই একটা পরীক্ষাগার। গণতন্ত্রের প্রশংসা এই জন্যই করা হয়েছে যে এখানে বিরোধিতার সুযোগ আছে। আর আছে বলেই হিরোসিমা দিবসে ক্যাপিটল হিলের সামনে যুদ্ধবিরোধিরা অবস্থান করে। এই বিরোধিতা আছে বলেই আস্তে আস্তে ডিরেক্ট ডেমোক্রাসি বা পলিটিক্যাল রিফর্মের দাবি উঠছে। নিউয়ার্কের রিচ এন্ড ফেমাসদের দুর্নীতি আস্তে আস্তে হলেও অনেকটা ভেঙে তাদের জেলে ঢোকানো গেছে [ কিছু কিছু-সবাইকে পারা যায় নি]-আমেরিকাতে আজকাল সি ই ও রা হামেশাই জেলে যাচ্ছে দুর্নীতির জন্য।
গণতন্ত্র কোন পরম সিস্টেম না-এটা একটা রাজনৈতিক সিস্টেম যার ক্রমাগত বিবর্তন হচ্ছে। গণতন্ত্র মার্কসবাদ বা কোন বাদি সিস্টেম না-এটা সময়ের সাথে পরিবর্তিত একটা পরীক্ষাগার। যার বিবর্তন চলতেই থাকবে। এবং সেই বিবর্তন জনগনের দাবী মেনেই হবে-দেরী হলেও হবে।
কেও যদি গণতান্ত্রিক সমাজকে বিবর্তনের এঙ্গলে না দেখে, আমেরিকান গণতন্ত্রর সাথে কমিনিউজমের তুলনা করা শুরু করে ( কমিনিউজম একটি রাজনৈতিক সিস্টেম যা এবসলিউটিজমের ওপর দাঁড়িয়ে) , সেটা অবশ্যই প্রমান করে রাজনৈতিক দর্শনের লেখকের নুন্যতম প্রাথমিক ধারনা টুকুও নেই।
অন্য দেশে আমেরিকার অপরাধ দীর্ঘ। আর সেই অপরাধ সবার আগে স্বীকার করে আমেরিকান জনগন। কোন রাজনৈতিক সিস্টেম পারফেক্ট হতে পারে না। প্রশ্ন হচ্ছে কোন সিস্টেম আমাদের সুযোগ দিচ্ছে সেটাকে কারেক্ট করার। বিবর্তিত করার। এটা না বুঝলে, এই তর্ক অর্থহীন।
@অজিত কুমার রায়,
অশোক বাবু আমার লেখা নিয়ে উনার নিজস্ব সমালোচনামূলক অভিমত দিয়েছেন (এবং সেটা আমি হৃষ্টচিত্তেই গ্রহণ করেছি, যদিও উনার অভিমতের সাথে আমি একমত নই), কিন্তু তার সূত্র ধরে আপনি বিপরীত পক্ষকে যেভাবে ‘আমেরিকান গণতন্ত্র দেখে যারা মুগ্ধ’, ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক’ ইত্যকার বিশেষণে বিশেষিত করে ‘চিপ শট’ নেয়ার চেষ্টা করছেন তা রীতিমত হাস্যকর। আপনার মন্তব্য অনেকটা ভূতপূর্ব মার্কিন রাষ্ট্রপতি বুশের মতোই – ‘আইদার উইথ মি, অর উইথ দেম’। হয় বুশের পক্ষে, নইলে আল-কায়দার। কেন, আমার তো অধিকার আছে কারো পক্ষেই না থাকার, নেই কি? একই ভাবে, যেকেউ একই সাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী এবং মার্ক্সবাদের সমালোচক দুটোই হতে পারেন। আমার অধিকার যেমন আছে মার্কিন বোমা হামলার বিরোধিতা করার, ঠিক তেমনি অধিকার আছে স্ট্যালিন-পলপটদের মতো স্বৈরশাসকদের কুকীর্তি আর নৃশংসতার বিরোধী হবারও। এই সহজ ব্যাপারটাই বোধ হয় বাংলা ব্লগগুলোতে বোধগম্য নয়। এখানে আওয়ামীলীগের সমালোচনা করলেই হয়ে যায় বিএনপির দালাল, বিএনপির সমালোচনা করলেই হয়ে যায় আওয়ামী-বাকশালী, ইসলামের সমালোচনা করলেই হয়ে যায় হিন্দুত্ববাদি, … এগুলো আমি দিনের পর দিন দেখে এসেছি। এগুলো কোন যুক্তি নয়, বরং আসলে ‘ফ্যালাসি অব বাইফারকেশন’- এর উদাহরণ।
@অভিজিৎ,
মনে হয় এই কথাটা সারা বাংলাদেশের বেলাতেও খাটে ( হয়ত ওপার বাংলাতেও!)! সংখ্যাগুরু চুড়ান্ত বাদীদের এই দেশে মত প্রকাশের অধিকার আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়!
