ভারতের অন্যতম বৃহত্তম প্রদেশ রাজস্থান। ছোট বড় অসংখ্য পাথুরে শক্ত পাহাড়ের গিরিখাতে ভরা দূর্ভেদ্য প্রাচীর আরাবল্লী পর্বতশ্রেণী প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ স্থান জুড়ে পশ্চিম ভারতের উপর দিয়ে উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম পর্যন্ত হরিয়ানা, রাজস্থান ও গুজরাট রাজ্যের মধ্যে দিয়ে প্রবাহমান। ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি ত্বত্তের পাহারা প্রাচীর হয়ে এই পর্বতশ্রেণী হিন্দু শাসিত ভারত থেকে চ্ছিন্ন করেছে মুসলিম রাজ্য পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশ। এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম “গুরু শিখর”, আরাবল্লী শব্দটির অর্থ ‘শৃঙ্গশ্রেণী’ অর্থাৎ অনেক গুলো পর্বত শৃঙ্গের সারি বাধা সন্নিবেশ। রাজস্থানের বিস্তৃর্ন জায়গা আত্মসাৎ করে আছে প্রচন্ড উষ্ণতা ও রাশি রাশি বালুকাণায় পূর্ণ বিরস “থর মরুভূমি”, এই রাজস্থানের ৫ম বৃহত্তম শহর আজমির।
৭ম শতাব্দিতে চৌহান বংশের রাজা অজয়ামেরু চৌহান রাজস্থানের প্রতিষ্ঠিতা।
সভ্যজাতি বিনির্মানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান, অমূল্য কোন খনিজ দ্রব্যের সুলভ খনি, শিক্ষা-সভ্যতা উৎকর্ষতার ঊষালগ্নের ভিত্তিভূমি, ক্রমপ্রসারমান বিজ্ঞানের চৌরাস পথ বেয়ে যাত্রা, কোন নতুন শিল্প সূচনার অগ্রনায়ক কিংবা নয় কোন প্রাকৃতিক মনোহরি রূপ লাবণ্যের দূর্বার আকর্ষণের হাতছানি, এই আজমির প্রসিদ্ধ হয়েছে ঊর্বশী ধর্ম যুগে অভাব কুঞ্জ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দখলদার সম্পদলোভী শাসকদের আগ্রাসী লোভ লালসার প্রত্যক্ষ সুফল ভোগ করা সুফী মঈনুউদ্দিন চিস্তির বদৌলতে।
চিস্তির জন্ম ১১৪১ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীণ পারস্যের তথা ইরানের সিজিস্তানের সঞ্জর নামক স্থানে। তাঁর পিতার নাম খাজা গিয়াসুদ্দীন আর মায়ের নাম মাহ্নূর। তাঁর প্রকৃত নাম মঈনুদ্দিন হাসান। কথিত আছে তিনি ছিলেন ইসলামের বিখ্যাত আলোচিত সমালোচিত সৈয়দ বংশের সন্তান(আলী ও স্ত্রী ফাতেমার বংশ সৈয়দ বংশ নামে খ্যাত। সম্পর্কে আলী নবীর চাচাত ভাই আর ফাতেমা নবীর মেয়ে)। জনশ্রুতি আছে চিস্তির পিতৃকুল এসেছে নবীর এক নাতি ইমাম হুসাইন এবং মাতৃকুল এসেছে আরেক নাতি ইমাম হাসানের বংশের হাত ধরে। ৬ষ্ঠ শতকের গোড়াতে মক্কা মদিনায় ক্ষমতা পালা বদলের মঞ্চে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রবল দাপটশালী আলী ফাতেমার বংশ প্রায় ৪০০ বছর পরে ১১দশ শতাব্দীতে ইরানের সীমান্ত প্রদেশে খুজে পাওয়ার দাবি কিছুটা সন্দেহের বাতাবরণ তৈরী করে বৈকি!
চিস্তির শৈশব কাটে ইরানে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। কৈশোরে প্রাপ্ত হন পিতার রেখে যাওয়া সম্পদ, একটি ফলের বাগান ও একটি বায়ু চালিত কল। ততদিনে পারস্যে(ইরান) তথা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীণ সংষ্কৃতি, বিশ্বাস ঝেটিয়ে বিদেয় করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে ইসলাম। ইসলামী আগ্রাসনের পূর্বে পারস্যের জনগণ ছিল স্বর্গ-নরক, এক ঈশ্বরবাদের সূচনাকারী ধর্ম জরাথ্রুষ্ট, মতবাদে বিশ্বাসী। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের সহবস্থান ছিল পারস্যে। ওমর ২য় খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর বদলে ফেলেন মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় মানচিত্র। পুরাতন সব ধর্ম বিশ্বাস পাল্টিয়ে উপহার দেন ইসলাম। এর জন্য অবশ্য খরচ হয়েছে প্রচুর রক্ত। রক্তে রঞ্জিত করতে হয়েছে অসংখ্য মরু জনপদ। মাত্র ১০ বছরের শাসনামলে ১২টি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পরেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল গণিমতের মাল সংগ্রহ, জিজিয়া কর আদায় সাথে ইসলাম বিস্তার। ইরান বাদ পড়েনি ওমরের আগ্রাসন থাকে। পুরানো বিশ্বাস গুড়িয়ে দিয়ে ওমর ইরানে প্রতিথ করেন নব্য ধর্ম ইসলাম বিশ্বাসের সংষ্কৃতি।
ইষ্টার্ন ইরান বর্তমান আফগানিস্তান সেসময় গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল ছিল মধ্যপ্রাচ্যের সাথে ভারতীয় ব্যবসা বাণিজ্যের। মুসলমান শাসকদের করায়ত্ব হয়নি তখনো আফগানিস্তান, ফলে ধর্ম বিশ্বাসে আফগানরা আরো কিছুদিন বৌদ্ধরীতি পালনের সুযোগ পেয়ে যায়। সেই সূত্রে আঞ্চলিক নৈকট্যের স্বভাব সিদ্ধ ধারায় ভারতীয় ধর্মীয় দর্শনের শান্ত সৌম্য বৈরাগ্য ভাবধারার আংশিক ছটা সন্তঃর্পনে অনুপ্রবেশ করে ইসলাম অধ্যুষিত ইরানে। উদ্ভব ঘটায় বৌদ্ধ ভিক্ষু শ্রেণী বা হিন্দু মুনি ঋষির আদলে পশমী পোশাক পরা একদল সংসার-অনাসক্ত আল্লাহভক্ত নতুন শ্রেণীর। এদের নাম হয় সুফি। অনেকের ধারণা আরবি শব্দ ‘সাফা’ অর্থাৎ পবিত্রতা থেকে “সুফি” শব্দটি এসেছে। আবার কেউ কেউ মত দেন ‘সুফ’ বা শ্রেণী হতেও সুফি শব্দ উৎপত্তি হতে পারে। তবে গ্রহণযোগ্য ব্যখ্যাটি দেন অধ্যাপক গিব ইবনে সিরিন। তিনি দেখিয়েছেন ইসলামের এই ধর্মীয় সাধকগণ একধরণের রঙিন পশমী বস্ত্র পরতেন যেমনটি ব্যবহার করতেন খ্রিষ্টানধর্মীয় সাধকরাও। এই কাপড়ের নাম ‘সুফ’ বা সউফ। এর থেকেই সুফি শব্দটির উৎপত্তি। সুফি শব্দের উৎপত্তি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মৃদু মতান্তর থাকলেও তাঁরা এক বাক্যে স্বীকার করেন- ভোগ বিলাসীতা পরিত্যাগ করে পশমী বস্ত্র পরিধান করে সংসারের কোলাহলতা থেকে দূরে গিয়ে নির্জনতায় জিকিরের মাধ্যমে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই সুফি দর্শনের মূল লক্ষ্য।
নবী ও স্রষ্টার উপর পূর্ণ বিশ্বাস যেখানে ইসলামের শেষ কথা সেখানে বিধর্মী(কাফের) প্রভাবে দুষ্ট সন্ন্যাস আদলে গড়ে উঠা সুফি চর্চা ঠিক কতখানি ইসলাম সম্মত তা যথেষ্ট তর্ক সাপেক্ষ। ইসলামের আতুরঘর মক্কা মদিনার ইতিহাসে একটু ঢু মারলে দেখব সেখানে এসব সুফী, পীর, দরবেশ শ্রেণীর কখনো উৎপত্তি ঘটেনি। সুফি দর্শন তাই প্রকৃত ইসলামের সাথে যতই সাংঘার্ষিক মনে হোক না কেন এ কথা স্বীকার করতেই হবে পরবর্তীতে এই সুফি শ্রেণী ইসলাম প্রচারে এনে দেয় নতুন মাত্রা। উদ্ভব ঘটে পীর, ফকির, দরবেশ নামে বাহ্যিক দৃষ্টিতে আপাত নিরীহ গোচের আরো কিছু ধর্ম প্রচারক শ্রেনীর। যাদের কাঁধে ভর দিয়ে পরমত অসহিষ্ণু, স্বয়ং সর্বশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হতে চেষ্টা করে কিছুটা সৌম্য সুস্থির ভদ্রস্থ চেহারায় আধ্যাত্মিকতার নতুন খোলসে। এসব শ্রেণীর উত্থানেই ইসলাম অনুসারীরা পেয়ে যায় বর্ম অস্ত্র, দাবি করার সুযোগ পায়- “তরবারির জোরে ইসলাম প্রচার হয়নি”।
ধীরে ধীরে এসব সুফি-দরবেশ, সুফি ঘরনার কবি-সাহিত্যিক এবং কিছু ইসলামী পণ্ডিত ধর্মের নানান ব্যখ্যা করে আর বাউলরা কাব্য, গীত গেয়ে এই সুফি দর্শনকে অনুসারীদের মাঝে জনপ্রিয় করে তুলতে সমর্থ হন।
একদিন এমন এক পথচারি ক্লান্ত ক্ষুধার্ত সুফি শায়খ ইব্রাহিম কুন্দুযীর সাথে সাক্ষাত ঘটে কিশোর চিস্তির। তিনি তখন ব্যস্ত বাগানের কাজে। সুফিকে দেখতে পেয়ে হাতের কাজ ফেলে চিস্তি আলাপচারিতায় মেতে উঠেন। খেতে দেন কিছু ফল মূল। সুফির আধ্যাত্মিক কথাবার্তায় কিশোর চিস্তি মুগ্ধতার আবেশে বিগলিত হয়ে পড়েন। তাঁর মনে ধর্মভাব জাগ্রত হয়ে উঠে। মনস্থির করেন তিনিও পরম করুণাময় রূপে প্রচারিত আল্লাহর নৈকট্য আসবেন।
মধ্যশতাব্দী গুলোতে ভরা জোয়ারে ধর্ম অবগাহনে প্রত্যেক ধর্মীয় গুরুদের সন্মান ও প্রতিপত্তি ছিল ঈর্ষনীয়। জায়গা সম্পদ বিক্রি করে চিস্তি অচিরেই যোগ দেন ধর্মগুরুদের সেই দলে।
৮ম শতকের শুরুতেই উজবেকিস্তানের প্রাচীন গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সমরখন্দ ও বোখারা নগর দুটি মুসলমান দখলে আসার পর ইসলাম প্রসারে সেখনে তৈরী করা হয় বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসা। কয়েক শতকের ব্যবধানে সমরখন্দ ও বোখারা পরিনত হয় ইসলামী শিক্ষা সংষ্কৃতি বিকাশের সেরা বিদ্যাপীঠের আসরে। মঈনুদ্দিনের যাত্রা ছিল তাই বোখারা অভিমুখে। এসেই পেয়ে যান তাঁরই স্বদেশী সুফি বাবা উসমান হারুনিকে। শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন হারুনির। একে একে খোরাসান, সমরকন্দ, গিয়ে সান্নিধ্যে আসেন সেখানে অবস্থানরত বিভিন্ন ইসলামী পণ্ডিতদের সাথে। এরপর ছুটেন বাগদাদের উদ্দেশে, পথিমধ্যে সাঞ্জান নামকস্থানে ইমাম নাজ্মুদ্দীনের সাক্ষাৎ নেন। তারপরে বাগদাদে গিয়ে দেখা করেনন তাঁর স্বদেশী আরেক ইসলামী প্রখ্যাত পণ্ডিত, পীর বলে কথিত আবদুল কাদির জিলানীর সাথে। বাগদাদ থেকে তিনি বিভিন্ন দেশ ও শহর-নগর ভ্রমণ করে ইসলামী জ্ঞানে আবদ্ধ হন উত্তম রূপে। তারপর যান মক্কা। মক্কা থেকে পা রাখেন মদীনায়।
তৎকালীন সময়ে শিক্ষা, সভ্যতা, সংষ্কৃতি, শিল্প, ভাষ্কর্যের চারণ ভূমি ভারতবর্ষের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল হু হু করে। রূপ লাবণ্যে ভরপুর ভারতবর্ষ যেন এক মোহময় হাতছানি, সমৃদ্ধতার প্রতীক, রূপকথার দেশ হিসাবে পরিচিত বিশেষত আরব জাহানের কাছে। সেই খ্যাতির স্নিগ্ধ বায়ু সেবনে চিস্তিও হন ব্যাকুল। সংকল্প করেন ভারত যাত্রার। লাহোরে এসে গাড়েন আস্তানা। ততদিনে ভারত মাদকতায় আসক্ত সাম্রাজ্যবাদী ইসলামী শাসকদের শোণ দৃষ্টি বারবার আছড়ে পড়তে শুরু করেছিল ভারত অভিমুখে। মুঈনুদ্দীন চিস্তি ৪০ জনের একটি দল নিয়ে ভিড়েন দিল্লীতে, অতঃপর আনুমানিক ১১৯১ সালের দিকে আজমীরে পা রাখেন। ততদিনে তাঁর বয়স হয়ে যায় ৫০ এর অধিক।
ভবঘুরে চরিত্রের অধিকারী চিস্তির ভাগ্যকাশে রংধনু হয়ে আসে গজনীর সুলতান শিহাবুদ্দীন মুহম্মদ ঘুরির ভারত দখল। হিন্দুস্থান দখল করতে ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘুরি এক বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে ভারত আক্রমণ করে বসেন। পৃথ্বীরাজ ভারতের অন্যান্য রাজপুত রাজাদের সহযোগিতায় মহম্মদ ঘুরিকে সেই যাত্রায় পরাজিত করেন। ঘুরি প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যান। কিন্তু যুদ্ধ পরাজয়ের দগদগে ক্ষত মহম্মদ ঘুরির ভারত দখলের আকাংখাকে আরো তীব্রতর করে। ঘুরি ভারত দখলের জন্য কত প্রচন্ড মরিয়া ছিলেন তা বুঝা যায় মাত্র এক বছরের মাথায় ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে আরো বিশাল সৈন্যবাহিনী জোগাড় করে পৃথ্বীরাজকে ফের আক্রমণ করার মধ্যদিয়ে। পৃথ্বীরাজ পরাজিত ও নিহত হন এই যুদ্ধে। দিল্লী ও আজমীর দখলে আসে ঘুরির। এই যুদ্ধটি তরাইনের যুদ্ধ নামে পরিচিতি পায় ইতিহাসে। পরে একে একে মিরাট, বুলান্দগড়, আলিগড়, কনৌজ, গুজরাট, গোয়ালিয়র, বারানসী, বুন্দেলখন্ড, প্রভৃতি অঞ্চল দখল করে নেন ঘুরি।
