বাংলাদেশে দূর্ঘটনা জনিত কারনে প্রানহানীর সংবাদ মনে আর তেমন রেখাপাত করে না, সবই অভ্যাস। অন্যায় হলেও স্বীকার করতে হচ্ছে যে কাল সকালেই খবরে দেখছিলাম ৯ জন নিহত, মনে তেমন বড় আলোড়ন হয়নি। রাতে খবর পেলাম ইতোমধ্যেই ১১৩টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। কারন এখনো অনির্নেয়। আমার আলোচনায় আপাতত কারন বড় নয়।

কারনটা হয়ত এখনো অনির্নেয়, হতে পারে বিশুদ্ধ দূর্ঘটনা যা হয়ত প্রতিহত করা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না, তেমন হতেও পারে। কিন্তু প্রানহানী ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা দেখে বেশ কিছু প্রাসংগিক প্রশ্ন ভাবনা আসে। প্রথমেই বোঝা যায় যে আধুনিক ইন্ডাষ্ট্রিয়াল সেফটি ব্যাবস্থার ন্যূনতম কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করা হলে, কিছুটা প্রস্তুতি আগে থেকে থাকলে কারন যাইই হোক এত বিপুল পরিমান প্রানহানী নিশ্চয়ই হত না। আগাম এই ভাবনা আসার কারন এমন দূর্ঘটনা এখন আর বিরল কোন ব্যাপার নয়, হয়ে দাঁড়িয়েছে নিয়মেরই মত। বেশ কিছু প্রানহানী ঘটবে, মিডিয়ায় বড় কাভারেজ আসবে, লোকে চোখের পানিও ফেলবে, সদাশয় গার্মেন্টস মালিক সরকার কিছু টাকা পয়সা সাহায্য দেবেন, তদন্ত কমিটিও হবে, দায়ী কেউ সে যেইই হোক কোনমতেই ছাড়া পাবে না এমন অংগীকারও শোনা যাবে। যে দেশে মানুষের জীবনের দাম ছাগলের মূল্যে যাচাই করা হয় সে দেশে লাখ টাকা ক্ষতিপূরন বা সাহায্য তো বেশ ব্যাপার বলতে হয়। সবই নিয়ম, তেমনি ভাবে নিয়ম পালিত হবে উত্তেজনা থিতিয়ে এলে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট, সে রিপোর্টে উল্লেখিত ব্যাবস্থা, বিশেষত দায়ী ব্যাক্তিদের শাস্তির দাবী এসবই চলে যাবে হিমঘরে, ততদিনে হয়ত এ জাতীয় আরেক ট্র্যাজেডী ঘটে গেছে, চক্র আবারো শুরু হয়ে যাবে। এভাবে অনিয়ম কেন নিয়মে পরিনত হবে?

গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে আমরা অনেক গর্ব করি, দেশের অর্থনীতিকে এই বিশ্বমন্দার দিনেও মূলত এই শিল্প বাঁচিয়ে রেখেছে, মোট রফতানী আয়ের ৮০% এখন আসে এই খাত থেকে। এই শিল্প প্রতিষ্ঠায় যেসব শিল্পপতি ভূমিকা রেখেছেন তারা অবশ্যই কৃতিত্বের দাবীদার, তাদের অবদান অস্বীকার করা যায় না। তেমনি এই শিল্প সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষ যারা কায়িক পরিশ্রমে বাঁচিয়ে রাখছেন তাদের ন্যূনতম মানবিক অধিকার, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবীও খুবই যুক্তি সংগত। এ ব্যাপারে আমরা সাধারন জনতাই বা কতটা সচেতন বা সহানুভূতিশীল? সরকারের ওপর বেশী ভরসা না করাই মংগল। কিছুদিন আগে গার্মেন্টস শ্রমিকরা বেতন ভাতার দাবীতে বেশ কিছুদিন বিক্ষোভ, ধর্মঘট করলেন। তখন অনেক সচেতন ব্লগারের লেখায় পড়লাম যে সেটা আসলে চীন নাকি কার ষড়যন্ত্র, দেশের গার্মেন্টস শিল্প ধ্বংস করার এক নীল নকশার অংশ, শ্রমিকরা না বুঝে ফাঁদে পা দিচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্র প্রিয় জাতি মনে হয় আমরা। যাক সে কথা, আমি বিস্তারিত তেমন জানি না, থাকি প্রবাসে, আপাত চোখে সব সময়ই মনে হয় যে দেশে যারা কায়িক পরিশ্রম করেন তাদের সকলকেই পুরো সমাজ সচেতন ভাবেই ঠকায়। এমন অবস্থায় এ ধরনের বিক্ষোভ, ধর্মঘট অত্যন্ত স্বাভাবিক, বাইরের ষড়যন্ত্রকারীরা সে সুযোগ নিতেই পারে।

