বঙ্গবন্ধু- নিশীথের মতো ব্যাপ্ত, স্বচ্ছতার মতো মহীয়ান

উনিশশো একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ- যে কোনো বিচারেই বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের জন্যে এক অনন্য ঘটনা। মোহান্ধের চোরাবালিতে আটকে থাকা দ্বি-জাতিতত্ত্ব, তারপর তেইশ বছরের পাকিস্তানি শাসন- বাঙালি স্বাধীনতার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠছিলো। এই স্বাধীনতা অর্জন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলো না- কারণ ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকের চোখে চোখ রাখলে দেখা যায়, সময়ের নির্মোহ এগিয়ে যাবার ভঙ্গিমায় স্তরে স্তরে ইতিহাস নির্মাণ করেছে নিজেকে। পলিমাটির বুকে নিজ পায়ে দাঁড়িয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।

বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়েই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলো বাঙালির সঙগ্রাম; সতেরো মিনিটের একটি নিটোল কবিতায় সেদিন অনবদ্য হয়ে ধরা পড়েছিলো মুক্তিযুদ্ধের জন্যে জাতির সুতীব্র আকাঙ্ক্ষার পোট্রেট। বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া-ভুট্টো আলোচনার ফলাফলের ভিত্তিতে পঁচিশে মার্চ রাতে জানোয়ার ইয়াহিয়া খানের ভাষণ দেবার কথা ছিলো সন্ধ্যা সাতটায়। জাতি প্রতীক্ষারত। ঢাকা সেনানিবাসের ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজ। এয়ার ফোর্সের গেইট দিয়ে অপেক্ষমান বিমানে উঠে পড়লেন জানোয়ার ইয়াহিয়া।অন্যদিকে চারতারা প্লেট লাগানো গাড়িতে প্রেসিডেন্টের ‘প্রক্সি’ দিয়ে ব্রিগেডিয়ার রফিক চললো রমনার প্রেসিডেন্ট হাউজে। পথে সাইরেন বাজানো হলো, আগে পিছে গার্ড। এই রিহার্সেলটি ধরা পড়ে গেলো। উইঙ কমান্ডার এ. কে. খন্দকার ও লে. ক. এ. আর. চৌধুরী নাটকীয় তামাশাটি ধরে ফেললেন। সাথে সাথে ঘটনাটি বঙ্গবন্ধুকে জানানো হলো। ইয়াহিয়া কেটে পড়েছে। বঙ্গবন্ধু সর্বত্র নির্দেশ পাঠালেন। সেই থেকেই ধরা পড়ে যায়- পাকিস্তানিরা একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চাইছে বাঙালির উপরে। বাঙালি যুদ্ধ চায়নি, সে নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে তার যে অধিকার, সে অধিকার চেয়েছিলো।

আগের পর্বটিতে উল্লেখ করা হয়েছে কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলো। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুর প্রহসনমূলক বিচারের আয়োজন করে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী। এ বিচারে বিশ্বব্যাপী নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়- তবে এই পর্বে তা উল্লেখ করা হচ্ছে না; বরঙ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কী আচরণ ও বিবৃতি ছিলো- তাই মূলত এই পর্বের প্রেক্ষণ। বস্তুত বঙ্গবন্ধু একটি স্বাধীনতা-উন্মুখ জাতির নেতা হিশেবে সারা পৃথিবীতে তৈরি করতে পেরেছিলেন তাঁর অনন্য অবস্থান। সে কারণেই বিশ্বের নানা দেশে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যামেরা ট্রায়াল নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন উঠেছে, প্রতিবাদ হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, নানা বিচিত্র পন্থায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেসব প্রতিবাদের মুখোমুখি হয়েছে, নানা মিথ্যাচারপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছে সঙবাদ-মাধ্যমকে। এগুলো বিশ্লেষণ করলে তাদের বক্তব্যের নানা দ্বৈততা চোখে পড়ে।

