‘ইউটোপিয়া’ (Utopia) শব্দটি সমাজ বিজ্ঞানী, লিখক,আইনজ্ঞ এবং রেনেসাঁর মানবতাবাদী দার্শনিক টমাস মোরের হাত ধরে তার কাল্পনিক স্বপ্নরাষ্ট্রের অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের একটি দ্বীপের স্বপ্নবিলাসী বর্ণনার মহাগ্রন্থ ‘ইউটোপিয়া (Utopia)’য় উদ্ভব ঘটে। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি তাঁর সেই যুগান্তকারী পুস্তক থেকেই নেয়া “For if you suffer your people to be ill-educated, and their manners to be corrupted from their infancy, and then punish them for those crimes to which their first education disposed them, what else is to be concluded from this, but that you first make thieves and then punish them.”—Thomas More, Utopia. এবার আমাদের দেশের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার দিকে তাকাই, কি দেখতে পাই? দেশের বেশীরভাগ মৌলিক সমস্যাগুলোর মুলেই দারিদ্রতা টমাস মোরের উপরোক্ত বানীকে সত্য প্রমান করেই।


সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী

“স্বপ্ন নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে। আমিও স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। এ দেশ, এ মাটি, এ মানুষকে নিয়েই আমার স্বপ্ন। আর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আমার স্বপ্নের অগি্নবীণা। বঙ্গবন্ধুর চেতনাই আমার বেঁচে থাকার প্রাণশক্তি, প্রতিদিনের পথচলার প্রেরণা, নতুন করে স্বপ্ন দেখার বাসনা, আমার জীবন ও রাজনীতি। তাই তো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে ঘিরে আমার সব স্বপ্নের রাজনীতির জালবোনা।” বলেছেন কালের কণ্ঠের সূচনা সংখ্যায় একটা লেখায় বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ।
আসলেই তাই; শেখ মুজিবর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী‘ পড়ে আর তার রাজনৈতিক জীবনবোধ নিয়ে পড়লে এমনটিই আমরা বুঝতে পারি। একজন ইউটোপিয়ানিস্ট হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কোন তুলনা নেই বাংলার রাজনীতিতে। তাই তাঁর হাত ধরেই আমরা সকল প্রকার বৈষম্যহীন অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত ইউটোপিয়ান বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে চাই। তা কীভাবে?

এইবার কিছু দৃষ্টান্ত দেখি, আমেরিকার জাতির পিতা জর্জ ওয়াশিংটন, সফল ও সবচে প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়ক আব্রাহাম লিংকন ও তাবৎ দুনিয়ার অসহযোগ আন্দোলনের মহান নেতা এবং ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর নামে গঠিত ফাউন্ডেশন সমূহ সম্পর্কে প্রথমে আলোচনা করে তারপর এই বাংলার সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎসর্গ করে ‘বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন‘-এর প্রয়োজনীয়তা ও অনিবার্যতা এবং তার কার্যক্রম কি হতে পারে তার উপর প্রাসঙ্গিক আলোকপাত করব।

জর্জ ওয়াশিংটনঃ
১৯২২ সালে একদল কর্মঠ ও দূরদর্শী তরুন মিসেস ভিভিয়ান মাইনর ফ্লেমিং এর নেতৃত্বে কেনমোর ক্রয় করেন (জর্জ ওয়াশিংটনের মৃত্যুর ১২৩ বছর পর);কেনমোর ছিল ১৭৭৫ সালে ফ্রেড্রিক্সবার্গে নির্মিত একটি বাড়ি যা জর্জ ওয়াশিংটনের বোন বেটি ও তাঁর স্বামী কর্নেল ফিল্ডিং লুইস নির্মাণ করেছিলেন। কেনমোর রক্ষার আন্দোলনের এক পর্যায়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট কেলভিন কুলিডজ বলেছিলেন ‘এইটা এর আত্মরক্ষার্থেই করা উচিৎ। যা দেশপ্রেমিক আমেরিকান হিসেবেই করা উচিৎ!’