মত প্রকাশ করতে যান,এক পক্ষের কাছে ফুলের মালা এবং অন্য পক্ষের কাছ থেকে জুতার মালা জুটে যাবে!
যদি মতামত দুপক্ষেরই বিরুদ্ধে যায়, তবে কপালে ঝাঁটার বাড়ি!এই দেশে এইসব খুবই সাধারন ঘটনা বলেই জানি 🙂
খুবই সত্য একটা কথা! যদিও বিএনপির চেয়ে আওয়ামীলীগের সমর্থকদের বেশি নামাজ পড়তে দেখেছি! তাঁরা বেশি নামাজ পড়ে থাকেন ধর্ম ভক্তি থেকে, নাকি মুরতাদ বদনাম এড়াতে, সেটা বোধগম্য হয়নি আমার কাছে কোনদিন!!
অশোক বাবুর লেখাটি পড়লাম। অধিকাংশ বাঙালী মার্কসবাদির যা সমস্যা উনার সমস্যাও তাই!
মার্কসবাদ এবং তার ওপর হওয়া সমস্ত্ ক্রিটিক্যাল এসেসমেন্ট বুঝতে প্রথাগত দর্শনে জ্ঞান থাকা বিশেষ জরুরী। এটা না থাকলে মার্কস নিয়ে অন্ধের হস্তি দর্শন অব্যাহত থাকবে।
ইতিহাসটা সংক্ষেপে এই। স্যার পপার মার্কসবাদ নিয়েই গবেষনা শুরু করেছিলেন তার পি এই চ ডি থিসিসে। উনিও বলছেন না মার্কস প্রথম দিকে বিজ্ঞানের নীতি অনুসরন করেন নি। উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সামাজিক বিবর্তনের সম্পর্ক স্যার পপার ও অস্বীকার করেন নি। আমি ও করছি না। কেও ই করেন না।
সমস্যা হয় মার্কসের নিজেই বিবর্তিত হতে থাকেন। এবং একটা সময়ে এসে উনি এবং এঙ্গেলেস ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে ঐতিহাসিক সত্য বা বৈজ্ঞানিক সত্য হিসাবে চালাতে থাকেন। যা কমিনিউজমের ভিত্তিভূমিও বটে। এটা প্রয়োগ জনিত ভুল না-দার্শনিক দিক দিয়েই ভুল। ওই ভাবে সমাজে ভবিষয়ত কি হবে, তা কেও কোন দিন কোন বৈজ্ঞানিক সূত্রের মাধ্যমে বলতে পারে না। তাহলে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সামাজিক সিস্টেমটা আর জটিল সিস্টেম থাকবে না!! আর এটা বা এই হিস্টোরিসিজম ঠিক না হলে, কমিনিউজমের ভিত্তি বলতেই আর কিছু থাকে না।
উনি যে ভুলগুলি করেছেন, তা বাঙালী মার্কসবাদি মাত্রই করে। ইনাদের ভুল চিন্তার তথ্য তালিকা বহুদিন আগে আমি মুক্তমনাতেই দিয়েছিলাম। এই লেখাটি তার ব্যতিক্রম না।
এতে এটাই বুঝলাম, লেখক মার্কস বা লেনিনের ক্রিটিক্যাল এসেসমেন্ট করতে, যে কষ্ট করার দরকার করেন নি। চটি বই এ ভরসা রেখেছেন। একটু চোখকান খোলা রাখেল জানতেন ১৯৩০ সালের আগেই মর্গানের নৃতত্ত্ব বাতিল করে নৃতাত্ত্বিকরা। আসলে ইন্টারনেটের প্রবেশের পূর্বে অধিকাংশ বাঙালীর চোখ খোলা সম্ভব হত না। এখন একটু নেট ঘাঁটালেই এসব বেসিক তথ্য জানা যায়।
মর্গান আমেরিকান এন্থ্রওপলজির জনক। যে বইটা পড়ে মার্কস অনুপ্রাণিত হোন তার তাম এন্সিয়েন্ট সোসাইটি। তার কিছুটা অংশ স্বীকৃত হলেও অধিকাংশটাই বাতিল। বৃটানিকা কি বলছে দেখুন [এছারাও ইন্টারনেটে নৃতত্ত্বের অনেক আর্কাইভ আছে] Morgan’s ideas about the development of technology over time have come to be regarded as generally correct in their fundamental aspects. His theory that human social life advanced from an initial stage of promiscuity through various forms of family life that culminated in monogamy has long been held obsolete, however.
