সরাসরি একজনের ব্রেইন থেকে আরেকজনের ব্রেইনে যোগাযোগ! একজনের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করে আরেকজনের কাজকর্ম! বলে কি, সত্যি নাকি?! ঘটনাটা ঘটেছে দুই সপ্তাহ আগে, ১২ আগস্ট ২০১৩ তারিখে [১], তবে খবরটা আমার চোখে পড়েছে খুব সম্প্রতি। এরপর থেকেই বেশ উত্তেজিত। ঘটনাটা জানানোর জন্যই এই ব্লগ।
ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের দুই বিল্ডিং-এ বসে আছে দুই জন মানুষ- রাজেশ রাও আছে তার ল্যাবে- কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিল্ডিং-এ, আর আন্দ্রে স্টক্কি আছে তার ল্যাবে- ইনস্টিটিউট ফর লার্নিং এন্ড ব্রেইন সায়েন্স বিল্ডিং-এ। দুই জনই মাথায় টুপির মতো একটা কিছু পরে আছে। একেক জনের টুপির বিশেষত্ব একেক রকম।
[ছবি ১: রাজেশ রাও (বামে) ও আন্দ্রে স্টক্কি (ডানে) বসে আছেন নিজ নিজ ল্যাবে।]
রাজেশের মাথার টুপি তার ব্রেইনের কাজকর্মের সিগন্যাল রেকর্ড করে ইইজ(EEG – Electroencephalography) ব্যবহার করে। অন্যদিকে, আন্দ্রের মাথার টুপি তার ব্রেইনে কিছু সিগন্যাল ঢুকায় টিএমএস (TMS – Transcranial Magnetic Stimulation) ব্যবহার করে, যার মাধ্যমে তার হাতের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পুরো ব্যাপারটা হলো – রাজেশ হাত নাড়াচড়া করার কথা চিন্তা করবে, সেই হাত নাড়ানোর সিগন্যাল রাজেশের টুপি থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে চলে যাবে আন্দ্রের টুপিতে, এরপর তা যাবে আন্দ্রের ব্রেইনে যার ফলে আন্দ্রের হাত নড়বে! এক মস্তিষ্ক থেকে আরেক মস্তিষ্কে!
[ছবি ২: এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন]
রাজেশ আর আন্দ্রে দুইজন মিলে ব্রেইন থেকে ব্রেইনে যোগাযোগের মাধ্যমে খেলেছেন এক কম্পিউটার গেম। খেলার নিয়ম হলো – মিসাইল রকেট থেকে একটা শহরকে বাঁচাতে হবে। দস্যুরা আক্রমণ করছে শহরকে, জাহাজ থেকে মিসাইল ছুড়ছে শহরের দিকে। খেলার ছবিটা দেখেন – বাম দিকে আছে শহরটা আর ডানে নিচের দিকে আছে দস্যুদের জাহাজ। একটা কামান আছে মাঝে। মিসাইল ছোড়ার পর তা শহরে আঘাত করার আগেই কামানের গোলা ফায়ার করতে হবে। তাহলেই বেঁচে যাবে শহর। মাঝে মাঝে স্বাভাবিক এরোপ্লেনও দেখতে পারেন আকাশে, তখন কিন্তু কামান ফায়ার করা যাবে না।
[ছবি ৩: কম্পিউটার গেম। গেমের স্ক্রিনে বাম দিকে আছে শহর, ডান দিকে আছে দস্যুদের জাহাজ, আর মাঝে কামান। বামের ছবিতে মিসাইল উড়ে যাচ্ছে শহরের দিকে, আর ডানের ছবিতে মিসাইলটি ধ্বংস করা হয়েছে কামান ফায়ার করে।]
রাজেশ দেখতে পাচ্ছে সব কিছু, কিন্তু তার কাছে কামান নেই। অন্যদিকে আন্দ্রের কাছে কামান আছে, কিন্তু সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তাদের মধ্যে ব্রেইন-থেকে-ব্রেইন ছাড়া যোগাযোগের অন্য কোন উপায়ও নেই। রাজেশ যখন মিসাইল দেখতে পায়, তখন তার ডান হাত নাড়ায়, তার ব্রেইনের এই সংকেত চলে যায় আন্দ্রের ব্রেইনে, তা আন্দ্রের ব্রেইনকে স্টিমুলেট করে, এর ফলে কামানের বাটনের ঠিক উপরে রাখা আন্দ্রের ডান হাতের আঙ্গুল উপর থেকে নিচে জোরে কামানের বাটনে চাপ দেয়। আর কামানের গোলা বাঁচিয়ে দেয় শহরকে। শহরকে বাঁচানোর হার ৯০% এর চেয়েও বেশি। দেখুন নিচের ভিডিওটা –