ঘুরির এই ক্রমপ্রসারমান হিন্দুস্থান দখল প্রক্রিয়া উন্মুক্ত করে ভারতবর্ষে ইসলাম বিস্তারের পথ। হিন্দুস্থানে রাজ আনুকূল্য পায় ইসলাম। ফলে ভাগ্যের চাকা চকিত ঘুরে যায় চিস্তির। প্রশাসন হাত বদল হওয়ায় নতুন শাসকের চাপে পড়ে আবার কেউবা শাসকের কৃপা লাভে বাপ দাদার লালিত ধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। তাদের এই ধর্মান্তকরণ কাজটি সাফল্যের সাথে সমাধা করেন চিস্তি। ফলে ইসলামী বিশ্বে চিস্তির নাম যশ ছড়াতে শুরু করে দ্রুত। কিছুদিনের মধ্যে হয়ে উঠেন ইসলামী বিশ্বে জীবন্ত কিংবদন্তি। অল্প দিনেই আজমীরে নিজ প্রভাব প্রতিপত্তি যখন তুঙ্গে উঠে সুযোগ বুঝে অবসান ঘটান কুমার জীবনের। পাণি গ্রহণ করেন বিবি উন্মত উল্লার। সনটি সম্ভবত ১১৯৪ বয়স এরি মধ্যে ৫৩ কি ৫৪ পার হয়ে যায় তাঁর। এই সংসারে ২ ছেলে ও ১ মেয়ের জন্ম দেন। ইসলাম প্রচারের কাজে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে পেরিয়ে যাচ্ছিল দিন। ধর্মীয় গুরু হওয়ার সুবাদে সন্মানও ধেয়ে আসতে শুরু করে চারদিক থেকে। একদিকে সন্মান অন্যদিকে প্রতিপত্তি এই দুই পরম আরাধ্য শক্তির সংমিশ্রণে চিস্তির তখন পোয়া বারো। তার ইছা অনিচ্ছার বিরুদ্ধে রা করার লোকের সংখ্যা নিতান্তই শূন্য। সেই মোক্ষম সুযোগে ১২২৩ সালে প্রায় ৮২ বয়সে করে ফেলেন ২য় বিয়ে। ভাগ্যবতি! এই স্ত্রীর নাম বিবি আসমত উল্লাহ। এই ঘর আলো করে আসে ১টি পুত্র সন্তান।
৮০ ঊর্ধ্ব বয়সে ২য় বিয়ে যে কোন সংবেদনশীল যুক্তিবোধ সম্পন্ন মানুষের মনে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য চিস্তির নৈতিকতাবোধের সুস্থতা নিয়ে, মননশীলতার বিকাশ সম্পর্কে। গায়ে পীর সুফীর উপাধি যতই সেঁটে দেয়া হোক তাঁর কর্ম জীবন, চিন্তা চেতনা, চারিত্রিক দৃঢ়তা একটা নির্দিষ্ট গন্ডিবদ্ধ বিশ্বাসের বাইরে গিয়ে কাল উত্তির্ণ হওয়ার দাবি রাখতে পারে না কিছুতেই। হতে পারে না সার্বজনীন।
অবশেষে সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ৯৪ বছর বয়সে চিরতরে যাত্রা করেন পরপারে। নিথর দেহটি সমাহিত করা হয় আজমীরে।
ইসলাম প্রচারকে ভিত্তি ভূমি ধরে চিস্তির কাজকে মহত্বের মানদন্ডে মূল্যায়ন করলে বলতে হয় আধুনিক জাকির নয়েক বা দেলোয়ার হোসেন সাঈদির সাথে বিশেষত তাঁর কোন পার্থক্য নেই। আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে প্রচারের ধরণ বা প্রক্রিয়াগত ভিন্নতা থাকতে পারে বটে তবে উদ্দেশ্যে আছে একাত্মতা।
আরো একটি উল্লেখযোগ্য কথা না বললেই নয় আজমীর শরীফ প্রসিদ্ধ হওয়ার পেছনে অন্যতম প্রভাবক হিসাবে যোগ হয়েছিল সুলতান গিয়াসউদ্দিন ভূমিকা। তিনি ১৪৬৪-১৫০০ সালের মধ্যবর্তি কোন এক সময় চিস্তির কবরটিকে ব্যাপক সংষ্কার কাজ করান। সেই পথ ধরে হাঁটেন “আকবর দা গ্রেট”, আজমীর ভ্রমণ কালে ১৫৬৪ সালে তিনি সেখানে একটি বিশাল তোরণ নির্মান করে দেন।
কয়েশ বছর আগে ভারত অধিপতি সম্রাটদের পদ ধুলিতে সিক্ত হওয়া তথা কথিত পূণ্যভূমি আজমীরের কথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে শ্রুতি গোচর হয়ে অজ্ঞতা ও অন্ধ বিশ্বাসের বেড়া জালে আবদ্ধ সাধারণ জনগণের মনঃস্তাত্বিক চিন্তা চেতনায় প্রভাবক হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে আজো। বাদ পড়ছে না হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কেউ।
বিঃদ্রঃ আরেক জন প্রখ্যাত সুফী বায়েজিদ বোস্তামী সম্পর্কে জানতে দেখুন এখানে।
ভাই আপনারা হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী কে নিয়ে এরকম বাজে মন্তব্য করছেন! আপনারা যাকে আজে বাজে কথা বলছেন এই খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী কে কোটি মানুষ শ্রদ্ধা করে। ওনাকে নিয়ে সমালোচনা করার আগে ওনার সম্পর্কে ভালো করে যানেন।খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী স্রষ্টার নৈকট্যশীলদের মধ্যে একজন ছিলেন। প্রমাণ দেখুন এখনো তার মাজারে হিন্দু,মুসলিম,বৌদ্ধ,খ্রীষ্টান,শিখ এরা সবাই তার মাজার জিয়ারত করে। কোটি মানুষের বিশ্বাস কে আপনারা কেন অসন্মান করবেন?
ভাল লাগল।
সুফিবাদ জিনিসটা কি তা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার বুঝি না, তবে কিভাবে এই বাদের উদ্ভব হল তা কিছুটা বুঝতে পারলাম। যতদূর মনে হয় প্রধানত সুফি সাধকদের মাধ্যমেই শান্তিপূর্ন ভাবে ইসলাম উপমহাদেশে ছড়িয়েছিল, যদিও আমারও সন্দেহ আছে আজকের দিনের মোল্লা আলেমরা এনাদেরকে আধুনিক যুগে ছেড়ে দিলে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন।
তুরষ্কে শুনেছি সুফি দরবেশদের এখনো বেশো রমরমা (সম্ভবত ইরাকেও), টিকিট কেটে ট্যুরিষ্টরা দরবেশ নৃত্য দেখতে যায়।
ভারতবর্ষে ক্ষমতাসীনদের মদদে কিভাবে হিন্দু-বৌদ্ধ-হিন্দু ধারার কনভার্ষন হল এ নিয়ে ভবিষ্যতে লেখা আশা করি।
@আদিল মাহমুদ,
আপনি আসল নবি না নকল নবি? আপনার ধমাদম বা ‘দম মারো দম’ ধর্মটা সুফিজম থেকে উৎসারিত মনে করে প্রায় আমার ধর্ম থেকে কনভার্ট হওয়ার পথে ছিলাম। আর আপনি কি না বলেন- সুফিবাদ জিনিসটা কি তা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার বুঝি না।
আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো- সুফিবাদ আদর্শহীন একটা ভন্ডামী ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু এই ভন্ডামীটা বাহ্যিকভাবে দেখতে ডাকাত ওয়াহাবিজম থেকে ভাল ছিল। দুই দলের পার্থক্য- চোর আর ডাকাতের। চোর যদি নির্বিঘ্নে ছহি ছালামতে চুরি করতে পারে তার ডাকাত হওয়ার দরকার পড়েনা। কিন্তু অসুবিধায় পড়লে তার ডাকাত হতে মোটেই সময় লাগেনা। তাই সুফিদের হাতে থাকতো তাসবিহ আর বগলে তলোয়ার। সুফিজমে আবার প্রকারভেদ আছে। ইতিহাস দেখুন কীভাবে সুফিবাদ ক্ষণেক্ষণে পলিটিক্যাল ইসলামের দ্বারস্থ হয়েছে ইসলামী সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে। একটা পেপার থেকে এখানে কিছুটা তুলে দিলাম-
Sufism- was it spiritual or politics?
Contrary to the spiritual mission of Sufism, the cult was primarily introduced in India for spread of Islam with a view to help the Muslim rulers for political domination. By and large the spiritual successors of mystic Islamic saints enjoyed the royal favour of Muslim rulers and gave moral support to the atrocious Muslim invaders and looked other way to ignore the growing social conflict. They also guided the State in political affairs with their experience of regular interaction with common people.
Shah Wali Ullah, a prominent Muslim thinker of eighteenth century who shaped the destiny of Indian Muslims was also a Sufi of Naqshbandi order. His contempt against the Hindus was identical to Shaikh Ahmad Sirhindi. The rise of two Hindu rebellious groups namely Marathas and Jats against the Muslim rulers in 1750s stirred the mystic spirit of Wali Ullah and he invited Ahmad Shah Abdali, the Afghan ruler to invade India to save the Muslims from the subjugation of Hindus. While formulating the contours of his mystical ideology, he transformed the Islamic mysticism to a theo-political concept for supremacy of Islam and for political power to the Sunnis
Of the various Sufi orders, Muslims of India prominently follow Chistiyya, Naqshbandiyya, Qadiriyya and Suharabardiyya. Of them the impact of Chisti order is visible even in small villages of Indian subcontinent. Kwaja Moin-ud-Din Chisti, a disciple of Khwaja Abu Abdal Chisti, the propounder of this order introduced it in India. Born in Afghanistan in 1142 AD, he came to India with the army of Shihab-ud-Din Ghuri in 1192 AD and selected Ajmer as his permanent abode since 1195. His shrine became a place of pilgrimage largely with the support of Muslim rulers. Akbar used to have annual pilgrimage there (Indian Islam by Murray T.Titus, 1979, Page 117).
Four Islamic mystics from Afghanistan namely Moinuddin(d. 1233 in Ajmer), Qutbuddin(d. 1236 in Delhi), Nizamuddin (d.1335 in Delhi) and Fariduddin (d.1265 in Pattan now in Pakistan) accompanied the Islamic invaders in India (A History of Modern India edited by Claude Markovitz, Anthen Press, 2002, Page 30). All of them were from the Chistiyya order of Islamic mysticism. Radiating from Delhi under Nizamuddin and following the trail of Mohammad ibn Tughlaq towards the south, the Chistiyya spread its roots all across India ( A History of Modern India edited by Claude Markovitz, Anthen Press, 2002). Internationally famous Sufi Shine at Ajmer Sharif in Rajasthan and Nizamuddin Auliya in Delhi belong to this order.
A section of Sufis under Chistiyya order was not against adjustment with Hindu saints of Bhakti cult and used even Hindi language for Islamic devotional songs. However, the orthodox Ulama with royal support forced the Sufis to raise the slogan of “back to Shariat” Even though Ulama had certain differences with Sufis over theological and mystic issues, Shariat remained a cementing force between them. Later both the Islamist groups joined together to woo the rulers with a view to furthering their self-seeking interest.
মূল লেখা এখানে-
শাহ জালালের আজান ধ্বনিতে গৌড়গোবিন্দের সাত তালা দালান ভেঙ্গে পড়লো পদার্থ বিজ্ঞানের কোন সুত্রে তা আইনষ্টাইন ভাল জানবেন। তবে আমরা জানি, দিল্লির সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ তার ভাতিজা সিকন্দার খান গাজীর নেতৃত্বে একদল সৈন্য সিলেট আক্রমনের জন্যে পাঠিয়েছিলেন। প্রবল বন্যার কারণে সিকন্দার যখন সিলেট আক্রমন করতে ব্যর্থ হন, সুলতান তখন তার সেনাপতি নাসিরুদ্দিনকে যুদ্ধ পরিচালনার নির্দেশ দেন। শাহ জালাল তার ৩৬০ জন সৈন্য নিয়ে পরে এসে নাসিরুদ্দিন ও সিকন্দার খান গাজীর সেনাবাহিনীর সাথে যোগদান করেন। শাহ জালাল সুরমার জলে জায়নামাজ বিছানোর অনেক আগেই নাসিরুদ্দিন ও সিকন্দার খান গাজী গৌড়গোবিন্দের সাত তালা দালান বিছায়ে দিয়েছিলেন।
@আকাশ মালিক,
এই ৩৬০ জনকে আসলে ঠিক সৈন্য বলা যায় না এরা ছিল অভাব গ্রস্থ মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত ভাগ্যন্বেষি যুবক। হিন্দু রাজাকে উচ্ছেদ করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের সুর্বণ সুযোগ দেখতে পেয়ে প্রবল আগ্রহে অস্ত্র তুলে নেয় হাতে। পরবর্তীতে অস্ত্রধারী এই ৩৬০ জন যুবক হয়ে যায় এক একজন বড় মাপের আউলিয়া!
