১
আমি একা জন্মাইছি, একা মইরা গেছি। আমি কি মুসলমান, আমি কি বাঙালি, আমি কি অনার্য? আমারে একটা শ্রেণীতে ফেইলা দেখলেই কি আমি তা হইয়া যাই? আমারে মুসলমান হইয়া উঠতে হয়, বাঙালি হইয়া উঠতে হয়, নাস্তিক হইয়া উঠতে হয়। ফলে ওগুলা আমার বানানো সত্তা। ওই সত্তাগুলারে আমি বানাইয়া উঠি। কিন্তু আমার মূল সত্তা হইলাম ব্যক্তি আমি। তারে হইয়া উঠতে হয় না। সে-ই আমার আদি সত্তা।
২
ফ্যাসিবাদ কী জিনিস? যে নিজের জীবনে নীতি চাপাইতে চায়, সে নীতিবান। যে অন্যের জীবনে নীতি চাপাইতে চায়, সে ফ্যাসিবান। তা সে যেই নীতিই হোক। ফ্যাসিবান আর যাই করতে কউক, ব্যক্তিসাধনা করতে কয় না। আত্মসাধনা করতে কয় না। ফ্যাসিবান আত্মরে বিলাইয়া দিতে কয়। তার ফ্যাসিগোষ্ঠির মাঝারে। ফ্যাসিবান আপনারে বোঝায়, আপনার দেখভালের দায়িত্ব আপনার না। আপনার নীতি ঠিক করার দায়িত্ব আপনার না। সেই দায়িত্ব ফ্যাসিগোষ্ঠির। আপনি বাদে অন্যের।
আত্মসাধনা হইলো নিজের দেখভাল নিজে করার সাধনা। নিজের নীতি নিজে ঠিক করার সাধনা। আত্মনিয়ন্ত্রণের সাধনা। কোনো মত পথ জাতি ধর্মের কাছে সমর্পণের আগে নিজের কাছে সমর্পণের সাধনা। সকল ফ্যাসিবাদরে বিলাইয়া দেয়ার সাধনা। ফ্যাসিবাদে ব্যক্তির উপর তার নিজের অধিকার আসে সবার পরে। ফ্যাসিবাদে ব্যক্তির মালিক ব্যক্তি নিজে না। ফ্যাসিবাদে ব্যক্তির মালিক হইলো মূলত তার ফ্যাসিগোষ্ঠিটা। আত্মসাধনায় নিজের মালিক হইলো কেবল নিজেই। আত্মসাধনায় নিজে আসে আগে, অন্যসকল মত পথ জাতি ধর্ম আসে পরে।
৩
ধর্মের সবচেয়ে বড় অনাচার ঘটে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। এতে ধর্মেরই ক্ষতি। রাষ্ট্র একচেটিয়া বলপ্রয়োগের কারখানা। যেই মতই বলপ্রয়োগের কারখানার অবলম্বন করে, সেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধর্মরে রাষ্ট্রের হাত হইতে মুক্তি দিতে হবে। কে কীভাবে ধর্ম পালন করবে সেইটা রাষ্ট্রের দেখার বিষয় না। মত নিশ্চিহ্ণ হয় না। ইসলামও নিশ্চিহ্ণ হবে না। ফলে আমরা বড়জোর তার মুক্তি কামনা করতে পারি। ইসলামের মুক্তি তারে বিচিত্র উপায়ে বাড়তে দেওয়াতে। ইসলামের কোনো অদ্বিতীয় রূপ নাই। নানা রকম ইসলামের অস্তিত্ব আছে, এইটা মানতে হবে। আরো নানা রকম ইসলাম তৈরি হইতে পারে, এইটাও মানতে হবে। যে যার মতো ইসলামরে খুঁইজা নিক। ইসলামের সমালোচনা যেখানে মুসলমানরে একাট্টা করতেছে, ইসলামের বিচিত্র বর্ধন সেইখানে মুসলমানরে ব্যক্তিসচেতন কইরা তুলবে। মুসলমান বুইঝা উঠবে যে প্রত্যেকের ইসলাম আলাদা। কোনো একক অদ্বিতীয় ইসলামের অস্তিত্ব নাই। ফলে এইটা নিয়া একাট্টা হওয়ারও সুযোগ নাই। অন্যের চাপানো ইসলামের উপর ভরসা না কইরা সে নিজের ইসলামের সন্ধান করবে। এইভাবে ব্যক্তি হইয়া ওঠার মাধ্যমে মুসলমানের মুক্তি ঘটবে। আর মুসলমানের মুক্তিতেই ইসলামের মুক্তি।
