এটা বলাই বাহুল্য দিন-ক্ষণ গণনা বর্তমানে এই আধুনিক মানবজাতির জীবনযাত্রার অপরিহার্য অঙ্গ । বাংলাদেশের এবং ভারতের বাঙালিদের প্রাত্যহিক জীবনে বাংলা এবং গ্রেগরীয় বা খ্রিষ্টীয় বর্ষপঞ্জী, এই দুইই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত । বাংলা দিন গণনাকে যদি তুলনা করা হয় তার হৃদস্পন্দন রূপে তবে ইংরেজি তারিখ গণনাকে অভিহিত করা যেতে পারে তার মস্তিষ্কের স্নায়ু-তাড়না হিসাবে । এই দুয়ের কোন একটাকে বাদ দিলে তার জীবনযাত্রা প্রায় অচল ।
বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ আসে সাড়ম্বরে – চৈত্রের কাঠফাটা রোদ্রে আর বৈশাখের আমের সুঘ্রাণে ! সেখানে গ্রামে-গঞ্জে বাংলা বর্ষবরণ পালিত হয় কত বিশাল বৈচিত্রে আর হৃদয়-স্পর্শ করা আমেজে ! উৎসবের উচ্ছ্বাসে সকলের হৃদয়-মন আন্দোলিত হয় নানা মাত্রায় আর নানান ছন্দে | আর আমরা যারা অভিবাসে এখানে রোদ্রের খরতাপে উত্তপ্ত চৈত্র-বৈশাখ মাস অনুপস্হিত । তবু এই অভিবাসী বাঙালিরা তাদের হৃদয়-উচ্ছ্বাসের প্রাবল্যে প্রতি বৎসর এপ্রিল-মে মাসের কোনো এক সময়ে বাংলা নববর্ষের উৎসব করে অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মত করে !
সঙ্গত কারণেই ইংরেজি দিনপঞ্জি বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত অপরিহার্য রূপে বিবেচিত হলেও সেখানে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন এখনো পর্যন্ত হয়ে থাকে নিতান্তই সীমিত পর্যায়ে এবং বলা যায় অনেকটা কেবল আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ । তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বড় শহরগুলোতে ইংরেজি বিদায়ী বছরের অন্তিম মুহূর্তটি আর নতুন বছরের শুভ-সূচনার ক্ষণটি বেশ আড়ম্বরপূর্ণ হয় বলেই শুনা যায়|
এখানে আমাদের এই নতুন স্বদেশে আমরা অনাবাসী হলেও এটাই বাস্তব সত্য যে ইংরেজি বর্ষপঞ্জিই এখন আমাদের জীবনযাত্রার নিত্য অনুষঙ্গ। তবু সঙ্গত কারণেই এদেশের আদি-বাসিন্দাদের মত করে ইংরেজি নববর্ষ পালনের দিকটা আমরা নতুন অভিবাসী বাঙালিরা তেমন করে রপ্ত করতে পারিনি | এই অনাবাসে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ধারা বংশপরম্পরায় লালন-পালন করার আত্যন্তিক আকুতিতে শ্যাম্পেনের ফেনিল স্ফুলিঙ্গে আমোদিত করে মধ্যরাতে নববর্ষ উদযাপন করা আমাদের অনেকের কাছেই হয়তবা অপছন্দনীয় বা অগ্রহণীয় । তবে ধারণা করতে অসুবিধে হয় না যে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সন্তানদের কাছে ক্রমে ক্রমে এদেশীয় রীতিতে এদেশের ইংরেজি New Year’s Celebration-ই হবে মুখ্য বিষয় ।
এই বিশ্বে বাঙালিদের মত আরো অনেক জাতিগোষ্ঠীরই তাদের নিজস্ব দিনপঞ্জি আছে এবং সেই পঞ্জিকা মতে তারাও তাদের নববর্ষ উদযাপন করে থাকে । তবে ইংরেজি বর্ষপঞ্জিটি খ্রিষ্টীয় বর্ষপঞ্জি হলেও এটি এখন বিশ্ব-পঞ্জিকা হিসাবে সমস্ত বিশ্বে স্বীকৃত এবং আন্তর্জাতিক সকল ঘটনাবলিই তদনুসারে সংঘটিত হয়ে থাকে । সেই হিসাবে ইংরেজি নববর্ষটি এখন বিশ্বজুড়ে সকলের কাছেই বিশেষ প্রণিধানযোগ্য ।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দ সমাপান্তে নতুন বর্ষ ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ সমাগত । পুরাতনের বিদায়ে নতুনের আগমন এই বিশ্ব-প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম । তবে আমাদের দিনপঞ্জি থেকে ২০১২ সাল অন্তর্হিত হলেও আমাদের অনেকের মন থেকেই কিয়ৎকালের জন্য হলেও এর রেশ তিরোহিত হবে না কিছুতেই, কারণ তার সাথে আমাদের অনেকেরই হরেক রকমের আনন্দ-বেদনার স্মৃতি বিজড়িত ! ২০১২ সালে যারা তাদের আপনজনদের হারিয়েছেন তাদের মানসপটে সেই বিগত সালটি জীবনভর বিরাজিত হয়ে রবে এক ক্ষত চিহ্ন রূপে আর যাদের জীবনে ঘটেছে জীবন-সাথীর বা নতুন আত্মজের আগমন তাদের মনে সেই পুরাতন বছরটি উদ্ভাসিত হয়ে থাকবে আনন্দের আধার হয়ে ! আবার অনেকের জীবনে গত বছরটি ছিল আর সকল বছরের মতই সাদা-মাঠা এবং গতানুগতিক । তবে সদ্য আগন্তুক এই নতুন বছরটি আমাদের সকলের নিকটই অপরিচিত !
