জামসেদ ভাইয়ের যত দুর্নামই থাকুক , সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে লোকটা বড্ড বউ ভালবাসে। যেমন, সেদিন জামসেদ ভাইকে অনেক গুঁতোগুঁতি করে নিয়ে গেলাম শাহবাগ। কিন্তু টিএসসির মোড় থেকে জামসেদ ভাইয়ের আর পা-ই চলে না। খালি পেট মোচড় দেয়। আমরা যতই টিএসসির দিকে আগাই, সে ততই টেনে ধরে আমাদের। ‘দাঁড়াও, দাড়াও, আগে পেটে কিছু দিয়া লই। শ্লোগান দিতে শক্তি লাগবো না?’
জামসেদ ভাইয়ের ক্রমাগত পীড়াপীড়িতে একসময় আমরা টিএসসির ফাস্ট ফুড দোকানে যাত্রাবিরতি নিতে বাধ্য হই। উদ্দেশ্য, আন্দোলনের জন্য খাদ্যগ্রহণের মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয়। তো খাবার পেটে দিতে দিতে জামসেদ ভাই শুরু করে মজার মজার গল্প। ভাবীরে কেমনে পটাইছিল, সেই সব রসালো গল্প শুনতে শুনতে কখন যে ঘণ্টা গড়িয়ে যায়, খেয়ালই থাকে না আমাদের।
একসময় পাশ দিয়ে যাওয়া মশাল মিছিল দেখে চমকে উঠি আমরা, ‘একটাই দাবি, ফাঁসি ফাঁসি’, ‘জামাত-শিবির রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’, ‘কাদের মোল্লার চামড়া, কুত্তা দিয়া কামড়া’ ইত্যাকার শ্লোগান শুনে আমাদের রক্ত গরম হয়ে উঠে, আর সেকেন্ডও দেরি না করে আমরা পড়িমরি করে ছুটি শাহবাগে। কিন্তু কিছুদূর এগুতেই বুঝতে পারি, জামসেদ ভাই পিছিয়ে পড়েছে আবারও।
‘জামসেদ ভাই, জামসেদ ভাই’- আমরা জোরে চিৎকার করতে থাকি। জামসেদ ভাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আওয়াজ দেয়াতে বুঝতে পারি, সে ধারে কাছেই অবস্থান করছে, নইলে মহাসমুদ্রের গর্জনের মাঝে আমাদের ডাক আর কতদূর যেতে পারে?
‘জামসেদ ভাই, আপনে লোকটা আসলেই পিছলা’
‘আর কইয়ো না, বউ ফোন দিছিল।’
‘আইচ্ছা ঠিক আছে, অহন চলেন, আরে, ঐ তো শোনা যাচ্ছে লাকির শ্লোগান, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা, তুমি কে, আমি কে, বাঙালি, বাঙালি।’
আমরা নিজেদের দলটিকে একটি লাইনে পরিণত করি। প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাঁধে হাত রাখি। এই জনসমুদ্রে যেকোনো মুহূর্তেই দলছুট হওয়ার সম্ভাবনা।
আমার কাঁধটি ধরেছিল জামসেদ ভাই। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত যেতেই তা আলগা হয়ে যায়, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, জামসেদ ভাই আবার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
‘তোমার ভাবীর ফোন। চিল্লা চিল্লি করতাছে। নাহ, আমি মনে হয়, তোমাগো লগে আর থাকতে পারুম না। আগে ঘর সামলাই, তারপর আরেকদিন তোমাগো লগে আমুনে।’
আমাদের মাঝে রকিব নামে একজন ঠোঁটকাটা আছে, সে বলে, ‘আপনি দেখি স্ত্রৈণ স্বভাবের, জামসেদ ভাই। ঘরে বউ তো আমাগোও আছে, নাকি?’
জামসেদ ভাই কিছু বলতে যায়, কিন্তু আবারও বেজে উঠে মোবাইল। জামসেদ ভাই চোখে-মুখে ‘একান্ত বাধ্য না হইলে’ ‘কিছু মনে কইরো না’ ইত্যাদি ফুটিয়ে তুলে দ্রুতই ত্যাগ করে শাহবাগের প্রজন্ম স্কয়ার।
জামসেদ ভাইকে এরপর আর বিরক্ত করিনি আমরা । একজন বউ-ভক্ত পারিবারিক মানুষকে বিরক্ত করা একাধারে অমানবিক ও অনৈতিক মনে হয়েছিল আমাদের নিকট। পরিবারের গুরুত্ব আমরা কে না জানি? বিজ্ঞজনেরা বলেন, একটা পরিবার বাঁচলে একটি দেশ বাঁচে!