http://www.britannica.com/EBchecked/topic/392246/Lewis-Henry-Morgan
এখানে লেখক আবার ভুল করছেন। ইস্যুটা হচ্ছে উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর সাধারন লোকের “ক্ষমতায়ন”।
আর লেখকের ভুল দুটো। যা গোটা লেখাটা জুরেই বিদ্যমান।
১) গণতন্ত্র বা ধনতন্ত্র-এগুলি সব সামাজিক বিবর্তনের ফল-এবং এই সিস্টেম গুলি স্টান্ডার্ড কিছু না। এগুলোও বিবর্তিত হচ্ছে। প্রশ্ন উঠবে বিবর্তনের মুখ কোন দিকে?
২) “শ্রেনীর” বা ক্লাসের ধারনা আস্তে আস্তে ভেঙে যাচ্ছে না আগের মতন আছে।
আমি তিন বছর আগে কাউন্সিল কম্যুনিজম নিয়ে লিখেছিলাম। এই নিয়ে গুরুচন্ডালি ফোরামে দীর্ঘ বিতর্ক হয় এবং যার মুল বক্তব্য ছিল
১) উৎপাদন ব্যবস্থার বিবর্তনে, সাধারন মানুষের কাছে উৎপাদনের ক্ষমতা কখন আসে? এই উত্তর মার্কস এর লেখা এবং বিবর্তন মেনে নিতে গেলে [ যা বৈজ্ঞানিক সত্য ও বটে] ,এটা তখন ই হবে, যখন, সেই উৎপাদন ব্যবস্থা এক মালিকানা ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার থেকে অনেক বেশী এফিশিয়েন্ট এবং ইনোভেটিভ হবে।
২) সোভিয়েত ইউনিয়ানে, বা চীনে সরকারের হাতে উৎপাদন ক্ষমতা যাওয়ার জন্য জনগনের হাতে উৎপাদন গেছে কি না। এর উত্তর সহজ। যায় নি। সোভিয়েত ইউনিয়ান বা চীনে যেটা হয়েছে, সেটাকে বলে স্টেট ক্যাপিটালিজম। এটা কোন মার্কসীয় তত্ত্ব ত নই- বরং সম্পূর্ন বিকৃত একটি দক্ষিনপন্থী, ফাসিস্ট মতাদর্শ ঃ http://en.wikipedia.org/wiki/State_capitalism
বরং আসুন (১) এর ওপর আমরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করি।
আমেরিকাতে কি দেখছি আমরা?
