ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার সরল পাঠ-১
ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার সরল পাঠ-২
ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার সরল পাঠ-৩

সাম্প্রদায়িক ঘৃনা বিদ্বেষ ছড়ানো শিক্ষার ফল কোন মাত্রায় হতে পারে? কেন আমাদের চিন্তিত হতে হবে? এটা ব্যাখ্যা করা খুব অল্প কথায় কষ্টকর; সাম্প্রদায়িকতার কুফল কেবল অপরকে গালিগালাজ/ মৌখিক ঘৃনা বিদ্বেষ ছড়ানো কিংবা বড়জোর মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা ভাংগার মত দুবৃত্তপনার মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। সাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রকৃত পক্ষে পুরো মনোজনগতকেই করে রাখে পংগু; যার ব্যাপক কুপ্রভাব পড়ে জীবন দর্শন, ইতিহাস চর্চা, রাজনীতি, রাষ্ট্র পরিচালনা, শিক্ষা দীক্ষা সব ক্ষেত্রে। সোজা কথায় সব কিছুকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে চিন্তা করে বিকৃত, অবাস্তব, এক তরফা বিশ্লেষন দাঁড় করিয়ে সম্পূর্ন ভুল শিক্ষা দেওয়া হয়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বহন করা হয় অর্থহীন হীনমন্যতা। এ ধরনের বিকৃত, এক তরফা বিশ্লেষনের কিছু উদাহরন দেব। বিশেষ করে কিছুটা ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত আলোচনা ছাড়া কুফলের মাত্রা কিংবা বর্তমান কালের মেকানিজমও ভাল বোঝা যাবে না।

সাম্প্রদায়িকতা শিক্ষার ব্যাপক কুফল ব্যাক্তিগত ও সামষ্টিক দু’যায়গাতেই ব্যাপক মাত্রায় দেখা যায়। এই সাম্প্রদায়িকতা কখনো বা আপাত চোখে নির্দোষ, নিরীহ এমনকি মহা উপকারী মনে করার কারনে এর অন্য চেহারা সহজেই ঢাকা পড়ে যায়, এমনকি নিজেরা এর জন্য সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ বা চরম আঘাত খেলেও সেটাও স্বীকার করতে ধার্মিক মন চায় না। জন্মসূত্রেই সব দেশের মুসলমানই নিজেদের রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের বাইরেও মুসলমান নামের আরেকটি জাতীয়তাবোধ প্রাপ্ত হয়। তাতে দোষের কিছুই নেই, দ্বৈত জাতীয়তাবোধ অপরাধ বা দোষের কিছু নেই। প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাসী অন্যান্য ধর্মাবলম্বিরাও যেমন খৃষ্টান, ইহুদী, কিংবা হিন্দুরাও ধর্মীয় দ্বৈত জাতীয়তাবাদের পরিচয় জন্মসূত্রেই পায়। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মত বায়বীয় জাতীয়তাবাদ ছাড়াও দুই দেশের নাগরিকত্ব নিয়েও বহু লোকে শান্তিপূর্ন ভাবে বসবাস করছে, কোন রকমের আদর্শগত সঙ্ঘাতে সচরাচর পড়ে না। মুসলমান সমাজে এই ধর্মীয় পরিচয়ের গুরুত্ব দেওয়া হয় অত্যাধিক। আপাত নিরীহ এই ধর্মীয় পরিচয়ের ব্যাপারে তাকে বাল্যকাল থেকেই এতই সচেতন করে তোলা হয় যে তার মনে অনেক সময়ই সরাসরি বা অবচেতন ভাবে অন্যান্য ধর্মাবলম্বিদের ব্যাপারে জন্মে এক ধরনের উদাসীনতা বা অনীহা, ক্ষেত্র বিশেষে বিদ্বেষ; উলটো দিকে নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি জন্মে অন্ধ পক্ষপাত। শিক্ষা ব্যাবস্থায় জাতিগত ঘৃনা বিদ্বেষের পাঠ নিঃসন্দেহে এই মানসিকতা বাড়ায়।

মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই, শুনতে ভালও লাগে, এর কিছু উপকারিতা আছে নিজেও বিশেষ করে প্রবাসে পেয়েছি। এর অন্য দিকও আছে। যেমন এই ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধের কারনে ‘৭১ সালের পাকিস্তান কিংবা আরব দেশের একজন মুসলমান বাংগালী মুসলমানের ধর্মের ভাই, পাশের বাড়ির বাংগালী বিধর্মী তার আপন নয়। আমাদের প্রথম পর্বের মূল ধর্মশিক্ষা বই এর কথাই ধরেন, এমনকি পরের কোট করা নানান কাল ও দেশের নানান বড় বড় আলেমদের রেফারেন্স দেখুন; জেহাদী কথাবার্তার প্রসংগ বাদ দিলেও সেসব সূত্রে পরিষ্কারভাবেই বিধর্মীদের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখার ব্যাপারেই কড়া রকমের রাখঢাকের নির্দেশনা আছে। এমনকি প্রতিবেশীর হক পূরন কিংবা দান করার মত মৌলিক মানবিক ব্যাপারেও আগে মুসলমান খুঁজে বার করতে হবে, এর এক বাস্তব উদাহরন জাফর ইকবালের ’৭১ এর এক স্মৃতিচারনমূলক লেখায় আছে, এক মাওলানা সাহেব অসহায় হিন্দু পরিবারকে দান করলে সওয়াব পাওয়া যাবে না বলে তাদের সামনেই সবক দিচ্ছেন। সাম্প্রদায়িকতা মানেই রক্তারক্তি খুনাখুনী কিংবা রামু ষ্টাইলে মন্দির প্যাগোডা ভাংগা নয়। আমাদের দেশের বেশীরভাগ লোকে আমার মনে হয় সাম্প্রদায়িকতা বুঝতে তেমন কিছুই বোঝেন। নিজেকে কেবল নিজ সম্প্রদায়ের মাঝে সীমাবদ্ধতা করাটাও অবশ্যই সাম্প্রদায়িকতা, যদিও এ ধরনের সাম্প্রদায়িকতা আইনের চোখে অপরাধ নয়। এ ধরনের নির্দোষ সাম্প্রদায়িকতা আপাত চোখে নিরীহ হলেও দেশের বা সমাজের ঐক্যের প্রশ্নে তুলতে পারে বিভেদের দেওয়াল, বিধর্মীদের মৌলিক অধিকারের ব্যাপারে করে তুলতে পারে উদাসীন যা এক পর্যায়ে তাদেরকে নিজ দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশেই সংশয়ী করে তুলতে পারে।

’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক বাঁধ ভাংগা আবেগের কাছে সব হিসেব নিকেশের পরাজয়, যা সম্ভব হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক দর্শনের কারনেই। প্রবাসী সরকারের পোষ্টারে তখন লেখা ছিল – ‘বাংলার খ্রীষ্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান-আমরা সবাই বাংগালী’। জাত ধরে কার সাথে বন্ধুত্ব করা নিষেধ, কে কার বিরুদ্ধে হাজার বছর ধরে জাতিগত ষড়যন্ত্র করে আসছে, কার আল্লাহ বড় নাকি কার দেবতা বড়, কাকে জাত ধরে অভিভাবক বা বন্ধু মানা যাবে না এই ধরনের ধর্মীয় বিধিবিধান খোঁজ করার কথা কারো মাথায় আসেনি। কিংবা ইতিহাসের আস্তাকুড় খুঁজে কার পূর্বপুরুষ কয়শো বছর আগে আরব দেশ থেকে এসে ভারত দখল করেছিল আর কার পূর্বপুরুষ কাকে জাত্যাভিমানের কারনে হাতে পানি ঢেলে দেয়নি এসব আবর্জনার দূর্গন্ধ টানার কথাও সাময়িক ভাবে ভুলতে পারা গেছিল। সোজা কথায় বাংগালী জাতীয়তাবাদের কাছে পরাজিত হয়েছিল ধর্মীয় জাতীয়তাবোধের যাবতীয় সংকীর্নতা। এ কারনেই বাংগালী জাতীয়তাবাদের প্রতি বদর রাজাকার গোষ্ঠির তীব্র বিরাগ। আজকের দিনে রাজাকার বদর গোষ্ঠীর গায়ে গতরে বেড়ে ওঠারও একটি বড় দর্শনগত কারন বাংগালীর নিজ সংস্কৃতিকে দিনে দিনে দূরে ঠেলে দেবার প্রবনতা।

