অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম মারা যাবার পর আমি একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম ১৭ই মার্চ, ‘একজন অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম এবং মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে। এই সিরিজটির প্রথম পর্ব ছিল সেটি। ভেবেছিলাম অত্যন্ত দ্রুতই সিরিজের বাকি পর্বগুলো লিখে ফেলব। কিন্তু এর মধ্যে ব্লগারদের ধরপাকড় সহ দেশের রাজনীতির টালমাটাল অবস্থায় এ নিয়ে আর কাজই করা হয়ে উঠেনি। আজ বহুদিন পরে লেখাটির ২য় পর্ব পাঠকদের জন্য পেশ করছি। তবে এই সিরিজটি কেবল জামাল নজরুল ইসলামকে নয়, সামগ্রিকভাবে মহাবিশ্বকে বোঝার প্রয়াস হিসেবেই আমি দেখছি।
:line:
শূন্যতার শক্তি
আগের পর্বে আমরা দেখেছিলাম যে আইনস্টাইন তার আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে পাওয়া বিখ্যাত সমীকরণের বাম দিকে ল্যামডা নামের একটা কাল্পনিক ধ্রুবক যোগ করেছিলেন। আসলে আইনস্টাইনের আস্থা ছিল একটি সুস্থিত মহাবিশ্বের মডেলে – যে মহাবিশ্ব সংকুচিতও হয় না, প্রসারিতও হয় না। কিন্তু ১৯৩১ সালে যখন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবলের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ল মহাবিশ্ব আসলে প্রসারিত হচ্ছে, আইনস্টাইন তৎক্ষণাৎ তার সমীকরণে মহাজাগতিক ধ্রুবককে ‘তাত্ত্বিকভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ’ অভিধায় অভিহিত করে বাতিল করে দিলেন। সমীকরণে এই ধ্রুবক আমদানীকে অভিহিত করলেন ‘জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল’ হিসেবে।আইনস্টাইন তার বিখ্যাত সমীকরণ থেকে মহাজাগতিক ধ্রুবক বা ল্যামডাকে ‘ত্যাজ্য’ করে দেওয়ার পর থেকে অন্তত ছয় দশক পদার্থবিজ্ঞানীরা এ নিয়ে টু শব্দ করেননি। তবে আজ আমরা জানি আইনস্টাইন যদি তার সমীকরণে তাড়াহুড়ো করে এই মহাজাগতিক ধ্রুবক যোগ নাও করতেন, আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এর সহযোজন অপরিহার্যই ছিল। কিন্তু এই নতুন দিনের মহাজাগতিক ধ্রুবক আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা থেকে উঠে আসেনি, এসেছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার রহস্যময় দুনিয়া থেকে।
মজার ব্যাপার হল, নতুন ভাবে ফিরে পাওয়া এই মহাজাগতিক পদটির ধারণা আইনস্টাইনের পুরনো মহাজাগতিক ধ্রুবকের চেয়ে ভিন্ন। আইনস্টাইনের মূল ক্ষেত্র সমীকরণ ( $latex G_{\mu\nu} = 8\pi GT_{\mu\nu}$ )-এর উল্লেখ আগেই করেছি। এই সমীকরণটি মোটা দাগে স্থানের বক্রতার ($latex G_{\mu\nu}$ ) সাথে ভর-শক্তির বিন্যাসের ($latex T_{\mu\nu}$) একটা সম্পর্ক নির্দেশ করে। যখন আইনস্টাইন তার ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট’টি যোগ করেছিলেন, তিনি সেটা করেছিলেন সমীকরণের বাম দিকে ($latex G_{\mu\nu} + \Lambda g_{\mu\nu}= 8\pi GT_{\mu\nu}$) । তিনি এটাকে স্পেস বা স্থানের বৈশিষ্ট্য হিসেবেই দেখেছিলেন। কিন্তু আজ যখন আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাদের নতুন মহাজাগতিক ধ্রুবক নিয়ে ঘষামাজা করছেন, তাদের সেটা বসাতে হচ্ছে সমীকরণের ডান দিকে [ $latex G_{\mu\nu} = 8\pi G(T_{\mu\nu} + \rho_{vac}. g_{\mu\nu})$ ] । আর ডানদিকে বসানোর ফলে এর অর্থই গেছে রাতারাতি বদলে –
চিত্র: যখন আইনস্টাইন তার ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট’টি যোগ করেছিলেন, তিনি সেটা করেছিলেন সমীকরণের বাম দিকে। তিনি এটাকে স্পেস বা স্থানের বৈশিষ্ট্য হিসেবেই দেখেছিলেন। কিন্তু আজ যখন আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাদের নতুন মহাজাগতিক ধ্রুবক নিয়ে ঘষামাজা করছেন, তাদের সেটা বসাতে হচ্ছে সমীকরণের ডানে । আর ডানদিকে বসানোর ফলে এর অর্থই গেছে রাতারাতি বদলে (ছবির মূল উৎস: সায়েন্টিফিক আমেরিকান, সেপ্টেম্বর, ২০০৪)