@রাজেশ তালুকদার,
সূফীবাদ সম্পর্কে এম.এ. খানের লেখা “জিহাদ” অনুবাদ ব-দ্বীপ প্রকাশনা। (বইটি পড়লে পরিষ্কার বুঝতে পারবেন সূফীবাদ কি আসলেই শানি-পূর্ণ ছিলো?) বইিটির ৪নং অধ্যায় ”সূফীবাদের উৎস” থেকে কিছুটা তুলে ধরা হলো।
ভারতীয় সূফীগণ
কিছু কিছু সূফী সম্পূর্ণরূপে ইসলামের পথ থেকে বিচ্যুত হলেও অধিকাংশই গোঁড়া বা মূলপন্থী থেকে যায়। দ্বাদশ শতকে গাজ্জালী মুসলিম সমাজে সূফীবাদের বিজয় ঘটাতে সক্ষম হন। তিনি মূলত ভ্রষ্ট ধারণা ও আচারসমূহকে অপসারিত করে সূফীবাদের দেহে ইসলামী গোঁড়ামিকেই বুনে দিয়েছিলেন, যার ফলে সূফীবাদ মুসলিমদের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা পায়। সুতরাং ইমাম গাজ্জালীর কারণে সূফীবাদের গোঁড়া অংশটাই মুসলিম সমাজে স্বীকৃতি পেয়েছিল। পথভ্রষ্ট বেশরীয়া সূফীদেরকে নানা নির্যাতন ভোগ, এমনকি মৃত্যুবরণও করতে হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, উগ্র গোড়া ইসলামী শাসক সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক (মৃত্যু ১৩৮৮) তার স্মৃতিগ্রন্থে লিখেছেন যে, ‘তিনি দিল্লীর শেখ রুকনউদ্দিনকে আটক করেছিলেন, যিনি নিজেকে মাহদী (মেসিয়াহ) বলে ঘোষণা করেন এবং তিনি অতীন্দ্রিয় চর্চা ও বিকৃত ধারণার দ্বারা জনগণকে বিপথে পরিচালিত করছিলেন এটা বলে যে: তিনি সে রুকনউদ্দিন, যিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি।’ জনগণ রুকনউদ্দিন ও তার কিছু ভক্তকে হত্যা করে; তারা ‘তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ও তার হাড় ভেঙ্গে খণ্ড খণ্ড করে।’
ভারতে মধ্য-এশীয় তুর্কীরা যখন সরাসরি মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করে (১২০৬), তখন গাজ্জালীর খাঁটি বা কট্টর সূফীবাদ মুসলিম সমাজে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল এবং মুসলিম হামলাকারীদের পথ ধরে ভারতে সূফীদের আগমন ঘটে ব্যাপকভাবে। ভারতের বিখ্যাত সূফী দরবেশ – যেমন নিজামউদ্দিন আউলিয়া, আমীর খসরু, নাসিরুদ্দিন চিরাগী, খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তী ও জালালুদ্দিন – এরা সবাই গোড়া ও অসহিষ্ণু মতবাদী ছিলেন। তারা গোঁড়া ইসলামী পণ্ডিত বা উলেমাদেরকে উচ্চ মূল্য দিতেন এবং তাদের শিষ্যদেরকে ধর্মীয় আইন ও সামাজিক আচরণ সম্পর্কে উলেমাদের রায় অনুসরণ করে চলার পরামর্শ দিতেন। বিখ্যাত আরব-স্প্যানিশ সূফী চিন্তাবিদ ইবনে আরাবীর (মৃত্যু ১২৪০) গোঁড়ামিহীন বিতর্কিত মতবাদ ও চর্চায় প্রভাবিত হয়ে ভারতীয় সূফীদের মধ্যে মঈনুদ্দিন চিশতী ও নিজামুদ্দিন আউলিয়া ছিলেন তুলনামূলক অগোড়া ও উদারপন্থী। গোড়া মুসলিমদের বিরক্ত করে তারা তাদের সূফী ধর্মীয় আচার-প্রক্রিয়ায় বাদ্যপর্ব (সামা) ও নৃত্য (রাক্স) প্রবর্তন করেন। কিন্তু ইসলামের প্রকৃত রীতি-নীতির প্রশ্নের মুখোমুখি হলে তারা কখনোই মূল গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যান নি এবং ধর্মীয় ব্যাপারে সর্বদাই উলেমাদেরকে অগ্রগণ্য মনে করতেন। সূফী দরবেশদের প্রবর্তিত নৃত্যগীত ও বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা অনুমোদনযোগ্য কিনা সে প্রশ্নে আউলিয়া বলতেন: ‘যেটা আইনে (শরীয়া) নিষিদ্ধ, সেটি অগ্রহণযোগ্য।’ সেকালে বিতর্কিত সূফীদের ভজন বা ভক্তিমূলক গান অনুমোদনযোগ্য কিনা, সে প্রশ্নে তিনি বলেন: ‘বর্তমানে এ বিতর্কের ব্যাপারে বিচারক (অর্থাৎ কাজী, সাধারণত গোড়া প্রকৃতির) যে রায় দিবেন, তাই কার্যকর হবে।’
শ্রেষ্ঠ সূফী চিন্তাবিদ গাজ্জালী জিহাদ সম্পর্কে গোঁড়া ও সহিংস মত পোষণ করতেন। তিনি তার অনুরাগী মুসলিমদের উপদেশ দিতেন:
“বছরে অন্তত একবার জিহাদে অবশ্যই যেতে হবে। দুর্গে অবস্থানকারীদের মাঝে নারী-শিশুরা থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে গুলতি ব্যবহার করা যেতে পারে। অগ্নিসংযোগ করে তাদেরকে পুড়িয়ে কিংবা ডুবিয়ে মারা যেতে পারে। তাদের গাছপালা কেটে ফেলা যেতে পারে। তাদের অতি প্রয়োজনীয় গ্রন্থ (বাইবেল, তৌরাত প্রভৃতি) অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে। জিহাদীরা লুণ্ঠিত মালামাল (গণিমতের মাল) ইচ্ছে অনুযায়ী গ্রহণ করতে পারে।
জিম্মি কর্তৃক অবমাননামূলক ‘জিজিয়া’ কর প্রদান সম্পর্কে তিনি লিখেছেন:
ইহুদী, খ্রীষ্টান ও মাজিয়ানদেরকে অবশ্যই ‘জিজিয়া’ দিতে হবে। জিজিয়া প্রদানকালে জিম্মি তার মাথা ঝুলিয়ে দিবে এবং সরকারি কর্মচারী জিম্মির দাড়ি ধরে কানের নিচের স্ফীত স্থানে আঘাত করবে।
তিনি ‘ওমরের চুক্তি ও শরীয়া-প্রতিষ্ঠিত নিয়মের আলোকে জিম্মিদের ক্ষেত্রে কতকগুলো অক্ষমতা নির্দিষ্ট করেন। তিনি লিখেছেন:
তারা খোলাভাবে মদ্যপান করতে ও চার্চের ঘণ্টা বাজাতে পারবে না… তাদের ঘর মুসলিমদের ঘরের চেয়ে উঁচু হবে না, তা ‘যত নীচুই হোক। জিম্মিরা চমৎকার কোনো ঘোড়া বা খচ্চরে চড়তে পারবে না; তারা কেবল কাঠের গদী সম্বলিত গাধার পিঠে চড়তে পারে। তারা রাস্তার ভাল অংশ দিয়ে হাঁটতে পারবে না। তাদেরকে তালি দেওয়া জামা-কাপড় পরতে হবে। এমনকি সরকারী গোসলখানাতেও তাদেরকে মুখ বন্ধ রাখতে হবে।
বিশিষ্ট ভারতীয় সূফীগণ বিধর্মী কিংবা জিহাদের বিষয়ে ব্যাপক কোন মন্তব্য বা লেখা রেখে যান নি। তবুও ছোটখাটো সুযোগ পেলেই এসব বিষয়ে তারা যেসব ছিটেফোঁটা মন্তব্য করে গেছেন, তা এসব ব্যাপারে তাদের চিন্তাচেতনার ইঙ্গিত দেয়। সামগ্রিকভাবে অবিশ্বাসী ও জিহাদের ব্যাপারে তাদের ধারণা ছিল অনেকটা শ্রেষ্ঠ সূফী সাধক গাজ্জালীর অনুরূপ।
নিজামুদ্দিন আউলিয়া (১২৩৮-১৩২৫): নিজামুদ্দিন আউলিয়া গোঁড়া মুসলিমদের মতামত অবলম্বনে হিন্দুদেরকে নরকের আগুনে পোড়ার জন্য অভিশপ্ত করেন। তিনি বলেন: ‘বিধর্মীরা মৃত্যুকালে শাস্তি পাবে। সে মুহূর্তে তারা ইসলামকে সত্য বলে স্বীকার করবে, কিন্তু তাদের তখনকার সে বিশ্বাস গ্রহণযোগ্য হবে না; কারণ সেটি হবে না অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস। সুতরাং একজন বিধর্মীর মৃত্যুকালীন বিশ্বাস অগ্রহণযোগ্য থেকে যাবে।’ তিনি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন: ‘পুনরুত্থানের দিন বিধর্মীরা শাস্তি ও নিদারুণ যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়ে ইসলাম গ্রহণ করবে, কিন্তু তা কোন কাজে আসবে না। তারা নরকেই যাবে, যদিও বিশ্বাসী হিসেবে।’ তার ‘খুৎবা’য় নিজামুদ্দিন আউলিয়া বিধর্মীদেরকে অপকর্মকারী পাপী হিসেবে নিন্দা করে বলেন: ‘আল্লাহ বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীদের জন্য যথাক্রমে স্বর্গ ও নরক সৃষ্টি করেছেন, পাপীদেরকে তাদের অপকর্মের প্রতিদান দিতে মাত্র।’
অমুসলিমদের বিরুদ্ধে জিহাদ সম্পর্কে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার চিন্তাভাবনা কুরআনের প্রথম ‘সূরা ফাতিহা’ সম্পর্কে তার বিবৃতি থেকে পাওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন: সূরা ফাতিহায় ইসলামের দশটি মৌলিক ভিত্তির মধ্যে দু’টি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তা হলো: ‘অবিশ্বাসীদের সাথে যুদ্ধ করা এবং স্বর্গীয় বিধিবদ্ধ আইন প্রতিপালন করা।’ এবং সে মুতাবেক হিন্দুদের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে নাসিরুদ্দিন কিবাচার বিজয়ে তিনি সাতিশয় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন এবং তার শিষ্য শাহ্জালালকে ৩৬০ জন জিহাদী সাথীসহ প্রেরণ করেছিলেন সিলেটের রাজা গৌর গোবিন্দের বিরুদ্ধে লড়াই করতে।
দক্ষিণ ভারতে মালিক কাফুরের নেতৃত্বে পরিচালিত জিহাদের সম্ভাব্য সফলতা সম্পর্কে কাজী মুঘিসুদ্দিন যখন আউলিয়ার কাছে জানতে চান, আউলিয়া তখন আবেগাপ্লুতভাবে বলে উঠেন: ‘এ বিজয় তো কি, আমি আরো বিজয়ের অপেক্ষায় আছি।’ নিজামুদ্দিন আউলিয়া সুলতান আলাউদ্দিনের জিহাদ অভিযানে লুণ্ঠিত মালে গণিমত থেকে বিপুল পরিমাণ উপহার গ্রহণ করতেন ও তার খানকায় বা আশ্রমে তা গর্বের সাথে প্রদর্শন করতেন।
খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তী (১১৪১-১২৩০): নিজামুদ্দিন আউলিয়ার পর সম্ভবত ভারতের দ্বিতীয়-শ্রেষ্ঠ সূফী সাধক ছিলেন খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তী, যিনি হিন্দুধর্ম ও তার চর্চার বিরুদ্ধে গভীর ঘৃণা প্রদর্শন করেন। আজমীর-এর আনাসাগর লেকে পৌঁছে তিনি সেখানে অনেক প্রতিমা-মন্দির দেখতে পেয়ে আল্লাহ ও নবীর সাহায্যে সেগুলো ধূলায় মিশিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। সেখানে আবাস স্থাপনের পর খাজার ভক্তরা প্রতিদিন একটি বিখ্যাত মন্দিরের সামনে একটি গরু (হিন্দুরের কাছে পবিত্র) আনতো, যেখানে রাজা ও হিন্দুরা পূজার্চনা করতো; তারা সে গরু সেখানে জবাই করে তার মাংস কাবাব বানিয়ে খেত, যা ছিল হিন্দুধর্মের প্রতি তার ইচ্ছাকৃত ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। বলা হয়, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য তিনি না কি সেখানকার হিন্দুদের অতি পবিত্র বিবেচিত দু’টি হ্রদ ‘আনাসাগর’ ও ‘পানসেলা’ শুকিয়ে দিয়েছিলেন তার আধ্যাত্মিক শক্তির তেজ দিয়ে। মঈনুদ্দিন চিশ্তীও তার ভক্তদের নিয়ে ভারতে এসেছিলেন বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার লক্ষ্যে এবং সুলতান মুহাম্মদ ঘোরীর বিশ্বাসঘাতী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আজমীরের সে যুদ্ধে ক্ষত্রিয় হিন্দু রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান পরাজিত হন। চিশ্তী তার জিহাদী উদ্দীপনায় এ যুদ্ধে বিজয়ের সমস্ত গৌরব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বলেছিলেন: ‘আমরা পিথাউরাকে (পৃথ্বীরাজকে) জীবন্ত আটক করে ইসলামের বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছিলাম।’