১) স্টার্টাপ গুলি নতুন প্রযুক্তি আনছে এবং সেখানে দক্ষ কর্মীরা মিলিয়নার হচ্ছে-কারান তারাও পুজিপতি দের সাথে কোম্পানীর মালিক। এরা পুরাতন পুঁজিপতিদের চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। একটা ক্লাসিক কেস হল, মিলিনিয়াম কপিরাইট আইন। যেখানে গুগুল এবং ফেসবুক ডিজনি এবং অন্য মিডিয় কোম্পানীকে বাধ্য করে আমেরিকান কংগ্রেসে ওই আইন না মানতে। এক্ষেত্র গুগুলের ভূমিকা ছিল জনগনের পক্ষে-কারন তাতেই ছিল তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ।
২) ক্রেডিট ক্লাব, ক্রেডিট ইউনিয়ান গুলি, যা কোয়াপরেটিভ-তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। প্রথাগত ব্যাঙ্কিং লসে চলতে চলতে ছোট হচ্ছে।
৩) প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যেখানে সম্ভব ওপেন সোর্স আসছে। এতে আই বি এম বা মাইক্রোসফটের আকাধিপত্য ভেঙে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে জনগন প্রযুক্তির আই পির মালিক হচ্ছে।
৪) আস্তে আস্তে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের ডিমান্ড বারছে। এম পি, কংগ্রেসমান রা যে বানিজ্যিক ক্রনি এটা সবাই বুঝছে। ভারত এবং আমেরিকাতে আস্তে আস্তে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের ডিম্যান্ড আরো বাড়ছে।
মনে রাখতে হবে আমরা একটা বিবর্তনের মধ্যে আছি। আস্তে আস্তে উৎপাদন ব্যবস্থায় এই সব ছোট ছোট পরিবর্তনগুলি, আরো বেশী জনগনের মধ্যে উৎপাদন ব্যবস্থার মালিকানা ছড়িয়ে দেবে। বিবর্তনের নিয়ম মেনেই। এবং আমার মতে সেটাতে মার্কসবাদ ব্য্ররথ না, সফল হয়। কমিউনিস্ট স্টেটের সাথে মার্কসবাদের কোন সম্পর্ক নেই।
আর চীন এবং কাম্বোডিয়ার জেনোসাইডের সমর্থনে লেখক যা লিখেছেন, সেটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। পলপটের সাফাই গাইতে পারে কেও, এটা আমার কল্পনার বাইরে। লেখকের কাছে জানতে ইচ্ছাকরে, খেমের রুজের আমলে হওয়া গণকবরগুলি, যা উদ্ধার কর্তা আরেক কমিউনিস্ট দেশ ভিয়েত নাম-তাও সব অপপ্রচার? লোকে ইচ্ছা করে গণ কবরে গিয়েছিল??
আর চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব যে ভুল ছিল্, সেটা ত চীনের কমিনিউস্ট পার্টিই প্রকারান্তরের স্বীকার করে নিয়েছে!! আমি আর কি বলব :lotpot:
এগুলো নিয়ে তর্ক করাও হাস্যকর। কমিউজমের ক্রাইমের দীর্ঘ তালিকা আমি বহুদিন আগেই ব্লগে লিখেছি।
আর ভারতের সাথে তুলনা যদি আসে, তাহলে এটাই বলতে হয়, ভারতের ব্যার্থতা যদিও গণতান্ত্রিক শাসনের কারনে হয় তা শ্রেয়। কারন গণতন্ত্রে সেই কাঠামোটা বদলানোর সুযোগ থাকে। গণতন্ত্রে কোন কিছুই শেষ কথা নয়। দেশের লোক তা বদলাবে। হয়ত আস্তে আস্তে হবে।
লেখক ইন্টারনেটে সবে পদার্পন করেছেন। ২০০৭-৮ সালে প্রচুর বাঙালী কমিনিউস্ট, সব তরুনের দল, সবে সবে ইন্টারনেটে এসে আমার সাথে বহু তর্ক করেছেন। ক্রমশ তারা যত ইন্টারনেটে নানান তথ্য জেনেছেন, বিচার করেছে, তাদের অধিকাংশই নিজেদের ভুল বুঝেছেন্। তারা বামই আছেন, কিন্ত কমিনিউস্ট নামে এক ফাসিজমের দালালি আর তারা করেন না। লেখক যত ইন্টারনেটে পড়াশোনা বাড়াবেন, তিনিও সেই দিকেই বিবর্তিত হবেন।
@বিপ্লব পাল,