বিচারের নামে প্রহসন চলছে। এ প্রহসন বিচার নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। জাতিসঙঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্ট তার মুখপাত্রের মাধ্যমে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ইন্টারন্যাশনাল জুরিস্ট কমিশন শেখ মুজিবের বিচারের বৈধতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে। সঙক্ষিপ্ত সামরিক ট্রাইবুন্যালে বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র থেকে বিরত থাকতে পাকিস্তান সামরিক জান্তার উপর পশ্চিমাদেশ চাপ সৃষ্টি করে। ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিচারের বিশ্ব জনমতকে প্রাথমিকভাবে উপেক্ষা করে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবকে উপেক্ষা করার শক্তি জানোয়ার ইয়াহিয়ার ছিলো না। পাকিস্তান অর্থ. অস্ত্র এবঙ সামরিক সরঞ্জাম ইত্যাদির জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ এশিয়া স্থিতিশীল রাখার নীতি অনুসরণ করে এবঙ এই অঞ্চলে ভারসাম্যমূলক পরিস্থিতি যাতে বিনষ্ট না হয় সেই নীতি গ্রহণ করেছিলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা ভাবা যুক্তিযুক্ত ছিলো, গোপন বিচারে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ড হলে তারা যে স্বাধীনতার চেয়ে কম কিছু নিয়ে সমঝোতার চেষ্টা চালাচ্ছে, তা ভেস্তে যাবে। ফলে এ অঞ্চলের পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। পাকিস্তানের উপরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাপ সৃষ্টি করে এবঙ সেপ্টেম্বর মাসে ফারল্যান্ড স্টেট ডিপার্টমেন্টকে জানায়-

This issue offers example of both use and limitations of our leverage, and the final story has not yet been written. I have raised the question of Mujib with Yahya at almost every meeting since May, and it is also one of the new issues in which we have also exerted public pressure on the GOP. The results have been as much as could have been hoped for realistically. Mujib has been brought to trial on charges that could lead to the death penalty. On the other hand, the trial is not being conducted in a summary manner. Mujib has been allowed an outstanding defense lawyer, and we have received personal assurances that he will not be executed. (১)

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে না এই আশ্বাস পেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান এবঙ মুজিবনগর সরকারের মার্কিনপন্থী নেতাদের সঙ্গে বাঙলাদেশের সমস্যা নিয়ে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। কোলকাতার মার্কিন কনসুলারকে বাঙলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী (ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী) খন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব দেয়া হয়। এটা বেশ গোপন বিষয় ছিলো না যে আদর্শগত ও ব্যক্তিগতভাবে তাজউদ্দীনের আহমেদের সঙ্গে খন্দকার মোশতাকের বৈরী সম্পর্ক ছিলো। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের মাধ্যমে লন্ডনের প্রখ্যাত আইনজীবী শ্যান ম্যাক ব্রাইট শেখ মুজিবের জীবন বাঁচানোর জন্যে আবেদন করবে কি না এ সম্পর্কে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম খন্দকার মোশতাককে জিজ্ঞেস করলে মোশতাক তাকে বলে-

তোমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তোমরা শেখ মুজিবকে চাও, না স্বাধীনতা চাও? তোমরা দুটো একসঙ্গে পাবে না।(২)

সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কে কঙগ্রেসম্যানদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলাপ করার সময় তিনি স্বীকার করেন যে- কতিপয় বিদেশী সার্কেল এই বিচারে তিনি চাপের মধ্যে আছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের নির্বাহি আইনশাখা থেকে শেখ মুজিবের তার উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। শেখ মুজিব সম্পর্কে তার এতোদিনকার যে কঠোর অবস্থান ছিলো তা নমনীয় হয়ে পড়েছে। অক্টোবর মাসের উনিশ তারিখে ফরাসী সঙবাদপত্র ল’মন্ডে প্রকাশিত ইয়াহিয়া খানের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। ইয়াহিয়া খানকে জিজ্ঞেস করা হয়, পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার জন্য শেখ মুজিবের সাথে সে কথা বলেছে কি না; এর জবাবে ইয়াহিয়া খান বলে- একজন বিদ্রোহীর সঙ্গে সে কথা বলতে পারে না।

সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সালে কো-অর্ডিনেটর অব ইউএস ডিজাস্টার রিলিফ ফর ইস্ট পাকিস্তান, মরিস জে. উইলিয়ামস রিপোর্টে বলেন-