ওদিকে মুলতানে হিন্দুদের বিরুদ্ধ নাসিরুদ্দিন কিবাচার এক জিহাদী মুসলিম বাহিনী যখন বিপন্ন অবস্থায় পরাজয়ের মুখোমুখি, তখন চিশ্তীর সুবিখ্যাত শিষ্য ও সূফীসাধক কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকী কিবাচার কাছে গিয়ে তাকে একটি যাদুকরী বা অলৌকিক তীর দিয়ে বলেন: ‘বিধর্মী বাহিনীর দিকে এ তীর নিক্ষেপ করো… তার কথামত কিবাচা তা করেন এবং পরদিন যখন দিনের আলো ফুটে উঠে, তখন একজন অবিশ্বাসী সেনাকেও যুদ্ধ ক্ষেত্রে দেখা যায় নি; তারা সবাই পালিয়েছিল।’ এবং সে যাদুকরি সূফীসাধককে সম্মানিত করতে সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেক দিল্লীর আশেপাশের মন্দিরগুলো ভেঙ্গে সেগুলোর মাল-মসলা দিয়ে সুবিখ্যাত ‘কুতুব মিনার’টি নির্মাণ করেন।
আমির খসরু (১২৫৩-১৩২৫): শেখ নিজামুদ্দিন আউলিয়ার কৃতী শিষ্য আমির খসরু মধ্যযুগীয় ভারতের এক উদার সূফী কবি হিসেবে পরিচিত। অনেক আধুনিক ইতিহাসবিদের দৃষ্টিতে তার ভারতে আগমন ছিল এ উপমহাদেশের জন্য এক আশীর্বাদ। পরপর তিন সুলতানের রাজদরবারে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। তৎকালীন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে সুখ্যাত আমির খসরু ভারতে ক্লাসিক্যাল মিউজিক বা ধ্রুপদী বাদ্যের এবং কাওয়ালী গান (সূফীদের নিবেদনমূলক গান)-এর প্রতিষ্ঠাতা। তবলা আবিষ্কারের কৃতিত্বও তাকে দেওয়া হয়ে থাকে।
গান ও কবিতায় আমির খসরুর কৃতিত্ব ও সাফল্যের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যখন পতিত অবিশ্বাসী ও তাদের ধর্মের প্রশ্ন আসে, তখন তার ইসলামের গোঁড়ামিপূর্ণ আবেগ স্পষ্ট হয়ে উঠে। হিন্দু রাজাদের উপর মুসলিম বিজয়ের বর্ণনায় তিনি তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য, যেমন বৃক্ষ ও প্রস্তরমূর্তি পূজা ইত্যাদির ব্যাপারে বিদ্রূপ করেন। মুসলিম বীরদের দ্বারা পাথরের মূর্তি ভাঙ্গার ঘটনায় ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতঃ তিনি লিখেন: ‘মুহাম্মদের ধর্মের বিজয়োল্লাসের জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ। কোনো সন্দেহ নেই যে ‘গাবর’রা (পৌত্তলিকদেরকে খর্বিত করতে গালি) পাথর পূজা করে, কিন্তু পাথর তাদের কোন সেবায় আসেনি; তারা পরপারে গেল শুধু সে পূজার অর্থহীনতার সাক্ষ্য বহন করে।’
আমীর খসরু মুসলিম বীরদের দ্বারা হিন্দুদেরকে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনায় আনন্দ প্রকাশ করেন। ১৩০৩ সালে চিতোর বিজয়ের পর খিজির খান কর্তৃক ৩০,০০০ বন্দীকে হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে উল্লসিত আমির খসরু লিখেন: ‘আল্লাহকে ধন্যবাদ যে তিনি বিধর্মী-ছেদনকারী তলোয়ার দ্বারা ইসলামের চৌহদ্দি থেকে সকল হিন্দু নেতাদের হত্যার আদেশ দেন… ঈশ্বরের এ খলীফার নামে ভারতে অবিশ্বাসের কোনই স্থান নেই।’ মালিক কাফুরের দক্ষিণ ভারতের একটি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে সেখানে হিন্দুদের ও তাদের যাজক ব্রাহ্মণদের উপর চালানো নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিতে গিয়ে খসরু কাব্যিক আনন্দে উল্লসিত হন। হত্যাকাণ্ডটির বর্ণনায় তিনি লিখেন: ‘…ব্রাহ্মণ ও মূর্তিপূজকদের গর্দান থেকে মস্তক নাচতে নাচতে মাটিতে তাদের পায়ের উপর গড়িয়ে পড়লো ও রক্তের স্রোত বয়ে গেল।’ ভারতে হিন্দুদের দুর্দশাপূর্ণ বশীভূতকরণ ও ইসলামের বর্বরোচিত বিজয়ে গোঁড়ামিপূর্ণ উল্লাসে তিনি লিখেন:
সমগ্র দেশ আমাদের পবিত্র ধর্মযোদ্ধাদের তরবারী দ্বারা আগুনে ভস্মিভূত কণ্টকশূন্য জঙ্গলের মত হয়ে গেছে। ইসলাম বিজয়ী হয়েছে, পৌত্তলিকতার পতন ঘটেছে। জিজিয়া কর প্রদানের মাধ্যমে মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তির আইন মঞ্জুর না করা হলে, হিন্দুদের নামটি শিকড় ও শাখাসহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।
আমীর খসরু হিন্দুদের উপর মুসলিম বিজয়ীদের দ্বারা সংঘটিত বহু বর্বরোচিত সর্বনাশা নিষ্ঠুরতার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এসব বর্ণনায় তিনি কোথাও একটু দুঃখ বা অনুশোচনার চিহ্ন দেখান নি, বরঞ্চ আবেগ জড়িত উল্লাস প্রকাশ করেছেন। ওসব বর্বর ঘটনার বর্ণনায় তিনি সর্বদা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং নবী মুহাম্মদের প্রতি গৌরব প্রকাশ করেছেন – সে কৃতিত্বপূর্ণ কাজে মুসলিম যোদ্ধাদেরকে সক্ষমতা দানের জন্য।
অপর যে এক শ্রেষ্ঠ সূফী সাধক ভারতে আসেন তার নাম শেখ মখদুম জালাল আদ-দীন বিন মোহাম্মদ, যিনি হযরত শাহ জালাল নামে সমধিক পরিচিত ও বাংলার সিলেটে স্থিত হয়েছিলেন (পরে বর্ণিত)। এ সকল অতি শ্রদ্ধাবান সূফী সাধক ছাড়া আরও অনেক সূফী ব্যক্তিত্ব রয়েছেন – যেমন শেখ বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, শেখ নূরুদ্দিন মোবারক গজ্নবি, শেখ আহমদ শিরহিন্দী ও শেখ শাহ ওয়ালিউল্লাহ প্রমুখ – যারা অধিকতর গোঁড়া ধ্যান্তধারণার জন্য প্রায়শঃই আধুনিক ইতিহাসবিদ ও লেখকদের দ্বারা নিন্দিত হন। উদাহরণস্বরূপ, সুহরাওয়ার্দী তরিকা বা গোত্রের এক বিখ্যাত সূফী সাধক ও ইসলামী পণ্ডিত শেখ মুবারক গজ্নবি অমুসলিম (কাফির) ও তাদের ধর্মের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা ও অসম্মান প্রকাশ করতেন। তিনি সুলতানকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, ‘রাজারা কাফির ও কুফরি (নাস্তিকতা), শিরক (বহুঈশ্বরবাদ) ও মূর্তিপূজা উচ্ছেদ না করা পর্যন্ত তাদের ধর্ম রক্ষার দায়িত্ব পূরণ হবে না – যার সবই আল্লাহর উদ্দেশ্যে ও তাঁর নবীর ‘দ্বীন’ রক্ষার জন্য।’ কিন্তু কোন অসম্ভব পরিস্থিতিতে তার উপদেশ ছিল: ‘কুফরের গভীর ও দৃঢ় শিকড় এবং কাফির ও মুশরিকদের ব্যাপক সংখ্যাধিক্যের কারণে যদি পৌত্তলিকতা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা না যায়, তাহলে রাজাদের উচিৎ অন্তত মুশরিক ও মূর্তি-পূজক হিন্দুদের অমর্যাদা, অসম্মান ও মানহানি করা, যারা ঈশ্বর ও তাঁর নবীর নিকৃষ্টতম শত্রু।’
আধুনিক ইতিহাসবিদগণ কর্তৃক নিন্দিত হলেও এসব সূফী-সাধকরা তাদের সময়ে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন, বিশেষ করে উলেমা ও শাসক শ্রেণীর দ্বারা সম্মানিত হওয়ায় তারা রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নে যথেষ্ট প্রভাব খাটাতেন। সূফী সাধক বাহাউদ্দিন জাকারিয়া ও নুরুদ্দিন মুবারক ইসলামের সর্বোচ্চ ‘শেখ আল-ইসলাম’ খেতাবে ভূষিত হন, যা সাধারণত ইসলামের সবচেয়ে জ্ঞানী পণ্ডিতগণকে দেওয়া হত। ওসব অধিকতর গোড়া অথচ জনপ্রিয় সূফীদের ধ্যান ধারণা সম্পর্কে আরো বিশদ আলোচনায় না গিয়ে ইসলামের বিস্তারে সূফীরা কী ভূমিকা রেখেছিল, এখন তা বিশ্লেষণ করা যাক।
উমর উদ্দিনের মতে, ‘অগ্রগতির প্রাথমিক স্তরে সূফীবাদ ইসলাম (অর্থাৎ গোঁড়া ইসলাম) থেকে খুব বেশী পৃথক ছিল না। …এক পর্যায়ে কিছু পথভ্রষ্ট সূফী অনইসলামিক সর্বেশ্বরবাদে পৌঁছে, যা সৃষ্টিকর্তার সাথে ব্যক্তি ও সমগ্র সৃষ্টিকে একটা একক সত্তায় ঐক্যবদ্ধ করে। আত্মমগ্নতা, আত্মলোপ ও আত্মধ্বংস ঘোষণাকারী সর্বেশ্বরবাদ, যা ব্যক্তিকে ঈশ্বরের সঙ্গে মিলনের দিকে নিয়ে যায়, সেটি ইসলামের মূল ধারণায় একটা অপবিত্র মতবাদ। অগ্রগতির এ স্তরে তাদের কোনো পথ-নির্দেশক (অর্থাৎ নবী) অথবা আইন গ্রন্থের (অর্থাৎ কুরআন) প্রয়োজন পড়ে না। তারা শরীয়া আইনের প্রয়োজনীয় প্রায় সব আচার-আনুষ্ঠানিকতা – যেমন রোজা, নামাজ, হজ্ব, জাকাত প্রভৃতি – পরিত্যাগ করে। ইসলামী সমাজে তারা ‘বেশরীয়া’ অর্থাৎ শরীয়া বা ইসলাম বহির্ভূত বলে পরিচিতি পায়।
বেঞ্চামিন ওয়াকারের মতে:
সন্ন্যাসের নীতিতে অনেক সূফী ধারা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিশিষ্ট সূফীরা দারিদ্র্য, ‘ফকির’ বা ভিক্ষুক ও দরবেশী জীবনধারার স্তুতিতে লেখালেখি করেন। খুব অল্প সংখ্যক সূফী ইহলৌকিক আনন্দ, যেমন ধন্তসম্পদ, খ্যাতি, ভোজ, নারী সম্ভোগ ও সঙ্গী-সাথী পরিত্যাগ করে নিদারুণ দারিদ্র্য, নাম-নিশানাহীনতা, ক্ষুধা, চিরকুমারত্ব ও নিঃসঙ্গ জীবন গ্রহণ করে; এমনকি তারা তাদের আধ্যাত্মিকতাকে আরো শক্তিশালী করতে গালিগালাজ ও ঠাট্টা-বিদ্রূপে উদাসীন থাকার মাধ্যমে দুর্ব্যবহার ও অসম্মানকে স্বাগত জানায়।
@আকাশ মালিক,
নকশবন্দি টাইটেলের যে এমন বর্নাঢ্য ইতিহাস আছে জানতাম না। কিছুদিন আগে জেনেছি যে আসল নকশবন্দি সাহেবরা এখনো তুরষ্ক অঞ্চলে বেশ সেলিব্রিটির মতন আছেন। আমার ধারনা ছিল যে আমাদের দেশের মোল্লা আলেমদের এই জাতের টাইটেল সবই দেশজ।
আমার ব্যাক্তিগতভাবে কোন ইজমের প্রতিই ভক্তি বা ঘৃনা কোনটাই নেই, সবকিছুরই ভাল কিছু থাকলে গ্রহন কর, মন্দ থাকলে বর্জন কর এই সরল নীতি মেনে চলি। তবে সুফিবাদকে শান্তিপূর্ন উপায় বলেই জানতাম, যদিও ঠিক কি বা মূলধারার ইসলামের সাথে তফাতটা ঠিক কোথায় তা জানি না। কোমরে তলোয়ার রাখলেই হিংসাত্মক বা আক্রমনাত্মক তা নাও হতে পারে, আত্মরক্ষার্থেও হতে পারে, যদি দেখছি কিছু সুফি সাধকের এক সময় তেমন ট্র্যাক রেকর্ড ছিল।
ইসলাম উপমহাদেশে আসার পর অন্তত সনাতন ধর্মের ভয়াবহ বর্নবাদের কবল থেকে কি অনেক লোককে রেহাই দেয়নি,আপনি কি বলেন? বর্নবাদের প্রকোপে হয়ত আমাদের জেনারেশন পড়ত না তবে ধরেন আমার পিতাকে কোন উচ্চবর্নের সেবাদাস হিসেবে জীবন কাটাতে হত তবে সেটা কি তেমন সুখকর কিছু হত?
@আদিল মাহমুদ,
সুন্দর বিশ্লেষণ।
আমিও। কেউ যদি ধমাদম মেরে, রাত ভর হিল হিল করে মনে শান্তি পায় আনন্দ করে, তাতে আমার কোনই আপত্তি নাই। আমি নিজেও অনেক কিছু করে সুখ পাই যা অন্যের কাছে নিছক পাগলামী মনে হতে পারে। এক সময় মাজারে পড়ে থাকতাম, লাল কাপড় মাথায় বেঁধে গাঁজা খেয়ে দম মারো দম জিকির করতাম। ভাল লাগতো তাই করতাম। তাই যারা মাজারে বোমা মারে আমি তাদেরকে ঘৃণা করি। তবে এখানে ছোট্ট একটা কিন্তু আছে। জগতে দূর্বলের উপর সবলের অপরিসীম অনাচার অবিচার, জোরপূর্বক নিজের বিশ্বাস মতবাদ অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়ার ইতিহাস, আর তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমি আর মন্দ থাকলে বর্জন কর এই সরল নীতি মেনে চলতে পারিনা, বরং মন্দকে ঘৃণা করতে এবং মন্দের তীব্র প্রতিবাদে ব্রতী হই। সাতক্ষিরায় জ্বলেছিল দশ ঘর হিন্দু পরিবার, বছর ঘুরে নাই দিনাজপুরে জ্বলছে বিশ ঘর। শুধু মুখ ফেরায়ে বর্জন করলে চলবে?