এমষ্টার্ডাম ভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংস্থা জানাচ্ছে যে কেবলমাত্র ২০০৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশের গার্মেন্টসগুলিতে শুধুমাত্র আগুনে নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে ৫০০। অর্থাত বছরে গড়ে প্রায় ১০০ জন গার্মেন্ট শ্রমিক আগুনে পুড়েই মারা যাচ্ছে, অন্য দূর্ঘটনা বাদই থাকল। ২০১০ সালে আশুলিয়াতেই হামিম গার্মেন্টস অগ্নিকান্ডে নিহত হয় ২৬ জন। ২০০৬ সালে চট্টগ্রামে এক গার্মেন্টসে আগুনে পুড়ে মারা গেছিল ৫৪ জন, তার ২৪ ঘন্টা না কাটতেই ঢাকার তেজগাঁয়ে অবৈধভাবে সংস্কার চালানোর সময় ফিনিক্স ভবন ধ্বসে মারা গেছিল ১৮ জন গরীব শ্রমিক। এর আগে বছর, এই দুই ঘটনার মাটর ৯ মাস আগে সাভারে স্পেক্ট্রাম ভবন ধ্বসে মারা যায় ৮৬ জন মানুষ, তখন বলা হয়েছিল কঠোর ব্যাবস্থা নেওয়া হবে যেন ভবিষ্যতে এমন আর না ঘটে। তার মাত্র ৯ মাসের মধ্যেই মাটর ২৪ ঘন্টার ব্যাবধানে দেশের দুই প্রধান শহরে ঘটল দুই মারাত্মক দূর্ঘটনা যা এড়ানো খুবই সম্ভব ছিল। সাভারের ঘটনার কারন ছিল মনে পড়ে অবৈধভাবে অনুমোদিত নক্সার ওপরেও দুই তলা অতিরিক্ত বাড়ানো। এর মালিককে কদিন মনে আছে কোর্ট কাচারিতে দৌড়োদৌড়ি করতে হয়েছিল, কিন্তু চুড়ান্ত বিচারে তার ঠিক কি সাজা হয়েছিল কারো কি জানা আছে? আমি নিশ্চিত নই। মনে আছে ওনার স্ত্রী ছিলেন তখন সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারপতি।

জাফর ইকবাল স্যার একবার দেশের সড়ক দূর্ঘটনা বিষয়ে সোজা সরল মন্তব্য করেছিলেন যে এসব আসলে দূর্ঘটনা নয়, হত্যাকান্ড। কারন নিশ্চয়ই আমরা সকলেই জানি। গার্মেন্টেসের এসব দূর্ঘটনাকেও আসলে হত্যাকান্ড বলাটা খুব একটা বাড়াবাড়ি হবে না। হতে পারে এই হত্যাকান্ড পরিকল্পিত নয়। গার্মেন্টসগুলিতে কি চরম অমানবিক বিপদজনক পরিস্থিতিতে কাজ করানো হয় নিজের চোখেই দেখেছি। ঢাকায় আমার বাসা থেকে ৩টি গার্মেন্টস ওয়ালা এক ভবন দেখা যেত, তার পাশ দিয়েই বের হতে হত বড় রাস্তায়। সকালে দেখতাম সবাই ঢুকে যাবার পর দশাসই দারোয়ান গেটে তালা লাগিয়ে দেয়। এই অবস্থায় আগুন লাগলে কি অবস্থা হতে পারে সেটা অনুমান করতে কোন তদন্ত লাগে? বিশেষ করে দারোয়ান যদি তালা না খুলে চাচা আপন জান বাঁচা নীতি পালন করে? দূর্ঘটনা ঘটলে আমরা পত্রিকায় দেখি, আরো কত দূর্ঘটনা শুধু এই তালা লাগানো থেকে হয়েছে, তবে সৌভাগ্যক্রমে প্রানহানী হয়নি দেখে পত্রিকায় আসেনি তার হিসেব কারো পক্ষে রাখা সম্ভব?

