লেখকঃ কল্লোল মুস্তাফা
বটতলা বাজার। তাইন্দং ইউনিয়ন। তারিখ ১৭ আগষ্ট ২০১৩। গত ৩ আগষ্ট তাইন্দং এর পাহাড়ী গ্রামগুলোতে কি ঘটেছিল জানতে চাইলে বাজারে উপস্থিত বাঙালিরা মুক্তার আলীকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন তিনি ভালো বলতে পারবেন, হয়তো স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা বলেই। মুক্তার আলী ৪ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। কাকতালীয় ভাবে মুক্তার আলীর নামটা আমরা পাহাড়িদের কাছেও শুনেছি, অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গে। যাই হোক, মুক্তার আলী বললেন, এর আগে এই এলাকায় এমন ঘটনা ঘটেনি, পাহাড়ি বাঙালি ‘একই মায়ের পেটের ভাইয়ে’র মতো এখানে একসাথে বসবাস করে আসছে। ঘটনার দিন সকালের দিকে তিনি বাজারে এসে শুনতে পান কামাল হোসেন নামের একজনকে নাকি পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা অপহরণ করেছে, সবাই মিলে তাকে খোজাখুজি চলছে। ক্রসিং নামের একটা জায়গায় অনেকেই জড়ো হয়েছে। এরপর সেখানে গন্ডগোল হয় এবং পরে তিনি জানতে পারেন, পাহাড়িদের কিছু ঘরে আগুণ দেয়া হয়েছে। আগুন কারা দিয়েছে, কেন দিয়েছে সে সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না।
তার ভাষ্য অনুসারে কামাল হোসেন বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত। তার কোন পদ আছে কিনা বলতে পারেন নি। কামাল হোসেনের অপহরণের অভিযোগে পাহাড়ি গ্রামে আগুণ দেয়া হলেও পরে কামাল হোসেনকে অক্ষতই পাওয়া যায় আনুমানিক বিকাল ৫টার দিকে, এমনকি তার মোবাইল, মানিব্যাগও নাকি খোয়া যায়নি বললেন মুক্তার আলী। মুক্তার আলীর মতো উপস্থিত অনেকেই বললেন এটা সাজানো ঘটনা বলেই তাদের মনে হয়। তাদের কাছ থেকে জানা গেল, ৩ তারিখের ঘটনা ঘটার আগে কয়েকদিন ধরেই বিভিন্ন ধরণের গুজব, আশংকা বাতাসে ভাসছিল- ৩১ জুলাই রাতে ওসমান নামের এক সেটলার বাঙালির মাথায় মুখোশ ধারী কে বা কারা যেন লাঠি দিয়ে আঘাত করে, পরের দিন রাতে মুসলমান পাড়ায়(পূর্ব নাম পোমাং ) কে বা কারা নাকি গুলিও ফুটিয়েছে। ‘শান্তি বাহিনী’, ‘সন্ত্রাসী বাহিনী’ বা ‘জঙ্গল পার্টি’কে এর জন্য দায়ী করে এই নিয়ে কয়েকদিন ধরে রাতে পাহাড়িদের বিরুদ্ধে জ্বালাও পোড়াও স্লোগান দিয়ে সাম্প্রদায়িক মিছিল হয়েছে, এমনকি তাইন্দং ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের সমস্ত মসজিদ থেকে একযোগে মাইকিং ও হয়েছে- পাহাড়িদের বিরুদ্ধে ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তত’ থাকার আহবান জানিয়ে! কিন্তু কারা এই মিছিল করেছে, কারা মাইকে ঘোষণা দিয়েছে এই বিষয়টি তাদের জানা নেই বললেন।
আক্রান্ত বগাপাড়া কিংবা সর্বশ্বের পাড়ার পাহাড়িদের সাথে যখন আগের দিন কথা হচ্ছিল,তারাও এই গুজব, মিছিল, মাইকিং এর কথা জানিয়েছিলেন। তাদের বক্তব্য হলো, পাহাড়িদেরকে উচ্ছেদ করার জন্যই পরিকল্পিত ভাবে সেটলার বাঙালিরা এই ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে এবং এক্ষেত্রে আওয়ামী লিগ-বিএনপি-জামাত সব একজোট হয়েই এই কাজগুলো ঘটায়।