বৈশ্বিক পর্যায়ে গত বছরটি ছিল আর সকল পূর্ববর্তী বছরগুলোর মতই ঘটনাবহুল – তবে তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলির মধ্যে পরে এক সময়ে প্রায় সারা পৃথিবীব্যাপী সাম্রাজ্য বিস্তারকারী দেশ ইংল্যান্ডের সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সিংহাসনারোহনের ৬০ বৎসর পূর্তি উপলক্ষ্যে ডায়মন্ড জুবিলী পালিত, বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রভাব সৃষ্টিকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ব্যারাক ওবামার দ্বিতীয়বারের মত প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচন, লন্ডনের অলিম্পিক প্রতিযোগিতা, পৃথিবীর অনেক দেশে রাজনৈতিক অস্হিরতা আর সারা পৃথিবী জুড়ে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় আর ভূমিকম্পের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা । তবে আর একটি ঘটনা আমার বিবেচনায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য – আর তা হলো ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ আগস্ট আমেরিকার নাসা (NASA) পরিচালিত “মঙ্গলগ্রহ বিজ্ঞান গবেষনাগার” (Mars Science Laboratory) নামের স্বয়ংক্রিয় রোবট মহাকাশ অনুসন্ধানকারীর নিরাপদে মঙ্গলগ্রহে অবতরণ । তার উদ্দেশ্য মঙ্গলগ্রহে মানুষের বসতিস্হাপনের সম্ভাবনা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, মঙ্গলের জলবায়ু আর ভূতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করা এবং মঙ্গলগ্রহে মানুষবাহী নভোযানের অবতরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উপাত্ত সংগ্রহ করা । এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে মঙ্গলগ্রহে স্হায়ীভাবে মনুষ্য-বসতি স্হাপনের পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে সেখানে সারা পৃথিবী থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত প্রথম চারজন নভোচারী প্রেরণের লক্ষ্যে একটি নেদারল্যান্ড-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক বেসরকারী অলাভজনক (not-for-profit) প্রতিষ্ঠান ২০১২ সালে “মঙ্গলগ্রহ এক ( Mars One)” নামে একটি প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছে । আমাদের এই সবুজ-গ্রহের এই চারজন বিশেষ মানুষ সেখানে পাড়ি জমাবে চিরদিনের জন্য, সেই লাল গ্রহে স্হায়ীভাবে বসবাসের জন্য । তারপর থেকে এই প্রকল্প পর্যায়ক্রমে প্রতি দুই বৎসর অন্তর অন্তর সেখানে পাঠাবে আরো চারজন করে এই পৃথিবীর মানুষ । সীমিত পরিসরের এই পৃথিবী নামক গ্রহের জনবহুল এলাকাগুলোতে যেখানে ভূমি-দখল আর ভূমির মালিকানা নিয়ে প্রতিদিন হানাহানি-খুনাখুনি লেগেই আছে সেখানে মঙ্গলে মানব প্রজাতির বসতি স্হাপনের সংবাদ নিঃসন্দেহে আনন্দসূচক বৈকি ! ! তবে ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মঙ্গলগ্রহে মানুষের বসতিস্হাপন শুরু হলেও আমার মত সাধারণ মানুষদেরকে যে আরো বহুকাল এই পুরানো পৃথিবীতেই বসবাস করতে হবে এটা বোধ করি অনায়াসেই বলা যায় । তাই আমার বিবেচনায় আমাদের প্রয়োজন এই মাতৃ-পৃথিবীর প্রতি আরো যত্নবান হওয়া !