ফরহাদ মজহার সাহেব ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবহারের সবচেয়ে অদেখা শক্তিটা উদ্ধার করতে যাইতেছেন। ফরহাদ মজহার ইসলামের নামে সর্বহারা অনার্য ভাববাদীদের একাট্টা করবেন যেইদিন, সেই দিন তারে ঠেকানোর মূল অস্ত্রটা ওনার ইসলামের রাজনীতিটারে নিষিদ্ধ করায় নিহিত না। বরং নানান রকম ইসলাম দিয়া ওনারে গৌণ করাতেই নিহিত। সমাজে যদি নানারকম ইসলাম জারি থাকে, ফরহাদ মজহার তখন সবাইরে এক ইসলামের তলে একাট্টা করতে পারবেন না। এতে সর্বহারা অনার্য ভাববাদীরা ওনার ইসলামের হাত হইতে মুক্তি পাইবে। ইসলামও ওনার হাত হইতে মুক্তি পাইবে। ইসলামের রাজনীতি নিষিদ্ধ রাখলে ফরহাদ মজহারের মতো নিষ্ঠাবান শক্তিশালী মতধারার নেতারা ঠিকই তলে তলে সংগঠিত হইয়া উঠতে পারবেন। ধরা খাইয়া যাবে কেবল ওনারে ঠেকা দিবার উঠতি ইসলামগুলা।
৪
নিষিদ্ধতা অল্পই কাজ করে। যদি ধইরা ধইরা খতম কইরা দিতে না পারেন, তাইলে নিষিদ্ধতা নিষিদ্ধরে শক্তিশালীই করে কেবল। আপনি জাসদরে হয়তো নিষিদ্ধ করলে করতে পারেন। সমাজতন্ত্ররে নিষিদ্ধ করতে পারবেন না। সেইটা কাগজে কলমে থাকবে, বলবৎ হবে না। বরং সমাজতন্ত্রীরা তখন একাট্টা হইয়া উঠবে। নিষিদ্ধের মুক্তভাবে চিন্তার সুযোগ নাই। ফলে নিষিদ্ধ নানা মতে বিরাজ করে না। নিষিদ্ধরা সবাই একছাতার তলে চইলা আসে। আজকে সমাজতন্ত্রী দলগুলা নিষিদ্ধ হইলে সবাই একাট্টা হইয়া যাইতো আর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হইতো কোনো একটা কম্যুনিস্ট পার্টি। তারা তখন নিষিদ্ধ থাকতো নাকি বৈধ থাকতো ডাজ নট ম্যাটার। গণসমর্থনের কারণে বৈধতা পাওয়া সময়ের ব্যাপার হইতো কেবল। সমাজতন্ত্রী পার্টি করা বৈধ বিধায় আজকে কোটি কোটি বামপন্থী দল তৈরি হইছে। একটা আরেকটারে ঠেকা দিতেছে। বড়জোর জোট করতেছে। একাট্টা একদল হইয়া উঠতে পারতেছে না।
৫
বাঙালি জাতীয়তাবাদের মুক্তির জন্যেও বাঙালি জাতীয়তাবাদী আরো দল লাগবে। মানুষের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনারেও রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বাইরে রাখতে হবে। জাতীয়তাবাদী চেতনার উপর যতোদিন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থাকবে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী দল ততোদিন একটাই থাকবে – আওয়ামী লীগ। সে তার রকমের জাতীয়তাবাদটা রাষ্ট্রের মাধ্যমে সবার উপর চাপাইয়া দিয়া অন্যান্য রকমের বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান হওয়ারে নিশ্চিহ্ন কইরা দিতে থাকবে। এতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ক্ষতি হবে। ধর্মের মুক্তি হোক। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মুক্তি হোক। জয় বাংলা!