অত্যন্ত বিপ্লবাত্মক এই অর্থ। এখন এই নতুন পদের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের এক ধরণের শক্তি ঘনত্বকে (energy density) তুলে ধরেন, মহাবিশ্ব প্রসারিত হলেও এর মান অপরিবর্তিত থাকে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। সাধারণ পদার্থের ক্ষেত্রে আমরা জানি যে, পদার্থ যত প্রসারিত হয়, তত এর ঘনত্ব কমতে থাকে। চিন্তা করে দেখুন, একটা ঘরে কোথাও বোটকা গন্ধ থাকলে থাকলে আমরা দরজা জানলা খুলে দেই। ফলে বদ্ধ বাতাস প্রসারিত হয়ে (মানে ঘনত্ব কমে গিয়ে) চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়, গন্ধের তীব্রতাও কমে আসে। কিন্তু মহাবিশ্বের শুরুতে ব্যাপারটা সেরকম ছিল না। তখন যে অদ্ভুতুড়ে পদার্থটা রাজত্ব করত, সেটা প্রসারিত করা হলেও এর ঘনত্ব থাকতো অপরিবর্তিত। ফলে এর ভর আর অধিকৃত আয়তনের সম্পর্কটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সমানুপাতিক। এর আয়তন যত বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তার ভর। আর তার চেয়েও অদ্ভুত ব্যাপারটা হল, যে মহাকর্ষ শক্তির হিসেবটা উঠে আসছে গণনা থেকে সেটা আকর্ষণমূলক নয়, বরং বিকর্ষণমূলক। বিকর্ষণমূলক অভিকর্ষ বল? নিউটন বেঁচে থাকলে দুঃখে অক্কাই পেতেন হয়তো। এত কষ্ট করে পৃথিবীর বুকে আপেলের পতনকে আকর্ষণ বল দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন, সেই ছবিটাই যাচ্ছে একেবারে উল্টে। সুকুমার রায়ের ‘উল্টো রাজার দেশ’ নামের কবিতাটার মত –
‘উল্টো রাজার দেশে রে ভাই
উল্টো ভাবে বাঁচা
ঘরের মেঝে উপর দিকে
মেঝের দিকে মাঁচা’।
এই উল্টো রাজার দেশের মতো ব্যাপারটাই ঘটেছিল মহাবিশ্বের শুরুতে, আর সেজন্যই প্রায় ভরহীন একেবারে শূন্যাবস্থা থেকে এই বিপুল বিশাল মহাবিশ্বের উদ্ভব হতে পেরেছে। পদার্থবিজ্ঞানীরা এ প্রসারণকে বলেন ‘ইনফ্লেশন’ বা স্ফীতি। এই স্ফীতি তত্ত্বের কথা আমার এই সিরিজে বারে বারেই ঘুরে ফিরে আসবে। কারণ শূন্য থেকে মহাবিশ্বের উৎপত্তির ভিত্তিভূমিই হচ্ছে স্ফীতি তত্ত্ব যা মূল ধারার পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জোরালো তত্ত্ব। স্ফীতি তত্ত্বের জনক এমআইটির অধ্যাপক বিজ্ঞানী অ্যালেন গুথ তার গবেষণায় দেখিয়েছিলেন এই স্ফীতির সময় স্থানের প্রসারণ এমনকি আলোর গতিকেও হার মানিয়েছিল। স্টিফেন হকিং এবং লিওনার্ড ম্লোডিনো তাদের বিখ্যাত ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইয়ে রসিয়ে রসিয়ে লিখেছেন এভাবে[1] –
‘আপনি যদি জিম্বাবুয়ের অধিবাসী না হন, যেখানে সম্প্রতি মুদ্রাস্ফীতি ২০০,০০০,০০০ শতাংশকেও ছাড়িয়ে গেছে, তাহলে হয়তো স্ফীতি শব্দটা তেমন বিস্ফোরক শোনাবে না। কিন্তু একদম রয়েসয়ে করা অনুমান অনুযায়ীও মহাজাগতিক স্ফীতির সময় মহাবিশ্ব ১,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ গুণে স্ফীত হয়েছিলো মাত্র .০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০১ সেকেন্ডে। এ যেন একটা ১ সেন্টিমিটার ব্যাসের মুদ্রা হঠাৎ করে ফুলে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির দশ মিলিয়ন গুণ বড় হয়ে গেলো। শুনে মনে হতে পারে এতে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব লঙ্ঘিত হচ্ছে, কারণ আমরা জানি কোনো কিছুই আলোর গতির চেয়ে দ্রুত যেতে পারে না, কিন্তু আসলে তা নয়। কারণ গতির এই সীমা স্থান-কালের নিজস্ব প্রসারণের উপর খাটে না’।
লোরেন্স ইনভ্যারিয়েন্স বলে একটা পদ আছে পদার্থবিজ্ঞানে। এই পদ হিসেবে নিয়ে আপেক্ষিকতার নানা ধরণের জলিল সব গণনা করেছেন বিজ্ঞানীরা। সেখান থেকে তারা দেখেছেন, এই শক্তি-ঘনত্ব কেবল থাকতে পারে ‘এম্পটি স্পেস’ বা শূন্য স্থানে। কাজেই, শূন্যতাকে আমরা সাধারণভাবে যে রকম শূন্য মনে করি, সেরকম সাদামাঠা সে নয়। এ এক রহস্যময় শক্তির আধার যেন। নামে ‘শূন্য’ হলেও এর সূক্ষ্ম স্তরে সবসময়ই নানান ধরণের প্রক্রিয়া ঘটে চলেছে। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন সেখানে পদার্থ-কণা এবং প্রতিপদার্থ কণা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৈরি হচ্ছে, আবার তারা নিজেকে সেই শক্তিতে বিলীন করে দিচ্ছে। এই কণাগুলোকে আমরা বলি অসদ কণা বা ভার্চুয়াল পার্টিকেল। আর অসদ কণা তৈরির এই চলমান প্রক্রিয়াটিকে আমরা চলতি কথায় বলি ‘ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন’। এই ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের ব্যাপারটা আমরা খালি চোখে না দেখলেও নানা ধরণের সূক্ষ্ম পরীক্ষার মাধ্যমে এর অস্তিত্ব