ইসলামী জাতীয়তাবোধে কড়াভাবে বিশ্বাসীদের অধিকাংশই ’৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যূদয় মানতে পারেনি, যোগ দিয়েছিল পাক শিবিরে, আজো তারা অনেকেই বাংলাদেশের অস্তিত্বে একই কারনেই বিশ্বাস করে না। এদের মধ্যে যারা এমনকি বাংলাদেশের অস্তিত্ব বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে মেনেও নিয়েছে তারাও বাংগালী জাতীয়তাবোধ বা বাংগালী সংস্কৃতিকেই মনেপ্রানে ঘৃনা করে। বাস্তবে যে দেশেরই নাগরিক হোক না কেন, কল্পনার রাজ্যে তারা ইসলাম নামক এক ইউটোপিয়ার রাজ্যের গর্বিত নাগরিক। তাদের কাছে বাংগালী সংস্কৃতি মানে হল হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি। বিশ্বের সব মুসলমান মিলে এক ইসলামী খেলাফত গঠন করবেন এবং মোল্লা আলেমগনের নির্দেশনায় সেই স্বপের দেশ চালাবেন সেই সুদিনের আশায় তারা দিন গুজরান করেন, তাদের কাছে বাংগালী পরিচয় তেমন কোন অর্থ বহন করে না, উলটো বাংগালী জাতীয়তা সেই স্বপ্নের ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের পথে বাধা বলেই মনে হয়, কারন সেই কল্পনার রাজত্বে বাংগালী, পাকিস্তানী, ভারতীয় এ ধরনের ভৌগলিক জাতীয়তার অস্তিত্ব নেই, আছে কেবল মুসলমান পরিচয়। এটা মনে করার কোন কারন নেই যে এই মানসিকতার সকলেই রাজাকার কিংবা কেবলমাত্র রাজাকার ধরনের স্বল্প সংখ্যক লোকেই এমন ধারনা পোষন করে। এ মোটা দাগের ভুল অনেকেই করেন। এ বিষয়ে পরে বলব।

এই রাজনৈতিক দর্শনের সরল কারন ধর্মীয় নানান সূত্রে প্রাপ্ত যে জ্ঞান তাদের চিন্তা চেতনা আচ্ছন্ন করে রাখে তাতে তারা জগতের যাবতীয় সব সংঘটন বিচার করে ধর্মের পাল্লায়, যে পাল্লার দুই দিকে মুসলমান এবং অমুসলমান, বাকি সব ভ্যারিয়েবল বা বিচার্য এই পাল্লাতেই মূল্যায়িত হয়। আরব সংস্কৃতির বাইরের যে কোন সংস্কৃতিই ‘অনৈসলামিক’ কারন আরব দেশে নাজিলকৃত তাদের ধর্মীয় সূত্রে এসব সংস্কৃতির কোন উল্লেখ নেই, অনারব সংস্কৃতি মানেই যেহেতু বিধর্মীর, কাজেই গ্রহন করা যাবে না। বাংগাল দেশের আদি বাসিন্দা ছিল পৌত্তলিক হিন্দুরাই, কাজেই বাংগাল সংস্কৃতি মানে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি যাকে গ্রহন করা যায় না, সোজা হিসেব। অনারব যে কোন সংস্কৃতিকেই ধরে নেওয়া হয় স্বপ্নের ইসলামী সমাজ কায়েমের পথে বাধা; সে বাংলা ভাষা সংস্কৃতিই হোক আর পাশ্চাত্য সংস্কৃতিই হোক। নিজ ধর্মীয় জাতীয়তার শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং বিধর্মীদের সম্পর্কে আজন্ম নানান কটূকথা শুনতে শুনতে বিধর্মীদের ভাষা সংস্কৃতি সম্পর্কেও ঘৃনা আসবে এটাই স্বাভাবিক। এটা এ অঞ্চলে ব্রিটিশ আমলে দেখা গেছে, পাক আমলেও দেখা গেছে (এ সময় অবশ্য নিজ ভাষাকেও অনেকে ঘৃনা করেছে), এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও এর কবল থেকে নিস্তার নেই। পশ্চীমের উদাহরতার সুযোগ নিয়ে সেসব নানান দেশেও কিভাবে নিজেদের সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং বিধর্মী সংস্কৃতির বদনাম প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে দেওয়া হছে তারও উদাহরন গত পর্বে দিয়েছি।

অনেক ইসলাম প্রিয় ব্যাক্তি উপমহাদেশে মুসলমানদের আর্থ সামাজিক পতনের জন্য এত তরফা দায়ী করেন হিন্দুত্ববাদ, ইংরেজের মুসলিম বিদ্বেষ এমন কারনকে। ভাবখানা এমন যে বেনিয়া ইংরেজরা ইসলাম বিদ্বেষ এবং হিন্দু প্রীতির কারনে মুসলমানদের বাদ দিয়ে হিন্দুদের কোলে বসিয়ে নিজ গাঁটের পয়সা উজাড় করে বিলিয়েছে, হিন্দুদের মগজে অস্ত্রপ্রচার করে করে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ভরে দিয়েছে। সুলতানি আমলেও যে মুসলমানদের অবস্থা হিন্দুদের তূলনায় খুব ভাল ছিল তাও নয়। সাধারন হিন্দু মুসমানের অবস্থা একই রকম হতদরিদ্রই ছিল। হিন্দু ধনিক শ্রেনীর উত্থান বাংলায় মূলতঃ ইংরেজ নয়, সুলতানি আমলের শেষের দিকেই শুরু হয়। সিরাজউদ্দোলার পরাজয়কে এই সমস্ত ধর্ম প্রিয় বিশ্লেষক দেখে বিধর্মীর কাছে মুসলমানের পরাজয়, যার পর থেকে নাকি মুসলমানদের কপালে শনি নেমে আসে। মজার ব্যাপার হল সিরাজউদ্দোলা যে ক’জন রাজার ওপর রাজস্ব আদায়ের জন্য নির্ভর করতেন তারা প্রায় সকলেই ছিলেন হিন্দু, সে আমলের বেশীরভাগ বড় ব্যাবসায়ী যাদের নাম পাওয়া যায় সকলেই প্রায় হিন্দু বা জৈন। সে আমলের সবচেয়ে বড় ব্যাংকার ছিল জগত শেঠ। ইংরেজ আমলে মুসলমানদের পতনের মূল সূত্রপাত ছিল বস্তুত গোঁড়ামী; বিধর্মী ইংরেজী শিক্ষার প্রতি প্রবল অনীহা। যার ফলশ্রুতিতে আধুনিক শিক্ষা, জ্ঞান বিজ্ঞান অর্জন থেকেই তারা নিজেদের বঞ্চিত করেছে, শিক্ষা বলতে যে মাদ্রাসা মক্তব বাদেও কিছু হতে পারে তা বুঝতে তাদের বহুদিন লেগেছে, এর মূল্য পাকিস্তান বাংলাদেশকে আজো দিতে হচ্ছে।

