স্কুল অব লাইফ
চকচকে আর তেলতেলে স্কুলটির বহির্দেয়াল ঘেঁষে এক চিলতে ডাস্টবিন আর তার অববাহিকায় গড়ে উঠেছে এক খুদেকায় বস্তি। স্কুলটির অন্দরমহলের মতই বাইরের এই ডাস্টবিনটিতেও চলে বিপুল কর্মযজ্ঞ, দৃশ্যমান হয় ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্য! মানুষ-পশুর নিত্য আনাগোনা এখানে! বইয়ের পাতার মতই এই রাজ্যের প্রতিটি প্রস্থ উল্টে-পাল্টে দেখে মনোযোগী ছাত্রের দল। আবিষ্কারের নেশায় আবিষ্ট চোখে চেয়ে থাকে তারা, যতটা পারা যায় থলে বোঝাই করে নেয়া চাই, মুক্তো মিলুক আর নাই মিলুক, সাগর সেঁচা চলতেই থাকে।
কিন্তু অভিযানের ফাঁকে ফাঁক পেলেই ছাত্রের দল মেতে উঠে কোলাহলে। একটু ফুরসুত পেলেই ভীষণ উচ্ছৃঙ্খল আর অশান্ত হয়ে উঠে তারা। যেমন, এই মুহূর্তে দেয়াল ছাড়িয়ে শোনা যাচ্ছে ভীষণ শোরগোল, অশ্রাব্য খিস্তি-খেউরের মুহুর্মুহু আঘাতে পথচারীদের কানের পর্দা ফেটে যাবার যোগাড়। দু’জন মধ্যবয়স পেরুনো প্রায় বুড়ি এক হার না মানা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে আজ। বাচনিক তীর ছোঁড়াছুড়ির পাশাপাশি চলছে শারীরিক শক্তির অভিনব প্রদর্শনী। একটি সাধারণ চেহারার আটপৌরে থলে নিয়ে এই মুহূর্তে তাদের মধ্যে চলছে প্রবল আর পাশবিক টানাটানি।
“আরে, ভাতার খাকি মাগি, আমি না দেকলে ব্যাগডা তুই হাতাইতে পারতি? জিনিস্টা দেইখ্যা চিল্লায় উঠতেই হারামজাদি ছো মাইরা বস্তায় ঢুকায় ফালাইল। ছাড় কইতাছি, ছাড়, আমার জিনিস হাত থাইকা ছাড়।”
“কুয়ারা দেখছনি, খানকি মাগির! আমার জাগায় আমার হাত দিয়া জিনিস কুড়ামু, আর নটির জি’রে বলে তা ছাইড়া দিতে হইব!”
“তর কোন ভাতারে এই জাগা কিনা রাখছিল তর লাইগা? আবারো কইতাছি, আমার জিনিস আমারে দিয়া দে। নইলে আমার ছাওয়ালগো দিয়া তরে দেশছাড়া করমু, কইয়া রাখলাম!”
“পোলার দেমাগ দেখাইস না আমারে। আমার পোলারা তরে পাইলে হাড্ডি মাংস আলাদা কইরা নদীতে ভাসাইয়া দিব, বুঝলি! ”
তখন দেয়ালের ভিতরের স্কুলটির নতুন শিফট শুরু হতে যাচ্ছিল। স্কুলের দিকে হেঁটে আসছিল এক দল ধবধবে ফর্সা বালিকা। কয়েক গজ দূরের এই নাটকীয় দৃশ্য তারা খুব পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছিল। সংলাপের সঙ্গে সঙ্গে এই দুই বেআবরু, মধ্য বয়স পেরুনো, প্রায় বুড়ির অ্যাকশন থ্রিলার তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিল তারা। হাসতে হাসতে যখন তারা গড়িয়ে পড়ছিল একের উপর অন্যে বা অন্যের উপর একে, সাদা বলাকাদের ডানা ঝাপ্টাচ্ছিল যেন! অনেক দিন তারা এমন আনন্দদায়ক লাইভ শো দেখেনি। এখন পর্যন্ত গ্রেটেস্ট শো অব দেয়ার লাইফ!