এখন এই একবিংশ শতাব্দিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির যুগে যদিও এই মানব প্রজাতি তাদের ভবিষ্যত সন্বন্ধে অনেক কিছুই আগাম ধারণা করতে পারে তবে নতুন বছরে আমাদের ব্যক্তি জীবনে কি অভূতপূৰ্ব আকস্মিক ঘটনাবলী ঘটতে পারে সে বিষয়ে আমরা অজ্ঞাত ! তবে আমরা সকলেই নতুন বছরের তরে বিচিত্র সব নতুন আশায় বুক বাঁধি ! তবে শুধু আশা করলেই চলে না । আধুনিক মানুষ হিসাবে আমরা জানি আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও আমরা আমাদের বুদ্ধি আর পরিশ্রম দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ গড়নে ভূমিকা রাখতে পারি।
ধারনা করা যায় বিগত বছরের ন্যায় এই নতুন বছরেও আমাদেরকে মোকাবিলা করতে হবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, আর আমি মনে করি আমাদের সন্মুখে তার থেকেও বড় দূর্যোগ সারা পৃথিবী ব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তন্ আর প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়া ! আধুনিক মানুষ হিসাবে আমরা জানি মানুষ সহ এই পৃথিবীর সকল জীবজগৎ এই মাতা-প্রকৃতির উপর সর্বতোভাবে নির্ভরশীল । ডাইনোসরের মত বিশালাকায় প্রাণী যারা একদিন বিপুল বিক্রমে এই পৃথিবীর বুকে রাজত্ব করে বেড়াত তারা এক সময় প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেদেরকে খাপ খাওয়াতে না পারার জন্য হয়েছে বিলুপ্ত।
মানুষজাতি এতকাল যাবৎ এই পৃথিবীতে ঠিকে আছে তার বুদ্ধির জোরে মাতা-প্রকৃতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে । আমরা জানি প্রতিনিয়ত এই প্রকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে – এই পরিবর্তন কখনো কখনো মানুষের জন্য অনুকূল আবার কখনো প্রতিকূল । বুদ্ধিমান মানুষ (Homo sapiens sapiens)-এর কর্তব্য মানুষ সহ সমস্ত জীবকূলের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যে তার জীবনযাত্রা নির্বাহ করা । কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি আমরা এই বুদ্ধিমান মানুষেরা তাদের অতি আয়েসী জীবন যাপন করতে গিয়ে এই মাতা-প্রকৃতিকে কলুষিত করছি অহরহ । আজ ক্যানাডা-আমেরিকার মত বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে উন্নত দেশসমূহ পরিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছে তার বাসিন্দাদের অতি আয়েশী জীবনযাত্রার রসদ জোগাতে । আমরা জানি আজ আমাদের এই বাসভূমি ক্যানাডাতে বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন এক বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে । মানুষের বিবেচনাহীন কর্মকান্ডের ফল স্বরূপ উদ্ভূত মাত্রাতিরিক্ত বর্জ্য পদার্থ প্রাকৃতিক পরিবেশকে দূষিত করছে ।