১. আপনি কার্ল পপার সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়েছেন। পপারের Ph. D. থিসিসের শিরোনাম ছিলঃ “QUESTION OF METHOD IN COGNITIVE PSYCHOLOGY”. নেটে খুঁজলেও পাবেন। 😛
২. অশোকবাবুর প্রবন্ধটা আকারে বড় হলেও টানা পড়ে ফেলা যায়; আমি অন্তত তাই-ই করেছি। আপনাকেও মন্তব্য করতে হলে একটু কষ্ট করে পড়ে নিতে হবে। তাহলে দেখবেন আপনি যা যা বলেছেন, সেই কথাগুলকে অনার প্রবন্ধে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট যুক্তি আর তথ্য সমেত ছেঁচে দেওয়া হয়েছে। ফলে, আপনার মন্তব্যগুলোকে ঠিক অবোধ শিশুর সারাদিনব্যাপী একই বায়না করে যাওয়ার মতো শোনাচ্ছে। :lotpot:
৩. আপনি কতজন আমেরিকানকে আধুনিক পুঁজির দক্ষতায় মিলিয়নেয়ার হতে দেখেছেন বলেননি। আমেরিকানরা নিজেরা বলছে যে তাদের শতকরা পাঁচভাগ লোক, অবদারিদ্র্যসীমায় বাস করে আর আশিভাগ লোক, দারিদ্র্যসীমার অভিকর্ষে রয়েছেঃ http://politicalblindspot.com/us-poor/ আর http://politicalblindspot.com/shocking-study-4-out-of-5-in-usa-face-near-poverty-and-unemployment/। 🙂
8. চীনের দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে প্রচলিত গুজবের উৎস অমর্ত্য সেন। অশোকবাবু সেই অমর্তয় সেন থেকেই তথ্য দিয়ে (via Chomsky) গুজবটা থেকে ডালপালা ছেঁটে দিয়েছেন। এটা যদি আপনি না বুঝে থাকেন, তবে এসব আলোচনা থেকে আপনার অবসর গ্রহণ করা উচিত। 😉
@অনর্ঘ,
পপার মার্কস নিয়ে পি এইচ ডি শুরু করেছিলেন এবং নিজে একজন সোশালিস্ট কর্মীও ছিলেন।
In 1919, Popper became attracted by Marxism and subsequently joined the Association of Socialist School Students. He also became a member of the Social Democratic Workers’ Party of Austria, which was at that time a party that fully adopted the Marxist ideology.[15] After the June 15, 1919 street battle in the Hörlgasse, when police shot eight of his unarmed party comrades, he became disillusioned by what he saw to be the pseudo-scientific
http://en.wikipedia.org/wiki/Karl_Popper
মার্কসীয় মেথড মনঃস্তত্বে লাগানো যায় কি না, সেটা নিয়েই তার কাজ শুরু হয়। কারন উনি ফ্রয়েডিয় বিশ্লেষনে বিশ্বাসী ছিলেন না। পপার নিয়ে না পড়াশোনা করে মন্তব্য করলে, আমি আর কি করতে পারি :guru: ।
আমি আবার লিখছি, মার্কসীয় দর্শন না বুঝে, এই ধরনের তথ্য ঘাঁটলে ঘেঁটো ঘোলা জল ছারা কিছু বেড়বে না। বিশ্লেষনের অভিমূখ থাকা উচিত শ্রমিকের হাতে, উৎপাদকের হাতে উৎপাদনের মালিকানা যাচ্ছে কি না। কারন মার্কসবাদের মূল সেখানেই নিহিত। মার্কসবাদ নিয়ে এই সামান্য দার্শনিক জ্ঞান টুকু না থাকলে তর্ক করা বৃথা।
চীনের দুর্ভিজ্ঞ গুজব! তার উৎস অমর্ত্য সেন!! মশাই এটা আমার কাছে খবর!!! নেহাত লেখক বলেন নি, গ্যাং অব ফোর কেও অমর্ত্যসেনের রেকোমেন্ডেশনে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
পৃথিবীতে অনেক গবেষক আছে, ইন্সটিউট আছেন যারা জেনোসাইড নিয়ে গবেষনা করেন। এই লিঙ্ককে, কিছু কিছু রিসোর্স আছে চিনের জেনোসাইডের ব্যাপারে।
আর এটা যে প্রচলিত গুজব সেটাও জানতাম না (H) শুধু এটাই লিখব অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ হয় না