ওদিকে দেয়ালের ওপাশে স্কুল ভবনটির দোতলা বারান্দা থেকে এক জোড়া ধবধবে ফর্সা আর উৎসুক মুখ ঢলে ঢলে পড়ছিল নীচের দিকে। হেড মিস্ট্রেসের কপালে বিরক্তির ভাঁজ স্পষ্ট হলেও এসিস্টেন্ট হেড মিস্ট্রিসকে দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। সে শুধু অন্তর্নিহিত ছটফটানি ও ধড়ফড়ানি চেপে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। হেডমিস্ট্রেস আর নীচের ল্যান্ডস্কেপের দিকে বার কয়েক তাকিয়ে একসময় এসিস্টেন্ট নীরবতা ভাঙল।
“বস্তিটি সরিয়ে দিলে হয় না, আপা?”
“তোমার যেই কথা! ঐ জায়গা কি স্কুলের? তাছাড়া, বস্তি সরানো এত সহজ না! দেখা গেল, তুমি-আমিই সরে গেলাম। মিডিয়া আর মানবতাবাদীদের কাছ থেকে পালিয়েও কুল পাবে না।”
“তাহলে উপায়? আমাদের বাচ্চাদের শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে, আপা। এভাবে চললে তো ওদের লেখাপড়া চুলোয় উঠবে।”
“হুম, আমিও তো তাই ভাবছি। আচ্ছা, একটা কাজ করলে কেমন হয়? আমি আর তুমি আলাদা ভাবে ঐ দুই বুড়ির সাথে যোগাযোগ করব। আমরা দুজনকেই টোপ দেব যে, ওরাই হবে বস্তির রাণী। দেখবে, ওরা তখন আমাদের কথামত চলবে। আমাদের নির্দেশ ছাড়া আর একটা কাজও করবে না তখন। বোনাস হিসেবে পাব ওদের শক্ত-সমর্থ বেপরোয়া ছেলেগুলোর আনলিমিটেড সার্ভিস। দেখ, আমাদের স্কুলখানি ঝকঝকে তকতকে করে রাখবে ওরা। তাছাড়া স্কুলের সিকিউরিটির কাজেও লাগানো যাবে ঐ শক্ত-সমর্থ কালবর্ণের ছেলেপুলেগুলোকে।”
“প্লান মন্দ না, কিন্তু কালো ছেলের কথা বলায় ওবামার কথা মনে পড়ে গেল, আপা!”-এসিস্টেন্ট হেড মিস্ট্রেস অনেক চেষ্টা করছেন চেপে রাখতে, কিন্তু পারছেন না। তার বুকে আবার উঠেছে প্রবল ধড়ফড়ানি! অন্তর্নিহিত।
শীতের সওদা
‘এই সোয়েটারগুলো নির্ঘাত চোরাই মাল।” ফারুক দৃষ্টি আকর্ষণ করে মারুফের। দু’বন্ধু বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়েছিল। তবে কিছুদূর এগুতেই ফুটপাতের এক কোনায় ‘এক দাম তিনশ’ ‘যেইডা লন তিনশ’, ‘বাইছা লন তিনশ’ ‘শেষ হওয়ার আগেই লন তিনশ’ শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে।
“না, আমার তা মনে হয় না। এগুলি খুব সম্ভবত রিলিফের মাল। দেখস্ না, শীত আইলেই শহরের ধনী মানুষগুলো গরম কাপড় বিলানোর লাইগা কেমন ঝাঁপাইয়া পড়ে!”