চট্টগ্রামের সেই দূর্ঘটনার পর মালিক দায় চাপিয়েছিলেন দারোয়ানের ওপর। নিরাপত্তার স্বার্থে গেটে কলাপসিবল তালা ছিল, দারোয়ান সময়মত খুলে দেয়নি। কি দারুন ব্যাবস্থা না? লাভের গুড় সবচেয়ে বেশী খাবেন ওনারা, কম আয়ের লোকে মারা যাবে গন্ডায় গন্ডায়, আবার দূর্ঘটনা ঘটলে তার দায় সেই নিম্ন আয়ের লোকের ওপরেই চাপানোর কি দারুন ব্যাবস্থা। ন্যূনতম নৈতিকতাবোধও মনে হয় কাজ করে না, কিছু টাকা দিয়েই ব্যাস দায় খালাস। অথচ সিংগাপুর, দক্ষিন কোরিয়ার দুটি বড় ধরনের বিল্ডিং ধ্বসের কাহিনী দেখেছিলাম টিভিতে, প্রথমেই সাজা দেওয়া হয়েছিল মালিক পক্ষকে। যে দেশের রাষ্ট্রের পতির মত সম্মানিত পদের মানুষ নিজের ক্ষমতার অপব্যাবহার করে দলীয় পরিচয়ে দাগী সন্ত্রাসীদের কলমের খোঁচায় মুক্ত করে দিতে পারে সে দেশে আইনের শাসন কোনদিন সম্ভব? এসবের প্রতিক্রিয়া সুদুরপ্রসারী হতে বাধ্য। ফিনিক্স ভবন, স্পেক্ট্রাম ভবনের দূর্ঘটনার পর ভয়াবহ তথ্য জেনেছিলাম যে দেশে ’৯৩ সালে প্রনীত হওয়া ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড আইনাকারে এক যুগেও নিবন্ধিত করা যায়নি। কি অদ্ভূত দেশ। দেশে আসলেঈ কোন নাস্তিক থাকার কথা না, এমন অবস্থায় যে আরো ভয়াবহ সব দূর্ঘটনা ঘটে না তা আল্লাহ জাতীয় কোন সত্ত্বার অস্তিত্ব ছাড়া ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।

কাল একই সাথে চট্টগ্রামেও এক নির্মানাধীন ফ্লাই ওভারের গার্ডার ভেঙ্গে মারা গেল ১৩ জন নিরীহ মানুষ। এর তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী কাউকে না কাউকে তো সাজা পেতে হবে। সেটা কে হবে? আদৌ সে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখবে? গরীব লোকে ভিক্টিম বলেই এমন অবহেলা আর উঁচুতলার লোকদের বাঁচানো?

অথচ কয়েক বছর আগে একজন আত্মীয়ের কাছে শুনেছিলাম যে তাদের বাসার রাস্তায় রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কারন হল সে সময়কার সরকারের একন মন্ত্রী কন্যা সে পাড়ায় দয়া করে অবস্থান করেন, তার বাসায় আসা গেষ্টদের গাড়ি রিক্সার জন্য পার্ক করতে অসুবিধে হয়। আইনের কি বিচিত্র রকমারি ব্যাবহার। আইন সে তো তামাশা মাত্র কথাটা বার বারই মনে পড়ে যায়।

তদন্ত কমিটি, তার রিপোর্ট যথারীতি আলোর মুখ দেখে না। একবার পড়েছিলাম যে দেশের ৮৪% সংসদ সদস্যের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আছে। রিপোর্ট আলোর মুখ দেখলেও ব্যাবস্থা নেওয়া হয় না। কার অত দায় পড়েছে সেসব নিয়ে মাথা ঘামাবার? যারা মারা যাচ্ছে তারা তো সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষ। তারা মারা গেলে উহু আহা করা যায় কিংবা বড়জোর কিছু থোক টাকা ধরিয়ে দেওয়া যায়, তবে ভবিষ্যতে এসব ঠেকানোর মত ব্যাবস্থা নেওয়ার হ্যাপা করতে যাবে কে? ভাত ছড়ালে কি কাকের অভাব নাকি? ১০০ মরলে আরো ১০ হাজার এই দেশে পরের সপ্তাহেই পাওয়া যাবে।