সরাসরি সোজা হ্যাঁ বা না বলে দেয়াটা বোধ হয় ঠিক হবেনা, পাছে সাদ্দামের অত্যাচার থেকে কুর্দীদের বাঁচাতে আমেরিকা সারা ইরাক দখল করে নেয়াকে জায়েজ মনে করে ফেলে। উপরে মাহমুদ ইমরান সাহেবের জবাবে কামালউদ্দিন আহমেদ সূফীবাদ সম্পর্কে এম.এ. খানের লেখা থেকে কিছুটা তুলে দিয়েছেন, তা দেখতে পারেন। তারপর ইউরোপে মুসলিম সভ্যতার গর্বিত ইতিহাস তো আমাদের সামনেই আছে। কথা হলো, আমাকে সাহায্য করতে এসে আপনি যদি বিনিময়ে আপনার মতবাদ গ্রহণে আমাকে বাধ্য করেন, আমি সেটাকে অন্যায় মনে করি।
@আকাশ মালিক,
ভালো পয়েন্ট। বলপ্রয়োগের জাস্টিফিকেশনের উপর এই সন্দেহে স্থিত থাকা দরকার।
@আকাশ মালিক,
সাম্প্রদায়িক গোলযোগ আসলে অনেক সময় ধর্মের সরাসরি নির্দেশে নয়, পরোক্ষ প্রভাবে ঘটে। খোঁজ নিলে দেখবেন যে এসব গোলযোগকারির অনেকে নিজে ধর্মের শতকরা ১ ভাগও জানে না। ধর্মের অন্যতম মন্দ দিক হল কাল্ট গোছের মানসিকতা তৈরী করা যার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হল অপরদের ঘৃনা করা, তারঈ প্রভাব হল এসব, এর সাথে রাজনৈতিক বা সম্পত্তি দখল করার লোভ যুক্ত হলে আরো ভয়াবহ।
সরাসরি হ্যা/না জবাব আসলেই খুব কঠিন। মধ্যযুগে ভারতবর্ষে ইসলামের আগমন অন্তত সামাজিক দিক দিয়ে বহু মানুষকে মুক্তি দিয়েছিল বলেই প্রতীয়মান হয়, তবে অন্য কারো দেশে বিনা প্ররোচনায় হামলা করে তাদের মংগল সাধন হালাল করা কতটা সমর্থন করা যায় তা বেশ বিতর্কের ব্যাপার। ভারতবর্ষের আমরাও ব্রিটিশদের অত্যাচার শোষনের নানা গীত গাই। ২০০ বছর পরাধীন ছিলাম বলে কান্নাকাটি করি, যদিও এর আগে শেষ বাংলাদেশের রাজা কবে কে ছিলেন তা কে বলতে পারে? সিরাজউদ্দৌলা বা মুঘল বাদশাহরা কেউই বাংগালী ছিলেন না, জাতিগত ভাবে ভারতীয়ও ছিলেন না। ব্রিটিশ শাসনের ভাল দিকও অনেক অনেক আছে। ব্রিটিশ শাসন না এলে হিন্দু সমাজের নানান রকমের ভয়াবহ কুপ্রথা থেকে মুক্তি পেতে আরো বহু যুগ লাগত। আজকের ভারতের আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের পথে শীর্ষারোহন ব্রিটিশ শাসনের ছোঁয়া ছাড়া মনে হয় না এভাবে সম্ভব হত বলে। তারপরেও ব্রিটিশরা যেভাবে ছূঁচ হয়ে ঢুকে ফাল রূপে জেঁকে বসেছিল তা সমর্থন করা যায় না।
যারা ইরাক হামলার নিন্দায় রাস্তা কাঁপান তারা কিভাবে খলিফা উমরের মিশর কিংবা ইরান দখল সমর্থন করেন তা আমার বড় জানার ইচ্ছে আছে।
মাজারে কি আত্মিক মুক্তির টানে যেতেন নাকি নিছক ফ্রী গঞ্জিকা সেবনের উদ্দেশ্যে?
@আদিল মাহমুদ,
যথার্থ বলেছেন। খুব নগণ্য আমজনতা নিজ ধর্ম সম্পর্কে অনুসন্ধান করে। ধর্ম মানুষ ততক্ষন মানে যতক্ষণ নিজ স্বার্থের ক্ষতির আসংখা করে না, তদুপরি আরো কিছু যদি ফাও জোটার সম্ভাবনা দেখে তাহলে তো সোনায় সোহাগা। মানুষ ধর্ম ধর্ম চিৎকারে পাগল হয়। অথচ নিজ স্বার্থের সামান্য ব্যঘাত দেখলেই ঈশ্বর ভয় তখন ধার্মিক মন থেকে একে বারেই উদাও । করে না শেষ বিচারের অপেক্ষায় কাল ক্ষেপণ।
আপনি যদি শুধু বর্ণ প্রথা থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে একথা বিবেচনায় আনেন তাহলে ঠিক আছে আর যদি শিক্ষা, সংষ্কৃতি, সামাজিক উন্নয়নের অনান্য অনুসঙ্গের প্রসঙ্গের তুলনায় আসেন তাহলে বলতে হয় ইসলাম ভারতবর্ষের বহু মানুষকে প্রগতির চেয়ে চিন্তা চেতনায় পশ্চাৎপদ থাকতে সাহায্য করেছে বেশী। বরং ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন ভারতের সমাজ পরিবর্তনে অবদান রেখেছে ঢের বেশী।
অনেক দিন বিরতির পর আপনাকে নিয়মিত পেয়ে ভালো লাগছে।
ভালো থাকুন।
@রাজেশ তালুকদার,
– এ ধারনা আসলে পুরোই আমার নিজের। এ নিয়ে যাকে বলে একাডেমিক পর্যায়ের গবেষনা ঘাটাঘাটি তা কখনো করা হয়নি। আমার ব্যাক্তিগত ধারনা এই যে ভারতবর্ষে যে সময়টায় মুসলমান শাসন আসে সে সময়টায় জ্ঞানচর্চার অবস্থা ছিল ইউরোপের মতই স্থবির, প্রাচীন ভারতের জ্ঞান বিজ্ঞানের যুগ মনে হয় আরো আগেই শেষ হয়ে গেছিল। তাই সে সময়টায় মুসলমান শাসন তালেবানি শাসকদের মত জ্ঞানার্জনের পথ হঠাত রুদ্ধ করে দিয়েছিল এমন প্রতীয়মান হয় না, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পোড়ানোর মত ঘটনা প্রাথমিক যুগে ঘটেছিল অবশ্য। তেমনি আবার আকবরের মত শাসক সব ধর্মের লোকের মধ্যেই জ্ঞান চর্চা উতসাহিত করেছিলেন, প্রগতিশীলতার পথ দেখিয়েছিলেন, যদিও পরবর্তিকালে তা দ্রুত বিলীন হয়ে গেছে। জ্ঞান চর্চা সে আমলে ছিল অতি সীমিত সংখ্যক মানুষের মধ্যেই। তাই সে সময় মুসলমান শাসন না আসলে জ্ঞানচর্চার খুব উন্নতি হত বলে মনে হয় না। অবশ্য আগেই বলেছি যে আমার জ্ঞান সীমিত। চিন্তা চেতনায় মনে হয় না সে আমলের হিন্দু সমাজ সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের চেয়ে উন্নত ছিল। আপনি কি বলেন?
বর্নপ্রথার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া এচিভমেন্ট হিসেবে কম বলে মনে করি না। তবে এটাও ঠিক যে মুঘল শাসকরা সতীদাহ প্রথা কেউ কেউ নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করলেও পুরো সফল হতে পারেননি। ব্রিটিশের শাসন ছাড়া সম্ভব হত না। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা দেখলে দূঃখের সাথে মাঝে মনে হয় যে ব্রিটিশ শাসন আরো অন্তত ৫০ বছর মনে হয় দরকার ছিল।
– অতি সত্য কথা। দুনিয়ার সব দেশে মনে হয় কোন ধরনের উতসব এলে বাজারে জিনিস পত্রের দাম কমে, ইউরোপ আমেরিকায় মানুষ সারা বছর ক্রিসমাস সেলের জন্য অপেক্ষা করে। আর আমাদের দেশে রোজা রমজান ঈদ এলে হু হু করে জিনিস পত্রের দাম বাড়ে। টুপি দাড়ি মাথায় লাগিয়ে মজুদদারি চোখের সামনেই চলে, আরেক দিকে চলে রমজানের পবিত্র রক্ষা কর শ্লোগানে মিছিল। যারা রোজা রাখেন না বা উপোস করেন না তাদের প্রতি পুরো সমাজের ভয়াবহ ভ্রুকুটি, কখনো যা চলে যায় খুবই আপত্তিকর পর্যায়ে। কালই কাগজে দেখছিলাম রোজা উপলক্ষ্যে ওয়াসার কর্মচারিদের পানি বানিজ্যের খবর। রোজা উপলক্ষ্যে ওনারা গাড়ি প্রতি পানির সরকারী দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন, সুবিধে হওয়ার জন্য এমনকি গাড়ির গা থেকে সরকারী মূল্য ঘষে তুলেও ফেলেছেন। অভিযোগ আছে যে বানিজ্যের মনোপলির জন্য তারা নষ্ট হওয়া পাম্প ইচ্ছে করেই সারাচ্ছেন না। এসব লোকের বাড়িতে গেলেও দেখা যাবে সপরিবারে রোজা রাখছেন, ইফতার শেষ করে হয়ত তারাবি নামাজে দৌড়াচ্ছে।
এর মূল কারন ধার্মিকরা, বিশেষ করে যারা ধর্মকে নৈতিকতার একমাত্র সূত্র বলে মনেপ্রানে দাবী করেন তারা নিজেরাও আসলে জানেন না ধর্মের গন্ডি কোথায়। ধার্মিক বলে দাবীদারদের নিজ স্বার্থ আসলেই ধর্মের বড় বড় কথা বেমালুম বিস্মৃত হয়ে যাওয়া এতই সাধারন ঘটনা যে এই প্রবনতাকে দুয়েকজন করে থাকতে পারে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। এর একমাত্র ব্যাখ্যা এইই যে এসব ধার্মিক আসলে হয় বড় ধরনের ভন্ড আর নইলে নিছক বাপ দাদায় ধর্ম সম্পর্কে যা মাথায় পুরে গেছে তা আইডেন্টিটি রক্ষার স্বার্থে চেঁচিয়ে বেড়ায়, কারন তারা নিজেদের আইডেন্টিটি হিসেবে ধর্মের বিকল্প অন্য কিছু হতে পারে তা চিন্তা করার মত মানসিক অবস্থানে পৌছাতে পারেনি। যারা এসব লোকদের ধর্মের ভাই মনে করে আর নাস্তিক বা অন্য ধর্মের লোকদের লোকদের ভ্রান্ত পথের যাত্রী মনে করে তারাও মানসিকভাবেই পংগু।
@আদিল মাহমুদ,
আমি জেনেছি সাম্প্রতিক দিনাজপুরে মসজিদ নির্মাণকে কেন্দ্র করে যে ঘটনা ঘটেছে, সেই এলাকাটি হিন্দু অধ্যুসিত এলাকা। মুসলমান মাত্র কয়েকটি পরিবার। ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া হামিদা ভানু নামের মহিলাটির আল্লাহর জন্যে এক খানা ঘর বানাবার প্রয়োজন কেন পড়লো বুঝিনা। বলি, ওরে মুসলমান, সারা দুনিয়াটাই তো আল্লাহকে সেজদার জায়গা। আল্লাহর পা পড়ে নাই এমন জায়গা আছে নি জগতে? শুনেছি আরবের মুসলমানেরা নামাজের সময় হলে যে যেখানে যে অবস্থায় থাকে সে অবস্থায় সেখানে নামাজে খাড়া হয়ে যায়। এই ইট পাথরের তৈ্রী, রং-ঢং ছড়ানো ঝমকালো পাকা জায়গায় সেজদা করাটা কি জরুরী? আল্লাহ কি ঘর হারা রিফিউজি হয়ে গেছে যে, তার জন্যে তোরা বাড়ি বাড়ি মসজিদ তৈ্রী করবে? শুনেছি আজকাল বাঙ্গালী মুসলমানেরা না কি ঢাকা শহরকে মসজিদের শহর বলে ডাকেন। ভাল, খুব ভাল। এমন ভাবে মসজিদ বানাও, উঁচু উঁচু মিনার বানাও যে আজানের চটে হিন্দুরা এই দেশ ছেড়ে পালায়।
আহা, ওমর বিন খাত্তাব, খালিদ বিন ওলিদ, ইবনে আবি ওয়াক্কাস। এরা একেক জন চেঙ্গিস খান ছিলেন। আর্লি লাইফে দূর্ধষ সন্ত্রাসী ডাকাত। যখন যৌনম্মাদ আরবিয়ানদের একহাতে ধরা নারী পাগল শান্ডা আর ওপর হাতে বখরি রাখালীর ডান্ডা, পার্সিয়ানদের হাতে তখন দর্শন আর বিজ্ঞান। কী ভাবে হাজার বছরের গড়া সনাতন পারস্য সভ্যতাকে মরুভুমির ডাকাতেরা ধ্বংস করেছিল তা ইরান ইরাকের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে।
দুনোটাই। আত্মিক সম্পর্ক ছিলনা বললে মিথ্যা বলা হবে। তবে বিশ্বাসের মাত্রা ছিল হাফ এন্ড হাফ। আল্লাহ বিশ্বাস করতাম কিন্তু দোজখ আর বেহেস্ত কোনদিনই মানতাম না। দোজখ আর বেহেস্ত মানলে আল্লহকে অপমান করা হয়। আল্লাহ একই সাথে রহমান এবং কাহহার হতে পারেন না, ‘তুমি স্বর্প হইয়া দংশন করো ওঝা হইয়া ঝাড়ো’ এভাবে আল্লাহকে বিশ্বাস করা বোকামী। দোজখের ভয়ংকর অবিশ্বাস্য বর্ণনা আর বেহেস্তের সীমাহীন লোভ আমাকে আল্লাহ বিশ্বাসে সন্দিহান করে তুলেছিল সেই ছোট বেলায়। কিন্তু রাতের আকাশ-নক্ষত্ররাজি পুরোপুরি বিশ্বাসমুক্ত হতে দেয় নি।
@আকাশ মালিক,
দেসে মুসজিন নির্মান নিয়ন্ত্রন সংক্রান্ত কোন আইন নেই। আইনের চোখে কেউ বাকি সব নিয়ম মেনে মসজিদ তৈরী করলে সেটাকে বাধা দেবার কোন উপায় নেই। সে প্রশ্ন তুলে লাভ নেই। আমাদের দেশে মসজিদ মাদ্রাসা নির্মান সমাজ সেবার অংশ হিসেবে স্বীকৃত, আসলেই কি উপকার হল তা নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই।
খলিফা ঊমর পূর্ব জীবনে ডাকাত ছিলেন এমন তথ্যের উতস কি?