“রিলিফ হইলেও এগুলি চুরির জিনিস, আমি নিশ্চিত। রিলিফের স্টক থেকেই কায়দা কইরা সরানো হইছে।”
“না, তা নাও হইতে পারে। হয়ত ফকিন্নির দল কাঁচা পয়সার লোভে এইগুলি বেইচা দিছে।“
“যাই হউক, আমার কিন্তু জিনিসগুলি দারুণ পছন্দ হইছে। খুব মোলায়েম, কি কস্। আর ডিজাইনগুলি কি সুন্দর! ”- ফারুকের চোখ-মুখে মুগ্ধতা গলে গলে পড়তে থাকে।
“তুই কিনলে কেন, তয় আমি কিনমু না। চোরাই মাল কিনা গুনাগার হউনের কোন শখ নাই আমার। ”
“গুনার প্রশ্নই উঠে না, বেকুব। আমরা তো নগদ অর্থের বিনিময়ে কিনমু। চুরি করছে যারা গুনাহ তাগো হইব, আমাগো ক্যান?”
“তারপরও আমার মন সায় দিতাছে না। তুই কিনতে চাইলে তাড়াতাড়ি কিইনা ফ্যাল একটা। কিইনা চল তাড়াতাড়ি ভাগি এইখান থেকে।”
“আমি একটা কিনমু কে কইল তরে? আমার অন্তত পাঁচ-ছয়টা নেওনের প্লান আছে। মার্কেটে এই সোয়েটারগুলির একটাও দুই হাজার টাকার নীচে পাইবি না। তাই কইতাছি, তুইও যে কয়টা পারস্ নিয়া ল।”
“তুই ব্যাটা একটা আস্তা আহাম্মক। আজকেই তো আওনের সময় কইতেছিলি, তর এখন খুব হাত টানাটানি। তাইলে কি দরকার এতগুলি কেনার? সোয়েটারের যাদুঘর বানাইবি নাকি?”- কৌতুক ঝরে পড়ে মারুফের চোখে।
“ভাবিস না, টাকা আছে পকেটে। বাতেনের দোকানের টাকাডা আইজ দেওনের কথা আছিল। প্রায় হাজার দুয়েক টাকা। এহন ভাবতাছি, ঐ টাকায় যে কয়টা পাওয়া যায়….”
কথা শেষ করতে দেয় না মারুফ, “মাইন্সের টাকা বাকী রাইখা তুই এইগুলি কিনবি? তুই ব্যাডা মানুষ ভাল না। খাচ্চর কোনহানকার!”
“তুই একটা জিনিস ভুইলা যাইতেছস্, দোকানের টাকা দেওনের সময় পাওয়া যাইব। কিন্তু এই জিনিস আর পাইবি না।”
“ক্যান পাওয়া যাইব না? শীত আবার আইব। লগে লগে চোরাই জিনিসও আইব।”
“দেখ, শীত সবসময় আসে না। ঠাণ্ডা কি সবসময় পড়ে?”
“ঠাণ্ডাই যদি না পড়ে, তাইলে তো কইতে হয়, তর টাকাগুলি সব পানিতে ফালাইলি! ”
“তর কথা থামা দেখিন, মুখপোড়া! এগুলি শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সব সিজনেই পড়া যায়, বুঝলি, তাকায় দেখ্, জিনিসগুলা কি মোলায়েম আর মিহি!’’
ভালই লাগল চট করে শুরু এবং শেষ হয়ে যাওয়া অনুগল্প দুটি।
আমি বেরসিক টাইপ মানুষ, অন্তর্নিহিত কথাবার্তা তেমন বুঝি না, প্রথম গল্পে মনে হল স্কুল ওয়ালারা তাদের মৌলিক সমস্যার সমাধান হবে কিনা সেটাই চিন্তা করেনি। বস্তির লোককে চাকরি বাকরি দিয়ে হাতে রাখলেই কি তারা খিস্তি খেউড় বাদ দিয়ে ভদ্দরলোক হয়ে যাবে!
পরের গল্প পড়ে মনে হল এক মাঘে শীত যায় না, কাজেই হতাশ হবার কিছু নেই।
@আদিল ভাই,
চরম শীতে মৃতপ্রায় এই গল্পটিকে খানিক জীবন ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে জানাই ধন্যবাদ…………….