George Washington (Feb 22, 1732 [O.S. Feb 11, 1731]– December 14, 1799)
কেনমোর এ্যাসোসিয়েশন ১৯৯৬ সালে মাইলফলক হিসেবে তাঁর শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত পৈত্রিক নিবাসে একটি ফেরী ফার্ম করে যা এ্যাসোসিয়েশনের অর্থনৈতিক শক্তি যোগাত। এরকম নানা ঘটনাবহুল উত্থানের পর ২০০৮ সালে কেনমোর এ্যাসোসিয়েশনকে নাম পরিবর্তন করে করা হয় ‘দ্যা জর্জ ওয়াশিংটন ফাউন্ডেশন’। ‘দ্যা জর্জ ওয়াশিংটন ফাউন্ডেশন’-এর মিশন নির্ধারণ করা হয় এমন- ‘The mission of The George Washington Foundation is to enhance the public understanding and appreciation of the lives, values, and legacies of George Washington, Fielding and Betty Washington Lewis, and their families’।
‘দ্যা জর্জ ওয়াশিংটন ফাউন্ডেশন’ হচ্ছে একটি বেসরকারি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান যার সদরদপ্তর ছিল তাঁর স্মৃতিবিজড়িত জন্মস্থান ফ্রেড্রিক্সবার্গ, ভার্জিনিয়া। ফাউন্ডেশনটির সকল কার্যক্রম চলে স্বতঃস্ফূর্ত দাতা ও স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায়।

আব্রাহাম লিংকনঃ

দ্যা আব্রাহাম লিংকন ফাউন্ডেশন’ বা এএলএফ (ALF; The Abraham Lincoln Foundation) স্থাপিত হয় ১৯৯৬ সালে (অর্থাৎ আব্রাহাম লিংকনের মৃত্যুর প্রায় ১৩১ বছর পর) এটিও একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি জনসাধারণের ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বতঃস্ফূর্ত দাতব্য সাহায্য উপহারের অর্থায়নে চলে। প্রতিষ্ঠানটি ইউনিয়ন লীগের কোষাগার গড়ে তোলে যা জনস্বার্থে ভ্রমণ, প্রদর্শনী, সেমিনার, আলোচনাচক্র, সম্মেলন এবং বিশেষায়িত অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।


Abraham Lincoln (February 12, 1809 – April 15, 1865)
দ্যা আব্রাহাম লিংকন ফাউন্ডেশন রাষ্ট্রের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করে যা জনগণকে আমেরিকার সিভিল ওয়ার ও ফিলাডেলপিয়া এবং তার এলাকার ইতিহাস নিয়ে গবেষণাকর্ম করে থাকে। এইসব গবেষণা কর্মে দ্যা আব্রাহাম লিংকন ফাউন্ডেশন এর সাথে সিভিল ওয়ার ইতিহাস কমিশন, আব্রাহাম লিঙ্কন দ্বিশততমবর্ষীয় কমিশন, লা সাল্লে বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্যান স্টেট ইউনিভার্সিটি সমন্বিতভাবে কাজ করে।
ফাউন্ডেশনের মিশন নির্ধারণ করা হয় এমন-“The mission of the Abraham Lincoln Foundation of the Union League is to preserve and develop the collections of the Union League and utilize them to educate and inspire the community.”

মহাত্মা গান্ধী ফাউন্ডেশনঃ

মহাত্মা গান্ধী ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালে অর্থাৎ তাঁর প্রয়াণের ৩৫ বছর পর। সুরুর হুদা এইটা প্রতিষ্ঠা করেন আর ফাউন্ডেশনটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট লর্ড এটেনবার্গ। মহাত্মা গান্ধী ফাউন্ডেশনের ভারতীয় সদর দপ্তর মুম্বাই, গান্ধীর নাতী তুষার গান্ধী ফাউন্ডেশনের ভারতীয় শাখার বর্তমান প্রধান।


Mohandas Karamchand Gandhi (2 October 1869 – 30 January 1948)

মহাত্মা গান্ধীর অহিংস চেতনাকে সরক্ষন করা আর বর্তমান প্রজন্মের কাছে তা উপস্থাপন করাই এই ফাউন্ডেশনের মূল উদ্দেশ্য। এইখানে উল্লেখ্য মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে ভারতে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাধিক ফাউন্ডেশন আছে। সবাই মোটামোটি একই মিশন নিয়ে ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন।

    বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনঃ

(প্রস্তাবিত ও কল্পিত)
একজন আমেরিকানের কাছে জর্জ ওয়াশিংটন ও আব্রাহাম লিংকনের যে প্রয়োজনীয়তা একজন বাঙ্গালীর কাছে কেবল বঙ্গবন্ধুই সফলভাবে এই দুই প্রয়োজন মিটিয়ে দেন। ওয়াশিংটন যেমন আমেরিকানদের মুক্তির সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা দিয়েছেন তেমনি বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীন বাংলা দিয়েছেন আবার আব্রাহাম লিংকন যেমন আমেরিকানদের অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছেন গেটিসবার্গ স্পীচে তেমনি বঙ্গবন্ধু আমাদের সঙ্গায়িত করেছেন তাঁর ৭ই মার্চের মহাকাব্যিক ভাষণে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু এই ভুখন্ডের মানুষের জন্যে এক প্রবাদ প্রতিম রাজনৈতিক নেতা সেই কারনেই বিবিসি’র জরিপে তিনিই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী। অথচ অতি দুঃখের বিষয় তাঁর মহা প্রয়াণের ৩৮ বছর পার হয়ে গেল আমরা একটি ফাউন্ডেশন গড়ে তুলতে পারি নাই। এদিকে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা দুই দফায় প্রায় ১০ বছর পার করলেও তেমন কোন উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিতে পারেন নি বা নিতে দেখিনি।


