সেই আদিকাল থেকে নর-নারীর সম্পর্ককে যতই রহস্যের চাদরে ঢেকে রাখার একটা প্রবনতা থাকনা কেন, এখন এই আধুনিক যুগে এসে তা বোধহয় আর পারা যাচ্ছে না । এখন এমন একটা যুগের ভিতর দিয়ে আমাদের যাত্রা, যখন তথ্য ও জ্ঞানের মহাসড়ক হাতের খুবই কাছে, ইচ্ছে করলেই সড়কে ঢুকে পড়া যায়। এখন মানুষ অনেক বেশী জ্ঞান, বিজ্ঞান যুক্তির মাধ্যমে, কি, কিভাবে ও কেন বোধক প্রশ্নের দ্বারা প্রায় সব বিষয়ে সত্যের কাছাকাছি যেতে চায়। বর্তমান মানুষের এই প্রবনতা থেকে নর-নারীর রহস্যময় সম্পর্কের বিষয়টিও রেহাই পাবে না। এটা অবশ্যই একটা ইতিবাচক প্রবনতা। অত্যাধুনিক পরীক্ষাগারে, তীব্র আলোতে ফেলে, মানুষের দেহ ও মন উভয়কে ব্যাবচ্ছেদের মাধ্যমে মূল সত্যের কাছাকাছি যাবার চেষ্টা চলছে। এই সম্পর্কের রহস্যটা আসলে কোনখানে। কোন্ সে যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক অসম্পূর্নতার কারনে এই সম্পর্কটাকে নিয়ে ভাববাদীদের এত বেশী লম্ফ ঝম্ফ। বাড়াবাড়ি যাই হোক, সবকিছুর পেছনে একটা যথার্থ কারন থাকে- এই কার্য-কারন ত্বত্তটা এখনও পর্যন্ত বেশ জনপ্রিয়। অপরাপর কারনগুলি বাদ দিয়ে নর-নারী সম্পর্কিত জীববৈজ্ঞানিক কিছু কারন অনুসন্ধান করা যেতে পারে।
প্রকৃতির বিশেষ প্রয়োজনে একটা অভিন্ন জীব অস্তিত্তের মধ্য হতে নর ও নারী নামে দুটো ভিন্ন লৈঙ্গিক পরিচয়ের মানব সৃষ্টি হয়েছিল জীবনের সৃষ্টি ও বিবর্তনের ধারাবাহিকতায়। প্রকৃতির এই বিশেষ প্রয়োজনটা যে জীবন তথা প্রজাতির নিরবিচ্ছিন্নতাকে নিশ্চত করা সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। প্রজাতিকে রক্ষা করতে গেলে লাগে প্রজনন। জীবনের ঘটমানতা নিশ্চিত করতে প্রকৃতি তাই যৌন এবং অযৌন উভয় প্রকৃয়াকে জীবের মধ্যে সন্নিবেশিত করল। মানব জাতিতে অযৌন প্রকৃয়া কৃত্রিম হলেও যৌন প্রজনন প্রাকৃতিক, সহজসাধ্য, কাঙ্খিত এবং রহস্যময়। যৌন প্রকৃয়ার জন্য প্রয়োজন পড়লো দুটো ভিন্ন আঙ্গিকের জননাংগ। প্রকৃতি তাই নারী পুরুষের সকল স্বাধীন অঙ্গ-ব্যাবস্থা যেমন- পরিপাকতন্ত্র, শ্বষনতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র, রেচনতন্ত্র, প্রভৃতিকে হুবহু এক রেখে, শুধু পরিবর্তন ঘটালো প্রজননতন্ত্রের । ভিন্ন দুই ধারার প্রজনন অবকাঠামো তৈরী হলো। দুটো ভিন্ন প্রকৃতির অনুবীজ ওভাম ও স্পারমেটোজোয়াকে একত্রে মিলিয়ে জীবনের প্রারম্ভিক ভিত্তি ভ্রুন তৈরী করতে যে সমস্ত মনোদৈহিক পরিবর্তন ঘটানো দরকার তার সবকিছু করা হলো নিখুত নৈপুন্যে। জননতন্ত্রের ভিন্নতা সত্তেও তাদের কাঠামোগত ও উদ্দেশ্যগত সাদৃশ্য খুবই চোখে পড়ে। যেমন, নারীতে দুই ওভারি ওভাম তৈরিতে নিয়োজিত, পুরুষে দুটি টেস্টিকল স্পার্ম বানিয়ে চলে। আরও তুলনা করা যায় শুক্রবাহী ভাসডিফারেন্স এবং ডিম্ববাহী ফেলোপিয়ান নালীর মধ্যে । এছাড়া আরও অনেক