ধর্মীয় সাধু পুরুষদের একটি দুর্বল দিক তাঁদের জীবন নিয়ে কেউ বেশিদূর এগুতে চায় না। সাধুদের জীবন চরিত নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করলেও বিশ্বাসীদের কাছে তা কস্মিনকালেও গ্রহণযোগ্য হবে না। আবার ভিন্ন মতাবলম্বীদের কাছে যা মারাত্মকভাবে আদৃত হবে। সাধু পুরুষেরা সত্য প্রচারে ব্রতী থাকেন কিন্তু তাঁদের জীবন সত্য অন্ধকারে থাকে চিরকাল। লেখা মন্তব্য দুটিই ভালো লেগেছে। তবে পোস্টে আরও কিছু রেফারেন্স থাকলে আরও ভাল লাগতো। কিছুটা একপেশে বিশ্লেষণ মনে হয়েছে এই কারণে। হয়তো সাধু পুরুষের জীবন বলেই।
—————————————————————
আধুনিক শব্দটির অপব্যবহার হল। যাহোক, আপনি বরাবরই ইতিহাস সমৃদ্ধ লেখা লেখেন। এটিও এ ধারাবাহিকতার ফল। আশা করি এ ধারা অব্যাহত থাকবে। যারা অনেক বই পড়ে ইতিহাস জানার মত জ্ঞান, সময় ও সুযোগ পাই না, তাদের জন্য এমন লেখা আশির্বাদস্বরুপ।
ভ্রাতা রাজেশ তালুকদার ,
নিরপেক্ষতার দৃষ্টিতে আপনার পোষ্ট খারাপ না । ইতিহাস কখনও এক সাইডের হয় না । আপনার নিজের মন গড়া চিন্তা ভাবনা অন্য-দশজনের মাথায় যে এককেন্দ্রিক ধারনা জন্মাল তা কতটা ক্ষতিকর তা ভেবে দেখেছেন । আজ কিংবা কাল না হয় বহু শতাব্দীতে পরে এর প্রভাব পরবেই , তখন এর জবাবদিহিতা করতে হবে । বহুত কথাই শুনলাম আপনার কাছ থেকে কিন্তু আফসোস উল্লেখযোগ্য কোন রেফারেন্স নাই , নাকি ইদানীং নিজেই ইতিহাস লিখা শুরু করে দিয়েছেন । কোন আদর্শই প্রকৃত আদর্শ নয় , আদর্শ বাস্তবিক রূপ লাভ করতে গেলে সামাজিকতার জন্য অনেক সময় অনেক কাজ করতে দিতে হয় তাতে যদি আপন মানসম্মান কিছুটা কমেও যায় । আরও কিছু , সুফিবাদ কোন ধর্ম নয় এটি কেবল দর্শন মাত্র । যে কেউ এই দর্শনে চলতে পারে । সুফিবাদ জানুন তারপর না হয় কিছু কথা বলুন আর কাউকে যদি আক্রমণ করার প্রবল ইচ্ছা থাকে সেটা ভিন্ন বেপার । নিজের মন গড়া কথা দিয়ে তো আর চিড়ে ভিজবে না ভ্রাতা । মনস্তাত্ত্বিক ভাবে আপনিই এখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন কিছুটা ।
বিঃদ্রঃ আপনার জন্য সূফীবাদের একটি কী ওয়ার্ড দিয়েছি (আমার নিক) , একটু ব্যাখ্যা চাইছি বৈজ্ঞানিক উপায়ে কারণ উহা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সাথে একেবারেই যায় । ধন্যবাদ লেখাটি উপহার দেবার জন্য ।
@আলমে আরোয়া,
ভাই আমার লেখায় কোথাও আমি তো সুফীবাদ ভালো না মন্দ সে বিষয়ে আলোকপাত করি নি। মুদ্রার অপর পিঠের মত চিস্তির যে আরেকটা পিঠ ছিল তা তুলে ধরতে চেয়েছি মাত্র। তাঁর জীবন বিশ্লেষণে তিনি ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে সবাইকে আপন করে নিতে পেরেছেন সেই প্রমাণ তো মিলে না! যদি পারতেন তা হলে ধর্মান্তরের প্রশ্ন আসে কেন? তাঁর মক্কা মদিনায় ভ্রমণের উদ্দেশ্যই বা কি? ইসলামের মূল স্রোত সৌদিতে সুফিবাদের কোন প্রচার নাই কেন? আপনি সুফীবাদকে সত্যি দর্শন মনে করলেও চিস্তি সহ অন্যান্য সুফীরা তা মনে করেন না তাঁরা সবাই সুফীবাদকে নিয়েছিলেন একটি সুর্নিদিষ্ট ধর্মের অনুসঙ্গ হিসাবে।
বিষয়টা কি একটু খোলাসা করবেন?
@রাজেশ তালুকদার,
এ রকম লেখার, অজানাকে জানার দরকার আছে সে যতই রূপকথার মত শোনায় না কেন। কথা উঠেছে সুফিজম নিয়ে। জালাল উদ্দীন রূমী পড়েছি, পড়েছি বিবেকানন্দও। রূমী ডাক দিয়েছেন- তোরা এসো ধর্ম বর্ণ, আস্তিক নাস্তিক, বিশ্বাসী অবিশ্বাসী নির্বিশেষে, বিবেকানন্দ মুসলমানের মসজিদে যান সাম্যের বাণী শোনাতে। কিন্তু বেলা শেষে রূমী একজন মুসলমান আর বিবেকানন্দ একজন হিন্দু।
এই সুফিদের নিয়ে যত আজগুবি কাহিনি লেখা হয়েছে, দুনিয়ার কোন ‘ঠাকুর মার ঝুলি’ এর তুলনা হয় না। মইনুদ্দিন চিশ্তির কাছে হ্যারি পটার, স্পাইডার ম্যান, ব্যাট ম্যান, সুপার ম্যানরা ড্যাম ফেইল্ড। মইনুদ্দিন সাগরের জলকে আদেশ করেন- সাগর শুকিয়ে যায়, সাপে কাটা মৃত ব্যক্তিকে হুকুম করেন- আমার আদেশ তুমি জেগে উঠো। মৃত ব্যক্তি হেসে জেগে উঠে। উটকে মাটিতে সুপার গ্লু দিয়ে বসিয়ে রাখতে পারেন, উটরা উঠতে পারেনা। এখানে কারবারটা দেখেন –
httpv://www.youtube.com/watch?v=HhFAPmsy-HI&feature=related
নিন্দুকের কথায় মাননীয় ব্যাক্তির মান কমে না।উত্তরুত্তর বাড়তেই থাকে।চালিয়ে যান।
আব্দুল কাদির এর সাথে মইনুদ্দিন চিশতির কখনই সাক্ষাৎ হয় নি।
মইনুদ্দিন যাহাই করুক না কেন,ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একটি মোটা অঙ্কের জনসংখ্যা তাঁকে শ্রদ্ধা করে।আপনার মত কিছু লোকের অশ্রদ্ধা তাঁকে আর ও সম্মানের শিখরে দ্রুত পৌঁছাতে সাহায্যই করবে।
সত্য সহায়।গুরুজী।
@সিরাজুল ইসলাম,
ভাই আপনে কি b.tv তে জব করেন।
@রাজেশ তালুকদার, আপনার দু’টো লেখা থেকে দু’জন সম্পর্কে জানতে পারলাম। খাজা নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার ইতিহাস জানি। সিলেটের শাহজালাল সম্পর্কে বিক্ষিপ্তভাবে জানি। আরও জানার অপেক্ষায় থাকলাম। আপনি পারেন-সে অক্ষমতা দুর করতে। ভালো থাকবেন। (F)
@অসীম,
মুক্তমনায় লেখার শুরুতেই আমার একেবারেই কাচা হাতের একটি লেখা আছে শাহজালালকে নিয়ে। লেখা লেখি অনেক বছর চর্চা না থাকায় সে লেখায় বানান সমস্যা ছিল প্রচুর, ছিল বাক্য বিন্ন্যাসে আসঙ্গতি, টেকনিকে ছিলাম দূর্বল। স্বভাবতই মুক্তমনার বোদ্ধা লেখক পাঠদের প্রচুর গঠন মূলক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে সে সময়। যে কারনে লেখাটির লিঙ্ক দিতে লজ্জা বোধে ভুগি।
ভুল ত্রুটি যদি উপেক্ষা করতে পারেন তা হলে একটি বার চোখ রাখতে পারেন এখান
ধন্যবাদ।
আমি আজমীরে দেখেছি মানুষের বিশ্বাস কতখানি অন্ধ হতে পারে আর একই সাথে সে বিশ্বাসকে পুঁজি করে আর একদলের ব্যবসা।
ভালো লেগেছে আপনার লেখা।
পড়ে খুবি ভালো লাগলো।অনেক কিছু জানা গেল।সুফীবাদ তবুও মৌলবাদের থেকে ভালো।বোমাবাজী বা সাম্প্রদায়িকতার উসকানিটা থাকেনা বললেই চলে।মুসলিমরা যতই চিস্তি সাহেবকে আধ্যাত্মিকতার শীর্ষে নিয়ে যাক তাঁর মানবতার জন্য রেখে যাওয়া তেমন কোন কাজ খুজে পাই নি, যেমনটা পাওয়া যায় মাদার তেরেসা থেকে। নিজ ধর্মে অটুট থেকেও এই মহীয়সী নারী সেবা দিয়েছেন সকল ধর্মের ও বর্নের মানুষকে।
আপনার ওপর এখন একটা চাপা ক্ষোভ আছে। :guli: যীশুর জন্ম কাহিনী লিখতে যেয়ে সেই যে হাইড্রোলিক ব্রেক চাইপা ধরলেন আর ছাড়লেননা। এখনো ওটার অপেক্ষাতে আছি।
@ছন্নছাড়া,
আলসের যানে চড়ে যে ঘুড়ে মরছি! আপনার তাড়া খেয়ে দেখি ২০১২ মধ্যে নামিয়ে দিতে পারি কিনা। হা হা হা
উৎসাহিত করার জন্য ধন্যবাদ।
লেখাটি সত্যিই তথ্যবহুল ও প্রামাণ্য। পীর দরবেশ সুফিদের মাজার ইসলাম ধর্মের মূলানুসারি নয়। তাই আরব অঞ্চলে কোন পীরের ভাত নেই। কেউ পীর দাবি করলেই তাকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে ও হবে। রচনাটির জন্য লেখককে ধন্যবাদ। বাংলাদেশের পীরদের সম্পর্কেও এমন নির্মোহ লেখা দাবি করছি।
আপনারা ভাষ্য অনুযায়ী সুফিরা হিংস্র রক্তলোলুপ সন্ত্রাসী ছিল না বলে যে ধারণাটি প্রকাশ করা হয়েছে তা পুনর্বিশ্লেষণের জন্য বদ্বীপ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এম. এ খানের লেখা ‘জিহাদ’ বইটি দেখার জন্য অনুরোধ করছি। মুক্তমনাতে আবুল কাশেমের এ বিষয়ে লেখা আছে।
@মুক্তা,
ধন্যবাদ আগ্রহ প্রকাশ করার জন্য। এর আগে “বায়েজিদ বোস্তামী নিয়ে কিছু কথা” নামে আরেকটি পোষ্ট লিখেছিলাম। পড়তে চাইলে দেখতে পারেন এখানে
পোস্ট পড়লাম; ইতিহাস জানার ব্যাপারে আমার আগ্রহ আছে, সেই প্রেক্ষাপটে দারুণ; অন্যদিকে সূফীবাদ সম্বন্ধেও আমার জানার ইচ্ছে আছে। সব মিলিয়ে পোস্টটি ভালো লেগেছে- যদিও ইতিহাসের রঙ বাদ দিলে হিশেব অন্য রকম হতে পারতো।
@শনিবারের চিঠি,
ইতিহাসের রং বদলাতে কসরত তো কম হয় নি। চিপা চাপার ফাঁক গলে ইতিহাস কিন্তু ঠিক মাথা তুলে বেড়িয়ে পড়ছে। হিসাবটা নতুন করে শিখতে হচ্ছে এখন।
ধন্যবাদ সঙ্গে থাকার জন্য।
আজমীর শরীফ আমাদের দেশের ধার্মিকতার অন্যতম এক উপাদান। সেই আজমীর শরীফকে জানার ইচ্ছা ছিল অনেক দিন ধরেই। জানার সেই ক্ষুধা মেটানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ! আপনি আরো নিয়মিত লিখলে আমাদের নিত্য ক্ষুধিত মস্তিষ্ক কিছুটা ক্ষুরধার হয়ে উঠার সুযোগ পেত বলে মনে হয়।
@কাজি মামুন,
আপনি জানার ইচ্ছা প্রশমিত হয়েছে দেখে স্বস্তি পেলাম
আলসিকে সময় দিতে হয় নিয়মিত। তাই লেখা হয়ে উঠে না :))
ও, হ্যা বায়েজিদকে জেনেছেন নিশ্চই। না জানলে লেখার শেষে লিঙ্ক জুড়ে দিয়েছি। দেখতে পারেন অথবা মুক্তার করা মন্তব্যের প্রতিউত্তরের লিঙ্ক দেখতে পারেন।
(Y)
আপনার লেখাটি পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম।তবে আমার কিছু কনফিউশন আছে।আমার মতামত সহ উল্লেখ করছি।ভুল থাকলে ধরিয়ে দেবেন দয়া করে।
এই যুক্তির বিরূদ্ধে আমার প্রথম স্বীকার্য হচ্ছে, ১) কেউ ওলা বিবিতে অন্ধ-বিশ্বাস করলে আমি জোর করে তাকে বাঁধা দেবো না যতক্ষণ না অন্য কেউ এই অন্ধ-বিশ্বাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।আমি বড়জোড় তাকে বুঝিয়ে বলতে পারি যদি সে আমার কথা শুনতে রাজি হয়।
এই স্বীকার্যের উপর দাঁড়িয়ে থেকে আমি সাঈদীর সমালোচনা করবো;কারণ- সাঈদীরা উস্কানীমূলক কথা বার্তা বলে একটি সাম্প্রদায়িক দাংগা লাগানোর অপচেষ্টায় আছে যেটা করতে পারলে তাদের লাভই হবে বেশী।এটি একটি সম্পূর্ণ ঘৃণ্য রাজনৈতিক অপচেষ্টা। জাকির নায়েক ইসলামী শরীয়া ভিত্তিক সমাজ কায়েম করতে আগ্রহী।আমি জাকির নায়েকের অন্ধ-যুক্তির সাথে একমত নই।
চিশতি বা অন্য সূফী সাধকেরা, আপনার মতে, একইরকম হিংস্র,শুধু সময় ও প্রতিবেশের কারণে তাদের হিংস্রতা প্রকাশিত হয়নি। এ দাবীর প্রামাণিকতা কোথায়?আপনি কী রেফারেন্স দিয়ে দেখাবেন কোথায় চিশতি সাম্প্রদায়িক দাংগা লাগানোর ব্যবস্থা করেছে?
তো এখানে নৈতিকতার পরাজয় বা মননশীলতার অ-বিকাশের কী চিহ্ন আপনার চোখে পড়লো?এটা কী বৈজ্ঞানিক যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত যে, আশি বা একশো বছর বয়সে বিয়ে করলে সে ব্যক্তি আর নৈতিক থাকেন না না-কি আপনার চারপাশের সংস্কৃতি ও মধ্যবিত্তীয় সংস্কার দ্বারা নির্ধারিত ও সংজ্ঞায়িত?আপনি কী সেই সময়ের ভারতের উত্তরাঞ্চল ও পশ্চিম-উত্তরাঞ্চল এবং ইরান ও আফগানিস্থানের বিয়ে সংক্রান্ত নৈতিক মানদন্ড কী ছিলো একটু দেখাবেন?
আপনার এই যুক্তির বিরোধীতায় আমার প্রপোজিশন হলো, আমি ধর্মকে ‘সংস্কৃতির’ অংগ বলে মনে করি।এর মানে কিন্তু আবার এটা বুঝাচ্ছি না যে ভবিষ্যতে যখন ধর্ম থাকবে না তখন সংস্কৃতিও থাকবে না।কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এ পর্যন্ত ধর্ম বেড়ে উঠেছে সংস্কৃতির কাঠামোর মধ্যে।আমি এই বাস্তবতা ধরে কথা বলছি।
প্রশাসন বদল হলে রাজ অনুগ্রহের লোভে লোকে প্রশাসনের ধর্ম গ্রহণ করে, এই যুক্তি খুব একটা খারাপ যুক্তি না।কিন্তু আপনি কী দয়া করে ভারতে বৌদ্ধ ও অন্ত্যজ-বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উত্থানের ধারা বিশ্লেষণ করবেন?ঠিক কোন যুক্তিতে সাধারণ মানুষ বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলো?পাল আমলে সহ্য করেছিলো নির্মম নির্যাতন?হিন্দুদের মধ্যকার যে শ্রম-বিভাগ(যার উপরিকাঠামো হচ্ছে বর্ণ-বিভাগ) তা ঠিক কতোখানি সমাজের লোকজন মেনে নিয়েছিলো?আপনার কী মনে হয় না একটা আলাদা বিকল্প পাওয়ার পর ওরা ঐদিকে চলে গেলো যেখানে কীনা অন্ততঃ আপাতদৃষ্টিতে কোন ছুৎ-অচ্ছুৎ এর ব্যাপার নেই?আপনি আমাকে আশরাফ আতরাফের যুক্তি দিতে পারেন।অনেকেই দেয়।কিন্তু সেটা ইসলামের মূল বই ও যেকোন প্রকার ভাষ্য দ্বারা স্বীকৃত নয়।ফলে আশরাফ আতরাফের ব্যাপারটি লোকজন খারাপ চোখে দেখলেও তাদের টেক্সটকে ঐভাবে দেখে নি।কিন্তু হিন্দুদের নানা টেক্সটে ব্যাপারটি দেখা যায়।তাই আমি মনে করি না, যে একটি বিশ্বাস তা যতোই ভুল হোক সেটা যদি জনগণের মনে গ্রথিত না হয় তাহলে তা কখনো সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠতে পারে না।ইসলাম যে এখানকার জনমানসের মনে গ্রথিত হয়ে টিকে আছে এর পেছনে আছে এর সূফীবাদ দ্বারা সংস্কারায়িত রূপের বিস্তার।
এটা ধর্মীয় গুরূদের বেলায় সত্য হতে পারে।কিন্তু এটি সূফীদের ব্যাপারে সত্য নয়।সূফীবাদ অনেকাংশে এবং কোন কোন ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে ছিলো ইস্টাব্লিশমেন্টের বিরোধী।এজন্য এদেরকে ব্যাপক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।উদাহরণঃ মনসুর হাল্লাজ ও তাঁর অনুসারীরা কিংবা খৈয়াম কিংবা সাদী।এদেরকে রাষ্ট্র কখনো ভালো চোখে দেখেনি।
তরবারির জোরে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে ঠিক।কিন্তু তার যে ‘সাংস্কৃতিক কাঠামো’ গড়ে উঠেছে যার মধ্যে অনেক অনৈসলামিক উপাদান আছে সেটা তো তরবারির জোরে হয়নি।আর আপনি পরিসংখ্যান দেখুন, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আমলেও শতকরা হিসেবে হিন্দুর সংখ্যা বেশী ছিলো।তো এবার বলুন কেন শুধু নিম্নশ্রেণীর কিছু অংশ,যাদের সাথে শাসকদের কোন সংস্রব ছিলো না কিংবা যারা শাসকদের কাছ থেকে কোন অনুগ্রহ পেতো না,তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে?(মনে রাখতে হবে, ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা এক দিনে বাড়েনি এবং তা হিন্দু জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে যায় নি ভারতবর্ষে;অর্থ্যাৎ এটা ধীরে ধীরে স্থায়িত্ব পেয়েছে)
তো এই কাজ কেউ করলে আমার সমস্যা কী!এরা তো আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধাচ্ছে না।
জরথ্রুস্ট এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী-এটা বিতর্ক সাপেক্ষ ব্যাপার।আমি আপনাকে রেফারেন্স দিচ্ছি, জেন্দাবেস্তয় (যেটা কীনা ঋকবেদ -এর পরবর্তী অথবা অগ্রবর্তী সংস্করণ) ইন্দ্র বরূণ মিত্রের মতো দেবতাদের উল্লেখ আছে। সুতরাং আপনি শুধু ‘আহুরা মাজদা’র কথা মাথায় রেখে ওরকম কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারেন না।যেমন পারেন না, ‘ভগবান’ বা ‘ঈশ্বর’ শব্দটি মাথায় রেখে সনাতন ধর্মকে ‘একেশ্বরবাদী’ প্রমাণ করতে।
ধন্যবাদ।
@মাহমুদ ইমরান,
@অসীম, আপনি এইটা দিয়া কী বুঝাইতে চাইলেন?আমি কিছু বুঝি নাই। এইটা কী দাঙ্গার রেফারেন্স টানলেন?এইটা কী উপন্যাস? যদি তা হয় তবে আমার প্রশ্ন উপন্যাস কী ‘রেফারেন্স?’আপনি রেফারেন্স হিসাবে উপন্যাসরে টানলেন কেন?আর এই উপন্যাসের ইতিহাস কে বলছে? অথবা এই বইয়ের ইতিহাস কে বলছে?যাযাবর তো ইতিহাসবিদ নন।তো আপনি ভবিষ্যতে যাই লিখবেন, প্রামাণিক লিখবেন।আর লিখার আগে সূফীবাদ আউলিয়া সম্বন্ধে জাইনা নেবেন আশা করি
@মাহমুদ ইমরান,পর্দার অন্তরালে কি ঘটেছিল সেদিন…নিশ্চয়ই না বোঝার কথা নয়। আর না বুঝলে বইটা পড়ে নিলে ল্যাঠা চুকে যায়।
উপন্যাসেও ইতিহাস পাওয়া যায়।
রাজেশ তালুকদারের এই লেখা তো একটা বড় প্রমাণ। সিলেটের শাহজালালের ইতিহাসটা জেনে নিতে পারেন। অন্যকিছু পেলে,সময়ে মুক্তমনায় লিখে জানাবো। ধন্যবাদ।
@মাহমুদ ইমরান,
পড়ে সুদীর্ঘ একটা মন্তব্য প্রকাশের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
হাতে বেশি সময় নেই, সংক্ষেপে সরাসরি আপনার মতদ্বৈতার বিষয় গুলো নিয়ে খানিকটা আলোচনায় আসি-
জোর করে কারো বিশ্বাসে বাধা দেয়া বা কাউকে হেয় করা কোন সভ্য দেশ বা শিক্ষিত জাতি কখনো সুনজরে দেখে না। তা সভ্যতা পরিপন্থিও বটে। তবে অন্ধ বিশ্বাস লালন সব সময় ক্ষতিকারক। অন্ধ বিশ্বাসের কারনেই সমাজে নানান কুসংষ্কারের জন্ম দেয়, সৃষ্টি হয় অজ্ঞতা প্রসূত জাতি। সমাজ উন্নয়নে যা কোন দেশ বা জাতিকে পিছিয়ে দিতে পারে কয়েকশ থেকে কয়েক হাজার বছর।
ভাই আমি তো লেখায় কোথাও এই উদ্ভট দাবি করিনি। তবে হ্যাঁ চিস্তি ধর্মান্তরিত কাজকে ফরজ মনে করে যাদের ধর্মান্তরিত করেছিলেন তাদের সুযোগ্য বংশ ধরেরা দাঙ্গা ফ্যাসাদের জন্য মোটেই কখনো দায়ী ছিল না একথা কি আপনি জোর দিয়ে বলতে পারেন?
ভাই করিম উদ্দিন, রহিম উদ্দিন বা সুবল দাস যদি এই বিয়ে করে সমাজে তার প্রভাব খুব একটা পরে না কিন্তু কোন নবী, পীর সুফী বলে কথিত কোন পবিত্র মহা পুরুষ যদি এরকম বিয়ে করে সমাজে তার খারাপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। কারন তারা আইডল। সমাজের বহু লোক তাদের জীবন অনুসরন করে করে। একবার কি ভেবে দেখেছেন অকাল বিধবাদের জীবন জ্বালা? অপ্রসাঙ্গিক হলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি নবীর জীবণ আদর্শ অনুসরণ করতে গিয়ে ইসলামী অনেক দেশে বৃদ্ধের শিশু বিয়ে জায়েজ। বিষয়টা কতটুকু নৈতিক?
আমিতো এই মতকে খন্ডন করি নি। আমি শুধু দেখাতে চেয়েছি ঘুরির ভারত দখল হিন্দুস্থানে ইসলামের রুদ্ধ দ্বার খুলে দিয়েছে। এতে তলোয়ারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও যে অনস্বীকার্য ছিল।
বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারের পিছনে তৎকালীন নৃপতি গণের শীতল ছায়াকে অস্বীকার করার উপায় নেই তবে একথা সত্য কোন বৌদ্ধ নৃপতি তাঁর অনুসারিত ধর্ম প্রজাদের উপর চাপাতে চেষ্টা করেনি। তাদের ধর্মনিরপেক্ষ উদার ভূমিকার কারণে ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্ম সহজেই লুপ্ত হয়ে পড়েছে অন্যদিকে অতি
রক্ষনশীলতার উপর ভর করে হিন্দু ধর্ম আজো টিকে আছে ভারতে। একি কথা ইসলামের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
উদারতা নিয়ে সুফী বাদের স্থায়িত্ব ছিল স্বল্প। কারণ সুফীবাদ প্রকৃত ইসলাম নয়। সুফিরা দাঙ্গা বাজায় নি সত্য তবে গোঁড়ামি পূর্ণ ইসলামী মতবাদ ছড়াতে পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে।
ধর্ম মানুষের চিন্তা চেতনা ক্রম পরিবর্তনের ফসল। শ্বাসত কিছু নয়। হিন্দু দর্শনের শুরুতে মহাশক্তি ধর “ভগবান” নামে কারো উপস্থিতি ছিল না। বহু দেবতাবাদ বিশ্বাসের দূর্বলতা ঢাকতেই আমদানি করতে হয় ভগবান মহাশয় কে। একি প্রক্রিয়া অনুসৃত হয়েছিল জরথ্রুস্ট মতবাদে। বহু সময় সাপেক্ষ জটিল ধাপ পেরিয়ে এক সময় বহু দেবতা বাদ থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে এক দেবতা বাদ কল্পনার সূচনা করে।
ভালো থাকুন।
@মাহমুদ ইমরান,
হাস্যকর কথা। কোন জিনিসকে যদি সব সময়ের মান দন্ড ধরা হয় তাহলে তা যে কোন সময় সাপেক্ষেই পরীক্ষায় উতরে যেতে হবে। কোন গ্রন্থ তা যে সময়ের ই হোক না কেন তা যদি ঐশ্বরিক ও সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য ধরা হয় তাহলে যে কোন শর্ত সাপেক্ষে এর একটি ত্রুটি ই যথেষ্ট একে বাতিল করার জন্য।
চিস্তি সাহেব যে সময় যে কাজ করেই থাকেন না কেন তার আদর্শ সব সময় চলার উপযোগী হয়া উচিত। অতীতে তার মাজার জিয়ারত হতো এখনো হয়। তাই অতীত বা বর্তমানের যে কোন শর্তেই যদি উনি ফেল্টুস হোন তাহলে তিনি বাতিলের খাতায় যাবার যোগ্য।
কেউ যদি নিজের প্রভাব খাটিয়ে মেয়ের বয়সী কচি মেয়েকে বিয়ে করেন সেইটা আপ্নার যে প্রি-/প্রো/ পোস্ট মর্ডানিজমের পাল্লায় ফালান তা ঐ লোকের মানসিক সুস্থতার প্রশ্ন তোলে বৈকি।
@অগ্নি,
রাজেশ তালুকদারকে প্রশ্ন করে আপনার কাছ থেকে উত্তর পাওয়া যায় ব্যাপারটা বেশ অদ্ভূত ঠেকছে।যাউকগা আমি কবে আবার প্রি প্রো আর পোস্ট মডার্নিজম নিয়া আসলাম?এইসব আমি বুঝি না।এইসব কথাতো আমি বলি নাই।আপনে বেহুদাই কথা আমদানী করলেন কইত্থেইকা?আমদানী করলেনই যখন তয় কিছু কথা কই। মানুষিক সুস্থতা কারে বলে ভাই?এইটার মানদন্ড কী?এইটার লগে ক্ষমতার সম্পর্কটা একটু বিচার কইরা দেখবেন না?আর ক্ষমতার লগে ক্ষমতার উৎস উৎপাদন ব্যবস্থার সম্পর্ক তারপর পরিবার ও এর গঠন বিন্যাস এবং এর সংজ্ঞা কী ছিলো এইসব দেখবেন না?নাকি জাস্ট একটা জাম্প দিয়া হেভি প্রগতিশীল সাইজা যাইবেন?ব্যাসদেব যখন তার কল্পিত চরিত্রগুলার লগে অবৈধ সংগম করে করে এক্কেবারে কুরূক্ষেত্রের দুইটা দল বানাইয়া দিলো তখন ব্যাসদেবরে গালি দিবো নাকি সেই সময়ের পরিবার সম্পর্ক সম্বন্ধে আগ্রহী হবো সেইটাও দেখার বিষয়।কিংবা রাধা যখন নাকি প্রেম করতেছিলো তারই ভাইগনা কৃষ্ণের লগে?গোপীবালা?বা আদম যখন হাওয়ার সাথে সংগম করলো? এবং তাদের সন্তান সন্ততিরা করলো নিজেগো মইধ্যে?কিংবা রবীবাবু যখন বিয়া দিয়া দিলো তার কিশোরী মাইয়াগো?তহন কোন জায়গায় দাঁড়াইয়া আমি ক্রিটিসাইজ করমু।আমি বলবো যে, এখনকার আমাদের মানদন্ডে এইটা ঘৃণ্য এবং খারাপ;তবে ওদের সময়(কেউ কেউ মানদন্ড চেঞ্জ করতাছিলো যদিও) সেই পুরানা মানদন্ডই রইয়া গেছিলো।আমি তো জাস্টিফাই করার কতা বলি নাই
এইটার সাথে আমি একমত না।এইটা কী একটা যুক্তি!!!নাকি আপনের দাবি?