শাহবাগ কেন্দ্রিক আলোচনা তাই আমরা জামসেদ ভাইয়ের সামনে আর আনি না। অথচ গত কদিন ধরে, এই আলোচনা ছাড়া আর কোন কথাই নেই আমাদের মাঝে। আজ হঠাৎ দেখি জামসেদ ভাই আড্ডা-স্থলের এক কোনে একা বসে আছে। লোকটার সাথে গত কয়দিন ধরে কোন কথা হয় না। তাই শাহবাগের সাথে আপাত সম্পর্কহীন একটা প্রসঙ্গ খুঁজে বের করতে হয় আমাকে। জামসেদ ভাইকে জিজ্ঞেস করি, ‘আগামীকাল তো পহেলা ফাল্গুন, ভাবীকে নিয়ে বেরুবেন নাকি?’
জামসেদ ভাই মনে হল বিরক্ত হলেন, ‘পৌষ-ফাল্গুন এইসব হল হিন্দুয়ানী কালচার। আমরা এইসব পালন করি না।’
জামসেদ ভাই কনজার্ভেটিভ জানতাম, কিন্তু এতটা, তা জানতাম না। তাই কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করি, ‘পরেরদিনও কি বেরুবেন না? আপনি ভাবিকে এত ভালবাসেন, অথচ বছরের এমন দুটি দিন মিস করবেন?’
এইবার আমাকে আগের চেয়েও অবাক করে দিয়ে জামসেদ ভাই বললেন, ‘পরের দিন বেরুবো। প্রতি বছরই বেরোনোর চেষ্টা করি। আর যদি বেরুতে নাও পারি, তোমার ভাবিকে একটা গিফট অন্তত দেই।’
ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই বিসদৃশ লাগছিল। তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘একটা জিনিস আমার মাথায় ঢুকছে না, জামসেদ ভাই! আপনি পহেলা ফাল্গুন পালন করেন না, অথচ ১৪ই ফেব্রুয়ারি পালন করেন? কিন্তু কেন? আমারে দয়া কইরা বুঝাইয়া দিবেন, পহেলা ফাল্গুন করলে কি গুনাহ্ হয়, আর ১৪ই ফেব্রুয়ারি করলে কি বিশেষ নেকি লাভ হয়?’
‘১৩ই ফেব্রুয়ারির কি ইতিহাস আছে, আগে সেইডা কও আমারে? এই দিনে কি কেউ ভালবাসার জন্য প্রাণ দিছে? কিছু ভারত-ঘেষা বাম বুদ্ধিজীবী একটা দিন পালন করতে বললেই, আমাগো তা করা লাগবো? অন্যদিকে, দেখ, ১৪ই ফেব্রুয়ারি একটা আন্তর্জাতিক দিবস, সারা দুনিয়ার মানুষ এই দিনডারে ভালবাসার দিন হিসাবে পালন করে, অথচ ১৩ই ফেব্রুয়ারির লগে তুমি এই দিনডার তুলনা করতাছো?’
আমি তাকিয়ে থাকি জামসেদ ভাইয়ের দিকে। জানতাম, জামসেদ ভাই একজন রক্ষণশীল মানুষ, একজন বউ পাগল মানুষ। কিন্তু আজ নতুন করে জানলাম, আমাদের জামসেদ ভাই একজন আন্তর্জাতিক মনের মানুষ। একজন ভেজালমুক্ত আর হান্ড্রেড পার্সেন্ট খাঁটি আন্তর্জাতিক মানুষ। জামসেদ ভাইয়ের ভালবাসার বোধ ও ব্যাপ্তি আজ দেশ-জাতি-কাল মাড়িয়ে দূর বিশ্বপানে যায় ছড়িয়ে!
এভাবে শেষ করাটা একেবারেই পছন্দ হয়নি ভাই । বুঝা গেল জামশেদ শাহেবের মানষিকতার কাছে লেখক হেরে গেছেন । যেটা পাঠকের কাছে অনাকাংঙ্ক্ষিত । আপনার অবস্থান পরিষ্কার করে তুলে ধরা উচিত ছিল ।
@প্রবাল,
সহমত।
তিনি শাহবাগে যেতে চান নাই। এবং পহেলা ফাল্গুন হিন্দুয়ানী। দুইটা এক করলে কেমন যেন গন্ধ বের হচ্ছে।
@ডাইনোসর,
একজন গন্ধওয়ালা ছাগুকে তুলে ধরতে চেয়েছি, তাই গন্ধ তো লাগবেই। কিন্তু আপনার কথার সুর বলছে, আপনি গল্পের উত্তম পুরুষকে নিয়েই সন্দেহে ভুগছেন। সেক্ষেত্রে বলব, আপনি গল্পটির সূক্ষ্ম বিদ্রূপটি ধরতে ডাইনোসর টাইপের ভুল করেছেন।
এই কথাটির মাঝে আপনি বিদ্রূপ দেখতে পান না? নাকি আপনার মনে হল, গল্পের উত্তম পুরুষ প্রশংসা করে কথাগুলো বলছে বা জামসেদ ভাইকে নিয়ে আবেগে বুদবুদ করছে?