গাঠনিক বৈশিষ্ট বিশ্লষন করলে দেখা যাবে, কোন এক অভিন্ন অবস্থা থেকে বিবর্তিত হয়ে অঙ্গ-ব্যাবস্থা দুটি একই উদ্দেশ্য সাধনে কিঞ্চিত ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করেছে। কি সেই অভিন্ন অবস্থা? সৃষ্টির সুদুর অতীতে জীবের এককোষীয় অস্তিত্বই সেই অভিন্ন অবস্থা, যখন সেই এককোষী দেহে কোন লৈঙ্গিক চিহ্ন ছিল না, অথচ আজ বিবর্তনের দীর্ঘ পথ ধরে ধরে আমরা নারী, পুরুষ, অথবা উভলৈঙ্গিক। অবশ্য আমাদের উভলৈঙ্গিক অস্তিত্তটি এখনও প্রকৃতির পরিক্ষাগারে পর্যবেক্ষন ও নিবীড় নীরিক্ষায় ছাড়পত্রের জন্য অপেক্ষমান। যোগ্যতমের প্রতিযোগীতায়, প্রাকৃতিক নির্বাচনে টিকে গেলেই আমরা তাদের কোলে তুলে নিতে পারবো। যাইহোক, শুধু দুটি ভিন্ন অবকাঠামো তৈরী করে রাখলেই যে মানুষ তাতে উপগত হবে, এমন সহজ প্রানী সে নয়। তার জন্যে প্রকৃতি তৈরী করলো হরেক রকম অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিরস, যা মানুষের মন, মনন, ইচ্ছা, চাহিদা, সৌন্দর্যবোধ, কাব্যিকতা, মায়া, মমতা, স্নেহ সবকিছু মিলিয়ে এক বিশেষ প্রকৃতির ক্ষুধা-চাহিদা তৈরী করে, যার নাম কামানুভুতি বা কাম। অনেকটা খাবারের ক্ষুধার মত, তবে উভয়ের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্পুর্ন ভিন্ন। খাবারের ক্ষুধা যতটা যান্ত্রিক, কাম মোটেই তা নয় । কামের সংগে অঙ্গাংগীভাবে জড়িয়ে আছে মানুষের সুক্ষ থেকে স্থুল সকল মাত্রার শারীরিক ও মানষিক বোধ ও অনুভুতি।
মানুষের মধ্যে সবসময় ভিন্ন বেক্তিত্ব ও মানষিক গঠন বিদ্যমান । বাহ্যিক বা অন্তরগত যে কোন বিষয়ে সব মানুষ ভিন্ন আঙ্গিকে বা প্যাটার্নে চিন্তা করে থাকে। অন্তঃক্ষরা রাসায়নিক পদার্থ সমূহ মৌলিক বা মিশ্র আবেগ সমূহ নিয়ন্ত্রন করলেও একই প্রকৃতির ভিজুয়ালাইজেশন বা চিন্তার মধ্য দিয়ে সব মানুষের ক্ষত্রে কামানুভুতির চুড়ান্ত বাসনা বা মিলনাঙ্খায় পৌছাতে পারে না । তবে মূল কথা হলো, পাঁচ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যাকিছু যৌনমাত্রিক অভিজ্ঞতা মানুষ গ্রহন করে, তার সবকিছু মস্তিস্কে প্রকৃয়াজাত হয়ে, বিভিন্ন হরমোনের সাহায্যে একটা বেশ জটিল মনোদৈহিক প্রকৃয়ার মাধমে শরীরে কমানুভুতি জাগাতে সক্ষম হয় । একটা উদাহরনের মাধ্যমে বিষয়টাকে পরিষ্কার করা যেতে পারে : একটা যৌনাবেদনময়ী জীবন্ত নারী মূর্তি দর্শনের পর থেকে তাতে উপগত হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ পথ একটা কবি মন যেভাবে অতিক্রম করবে, একটা নিখাদ শ্রমজীবি মন সেভাবে অতিক্রম করবে না। এই পথটুকুর গাঠনিক বিন্যাশ ভিন্ন চিন্তা-প্যাটার্ন এর মানুষের জন্য ভিন্ন রকম হবে বলে আমার ধারনা । পাত্র ভেদে এই পথ পরিক্রমা যেমন দীর্ঘ হতে পারে, তেমনি সংক্ষিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। অতি