১৮৩৫ সালে ব্রিটিশরা রাজ ভাষা ফার্সী বদল করে ইংরেজী প্রবর্তন করে। ইংরেজের তখন রাজ্য চালাতে দরকার ছিল অসংখ্য ইংরেজী জানা কর্মচারী। মুসলমানরা এই বাস্তবতা গ্রহনে অস্বীকার করে, গোঁয়াড়ের মত কাফের বিধর্মী ইংরেজী শেখা যাবে না পন করে। অন্যদিকে ততকালীন হিন্দু্রাও যে বিরাট উদারমনা ছিল তা নয়, তবে তারা বাস্তব বুঝত। মুখে ইংরেজদের ম্লেচ্ছ ফ্লেচ্ছ বলে গাল দিলেও ইংরেজী শিক্ষা শুরু করে ভাল চাকুরি পেতে থাকে, এভাবে সামাজিক ভাবে উচ্চ অবস্থানে চলে যায়, আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের দিকে ঝুকে। মুসলমানদের এমনিতেই ছিল ক্ষমতা হারানোর বেদনা, এর সাথে যোগ হয় দিনে দিনে পিছিয়ে পড়ার (প্রকৃত পক্ষে বলা উচিত হিন্দুদের উত্তরোত্তর উন্নতি দেখার ফলে) কারনে হীনমন্যতায় ভোগা। হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক কোন সময়ই উপমহাদেশে স্বাভাবিক না হলেও এভাবে দূরত্ব আরো অনেক বেড়ে যায়। বেনিয়া জাতি ইংরেজরা ধর্মকর্ম নিয়ে তেমন মাথা না ঘামালেও মুসলমানদের সাথে তাদের দূরত্ব হয় বেশী, কারন তাদের আশেপাশের কর্মচারী, আমত্যগন অধিকাংশই হিন্দু। সিপাহী বিদ্রোহে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই যোগ দিলেও বিদ্রোহ দমনের পর এ কারনে মুসলমানদের ওপর রাজরোষ পড়েছে বেশী পরিমানে।

বাংগালী হিন্দুরাও মুসলমানদের বাংগালী বলে মনে করত না, সে আমলের সাহিত্যিকদের মাঝেও এই ধরনের মুসলমান বিদ্বেষী মনোভাব দেখা যায়। ভারতীয় স্কুলের ইতিহাস পাঠ্যসূচীতেও কিছু এক তরফা বিশ্লেষন আছে, যেখানে উপমহাদেশে মুসমানদের দেখানো হয় দখলদার বিদেশী শক্তি হিসেবে যাদের কোন ভাল অবদান নেই। তবে উল্টোদিকে আবার পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের কারনে বাম ধারার ঐতিহাসিকরা মুসলমান শাসনের অনেক কালো দিক ইচ্ছেকৃত ভাবে গোপন করেছে এমন অভিযোগও আছে। ভারত আমাদের মূল আলোচ্য নয়। ভারতীয়রা আর যাইই করুক জুজুর ভয়ে নিজেদের অন্তত নিজেরাই পিছিয়ে রাখেনি।

ততকালীন মুসলমান সমাজে ইংরেজী শিক্ষার অবস্থান কেমন তা স্যার সৈয়দ আহমদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝা যেতে পারে। স্যার সৈয়দ আহমেদ ছিলেন সে আমলে মুসলমানদের মধ্যে আধুনিকতার প্রতিভূ, তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে ইংরেজী হেলা করে জাতি কেবলই পিছাবে, সেই উপলব্ধির মূল্যও দিতে হয়েছে তাকে; তিনি যখন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা শুরু করেন তখন তাকে মোল্লা চক্র যথারীতি কাফের উপাধি প্রদান করে। বস্তুত মোল্লা চক্র এবং তার সমর্থকদের কাছে কোন রকম প্রগতিশীলতার কথা, নিজেদের আত্মসমালোচনার পরিনাম সব যুগেই অত্যন্ত কঠোর। আজকের দিনেও এর তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। মুসলমান সমাজে যারাই সামান্য আত্মসমালোচনা করেন তাদের ধরা হয় ঘরের শত্রু বিভীষন হিসেবে। আগের যুগে সরাসরি কাফের বলা হত, বর্তমানে তাদের ছদ্মবেশী নাস্তিক, পৌত্তলিক মুসলমান, মুসলমান নামধারি বিধর্মীর এজেন্ট জাতীয় বহুকিছু বলে অভিহিত করা হয়। ব্লগের কোন পরীক্ষিত ইসলাম ডিফেন্ডার ভাইও মোল্লা চক্র, গোড়ামির সমালোচনা করলে ক্ষমা পান না, তার হয়েও পুরনোদের স্বাক্ষ্য দিতে হয় যে তিনি আসলেই সাচ্চা মুসলমান, ছদ্মবেশী এজেন্ট নন।

মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রঃ) ছিলেন ব্রিটিশ আমলের উপমহাদেশের এক বড় আলেম, তার লেখা বহু বই পুস্তক ইসলাম প্রিয় জগতে এ যুগেও অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার লেখা “ইছলাহুর রুসূম” বা কুসংস্কার সংশোধন বইতে তিনি সরাসরি ইংরেজী, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা এসব শিক্ষা করা যে অনুচিত তা কোরানের আলোকে ব্যাখ্যা করে কুসংস্কার দূরীকরনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন [১]। ভাল চাকু্রী লাভের আশায় এসব অপবিদ্যা আয়ত্ব করার বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এই প্রবনতা কি আজো গেছে? ইরান বছর দুয়েক আগে দর্শন, সমাজ বিজ্ঞান, আইন, মনোবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এ জাতীয় ১২ বিষয় অতিমাত্রায় পশ্চীমা বলে আর নুতন বিভাগ খোলা হবে না এবং বর্তমান বিভাগগুলির কোর্স সংশোধন করা হবে ঘোষনা দিয়েছে [২] । সম্প্রতি আরো এক ধাপ এগিয়ে মহিলাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০টি কোর্স তারা নিষিদ্ধ করেছে [৩]।

আমার দাদা নানাদের জেনারেশনে মুসলমান সমাজে পড়শুনা করা বলতে মূলত বোঝাতো মাদ্রাসা মক্তব। সে সময় কিংবা আরো আগে মুসলমানদের মধ্যে হাতে গোনা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ে পড়াশুনা করেছেন তাদের বিষয় দেখা যায় আরবী, ইসলামের ইতিহাস, নয়ত বড়জোর বাংলা, ফার্সী এই ধরনের। সেই একই যুগে এমনকি তারও আগে একই বাংলাতেই জন্ম নিয়েছেন জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্ল রায়, সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহার মত বিজ্ঞানীরা। ইউরোপে প্রথম ভারতীয় হিশেবে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন আমাদেরই ঢাকা জেলার নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়, ১৮৭৬/৭৭ সালে। শেষ জীবনে তিনি ইসলাম গ্রহন করেন। ’৪৭ এর দেশভাগের পর পূর্ববংগ পড়েছিল বুদ্ধিজীবি শূন্যতায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও পড়ে গেছিল ভয়াবহ শিক্ষক সংকটে। পশ্চীম বাংলার বিখ্যাত বুদ্ধিজীবিদের এক বড় সংখ্যকেরই আদি নিবাস আমাদের বাংলাদেশ। সে তূলনায় ’৪৭ এর দেশভাগের পর সেখান থেকে আমাদের বুদ্ধিজীবি প্রাপ্তির তালিকা প্রায় শূন্য। আমাদের মেট্রিকে বাংলা দ্রুত পঠন হিশেবে ‘আবদুল্লাহ’ উপন্যাস ছিল বিংশ শতকের গোড়ার মুসলমান সমাজের নানান কুসংস্কার, বিশেষ করে আধুনিক শিক্ষা গ্রহনের অনীহা বিষয়ক গোঁড়ামী নিয়ে।