সনাক্ত করা গিয়েছে। সেই ১৯৪৭ সালের দিকেই বিজ্ঞানী উইলিস ল্যাম্ব পরীক্ষার সাহায্যে প্রমাণ করেন যেন অসদ কণার প্রভাব গোনায় না ধরলে ডিরাক সমীকরণের মাধ্যমে হাইড্রোজেন পরমাণুর শক্তিস্তরের গণনা কখনোই সঠিক ফলাফল দিবে না। সত্যিই তাই। তার এই পরীক্ষণকে বিজ্ঞানের জগতে সবচেয়ে সফল পরীক্ষাগুলোর একটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়[2]। ল্যাম্ব তার অসদ কণিকা নিয়ে যুগান্তকারী গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। আর তখন থেকেই কিন্তু বিজ্ঞানীরা জানেন অসদ কণিকাগুলোর অস্তিত্ব সত্যি সত্যিই আছে[3]।
চিত্র: বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন যে শূন্য স্থানে অনবরত নানান ধরণের প্রক্রিয়া ঘটে চলেছে, তৈরি হচ্ছে ভার্চুয়াল পার্টিকেল বা অসদ কণিকা (ছবির উৎস – লরেন্স ক্রাউস, ইউনিভার্স ফ্রম নাথিং)।
আমরা যদি কোয়ান্টাম বলবিদ্যা থেকে পাওয়া নতুন বাস্তবতাকে মেনে নেই, তবে নতুন চোখে শূন্যতাকে দেখতে হবে আমাদের। কারণ, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার চোখে শূন্যতা বলে সেভাবে কিছু নেই। সেখানে প্রতিমুহূর্তেই অসদ কণিকাগুলো একেবারে যেন ভুতের মতো হুস্ করে নাকের ডগায় উদ্ভূত হচ্ছে আবার সেখানেই তিরোহিত হচ্ছে। এভাবেই তারা শূন্যস্থানে শক্তি সরবরাহ করে চলেছে অনবরত। কাজেই শূন্যস্থানের মধ্যে শক্তি আসলে লুকিয়ে আছে। এই লুকিয়ে থাকা শক্তিটাই ইদানীং আমাদের মহাবিশ্বের উৎপত্তি আর পরিণতির পেছনে বিজ্ঞানীদের গবেষণার মূল নিয়ামক হয়ে উঠেছে যেন। ব্যাপারটি নজরে পড়েছিল সদ্য প্রয়াত বাঙালি বিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের চোখেও, সেই আশির দশকেই। তিনি তার ১৯৮৩ সালে লেখা বিখ্যাত ‘মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি’ (The Ultimate Fate of the Universe) বইয়ের ‘কৃষ্ণবিবর চিরকালের জন্য নয়’ (A Black hole is not forever) অধ্যায়ে লিখেছিলেন[4] –
‘কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূত্র অনুযায়ী, ‘শূন্য’ স্থান আসলে সম্পূর্ণভাবে শূন্য নয়, বরং কণা এবং প্রতিকণাদের অসদ যুগলে (virtual pairs) পরিপূর্ণ, যা অব্যাহত ভাবে শূন্যস্থানে তৈরি হচ্ছে আবার সেখানেই বিলুপ্ত হচ্ছে। আগেই বলা হয়েছে যে কোন কণার বিপরীতে প্রকৃতিতে ‘প্রতিকণিকা’ থাকে – যার চার্জ মূল কণার বিপরীত, কিন্তু ভর সমান; আর এরা যুগল আকারে একেবারেই পরিশুদ্ধ শক্তি কিংবা বিকিরণ থেকে উদ্ভূত হতে পারে। এই কণা আর প্রতিকণার যুগলকে ‘ভার্চুয়াল’ বা অসদ বলা হচ্ছে কারণ, প্রকৃত কণাদের মতো এদের কণা ত্বরকের (particle detector) মাধ্যমে সরাসরি সনাক্ত করা যায় না। তাদের পরোক্ষ প্রভাব অবশ্য পরিমাপ করা যায়, এবং তাদের অস্তিত্ব সনাক্ত করা হয়েছে আহিত হাইড্রোজেন পরমাণুর বর্ণালি থেকে প্রাপ্ত ল্যাম্বের অপবর্তন (Lamb shift) থেকে। এই অসদ কণা তৈরি করার জন্য শক্তির যোগানটা আসে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি থেকে।… দেখে মনে হয় অসদ কণিকাগুলো যেন অনিশ্চয়তা নীতি দিয়ে পরিচালিত কোন ব্যাঙ্ক থেকে স্বল্পকালীন ঋণ নিয়ে নিজের অস্তিত্বকে বাস্তব করে তুলছে। এই ব্যাপারটিকে বলে ‘ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন’।
চিত্র: অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের ‘মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি’ (The Ultimate Fate of the Universe) বইয়ে ব্যবহৃত অসদ যুগলের (virtual pairs) ছবি এবং আনুষঙ্গিক ব্যাখ্যা।
গুপ্ত শক্তি
অবশ্য শূন্যতার মধ্যে শক্তি লুকিয়ে আছে এটা জানা গেলেও ঠিক কতটুকু শক্তি এর মধ্যে লুকিয়ে আছে সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা ঐক্যমত্যে পৌঁছতে পারেননি; ব্যাপারটি এখনো তাদের কাছে মূল্যবান গবেষণার বিষয়। মহাবিশ্বের ত্বরণ এবং প্রসারণের জন্য দায়ী যে গুপ্ত শক্তির (Dark energy) কথা আমরা ইদানীং হরহামেশা শুনি, তার পেছনে এই ‘শূন্য শক্তির’ ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়। অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম যখন তার ‘মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি’ নামের বইটি লিখেছিলেন তখন তিনি এবং সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা এই গুপ্ত শক্তির কথা জানতেন না। জামাল নজরুল ইসলামের ১৯৮৩ সালে লেখা বইটিতে সঙ্গত কারণেই গুপ্ত শক্তির কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। এই ব্যাপারটি জানা গিয়েছিল তার বইটি প্রকাশিত হবার ১৫ বছর পর। অনেকটা সৌভাগ্যক্রমেই সল পার্লমুটার আর ব্রায়ান স্মিট নামক দুইজন পদার্থবিদের সুপারনোভা নিয়ে ঐতিহাসিক পরীক্ষায় ব্যাপারটা বেরিয়ে আসে।