স্থুলমাত্রার চিন্তা-প্যাটার্ন যুক্ত মানুষের ক্ষেত্রে এই পথ পরিক্রমা সহজাত প্রবৃত্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং সংক্ষিপ্ত হতে পারে। চিন্তা-প্যাটার্নের ভিন্নতার জন্য যেমন যৌন পথপরিক্রমার প্রকৃতি পরুষে পুরুষে ভিন্ন ভিন্ন হয় তেমনি নারীতে নারীতে তা অবশ্যই ভিন্ন। কাজেই পুরুষে নারীতে এই সেক্স লুকাস ভিন্ন হবে প্রাকৃতিক নিয়মে । যৌনতার জন্য চিন্তা-প্যাটার্ন তৈরীতে উভয় প্রকার লিংগের বেলায়ই তাদের সুগঠিত সামাজিক সত্তা (Social Self) প্রধান ভূমিকা রাখে। তবে বাক্তি সত্তা (Individual Self) ও বস্তু সত্তাও (Material Self) যে কোন ভুমিকা রাখে না তা নয়, তবে তা সামাজিক সত্তা দ্বারা উত্তীর্ন হতে হয়। এটাই স্বাভাবিক, তবে এর ব্যাতিক্রমও রয়েছে। তবে তা একান্তই ব্যাতিক্রম এবং সংখ্যালঘু । এতকিছু বলার যে উদ্দেশ্য তা হলো, নারী ও পুরুষের এই চিন্তা-প্যাটার্নগত বৈচিত্র প্রজাতির প্রজনন উদ্দেশ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তবে তা অন্যসব পার্থিব উদ্দেশ্য সাধনে নারী ও পুরুষের সক্ষমতার সাম্য, জীব সৃষ্টির মৌলিক তত্ত্ব, তথা সুদূর অতীতে মানুষের এককোষীয়, অলৈঙ্গিক পটভূমি ভিত্তিক অভিন্ন একক জীবনকে চ্যালেঞ্জ করে না ।
জৈবরাসায়নিক দৃষ্টিকোন থেকে সংক্ষেপে নর-নারীর অবস্থানটা একটু মূল্যায়ন করতে পারলে মন্দ হতোনা। পুরুষের দেহে যে এস্টোরয়েড এন্ড্রজেন হরমোন তৈরী হয়, তার ভেতরে টেস্টেস্টোরন-টা পরিমানে অনেক বেশী এবং তাই তাকে পুরুষ বানায় । আবার নারী-হরমোন এস্ট্রজেন খুব স্বল্প মাত্রায় পুরুষের দেহে যকৃত ও বৃক্কের এড্রিনাল কর্টেক্সে তৈরী হয়, যা অপ্রতুল হওয়ার জন্য তাকে নারীতে পরিনত করতে পারে না । নারীর ক্ষেত্রে ওভারি থেকে যে এন্ড্রজেন তৈরী হয় তা এনজাইমের মাধ্যমে এস্ট্রজেনে পরিনত হয়, এই নারী-হরমোনই তাকে নারী করে । খুব স্বল্পমাত্রায় নারীদেহে টেস্টেস্টোরন থেকে যায়, যা অন্য কোন বিশেষ কাজ করলেও তাকে পুরুষ বানাতে পারে না । নারী পুরুষ নির্বিশেষে টেস্টেস্টোরন এবং এস্ট্রজেনের উপস্থিতি তাদের জীববৈজ্ঞানিক অভিন্নতাকে স্পস্ট করে তোলে ।
সবার কাছে নর-নারী সম্পর্কটাকে কমবেশী রহস্যময় মনে হয় । এরকম ভাবাটাই বোধ হয় জেনেটিক নির্দেশ। যে জিনিস যত বেশী রহস্যে ঘেরা, তার প্রতি তত বেশী আকর্ষন। আর এই আকর্ষন সৃষ্টি করাই প্রকৃতির মূল অভিলাস। বয়ঃপ্রাপ্তির কিছুসময় আগে বা পরে বালক, বালিকাদের শারীরিক ও মানষিক অবস্থা বিশ্লষন করলে বোঝা যাবে, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষন ও রহস্যময়তা কতখানি তীব্র থাকে। বয়োবৃদ্ধির সংগে সংগে এই আকর্ষন কমতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তা বিরক্তিকর বা অত্যাচেরের মত লাগাও বিচিত্র নয়। তবে অভিজ্ঞতা থেকে একটা জিনিস অনুভব করতে পারি, বয়োঃপ্রাপ্তির বা বয়োঃসন্ধিক্ষনের অভিজ্ঞতা উভয় লিঙ্গের জন্যই ভয়ংকর, বিষ্ময়কর এবং অভুতপূর্ব। আমার মনে হয়, এই সময়টা সুন্দর-সুশৃঙ্খল সামাজিক আবহে কাটাতে পারলে বাকী জীবনের দৈহিক, মানষিক ও আত্মিক উন্নতি ও শান্তি কিছুটা নিশ্চিত হতে পারে ।