এক্সপেরিমেন্টের ভিডিও
[ভিডিও ১: এক্সপেরিমেন্টের ভিডিও। ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে কি? :S]
উল্লেখ্য- ব্রেইন থেকে ব্রেইনে যোগাযোগ এবারই কিন্তু প্রথম নয়। এর আগেও হয়েছে। ইঁদুর থেকে ইঁদুরের ব্রেইনে যোগাযোগ দেখিয়েছেন ডিউক ইউনিভার্সিটির গবেষকরা [২]। এছাড়া মানুষ আর ইঁদুরের ব্রেইন-থেকে-ব্রেইনে যোগাযোগ দেখিয়েছেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা [৩]। তবে, ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির প্রফেসররাই প্রথম দেখিয়েছেন মানুষের ব্রেইন-থেকে-ব্রেইনে যোগাযোগ।
মানুষের ব্রেইন-থেকে-ব্রেইনে যোগাযোগের এই পদ্ধতি অনেকটা সায়েন্স ফিকশনের মতো শোনায় না? অনেকের কাছেই হয়তো এটা বেশ ভয়ংকর একটা ব্যাপার। তবে, চিন্তা করুন না প্যারালাইস্ড্ মানুষের কথা। তাদের এক অংশের ব্রেইন সিগন্যাল নিয়ে যদি অন্য অংশকে কাজ করানো যায়, তাহলে সেই দিন দূরে নয় যেদিন প্যারালাইস্ড্ মানুষটিও ফুটবল খেলতে পারবে!
সূত্র:
১) http://homes.cs.washington.edu/~rao/brain2brain/experiment.html
২) http://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/23448946?dopt=Abstract&holding=npg
৩) http://www.plosone.org/article/info:doi/10.1371/journal.pone.0060410
একজনের ব্রেইন আরেক জনের শরীর !!!!!!!!!!! চমৎকার , স্পরশের অনুভুতিও কি পাওয়া যাবে? অনেক ধন্যবাদ। (Y)
@আস্তরিন,
একজনের গায়ে স্পর্শের ফলে ব্রেইনে যে এক্টিভিটি দেখা যায়, সেটা রেকর্ড করে, একই এক্টিভিটি যদি আরেকজনের ব্রেইনে তৈরি করা যায়, তাহলে স্পর্শের অনুভূতি পাওয়া যাবে বৈকি।
আপনি না লিখলে হয়তো আরও পরে কোনও এক সময় জানতাম। ধন্যবাদ, এত সুন্দর একটা বিষয় নিয়ে লেখার জন্য।
চমৎকার একটি লিখার জন্য ধন্যবাদ
বাহ দারুণতো। ডিভাইসটা ছোটো সাইজের বানানো গেলে পরীক্ষার হলে ব্যাপক কাজে লাগবে 😀 । মুক্তমনায় আরো নিয়মিত লিখবেন আশা করছি।
@রামগড়ুড়ের ছানা,
হা হা হা 😀
কিছুদিন পর দেখা যাবে, পরীক্ষার হলে টুপি পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে!
@প্রতিফলন,
গুগল গ্লাসের ভয়ে চশমা পরা আবার নিষিদ্ধ না হয় 😛
@রামগড়ুড়ের ছানা,
ভাল কথা, লেখার মধ্যে ইউটিউব ভিডিও বা অন্য ভিডিও এড করে কীভাবে? আমি গুগলিং করলাম, কিন্তু নিচের লাইনটুকু ছাড়া আর কিছু আসে না। এবং ইহা কাজ করে না। 🙁
অসাধারন আবিষ্কার। চমৎকার খবরটি জানানোর জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
@তারিক,
আপনাকে স্বাগতম! 🙂
আচ্ছা স্টিফেন হকিং যে সফট ওয়্যার এর মাধ্যমে কম্পুটারের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন সেটা কিভাবে কাজ করে?, এটি ত কম নয়, মানুষের চিন্তাকে শব্দ বানানো বা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ। মাথায় গল্প , উপন্যাস চিন্তায় আনলেই তা প্রিন্ট হয়ে বের যাবে। মানুষ যন্ত্র হয়ে যাচ্ছে নাকি যন্ত্র মানুষ হয়ে যাচ্ছে!!