সে সময় বিজ্ঞানীদের সবাই ধারণা করতেন ১৩০০ কোটি বছর আগে যে মহাবিস্ফোরণ ঘটেছিল, তারপর থেকে মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে শুরু করেছে এবং সেই প্রসারণের হার নিশ্চয় সময়ের সাথে সাথে কমতে শুরু করবে। একটা টেনিস বল উপরে ছুঁড়ে দিলে যেমন উপরে উঠার সময় বলটার বেগ ধীরে ধীরে কমতে থাকে, তারপর মাধ্যাকর্ষণের টানে আবার আপনার হাতে ফেরত চলে আসে – ঠিক তেমনি মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানীরাও ভাবতেন মহাবিশ্বের প্রসারণ ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে পেতে একটা সময় থেমে যাবে, আর তারপর তা আবার ধীরে ধীরে ‘ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন’। তো মহাবিশ্বের প্রসারণটা ঠিক কি হারে কমছে সেটা বের করতেই ১৯৯৮ সালে নানা ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষার আয়োজন করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। সল পার্লমুটার আর ব্রায়ান স্মিটের টাইপ ১এ সুপারনোভা সংক্রান্ত পরীক্ষা থেকে যে ফলাফল পাওয়া গেল তা অবিশ্বাস্য! বিজ্ঞানীরা দেখলেন মহাবিশ্বের প্রসারনের হার আসলে কমছে না, বরং বেড়ে চলেছে। মানে মহাবিশ্বের মন্দন হচ্ছে না, হচ্ছে ত্বরণ। নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ এই আবিষ্কারটাই আইনস্টাইনের সমীকরণের বাতিল করে দেয়া সেই ‘মহাজাগতিক ধ্রুবক’ কে বিজ্ঞানের জগতে নতুনভাবে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
মহাজাগতিক ধ্রুবক সমস্যা
বিজ্ঞানীরা জানেন শূন্যতার মধ্যে শক্তির পরিমাণ মহাবিশ্বের সামগ্রিক গুপ্ত শক্তির চেয়ে বেশি হতে পারে না। বড় জোর প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে ১০-৮ আর্গ। অথচ কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সমীকরণগুলো সমাধান করে শূন্যতার শক্তির যে মান পাওয়া যায়, তা জলহস্তীর মত বিশালকায় – প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে ১০১১২ আর্গ। অর্থাৎ বাস্তব মানের চেয়ে কাগজে কলমে গণনা ১০১২০ গুন বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এটা একটা সমস্যা। ছোট খাট নয়, খুব বড় সড় সমস্যাই। সমস্যাটিকে পদার্থবিজ্ঞানে চিহ্নিত করা হয় ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট প্রবলেম’ বা ‘মহাজাগতিক ধ্রুবক সমস্যা’ হিসেবে। সমস্যাটির দিকে প্রথম নজর দিয়েছিলেন রুশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইয়াকভ জেলডোভিচ ১৯৬৭ সালে, যখন তিনি প্রথমবারের মত শূন্যস্থানের শক্তি-ঘনত্ব নির্ণয় করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তার পর থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবেই বিরাজ করছে বিজ্ঞানের জগতে। স্টিফেন ওয়েইনবার্গের ১৯৮৯ সালের গবেষণা প্রবন্ধে সমস্যাটির ভাল সারমর্ম পাওয়া যায়[5]। তবে সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা কিছুটা হলেও হদিস করতে পেরেছেন কেন তাদের গণনা আর বাস্তবতায় এত ফারাক হচ্ছিল। একটি গণনা থেকে দেখা গেছে ফার্মিয়নের মধ্যে যে ঋণাত্মক শূন্য শক্তি লুকিয়েছিল সেটা তারা গোনায় ধরেননি। সেটা গোনায় ধরলে গণনা আর বাস্তবতার ফারাক অনেক কমে আসে[6]। আরেকটি আভাস পাওয়া গেছে বিখ্যাত ‘হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপাল’ এর সঠিক ব্যবহারের মধ্যে। মহাবিশ্বের শূন্য শক্তি ঘনত্ব (vacuum energy density) নির্ণয় করা হয়েছে মহাবিশ্বের সকল শূন্য-বিন্দু শক্তি স্তরের যোগফল থেকে (sum over all the zero-point energy states)। এই যোগফল বের করার সময় ধরে নেওয়া