‘বিষয়টি যখন পুরোপুরি বিচার বিভাগের হাতে, তখন আশা করা যায় মুজিব সুবিচার পাবেন’- এই বক্তব্য ইয়াহিয়ার। তিনি বর্ণনা করেছেন, মুজিবের জন্য যথেষ্ট সঙখ্যক স্বাধীন আইনজীবী নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইয়াহিয়া নিজে বিশ্বাস করেন- মুজিব দোষী। দুটো এসেম্বলি, দুটো প্রদেশ, দুটো শাসনতন্ত্র থাকবে সেটা কিন্তু যখন দুটো পতাকা নিয়ে এলো এবঙ তারা পাকিস্তানের পতাকা ছিঁড়ে ফেললো, তখন তা হলো দুটো দেশের স্বাধীনতা। বাঙালি বন্ধুরা আমাদের বলেছেন- যদি মুজিবকে হত্যা করা হয়, তাহলে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আবার ব্যাপকভাবে উদ্বাস্তুর ঢল নামবে। এই মূল্যায়ন আমরা ইয়াহিয়াকে তার অর্থমন্ত্রী এম. এম. আহমদের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছি। এটা আমাদের এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছে যে- অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতি জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব বেশি ভয়ঙ্কর। (৩)

এদিকে এই রিপোর্ট পাঠানোর আগে সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের জন্য প্রস্তুত করা হয় আরেকটি রিপোর্ট, তা তৈরি করা হয় দশ জুলাই, উনিশ শো একাত্তর সালে। সেখানে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রশ্নে মুজিব প্রসঙ্গও আসে। এতে বলা হয়-

আমাদের তৃতীয় কৌশল হচ্ছে, ইয়াহিয়াকে যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার পথে অগ্রসর হতে আহবান জানানো। যদিও এটা ঠিক যে- এর সঙ্গে জটিল বিষয় জড়িত। তবে আমরা সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমঝোতার প্রকৃতি নিয়ে কোনো কথা বলবো না। ইয়াহিয়া আশা করেছেন যে- আগামী চার মাসের মধ্যে জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে সক্ষম হবেন। কিন্তু তাই বলে তিনি আওয়ামী লীগের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেননি কিঙবা পূর্ব পাকিস্তানের অসাধারণ জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় কোনো আগ্রহ দেখাননি।.. .. তবে আমরা ইয়াহিয়াকে এই ইঙ্গিত দিতে পারি যে- শুধু আওয়ামী লীগই পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র দল, যার রয়েছে সত্যিকারের জনপ্রিয় ম্যান্ডেট। সুতরাঙ পূর্ব-পাকিস্তানের সমস্যার কোনো টেকসই সুরাহা করতে হলে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই করতে হবে। (৪)

এখানে একটি বিষয় জানা গুরুত্বপূর্ণ যে- পশ্চিমা পাকিস্তানিরা সেদিন সত্তরের নির্বাচনকে কোন চোখে দেখেছে। এ প্রসঙ্গে আমির তাহেরির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়-

পূর্ব-পাকিস্তানের উপ-নির্বাচনে সবগুলো আসনে আওয়ামী লীগ জিতলে এবঙ আবারও তারাই সঙখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে এবঙ তারা যদি আবারও (সেনাবাহিনীর ভাষায়) দেশকে বিভক্ত করতে চায়, সেক্ষেত্রে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে- আমাদের এ প্রশ্নের জবাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন- আগের নির্বাচনে কারচুপি, সন্ত্রাস আর অসাধু উপায়ে জয়লাভ করেছিলো আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিবের দল নিয়ম ভঙ্গ করেছেন জেনেও সাথে সাথে তিনি কেনো নির্বাচন বন্ধ করেননি- এ ব্যাপারে প্রশ্ন করি তাকে।

জবাবে প্রেসিডেন্ট বলেন, উন্নত দেশগুলোসহ সব দেশের নির্বাচনেও অসাধু কাজ কারবার হয়। তবে আওয়ামী লীগের তৎপরতা সম্পর্কে সে সময় সঠিক তথ্য ছিলো না। পূর্ব পাকিস্তানের সঙখ্যালঘু হিন্দুদের ভোটেই প্রধানত জয়ী হয়েছিলো সে। মুসলিম ভোটারদের শতকরা বিশ ভাগের অধিক কেউ তার দলের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট দেয়নি। (৫)

‘পূর্ব পাকিস্তানের সঙখ্যালঘু হিন্দুদের ভোটেই প্রধানত জয়ী হয়েছিলো সে। মুসলিম ভোটারদের শতকরা বিশ ভাগের অধিক কেউ তার দলের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট দেয়নি।’– এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুকে একটি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অপ-তৎপরতা চালিয়েছিলো। কিন্তু বিষয়টি এমন যে- বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাড়ে সাত কোটি জনতার নেতা, বাঙালির নেতা। এ বিষয়টি নিয়ে নানাভাবে জল ঘোলা করার একটি প্রয়াস পরবর্তী সময়ে বাঙলাদেশে ঘটেছে। অনেকেই বলেছেন- বঙ্গবন্ধু ছিলেন হিন্দু-বিদ্বেষী, ইয়াহিয়া বলছে- হিন্দুরাই তাঁকে ভোট দিয়েছেন; এখন প্রশ্ন হচ্ছে- ইতিহাসের স্বচ্ছ আলোয় সত্য রূপটি যখন ধরা পড়ে, গোধূলীর কোলের রঙ তখন কী হয়?

এদিকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর থেকেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কোর্ট মার্শালের কথা বলে এসেছে। তখন একটি প্রশ্ন উঠেছিলো যে- আওয়ামী লীগ নেতার বিচার হলে এবঙ তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার আগেই তা কার্যকর করা হবে কি না। এর জবাবে ইয়াহিয়া সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো- বিষয়টি সামরিক বিচার বিভাগের হাতে এবঙ কবে বিচার শুরু হতে পারে তার সঠিক তারিখও বলতে পারেনি ইয়াহিয়া। এমনকি ইয়াহিয়া এমন বলে যে- মুজিবের কোর্ট মার্শাল হবে, অ্যাসেম্বলির অধিবেশন শুরু হওয়া পর্যন্ত সে জীবিত থাকবে কি না আমি তা-ও বলতে পারবো না। এদিকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার এবঙ মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও চলছে আন্তর্জাতিক নানা অঙ্গনে আলোচনা। ভারতে আশ্রয় নেয়া পূর্ব-পাকিস্তানি শরণার্থীদের বিষয়ে পাকিস্তান সরকারের মনোভাব জানা যায় ইয়াহিয়া খানের নিম্নোক্ত বিবৃতি থেকে-

আমি সকলকেই ফিরে আসার আহবান জানিয়েছি, কিন্তু এই আহবান ঘরছাড়া মানুষগুলোর কাছে পৌঁছেছে কি না আমি নিশ্চিত নই। আশি হাজার শরণার্থী ইতোমধ্যেই দেশে ফিরছে এবঙ প্রতিদিন ফিরছে প্রায় এক হাজার উদ্বাস্তু। উদ্বাস্তুদের দেশে ফেরা ঠেকাতে উঠে পড়ে লেগেছে ভারত। দেশটির এ ধরণের আচরণের কারণ হচ্ছে, ইন্দিরা গান্ধী এই ইস্যুটিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিশেবে ব্যবহার করছে।.. ..ভারত তার নিজস্ব ভূ-খণ্ডের ভেতরে গেরিলাদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবির খুলেছে। প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়েছে। পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে আশ্রয়হীন মানুষগুলোকে। (৬)

সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক একটি ‘নতুন তাসখন্দ’ গঠনের প্রস্তাবের সত্যতা সম্বন্ধে ইয়াহিয়া জানায়-

এ ব্যাপারে সরকারিভাবে কোনো তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যে কোনো স্থানে আমি বৈঠকে বসতে পারি, কিন্তু তারা আমাদের সবগুলো আলোচনা প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। তারা পাকিস্তান ভাঙার স্বপ্ন দেখছে এবঙ প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছে- ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানে নয়, শুধুমাত্র শেখ মুজিবের বাঙলাদেশেই ফিরে যাবে তারা (উদ্বাস্তুরা) (৭)

এদিকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার (পাকিস্তানদ্রোহিতার) অভিযোগসমূহের তদন্ত সমাপ্ত করে বিশেষ সামরিক ট্রাইবুন্যাল। সতেরো সেপ্টেম্বর উর্দূ ভাষায় লিখিত সরকার নিয়ন্ত্রিত ন্যাশনাল প্রেস ট্রাস্ট কর্তৃক পরিচালিত পত্রিকা ‘ইমরোজ’- এর রিপোর্টে জানা যায়-

নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিগত মার্চের পঁচিশ তারিখ আর্মি ক্র্যাকডাউনের পর হতে বন্দী রয়েছেন। শেখ মুজিবকে বিশেষভাবে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে এবঙ তা দিচ্ছে একজন সরকারি ডাক্তার যিনি প্রতিদিন তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন। শেখ মুজিবকে দুজন এটেন্ডেন্ট দেয়া হয়েছে এবঙ সকল জাতীয় পত্রিকা তাকে সরবরাহ করা হচ্ছে।