পাহাড়িরা যুগ যুগ ধরে যেই জায়গা গুলোতে জুম চাষ করে আসছে, ভোগ দখল করে আসছে, সেই জায়গাগুলো দখল করতে করতে তাদেরকে আজ খাগড়াছড়ির এক প্রান্তে ভারতীয় সীমান্তের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। একসময় যেখানে মাত্র শতকরা ২ শতাংশ বাঙালি ছিল, সেখানে এখন ৮০ শতাংশই বাঙালি। গোটা তাইন্দং ইউনিয়নে বাঙালির সংখ্যা যেখানে ১৫ হাজার সেখানে পাহাড়িদের সংখ্যা মাত্র ৩ হাজার। এরকম বাঙালি সংখ্যা গরিষ্ঠ অঞ্চলে বাঙালি পাড়ায় গিয়ে কথিত পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হামলা করে ফিরে আসাটা অবাস্তব, আজগুবি। আবার ওসমানের মতো একজন সাধারণ ট্রাক্টরচালকের বাড়িতে কথিত পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের ডাকাতি করতে যাওয়ার অভিযোগটিও দুর্বল। বরং বিভিন্ন প্রভাবশালী বাঙালি পাহাড়িদের বসতি, টিলা, বাগান, বাজারের প্লট নিজের বলে দাবী করে সেগুলো দখল করে নিচ্ছে। এই দখল করার প্রকৃয়া হিসেবেই বিভিন্ন সময় পাহাড়িদের গ্রামে হামলা করা হয়, ঘর বাড়ি পুড়িয়ে লুটপাট মারধর করে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরী করা হয় যেন পাহাড়িরা সেসব স্থানে থাকার সাহস হারিয়ে ফেলে। শুধু খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দং ইউনিয়নে নয়, গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামেই এই এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটছে যার খবর গণমাধ্যমে আসেনা, যে বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনও কোন ব্যাবস্থা গ্রহণ করেনা। এই মাটিরাঙ্গা উপজেলাতেই এর আগে এপ্রিল মাসে প্রাণকুমার পাড়ার ২৭টি এবং জুন মাসে তাকামুনি পাড়ার ৪০টি পাহাড়ি পরিবারের উপর আক্রমণ করা হয়। এ নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান শামসুল হকের সাথে পাহাড়িদের একটি সংগঠন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের লিখিত চুক্তিও হয়, যে চুক্তি অনুসারে পাহাড়ি বাঙালিদের বিষয়ে যে কোন বিভেদ/বিরোধ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নিস্পত্তি করার কথা। কিন্তু আমরা দেখলাম মাটিরাঙ্গার তাইন্দং এ পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের আক্রমণ এবং অপহরণের গুজব ছড়িয়ে সোজা পাহাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে ৩৬টি ঘর পোড়ানো হল, কয়েকশ পরিবারের ঘর বাড়িতে লুটপাট চালানো হল, মন্দিরে হামলা চালিয়ে মূর্তিভাঙা, মূর্তি ও অর্থ লুট করা হলো।
তাইন্দং এর সর্বেশ্বর পাড়ায় যেসব ঘরে আগুণ দেয়া হয়েছে তার একটি প্রভাত চন্দ্র চাকমার। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল ভাঙা টিলা নামক স্থানে তার জমিকে নিজের জমি বলে দাবী করছেন আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তার আলী অথচ ভাঙা টিলায় প্রভাত চন্দ্ররা দীর্ঘদিন ধরে সেগুন বাগান করছেন। মুক্তার আলী ৮৮ সালে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেটলার হিসেবে যখন এই এলাকায় আসেন তখন মুক্তার আলীর নামে ৫ একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয় যা মুক্তার আলীর দাবী অনুসারে ভাঙা টিলায় অবস্থিত। মুশকিল হলো কবুলিয়ত গুলোতে জমির সীমানা এমন ভাবে বিভিন্ন ঝোপঝাড়, টিলা, গাছ ইত্যাদি দ্বারা চিহ্নিত করা থাকে যার ফলে এক কবুলিয়াত ব্যাবহার করে একাধিক জায়াগা দাবী করা