আলোচিত এই দূর্ঘটনার পরও মালিক পক্ষ তাদের কোন দায় অস্বীকার করেছেন, তা নিয়ে মন্তব্য করার মত শক্ত তথ্য এখনো পাইনি। তবে কিছু মৌলিক সমস্যা এখানেও ছিল অনুমান খুব অযৌক্তিক নয়। সেই পুরনো নিয়মেই আগুন লাগার পর মহিলা শ্রমিকদের নীচে নামতে বাধা দেওয়া হয়েছে। আরো অদ্ভূত ব্যাপার হল এ গার্মেন্টস এ পুরুষ মহিলাদের জন্য আলাদা সিঁড়ি, জানি না কোন উর্বর মস্তিষ্ক থেকে এসব বেরোয়। যথাযথ ইভ্যাকুয়েশন ব্যাবস্থা থাকলে এত লোকে মরতে পারে না, এক বড় সংখ্যক মারা গেছে আগুনে তাতক্ষনিক ভাবে পুড়ে নয়, জীবন রক্ষার্থে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে। যথাযথ ইমার্জেন্সী ইভ্যাকুয়শন ব্যাবস্থা থাকলে এরা অন্তত অনেকেই বেঁচে যেত। এসব অতি মৌলিক নিরাপত্তা ব্যাবস্থা কেন আবশ্যিক আইনাকারে পালন করা হয় না? যে গার্মেন্টস শত কোটি টাকা বছরে আয় করে সে নিরাপত্তা বাড়াতে কেন ১ কোটি টাকাও অতিরিক্ত খরচ করবে না? এই গার্মেন্টসের মালিক ঘটনার ২২ ঘন্টা পরেও ঘটনাস্থলে যাননি, তিনি অসূস্থ অবস্থায় বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছেন বলে দাবী করেছেন, ক্ষয়ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকা দাবী করেছেন।

জন্মই তাদের আজন্ম পাপ?

জন্মই তাদের আজন্ম পাপ?

অতীতের মত এবারও দেখা গেছে উদ্ধারকারী দলের দেরীতে আসা, এবং যথাযথ ট্রেনিং, যন্ত্রপাতির অভাব। এসবই বা বার বার কেন ঘটে? আমাদের দেশ ঘন বসতিপূর্ন, এখানে উদ্ধারকাজ আসলেই খুব একটা সহজ নয়। গার্মেন্টসগুলিকে কোন একটি নির্দিষ্ট জোনে এক সাথে সরিয়ে কেন শক্তিশালী অগ্নিনির্বাপন ও উদ্ধার ব্যাবস্থা রাখা হয় না? সব কলকারখানায় শ্রমিক কর্মচারী কর্মকর্তাদের কেন আবশ্যিকভাবে ফায়ার ড্রিল করানো হয় না যেমন এই ধরনের জরূরী অবস্থায় সুশৃখংলভাবে কি করতে হবে সেটা তারা আগে থেকেই জানতে পারে? এসব চিন্তা করতে আমার লেগেছে ৫ মিনিট, বড় বড় কর্মকর্তা, গার্মেন্টস মালিক, জনপ্রতিনিধিরা কেন বছরে পর বছরেও এই সোজা কিছু মৌলিক নিরাপত্তামূলক ব্যাবস্থা চিন্তা করতে পারেন না?

২০০৫ সালের সাভারের স্পেক্ট্রাম দূর্ঘটনার পর ইন্টারন্যাশনাল টেক্সটাইল গার্মেন্টস লেদার ওয়ার্কাস ফেডারেশনের সাধারন সম্পাদক নীল কার্নেগী মিডিয়ার মুখোমুখি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন “হোয়্যার ইজ গভর্নমেন্ট!” গরীব লোকের মানবাধিকার বাদ দেই, এ জাতীয় দূর্ঘটনা ঘটতে থাকলে চীন ভারতের ষড়যন্ত্র লাগবে না, বিদেশে এমনিতেই আমাদের কোটা কমিয়ে দেবে। আগেই বলেছি যে সরকারের ওপর তেমন ভরসার কিছু নেই। সচেতন হতে হবে সাধারন নাগরিকদেরই, প্রশ্ন করতে হবে “হোয়্যার ইজ আওয়ার কনশাসনেস”। দূর্ঘটনা, প্রানহানী সব দেশেই কিছু না কিছু ঘটে। তবে তদন্ত হয়, দোষী লোকে শাস্তি পায়, ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা নেওয়া হয়। দায় অস্বীকারের সংস্কৃতি আর কতদিন? যে দেশে দায় নিজ কাঁধে নেবার মত লোক বেশী নেই সে দেশ খুবই দূর্ভাগা। দায় স্বীকার সভ্যতার মাত্রা নির্নায়ক।

সূত্রঃ
গার্মেন্টস ট্র্যাজেডিঃ কে করবে হত্যাকান্ডের বিচার