আমরা অনেকেই জানি আগামী দিনগুলোতে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন (Global warming) ক্রমে ক্রমে মানব-প্রজাতির তথা সমস্ত জীব জগতের জন্য এক বিরাট হুমকি স্বরূপ আবির্ভূত হচ্ছে । আজ এটি বৈজ্ঞানিক এবং বাস্তবিক সত্য যে মানুষ তার আয়েসী ও অপরিকল্পিত জীবনধারার মাধ্যমে এই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ত্বরান্বিত করছে । ক্যানাডা, যুক্তরাষ্ট্রের মত ধনী দেশগুলোতে অপরিকল্পিত আর উচ্চহারে গাড়ির ব্যবহার বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমান বাড়াচ্ছে, মাংসাসী মানুষের অপরিমিত পরিমান মাংসের যোগান দিতে মাত্রাতিরিক্ত পরিমানে গবাদিপশুর উৎপাদন, আর বর্জ্য পদার্থের ব্যবস্হাপনা থেকে তৈরী হচ্ছে মিথেন গ্যাস, আর ধনী দেশগুলোতে কৃষিতে মাত্রাতিরিক্ত আর অপরিকল্পিত ভাবে নাইট্রোজেন সারের ব্যবহারের ফলে বায়ুমন্ডলে যোগ হচ্ছে নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস । গ্রীন-হাউজ গ্যাস (Greenhouse gases) নামে পরিচিত এই সকল গ্যাস এই বৈশ্বিক উষ্ণায়নেকে করছে ত্বরান্বিত ।
আমরা হয়ত অনেকেই জানি না বার্ষরিক মাথাপিছু শক্তি (energy) ব্যবহারের পরিমান এই পৃথিবীতে ক্যানাডায় সর্বোচ্চ আর বিলাসী জীবন যাপনের ফলে বায়ুমন্ডলে গ্রীন-হাউজ গ্যাস নির্গমনে ক্যানাডার স্থান দ্বিতীয় । এই বিশ্বে মানব উন্নতির কষ্টিপাথরে বিবেচনা করলে এই দুটোই আশঙ্কার আর একই সাথে লজ্জার বিষয় ! আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় : ক্যানাডার জনসংখ্যা মাত্র ৩ কোটি, কিন্তু এখানে শক্তি অর্থাৎ জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, বৈদ্যুতিক শক্তি ইত্যাদি ব্যবহারের পরিমান পুরো আফ্রিকা মহাদেশে এই শক্তি ব্যবহারের সমকক্ষ যদিও সেখানে মানুষের সংখ্যা ৭০ কোটি ! এই বিপুল পরিমান শক্তির অপচয় আমাদের এই পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশকে দূষিত করার সাথে সাথে আমাদের অর্থনৈতিক মন্দাকে করবে আরো অধিক মন্দীভূত !! গত ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আমাদের এই গ্রহের তাপমাত্রা প্রতি বছর গড়ে 0.৬0 সেলসিয়াস হিসাবে বাড়ছে এবং আমাদের উত্তর গোলার্ধ গত ১০০০ বছরের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন অধিক উষ্ণ । পৃথিবীর এই গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীব্যাপী জলবায়ুর ক্রম পরিবর্তন হচ্ছে – তার পরিণতি স্বরূপ সারা পৃথিবীতে বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমান বাড়ছে -এবং এন্টার্কটিকা মহাদেশের স্হায়ী বরফের স্তুপ ক্রমাগত গলে যাচ্ছে – এবং এর পরিণতিতে মহাসাগরগুলোতে জলের উচ্চতা বাড়ছে । এর ফলে একদিন হয়তবা মালদ্বীপের মত দেশ পুরো সাগরের নিচে তলিয়ে যাবে, বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চল বঙ্গোপসাগরে বিলীন হবে !!