@বিপ্লব পাল,
বিপ্লববাবু, আপনার দেওয়া উদ্ধৃতি কিংবা উইকিলিঙ্ক, কোথাও পপারের মার্ক্সবাদ নিয়ে গবেষণার তথ্য নেই। অন্য সূত্র থেকে পেয়ে থাকলে জানান। তা না হলে বুঝতে হবে, এই গবেষণাটা আপনারই। পপারের নয়। আমরা দর্শনের ছাত্ররা পপার নিয়ে চটজলদি তথ্যের দরকার হলেই উইকিপিডিয়ার ওই পেজটা খুলে বসি। আপনার মন্তব্যের উপরে মন্তব্য করার আগেও ওটা আর একবার দেখে নিয়েছিলাম। আপনি লিঙ্কটা দেবার পর আবার পড়লাম। না না না। পপার মনস্তত্ত্বের গবেষণায় মার্ক্সবাদকে কাজে লাগানো বা বিরোধিতা করা সংক্রান্ত কোনও খবরই সেখানে নেই। পপারের আত্মজীবনীতেও তথ্যটা পেলাম না। আপনার বিস্তর পপার-পড়াশুনার মধ্যে কিছু একটা ভেজাল ঢুকে গেছে বলে ভয় পাচ্ছি।
:-O
আর একটা প্রশ্ন জিগ্যেস করতে ইচ্ছা করছে। আমেরিকার শ্রমিকরা উৎপাদনের শেয়ার টেয়ার কিনেও কি ডিভিডেন্ড পাচ্ছে না? নইলে শতকরা আশি ভাগ আমেরিকান কীভাবে দারিদ্র্যসীমার কাছে ঘুরঘুর করছে? নাকি আমার এই তথ্যটা ভুল? অথবা লিঙ্কে ভুল তথ্য দিয়েছে? দয়া করে এটা জানাবেন। আপনি বড্ড “কী খাচ্ছ জিগ্যেস করলে বৃষ্টি পড়ছে”-জাতীয় উত্তর দেন। আমাদের মতো কম পড়াশুনা করা ছাত্রদের বুঝতে অসুবিধা হয়।
😕
বাকিগুলো নিয়ে পরে আবার বসা যাবে।
ভালো থাকবেন।
🙂
@অনর্ঘ,
পপারের Conjectures and Refutations (1963) বইয়ে পাবেন মার্ক্সবাদের উপরে উনার পর্যবেক্ষণ , যেমন :
“A Marxist could not open a newspaper without finding on every page confirming evidence for his interpretation of history; not only in the news, but also in its presentation — which revealed the class bias of the paper — and especially of course what the paper did not say. ”
http://www.stephenjaygould.org/ctrl/popper_falsification.html
@সংশপ্তক,
সংশপ্তকবাবু,
আমি জানতে চেয়েছিলাম যে পপারের Ph. D. থিসিসের কাজ মার্ক্সবাদ নিয়ে শুরু করেছিলেন – এই তথ্য বিপ্লববাবু কোথায় পেয়েছেন। উনি আমার মুল মন্তব্যের জবাবে পপার নিয়ে পড়াশোনার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং একটি উধৃতি আর একটি লিঙ্ক দিয়েছিলেন। আমি আমার দ্বিতীয় মন্তব্যে দেখালাম যে ঐ উধৃতি আর লিঙ্কে ঐ তথ্য নেই। আমি আবার তাঁর তথ্যের উৎস জানতে চাইলাম, কিন্তু তিনি এখনো মৌনী হয়ে আছেন, হয়ত খুঁজে চলেছেন, হাত ফস্কে লিখে ফেলা সে তথ্যটি। এখন আপনি এই লিঙ্ক এবং এই তথ্য দিয়ে যা শোনালেন, তাতে আমার প্রথম বিবৃতিটিই সত্য বলে প্রমাণিত হল। এবং বিপ্লব পালের যে প্রথম জবাবী মন্তব্যঃ “স্যার পপার মার্কসবাদ নিয়েই গবেষনা শুরু করেছিলেন তার পি এই চ ডি থিসিসে” – এই উক্তিটি তিনি কিছু না জেনেই করে বসেছিলেন। পপার থেকে উনি মার্ক্সবাদ বিরোধী অনেক সূত্র নিয়েছেন। হয়ত সেই কারণেই ভেবেছেন যে পপার মার্ক্সবাদ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন। এখন আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পেয়ে “কী খাচ্ছ জিগ্যেস করলে বৃষ্টি পড়ছে” – জাতীয় উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন। আপনিও কি সেই দায় বহন করছেন?????