– খুব ভাল পয়েন্ট। দেশে আজ জামাত বা সব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার শক্ত দাবী উঠছে। দাবীটা অবশ্যই যুক্তিপূর্ন হলেও অন্যদিকও চিন্তা করার আছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে দিলেই তাদের রাজনীতি শেষ, বিষদাঁত ভংগ এই ধরনের ইউটোপিয়ায় ভোগার পরিনাম হতে পারে মারাত্মক। ধর্মীয় মোড়কে নুতন সংগঠন গড়ে তোলা দুদিনের ব্যাপার মাত্র। হিজবুত তাহরীর সংগঠন গড়ে তুলছে রাজনৈতিক দল হিসেবে নয়, নানান রকম সিরাত তাফসীর এ জাতীয় ধর্মীয় মোড়কে। ‘৭১ সালের পর জামাত প্রাথমিক পর্যায়ে ঘর গুছিয়ে এনেছেও একই কায়দায়।
জামাতের ৫/৬% ভোট ব্যাংক জামাত নিষিদ্ধ করে দিলেই আওয়ামী মনষ্ক হয়ে যাবে না কিংবা নবীন প্রজন্মের মাদ্রাসা জাতীয় প্রতিষ্ঠান বা ধারার ছাত্ররাও ধর্মনিরপেক্ষ ধারার রাজনীতিতে যোগ দেবে না এটা বিবেচনায় না রেখে ক্যান্সারের চিকিতসা এন্টী-বায়োটিকে সারানোর চিন্তা পরিনামে হতে পারে মারাত্মক। নিষিদ্ধ শুদ্ধ এসব কোন ব্যাপার নয়।
শাস্তি হিসেবে জামাত নিষিদ্ধ করা যেতে পারে, তবে কেউ যদি মনে করেন যে এতেই রাজাকারদের দিন শেষ হয়ে যাবে তবে তারা মারাত্মক ভুলের জগতে বিচরন করছেন।
@আদিল মাহমুদ,
চমৎকার বলেছেন।
১. ব্যাক্তির অস্তিত্ত্ব অবশ্যই আছে কিন্তু সমাজের বাইরে একজন ব্যক্তি আসলে কোন জায়গায় দাড়াইয়া আছে এইটা নিয়া সব সময়েই আমার একটু ঝামেলা হয়। সমাজের বাইরে আপনে রুপম আমি সাইফুল এরা আসল কারা? বা আছিই কোনখানে?
ব্যাপারটা এইভাবে বললে মনে হয় বুঝাইতে সুবিধা হইব। বর্তমান বিজ্ঞান নাকি প্রকৃতিরে বসে আনার জন্য, মানুষের কাজে লাগানোর জন্য ব্যাপক চেষ্টাচরিত্র করতেছে এইরকম একটা ডিসকোর্স চালু আছে। আমার সমস্যার জায়গাটা হইল, প্রকৃতির বাইরে মানুষ কই থাকে? মানুষ কি প্রকৃতির বাইরে? যদি বাইরে হয় তাইলে প্রকৃতির সংজ্ঞা কী?
৪. আমি ব্যক্তিগতভাবে যেকোন নিষিদ্ধের বিপক্ষে। এইখানে দুইটা প্রশ্ন রাখতেছিঃ
নাৎসী বাহিনী নিষিদ্ধের ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মের ব্যাবহার নিষিদ্ধ করে, রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা কি কোন ধরনের নিষিদ্ধিকরন আপনার মতে?
৫. বাঙালি জাতিয়তাবাদের সঠিক স্বরূপ কোনটা আপনার কাছে? মানে যেহেতু বলতেছেনঃ
এইজন্য বললাম।
আমি যেহেতু এই ব্যাপারে কোন বিশেষজ্ঞ না এমন কি আমার অজ্ঞতাও অজ্ঞতার পর্যায়ে পড়ে না। তারপরেও কই, বাঙলা ভাষার এই যে কথিত প্রমিত রূপ এই এলিট জিনিসটা আপনারে পেইন দেয় না? আমারে তো ব্যাপক পেইন দেয়। মুখে কইতে সমস্যা নাই, লেখতে গেলেই কোন এলিট শুদ্ধগোষ্টি আইসা ভাষা ব্যাবহারে শুদ্ধতার পরিধি নিয়া আওয়াজ ছাড়ে। ব্যাপক পেইনরে ভাই!