হয়েছিল সেই স্তরগুলোর সংখ্যা এর আয়তনের সমানুপাতিক। কিন্তু সাম্প্রতিক ‘হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপাল’ থেকে জানা গেছে ব্যাপারটা আয়তনের সমানুপাতিক না হয়ে ক্ষেত্রফলের সমানুপাতিক হওয়াটাই যৌক্তিক, যেটা ঘটে কৃষ্ণবিবরের ক্ষেত্রে। আমাদের মহাবিশ্বের স্তরের সংখ্যা একই আয়তনের কৃষ্ণবিবরের চেয়ে বেশি হতে পারে না। এই অনুজ্ঞার ভিত্তিতে গণনা করে দেখা গেছে এর মান বাস্তব মানের খুব কাছাকাছি চলে আসে[7]। মহাজাগতিক ধ্রুবকের মান গণনা নিয়ে সমস্যা থাকলেও মহাবিশ্বের সার্বিক ছবিটা আঁকতে সেটা কিন্তু কোন সমস্যা তৈরি করছে না। লরেন্স ক্রাউস এবং টার্নার সহ বিজ্ঞানীরা মনে করেন কিছু অজানা প্রক্রিয়া থাকতে পারে, যেটা এখনো বিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করতে পারেননি। এর খোঁজ পাওয়া গেলে দেখা যাবে, সমীকরণের পদগুলো কাটাকাটি করে একে সেই বাস্তবতার কাছাকাছি স্বল্প মানে নামিয়ে এনেছে[8]।
অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামও মহাজাগতিক ধ্রুবকের মান নির্ণয়ে বেশ কিছু অগ্রসর কাজ করেছিলেন আশির দশকে। তিনি তার ‘মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি’ শিরোনামের বইয়ে কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্টকে উল্লেখ করেছিলেন ‘কসমোলজিক্যাল টার্ম’ বা ‘মহাজাগতিক পদ’ হিসেবে। তিনি লিখেছিলেন,
এই টার্মটি প্রাথমিকভাবে তার সমীকরণে প্রবর্তন করেছিলেন আইনস্টাইন স্বয়ং, সমীকরণের সমাধান হিসেবে একটি সুস্থিত মহাবিশ্ব খুঁজে পেতে। আইনস্টাইন চাচ্ছিলেন সমীকরণ থেকে একটা মহাজাগতিক সমাধান খুঁজে পেতে। তখনো হাবল মহাবিশ্বের প্রসারণ সংক্রান্ত আবিষ্কারটি করেননি। আইনস্টাইনের এক ধরণের ধারণা জন্মেছিল যে, সময়ের সাথে সাথে মহাবিশ্বের কাঠামোগত কোন বড় পরিবর্তন হয় না, এবং মহাবিশ্ব মোটা দাগে স্থিতিশীল, মানে সুস্থিত। তার মূল সমীকরণে কিন্তু এই সুস্থিত মহাবিশ্বের কোন ব্যাপার স্যাপার ছিল না, বরং আইনস্টাইন মহাবিশ্বকে স্ট্যাটিক বানানোর জন্যই এই টার্মের আমদানি করেছিলেন। এই আমদানি করা পদটি সমীকরণের সরলতাকে বিনষ্ট করেছিল, এবং পরবর্তীতে আইনস্টাইন এই পদ আমদানির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, যদি তিনি নিজের মনের উপর নির্ভর না করে মূল সমীকরণের উপর নির্ভর করতেন, তবে তিনি হয়ত অনেক আগেই মহাবিশ্বের প্রসারণের আভাস দিতে পারতেন।
জামাল নজরুলের বইটি যে বছর প্রকাশিত হয়েছিল সেই ১৯৮৩ সালে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তিনি অবশ্য সেখানে মহাজাগতিক পদকে মহাজাগতিক ধ্রুবক হিসেবেই উল্লেখ করেছিলেন। ফিজিক্স লেটার জার্নালে প্রকাশিত এ প্রবন্ধটির পুরো শিরোনাম ছিল – ‘মহাজাগতিক ধ্রুবক এবং সার্বিক আপেক্ষিকতার চিরায়ত পরীক্ষণ’[9]। এ প্রবন্ধে তিনি চিরায়ত পদ্ধতিতে ধ্রুবকের মান নির্ণয়ে প্রয়াসী হন। তিনি এ পদ্ধতিতে মহাজাগতিক ধ্রুবকের যে মান নির্ধারণ করেছিলেন তার উচ্চ সীমা ছিল প্রতি বর্গমিটারে ১০-৩৮ এর মত। তিনি বুধ গ্রহের অনুসূরের পরিবর্তন বা চলন অবলম্বন করে এই সীমাটি বের করেছিলেন। অনেক পাঠকই হয়তো জানেন যে, এই বুধগ্রহের অনুসূর চলনকে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব ছাড়া সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না বহুদিন ধরেই। ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন প্রদত্ত আপেক্ষিক তত্ত্ব যখন ব্যাপারটিকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারল, তখনই আইনস্টাইন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে তাঁর দেয়া আপেক্ষিকতা তত্ত্ব সঠিক। অধ্যাপক ইসলামও এই বুধগ্রহের অনুসূর চলনকে উপজীব্য করে মহাজাগতিক ধ্রুবক গণনা করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিছুদিন আগে মুক্তমনা ব্লগার এবং জ্যোতির্পদার্থবিদ ড. দীপেন ভট্টাচার্য বিডিনিউজ২৪ পত্রিকায় অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের কাজের উপর মনোজ্ঞ লেখা লিখেছিলেন ‘অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম – একটি কর্মময় জীবন’ শিরোনামে। তার প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, তখনকার