তাই এই নতুন বৎসরের প্রাক্কালে সকলের প্রতি আহ্বান – এই নতুন বছরে আমাদের নতুন স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আর আমদের এই শ্যামলা বসুন্ধরাকে আরো শ্যামলাতর করতে আমরা আমাদের নিজেদের সীমিত পরিসরে আমাদের স্ব স্ব কর্তব্য আর দায়িত্ব পালন করি । আমরা কি ইচ্ছা করলেই পারি না আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে গাড়ির ব্যবহার আর একটু কমাতে ? আমাদের গৃহে জল, বিদ্যুৎ, আর প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহারে আরো একটু সাশ্রয়ী হতে ? আমরা কি আর একটু সচেতন হলে পারি না আমাদের অনুষ্ঠানগুলোতে ফোমের থালা-গ্লাস ব্যবহার করার পরিবর্তে বহুবার-ব্যবহারোপযোগী থালা-গ্লাস ব্যবহার করতে ? আমরা কি পারি না আমাদের প্রতিটি পরিবারে বর্জ্য পদার্থ উৎপাদনের পরিমান আরো একটু কমাতে? হ্যাঁ, আমরা ইচ্ছা করলেই পারি, তার জন্য চাই কেবল আমাদের একটু ঐকান্তিক ইচ্ছা !! আসুন আমরা এই নতুন বছরে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে কোনো জিনিস ব্যবহারের কালে তিনটি শব্দ মনে রাখি আর সেই তিনটি শব্দ হলো: Reduce, Reuse আর Recycle :
বর্ষ-শেষের প্রার্থনা:
বিলীন হলো বুঝি আরো একটি বৎসর,
মহাকালের মহা-অতল তলে,
সময় দেবতা এসে হেসে
জানায়ে গেল মোরে ইত্যবসরে,
জমা হয়েছে মোর কত শত-সহস্র ঋণ
এই মাতা বসুন্ধরার তরে !
কে জানে হয়তবা মিলিবে অবকাশ
আরো একটি বৎসরের তরে,
যদি পারি শোধিতে কিঞ্চিত এই মহা ঋণ-ভার ?
প্রণমি এই সময় দেবতারে –
কহিলাম আমি করজোড়ে,
দেও মোরে শক্তি -বুদ্ধি-বিবেচনা অকাতরে,
পারি যেন এই ঋণ খানিক শোধিবারে
নতুন এই বৎসরের বিচিত্র কর্মযজ্ঞে !!
নতুন বৎসর সকলের পারিবারিক জীবনে মঙ্গল বহে নিয়ে আসুক, এই ধরিত্রী মাতার প্রতি আরো মমতাশীল হওয়ার নিমিত্তে এই পৃথিবীর সকলের মনে শুভবুদ্ধির উদয় হোক নববর্ষে সকলের তরে রইলো এই আন্তরিক শুভ কামনা । সকলকে -“Happy New Year-2013″।
দ্রষ্টব্য : আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট স্টেটের একটি ছোট্ট শহর নিউটাউন (Newtown) । সেখানে মাত্র ২৭০০০ হাজার লোকের বাস । সেই শহরেরই একটি ছোট্ট গ্রামীণ এলাকা Sandy Hook, আর সেখানকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় Sandy Hook Elementary School l ফুলের মত ফুটফুটে সুন্দর সব শিশুরা সেই বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী । ২০১২ সাল প্রায় তার শেষ প্রান্তে ! আর কয়েকটা দিন পরই বড়দিনের উৎসব আর নববর্ষ ! মনে তাদের উপচে-পড়া আনন্দ ! আর তার মধ্যেই এল সেই কাল দিন – ডিসেম্বর ১৪ । আর সব সকালের মতই সেই সকালেও সেই শিশুরা ছিল তাদের শ্রেণীকক্ষে অধ্যয়নরত । এরই মধ্যে আচমকা তাদের শ্রেণীকক্ষে ঢুকলো মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্রধারী এক আততায়ী । নির্দয়, নৃশংস সেই আততায়ী এলোপাতাড়ি গুলি চালালো । মেঝে লুটিয়ে পড়ল ২০ টি কুসুম কলি, সেই সাথে সেই বিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল সহ আরো ছয় জন শিক্ষাজীবী !
কি মর্মন্তুদ অকল্পনীয় ঘটনা !! এই রূপ ঘটনা যেকোন স্বাভাবিক মানুষকে মর্মপীড়ায় জর্জরিত না করে পারে না ! যদিও মৃত্যু এই জীবনেরই অঙ্গ কিন্তু মাত্র ছয়-সাত বৎসর বয়সী এই ২০টি নিষ্পাপ শিশুর এই ধরনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর শোক বহন করা সেই সকল শিশুর মাতা-পিতার পক্ষে কি রকম দুরূহ ব্যাপার তা বোধ করি অন্যদের পক্ষে কল্পনা করাও দুঃসাধ্য !!