@সাইফুল ইসলাম,
ভালো প্রশ্ন। এইটাকে এভাবে দেখেন। ব্যক্তি সমাজের বাইরে নাই। ব্যক্তি সমাজের ভিতরেই। এতোই ভিতরে যে ব্যক্তিই সমাজের ভিত্তি। ব্যক্তিরে যে আমি সমাজের আগে দেখছি, এর মানে কিন্তু এই না যে কেবল ব্যক্তিই দেখছি, আর কিছু দেখছি না। জাতি ধর্ম বর্ণ শ্রেণী সমাজ সবকিছুই আছে। ব্যক্তিও আছে। কিন্তু ব্যক্তির উপর অধিকার কার? হয়তো সবারই একটু একটু আছে। কিন্তু সবার আগে ব্যক্তির নিজের আছে। সে নিজেই নিজের তাগিদে স্বেচ্ছায় সমাজ জাতি ধর্মের কাছে সমর্পণ করে। এ কারণে সমাজ জাতি ধর্ম তৈরি হয়। কিন্তু সেইটা বদ্ধ হয়ে যায় যখন সেখান থেকে ফিরে আসার সুযোগ ব্যক্তির থাকে না। মুক্ত সমাজ মুক্ত জাতি মুক্ত ধর্ম তৈরি করতে হলে ব্যক্তির অংশগ্রহণের ও অংশবাতিলের অধিকার ব্যক্তির নিজেরই থাকতে হবে। স্বেচ্ছামূলক সমাজ তো বেসমাজ নয়। সেটা মুক্ত এবং আমার মতে সবচেয়ে শক্তিশালী সমাজ। অন্যদিকে ব্যক্তির বাইরে সমাজ কই? ব্যক্তির বাইরে সমাজ চিন্তা করা অসম্ভব। ব্যক্তি ছাড়া সমাজ নাই।
এইতো গেলো ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির বদ্ধ-বনাম-মুক্তগত ব্যবহারিকতা। তত্ত্বে আসি। তাত্ত্বিকভাবে ব্যক্তির দিক দিয়ে দেখবেন নাকি সমাজের দিক দিয়ে দেখবেন? মানুষ আর প্রকৃতি আলাদা করে দেখবেন নাকি প্রকৃতির ভিতরেই মানুষকে অনুল্লেখ্য বিলীন হিসেবে দেখবেন? তাত্ত্বিকভাবে সবভাবেই তো দেখা যায়। নৈর্ব্যক্তিকভাবে দেখলে এর কোনোটাই তো কোনোটার চেয়ে উত্তম নয়? বরং একজন প্রকৃত প্রকৃতিপ্রেমী প্রকৃতি ও পরিবেশকে রক্ষার খাতিরে মানুষকে বশে আনা কি তারে সীমিত এমন কি বিলীন করে দেয়ার কথা ভাবতেও সক্ষম হতে পারে। তাহলে ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার আলাদা কী মর্ম? আলাদা মর্ম এই যে পৃথিবীর একমাত্র অর্থপূর্ণ পর্যবেক্ষক হলো ব্যক্তি। এই যে আপনি আমার লেখা দেখছেন, কথা বলছেন, বোধন অনুভব করছেন, সেটা প্রকৃত ও সত্য। এ নিয়ে আপনার কোনো দ্বিমত নাই। এটা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণের কোনো প্রয়োজন আপনার নাই। এটা তত্ত্ব না। এটা আপনার সজ্ঞার একমাত্র প্রকৃত সত্য। একমাত্র আপনার ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্বকেই আপনি প্রমাণ ছাড়াই সত্য মানতে পারেন। আপনি যখন বিজ্ঞানী হিসেবে পর্যবেক্ষণ করেন, তখন আপনি আপনার পর্যবেক্ষণকে যাচাই করে নেন। কিন্তু এখানে একটা স্বতঃসিদ্ধকে যাচাইপূর্বভাবে আপনি মেনে নেন যে আপনি পর্যবেক্ষক অস্তিত্বমান। পর্যবেক্ষক পর্যবেক্ষককে যাচাই করতে পারে না। তার মানে এই নয় যে তার অস্তিত্ব নেই। এটা প্রমাণের ঊর্দ্ধে। প্রমাণ অপ্রয়োজনীয়। আপনি ব্যক্তি পর্যবেক্ষক অস্তিত্ববান মনে করেই আপনার বাইরের পর্যবেক্ষণকে যাচাই শুরু করেন। তারপর উদ্ঘাটন করেন যে আপনি কোষ দিয়ে গঠিত। কোষ অণু, পরমাণু, প্রোটন ইলেক্ট্রন দিয়ে গঠিত। সমাজ আপনাকে দিয়ে গঠিত। এতো রকম স্তরীভূত