দিনে ইউরোপের বিভিন্ন নামকরা বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রবন্ধ জমা দেওয়া হত কোন লব্ধ প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী মারফত। জামাল ইসলামের প্রবন্ধ জমা দিতেন ফ্রেড হয়েল, স্টিফেন হকিং, মার্টিন রিজের মত বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা। যেমন, মহাজাগতিক ধ্রুবকের মান সংক্রান্ত জামাল নজরুলের গবেষণাপত্রটি প্রবন্ধটি প্রকাশ করার জন্য সম্পাদকের কাছে জমা দিয়েছিলেন বর্তমান ব্রিটিশ রাজকীয় জ্যোতির্বিদ মার্টিন রিজ। আর গবেষণাপত্রটি লেখায় অনুপ্রেরণা আর পরামর্শ যুগিয়েছিলেন এ যুগের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। তবে এখানে বলে রাখা দরকার, অধ্যাপক নজরুল তার গণনা থেকে ধ্রুবকের মান ১০-৩৮ পেলেও বর্তমান পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এই ধ্রুবকটির মান প্রতি বর্গ মিটারে ১০-৫২ বলে মনে করা হয়।
কাজেই সারমর্ম দাঁড়ালো – যে মহাজাগতিক পদটিকে আইনস্টাইন তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হিসেবে চিহ্নিত করে বাতিল করেছিলেন, সেটাকেই আমরা আবার আশির দশকে পূর্ণোদ্দমে ফিরে আসতে দেখলাম ইনফ্লেশন বা স্ফীতিতত্ত্বের মাধ্যমে। কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে মহাবিশ্ব উদ্ভূত হবার পর যে বিকর্ষনশক্তি মহাবিশ্বকে প্রসারিত করে দ্রুত স্ফীতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল, আজ সেটা এই মহাজাগতিক ধ্রুবকের সাথেই সম্পর্কিত বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। আর ১৯৯৮ সালের পর রহস্যময় ‘ডার্ক এনার্জি’ বা গুপ্ত শক্তির খোঁজ পেলেন বিজ্ঞানীরা, তার অস্তিত্বের পেছনেও সম্ভবত রয়েছে এই ধ্রুবকেরই জটিল মারপ্যাঁচ। এগুলো বোঝা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, এই বিকর্ষণ শক্তি আর গুপ্ত শক্তির প্রভাব পড়েছে বিজ্ঞানীদের মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি নিয়ে ইদানীংকার ভাবনাতেও। তবে সেটা আর এখন নয়, এ নিয়ে কিছু কথা বলা যাবে পরবর্তী পর্বে …
চলবে
তথ্যসূত্র
[1] Stephen Hawking & Leonard Mlodinow, The Grand Design, Bantam, 2010 (অনুবাদ, তানভীরুল ইসলাম, মুক্তমনা)
[2] Lawrence M. Krauss, A Universe from Nothing: Why There Is Something Rather than Nothing, Free Press, 2012.
[3] Gordon Kane, Are virtual particles really constantly popping in and out of existence? Or are they merely a mathematical bookkeeping device for quantum mechanics? Scientific American, 2006
[4] Jamal N. Islam, The Ultimate Fate of the Universe, Cambridge University Press; 1983, page 91.
[5] Steven Weinberg, The cosmological constant problem, Reviews of Modern Physics, Volume 61, Issue 1, pp.1-23, January 1989
[6] Victor J. Stenger, The Fallacy of Fine-Tuning: Why the Universe Is Not Designed for Us, Prometheus Books (April 26, 2011)
[7] Victor J. Stenger, The Problem with the Cosmological Constant, CSI, Volume 21.1, Spring 2011.
[8] Lawrence M. Krauss and Michael S. Turner, A Cosmic Conundrum, Scientific American 15, 66 – 73 , 2006
[9] J.N. Islam, The cosmological constant and classical tests of general relativity. Physics Letters A, Volume 97, Issue 6, 5 September 1983, Pages 239–241.
@ অভিজিত দা,
১. আমাদের মহাবিশ্বে কি শুন্য স্পেস আছে বা কৃত্তিমভাবে কি সৃষ্টি করা যায়? না থাকলে শূন্য স্থানের পরীক্ষা গুলো কিভাবে করে?
২. শূন্য স্থান হতে সমান ভরের ইলেকট্রন আর পজিট্রন কিভাবে সৃষ্টি হয়? এটা কি পজিটিভ ভর আর নেগেটিভে ভর?
বরাবরের মতই ভাল লাগল পড়তে। এই লেখায় অনেক পুরনো বিষয়য়ের উল্লেখ আছে, তবে নতুন অনেক কিছুও উঠে এসেছে, বিশেষ করে জামাল নজরুল স্যারের কাজগুলো আস্তে আস্তে উঠে দৃশ্যমান হচ্ছে।
এ ধরনের উদাহরণ দুর্বোধ্য বিজ্ঞানকে সাধারণ পাঠকদের কাছে সহজবোধ্য করে তোলে। আমার ক্ষেত্রে যেমন করেছে।
পরবর্তী পর্বগুলো আরও জমজমাট হবে, এমনটাই প্রত্যাশা!