মনে রাখা দরকার শুধুমাত্র প্রজন্মের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য প্রকৃতি লৈঙ্গিক বৈচিত্র সৃষ্টি করেছিল, অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়। তারজন্যে অপারাপর পার্থিব উদ্দেশ্য সাধনে নারীর দক্ষতা ও ক্ষমতা সীমিত একথা সত্য, যেমন, স্বাভাবিকভাবে ভারী বোঝা বহন করা নারীর জন্য কষ্টসাধ্য হলেও, পুরুষের জন্য তা নয়। আবার গানিতিক বুদ্ধমত্তায় পুরুষ যতটা এগিয়ে নারী ততটা নয়। তবে এই অবস্থা স্থায়ী নাও হতে পারে। সেটা কিভাবে সম্ভব ? যদি কোনভাবে কখনো, ভবিষ্যত বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে মানব সভ্যতা নারী ও পুরুষকে প্রজাতি রক্ষার দায় তেকে মূক্তি দিতে পারে তাহলে পুরুষ ও নারীর লৈঙ্গিক বৈচিত্র পরিবর্তীত হয়ে যেতে পারে। এতখানি আশা করা যায় এই কারনে, এমব্রয়োনিক স্টেম সেল দিয়ে মানষ ইতিমধ্যে শুক্রকীট বানিয়ে ফেলেছে, ডিমও বানাবার পথে, কৃত্রিম জরায়ু তৈরীর কাজও অনেকটা এগিয়েছে। তাহলে আর বাকী থাকলো কি? এখন সব কিছু সময়ের ব্যাপার মাত্র, আশা নিয়ে অপেক্ষা করা আর কি! তখন এই লৈঙ্গিক ভিন্নতা মানুষের জন্য শুধু একটা বিনোদন বা উপভোগের বিষয় হয়ে যেতে পারে। হয়ত তখন নারী ও পুরুষের দৈহিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমতা আসতে আর কোন বাধা থাকবে না। সাধারন বুদ্ধিতে বলে, এটা হবার যথেষ্ট কারন ও সম্ভাবনা রয়েছে।
জীব ও মনোবৈজ্ঞানিক এতসব তথ্য ও তত্ত্বের সন্নিবেশের মূল উদ্দেশ্য আরকিছু নয়, যাতে তথ্যসমূহ ব্যবহার করে নর-নরীর মানবীক সম্পর্কের এবং যৌক্তিক অবস্থান ও অধিকারের বিষয়ে উভয়েরই একটা মজবুত দার্শনিক ভিত্তি তৈরী ও মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়। কারন, যে কোন কর্মকান্ড বা ব্যবহারিক অভিবেক্তির পেছনে একটা শক্ত দার্শনিক পটভূমী থাকলে ভাল হয়। উদাহরন সরূপ বলা যায়, যদি আমি বাজারে গিয়ে লাউ কিনতে চাই তাহলে আমার লাউ সম্পর্কে একটা যথার্থ র্পূর্বধারনা থাকতে হবে। এই ধারনাটাকে গঠিত হতে হবে পর্যবেক্ষনগত ইন্দ্রিগ্রাহ্য অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তথা বৈজ্ঞানিক তথ্য ও তত্ত্বের দ্বারা। অতপর পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক তথ্যের সমন্বয়ে, যথার্ত যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে লাউ ক্রয়ের সম্ভাব্যতা, উপযোগীতা, উচিত্য বিশ্লেষন পূর্বক