গঠনের মধ্যে তখন আপনাকে বিলীন মনে হতে পারে। কিন্তু এখানে আপনার ব্যক্তিসত্তা আলাদা এভাবেই হয় যে এই সকল জ্ঞানটা শূন্যে ধৃত হয় না, ধৃত হয় ব্যক্তি আপনার বোধনে। এ কারণে আপনার কোষের আলাদা অস্তিত্বের উপর আপনার অধিকার বেশি বলে আপনি ভাবতে পারেন। আবার আপনার ব্যক্তিসত্তার উপর সমাজের চেয়ে আপনার অধিকার বেশি বলে ভাবতে পারেন। এমন বোধন সমাজের আছে বলে আমাদের জানা নেই। এমন বোধন একটা কোষের আছে বলে আমাদের জানা। আপনি চাইলে ভাবতে পারেন যে আছে। কিন্তু এমন বোধন আপনার যে আছে, সেটা আপনার ভাবার প্রয়োজনও হয় না। সেটা আপনার ভাবার আগেই যে সত্য তা আপনি জানেন। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে এত রকম স্তরীভূত গঠনের মধ্যে ব্যক্তির অস্তিত্ব আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এইভাবে না দেখলে আপনার কোষ, আপনি, আপনার সমাজের, কোনোটার আলাদা কোনো বিশেষত্ব নাই।
এই বৈশিষ্ট্যের কারণে একজন ব্যক্তি মানুষের বাইরের পুরোটাই ওই ব্যক্তি মানুষের প্রকৃতি। এটার তত্ত্বীকরণও হয়েছে। এআই গবেষণায় এই ভোকাবুলারি ব্যবহার করা হয়। বুদ্ধিমত্তা ধারণ করে একজন এজেন্ট। এজেন্টের বাইরে পৃথিবীতে আর একটা জিনিসই আছে - এনভারন্মেন্ট। এজেন্ট তার এনভারন্মেন্টের উপর অ্যাকশান (ক্রিয়া) সঞ্চালনের মাধ্যমে তার লক্ষ্য হাসিল করে। ওটাই তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। ব্যক্তিই যেকোনো অর্থপূর্ণ লক্ষ্যের ইউনিট।
এতে কোষের উপর অবিচার হলে হতে পারে। আপনি ব্যক্তি আপনার খায়েশের জন্যে হাত চুলকিয়ে কয়েকশ কোষ ঘষে মেরে ফেলতে পারেন। কিন্তু সমাজের কি খুব ক্ষতি হতে পারে? ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দেয়া জগতেও সমাজ গঠন হতে পারে। সেটা হবে স্বেচ্ছামূলক সমাজ। যেমন মুক্তমনা ওয়েবসাইটটা একটা সমাজ। এখানে সদস্যতা কোনো ব্যক্তির জন্য বাধ্যতামূলক না। স্বেচ্ছায় যদি আজকে সব সদস্য মুক্তমনা থেকে পালিয়ে যায়, মুক্তমনা মডারেটরদের সাধ্য নেই এই সমাজকে টেকানোর। তারপরেও কিন্তু তেমনটা ঘটে না। স্বেচ্ছায় মানুষ এখানে মিলিত হয়। একটা স্বতস্ফূর্ত সমাজ গড়ে তোলে। সমাজ ব্যক্তির চেয়ে যখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেখানে সদস্যতা বাধ্যতামূলক করা হয়, ব্যক্তির ব্যাপারে ব্যক্তির আগে সমাজের অধিকারকে গণ্য করা হয়। যেমন অনেক বদ্ধ ধর্মীয় সমাজ। রাষ্ট্র। সেটার উপকারিতা নিয়ে কেউ কোনোদিন বলে নি। বলেছে সমাজের ভালো হয়েছে। কিন্তু আসলে যা হয়েছে, তা হলো কিছু ব্যক্তির জবরদস্তি লোকসানের বিনিময়ে অন্য কিছু ব্যক্তির লাভ।
@সাইফুল ইসলাম,