এ রিপোর্টে দুটো মিথ্যাভাষ্য আছে। একটি হলো- প্রতিদিন তো স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হতোই না, উপরন্তু একটি বদ্ধ ঘরে রাখা হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুকে এবঙ এতে তাঁর শারীরিক সমস্যাও হয়, যা সামরিক সরকার দায়সারাভাবে সমাধান করে। দুই- তাঁকে কোনো পত্রিকা সরবরাহ করা হয়নি, এমনকি বঙ্গবন্ধু কোনো সঙবাদ জানতে চাইলে তাঁকে নানাভাবে তিরস্কারও করা হয়েছে। (৮)

বাইশে সেপ্টেম্বর পাকিস্তান তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন- এখনো শেখ মুজিবের বিচার কাজ চলছে। শেখ মুজিবের বিচার সম্বন্ধে এটাই হলো প্রথম সরকারি মন্তব্য। তিনি বলেছেন-

বিচার কাজ চলছে ব্রিটিশ বোর্ডের কার্যবিধি অনুয়ায়ী। সেজন্য বিচারকার্য প্রক্রিয়াগত কারণে মুলতবী হচ্ছে। মুখপাত্র বলেন- বিচার কোন পর্যায়ে রয়েছে তা তিনি বলতে পারছেন না। বিচারের কোথায় হচ্ছে সে সম্পর্কেও জানা যায়নি। কিন্তু পশ্চিম পাঞ্জাবের লায়ালপুরে আগস্ট থেকে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। মুজিবুর রহমানের জাতীয় সঙসদের সদস্যপদ বহাল রাখা হয়েছে। পূর্ব বাঙলায় নভেম্বর ও ডিসেম্বরে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সেক্ষেত্রে তাঁর আসনটি উপ-নির্বাচনের জন্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। (৯)

সৌজন্যে: জেস্টর ইকোনোমিক এণ্ড পলিটিক্যাল উইকলি

হ্যারি ডাব্লিউ ব্লেয়ারের প্রতিবেদনের একাঙশ (সৌজন্যে: জেস্টর ইকোনোমিক এণ্ড পলিটিক্যাল উইকলি)

২৮ সেপ্টেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের প্রেস নোটে উল্লেখ করা হয়-

পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা ঘোষণার জন্য পাকিস্তানের সামরিক প্রধান আইন প্রশাসক শেখ মুজিবের গোপন বিচারের জন্যে বিশেষ মিলিটারি বোর্ড গঠন করেছেন।

১১ আগস্ট ৭১ থেকে বিচার আরম্ভ হয়। কোর্ট ঐ দিনই মুলতবী হয় যাতে শেখ মুজিবের বিচার সুষ্ঠু ও আইনানুগ হয় যেক্ষেত্রে শেখ মুজিব নিজের মতো করে ডিফেন্স কাউন্সিল নিয়োগ করতে পারেন।

৭ সেপ্টেম্বর ৭১ এ. কে. ব্রোহি এবঙ তিনজন সহকারি মোহাম্মদ গোলাম আলী মেনন, আকবর মীর্জা এবঙ গোলাম হোসেনকে নিয়োগ দেয়া হয় এবঙ সাক্ষীগণের জেরা শুরু হয়। প্রসিকিউশন এ পর্যন্ত ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে যা দ্বারা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রুজু করা অভিযোগ প্রমাণিত হয়। শেখ মুজিবের পক্ষে এ. কে. ব্রোহি আইনজীবী হিশেবে যোগদান করেন। যথাসময়ে জনগণকে এ বিচার সম্বন্ধে জানানো হবে এবঙ বিচারের অগ্রগতি সম্বন্ধেও জানানো হবে।

জনসাধারণকে স্বীয় আগ্রহে এ বিচার সম্বন্ধে কোনো প্রকার মন্তব্য, গুজব বা গোপনীয়তা ভঙ্গ না হয় তার জন্যে জনগণকে বিরত থাকতে বলা হয়- যাতে বিচার কাজ বা মানসিকতা যা বিচার কার্যে ক্ষতি করতে না পারে। (১০)

শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়াও বঙ্গবন্ধুর এই বিচার প্রক্রিয়াটিকে একটি ক্যামেরা ট্রায়াল হিশেবে ঘোষণা করেন। ল’মন্ডে পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া বলে-

.. .. তার (শেখ মুজিব) জন্য একজন ভালো আইনজীবী নিয়োগের ব্যাপারে আমি আগ্রহী। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সঙহতি যেখানে জড়িত সেখানে ক্যামেরা ট্রায়াল অভাবিত কিছু নয়। যখন ট্রায়াল শেষ হবে এবঙ পারিপার্শ্বিকতা অনুকূল প্রতিয়মান হবে তখন নিকট ভবিষ্যতে এর পূর্ণাঙ্গ বিবরণ আমি প্রকাশ করবো।