’৭১ সালের যেসব রাজাকার বই লিখেছে তাদের বই পড়লে দেখা যায় যে সকলের চিন্তাধারার পরতে পরতে আছে ইসলাম প্রেম এবং বাংগালী সংস্কৃতির প্রতি পাক সেনাদের মতই অপরিসীম ঘৃনা বিদ্বেষ। একই ধরনের ভাবনার প্রতিফলন দেখা যায় বর্তমান কালের বহু মোল্লা আলেম শ্রেনীর লোকের কথাবার্তাতেও। বাংগালী সংস্কৃতির প্রতি এই ঘৃনা বিদ্বেষ হালাল করার উপায় হিসেবে সনাতন হিন্দু সমাজের কঠোর বর্নপ্রথার জুজু দেখা, হিন্দু জমিদার বাড়ির সামনে মুসলমানকে জুতো পরতে দিত না স্মরন করানো (ভাবখানা এই নিয়ম কেবল মুসলমান প্রজাদের জন্যই ছিল এবং এখনো আছে), গ্লাসে জল না দিয়ে হাতে ঢেলে দিত (ভাবখানা হিন্দু সমাজ এখনো এসব নিয়মের চর্চা করে যাচ্ছে এবং স্কুলে শিক্ষা দিচ্ছে) এসবের বয়ান। হিন্দুরা দুশো বছর ব্রিটিশের সাথে তাল মিলিয়ে মুসলমানদের শোষন করেছে কারন জমিদাররা বেশীরভাগ ছিল হিন্দু। অদ্ভূত বিশ্লেষন। জমিদার শ্রেনী ছিল হিন্দু সমাজের ভেতরেও সংখ্যার বিচারে অতি স্বল্প সংখ্যক, তাদের শোষন, অত্যাচার থেকে দরিদ্র হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান, বৌদ্ধ কেউই রেহাই পায়নি। ভাবখানা এমন যে হিন্দু জমিদাররা বেছে বেছে কেবল মুসলমান প্রজাদেরই শোষন করেছিল আর হিন্দু প্রজাদের সোনায় মুড়ে রেখেছিল। মুসলমান জমিদাররা সংখ্যায় কম হলেও তারাও একই ভাবে গরীব প্রজাদের অত্যচার শোষন করেছে। তাদের বাড়ির সামনে দিয়েও জুতো পরা ছাতা খোলা নিষিদ্ধ ছিল। শেষের দিকে ইসলাম প্রিয় ভাইদের প্রিয় হয়ে ওঠা হুমায়ুন আহমেদের অয়োময় নাটকেও দেখা যায় মীর্জা বাড়ির সামনে দিয়ে গরীব প্রজা কাশেমকে বলপূর্বক জুতো খোলানো হয়েছে, কাশেম জমিদার হয়ে আবার খুলিয়েছে সোলায়মানকে।

এই ধরনের বিকৃত এক তরফা তত্ত্ব এখনো বহু রাজাকার সমর্থক এবং আধা রাজাকার গোছের লোকজন অকপটে বয়ান করে চলেছেন যাতে হিন্দু ধর্ম এবং ধর্মাবলম্বিদের প্রতি বিদ্বেষ সদা জিইয়ে থাকে, এথনিক ক্লিঞ্জিং এর প্রতি পরোক্ষভাবে হলেও সহানুভূতি জন্মে, বাংগালী সংস্কৃতির প্রতি বিদ্বেষ জন্মে, এবং নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ববাদের দাবী বজায় থাকে। স্বাধীনতাত্তোর ভারতের নানান সাম্রাজ্যবাদী পদক্ষেপ এই চক্রের কাছে আশীর্বাদের মতই দেখা দিয়েছে। এসব তারা বয়ান করেন কেবল ইতিহাস শিক্ষা দিতে নয়, নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতা বজায় রাখতে। এ কারনেই এই অধ্যায় একটু গুরুত্ব দিয়ে লিখছি।

ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আন্দোলনেও হিন্দু মুসলমান সকলেরই অংশগ্রহন ছিল। ব্রিটিশের দালালিতেও হিন্দু মুসলমান কোন সম্প্রদায়ের উচ্চশ্রেনী/মধ্যম শ্রেনীই বাদ ছিল না, এখানেও ধর্মের কোন ব্যাপার ছিল না, তারা তাদের শ্রেনী স্বার্থের কারনেই তেমন ভূমিকা নিয়েছিল। খান বাহাদুর, রায় বাহাদুর এসব টাইটেল জমিদাররা ইংরেজের দালালি করেই পেত। যেমন সিপাহী বিদ্রোহ দমনে ইংরেজকে বিশেষ সহায়তার পুরষ্কার স্বরুপ ঢাকা ও আশে পাশের বেশ ক’জন হিন্দু মুসলমান জমিদারকে পুরষ্কৃত করা হয়। জমিদার আবদুল গণিকে সবচেয়ে বিশিষ্ট ভূমিকার কারনে নবাব উপাধী দেওয়া হয় [৪]। ঢাকা শহরের উন্নয়নে নবাব পরিবারের অসংখ্য অবদান থাকলেও সে নবাব উপাধির ইতিহাস হল সিপাহী বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ রাজকে সক্রিয় সহায়তা প্রদান। নবাব পরিবারের সাথে ব্রিটিশ রাজের ব্রিটিশ আমলের শেষ পর্যন্তই অত্যন্ত সুসম্পর্কই ছিল, এক নবাব হাবিবউল্লাহ ইংরেজের হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়াইও করেছেন। নবাব পরিবার হিন্দু হলেই এসব তথ্য ভর করে দারুন সব বিশ্লেষন ফাঁদা যেত; যেমন ঢাকার হিন্দু জমিদার কাফের ব্রিটিশের সাথে ষড়যন্ত্র করে মুসলমান সিপাহীদের নির্মভাবে ফাঁসী দিয়েছিল বিশ্ব মুসলমানের মেরুদন্ড ভেংগে দেওয়ার কূট চক্রান্ত করে।

রাজাকারদের চোখে পাকিস্তান=ইসলাম, পাকিস্তান ভেংগে বাংলাদেশ গড়া মানে ইসলামের পরাজয়, হিন্দুত্ববাদের বিজয়, কাজেই পাক সমর্থন করা ঈমানী দায়িত্ব। একই রকমের মূল্যায়ন সাধারন ভাবে দেশের আলেম সমাজেরও ছিল। হিন্দু ভারতের সহায়তায় মুসলমান পাকিস্তান ভাংগা তত্ত্বীয় ধর্মজ্ঞানে কোনভাবেই সমর্থন করে না বলাই বাহুল্য। ইসলামের প্রতি গভীর অনুরাগ থেকেই বাংলা সংস্কৃতির প্রতি তাদের ঘৃণার আগুন আজো জ্বলছে, যার প্রকাশ ঘটে নানান রূপে, যেমন বাংলা নববর্ষ হারাম, শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া শিরকী এসব ফতোয়া প্রদান করার মাধ্যমে। আবারো বলছি, বাংলা ভাষা সংস্কৃতি সম্পর্কে এমন ঘৃনা বিদ্বেষ কেবল পাক সেনা এবং অল্প কিছু আধা শিক্ষিত মোল্লা বা রাজাকার বদরের মানসিকতা ভাবা খুবই ভুল হবে। এই ধরনের মানসিকতার অধিকারী ছিলেন সেকালের ইসলাম প্রেমিক উচ্চশিক্ষিত বুদ্ধিজীবিকূলও। হিন্দু রবীন্দ্রনাথকে বাংলায় নিষিদ্ধ করার দাবী জানিয়ে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে বেড়াতেন ওনারা। অধ্যাপক আলী আহসান ’৬৪ সালে পাকিস্তানের স্বার্থে রবীন্দ্রনাথকে বিসর্জন দেবার দাবী জানিয়েছিলেন। একজন মৃত কবি ১৩ কোটি লোকের বিশাল এক দেশের জন্য রীতিমত হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন কেবলমাত্র ধর্মবিশ্বাসের কারনে।

মাওলানা আকরাম খাঁ ছিলেন ব্রিটিশ আমলের একমাত্র উল্লেখযোগ্য বাংলা পত্রিকা আজাদের প্রতিষ্ঠাতা। উনি নানান ধর্মীয় আন্দোলন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথেও যুক্ত ছিলেন। উনি উদারমনা মাওলানা ছিলেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে সদ্ভাব রাখায় বিশ্বাস করতেন। ’৫২ সালে পাক সরকার তার নেতৃত্বে মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারে এক কমিটি করে, সেখানে তিনি মত দিয়েছিলেন যে বাংলা হল হিন্দুদের ভাষা, একে পরিমার্জন করে মুসলমান উপযোগী ভাষা বানাতে হবে। উদারমনা মাওলানার ভাষ্য এমন হলে বাকিদের চিন্তাধারা কেমন ছিল বোঝা যেতে পারে। ‘৬৭ সালে মুসলিম লীগের খান এ সবুর (’৭১ এর এক ভয়াবহ রাজাকার) রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করার দাবী জানানোর পর আজাদ পত্রিকায় হিন্দু সংস্কৃতির জয়গান গাওয়া রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই নিষিদ্ধ করা উচিত ছিল বলে মত প্রকাশ করা হয় [৫]। উর্দু হরফে বাংলা প্রবর্তনের মত বহুবিধ ফর্মুলা এই চক্র পাক আমলে বহুবার প্রস্তাব করেছে।

মনে রাখতে হবে যে এরা সকলেই বাংগালী বা বাংলাভাষী, উর্দুভাষী পাকিস্তানী নয়। এদের বুদ্ধিবৃত্তিক বংশধররা বহাল তবিয়তেই আমাদের মাঝেই আছে। যতদিন না ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা বন্ধ না হয় এরা থাকবেই, দিনে দিনে আরো বাড়বে। জাতির মাঝে সফল ভাবে গড়ে তুলবে আদর্শগত বিভাজন যা ’৭৫ এর পর থেকে প্রকট ভাবে হয়েছে। এই বিভাজন কিন্তু হিন্দু মুসলমানের মত সরল বিভাজনও নয়।

আবার অতীতে ফিরে যাই। বংগবন্ধু ’৭১ সালে ঠিকই বুঝেছিলেন আসন্ন আন্দোলনে কোন পক্ষ বাংগালী হয়েও পাক দালালি করবে। ’৭১ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী বাংলা একাডেমীতে ভাষা আন্দোলন বিষয়ক এক স্মরন সভায় বংগবন্ধু সাম্প্রদায়িক মানসিকতার বুদ্ধিজীবিদের উদ্দেশ্যে এক কঠোর বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন, “৪৮ সালের ১১ই মার্চ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করলে কোন মুসলমান গণপরিষদ সদস্য তার প্রতিবাদ জানাননি। এর প্রতিবাদ করেছিলেন একজন হিন্দু, তিনি কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। …যখন আমাদের সংস্কৃতির ওপর ক্রমাগত আঘাত এসেছে, যখন আমরা দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিকে পরিনত হয়ে গেছিলাম, তখন ক্ষমতার লোভে সবাই এত বেশী মুসলমান হয়ে গেছিলেন যে এর বিরুদ্ধে কেউ একটি কথাও বলেননি। ……সূর্যসেনের নাম বলতে আপনারা ভয় পান, কারন তিনি ছিলেন হিন্দু” [৬]। বংগবন্ধুও অনেকের মতই এই চক্রের সাম্প্রদায়িকতার কারন সম্ভবত ‘ক্ষমতার লোভ’ বুঝতেন যা সঠিক নয়।

ইসলাম প্রিয় বুদ্ধিজীবিরা পাকিস্তান আমল থেকেই বাংগালী সংস্কৃতিকে নিষ্ঠার সাথে ঘৃনা করে গেছেন, ’৭১ সালেও পক্ষ বেছে নিতে দ্বিধা করেননি। এই দলের একমাত্র ব্যাতিক্রম ছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, যিনি পাকিস্তানের স্বার্থে রবীন্দ্রনাথকে বিসর্জন দেবার আহবান জানালেও বিস্ময়করভাবে কলকাতায় হাজির হয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে অবস্থান নিয়ে চমক দেন। সবচেয়ে দূঃখজনক হল যে পাক সমর্থক বা রাজাকার মানেই দাঁত মুখ খিঁচানো দানব প্রকৃতির কিংবা মূর্তিমান শয়তানের মত কূটিল যে চেহারা প্রথমেই ভেসে উঠে এসব স্বাধীনতা বিরোধীরা সকলে তেমন নন। এদের মধ্যে সত সজ্জন ভালমানুষরাও ছিলেন, আদর্শগত কারনেই এরা পাক পক্ষ সমর্থন করেছিলেন। এরা সকলে টাকা পয়সা ক্ষমতার লোভে রাজাকারি করেছিলেন এমন ধারনা খুবই হাস্যকর। আদর্শগত কারন ছিল মূল, যে আদর্শ তারা পেয়েছিলেন ধর্মীয় চেতনার কল্যানে, যার মূলে ছিল চরম সাম্প্রদায়িকতা। তাদের ধর্মীয় বিশ্লেষকের চোখে বিপন্ন ইসলাম ও পাকিস্তান রক্ষার্থে পাক আর্মির যাবতীয় কুকর্কমে সায় দিতে তাদেরও বিবেকে বাধেনি। ’৭১ এর ঘটনা বা নৃশংসতার জন্য ইসলাম দায়ী নয়। তবে পাক আর্মির বর্বরতা/নৃশংসতা, বিশেষ করে রাজাকার বদরদের নৃশংশতা/বেঈমানীর পেছনে ধর্মীয় চেতনার ভূমিকা অবশ্যই আছে।

আজকের দিনেও তালেবান জাতীয় কেউ সাচ্চা ইসলাম কায়েমের নামে বাংলা দখল করে নিলে এ ধরনের মানসিকতার অধিকারী বহু লোকেই তাদের দলে জুটে যাবে, কোন সন্দেহ নেই। আবার অনেকে বলেও যাবেন ইসলামের সাথে এসবের কোন সম্পর্ক নেই….এরা আসল ইসলাম জানে না ইত্যাদী।