যদিও আমরা সকলেই জানি এই পৃথিবীর কোন স্থানই আমাদের কল্পনার আর আরাধনার স্বর্গলোক নয়, এখানে কোন মানুষই একশত ভাগ নিরাপদ নয় তবু এই ধরনের গণহত্যার ঘটনা আমাদের চেতনাকে বিশেষ ভাবে আন্দোলিত করে, আমাদের যুক্তিবাদী মনকে হাজারো প্রশ্নে জর্জরিত করে । কেন আমেরিকার মত একটি ধনাঢ্য ও তথাকথিত উন্নত দেশে বেড়ে উঠা ২০ বৎসরের একটি যুবক এতগুলো নিরপরাধ শিশুকে খুন করল, কেন সে তার নিজের গর্ভধারিণীকেও উপর্যুপরি বুলেটের আঘাতে হত্যা করল এটা নিঃসন্দেহে খুবই গভীর রহস্যজনক এবং একটি জটিল গবেষণার বিষয় ! তবে এতদসত্বেও এটা বোধ হয় নির্দ্বিধায় বলা চলে যে একটা স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এই ধরনের একটি ঘটনা ঘটানো অসম্ভব ! সেই বিচারে বলা যায় সেই আততায়ী, মাতৃহন্তারক ও আত্মঘাতী যুবকটি ছিল মানসিক ব্যধিগ্রস্ত ! কিন্তু প্রশ্ন হলো কেমন করে সেই অস্বাভাবিক মানুষটি আয়ত্ব করল তার মা’র অধীনস্ত মারাত্মক সব আগ্নেয়াস্ত্র ? সেই যুবকটি যে তার মায়ের সাথে বসবাস করত তার মা কি জানত না তার ছেলেকে ? তিনি কেন ছিলেন তার ছেলের মানসিক অবস্হা সম্পর্কে এতটাই নির্বিকার ? কেন তিনি তার আগ্নেয়াস্ত্রসমূহ রাখতে পারলেন না নিরাপদ স্থানে, তার মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন সন্তানের ধরা ছোঁয়ার বাইরে ??
আরেকটি বিরাট প্রশ্ন – এ বিষয়ে রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে ! আমরা জানি ১৭৯১ সালের ১৫ ডিসেম্বরে আমেরিকার সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে সেখানে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যক্তিগত ব্যবহার সরকারিভাবে অনুমোদিত হয় অর্থাৎ ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অজুহাতে জনসাধারণের অস্ত্র রাখা ও বহন করা রাষ্ট্রীয় ভাবে বৈধ করা হয় । তবে অস্ত্র ধারণকরা বৈধ হলেও সেই অস্ত্রের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা বা তার অপব্যবহার রোধ করতে সেই অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসাবেই রয়ে যায় ! কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমেরিকার রাষ্ট্রব্যবস্হা কি পারছে তার সেই দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করতে??
এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্রের ছড়াছড়ি ! বলা হয়ে থাকে সেখানকার মোট জনসংখ্যার চেয়ে সেখানে জনসাধারণের কাছে আগ্নেয়াস্ত্রের পরিমান বেশি ! সেখানে প্রতি বৎসর প্রায় ১২০০০ লোক অস্ত্রধারীর গুলিতে নিহত হয় ! আর নিউটাউনের ঘটনার মত এই ধরনের নৃশংস গণহত্যার ঘটনা আমেরিকার ইতিহাসে এই প্রথম নয় ! স্যান্ডি হুক বিদ্যালয়ের এই হৃদয়-বিদারক ঘটনা আমদেরকে মনে করিয়ে দেয় ২০০৭ সালের এপ্রিলের ১৬ তারিখে আমেরিকার ভার্জিনিয়া স্টেটের ভার্জিনিয়া টেক (Virginia Tech) বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া অনুরূপ আর একটি ঘটনার কথা । সেখানে এক আততায়ীর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে নিহত হয় ৩২ জন ছাত্র !