অভিজিৎদা , দারুণ হয়েছে বরাবরের মতো । এখানে একটা বিষয় বলতে ইচ্ছে করে যে, আইনস্টাইন কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে কোন কোন ব্যাপারে উপেক্ষা করে গেছেন । আমার কাছে এ মূহুর্তে কোন সূত্র নেই । বিভিন্ন প্রবন্ধ পড়ে হয়ত: আমার ধারণাটা হয়েছে । আইনস্টাইন কি কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে উপেক্ষা করাতে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন নি ? কিংবা উনি আপেক্ষিক তত্ত্ব কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে প্রাধান্য দিয়েছেন – কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন । কিন্তু আজকের আধুনিক পদার্থবিদ্যা তো কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ছাড়া একেবারেই অচল । যা হোক আপনার কাছ থেকে হয়ত বিশদ ব্যাখ্যা পাবো। আর একটা কথা,চবিতে পড়ার কারণে স্যারকে অনেকবার সামনাসামনি দেখেছি । আমার মতো থার্ড ডিগ্রির সাহস হয়নি স্যারের সাথে কথা বলার । বিভিন্ন বিয়ে কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানেও স্যারকে দেখেছি । সাহসে কুলোয়নি । বেশ ক’বছর আগে ( সম্ভবত: ২০০৮ সালে ) ভারতের বিজ্ঞানী পথিক গুহ দেশ পত্রিকায় বিজ্ঞান বিষয়ক একটা গল্প (উনি বিজ্ঞান বিষয়ক বেশ কিছু গল্প লিখেছেন) লিখেছিলেন, সেখানে একটা মহাকাশ সেমিনারের ঘটনা ছিল । ছিল জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের নাম । এর পরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্যারের সাথে দেখা হয়েছে । বলতে পারিনি । তবে কথাটা আমাদের এক ডিপার্টমেন্টের ম্যডাম ( যে কিনা স্যারের আন্ডারে এম.ফিল করেছে) তাঁর মাধ্যমে জানিয়েছিলাম । স্যারকে নিয়ে আপনার লেখাটা সত্যি প্রশংসার দাবীদার । সেসাথে জানলাম অনেক কিছুই । কৃষ্ণবিবর বইটা বুকশেলফে আছে । বের করে পড়তে হবে । আর একটা কথা, এইমাত্র এক সাহিত্য পাঠক অনুরোধ করলো The ultimate fate of the universe বইটা স্যারের পরিবারের অনুমতি নিয়ে অনুবাদ করলে বিজ্ঞান পাঠক উপকৃত হতো । আপনার মতামত জানার অপেক্ষায় রইলাম । ভাল থাকবেন ।
ভালো লাগল। আরও কিছু জানার জন্য মহাজাগতিক বিসয়গুলোর বাংলা ই বুক পাওয়ার উপায় কি?
কঠিন বিষয় তবে কেন যেন বেশ সহজ লাগলো 🙂
আসলেই :-O নতুন কিছু জানলাম; আসলেই আমার জ্ঞান এখনো প্রাথমিক বিন্দুতেই রয়ে গিয়েছে (U)
অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের ‘মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি’ (The Ultimate Fate of the Universe) না পেলেও ‘কৃষ্ণ বিবর’ বইটি সংগ্রহের চেষ্টা করবো; যদিও যথেষ্ট সন্দেহ আছে এমন গুরুগম্ভীর বই আমার দ্বারা পড়ে শেষ করা সম্ভব হবে কিনা সে বিষয়ে :-s
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম :))
অনবদ্য একটা সিরিজ হচ্ছে। আশাকরি পরের পর্বগুলো সল্পবিরতিতেই পাবো।
গুপ্তশক্তি, মহাজাগতিক ধ্রুবক, ইন্ফ্লেশন এই ব্যাপারগুলো আজকাল খুব কৌতূহল সৃষ্টি করেছে মনে। ফর্মালি পড়াশুনা করতে হবে এ নিয়ে। আলসেমিতে হয়ে উঠছে না। এই লেখাটা পুরোণো আগ্রহে উদ্যম জোগালো। 🙂
খুবই ভাল লাগল। বাংলায় এই জিনিসগুলো সহজ ভাবে নিয়ে আসতে আপনি সিদ্ধহস্ত।
উনি জানতেন যে ওনার প্রাপ্ত উচ্চ সীমাটির মানটি খুবই বড়। কারণ ঐ সময়েই মহাজাগতিক প্যারামিটারগুলো ব্যবহার করে তিনিই দেখিয়েছিলেন যে Λএর মানটি ১০^-৫০ এর কম হবে। বুধ গ্রহের অনুসূর ব্যবহার করে মান বের করাটা একটু ক্লাসিক, তাই হয়তো সেটা ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। 🙂
অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের অবস্থান স্টিফেন হকিং এর সারিতে, আইনস্টাইনের সারিতে। আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার।
কিন্তু তিনি আবার ধার্মিকও ছিলেন। এটা আমার কাছে সাংঘর্ষিক বলেই মনে হয়। জীবনের প্রাক্কালে মগজের একটা অংশে কিছু ঢুকে থাকলে তা যেন পাথরের (stone) মতই কঠিন হয়ে থাকে। রান্না-বান্নার যত উৎকর্ষই হউক, ছোট বেলায় মায়ের হাতের রান্নার উপরে কিছু হয় না। এটা মগজে লেপ্টে থাকে।
লেখককে ধন্যবাদ আর কী দিব। তিনি বিজ্ঞানের প্রান্তিক বিষয় গুলোতে একজন সিদ্ধহস্ত প্রতিষ্ঠিত লেখক।
অনেকদিন যাবৎ দ্বিতীয় পর্বের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। পড়ে ভাল লাগল। সেই সাথে কিছু কৌতূহলও জাগল।
কণিকাগুলো যদি অনেকগুলো স্ট্রিং এর সমষ্টি ধরা হয় তবে শূন্যতে সৃষ্ট কণিকাগুলো কত মাত্রার হবে? কারণ স্ট্রিং ১০,১১ এমনকি ২৬ মাত্রারও হতে পারে।
তারমানে মহাবিশ্বকে দ্বিমাত্রিকভাবে দেখাটাই তো যোউক্তিক,তাই নয় কি? আমরা তবে ত্রিমাত্রিক দেখি কেন?