@অনর্ঘ,
আমাদের উচিৎ যথাসম্ভব মূল আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখা । কার্ল পপার ঠিক কখন মার্ক্সবাদ নিয়ে গবেষণা করেছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয় – উনি মার্ক্সবাদ নিয়ে আদৌ গবেষণা করেছেন কি না সেটাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং মার্ক্সবাদ নিয়ে পপারের বিস্তর গবেষণা আছে যেখানে মার্ক্সবাদের সমালোচনা করা হয়েছে। এখন সেই সকল গবেষণা নিয়ে এখানে আলোচনা হতে পারে প্রাসঙ্গিকতার স্বার্থে , যদিও অজ্ঞাত কারণে এই প্রবন্ধের লেখক অশোক বাবু প্রথম থেকেই আলোচনায় অনুপস্থিত। আমরা আশা করবো যে, উনি অন্তত উনার অপারগতার কথা একটি মন্তব্য দিয়ে জানাবেন।
কার্ল মার্ক্সের নিন্দুকেরা বলেন- Though he was proud of his scientific method, most of Marx’ predictions are like Jewish prophecies and Christian revelations, inspiring, sometimes self-fulfilling, certainly true for the faithful, but not testable by scientific means.
তবু লেখক যখন আশা দিচ্ছেন-
তাই লেখকের কাছে সবিনয়ে জানতে চাই- “historical change” আর “economic change” বলতে কী বুঝায় এবং এ দুয়ের মধ্যে সম্পর্কটা কী, যদি থেকে থাকে?
আর “economic laws of motion.” বলতে মার্ক্স কী বুঝাতে চেয়েছেন?
অশোক মুখোপাধ্যায়, মুক্তমনায় স্বাগতম। অতিকায় লেখা, তবুও পড়ে শেষ করেছি। আমি বিতর্কে না গিয়ে অশোক বাবুকে একটা প্রশ্ন করতে চাই, আমার মাথায় ব্যপারটা অনেকদিন থেকেই ঘুড়ছে, কিন্তু বালখিল্য ব্যাপার কিনা সে সন্দেহ থেকে আর জিজ্ঞ্যেস করা হয়নি। সেরকম হলে ক্ষমা করবেন। জানতে চাইবার জন্যেই প্রশ্ন। ডারুইনীয় তত্ত্বের আলোকে সামাজিক বিবর্তনবাদ আর মার্কসীয় বিবর্তনবাদের মধ্যে কি কোন দ্বন্দ্ব আছে? নাকি উভয়কেই একই ধরে নেয়া চলে? আমি প্রাইমেটদের কাল থেকেই বিষয়টা বুঝতে চাইছি।
যা বলতে চেয়েছিলাম তার অনেকটাই উপরে ‘দেব’ বলে দিয়েছেন। লেখাটার শুরু দেখে যা ভেবেছিলাম বা আশা করেছিলাম ( যৌক্তিক নিরপেক্ষ আলোচনা) তা মোটেই পাইনি। এই লেখা দিয়ে কি প্রমাণ করতে পারলেন ‘মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান’? ধর্মবাদী মোল্লা-পুরোহিতদের মত অকারণে ইতিহাস কেচ্ছা কাহিনি টেনেছেন আর কিছু মনের ঝাল মেটাতে গিয়ে ব্যক্তি আক্রমন ও অর্থহীন খোঁচাখুচি করেছেন।
তাহলে দুনিয়ার সকল ধর্মগ্রন্থগুলো কী দোষ করলো? ‘মনে হচ্ছে’, ‘হতে পারে’, ‘সম্ভাবনা আছে’, তারপর যা হবার ছিল তা হলোনা মেঘে ভাসিয়ে নিয়ে গেল, এটাও বিজ্ঞান?