মানসিক ভাবে অসুস্হ মানুষ আর মানুষ নামধারী কিছু হিংস্র প্রাণী এই পৃথিবীর সর্বত্রই বিদ্যমান ! কিন্তু এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব একটি সুষ্ঠু আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন অনুমোদন ও তার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করা যেন এই কিছু অপ্রকৃতস্ত আর দুষ্কৃতিকারীর কাছে অস্ত্র প্রাপ্তি হয় দূর্লভ্য ! সেখানে আগ্নেয়াস্ত্র এতটা সহজলভ্য না হলে হয়তবা ঘটত না Virginia Tech আর Sandy Hook স্কুলের সেই নৃশংস গণহত্যার মত ঘটনা ।
আমার বিবেচনায় একটি উন্নত বিশ্বের দেশে হিসাবে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আর কাল বিলম্ব না করে এই ব্যক্তিগত পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্র ধারণ, বহন ও ব্যবহারের নিয়ন্ত্রনের বিষয়টি বিশদভাবে তলিয়ে দেখা এবং শীঘ্রই এ বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্হা গ্রহণ করা !
আমরা ধারণা করতে পারি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে দীর্ঘ সময়ব্যাপী অন্তর্ভুক্ত এই অস্ত্র আইনটির সংশোধন বা পরিবর্তন করা সহজ সাধ্য নয় কারণ বর্তমান অস্ত্র আইনটির পক্ষে সমর্থনকারী গোষ্ঠীর সংখ্যাও সেখানে নেহাৎ কম নয় । তবে নিউটাউনের এই নৃশংস শিশু হত্যাকান্ডের পর বর্তমানে আমেরিকার সাধারণ জনগণ আমেরিকার বর্তমান অস্ত্র আইনটির বিরুদ্ধে সোচ্চার ! আশা করি প্রেসিডেন্ট ওবামা তথা আমেরিকার প্রশাসন এই সুযোগের সৎ ব্যবহার করে তাদের অস্ত্র আইনের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করে এই ধরনের ভয়াবহ ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে বিশেষ তৎপর হবে । আজ সারা বিশ্বে একটি প্রভাব সৃষ্টিকারী দেশ হিসাবে আমেরিকা এই কাজটি যত দ্রুত করতে পারবে ততই আমেরিকার জন্য হবে মঙ্গলজনক এবং অন্য অনেক দেশেও তা হতে পারে অনুকরণীয় |
সব শেষে Sandy Hook বিদ্যালয়ের সেই হৃদয় বিদারক ঘটনায় নিহতদের মাতা-পিতা আর অনান্য স্বজনদের প্রতি রইলো আমার গভীর সমবেদনা আর এই পৃথিবীর কোথাও যেন এমন ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য মর্মের গভীর থেকে রইলো আমার প্রার্থনা !!
জানুয়ারী ১, ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ
গুয়েল্ফ, ক্যানাডা
লেখাটা পড়লাম। ভাল লাগলো নতুন বছরের শুভেচ্ছা। কিন্ত আরো ভালো লেগেছিল আপনার সেই ‘ছিন্ন স্মৃতি’র পর্ব। মাত্র দুটো পর্ব পেয়েছিলাম। বাল্যকালের নষ্টালজিক সেই স্মৃতি ভ্রমনের কাহিনী অনেক আগ্রহ নিয়ে পড়েছিলাম। শিশু মনের উপর সামাজিক নেতিবাচক তা কিভাবে প্রভাব ফেলা আপনার সেই সব লেখায় তা ফুটে উঠেছিল। এগুলো আমাদের শিকড়। ঐ লেখার অসমাপ্ত পর্বগুলো কি আমারা পাবো? ধন্যবাদ।
প্রিয় শাখা নির্ভানা,
আমার আন্তরিক ধন্যবাদ লেখাটা পড়ার জন্য । “ছিন্ন স্মৃতি” বিষয়ে আপনার সহৃদয় অনুপ্রেরণামূলক মন্তব্য পড়ে মনে পরবর্তী পর্ব লেখার উৎসাহ জন্ম নিচ্ছে ! নববর্ষে আপনার ও আপনার পরিবারের প্রতি রইলো আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা !