ছোটবেলা থেকে একটা অসম্ভব সময়ের কথা শুনে এসেছিলাম। হাজার বছরের ভীতু বাঙালিরা হঠাৎ করে কীভাবে যেন সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটা বিশাল ব্যাপার ঘটিয়ে ফেলেছিল! নিজেদের দাবী-দাওয়া আদায় করার জন্য ধর্মীয় সংকীর্ণতার গন্ডি থেকে মুক্ত হয়ে তারা করে ফেলেছিলো নিজেদেরকে মুক্তি করার একটা যুদ্ধ- মুক্তিযুদ্ধ! বাঙালির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সময় একাত্তুর রচিত হয়েছিলো সেইসব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তাক্ত হাতে। ছোটবেলা থেকেই যতবার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়েছি, দেখেছি, কিংবা শুনেছি স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রের অসম্ভব উন্মাদনাময় গানগুলি, দারূন একটা ভালোলাগায় মন ভরে গিয়েছে। চারিদিকে হাজারো হতাশার মধ্যে বাস করেও দেশকে নিয়ে আশাবাদের শেষ সলতেটুকুর যোগান দিয়ে এসেছে এই মু্ক্তিযুদ্ধ, এই একাত্তুর। এই দেশকে দিয়ে কিছুই হবে না- রাতদিন এই আপাত সত্যকে চিৎকার করে বলার পরও মন থেকে বিশ্বাস করতে পারি নি কখনোই, যে জাতি একাত্তুর সৃষ্টি করতে পারে, সেই জাতি এত সহজে হারতে পারে!
দিনের পর দিন এই বিশ্বাস হারাচ্ছিলাম। পাকিস্তান নামক একটা অভিশপ্ত দেশ থেকে মুক্ত হয়ে আবার সেই পথে হাঁটার লক্ষণ দেখে, হাজার বছরের বাঙালির যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সেই চেতনাকে আবার উল্টো পথে সাম্প্রদায়িকতার দিকে অগ্রসর হতে দেখে, স্বাধীন বাঙলাদেশে স্বাধীনতার বিরোধীদের জাতীয় পতাকা লাগানো গাড়িতে চড়ে মনের সুখে দিগ্বিদিক বেড়াতে দেখে, রাজনৈতিক নেতাদের নিজ স্বার্থের জন্য দুর্নীতির কাছে পুরোপুরি বিক্রি হয়ে যেতে দেখে মনে হয়েছিল, একাত্তুর ছিল নিছকই এক দুর্ঘটনা। ক্ষণিকের অর্থহীন আবেগে সারা দেশের মানুষ গণহিস্টিরিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়া রোগীর মত হঠাতই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো সেদিনের সেই অবিশ্বাস্য যুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধটাই একটাসময় অর্থহীন এক আবেগে পরিণত হয়ে যাচ্ছিল আমার কাছে, সাথে অর্থহীন হয়ে যাচ্ছিল হৃদয়ের গভীরের কোথাও লুকানো টিমটিম করে জ্বলা সেই আশাটাও।
কিন্তু আবারো হঠাৎ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার হয়ে গেল! মানুষ জেগে উঠল! অনেকে মনে করে সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই একটা সময় স্বাভাবিক হয়ে যায়, সবকিছুই মানুষ একসময় ভুলে যায়। মিথ্যে কথা! মানুষ যাকে ভালোবাসে খুব ভেতর থেকে, তাকে সে কখনোই ভুলতে পারে না। আমরা যারা একাত্তুরকে সরাসরি দেখি নি, কিন্তু সরাসরি না দেখেও খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছি মন থেকে, আমরা কখনোই ভুলতে পারি নি সেই সময়ের অদ্ভূত আবেগের কথা, লাখো শহীদের নির্ভযে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার কথা, কিংবা হাজারো মেয়ের সম্ভ্রম হারানোর গ্লানির কথা। আর ভুলি নি আমাদের আদি পাপের কথা। এই দেশের আলো-ছায়া-জলে বেড়ে উঠে যারা এই দেশেরই হাজার হাজার মানুষকে খুন করেছে সেই জানোয়ারতুল্য রাজাকার-আলবদর-আলশামস্-দের বিচার না হওয়ার বেদনা আমরাও ভোগ করেছি, আমরাও অবাক হয়েছি যখন দেখেছি তাদেরই কেউ কেউ এদেশের মন্ত্রী হয়ে বসেছে, আমরা বিস্ময়ে পাথর হয়েছি যখন দেখেছি তারা যে দেশের বিরোধিতা করেছিলো সেই দেশেই বিশাল রমরমা ব্যবসা খুলে বসেছে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে! আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু যাদের চেতনায় আছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, কখনোই ক্ষমা করতে পারিনি এই নরপিশাচদের। তাই যখন মানবতাবিরোধী অপরাধের ট্রাইব্যুনাল কসাই নামে পরিচিত এক রাজাকারকে ফাঁসির বদলে দিল যাবজ্জীবন, আমাদের সবার দীর্ঘদিনের বেদনা সব একসাথে যেন প্রকাশিত হয়ে পড়লো।