শেখ মুজিবুর রহমান (March 17, 1920 – August 15, 1975)

নামেমাত্র এক ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ ও তাঁর স্মৃতিবিজড়িত বাসভবন ধানমন্ডি ৩২ নং বাড়ীকে নামসর্বস্ব ‘বঙ্গবন্ধু যাদুঘর’ করা হলেও প্রতিষ্ঠানদ্বয় কার্যত নিষ্ক্রিয় । রাজনৈতিক দলাদলির শিকার হয়ে আওয়ামীলীগের ৫ বছর একটু সচল হলেও পরবর্তী ৫ বছরেরে বিএনপি-জামাতি স্বেচ্ছাচারী আগ্রাসণে কার্যক্রম সহকারে প্রতিষ্ঠানদ্বয় চলে যায় হিমাগারে। বঙ্গবন্ধুর নামে অনেক সংগঠন আছে তবে সবগুলাই চাটুকার সংগঠন যার বেশীরভাগই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় তৎপর থাকে অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আর বাকি সময় থাকে হিমাগারে।

বঙ্গবন্ধু শুধু এই বাংলার জাতির জনক নন তিনি বাংলাদেশের সবচে প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা ও রাষ্ট্র প্রধান। তাঁর সংগ্রামী বর্ণাঢ্য জীবন এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেহেতু একসুত্রে গাঁথা তাই এর সংরক্ষন, গবেষণা ও তার প্রচার তরুন সমাজকে করতে পারে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এবং রাষ্ট্রের ইতিহাস ও রাজনীতিতে সচেতন। যা দেশের এমন রাজনৈতিক ক্রান্তিলগ্নে হতে পারত একটি রাজনৈতিক আদর্শিক অবস্থান। বঙ্গবন্ধুর সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম, গনমানুষের মুক্তির সংগ্রাম ও বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস যেভাবে জড়িত তা শুধু অনন্য নয় বিশ্বের ইতিহাসেই বিরল।

বাকি সব বিশ্বনেতাদের মতই বিশ্বজুড়ে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ খ্যাত এই মহান নেতার নামে প্রতিষ্ঠিত এই ফাউন্ডেশন শুধু তাঁর ইতিহাস সংরক্ষণ, গবেষণা ও তার প্রচার করবে না গবেশনায় করবে সমসাময়িক রাষ্ট্রীয় সমস্যাবলীর সমাধান। শুধু তথাকথিত রাজনীতিক আর সুশীলদের মত কিছু বড় কথা আর সুশীলতা দেখানোর জন্যে এমন প্রস্তাব করছি না। আমি আগামী কিছুদিনের মধ্যেই আমার ব্যক্তিগত গবেষণার কিছু ভাবনা বা প্রস্তাবনা এই ফাউন্ডেশনের একজন স্বপ্নকথক হিসেবে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করব।

একজন বঙ্গবন্ধুকে তারা হত্যা করেছে কিন্তু তার চেতনাকে কখনই কেউ ধ্বংস করতে পারবে না আর ‘বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন’ এর মাধ্যমে আমরা তার স্মৃতিকেই শুধু ধরে রাখব না একই সাথে বাংলাদেশের প্রথম ইউটোপিয়ানিস্ট রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন গবেষণাধর্মী কাজ করে যাব।

‘যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’

    নোটঃ

ফেসবুকে ‘বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন’ নামে একটা পেজ খোলা হয়েছে। সবাইকে পেজে লাইক দিয়ে নতুন নতুন আইডিয়া বা রাষ্ট্র ভাবনা শেয়ার করার জন্য অনূরোধ করা হচ্ছে। আগামী কয়েকটি পর্বে আমি ‘বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন’-এর প্রস্তাবকর্তা হিসেবে আধুনিক বাংলাদেশ গঠনের কিছু নিজস্ব আইডিয়া বা প্রস্তাব তুলে ধরব। আশাকরি পাঠকেরা সবাই উপদেশ, পরামর্শ বা দিকনির্দেশনা দিয়ে কাজগুলোকে কল্যাণকর করে তুলতে সাহায্য করবেন।