পনেরোই সেপ্টেম্বর, উনিশ শো একাত্তর সালে পাকিস্তানের সামরিক ডিটেক্টর ইয়াহিয়া বিগত পাঁচ মাসের নীরবতা ভঙ্গ করে কথা বলা শুরু করে- যদিও সেগুলো মিথ্যে কথা। সে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমকে জানায় যে- পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগে শেখ মুজিবের বিচার কাজের জন্য ক্যাঙ্গারু কোর্ট গঠন করা হয়েছে। এখানে একটি প্রশ্ন উঠেছিলো- যদি ইয়াহিয়া আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, তবে কেনো সে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছে অনুযায়ী আইনজীবী দিচ্ছে না। পৃথিবীর যে কোনো অঙশ থেকে কেনো আইনজীবী নিয়োগ দিতে দিচ্ছে না, এটা কি ন্যায় বিচারের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নয়? আইনে একজন সাধারণ নাগরিকও মৌলিক অধিকারবলে একজন যথোপযুক্ত আইনজীবী পেতে পারেন- তবে শেখ মুজিব কেনো পাচ্ছেন না? এটা কি ন্যায় বিচারের সঙ্গে প্রহসন নয়?

আলোচনার এ পর্যায়ে পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রসঙ্গে কিছু মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। সেগুলো হলো- বঙ্গবন্ধু কখন যুদ্ধ ঘোষণা করেন? সমগ্র দেশবাসী যথাযথভাবেই অবগত ছিলেন যে- ১৯৭০ এর ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে তিনশত আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেন- যার ভিত্তি ছিলো ছয় দফা কর্মসূচী। এখন এই ছয়দফা কর্মসূচীকে কি সামরিক কর্তৃপক্ষ নির্বাচন-পূর্ব বা নির্বাচন-উত্তর সময়ে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন? পক্ষান্তরে জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছিলো- ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রে ছয়দফাকে কেনো একোমডেট করা যাবে না? আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জেনারেল ইয়াহিয়া একাত্তর সালের চৌদ্দ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী হিশেবে উল্লেখ করে। এমন কি ঘটনা ঘটলো এই অবস্থার বিপরীতে শেখ মুজিবুর রহমানকে রাতারাতি পাকিস্তানের শত্রু বানানো হলো? এ অবস্থায় ডিগবাজী ও স্বেচ্ছাচারিভাবে ইয়াহিয়া খান পহেলা মার্চ আহূত জাতীয় সঙসদের বৈঠক স্থগিত ঘোষণা করে। তাকে জাতীয় সঙসদ অধিবেশন স্থগিত করার অধিকার কে দিলো? রাজনৈতিকভাবে বা আইনানুগভাবে কে তাকে স্বৈরাচারি একটি অবস্থানের অনুমোদন দিয়েছিলো? অথবা জনগনের বা জনমতের রায় কি এর পক্ষে ছিলো? ইয়াহিয়া খানের পহেলা মার্চ সঙসদ অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণাই ছিলো পাকিস্তান সঙ্কটের অন্তর্নিহিত কারণ। ঘটনা প্রবাহকে আরও ভয়ানক করে তোলার লক্ষ্যে সে পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস-এডমির‌্যাল এস.এম. আহসানকে সরিয়ে পাঞ্জাবের কসাই টিক্কা খানকে গর্ভনর পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ত্রিশ-আশি হাজার সৈন্য বাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়। সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিতে জনগণকে ভীতিগ্রস্থ করে তোলেছিলো। বিমানে আনা সেনাবাহিনীর আগমনের উদ্দেশ্য কি সে সম্পর্কে ভীতিপ্রদ গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো। সকল ধরণের নির্দেশনা প্রমাণ করে যে, একটি নিষ্ঠুর আক্রমণ আসন্ন। সামরিক বাহিনীর উপর আস্থাহীনতা ও তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে জনগণ সর্বত্র সম্পূর্ণভাবে দোসরা মার্চ থেকে জঙ্গী বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ঢাকা, চট্টগ্রামে সামরিক বাহিনী নিষ্ঠুরভাবে কমপক্ষে কয়েকশত লোককে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু যখন এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানান এবঙ বিক্ষুব্ধ জনগণ যখন সারা দেশব্যাপী আক্ষেপে ফেটে পড়েছিলো- তখনও বঙ্গবন্ধু উগ্রপন্থী কর্মসূচী গ্রহণ করেননি। তিনি অবিলম্বে জাতীয় সঙসদ অধিবেশন ডাকার আহবান জানান। পূর্ব পাকিস্তানের সকল রাষ্ট্রযন্ত্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী শ্রেণি বঙ্গবন্ধু নির্দেশমতো পরিচালিত হচ্ছিলো। ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণে তিনি জাতির জন্যে দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। অবস্থার প্রেক্ষিতে ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে ঢাকায় আসেন। প্রশ্ন হচ্ছে- তখন পর্যন্ত ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর অসহোযোগ আন্দোলনকে অবৈধ ঘোষণা করেনি, তাহলে পঁচিশে মার্চে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করাটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- বিশ্ববাসী যে বিষয়টিতে আকর্ষণবোধ করেছিলেন, তা হলো বঙ্গবন্ধু জনগণের ঐক্যবদ্ধ সহযোগিতায় পঁচিশে মার্চ, উনিশ শো একাত্তর পর্যন্ত ডি-ফ্যাক্ট গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইয়াহিয়া শাসনতান্ত্রিক আলোচনার অন্তরালে ভয়ঙ্কর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ব্যস্ত ছিলেন শাসনতান্ত্রিক বিষয় চূড়ান্তকরণে। হঠাৎ করেই জানোয়ার ইয়াহিয়া পঁচিশে মার্চে আলোচনা ভেঙে দেয়। কোনো কথা না বলে ঢাকা ত্যাগ করে এবঙ আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে জেনারেল টিক্কা খানের হাতে বাঙালি নিধনের ফরমান ধরিয়ে দিয়ে যায়। সকল বিদেশি সাঙবাদিকদের আটকে রাখা হয়।

ইতিহাসের ঘটনা যদি এই হয়- তবে কীভাবে ইয়াহিয়া সেদিন দাবি করে, ‘বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলো’? একাত্তরের মার্চ পর্যন্ত কী ঘটেছিলো, তা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। জনগণের গণতান্ত্রিক অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে সার্বিক সামরিক আক্রমণ পরিচালনা করে পাকিস্তানি হায়নারা। বস্তুত অপরাধ করে পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী, তারাই নিরীহ বাঙালির উপর পৈশাচিক আক্রমণ চালায়।

টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন

টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন

এদিকে পঁচিশে মার্চের গণহত্যার পক্ষে ইয়াহিয়াকে সাফাই গাইতে শোনা যায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। চব্বিশ মে, উনিশ শো একাত্তর সালে করাচিতে সাঙবাদিক সম্মেলনে জেনারেল ইয়াহিয়া বলে-

ছাব্বিশে মার্চ সামরিক বাহিনী অ্যাকশনে না গেলে আমাদের গ্রেফতার করা হতো। … … পাকিস্তান সরকার যেরূপ যথাযথ মনে করবে তার (শেখ মুজিব) বিষয়ে সে ধরণের সিদ্ধান্তই নেবে। ছয় দফা ছিলো পাকিস্তান কনসেপ্ট এর বিরুদ্ধে, সুতরাঙ আমার সেনাবাহিনী একে প্রতিহত করবেই। কারণ আমি মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করে দেখেছি। পাকিস্তানের অখণ্ডতার বাইরে বাঙলাদেশের অস্তিত্ব কোনো দিনই তিনি মেনে নেবেন না। আমি তাকে প্রধানমন্ত্রীর মতো বড়ো পদ অফার করেছিলাম। কিন্তু তিনি উৎসাহিত ছিলেন না। শেখ মুজিব দুটো অ্যাসেম্বলি, দুটো শাসনতন্ত্র এবঙ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব করেছিলেন, যাতে তিনি পূর্বাঙশ আইনানুগভাবে পৃথক করতে পারেন। (১১)

বঙ্গবন্ধুকে কেনো গ্রেফতার করা হলো- এ প্রশ্নের একটি উত্তর ইয়াহিয়া খানই দিয়ে গেছে। জাতির উদ্দেশে দেয়া এক বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া বলে-

