ক.
ছয়মন বানুকে মহল্লা ছাড়া করার সাত দিন হতে না হতেই গ্রামের উত্তর দিকের শেষ ঘরটিতে প্রথম কে যেন বলল,
সফেলা বেশ্যা। আমি নিজ কানে শুনে এলাম।
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে মহল্লার সকলে বলল,
সফেলা বেশ্যা।
মাসখানেকের মধ্যে গ্রামের সকলে জানলো,
সফেলা বেশ্যা।
গ্রামের প্রতিটা ঘরে ঘরে, মোড়ে মোড়ে, দোকানে দোকানে আলোচনা হচ্ছে,
সফেলা বেশ্যা।
আলোচনার সুবিধার্থে, গ্রামের মোড়ে মোড়ে মাচান বসানো হয়েছে। পুকুরে স্নান করতে গিয়ে মহিলাদের বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যাচেছ প্রতিদিনই। সদ্য স্কুলে পা দেওয়া ছেলে মেয়েরাও তাদের স্বভাবজাত আড্ডা ছেড়ে মেতে উঠেছে,
সফেলা বেশ্যা।

খ.
গ্রামের মহিলারা দলে দলে জমায়েত হচ্ছে। তাদের এখন নাওয়া-খাওয়া কোন কিছুই ঠিক মতো হচ্ছে না। স্বামীর দিকে নজর রাখতে রাখতে বেশির ভাগই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। পুরুষদের জন্যে বাড়িতে এখন ১৪৪-ধারা জারি করা হয়েছে, সূর্যের আগে ফিরতে হবে ঘরে!
সকলের মধ্যে থেকে প্রথম কথা বলে মাঝবয়সী এক মহিলা,
আমার মরদের ঈদ লাগছে, সবসময় গুনগুনিয়ে সিনেমার গীত গায়।
আরেকজন বলে,
আমার ভাতার কাজের বাহানাতে বাড়িতে ঢুকতিই চায় না।
সব থেকে রুগ্ন গড়নের মহিলাটি বলে,
আমার স্বুয়ামী তো সারা রাত বিছানায় ইশপিশ করে। ঠিক মতো খাওন-দাওন করে না। মনে হয় ঐ মাগির ভুতে ধরছে।
সকলের মধ্যে থেকে স্বাস্থ্যবতী মহিলাটি বলে,
গ্রামের সব পুরুষদেরই এখন একই অবস্থা।
সবথেকে বয়স্কজন বলে ওঠে,
হবে না! মিনসেদের কি দোষ, বল তুরা? হুনছি, ঐ মাগির গতর থেকি রস নাকি চুয়ি চুয়ি পড়ে! মধু যেকিনে থাকবি, মাছি তো সেকিনে ভন ভন করবিই। তাই তোগো মরদগেরে বেশি চাপাচাপি না করি ঐ খানকিরে আগে গ্রাম ছাড়নের ব্যবস্থা কর।
একজন মহিলা তার পাশের জনকে টিটকিরি মেরে বলে,
আমার দেবর বলছিল, তোর ভাতার নাকি আজকাল ঐ মাগির বাড়ির আশেপাশে খুব ঘুর ঘুর করে?
মহিলা ক্ষেপে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
এই, আমার কুদ্দুসের বাপেরে নি’ একটাও আজেবাজে কথা কবিনা কইলাম! কেনে, তুই আর তোর দেবরের ফস্টিনস্টির ঘটনাটা মনে হয় আমরা জানি নে?
বয়স্ক মহিলাটা সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
এই নিজেদের গায়ে কাদা ছুড়াছুড়ি বন্ধ কর তুরা। আগে মাগির স্যাটায় আগুন লাগা, তারপর তুরা যত ইচ্ছা খিস্তি কর।