লক্ষ্য করুন আমি ব্যক্তির ক্ষেত্রে অধিকারগত দিক থেকে আলাপ করেছি, কিন্তু নিষিদ্ধকরণের ব্যাপারে অধিকারগত আলাপ করি নি, ব্যবহারিক আলাপ করেছি। ব্যক্তি ছাড়া আর কোনো এনটিটি অধিকার সংরক্ষণ করে বলে আমি মনে করি না। সেখানে একটা দলকে নিষিদ্ধকরণ নিতান্তই ব্যবহারিক আলাপ। দুইটা স্তরে এই ব্যবহারিক আলাপ সারা যায়। প্রথমে রাষ্ট্রের ভিতরে থেকে। ব্যক্তির অধিকার সংরক্ষণ করার নিমিত্তে যদি রাষ্ট্র গঠন করেন, তাহলে বহুল প্রমাণিত অপরাধী সংগঠন যেমন নাৎসী বাহিনী কিংবা জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা রাষ্ট্রের পরম দায়িত্ব। কিন্তু সেটা আফটার দ্য ফ্যাক্ট। এটার ভিত্তি আছে। অপরাধ আগে হইছে, তারপর ব্যবস্থা। কিন্তু একটা মত বা পথকে (ইসলাম, ধর্ম, সমাজতন্ত্র, রক্ষণশীলতা, প্রকৃতিপ্রেম) (১) অপরাধীও করা যায় না, (২) সেটার বাস্তবায়নও বলবৎ করা অসম্ভব। সেটা বরং অন্যান্য অনাচারের জন্ম দেয়। অন্যদিকে সেটাকে মুক্তভাবে বাড়তে দিলে একই পথে একাধিক যাত্রী তৈরি হয়ে তারা সুন্দর একটা আরেকটাকে ব্যালেন্স করতে পারে। হ্যাঁ, অঘটনের সুযোগও এটা খোলা রাখে বটে। তবে সেটা বৃহত্তর অকল্যাণের চেয়ে মন্দের ভালো।
আরেকটু উপরের স্তর দিয়ে দেখলে, কে কাকে নিষিদ্ধ করবে? ব্যক্তির অধিকারের প্রধান ভায়োলেটর তো রাষ্ট্র নিজে। আমরা রাষ্ট্রের বাইরে যেহেতু নেই, এই প্রশ্নও এখন আর আসবে না। কিন্তু রাষ্ট্র না থাকলে নিষিদ্ধকরণেরও কোনো অর্থ নাই।
প্রশ্ন হলো ধর্মনিরপেক্ষতাকে কোন অ্যাঙ্গেল থেকে দেখছেন? রাজনৈতিক দর্শন হিসাবে সেক্যুলারিজম বলতে এনলাইটেনমেন্টের সেক্যুলারিজমকে বোঝানো হয়। সেই সেক্যুলারিজম কিন্তু কোনো প্রকার আরোপমূলক ব্যবস্থা নয়। ফলে এটা কোনো প্রকার নিষিদ্ধকরণও নয়। এই প্রশ্নটা এর আগে কৌস্তুভও করেছিলো। এই ভুল বোঝাবুঝিটা বিরাজ করে আমাদের মনে যে ধর্মকে সাইজ করার জন্যে এই ব্যবস্থা। এটা দ্বারা বরং রাষ্ট্রকে সীমিতকরা হয়েছে। কাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এখানে? রাষ্ট্রকে, ধর্মসংক্রান্ত বিষয়ে নাক গলাতে। মানুষের ধর্মাচার তার যাতে মাথা ব্যথার বিষয় না হয়। কোনো আইন যাতে সে ধর্মীয় বিবেচনায় না করে। ফলে এটা নিষিদ্ধকরণ নয়। বরং রাষ্ট্রকে সংকোচনমূলক। আর রাষ্ট্রকে সংকোচন করলে তার সাব্জেক্ট নিষিদ্ধ হয় না, বরং তার সম্প্রসারণ ঘটে। এর বিস্তারিত থমাস জেফারসনের লেখায় পেতে পারেন। সেখানে তিনি বিস্তারিত বলেছেন কীভাবে ধর্মকে তিনি মুক্তি দিচ্ছেন রাষ্ট্রের কালো হাতকে ধর্মের থেকে দূরে সরিয়ে। সেখানে রাষ্ট্রকে বিজ্ঞানের থেকেও দূরে রাখতে বলেছেন। তিনি বলেছিলেন যে রাষ্ট্র যদি এক তত্ত্বকে অন্য তত্ত্বের উপর বেশি মর্যাদা দেয়, বিজ্ঞানের মুক্ত গতি তাতে ব্যাহত হবে। বিজ্ঞানের নিজেকে নিজে শুদ্ধ করার চর্চা লংঘিত হবে। অনেক জীর্ণ তত্ত্ব তখন রাষ্ট্রের একচেটিয়া বলপ্রয়োগের ছত্রছায়ায় টিকে থেকে যাবে।
ফলে এনলাইটেনমেন্টের ধর্মনিরপেক্ষতাকে আমি নিষিদ্ধকরণই মনে করি না। আমার লেখাতেও কিন্তু আমি রাষ্ট্রকেই সীমিত করার কথা বলেছি –
ধর্মের সবচেয়ে বড় অনাচার ঘটে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। এতে ধর্মেরই ক্ষতি। … ধর্মরে রাষ্ট্রের হাত হইতে মুক্তি দিতে হবে। কে কীভাবে ধর্ম পালন করবে সেইটা রাষ্ট্রের দেখার বিষয় না।