পনেরো মার্চ থেকে পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত আমি শেখ মুজিব এবঙ তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে ঢাকায় বহুবার বৈঠকে মিলিত হয়েছি। যখন তিনি আমাদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন তার অন্তরালে মুজিব ও তার অনুসারীরা গোপনীয়ভাবে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পাকিস্তান ভেঙে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আলোচনার শেষ পর্যায়ে পরিস্কার হয়ে গেলো যে, মুজিবুর রহমান এবঙ তাঁর উপদেষ্টাগণ এক পাকিস্তানের ভিত্তিতে আলোচনা চাচ্ছিলেন না বরঙ আমার কাছ থেকে যে কোনোভাবে একটি ‘প্রক্লেমেশন’ চাচ্ছিলেন যার দ্বারা জাতীয় সঙসদকে দুটো গণ-পরিষদে বিভক্ত করা যায়, একটি কনফেডারেশন জন্ম দেয়া যায় এবঙ সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে সম্পূর্ণভাবে দেশকে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যায়। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে তিনি আশা করেছিলেন একটি পৃথক রাষ্ট্র বাঙলাদেশের সৃষ্টি করা। এভাবে তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা ধ্বঙস করতে চেয়েছিলেন। (১২)

একই ধরণের বক্তব্য পাকিস্তান টেলিভিশনের সঙ্গে দেয়া এক সাক্ষাৎকারেও দিয়ে থাকে ইয়াহিয়া খান। এটি পাঁচ আগস্ট, উনিশ শো একাত্তরের ঘটনা। সেখানে ইয়াহিয়া বলে-

রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবঙ দেশের আইনানুযায়ী তার বিচার কার্য চলবে। শেখ মুজিব প্রকাশ্যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মাধ্যমে বিদ্রোহাত্মক কর্মকা- পরিচালনা করে আসছে। এটা ঠিক যে, রাজনৈতিকভাবে অখ- পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসার উচ্চাশা তাঁর ছিলো না। (১৩)

বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী একটি আলোচনার সৃষ্টি হয়, এবঙ এটিও বোধগম্য যে- বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঙলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে তাঁর আপোষহীন অবস্থানের জন্যে। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী একদিকে নির্মম গণহত্যা ও অত্যাচারের মাধ্যমে বাঙালিকে নিয়ে যেতে থাকে পীড়নের শেষপ্রান্তে, অন্যদিকে তারা গ্রেফতার করে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে দাঁড় করায় বিচারের কাঠগড়ায়। এ প্রেক্ষিতে তারা যে বক্তব্যগুলো দেয়, তার পুরোটাই ছিলো মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যে ঠাসা। বিশ্ব গণমাধ্যমকে তারা নানা মিথ্যাচারে বিভ্রান্ত করে তুলতে চায়, এ বিষয়ে ব্যবহার করে সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমকে। কিন্তু বিশ্ব গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর প্রহসনমূলক বিচার, প্রহসন হিশেবেই ঠাঁই পায়। বিশ্ব গণমাধ্যমের প্রতিক্রিয়াগুলো তুলে ধরার প্রয়াস থাকবে আগামী পর্বে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই দুর্বহ নির্যাতন-নিপীড়ন আর বর্বরতার মাঝেই নির্মিত হতে থাকে একাত্তরের ইতিহাস- স্বাধীনতার জন্যে বাঙালি লড়াই করতে থাকে, সাতকোটি বিপন্ন কোকিলের কণ্ঠে ধরা পড়ে মিছিলের ভাষ্য, মৃত্যু হয়ে ওঠে জীবনের ঐশ্বর্য।

তথ্যসূত্র

১। Trial and sentencing of Mujib, আমেরিকান পেপার্স, রোয়েদাদ খান সম্পাদিত, পৃষ্ঠা: ৬৮৪
২। বাঙলাদেশ ডকুমেন্টস, ভলিউম-২, পৃষ্ঠা: ২১-২৫
৩। ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল, মিজানুর রহমান খান, সময় প্রকাশন, পৃষ্ঠা: ১০৪
৪। ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল, মিজানুর রহমান খান, সময় প্রকাশন, পৃষ্ঠা: ১০৫
৫। আমির তাহেরির প্রতিবেদন, সূত্র: কাইহান ইন্টারন্যাশনাল, ৩০ জুলাই, ১৯৭১।
৬। প্রাগুক্ত
৭। প্রাগুক্ত
৮। পাকিস্তানের মৃত্যু যন্ত্রণা, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ
৯। বাঙলাদেশ ডকুমেন্টস, ভলিউম-২, পৃষ্ঠা: ৩৩
১০। The Dawn, Karachi, 2 September, 1971
১১। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৬৪-৬৯
১২। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৮৬
১৩। The Dawn, Karachi, 5 August, 1971

১৬ ভাদ্র, ১৪১৯