সম্ভব এবং তা করা হয়ও। তাছাড়া জাল কবুলিয়াতের মাধ্যমেও পাহাড়িদের জায়গা জমি দখল করা হয়েছে এবং হচ্ছে। মুক্তার আলীদের কবুলিয়াত যদি জাল নাও হয় তাহলেও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই দখল পাহাড়িরা মানবে কেন? পাহাড়িরা যুগ যুগ ধরে যেসব জমিতে বসবাস ও চাষাবাদ করছেন, সেসব জমি কাউকে কবুলিয়াত করে দেয়ার কোন এক্তিয়ার রাষ্ট্রের নেই। তারপরেও মুক্তার আলীর মতো মানুষদেরকে রাষ্ট্রীয় ভাবে সমতল থেকে পাহাড়ে এনে এভাবে পাহাড়িদেরকে নিজভূমে পরবাসী করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় ও প্রাশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতায় সেই প্রকৃয়া জারি আছে। কথিত শান্তি চুক্তির পরে এই প্রকৃয়া বন্ধ হওয়ার বদলে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পাহাড়ি জমি আরো লোভনীয় হয়ে উঠেছে, সেটলার বাঙালিরা পাহাড়িদের জমির উপর দখল দাবী করা কবুলিয়াত বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করছে, কোম্পানির কাজ হলো দখলের কাজটি বাস্তবায়িত করে গাছ, ফল, কাঠ, মাছ, রাবার, চা ইত্যাদির ব্যাবসা করা।
বটতলী বাজারে বসা মুক্তার আলীর সামনে ভাঙা টিলার জমি দখলের অভিযোগটি তুলতেই তিনি দাবী করলেন, সে বিরোধ নাকি কয়েকদিন আগেই মিটে গেছে। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ফনীভূষণ নাকি বলেছেন প্রভাত চন্দ্র চাকমাকে ৪০ হাজার টাকা দিলে তিনি ঐ জমি ছেড়ে দেবেন, এই জন্য ফনীভূষণকে মুক্তার আলীর ছেলে ৭ হাজার টাকাও দিয়ে এসেছে। মুক্তার আলী মীমাংসার দাবী করলেও প্রভাত চন্দ্র চাকমা এর আগের দিনও আমাদের কাছে জমি দখলের তৎপরতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। তাইন্দং ইউনিয়ন খাগড়াছড়ির সবচেয়ে উর্বর অঞ্চলের একটি বলে পরিচিত। সেখানকার প্রতি একর পাহাড়ি জমি কমপক্ষে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা দামে বিকোবে। তার উপর ভাঙা টিলায় রয়েছে লাখ লাখ টাকা দামের সেগুণ গাছ। এই রকম একটা জমির ৫ একর মাত্র ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে আদায় করতে চাওয়াটা মীমাংসাই বটে!
বটতলী বাজারে বাঙালিদের সাথে কথা বলার ঠিক আগেই কথা হয় তানাক্কা পাড়া ক্যাম্পের এক বিজিবি কর্মকর্তার সঙ্গে। ঘটনা স্থলের আধা কিমি থেকে দুই/তিন কিমি এর মধ্যে যতগুলো বিজিবি ক্যাম্প আছে তার মধ্যে তানাক্কা পাড়া ক্যাম্পটি ঘটনাস্থলের সব থেকে নিকটে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ইউএনও এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক উপসচিব। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ বিজিবি কর্মকর্তা তদন্তানাধীন বিষয়ে অফিসিয়ালি কোন বক্তব্য দেয়ার অপারগতা প্রকাশ করে ‘আনঅফিসিয়ালি’ গুলির শব্দ, মাইকিং, মিছিল ইত্যাদি বিষয়গুলোর কথা উল্ল্যেখ করলেও এর পেছনে ভূমি বিরোধ বা অন্যকোন মোটিভ সম্পর্কে কিছু বলেন নি। অবশ্য তার কথা অনুসারে পাহাড়িরা ‘কিছু হলেই’ নাকি বিশেষ ‘রাজনৈতিক গোষ্ঠীর’ কথায় তাদের কাছে না এসে ভারতীয় সীমান্তে চলে যায় যেন বিষয়টাকে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত করা যায়। তার ভাষায় বিষয়টা পুরোটাই ‘পলিটিক্যাল’! অপারেশন উত্তরণের আওতায় সীমান্ত পাহারা দেয়ার পাশাপাশি স্থানীয় আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দ্বায়িত্বও বিজিবি পালন করে, স্থানীয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে সহায়তা করে। তাই তাদের কাছে না এসে পাহাড়িরা কেন বারবার সীমান্তে চলে যায় তা নিয়ে তাকে বেশ অসন্তুষ্ট মনে হলো। বললাম-