@সুদীপ্ত শেল্ডন,
চমৎকার প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ।
এ ব্যাপারগুলো এখনো অনুমানের উপরেই নির্ভরশীল। স্ট্রিং থিওরির মাত্রা নিয়ে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন। এম তত্ত্ব বলছে বস্তু কণা এবং তা দিয়ে গঠিত আমাদের বিশ্বজগত আসলে ১১ মাত্রার। বেশিরভাগ স্ট্রিং তাত্ত্বিক সেটার গণিত মেনে নিলেও, পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ বলতে যা বুঝি তা কিন্তু আসেনি। ফ্ল্যাট স্পেস একটা থিওরি ২৬ মাত্রার কথা বলছে বতে তবে এগুলো এখনো গাণিতিক বিমূর্ততাই। অন্যদিকে ভার্চুয়াল পার্টিকেলগুলোর কিন্তু পরীক্ষালব্ধ অনেক প্রমাণই পাওয়া গেছে (কাসিমিরের পরীক্ষা, ল্যাম্ব-এর পরীক্ষা ইত্যাদি)। বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম লেভেলে অসদ কণিকার অস্তিত্বকে বাস্তবতা হিসেবেই মেনে নিয়েছেন (দেখুন এখানে)। যদি স্ট্রিং তত্ত্ব সঠিক বলে প্রমাণিত হয়, তবে অন্য বস্তুকণার মতোই হয়তো সেগুলো ত্রিমাত্রিক না হয়ে বহুমাত্রিক হতে পারে, কিন্তু সেটা জানার জন্য আমাদের ভবিষ্যৎ জ্ঞানের উপর নির্ভর করা ছাড়া গতি নেই, এই মুহূর্তে।
এটাও এমন একটি বিষয়, যা কিনা গবেষকদের জন্য গবেষণার একটি সজীব শাখা। স্ট্রিং তত্ত্বের মতই কিংবা তার চেয়েও হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপাল হাইলি স্পেকুলেটিভ, এবং এটারও এখনো গণিত এবং ‘ইন্টারপ্রেটেশন’ ছাড়া কোন পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ পাওয়া যায় নি। মহাবিশ্ব যদি হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপালের কথা অনুযায়ী কেবল দ্বিমাত্রিক প্লেনের প্রজেকশন হয়, তবে আমরা ত্রিমাত্রিক দেখি কেন – এটা একটা ভাল প্রশ্ন। আমাদের দেখা আর বাস্তবতাতে পার্থক্য থাকতেই পারে। আমরা প্রতিদিন সূর্যকে পূব দিকে উঠতে দেখি, পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে দেখি পূব থেকে পশ্চিমে, যদিও জানি বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেও এটা হতে পারে। আর সিনেমার হলোগ্রামগুলোকেও তো ত্রিমাত্রিক বলে ভুল হয়, যদিও সেগুলো দ্বিমাত্রিক পেলের উপরেই প্রজেকশন। Raphael Bousso যিনি এই হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপাল নিয়ে কাজ করেছেন, তার মতে, “”The world doesn’t appear to us like a hologram, but in terms of the information needed to describe it, it is one,” মানে মহাবিশ্বকে হলোগ্রামের মত না মনে হলেও মহাবিশ্বের জটিল তথ্যগুলো কোন একটা দ্বিমাত্রিক প্লেনে সংরক্ষিত হয়। কিন্তু এটাই যে সত্যি তা হলফ করে বলার উপায় নেই। লিওনার্ড সাসকিন্ডকে উদ্ধৃত করেই বলি –
‘There are two descriptions of reality: either reality is the bulk of spacetime surrounded by the boundary, or reality is the area of the boundary. So, which description is real? There is no way to answer that … এট লিস্ট নাও!
ভাল থাকুন।
@অভিজিৎ,
হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপালের ব্যাপারটা কিছুটা হলেও ধরতে পেরেছি। আরও পড়তে হবে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু খটকা লাগল-
যতদূর জানি, হার্টলে-হকিং এর একটা প্রস্তাব আছে যা no boundary proposal নামে পরিচিত। হকিং এ সম্পর্কে বলেন-
Stephen Hawking,The Theory of Everything,jaico Publishing House,2008,page 88.
লিওনার্ড সাসকিন্ডের উক্তিটি এক্ষেত্রে কি no boundary proposal এর বিরোধিতা নয় কি?