স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় এনে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে সেটাই লাউ ক্রয়ের জন্য দার্শনিক পটভূমি। অর্থাত, সঠিক দর্শনিক ভিত্তি সঠিকভাবে কর্মকান্ড সম্পাদনে অবদান রাখে। ঠিক একইভাবে বলা যায়, জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষ পরষ্পরের সংগে কিভাবে ব্যবহার ও অভিবেক্তি বিনিময় করবে তার দার্শনিক পটভূমি তৈরীতে যে সকল উপাদান অবদান রেখেছে তারা হচ্ছে ধর্ম, লোকাচার, প্রথা, সংস্কার ও মিথ। তাই এই তথ্য-প্রযুক্তির যুগেও অনেক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নারী ও পুরুষ পারস্পরিক অবস্থান এবং অধিকার নিরুপনের ক্ষেত্রে মধযুগীয় ধ্যনধারনায় আটকে আছে। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য বৈজ্ঞানিক তথ্য ও তত্ত্বের সমন্বয়ে নারী-পুরুষের যৌক্তিক অবস্থান নির্নয়ে, স্থান-কাল বিবেচনায় এনে যে দর্শনিক পটভূমি রচিত হবে তার মূল প্রথিত থাকতে হবে সমাজের গভীর মূলে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের কতখানি মানবিক করেছে তার প্রমান, বিবর্তনীয় জীবনবৃক্ষ, যে বৃক্ষের তাবত্ শাখা প্রশাখা এক ও অভিন্ন কান্ডে এসে মিশেছে । যেখানে নারী পরুষ বৈসাম্য দূরে থাক, সকল প্রানের বৈসাম্যকে অশ্বিকার করা হয়েছে, অথচ প্রান সৃষ্টির বাইবেলীয় মিথ নারী পুরুষ তথা সকল প্রানির পার্থিব অস্তিত্বকে বৈসাম্যের বিষে করেছে জর্জরিত।
বঙ্গসমাজে যে শ্রেনীভুক্ত মানুষগুলো সবচেয়ে বেশী বৈসাম্যের শীকার, তাদের মধ্যে: নারী, বৃদ্ধ, শিশু, প্রতিবন্ধি, সংখ্যালঘু ও অপর পক্ষে গৃহপালিত প্রানী উল্লেখযোগ্য। তাদের মধ্যে আবার নারী-বৃদ্ধ, নারী-শিশু, নারী-প্রতিবন্ধি এবং নারী-সংখ্যালঘু চরম পীড়নে জর্জরিত, অথচ মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে এরাই সবচেয়ে বেশী মানবিক ব্যাবহার পাবার যোগ্য। একধরনের অতিলৈঙ্গিক চেতনা বোধ এই নিপীড়নমূলক বৈষাম্য সৃষ্টির জন্য দায়ী। আর এই চেতনাকে কাজে লাগিয়ে ধর্ম, সংস্কার, কখনও বা অনুশাষনের নামে খুব ঠান্ডা মাথায় বৈধ ও অবৈধ উভয় ক্ষমতাবানেরা দুর্বলতমের উপর যেহাদী জোশে ঝাপিয়ে পড়ে। খুব ধীরে হলেও অবস্থার দিন দিন উন্নতি হচ্ছে বলে মনে হয়। এসব ক্ষেত্রে দেশের প্রচার মাধ্যমগুলো মোটের উপর ভাল কাজ করছে। তবে এই অবস্থার পরিবর্তন হবে, মানুষ এব্যপারে আশাবাদী ।
নারী সবসময় পুরুষের জন্য শক্তি ও অনুপ্রেরনার উত্স। শরীরে, মনে সর্বত্র সে এই শক্তি অনুভব করে। নারী পুরুষের মাঝে খুজে পায় আস্থা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। এই নিরাপত্তা-আস্থা যেমন অর্থনৈতিক হতে পারে, তেমনি সঙ্গিহীনতার জন্যও হতে পারে। এই সম্পর্ক শুধু দেহে নয়, মনে ও আত্মায় পরিব্যাপ্ত। নারী-পুরুষ সম্পর্ক তাই তৃস্তর