আপনাদের কাছে আসবে কিভাবে? আপনাদের উপস্থিতিতেই তো বিভিন্ন সময় পাহাড়িদের উপর হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। গত ৩ অগাষ্টেও ক্রসিং এলাকায় আপনাদের উপস্থিতিতে পাহাড়িদের ১১ নেতার উপর হামলা হয়েছে।
তিনি বললেন, ক্রসিং এলাকায় এমন কিছু ঘটে নাই যার জন্য পাহাড়িরা আমাদের উপর আস্থা রাখতে পারবেনা। ১৫শ’র মতো ক্ষুব্ধ বাঙালিকে নিয়ন্ত্রণ করা তো সহজ কথা না। এত মানুষের মধ্যে কেউ একটা ঘুষি মারলে তো সেটা পুরোপুরি ঠেকিয়ে রাখা জায়না। অপহরণের কথা ছড়িয়ে পড়ার পর সেদিন ওখানে যে পরিস্থিতি ছিলো, বিশাল বিশাল দা নিয়ে বাঙালিরা হাজির ছিল। আমরা না থাকলে সেখানে ১১জনই খুন হয়ে যেত। তাছাড়া আমরা পাহাড়ি নেতাদেরকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে ক্যাম্পে চিকিৎসা ব্যান্ডেজ ইত্যাদির ব্যাবস্থা করেছি।
আমরা অবশ্য জিজ্ঞেস করিনি, উল্টোটি হলে অর্থাৎ পাহাড়িরা যদি বাঙালি নেতাদের উপর হামলা করতো তাহলে কি বিজিবি স্রেফ খুন হয়ে যাওয়া ঠেকিয়েই খুশী থাকতো কিনা!
আমরা শুধু জানতে চাইলাম- আশপাশে ছয় ছয়টি বিজিবি ক্যাম্প থাকা সত্ত্বেও পাহাড়ি গ্রামে কেমন করে ঘরবাড়ি পোড়ানো, মন্দির ভাঙচুর, লুটপাট ইত্যাদি করা সম্ভাব হলো? বিশেষ করে কয়েকদিন ধরেই যেখানে নানা রকম গুজব, মিছিল, মাইকিং ইত্যাদি হচ্ছিল সেখানে কেন গ্রামগুলোতে নিরাপত্তার ব্যাবস্থা নেয়া হলো না? কেমন করে ক্রসিং এলাকা থেকে গিয়ে সেটলার বাঙালিরা পাহাড়ি গ্রাম গুলোতে লুটপাট অগ্নি সংযোগ করতে পারল? পাহাড়িদের তো অভিযোগ হলো বিজিবির পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে সেটলাররা এরকম ঘটনা ঘটানোর সাহস করতো না।
তিনি বললেন- শোনেন, আমরা না থাকলে সেদিন শুধু ৩৬টা না, ৩শ’র বেশি ঘরবাড়ি পুড়তো, লুটপাট হতো আরো বেশি। আমরা বরং এটা ঠেকাতে পেরে সন্তুষ্ট। ক্রসিং এলাকা থেকে যখন বাঙালিদেরকে আমরা সরিয়ে দেই তখন আমাদের ধারণা ছিলনা এরা এখান থেকে পাহাড়ি গ্রামে গিয়ে এরকম ঘটনা ঘটাবে। আমরা টের পাওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন গ্রামে টহল দল পাঠাই, আর আমাদের লোকবলও সীমিত।
তারপর তিনি নিজেই জানালেন এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তারা কত আন্তরিক, কিভাবে টাকা দিয়ে প্রতিটি গ্রামে সোর্স পোষেণ, সীমিত লোকবল নিয়েও সীমান্ত রক্ষার পাশাপাশি এলাকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে প্রশাসনকে সাহায্য করেন ইত্যাদি। আমরা অবশ্য জানতে চাইনি, প্রতিটা গ্রামে সোর্স থাকার পরও, টানা কয়েকদিন ধরে মিছিল মাইকিং গুজব ইত্যাদি আলামত দেখা গেলেও কিভাবে তারা টের না পেয়ে থাকতে পারেন এবং কিভাবে অস্ত্র সজ্জিত হয়ে তাদের সামনে কামাল অপহরণের অযুহাতে পাহাড়ি নেতাদের উপর সেটলার বাঙালিরা হামলা করার পরও পাহাড়ি গ্রামগুলো অরক্ষিত রেখে দেয়া যেতে পারে!