@রূপম (ধ্রুব),
” সেক্যুলারিজম কিন্তু কোনো প্রকার আরোপমূলক ব্যবস্থা নয়। ফলে এটা কোনো প্রকার নিষিদ্ধকরণও নয়। —— এটা দ্বারা বরং রাষ্ট্রকে সীমিতকরা হয়েছে। ”
কথাটার তাৎপর্য অনেকেই বুঝতে চান না।
আমাদের মিডিয়া, সমাজ সবখানে ষাধারন মানুষদের আলাপে বার বার দেখা যায় যে সরকার বাহাদুরের কাছে পৌনপুনিক আর্জি কিংবা দাবী, এটা নিষিদ্ধ করো, ওটা ব্যান করো, ঐটা বন্ধ করে দেও। নানান জিনিষ নিষিদ্ধ করে জাতির চরিত্র ঠিক করে ফেলতে সবার উৎসাহ ব্যাপক। ঠিক যেনো সবাই ধরে নিয়েছেন আমরা একটি adolescent nation।
এটা হতেই পারে। তবে মুক্তমনাদের বিভিন্ন মত বা পথ নিষিদ্ধের দাবী করার আগে একটু চিন্তা করা দরকার।
তবে অপরাধী ও যুদ্ধে পরাজিত সংগঠন হিসেবে জামাতে ইসলামী নিষিদ্ধ করা সভ্যতার যে কোনো মানদন্ডে গ্রহন যোগ্য।
@সাইফুল ইসলাম,
কথ্য ভাষার সমালোচনা অনেক সময় এলিটপনার দিক থেকে হয়ে থাকে। কিন্তু কথ্য ভাষার সমালোচনা মাত্রেই কিন্তু এলিটপনা না। অনেককেই দেখেছি বরং এর ব্যবহারিক দিকটা চিন্তা করেন। যোগাযোগের সুবিধার কথা চিন্তা করেন। কথ্য ভাষায় লেখা অপ্রচলিত বলে পড়তে অসুবিধা বোধ করেন। কথ্য ভাষায় লেখার জন্যে স্রেফ অধিকার ছাড়া আরো যদি কারণ আমাদের থাকে সেগুলোকে গুছিয়ে বলতে পারাতেই এর সমাধান।
@সাইফুল ইসলাম,
আমি কিন্তু ইসলামের ক্ষতির কথাও বলেছি ইসলামের কোনো সঠিক স্বরূপের অস্তিত্ব স্বীকার না করেই। বরং বলেছি ইসলামের নানা রূপ থাকতে পারে, এটা মানতে হবে।
সঠিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ কোনটা সেটা কে ঠিক করবে? আমার কাছে যেটা সঠিক মনে হবে, সেটা আপনি কেনো মানবেন? ফলে বলা হবে যে সঠিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ “বাঙালিই” নির্ধারণ করবে। তো বাঙালি যে একটা জাতীয়তাবাদই নির্ধারণ করবে এমন তো অবান্তর চিন্তা। সে বহুরকম চিন্তা করবে। তখন একজন এসে বলবে যে তারটা বাদে বাকি সকল হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ নামের কলঙ্ক। ইতিহাসের অপলাপ। জাতিদ্রোহিতা। রাষ্ট্রদ্রোহিতা। এই বদ্ধতাটাকেই আমি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ক্ষতি বলছি। সঠিক বেঠিকের অস্তিত্ব ব্যতিরেকে এটা সত্য।
আমার কথ্য ভাষায় লেখা প্রবন্ধ খারাপ লাগে না। অবশ্য আমি এ ব্যাপারে একটু বায়াসড। রূপম তো আমাদের লেখার লিঙ্ক উপরেই দিয়ে দিয়েছেন।
লেখাটার আবেদন আছে। আলোচনা হোক।
লেখাটি বিষয় ভালো কিন্তু উপস্থাপন নয়। আমি কিন্তু কথ্য ভাষায় লেখা খুব একটা পছন্দ করতে পারি না ,বিশেষ করে যেরকম কথ্য ভাষা সাধারনত মানুষ কথা বার্তাতেও ব্যবহার করে না। আপনার এই পর্যন্ত লেখা লেখি দেখে হঠাৎ এই রকম পরিবর্তন একটু বিস্ময়কর লেগেছে, বিশেষ করে এরকম সিরিয়াস একটি বিষয়ে। এটা কি কোনো subconscious defense mechanism এর ফলাফল?