বিশিষ্ট। তাইতো দৈহিক সম্পর্কের উপযোগীতা ফুরিয়ে গেলেও মানষিক ও আত্মিক সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা বজায় থাকতে পারে। তবে তা থাকে বিশেষ কিছু শর্ত সাপেক্ষে। যেমন, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সন্মানবোধ এবং আগ্রহের স্বাভাবিক প্রকাশ থাকতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি দেহের প্রতি আগ্রহ একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হতে পারে। তখন অন্য কোন আগ্রহের বিষয়ে খোজ করার দরকার হয়, যেমন: সৃজনশীলতা, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা, রসোবোধ, জ্ঞান অনুসন্ধিত্সা, প্রজ্ঞা ও যৌক্তিক বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি। দেহ একটা ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য ধরাছোয়ার বস্তু। তার পারস্পরিক দৈহিক অভিজ্ঞতা বিনিময় ও উপযোগীতা একসময় শেষ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু শিল্প-সাধনার, জ্ঞান-প্রজ্ঞার উপযোগীতা কোনদিন শেষ হবার নয়, হয় না। তাই এগুলোর আদান প্রদানে নারী-পরুষ সম্পর্ক আরও সুন্দর আরও উপভোগ্য হয়ে উঠে। এইভাবে তীব্র লৈঙ্গিক বোধের বাইরে, বৃহত্ কর্মপরিসরে নারী পুরুষের একত্রিত ও সহযোগীতামূলক অবস্থান আরো বেশী উত্পাদনমূখী ও শান্তিময় সমাজগঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। একে অপরের শক্তি, প্রেরনা ও আস্থার উত্ স হয়ে পাশাপাশি সহাবস্তান সুন্দর-সাবলীল হয় । এটাই আসলে আত্মার সম্পর্ক : নারী-পুরুষ সম্পর্কের মূল রহস্য ।
সবশেষে মহীয়ষি রাবেয়ার একটা ছোট্ট গল্প দিয়ে শেষ করবো । একদা এক সন্ধায় মহর্ষি হাছান বসরি তাঁর দুই-চারজন জ্ঞানী বন্ধু সমভিব্যাবহারে রাবেয়া বসরীর জীর্ন কুটীরে তত্ত্বালোচনার জন্যে আতিথ্য গ্রহন করলেন । কিঞ্চিত আহারের পর কয়েকজন প্রজ্ঞাবান মানুষ গভীর আলোচনায় মগ্ন হলেন। তাপসীর বাগ্নীতা, যুক্তি, জ্ঞান ও বাক্তিত্বে অতীথিরা এত বেশী অবিভূত ও সম্মোহিত হয়ে পড়েছিলেন যে, কখন প্রভাত হয়েছে তা তারা বুঝে উঠতে পারেননি। অতিথিরা প্রস্থান করলেন । পথে যেতে যেতে মহর্ষি হাসান বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষন করলেন, “দেখুন, আমরা যে এতটা সময়, দীর্ঘ রজনী একজন নারীর সঙ্গে একই ছাদের নীচে কাটিয়ে দিলাম, আমার একটি মূহুর্তের জন্যও মনে হলোনা সে নারী আর আমি পুরুষ । আপনাদের অনুভুতি কেমন ছিল?” বন্ধুরা জানালেন তাদেরও একই রকম অনুভুতি হয়েছিল, অর্থাত নারি-পুরুষের ব্যাপারটি তাদের মনে আসেনি। সাথিরা ধরে নিলেন এটা রাবেয়ার কোন অলৌকিক ক্ষমতা হবে। এখানে যেটা বলার কথা সেটা হলো, নারি-পুরুষ আমাদের একটা পরিচিতি এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই কিন্ত তারপরেও আমাদের