পুনশ্চ: তাইন্দং এ হেলিকপ্টার ও গাড়ির আনাগোনা, সচিব, ইউএনও সহ প্রশাসনের নানামুখী তৎপরতা, ভীত সন্ত্রস্ত পাহাড়িদের ভারতীয় সীমান্ত থেকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে ফিরিয়ে আনা, তাবু টানানো ইত্যাদির মধ্যেও ঘরপোড়া পাহাড়িদের আতংক কাটেনি। তারা জানেন এইসব লোক দেখানো তৎপরতা একসময় থেমে যাবে, তখন আবারও হয়তো তাদের উপর অন্য কোন উপায়ে অন্য কোন অযুহাতে হামলা হবে। এরকমটাই হয়ে এসেছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। পরিস্থিতির যে গুণগত পরিবর্তনের কোন ইঙ্গিত নাই, তার লক্ষণ এমনকি তাইন্দং থেকে আনুমানিক প্রায় ৭০/৮০ কিমি দূরে খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার তৈচাকমা পাড়ার চলমান ঘটনাবলী থেকেও বোঝা যায়।
৩ আগষ্টে তাইন্দং এ পাহাড়িদের উপর হামলার প্রতিবাদে পাহাড়িদের সংগঠন ইউপিডিএফ ৫ আগষ্ট খাগড়াছড়ি জেলায় সকাল সন্ধ্যা সড়ক অবরোধ কর্মসূচী পালন করে। সেই অবরোধে পিকেটিং এর অংশ হিসেবে তৈচাকমা পাড়া এলাকায় একজন বাঙালির মোটরসাইকেলে আগুণ দেয়া হয়। মোটর সাইকেলটি বাঙালির বলে অবরোধের মতো একটি কর্মসূচীর অংশ হিসেবে ঘটা ঘটনাকে দ্রুতই সাম্প্রদায়িক চেহারা দেয়া হয়, দুইটি জিপ গাড়ি করে পুলিশের ও আর্মির ক্যাম্প অতিক্রম করে প্রকাশ্যে দেশীয় অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তৈচাকমা পাড়ায় হামলা চালানো হয়, পাহাড়িদের দোকান পাট ভাঙচুর করে অমিন্দ্র ত্রিপুরা নামের একজনকে তুলে নিয়ে গিয়ে পেটানো হয়। মানিক ছড়ি থানার পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করলেও জড়িতদের কোন বিচারের কোন ব্যাবস্থা হয়নি। এ ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা পাহাড়িরা নিকটস্থ বাটনাতলী বাজারে যাওয়া বন্ধ করে দেয়ায় তাদের উপর এখন নানা ভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। পাহাড়িদের অভিযোগ হলো, গত ১৮ আগষ্ট দুপুরের দিকে বাটনাতলী ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল এসে তৈচাকমা পাড়ার পাহাড়িদের হুমকী দিয়ে যায়, বাজারে না গেলে নাকি তাদের ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে!
যতদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভূমি আগ্রসন বন্ধ না হবে, সামরিক দখলদ্বারিত্বের অবসান না ঘটবে, পাহাড়িদের যৌথ মালিকানাধীন জুমের জমি খাস জমি হিসেবে অধিগ্রহণ,লিজ, সেটলার, কোম্পানির কাছে বরাদ্দ কিংবা বিক্রয় বন্ধ না হবে, পাহাড়িদের জমিতে রাবার চা ইত্যাদি কমার্শিয়াল প্ল্যান্টেশনের ধান্দা চলবে ততদিনই এই পরিস্থিতি বজায় থাকবে।
যতবারই এ চিত্রগুলি দেখি, ততবারই মনে পড়ে শামসুর রহমানের সেই ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা…………’
আর কত? শুধু একটি ধর্ম বা শুধু একটি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠিতে জন্ম নেয়ার জন্য আর কতকাল মানুষকে হতে হবে লুন্ঠিত?
কল্লোল মুস্তাফাকে ধন্যবাদ। জাতি-নিধনের পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরে তিনি মানবতার দায় কিছুটা হলেও মিটিয়েছেন।
সরোজমিন এ প্রতিবেদনে মুক্তার আলীদের আর বিজিবি এর ভূমিকা বুঝতে সহযোগিতা করেছে।আরও লিখুন।
১৯৮৯ সালে একবার বন্ধুদের সাথে টেকনাফ থেকে রাঙ্গামাটি হয়ে কক্সবাজার গিয়েছিলাম।পাহাড়ি এলাকায় সেনাবাহিনী আমাদের বহর থামায় এবং বলে “আপনাদের কি দুর্মতি হয়েছে যে এপথে এসেছেন?”। আমি ত অবাক নিজের দেশে ভ্রমন করছি আবার দুর্মতি কিসের?। সেনাবাহিনীর সদস্যটি ছিলেন কর্মকর্তা তিনি বোঝালেন পথ নিরাপদ নয় কিন্তু তিনি আমাদের সাথে করে একটি গ্রাম দেখাতে নিয়ে গেলেন। সেনাবাহিনীর সদস্য একজন পাহাড়িকে ডাকলেন যিনি দোকানে বসে চা পান করছিলেন, তাকে সেনাবাহিনীর সদস্য ডাকা মাত্রই আমি দেখতে পেলাম সেই পাহাড়ির চোখে এক আতংক যা আমাদের ছিল ১৯৭১ এর নয় মাস। কি ভয়ংকর সে আতংক তা আমি জানি। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী পাহাড়ি জনগনের ওপর যে অত্যাচার করেছে তা ৭১ এর হানাদার বাহিনীর চেয়েও ভয়ংকর। এখন অনলাইনে সব ই আছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর বিচার হওয়া উচিৎ , যদি ৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরা চাই ।
@সপ্তক,
আপনার মানবিক পর্যবেক্ষণটি জরুরি।
পাহাড়ে পাকিপনার বিচার তো দূরে থাক, দুঃশাসনটিই এখনো বন্ধ হয়নি। এই নিয়ে বেশকিছু দিন
হলো লিখছি। [লিংক]
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। (Y)
@বিপ্লব রহমান,
একই দেশের নাগরিক আমরা। এখানে সব নাগরিক সমান। “মানবিক” শব্দটি প্রযোজ্য হত যদি অন্য দেশের নাগরিক সম্পর্কে বলতাম। আমার নাগরিক ভাইয়ের ওপর আমাদের সেনাবাহিনী অত্যাচার করবে এক্ষেত্রে “মানবিক” শব্দটি আমাকে চরম লজ্জা দেয়। কোথায় আমরা মানবিক?। অনলাইন থেকে শুরু করে দেশে ত দেখি না বাঙালীরা পাহাড়ি ভাইদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদ করছে। আমরা পাকিদের মতই “অমানবিক” আচরন করছি। এর খেসারত আমাদেরকেও দিতে হবে। এক যাত্রায় দুই ফল হয় না। চরম ঘৃণা প্রকাশ করছি এই অত্যাচারের।