ইসলামী জাতীয়তাবোধের কারনে জন্মে নিজ গোষ্ঠির প্রতি এক ধরনের বিশেষ মমত্ববোধ ও পক্ষপাতিত্ব, তাতেও থেমে থাকলে নাহয় হত। এই বিশেষ মমত্ববোধ ও পক্ষপাতিত্বের কারনে যখন স্বাভাবিক যুক্তিবোধ, নীতিবোধ হারিয়ে মৌলিক ন্যায় অন্যায় বোধই লোপ পায় তখনই হয় মুশকিল। আধুনিক বিশ্বে যার অন্যতম ভুক্তভোগী হয়েছে বাংলাদেশী মুসলমানেরাই। ’৭১ সালে আমরা মোটামুটি জানি যে অল্প কিছু ব্যাতিক্রম বাদে মোটামুটি ভাবে সব মুসলমান দেশ পাকিস্তানীদের পক্ষ নিয়েছিল। সৌদী আরব কিংবা ইরানের মত কট্টররাই শুধু নয়, এমনকি তুরষ্ক ইন্দোনেশিয়ার মত সেক্যুলার ধাঁচের মুসলমান প্রধান রাষ্ট্রও এ তালিকা থেকে বাদ যায়নি। মুসলমান বিশ্বের উল্লেখযোগ্য বড় নেতাদের মাঝে কেবল প্যালেষ্টাইনী ইয়াসির আরাফাত এবং পাকিস্তানী সীমান্ত গান্ধী নামে পরিচিত খান আবদুল গাফফার খান সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন। কারো সাতে পাঁচে না থাকা নেপালী, তীব্বতীরা পর্যন্ত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহন করেছে স্রেফ মানবিকতার দায়ে, কার কোন ধর্ম এসব ক্ষুদ্রতার মাঝে মানবতা জিম্মা রাখলে সেটা সম্ভব হত না। মুসলমান বিশ্বের নির্লজ্জ পাক সমর্থন কেউ কেউ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন আরব রাষ্ট্রগুলির মার্কিন ঘেঁষা নীতির কারনে। এ বিশ্লেষন ঠিক নয়। আরব দেশগুলি নিজেরাই এক যুক্ত বিবৃতীতে এ যুদ্ধকে ‘জেহাদ’ নামে অভিহিত করে পাকিস্তানের প্রতি অর্থ ও সামরিক সাহায্য বাড়িয়ে দিয়েছিল, এ থেকেই বোঝা যায় অন্ধ পাক সমর্থনের মূল কারন কোথায় ছিল। এই রকম যুক্তিহীন অমানবিক পক্ষপাতিত্ব তীব্র সাম্প্রদায়িকতা্র প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়।

এটাও মানা যেতে পারে যে অনেক সময়ই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যে নীতি গ্রহন করা হয় তা দেশের জনগনের মনোভাবের প্রকাশ নাও হতে পারে। যেমন ততকালীন মার্কিন সরকার নীতিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী হলেও সে দেশের জনগন তাদের সরকারী নীতির প্রতিবাদ করেছে, আমাদের জন্য চাঁদা তুলেছে, এমনকি ডিংগি নৌকো করে সাগর পাহারা দিয়েছে যেন পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে অস্ত্রবাহী জাহাজ রওনা হতে না পারে। বংগবন্ধুও পাক কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডনের সাংবাদিক সম্মেলন এবং ঢাকার রেসকোর্সের জনসভায় মার্কিন জনগনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন।

মুসলমান দেশগুলিতে তেমন কোন আলামত দেখা যায়নি। হাতে গোনা কয়েকটি বিবৃতি/মিছিল ছাড়া তেমন কোন প্রতিবাদের আলামত নেই। এমনকি ভারতের, বিশেষ করে পশ্চীম বংগের লোকজন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে চরম সহানুভূতিশীল হলেও মুসলমান সম্প্রদায়, বিশেষ করে অবাংগালী মুসলমানরা ছিল বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। তাদের মালিকানাধীন পত্রপত্রিকায় সরাসরি পাক সমর্থক লেখা বের হত। এদের অনেককে অবশ্য প্রবাসী সরকার পরের দিকে বহু সাধ্য সাধনার পর আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন। এমনকি কোন কোন মুসলমান দোকানী ঘর বাড়ি স্বামীহারা বাংলাদেশী মুসলমান উদ্বাস্তু মহিলার কাছেও নগদ দামে সওদা বিক্রি করতে অস্বীকার করেছে এমন ঘটনাও আছে। মুসলমান প্রধান দেশগুলি ও ভারতীয় মুসলমানদের এহেন ভূমিকা ছিল প্রবাসী মুজিবনগর সরকার ও ভারত সরকারের জন্য এক পর্বত প্রমান সমস্যা। এই সমস্যার মাত্রা কেমন ছিল তা বোঝা যায় যুদ্ধের পর পর প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র নীতির সুর থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছিল, “It is very painful to note that the Arab countries by and large have acted against our interests…..We considered this to be aweful failure of all the Governments who propagate Islamic brotherhood” [৭]. ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ শুনতে যতটা মধুর লাগে সবসময় ততটা মধুর নাও হতে পারে।

হুমায়ুন আহমেদ তার জ্যোতস্না জননীর গল্প বইতে মুসলমান রাষ্ট্রগুলির এহেন ভূমিকায় বিস্ময় প্রকাশ কেন করেছেন তা তিনিই ভাল জানেন। এই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ততকালীন পোপের বিবৃতি কোট করে, সেকারনেই মনে হয় তার বেশী খারাপ লেগেছে। তবে এতে বিস্ময়ের কিছু থাকার কথা নয়। মুসলমান দেশগুলিতে ধর্মীয় শিক্ষার নামে যে সাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকাশ্য চর্চা বাল্যকাল থেকেই করা হয় তাতে এহেন আচরনের উলটো কিছু হলেই অবাক হতে হত। ধর্মীয় চোখে বিশ্বের যাবতীয় সমস্যার বিশ্লেষন ইউনিক হতে পারে, যতই ভ্যারিয়েবল থাকুক না কেন চুড়ান্তভাবে মুসলমান বনাম অমুসলমান এই দৃষ্টিকোন মূল্যায়িত হবার সম্ভাবনা থেকেই যায়। ফলাফল যেমন হবার তেমনই ’৭১ সালে হয়েছিল। আজকের দিনেও পূর্ব তীমুর, দক্ষিন সুদানের স্বাধীনরতার মূল্যায়ন অনেকে এভাবেই করে।

সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবোধের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শিক্ষা হল বিধর্মীরা সর্বদা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে (আমাদের ধর্মশিক্ষার বইতেই সরাসরি এই কথা আছে), তাদের বিরুদ্ধে সেই নবীজির আমল থেকেই জেহাদ চলে আসছে, এবং সে জেহাদে জাতিকে একতা বজায় রেখে কওম রক্ষা করতে হবে। এর মাঝে ন্যায় অন্যায় বিচার বিবেচনার তেমন অবকাশ নেই, মূল বিবেচ্য হল মুসলমান বনাম অমুসলমান, অন্য কথায় ন্যায় অন্যায়ের সীমারেখা হল মুসলমান অমুসলমান। তাই বাংগালী লাখে লাখে মরছে, ধর্ষিতা হচ্ছে, নিরন্ন, নিরাশ্রয় হয়ে অপর দেশে আশ্রয় নিচ্ছে সেসব দৃশ্য দুনিয়াময় আলোড়ন তুললেও মুসলমান বিশ্বে কোন আলোড়ন তোলেনি, কারন অত্যাচারী পক্ষ এখানে মুসলমান, যারা ইসলামের সেবক রক্ষক বলে নিজেদের দাবী করেছিল, অত্যাচারিত পক্ষ নিজেদের কোন ধর্মীয় পরিচয়ে আবদ্ধ করেনি। উলটা মুক্তিযুদ্ধকে বিধর্মীদের ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে মুসলমান দেশগুলির মিডিয়াতে কলাম লেখা হয়েছে, ভারতের ভূমিকার পর এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কতটা জোরদার ছিল বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়। আপনার মাথায় যদি গেঁড়ে বসে থাকে যে বিধর্মী মানেই ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে চিরকাল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে তবে মুশরিক ভারতের সহায়তায় সর্ববৃহত মুসলমান রাষ্ট্র ভাংগা কিভাবে গ্রহন করতে পারেন? আর কোন বিবেচনা লাগে?