@সফিক,
ভালো মন্তব্য। ধন্যবাদ। এটা আমার মুখের ভাষার কাছাকাছি বলতে পারেন। কথোপকথনে, এমন কি ফেইসবুক মেসেজেও এই ভাষা ব্যবহার করি। তো উপরের লেখাটার অধিকাংশই ফেইসবুক মেসেজে অনেকের সাথে কিছু কথোপকথনের সংকলন। সেখানে যেই ভাষা ব্যবহার করেছি, সেটা রেখে দিয়েছি, বাক্যগুলো আরো পরিমার্জন করে কেবল। ফলে subconscious defense mechanism অন্তত এখানে কাজ করে নি।
এই ভাষায় লেখা আমি আগেও লিখেছি (“নাস্তিক মুসলমান“), এই ব্লগে নেই বোধহয়। এর আগে অভিজিৎ রায় ও বন্যা আহমেদও এই ভাষায় এই মুক্তমনাতেই লিখেছেন। সাইফুল ইসলাম তো লিখেনই। এই ভাষায় বলা নিয়ে আমার কিছু চিন্তা ও অনেকের আলোচনা এই লেখাতে আছে। দুই ভাষাতেই লেখালেখির অভিজ্ঞতা দুইরকম। মুখের ভাষা এই ভাষার কাছাকাছি হওয়ায় চিন্তা এই ভাষায় লিখলে বেশি সাবলীলভাবে প্রকাশ পেতে দেখেছি। বিশেষ করে বিষয় যখন বেশি জটিল হয়। এমন বলতে আমি আরও অনেককেই শুনেছি। নিজে এখন এটা উপলব্ধি করছি। সেখানে প্রমিতে জটিল বিষয় নিয়ে লিখলে বাক্য গঠন ইংরেজির কাছাকাছি হয়ে যেতে চায়, সহজপাঠ্য থাকে না। ব্যাপারটা কিন্তু কেবল আমার নিজের ক্ষেত্রে। অন্য অনেকে প্রমিত ভাষাতেই সাবলীলভাবে লিখেন।
কেবল কথ্য ভাষা বলে পড়তে অপছন্দ করাটা আমি ঠিক আমলে নেই না। সেটা শুচিবোধ থেকে আসে বোধহয়। অপছন্দ করার এর চেয়ে বেশি কারণ থাকলে ভালো হয়, যেমন, “কথ্য ভাষায় পড়তে গেলে এই সমস্যা হয়”, এইরকম ফিরিস্তি। তো কথ্য ভাষায় লেখার (নিজস্ব) উপকারিতাটা তো বললাম। কথ্য ভাষায় লেখা পড়ার ব্যাপারে আমার নিজের সমস্যাগুলো একটা হলো এটা যদিও আমি সহজে অনুধাবন করতে পারি, কিন্তু সিরিয়াসনেসের কমতি অনেক সময়েই বোধ হয়। এটা কথ্য ভাষায় লেখার অন্যতম সমস্যা। এই সমস্যা হয়তো এই লেখাতেও চলে এসেছে। কথ্য ভাষায় একটা খোঁচা মারা টোনও আছে, যেটা আপনি যেমন বললেন, অনেক সময় একটা subconscious defense mechanism থেকেও আসতে পারে। কিন্তু অনেক সময় দুটোই একটা আরেকটাকে রিইনফোর্স করে। অর্থাৎ খোলা মনে লিখতে বসলাম। লেখাটা শেষে পড়ার পর দেখা যাবে যে লেখাটা একটা ডিফেন্সিভ টোনে কথা বলছে।
কথ্য ভাষায় লেখার একেবারে কোনো উপকারিতা না থাকলে আমি এই এক্সপেরিমেন্টে যেতাম না। কিন্তু আমার কাছে এর উপকারিতা হলো মুখের ভাষার কাছাকাছি হওয়া এবং ফলে চিন্তায় সাবলীলতার সুবিধা। ফলে সমস্যাগুলোকে (সিরিয়াসনেসের অভাবকে, ডিফেন্সিভ টোনকে) সমাধিত করে লেখার প্রচেষ্টা প্রতিবারই বোধ করি। ফলে আমার এই প্রচেষ্টা পুরনো ও এক্সপেরিমেন্টাল। এই ভাষাকে তার সমস্যাগুলো উতরিয়ে ব্যবহার করতে পারলে মঙ্গলই আছে মনে হয়। আপনার মন্তব্য চিন্তায় ও আলোচনায় বেশ কাজে দিলো। 🙂
সহমত। (F) (Y)