প্রধান ও বড় এনটিটি বোধ হয় আমরা মানুষ। মানবতা থাকলে মানুষ হওয়া যায়। মানুষ থেকে ব্যক্তি হয়ে উঠা যায় জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে। ব্যক্তিত্ব তৈরি করে ব্যক্তিকে । কোন সে জ্ঞান ব্যক্তিত্বকে গঠন করে। ভাত-কাপড় করে খাওয়া জ্ঞান নয়। কারন বাঘীনিও তার বাচ্চাদের শিকারের কৌশল শেখায় করে খাবার জন্যে। যে জ্ঞান অন্বেষন ও ধারন করতে হয় শুধুই জ্ঞানের জন্যে, সে জ্ঞানের নাম পূর্নাঙ্গ বা সর্বিক জ্ঞান (Holistic Knowledge), যা মানুষকে অতিলৈঙ্গিক চেতনা থেকে অতিমানবিক চেতনার দিকে অথবা কাঙ্খিত আলোর (Enlightenment ) দিকে নিয়ে যেতে পারে।
প্রকৃতি তার প্রয়োজনে নারী-পুরুষ সৃষ্টি করেছে, কিংবা প্রজন্মের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য প্রকৃতি লৈঙ্গিক বৈচিত্র সৃষ্টি করেছিল, এসব কথা কোন বৈজ্ঞানিক কথা হতে পারে না। আমি আর্টিকেলটা যা জানার জন্য পড়েছিলাম তার কিছুই জানতে পারলাম না, দুঃখিত। জানার বিষয় হল,
১) বিবর্তনবাদ অনুসারে নারী-পুরুষ যখন অভিন্ন ছিল, তখন ঠিক কীভাবে মানুষের বংশবিস্তার হয়েছে (গাছ-পালার উদাহরণ ছাড়া ঠিক মানুষের ক্ষেত্রেই ব্যাখ্যাটা জানতে চাচ্ছি)।
২) বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় কারা আগে তৈরি হয়েছে, নারী নাকি পুরুষ? এবং একটা থেকে আরেকটাতে রুপান্তরের পর্যায়গুলো কি কি?
৩) শুধু স্পেসিফিক এই টপিকের উপর কোন ভাল বই থাকলে বলবেন। আমি আমি বিবর্তনের প্রক্রিয়া জানতে চাই। প্রকৃতি তার নিজের প্রয়োজনে তৈরি করে ফেলেছে, এমন কথা দেখতে চাই না।
লেখাটি পড়ে বেশ ভাল লাগল ।
অসাধারণ একটি লেখা…
লেখার সাথে আপনার শিরোনামস্থ কাহিনিটাও তুলে দিলে (শেষদিকে এসে) শিরোনামের সার্থকতা থাকতো…
যে লোকটি আদমের পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে হাওয়ার আবির্ভাবের ব্যাপারটা জানে না সে শিরোনাম ও লেখার খেই হারাতে পারে…
ভালো থাকবেন নিরন্তর… 😕 :-s
এসব তথ্যের ব্যপারে উপযুক্ত রেফারেন্স আশা করছি।
বিশেষ করে- ”এমব্রয়োনিক স্টেম সেল দিয়ে মানষ ইতিমধ্যে শুক্রকীট বানিয়ে ফেলেছে” এ তথ্যটি খুবই গুরুত্বপুর্ন ও ভবিষ্যতে আরো আলোচনার দার উন্মচোন করবে।
@রফিক,
গবেষক দলটিকে লীড দিয়েছিল নিউ ক্যসেল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর করিম নেইর্নিয়া, সঙ্গে ছিল নর্থ-ইষ্ট ইংল্যান্ড স্টেমসেল ইন্সটিটিউট। তারা সবাই মিলে ল্যবে মানুষের এমব্রয়োনিক স্টেমসেল থেকে স্পার্ম তৈরীর একটা উপায় বের করেন। সময়টা ছিল ২০০৯ সাল। নীচের লিঙ্কে আরো বিস্তারিত জানা যাবে। ধন্যবাদ।
http://www.sciencedaily.com/releases/2009/07/090708073843.htm
লেখাটি ভাল লেগেছে। তবে আরও তথ্য বহুল হলে আরও ভাল লাগত।
@জাতীস্মর,
সময়ের অভাব। অনেক ধন্যবাদ।