@সপ্তক,
স্টিফেন হকিং-এর সফ্ট্ওয়্যার চিন্তাকে শব্দ বানায় না, বরং কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে লিমিটেড এক্সপ্রেশন ক্যাপাবিলিটিকে সহজে ভাষায় রূপান্তরিত করে। হকিং আগে লিখতেন তার হাতে রাখা একটা সুইচের মাধ্যমে। এখন প্রযুক্তি আরেকটু সহজ হয়েছে, সুইচ চাপতে হয় না, গালের ত্বকের সামান্য নড়াচড়ার মাধ্যমেই তা করতে পারেন। হকিং এর সাইট থেকেই উদ্ধৃত করছি –
আরো জানার ইচ্ছে থাকলে ঘুরে আসুন তার সাইটে।
মানুষ আর যন্ত্রের তুলনার ব্যাপারে বলি – হাতে-ঠেলা রিক্সা আর প্যাডেল-চালিত রিক্সার মধ্যে কোন্টাকে বেশি মানবিক বলে মনে হয় বলুনতো? নিশ্চয় প্যাডেল-চালিত রিক্সাকে? এই হিসাব অনুসারে বলতে হয়, মানুষ আরো মানবিক হচ্ছে।
ধন্যবাদ।
হ্যাঁ, সায়েন্স ফিকশনের মতই। যেমন, একদা শোনাত বেতার সংযোগের ব্যাপারটি, তারও আগে উড়োজাহাজ উড়ার ব্যাপারটি। এই দারুণ নিউজটি একেবারে ছবি ও ভিডিও-সমেত তুলে ধরার জন্য অনেক ধন্যবাদ। এ ধরনের ব্লগগুলিই মুক্তমনার বিশেষত্ব, আলাদা করে চেনায় এবং ডেকে আনে অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের!
আমার একটা প্রশ্ন আছে, ভাইয়া এবং বোকামি শোনাতে পারে, সেই রিস্ক নিয়েই প্রশ্নটি করছি: আন্দ্রে জানে, রাজেশ হাত নাড়ালেই তাকে কামান ফায়ার করতে হবে, মানে, রাজেশের কাছ থেকে যেকোনো সংকেত এলেই সে সেটি করতে পারে, এখানে রাজেশের হাত নাড়ানো সরাসরি আন্দ্রের কামান দাগানোর সাথে কিভাবে সম্পর্কযুক্ত? রাজেশের যেকোনো সংকেতকেই তো সে কামান দাগানোর জন্য ব্যবহার করতে পারে, মানে, এখানে আন্দ্রের কামান দাগানো তার আগের সিদ্ধান্তের প্রতিফলন কতটুকু আর রাজেশের সংকেতের প্রতিফলে ঘটে কতটুকু? মানে, মস্তিষ্কের সংকেত এখানে আন্দ্রেকে দিয়ে কামান দাগিয়ে নিচ্ছে নাকি জাস্ট একটা অ্যাকশনে নামার সিগনাল দিচ্ছে? মানে, আন্দ্রে যদি কামান না দেগে অন্য কিছু দাগাতে চায়, রাজেশের সংকেত সেক্ষেত্রেও কি আন্দ্রেকে দিয়ে কামান দাগিয়েই ছাড়বে?
প্যারালাইজড ব্যাক্তির প্যারালাইজড হাত কিন্তু আগে থেকে জানে না, তাকে কি করতে হবে। আন্দ্রের কিন্তু এই সুবিধা ছিল।
পরিশিষ্ট: অনেক দিন বাদে বাদে আপনি আসেন। সবসময় তা-ই হয়। আরও কি কম দিন বাদে আসা যায় না? পাঠকদের কথা ভেবে?
@কাজি মামুন,
অনেক অনেক ধন্যবাদ সুন্দর চিন্তাশীল প্রশ্নের জন্য। প্রথমেই বলি – আন্দ্রে আসলে জানতো না যে হাত নাড়াতে হবে, আন্দ্রে কিন্তু নিজে তার হাত নাড়ায়নি, বরং ইচ্ছার বাইরেই তার হাত নড়েছে। এই নাড়ানোর কাজটা করেছে রাজেশের চিন্তা (ভাল করে খেয়াল করে, রাজেশ কিন্তু আসলে হাত নাড়ায়নি)। আর হ্যাঁ, কম্পিউটার প্রকৌশলীদের চিন্তার মতো কেবল ০, ১ বা কেবল একটা ক্যারেক্টার (অক্ষর বা অন্য কোন চিহ্ণ) পাঠানো হয়নি ইন্টারনেটের মাধ্যমে, বরং রাজেশের ব্রেইন এক্টিভিটির একটা অংশই পাঠানো হয়েছে প্রসেসিং করে। এই প্রজেক্টের সাইট অনুসারে,