‘স্কুল অব লাইফ’- অনুক্ষণ কাড়াকাড়িতে লিপ্ত দুই মহিলার মাঝে বাংলাদেশের কারো প্রতিচ্ছবি দেখতে পান, আদিল ভাই? অথবা, দুই ধবল প্রধান শিক্ষিকার মাঝে আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী নেতা-নেত্রীদের? বাংলাদেশকে আজ অনেকে ‘স্কুল অব লাইফ’ বলে থাকেন। বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক মুরুব্বিরা! স্কুলের পাশের বস্তিতেও চলে ব্যাপক অনুসন্ধান, অহর্নিশি সাধনা, যেমনি করে স্কুলের ধবল বক-সাদা বালিকারাও চালায় বইয়ের রাজ্যে অনুসন্ধান, করে সাধনা!
‘শীতের সওদা’-সুযোগ পেলেই চোরকে ধোলাই দেই, বীরপুরুষ সাজার এমন মহান সুযোগ মিস করতে চাই না আমরা কেউ, কিন্তু চুরির মাল গলঃধকরনে আমাদের বিন্দুমাত্র বমিটিং হয় না, এমনকি শীতের মাল হলেও তার উপযোগিতা গ্রীষ্ম-বর্ষা অব্ধি নিয়ে যেতে পারি অবলীলায়। শীতে অনেক পাখি ভিড় করে, শীতের জন্য তৈরি হয়ে থাকে এক বণিক শ্রেণি, আর সওদার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তীর্থের কাকেরা!
আমার কি দুর্ভাগ্য, আমাকেই ব্যাখ্যা করতে হল! এমনই ব্যর্থ একটা রচনা এটি!
সবশেষে, আদিল ভাই, আপনাকে বসন্তের আগাম শুভেচ্ছা! বেশি দূরে তো নয়!
রূপক ফুটে উঠেছে।
কাল ছেলের কথা বলায় বুকে ধড় ফড়ানি হল প্রথম গল্পে আর দ্বিতীয় গল্পে এগুলি শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সব সিজনেই পড়া যায়, বুঝলি, তাকায় দেখ্, জিনিসগুলা কি মোলায়েম আর মিহি!’’
রুপক মনে করেই তো ভাবলাম। মনে হয় বেশি ভেবে ফেলেছি।ঠিক আছে ভাবনা কমিয়ে নিলাম।
@গীতাদী,
বেশি ভাবা খারাপ নয় কিন্তু সবসময়। তবে যাই ভাবুন না কেন, আপনার সেই ভাবনা যে অত্র অর্থহীন (মৃত অর্থে) লেখাটিকে ক্ষনিকের তরে হলেও কবর থেকে টেনে তুলেছে, তার জন্য আমার সীমাহীন কৃতজ্ঞতা! আপনি যদি ভাবনা কমিয়ে দেন, লেখাগুলোর সাথে লেখকগুলোরও অক্কা পাওয়ার শংকা!
অণুগল্প লেখক, অল্প কথার গল্প দুটো ভালই হয়েছে, তবে দুটো গল্পেরই সমাপ্তিটি কি বেশি শরীরবৃত্তীয় বলয়ে …………………………..
@গীতাদী,
সবসময় উদ্ধার করেন, এজন্য কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
সত্যি বুঝিনি, দিদি! বুঝলে আমার ব্যাখ্যাটি দিতে পারতাম। যাই হোক, শুধু এইটুকু বলছি, গল্পদুটি’তে আমার অনেক ভাবনাকে স্থান দিয়েছি স্যাটায়ারের আদলে। চলমান সময় এবং দেশকে তুলে ধরার প্রচ্ছন্ন প্রয়াস ছিল। রূপক বা স্যাটায়ার সঠিকভাবে ফুটে না উঠলে, সে আমারই ব্যর্থতা। সবচেয়ে বড় কথা, এটা তো একটা গল্প-প্রচেষ্টা! 🙂
তবু সবসময় যে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন, মৃত কোন লেখাকে ক্ষনিকের জীবন ফিরিয়ে দেন, তার জন্য সত্যি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।