ঠিক আছে আপনার জন্য উপরের লাইনটির বদলে নীচের লাইনটিঃ
কি খুশী হয়েছেন তো? আর সন্দেহ নেই তো? একেবারে সরাসরি সংলাপ রচনা করলাম আপনার বোঝার সুবিধার্থে।
@কাজি মামুন,
আরে না। আমি জামসেদ কেই বলেছি। আপনাকে কেন বলতে যাব!!
@প্রবাল,
আপনার তেমন মনে হতেই পারে। তবে আমার বিশ্বাস, গল্পটিতে যে সূক্ষ্ম বিদ্রূপ রয়েছে, তা আবার অনেক মনোযোগী পাঠকেরই চোখ এড়িয়ে যাবে না। জামসেদ সাহেবের অবস্থান আজকের প্রজন্ম স্কয়ার আন্দোলনের বিপরীতে, কিন্তু চিরাচরিতভাবেই সোজাসুজি প্রকাশ করার সাহস তাদের নেই। তাদের অবস্থান বুঝে নিতে হয় তাদের দোদুল্যমনতা দিয়ে, তাদের পিছলানো স্বভাব দিয়ে।
কেমন শেষ চেয়েছিলেন আপনি? গল্পের উত্তম পুরুষ বলবে, ‘জামসেদ ভাই, আপনি একটা রাজাকার!’ এরকম সংলাপ প্রত্যাশা করছিলেন? গল্পের শেষ লাইনটি আবার দেখুন। জামসেদ সাহেবকে একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তি হিসেবে অঙ্কিত করা হয়েছে, একজন লোক নিজের দেশের বা ইতিহাসের দায় মেটানোর তাগিদ অনুভব করে না, পহেলা ফাগুনের রঙ্গিন আহবানকে হিন্দুয়ানী মনে করে দূরে সরিয়ে রাখে, অথচ ১৪ ই ফেব্রুয়ারি পালনে উৎসাহের কমতি নেই (আবার উল্টা বুইঝেন না যে, আমি ১৪ই ফেব্রুয়ারি পালনের বিপক্ষে), যাদের জন্য কবি আব্দুল কাদির লিখেছিলেন সেই অমর বানি, “যে সবে বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি!’, তাদের জন্য শতভাগ খাঁটি আন্তর্জাতিক মানুষ বা আন্তর্জাতিক ভালবাসার বিশেষণ চয়ন আপনার জন্য যথেষ্ট হল না কেন, সেটাই এক বিরাট প্রশ্ন আমার কাছে!
আপনি বিশ্বশ্রেষ্ঠ গল্পগুলো পড়ে দেখুন, সেখানে আপনি লেখকের সরাসরি প্রতিবাদ পাবেন না, ইঙ্গিতময়তা একটা বড় অনুষঙ্গ সেখানে।
@কাজি মামুন,
আপনার জামসেদ ভাইরে এক্কেবারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট খাঁটি বঙ্গদেশী আক্ষ্যাওয়ালা বাঁশ দিলেন বুঝি? তা, ফাল্গুনের ইতিহাসটা কী তা তো জানা হলোনা। পরের সাক্ষাতে তাকে জিজ্ঞেস করে নিবেন যাতে আমরাও জ্ঞানপ্রাপ্ত হই।
ছোট গল্প ভালা পাইছি- (Y)
ভালোবাসা দিবসে আপনার লেখা বেশ ভালো লাগল। ভালো লাগা জানিয়ে গেলাম।
@আকাশ মালিক ভাই,
জামসেদ টাইপের লোকগুলো কি এক অদ্ভুত মানসিকতা নিয়ে বড় হয়েছে, পহেলা ফাল্গুন এদের কাছে হিন্দুয়ানী মনে করে, আর ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে মনে করে মুসলমানি! 🙂
আসলে এদের ভিতরও ভালবাসা আছে, যা প্রাকৃতিক, কিন্তু এদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, যা বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ, তাই হিন্দুয়ানী, আর এজন্য পহেলা ফাল্গুনকে দূরে সরিয়ে দিলেও, প্রাকৃতিক তাগিদেই কাছে টেনে নেয় ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে। অথচ বুঝতেই পারে না, আদতে পহেলা ফাল্গুন আর ১৪ই ফেব্রুয়ারির মাঝে কোন পার্থক্যই নেই।
এরা সবসময় নিজের জাতিসত্তা বা আত্মপরিচয় নিয়ে দ্বন্দ্বে ভোগে, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর প্রায় চার দশকের পাইক্কা আবাদ বাংলাদেশে এমন অনেক জাতীয়তাবাদী রোগী তৈরি করেছে।