যাক মুক্তমনায় স্বাগতম। অভিজিৎকে ধরাশায়ী করার চিন্তা বাদ দিয়ে বরং মার্ক্সবাদকে বিজ্ঞান প্রমাণ করুন, অভিজিৎকে আমরা পাঠকেরাই বর্জন করবো।
হ্যাঁ আরেকটু যোগ করি। মার্ক্সবাদ বিজ্ঞানের আওতার মধ্যে আসে না আর সেইজন্যই মার্ক্সবাদ ‘অবৈজ্ঞানিক’ এই কথাটাও অর্থহীন। আর মার্ক্সবাদ বৈজ্ঞানিক দর্শন নয় কথাটার মানে এই দাঁড়ায় না যে মার্ক্সবাদ ভ্রান্ত। কিন্তু সে বিচারটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে করতে যাওয়াটা ছায়ার সাথে লড়াই। অর্থনীতি, ইতিহাস এবং সমাজবিজ্ঞানের মত বিষয়গুলিতে যেভাবে কোন তত্ত্বের ঠিক ভুল বিচার হয় এটার ক্ষেত্রেও তাই হওয়া উচিত।
মার্ক্সবাদ অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও দর্শনের মিলে তৈরী। তার ঠিক ভুল নিয়ে আলোচনা হোক। কিন্তু সেটাকে বিজ্ঞানের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন? বিজ্ঞান মানে আমি ন্যাচারাল সায়েন্সের কথা বলছি, শুধু ‘বিশেষ জ্ঞান নয়’। ‘বৈজ্ঞানিক মতবাদ’ কথাটার মানে কি? এটাতো হার্ড সায়েন্স নয়।
হ্যাঁ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যেসব ব্যাপারগুলো আসে, যেমন যুক্তি, প্রমাণ, পরীক্ষা সেগুলো আপাত ভাবে বিজ্ঞানের বাইরে অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োগ হয়। সেটা শুধু মার্ক্সবাদ নয়, ফেমিনিজম, অর্থনীতি বা শেয়ার মার্কেট অ্যানালিসিসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এগুলো কোনটাই স্ট্রিক্টলি বিজ্ঞান নয়। এগুলো নন-সায়েন্স। তাতে এগুলোর গুরুত্ব/দুর্বলতা কিছু কমে না। বিজ্ঞানে আওতায় মানবজাতির সমগ্র কার্যকলাপ সিম্পলি আসে না। জোর করে ঢোকানোর প্রয়োজনও নেই।
মার্ক্সবাদের যুক্তি, প্রয়োগ, ইতিহাস সব কিছু নিয়ে আলোচনা হোক। স্বাগত। কিন্তু মার্ক্সবাদ ‘বিজ্ঞান’ (ইন দি টেকনিক্যাল সেন্স) এই বায়বীয় দাবীটির পেছনে না ছুটলেই ভাল হয়।
বিশাল লেখা!! মার্ক্সবাদ সমস্যা নয় – সমস্যা হল এই তত্ত্বে মানুষকে ইউটোপিয়ান চরিত্র কল্পনা করা হয়েছে। “গণতন্ত্র রক্ষা” র নামে যেমন অনেক সামরিক হুন্তা জোর করে ক্ষেমতা দখল করে মিথ্যার ফুলঝুরিতে গোয়েবেলস কেও লজ্জায় ফেলে দেয় তেমনি এই “মার্কসবাদ” বাদও কুয়াসি সামরিক সিভিলিয়ান ডেমাগোগ অটোক্রেট দের ক্ষেমতা দখলের অন্যতম হাতিয়ার। আর যারা এমন করছেনা তারা আসলে কেউই বাস্তবে মার্ক্সবাদে নাই।
রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, মইনুদ্দিন খান বাদল, দিলিপ বড়ুয়া, মতিয়া চৌধুরী, আসম আব্দুর রব, কর্ণেল তাহের, সিরাজ সিকদার…… ইত্যাদি ইত্যাদি
রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, মইনুদ্দিন খান বাদল, দিলিপ বড়ুয়া, মতিয়া চৌধুরী, আসম আব্দুর রব, কর্ণেল তাহের এসব ভুয়া সসমাজতান্ত্রিক দের সাথে সিরাজ সিকদার এর ন্যায় একজন অসাধারণ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মানুষের মিল করে ফেলে আপনি আপনার অজ্ঞতার ই পরিচয় দিলেন।