গ.
গ্রামের সকলে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মেম্বার বাড়ির বৈঠকখানায় পঞ্চায়েত ডাকা হল। মিটিং শেষে মসজিদের মাইকে ঘোষণা করা হল,
আগামীকাল বাদ-জুম্মা, গ্রামের সকল মুমিন ভাইদের ঈদগার ময়দানে উপস্থিত থাকার জন্যে বলা হচ্ছে। ইমাম সাহেব ইসলামী শরিয়া আইন মোতাবেক বেশ্যা সফেলার, নাউজুবিল্লাহ, আস্তগ্ফিরুল্লাহ, বিচার করবেন।
পরদিন, যথারীতি জুম্মার নামাযের পর গ্রামের সকলে দলে দলে যথাস্থানে জমায়েত হল। এ পর্যন্ত কোনো ঈদে এত মানুষ এ ময়দানে জমায়েত হয়নি। ইমাম সাহেব তার বয়ান শুরু করলেন,
প্রিয় মুমিন ভাইয়েরা আমার, আমরা সকলে পবিত্র জুম্মার পর ওজু সমেত এই ঈদগাহে হাজির হয়েছি একটা নেক মকছেদ পূরণ করার জন্যে। গ্রামে আল্লাহর গজব নাজিল হয়েছে। আপনাদের দান খয়রাতের হাত দিনে দিনে ছোট হয়ে যাচ্ছে, তাই এই গজব। আজ আমরা একত্রিত হয়েছি, এক বেগানা মহিলার বিচার করার জন্যে। ঐ নাপাক মহিলার নাম আজ মুখে নেয়াও পাপ। আল্লাহর পাক কালামে আছে, মহিলারা জ্যান্ত শয়তান, তারা মানব জাতিকে ধ্বংসের দিকে টানে! এজন্যই তাদেরকে টাইটের মধ্যে রাখার নির্দেশ আছে।
এখন বলেন, আপনারা সকলে কি ঐ বেগানা মহিলার পাপ কর্ম সম্পর্কে অবগত আছেন? থাকলে আওয়াজ তোলেন।
সকলে উচ্চস্বরে বলে ওঠে,
হ্যঁা হুজুর, আছি।
হঠাৎ এত জোরে শব্দ হওয়াতে আশেপাশের গাছপালা থেকে পাখিরা সব ঝটপট করে যে যার মতো রুদ্ধশ্বাসে উড়ে যায়।
আপনারা কি আল্লাহর পাক কালাম বুকে নিয়ে সাক্ষি দিতে পারবেন? পারলে আওয়াজ তোলেন।
আবার প্রচন্ড শব্দে কেঁপে উঠল মাটি।
কিছুক্ষণ কি যেন ভেবে নিয়ে হুজুর আবারো বললেন,
এখানে আজ গ্রামের সকলে উপস্থিত আছেন। কারা কারা ঐ বেগানা মহিলার কাছে গিয়ে নাপাক হয়েছেন, আওয়াজ তোলেন।
এবার আর কোন শব্দ হল না। যে কাশছিল, সে তড়িঘড়ি করে কাশি বন্ধ করে ফেলল। যারা ফিসফাস করছিল তারাও মুখ এঁটে রইল। কিছুক্ষণের জন্যে জনশূন্য হয়ে পড়ল সমস্ত মাঠ।
যদি কেউ থেকে থাকেন, আপনারা মসজিদে কিছু টাকা অথবা ফসল দিয়ে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবেন। ঐ বেগানা মহিলার শাস্তি হওয়ার দরকার। চরম শাস্তি, যা দেখে দ্বিতীয়বার কেউ এ-পথে পা বাড়ানোর সাহস পাবে না। আপনারা কি বলেন?
আবারো ভীষণ শব্দ বিস্ফোরণে ফেটে পড়ল মাঠ।
শরিয়া আইন মোতাবেক, কাল স্কুল ময়দানে ঐ বেগানা মহিলার গায়ে একশবার দোর্রা মারা হবে। আপনারা কি বলেন?
শেষবারের মতন শব্দ বিস্ফোরণে ফেটে পড়ল চারপাশ।

পরদিন, বাদ আছর, স্কুল ময়দানে সমস্ত গ্রামবাসীর সামনে সফেলাকে বেত্রাঘাত করা হল। গ্রামের মেম্বার, হেড মাস্টার, ইমাম, চোর, বাটপার সকলে পালাক্রমে দোর্রা মারলো। মহিলারা ঘেন্নায় স্যান্ডেল ছুড়ে মারলো। মাঝপথে সফেলা নিশ্চুপ হয়ে পড়লো, তবুও ডোজ কমপ্লিট করা হল। সূর্য ওঠার আগেই ভৈরব ঘাটে পুঁতে ফেলা হল সফেলার দেহ।

ঘ.
সফেলার এক মাস যেতে না যেতেই, গ্রামের দক্ষিণ দিকের শেষ বাড়িটাতে কে যেন প্রথম বলল,
আকলির মা বেশ্যা। আমি নিজ কানে শুনেছি।
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে মহল্লার সকলে বলল,
আকলির মা বেশ্যা।
মাসখানেকের মধ্যে গ্রামের সকলে জানল,
আকলির মা বেশ্যা।
এখন গ্রামের প্রতিটা ঘরে ঘরে, প্রতিটা মোড়ে মোড়ে, দোকানে দোকানে আলোচনা হচ্ছে,
আকলির মা বেশ্যা।

**গল্পটি কিছুটা এডিট করে আবারও পোস্ট আকারে দিলাম।