এবার ’৭১ সালের পাক/ভারত পক্ষ পরিবর্তন করে একটি কাল্পনিক দৃশ্য চিন্তা করেন। আমেরিকার মদদে ভারতীয় বাহিনী পূর্ব বাংলার হাজার হাজার নাগরিক হত্যা করছে, গণধর্ষন করছে, হিন্দু ধর্মগুরুরা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলি মুসলমান হত্যা ধর্ষন ধর্মীয় অধিকার বলে উষ্কানি দিচ্ছে, বাংগালীরা পালিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নিচ্ছে। মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া তখন কেমন দেখা যেত বলে মনে করেন? বাংগালী মুসলমান ভাইদের ভয়াবহ নির্যাতনের প্রতিক্রিয়ায় তৌহিদী জনতার গর্জন ও পদভারে আরব বিশ্ব কেঁপে উঠত না? আমেরিকার বিরুদ্ধে জেহাদের হুমকি, ইন্দিরা/নিক্সনের কুশপুত্তলিকা দাহ চাই কি দূতাবাসে হামলা, সুইসাইড বোমা কিছু বাদ থাকত? আমাদের হয়ে কাফের ভারতীয়দের বিরুদ্ধে লড়তে বেশ কিছু জেহাদী মধ্যপ্রাচ্য ও নানান মুসলমান দেশ থেকে চলেও আসতেন, যেমনটা আফগানিস্তানে গেছিলেন, আমরা বাংগালীও কেউ কেউ আফগানিস্তানেই শুধু নয়, প্যালেষ্টাইনেও গেছি। বাস্তবে আক্রমনকারী পক্ষ যেহেতু পাকিস্তানী মুসলমান ছিল,কাজেই সেক্ষেত্রে কোন অন্যায় ঘটেনি। মুসলমান নির্যাতনের উদাহরন হিসেবে ইসলামী প্রিন্ট মিডিয়া, ইন্টারনেট সূত্রে বহু খতিয়ান দেখা যায়। বাংলাদেশের ৩০ লাখ নিহত মানুষ, ২ লাখ ধর্ষিতা (যাদের অধিকাংশই মুসলমান) উদাহরন হিসেবে কেউ দেখেছেন? এসব গবেষকের কাছে মূল বিবেচ্য হল ধর্মীয় পরিচয়, ন্যায় অন্যায় নয়। জাকির নায়েক ও সমমনারা ইসলামী সভ্যতা কত মহান আর আধুনিক সভ্যতা (যেহেতু পশ্চীমি মূল্যবোধ এখানে মূল চালক) কত খারাপ সেটা বয়ানে প্রায়ই বসনিয়া, ইরাক, আফগান, গুয়ান্তামো বে’র উদাহরন দেন, ভুলেও ওনারা বাংলাদেশের গনহত্যা, বালুচি গনহত্যা, ইরাক-ইরানের ৮ বছর ব্যাপী যুদ্ধে নিহতদের হিসেব, সাদ্দাম/গাদ্দাফির নির্যাতন কিংবা বর্তমানের শিয়া সুন্নীদের রক্তারক্তি কি সিরিয়ার ভয়াবহ নির্যাতন এসব উদাহরন হিসেবে মুখে আনবেন না। কেবল হত্যাকারী পক্ষ অমুসলমান হলেই এসবও তালিকায় মহা সমারোহে যোগ হয়ে যেত।

আর কিছু মুসলমান দেশের নিত্য বিধর্মী নিপীড়ন প্রসংগ তো আদৌ সত্য বলেই গ্রহন করবেন না, নিতান্ত বাধ্য হলে সাফ বলে দেবেন যে ইসলামের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। তখন উলটো জোর গলায় বলবেন যে কিছু সংখ্যক লোকের দায় কেন তাদের প্রিয় ধর্ম কিংবা কিংবা জাতি নিতে যাবে? যুক্তিটা অবশ্যই খুবই গ্রহনযোগ্য। মুশকিল হল যে এই যুক্তি আবার হাজার হাজার বছর আগের সুদূর আরব মূলুকে কে কাকে মেরেছিল ধরেছিল, কোথা থেকে বার করে দিয়েছিল সেসবের জের ধরে আজকের দিনেও নিজেদের সন্তানদের প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে জাতিগত ঘৃনা বিদ্বেষ শিক্ষা দেবার সময় বেমালুম ভুলে যান। নির্দ্বিধায় নিষ্পাপ শিশুদের মনে বাল্যকাল থেকেই কোন জাতি পথভ্রষ্ট, কোন জাতি চির অভিশপ্ত এসব শিখিয়ে যান।

এই মানসিকতার আরো উদাহরন নিজের চোখেই দেখেছি। ’৯০ সালে ইরাক বিনা নোটিসে এক রাতে কুয়েত দখল করে নিল, কুয়েতের শেখসহ বহু লোক হতাহত, বাংলাদেশসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্ব একেবারে নিশ্চুপ, যেন কিছুই হয়নি। যেই রংগমঞ্চে আমেরিকা নামল অমনি ঢাকার রাস্তা কেঁপে উঠল ‘বাপের ব্যাটা সাদ্দাম’ সমর্থকদের পদভারে। কাফের আমেরিকা এসেছে মুসলমান ইরাকীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে, আর কি চুপ থাকা যায় নাকি! মজার ব্যাপার দেখেছিলাম যে আমেরিকা বুশকে প্রচুর গালাগালি করা হলেও যাদের মাটিতে যাদের আহবানে, সক্রিয় সহায়তায় মার্কিনীরা ঘাঁটি গেড়ে যুদ্ধ করেছিল সেই আরব দেশের ব্যাপারে আবার বাপের ব্যাটা সমর্থকরা চরম উদাসীন।

ইতিহাসের অনাদিকাল থেকেই পৃথিবীর নানান প্রান্তে মানুষ অত্যাচারিত হচ্ছে। মুসলমান যখন মুসলমানদের অত্যাচার করে সেটাতে কোন সমস্যা পাওয়া যায় না, অমুসলমানদের ওপর অত্যাচার, রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক বানানো তো আমলেই আনা যায় না, নানান ষড়যন্ত্র পাওয়া যায়। যেমন দক্ষিন সূদানের স্বাধীনতা, ইন্দোনেশীয়া ভেংগে পূর্ব তীমুরের আবির্ভাব হল বিধর্মীদের চক্রান্ত। আমাদের ’৭১ সালের মূল্যায়নও এভাবে কিছু বিদেশী আলেম স্কলারের চোখে তেমনই। কোথাও অত্যাচারী পক্ষ অমুসলমান ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠির ধর্মীয় পরিচয় মুসলমান হলেই ব্যাস ঈমান চাংগা হয়ে যায়। কারন নিজেদের সদা সর্বত্র নিপীড়িত প্রমান করতে হবে, আক্রান্ত আছি ভাবতে হবে, এটাও ঈসলামী জাতীয়তাবোধের এক অলিখিত ট্রেডমার্ক। ধর্মীয় সূত্রের নানান ঘৃনাবাদের তত্ত্ব যেগুলি কেয়ামত পর্যন্ত জিইয়ে রাখতে হবে সেসব সম্পর্ক নইলে সংশয় দেখা দিতে পারে। কাজেই ঘৃনাবাদ হালাল করার শ্রেষ্ঠ উপায় হল নিজেরাই সদা সর্বত্র এক তরফা নির্যাতিত এভাবে অব্যাহত প্রচারনা চালিয়ে যাওয়া।