-তবে কান্নার সুরে নয় এবার আর, প্রতিবাদের সুরে! আমরা সবাই নেমে এলাম রাজপথে। আমার ছাব্বিশ বছরের জীবনে এই প্রথমবারের মত রাজপথে নামা, আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে শ্লোগান তুলা, স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রের আবেগময় গান শুনে উন্মুক্ত দুপুরে চোখ ভিজে যাওয়ায় তা প্রাণপণে লুকানোর চেষ্টা করা! দেশ নিয়ে চিরকালের হতাশ এই আমার হঠাৎ দেশের জন্য আকূল আবেগ অ্নুভব শুধু আমার একার অনুভূতি নেই আজ আর, এই একই অনুভূতি আজ হাজার হাজার বাঙালির মধ্যে। আমাদের মধ্যে সবার রাজনৈতিক আদর্শ এক না, সবার ধর্মীয় পরিচয়ও অভিন্ন না, আমাদের জাতিসত্তাও ভিন্ন, আমরা নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ-যুবক, কিন্তু আমরা সবাই মনে করি আমাদের প্রধান পরিচয় আমরা সবাই বাঙলাদেশী। যে দেশে মানুষ জন্ম নেয় সেই দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধের জন্ম হওয়া খুব স্বাভাবিক মানবিক ব্যাপার। আমরা রাজাকারদের মত অস্বাভাবিক নই, অমানবিক নই, আমরা তাই আমাদের দেশকে ভালোবাসি। হয়ত এখনও আমরা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি ঠিক কীভাবে দেশের প্রতি আমাদের ভালোবাসাকে আমরা প্রকাশ করতে পারবো। তবে আমাদের ভালোবাসায় কোন খাদ নাই, তাই আমরা আজ সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছি আমাদের আদি পাপমোচনের লক্ষ্যে।
আমি জানিনা শাহবাগ আন্দোলনের লক্ষ্য শেষ পর্যন্ত পূরণ হবে কী না। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্যগুলোর কিছুটা পূর্ণ হবে, আর অনেকখানিই রয়ে যাবে অপূর্ণ। তবে এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড সাফল্য আমরা ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছি- আমরা আবার পেরেছি আশাবাদী হতে! সুদীর্ঘ বেয়াল্লিশ বছর ধরে হতাশ হতে হতে যখন আমরা একপ্রকার হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম, তখনই বেয়াল্লিশ বছরের সুপ্ত আগ্নেয়গিরিটা হঠাৎ জেগে উঠে আমাদের মুক্ত করেছে হতাশার জাল থেকে। এখন আমরা স্বপ্ন দেখতেই পারি আমাদের এই ভগ্ন-জীর্ণ-শীর্ণ-ধর্ষিত দেশটাকে নিয়ে।
আমাদের ভবিষৎ প্রজন্ম নিশ্চিতভাবেই শাহবাগকে মনে রাখবে এক বিপন্ন জাতির রূগ্নাবস্থায় আশার ঝলকানি দেখানো এক উজ্বল সূর্য হিশেবে।
একটুকরোর চেয়ে আরও বেশি। তা না হলে ২২ ফেব্রুয়ারি জঙ্গীদের তান্ডবের পরপরই আবার শাহবাগ ভরতো না।
আন্দোলনে অনেক কিছু পেয়ে গেছি। তাই পিছনে ফিরে তাকানোর সময় নেই। জয় আমাদের হবেই।
🙁 শাহবাগ এই মুহূর্তে গোটা বাংলাদেশের বাতিঘর।।
@সূর্য
আমি জানি বেশি আশাবাদী হওয়া ঠিকনা, যে যত বেশি আশাবাদী তার আশাভঙ্গের বেদনা তত বেশি। আমি আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে চিন্তা করছি না, একবুক ভর্তি করে আশা নিয়ে অপেক্ষা করছি মূল লক্ষ্য সবগুলো পূর্ণ হবেই। 😉
আরেকটা চরম কথা বলেছেন। আমরা আবার আশাবাদী হতে পেরেছি, আমাদের ঐক্য ফিরে এসেছে। আমরা এখন আর বিভ্রান্ত হই না। এখন থেকে যেকোনো প্রয়োজনে আমরা এক হতে পারব।
লেখাটার জন্য ধন্যবাদ। (F)
আপনার লেখার সাথে আমি একমত।আমার নতুন বিয়ে করা বউ যখন আমাকে নিষেধ করল শাহবাগের আন্দলনে যেতে,আমি তাকে বললাম ”আমি যে মনকষ্ট নিয়ে দিনযাপন করছি আমি চাই না আমার সন্তানরা-ও সেই একই কষ্ট নিয়ে বড় হোক।যারা এই দেশ তথা পুরো জাতিকে ধর্ষণ করেছে,মানবতাকে হত্যা করেছে তারা যদি এভাবে পার পেয়ে যায় আর আমরা ঘরে বসে শুধু হা-হুতাশ করি তাহলে আমরা নিজেদেরকে আর মানুষ-ই বা বলব কি করে?মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে,আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি,কিন্তু আজ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারীদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে শামিল হওয়ার সুযোগ যদি হেলায় হারাই তবে আর কি কখনো পাবো?”শেষ পর্যন্ত আমার বউ তার ভুল বুঝল।আফসোস,অনেকেই এখনো ভুলের রাজ্যেই বাস করছেন!
@Niloy, খুব ভাল করেছেন। (Y)