@সপ্তক, পাহাড়াদের উপর আমরা এখন যা করছি তা কিন্তু পাকিস্তানীরা আমাদের উপর যা করেছে তার বৈধ্যতা দেয়। যে নিপিরন করছি তা কোন ভাল ফল বয়ে আনবে না। আপনি সুন্দর বলেছেন। ধন্যবাদ।
[img]https://fbcdn-sphotos-b-a.akamaihd.net/hphotos-ak-frc1/1119898_440078306105460_1314850890_o.jpg[/img]
[লিংক]
—
নোটটি আগেই ফেবু’তে পড়েছি। নতুন কথা আর কি বলতে পারি? শুধু এইটুকু বলে যাই, প্রচণ্ড প্রতিরোধ-সংগ্রাম ছাড়া পাহাড় ও সমতলে আদিবাসীর সমূহ বিপদ।
কল্লোল মুস্তাফাকে মুক্তমনায় স্বাগতম। আরো লিখুন। (Y)
অনেক সময় উপযোগী এবং গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু; ভাল লেগেছে লেখাতি
পাহাড়ে কি হচ্ছে, কাদের দ্বারা আর ছত্রছায়ায় হচ্ছে সেটাও অত্যন্ত পরিষ্কার। অথচ আমরা বাংগালী জাতিই এক সময় শাসন শোষনের বিরুদ্ধে রুখে স্বাধীনতা এনেছিলাম।
সম্পদের সীমাবদ্ধতা যেখানে প্রকট সেখানে সাম্প্রদায়িকতা রূপ নিত্য দিনের রুটিনে, রাষ্ট্রও মদদ দেয় সংখ্যা গরিষ্ঠদের, জনতারও মোটামুটি নীরব হলেও সায় থাকে। আর মনে কখনো অস্বস্থি দেখা গেলে তা কাটানোর জন্য অপহরন জাতীয় কিছু ঘটনা মঞ্চায়ন করাই যথেষ্ট।
মুক্তমনায় স্বাগতম। আপনার নাম শুনেছিলাম, এখানে লেখা দেখে ভাল লাগল।
পক্ষে-বিপক্ষে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে, যুক্তি থাকতে পারে- তবে rape কে যদি আসলেই rape হিসেবে বলার স্বাধীনতা থাকে কিংবা adultery কে adultery কিংবা fornication কে fornication হিসেবেই বর্ণনা করতে হয় তাহলে- পার্বত্য চট্টগ্রামে যা চলছে তাকে Martial Law ই বলতে হয়, হতে পারে আংশিক কিংবা পুরপুরি কিন্তু ওটা Martial Law ই- যেভাবেই euphemise করার চেষ্টা হোক না কেন।
পার্ব্যত্য চট্টগ্রামে যে ধরনের আন্দোলন শুরু হয়েছিল- এমন পরিস্থিতিতে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে এমনকি বিশ্বে গণতন্ত্র ব্যাপ্তির একমাত্র ইজারদার যুক্তরাষ্ট্রও এমন করবে – পূর্বে করেছে – ভবিষ্যতেও করবে। হয় আইনের মধ্য থেকে এমন করতে হবে নাহয় দাবী পরিত্যাগ করতে হবে।
এখন দেখতে হবে এর সুযোগে কোন বিশেষ গোষ্ঠী- এক্ষেত্রে, বাঙ্গালিরা অবৈধ সুযোগ নিচ্ছে কিনা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোতে বাঙ্গালিরা ভালোই পটু- কালে কালে প্রমানিত- গুজরাটি কিংবা পাঞ্জাবি ত্থেকে কোন অংশে কম নয়, বলা ভালো উপমহাদেশে এই অপকর্মে গুজরাটিদের পরেই বাঙ্গালীদের স্থান- ইতিহাস তাই বলে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে এটা বাঙ্গালীদের জন্য শুধু খারাপ হবে- মানুষের মৌলিক জন্মগত অধিকারে বাম হাত ঢুকাতে চাইলে যে “চানেওয়ালার” কি হয় এর প্রমান আমরা ১৯৭১ সালেই দেখেছি- এখন আমরাই যেন ইতিহাসের খলনায়ক না হই সেদিকে সতর্ক হওয়া উচিত।
নিজের ভিটে বাড়ি ছেড়ে পালানো মানুষ নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে যায়,খুব বেদনাদায়ক।এই পাহাড়িরা কি সব ভারতে পালিয়ে যায়?ওখানে ওদের কি মেনে নেওয়া হয়?