মুসলমান নির্যাতনের খতিয়ান হিসেবে ইরাক, আফগান, চেচনিয়া, বর্তমানের মায়ানমার ইত্যাদী নানান উদাহরন সিরিজ আকারে পাওয়া যায়। সে সব খতিয়ানে অনেক সময়ই অর্ধসত্য কিংবা ডাহা মিথ্যা কথাও ব্যাবহার করা হয় নিজেদের বিধর্মীদের হাতে ভয়াবহ রকমের নির্যাতিত প্রমান করার জন্য, জাতিগত ঘৃনাবাদ ভালভাবে জিইয়ে রাখার স্বার্থে। সেদিন দেখি অন্য এক ব্লগে বিশ্বময় মুসলমানদের ওপর বৌদ্ধদের ভয়াবহ নির্যাতনের নানান কাহিনী। পিলে চমকে যাবার মত তথ্য হল থাইল্যান্ডে মুসলমান নাম নেওয়া নিষিদ্ধ, মুসলমানদের দুই সন্তানের ওপরে জন্ম দেওয়াও নাকি নিষিদ্ধ। এমন আজগুবি তথ্যের সূত্র খুঁজতে বেহুদা কিছু সময় নষ্ট করতে হল। রোহিংগা ইস্যু নিয়ে দেখেছি অনেক উচ্চ শিক্ষিত মুসলমান যারা ধর্মকর্ম নিয়ে তেমন মাথা ঘামান না তারাও যত্নের সাথে নানান ভূয়া ছবি প্রচার করে গেছেন। কোথাও নাক বোঁচা ধরনের লোকজনের মৃতদেহের ছবি পেলে সেটাও রোহিংগা গনহত্যার দৃশ্য হয়ে গেছে, সে ভূমিকম্পে নিহত তিব্বতী হোক কি থাইল্যান্ডে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের সময় শুইয়ে রাখা আটক লোকজন হোক। ধরিয়ে দিলেও কিছু বলেন না, ছবিও সরান না। এসব ড্রামাটিক মিথ্যাচারের কি কোন দরকার আছে? নিপীড়িত মানুষ সে রোহিংগা মুসলমান হোক, কাল হোক, নিম্ন বর্নের হিন্দু হোক সকলেই এক। মানবাধিকার সবার জন্যই প্রযোজ্য, মুসলমান পরিচয়ের গুরুত্ব ঘটা করে কেন বেহুদা লাগবে? রোহিংগাদের ধর্মীয় পরিচয় মুসলমান ভিন্ন অন্য কিছু হলে সমস্যা ছিল না, তখন নীরবতা পালন করতেন?

এথনিক্যালি বহিরাগতদের সাথে স্থানীয় আদিবাসীদের রেষারেষি প্রতিযোগিতা বিরল কিছু নয়। শরনার্থী জীবন কোনদিনই সহজ নয়। এরা অনেক সময় জড়িয়ে পড়ে নানান অপরাধের সংগে, স্থানীয়দের সংগে দাংগা হাংগামা ঘটা খুবই সাধারন। একই জাতীয় সমস্যা পাকিস্তানেও হয়েছিল। ’৪৭ এর পর ভারত থেকে আগত উর্দূভাষী মুসলমানদের সাথে স্থানীয় সিন্ধীদের নানান বিরোধ দেখা দেয়, এরপর চলে সিন্ধী বনাম মোহাজির ব্যাপক দাংগা হাংগামা। করাচী পরিচিত হয় বিশ্বের অন্যতম সন্ত্রাসের শহরে, ৮০/৯০ এর দশকে করাচীতে হাজার হাজার লোক নিহত হয়েছে জাতিগত সন্ত্রাস এবং পালটা সেনা অভিযানে। পাকিস্তানের সাম্প্রতিক তালেবানী/আল কায়েদা সন্ত্রাসের আমলে সেই সন্ত্রাস ঢাকা পড়ে গেছে। সেসময়কার নিহত মুসলমানদের ছবি কয়জনে চোখের পানি ফেলে বিলি করেছিলেন?

মুসলমান বিশ্বের অন্যতম সংবেদনশীল প্যালষ্টাইনী শরনার্থীরাই বা অন্যান্য আরব দেশে কেমন আছে? খুব ভাল আছে? জর্দান ছাড়া অন্যান্য দেশে তারা তেমন ভাল নেই, লেবাননে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয় না, ডাক্তারী ইঞ্জিনিয়ারিং এর মত ভাল ভাল পেশায় যোগদান নিষিদ্ধ আছে। জর্ডানেও ’৭০ সালে পিএলও যোদ্ধাদের সাথে জর্ডানী বাহিনীর যুদ্ধে হাজার হাজার প্যালেষ্টাইনী নিহত হয়েছে (ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর নামে পরিচিত [৮]), যার সংখ্যা ’৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মোট নিহত মুসলমান সংখ্যার কাছাকাছি হতে পারে। এর খবর কয়জনা রাখেন বা তাদের স্মরন করেন? ’৯১ সালে কুয়েত পুনরুদ্ধারের পর চলে ইরাক সমর্থক অভিযোগে সেখানে গণহারে অসংখ্য বিদেশীর ওপর চলে অত্যাচার নির্যাতন। সেখানে ’৩০ এর দশক থেকে বসবাস করা প্যালেষ্টাইনী এবং তাদের বংশোদ্ভূতরা ভুগেছিল সবচেয়ে বেশী। কারন খুবই অদ্ভূত; কুয়েত দখলের সময় ইয়াসির আরাফাত সাদ্দামকে সমর্থন করেছিলেন এটাই তাদের অপরাধ। চার থেকে সাড়ে চার লাখ প্যালেষ্টাইনীকে অতি দ্রুত বহিষ্কার করা হয়, প্যালেষ্টাইনীদের চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়, স্কুল থেকে শিশুদের নাম কেটে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। প্যালেষ্টাইনী নির্যাতনে কুয়েতী রাজ পরিবারের প্রত্যক্ষ মদদে ছিল। থানায়/সেনা ক্যাম্পে নিয়েও অনেককে বর্বরোচিতভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় স্রেফ প্যালেষ্টাইনী হবার অপরাধে। গনধর্ষনেরও অভিযোগ আছে বেশ কিছু। এসব কাহিনী সে সময় এন্টি সাদ্দাম উন্মাদনা আড়ালে মিডিয়ায় যায়গা পায়নি, আরো মার্কিন বাহিনী ছিল কুয়েতের মিত্র, পশ্চীমা মিডিয়াগুলির নীরবতার কারনও ছিল সেটা। আরব ও মুসলিম মিডিয়া নীরব ছিল সম্ভবত মুসলমানের হাতে মুসলমান নির্যাতনের কাহিনী গুরুত্বপূর্ন নয় বলে। এসব নিয়ে বহু সূত্র আছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সূত্র দিলাম [৯]।

এজন্যই বলি যে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার ভিত্তিতে বিশ্লেষনের কু-অভ্যাসের জন্য নিজেদের ভাই ব্রাদারদেরই ভুগতে হয় বেশী। ’৭১ সালে মুসলমিক বিশ্বের প্রত্যক্ষ মদদ না পেলে ইয়াহিয়া অত উন্মাদ হত না, মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাকিং পাওয়া জামাতি ধারার দেশীয় রাজাকাররাও নিরুতসাহিত হত। ’৯১ সালেও প্যালেষ্টাইনীদেরও নিঃসন্দেহে এতটা ভুগতে হত না।

[চলবে]

সূত্রঃ

১। ইছলাহুর রুসূম – মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (পৃষ্ঠা-৯৮)
২। Iran says some academic courses too “Western”
৩। Anger as Iran bans women from universities
৪। ঢাকা সমগ্র-২ – মুনতাসীর মামুন।
৫। মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ – মুনতাসীর মামুন।
৬। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস – ড. মোহাম্মদ হান্নান।
৭। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ – এইচ টি ইমাম।
৮। Black September in Jordan
৯। A Victory Turned Sour: Human rights in Kuwait Since Liberation – Human Rights Watch