জ্বি।ঐটা ওই সময়ে উতরে গেছে এইটা যেমন আপ্নেরে কইতে অইবো ঠিক তেমনি এইটাও কইতে অইবো যে ঐটার আবেদন এখন আর নাই।এখন আমাদের চিন্তা ভাবনা ঘুইরা গেছে।আমরা আধুনিক হইয়া গেছি!
@মাহমুদ ইমরান,
সূফীবাদ সম্পর্কে এম.এ. খানের লেখা “জিহাদ” অনুবাদ ব-দ্বীপ প্রকাশনা। (বইটি পড়লে পরিষ্কার বুঝতে পারবেন সূফীবাদ কি আসলেই শানি-পূর্ণ ছিলো?) বইিটির ৪নং অধ্যায় ”সূফীবাদের উৎস” থেকে কিছুটা তুলে ধরা হলো।
ভারতীয় সূফীগণ
কিছু কিছু সূফী সম্পূর্ণরূপে ইসলামের পথ থেকে বিচ্যুত হলেও অধিকাংশই গোঁড়া বা মূলপন্থী থেকে যায়। দ্বাদশ শতকে গাজ্জালী মুসলিম সমাজে সূফীবাদের বিজয় ঘটাতে সক্ষম হন। তিনি মূলত ভ্রষ্ট ধারণা ও আচারসমূহকে অপসারিত করে সূফীবাদের দেহে ইসলামী গোঁড়ামিকেই বুনে দিয়েছিলেন, যার ফলে সূফীবাদ মুসলিমদের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা পায়। সুতরাং ইমাম গাজ্জালীর কারণে সূফীবাদের গোঁড়া অংশটাই মুসলিম সমাজে স্বীকৃতি পেয়েছিল। পথভ্রষ্ট বেশরীয়া সূফীদেরকে নানা নির্যাতন ভোগ, এমনকি মৃত্যুবরণও করতে হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, উগ্র গোড়া ইসলামী শাসক সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক (মৃত্যু ১৩৮৮) তার স্মৃতিগ্রন্থে লিখেছেন যে, ‘তিনি দিল্লীর শেখ রুকনউদ্দিনকে আটক করেছিলেন, যিনি নিজেকে মাহদী (মেসিয়াহ) বলে ঘোষণা করেন এবং তিনি অতীন্দ্রিয় চর্চা ও বিকৃত ধারণার দ্বারা জনগণকে বিপথে পরিচালিত করছিলেন এটা বলে যে: তিনি সে রুকনউদ্দিন, যিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি।’ জনগণ রুকনউদ্দিন ও তার কিছু ভক্তকে হত্যা করে; তারা ‘তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ও তার হাড় ভেঙ্গে খণ্ড খণ্ড করে।’
ভারতে মধ্য-এশীয় তুর্কীরা যখন সরাসরি মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করে (১২০৬), তখন গাজ্জালীর খাঁটি বা কট্টর সূফীবাদ মুসলিম সমাজে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল এবং মুসলিম হামলাকারীদের পথ ধরে ভারতে সূফীদের আগমন ঘটে ব্যাপকভাবে। ভারতের বিখ্যাত সূফী দরবেশ – যেমন নিজামউদ্দিন আউলিয়া, আমীর খসরু, নাসিরুদ্দিন চিরাগী, খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তী ও জালালুদ্দিন – এরা সবাই গোড়া ও অসহিষ্ণু মতবাদী ছিলেন। তারা গোঁড়া ইসলামী পণ্ডিত বা উলেমাদেরকে উচ্চ মূল্য দিতেন এবং তাদের শিষ্যদেরকে ধর্মীয় আইন ও সামাজিক আচরণ সম্পর্কে উলেমাদের রায় অনুসরণ করে চলার পরামর্শ দিতেন। বিখ্যাত আরব-স্প্যানিশ সূফী চিন্তাবিদ ইবনে আরাবীর (মৃত্যু ১২৪০) গোঁড়ামিহীন বিতর্কিত মতবাদ ও চর্চায় প্রভাবিত হয়ে ভারতীয় সূফীদের মধ্যে মঈনুদ্দিন চিশতী ও নিজামুদ্দিন আউলিয়া ছিলেন তুলনামূলক অগোড়া ও উদারপন্থী। গোড়া মুসলিমদের বিরক্ত করে তারা তাদের সূফী ধর্মীয় আচার-প্রক্রিয়ায় বাদ্যপর্ব (সামা) ও নৃত্য (রাক্স) প্রবর্তন করেন। কিন্তু ইসলামের প্রকৃত রীতি-নীতির প্রশ্নের মুখোমুখি হলে তারা কখনোই মূল গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যান নি এবং ধর্মীয় ব্যাপারে সর্বদাই উলেমাদেরকে অগ্রগণ্য মনে করতেন। সূফী দরবেশদের প্রবর্তিত নৃত্যগীত ও বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা অনুমোদনযোগ্য কিনা সে প্রশ্নে আউলিয়া বলতেন: ‘যেটা আইনে (শরীয়া) নিষিদ্ধ, সেটি অগ্রহণযোগ্য।’ সেকালে বিতর্কিত সূফীদের ভজন বা ভক্তিমূলক গান অনুমোদনযোগ্য কিনা, সে প্রশ্নে তিনি বলেন: ‘বর্তমানে এ বিতর্কের ব্যাপারে বিচারক (অর্থাৎ কাজী, সাধারণত গোড়া প্রকৃতির) যে রায় দিবেন, তাই কার্যকর হবে।’
শ্রেষ্ঠ সূফী চিন্তাবিদ গাজ্জালী জিহাদ সম্পর্কে গোঁড়া ও সহিংস মত পোষণ করতেন। তিনি তার অনুরাগী মুসলিমদের উপদেশ দিতেন:
“বছরে অন্তত একবার জিহাদে অবশ্যই যেতে হবে। দুর্গে অবস্থানকারীদের মাঝে নারী-শিশুরা থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে গুলতি ব্যবহার করা যেতে পারে। অগ্নিসংযোগ করে তাদেরকে পুড়িয়ে কিংবা ডুবিয়ে মারা যেতে পারে। তাদের গাছপালা কেটে ফেলা যেতে পারে। তাদের অতি প্রয়োজনীয় গ্রন্থ (বাইবেল, তৌরাত প্রভৃতি) অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে। জিহাদীরা লুণ্ঠিত মালামাল (গণিমতের মাল) ইচ্ছে অনুযায়ী গ্রহণ করতে পারে।
জিম্মি কর্তৃক অবমাননামূলক ‘জিজিয়া’ কর প্রদান সম্পর্কে তিনি লিখেছেন:
ইহুদী, খ্রীষ্টান ও মাজিয়ানদেরকে অবশ্যই ‘জিজিয়া’ দিতে হবে। জিজিয়া প্রদানকালে জিম্মি তার মাথা ঝুলিয়ে দিবে এবং সরকারি কর্মচারী জিম্মির দাড়ি ধরে কানের নিচের স্ফীত স্থানে আঘাত করবে।
তিনি ‘ওমরের চুক্তি ও শরীয়া-প্রতিষ্ঠিত নিয়মের আলোকে জিম্মিদের ক্ষেত্রে কতকগুলো অক্ষমতা নির্দিষ্ট করেন। তিনি লিখেছেন:
তারা খোলাভাবে মদ্যপান করতে ও চার্চের ঘণ্টা বাজাতে পারবে না… তাদের ঘর মুসলিমদের ঘরের চেয়ে উঁচু হবে না, তা ‘যত নীচুই হোক। জিম্মিরা চমৎকার কোনো ঘোড়া বা খচ্চরে চড়তে পারবে না; তারা কেবল কাঠের গদী সম্বলিত গাধার পিঠে চড়তে পারে। তারা রাস্তার ভাল অংশ দিয়ে হাঁটতে পারবে না। তাদেরকে তালি দেওয়া জামা-কাপড় পরতে হবে। এমনকি সরকারী গোসলখানাতেও তাদেরকে মুখ বন্ধ রাখতে হবে।
বিশিষ্ট ভারতীয় সূফীগণ বিধর্মী কিংবা জিহাদের বিষয়ে ব্যাপক কোন মন্তব্য বা লেখা রেখে যান নি। তবুও ছোটখাটো সুযোগ পেলেই এসব বিষয়ে তারা যেসব ছিটেফোঁটা মন্তব্য করে গেছেন, তা এসব ব্যাপারে তাদের চিন্তাচেতনার ইঙ্গিত দেয়। সামগ্রিকভাবে অবিশ্বাসী ও জিহাদের ব্যাপারে তাদের ধারণা ছিল অনেকটা শ্রেষ্ঠ সূফী সাধক গাজ্জালীর অনুরূপ।
নিজামুদ্দিন আউলিয়া (১২৩৮-১৩২৫): নিজামুদ্দিন আউলিয়া গোঁড়া মুসলিমদের মতামত অবলম্বনে হিন্দুদেরকে নরকের আগুনে পোড়ার জন্য অভিশপ্ত করেন। তিনি বলেন: ‘বিধর্মীরা মৃত্যুকালে শাস্তি পাবে। সে মুহূর্তে তারা ইসলামকে সত্য বলে স্বীকার করবে, কিন্তু তাদের তখনকার সে বিশ্বাস গ্রহণযোগ্য হবে না; কারণ সেটি হবে না অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস। সুতরাং একজন বিধর্মীর মৃত্যুকালীন বিশ্বাস অগ্রহণযোগ্য থেকে যাবে।’ তিনি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন: ‘পুনরুত্থানের দিন বিধর্মীরা শাস্তি ও নিদারুণ যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়ে ইসলাম গ্রহণ করবে, কিন্তু তা কোন কাজে আসবে না। তারা নরকেই যাবে, যদিও বিশ্বাসী হিসেবে।’ তার ‘খুৎবা’য় নিজামুদ্দিন আউলিয়া বিধর্মীদেরকে অপকর্মকারী পাপী হিসেবে নিন্দা করে বলেন: ‘আল্লাহ বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীদের জন্য যথাক্রমে স্বর্গ ও নরক সৃষ্টি করেছেন, পাপীদেরকে তাদের অপকর্মের প্রতিদান দিতে মাত্র।’
অমুসলিমদের বিরুদ্ধে জিহাদ সম্পর্কে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার চিন্তাভাবনা কুরআনের প্রথম ‘সূরা ফাতিহা’ সম্পর্কে তার বিবৃতি থেকে পাওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন: সূরা ফাতিহায় ইসলামের দশটি মৌলিক ভিত্তির মধ্যে দু’টি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তা হলো: ‘অবিশ্বাসীদের সাথে যুদ্ধ করা এবং স্বর্গীয় বিধিবদ্ধ আইন প্রতিপালন করা।’ এবং সে মুতাবেক হিন্দুদের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে নাসিরুদ্দিন কিবাচার বিজয়ে তিনি সাতিশয় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন এবং তার শিষ্য শাহ্জালালকে ৩৬০ জন জিহাদী সাথীসহ প্রেরণ করেছিলেন সিলেটের রাজা গৌর গোবিন্দের বিরুদ্ধে লড়াই করতে।
দক্ষিণ ভারতে মালিক কাফুরের নেতৃত্বে পরিচালিত জিহাদের সম্ভাব্য সফলতা সম্পর্কে কাজী মুঘিসুদ্দিন যখন আউলিয়ার কাছে জানতে চান, আউলিয়া তখন আবেগাপ্লুতভাবে বলে উঠেন: ‘এ বিজয় তো কি, আমি আরো বিজয়ের অপেক্ষায় আছি।’ নিজামুদ্দিন আউলিয়া সুলতান আলাউদ্দিনের জিহাদ অভিযানে লুণ্ঠিত মালে গণিমত থেকে বিপুল পরিমাণ উপহার গ্রহণ করতেন ও তার খানকায় বা আশ্রমে তা গর্বের সাথে প্রদর্শন করতেন।
খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তী (১১৪১-১২৩০): নিজামুদ্দিন আউলিয়ার পর সম্ভবত ভারতের দ্বিতীয়-শ্রেষ্ঠ সূফী সাধক ছিলেন খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তী, যিনি হিন্দুধর্ম ও তার চর্চার বিরুদ্ধে গভীর ঘৃণা প্রদর্শন করেন। আজমীর-এর আনাসাগর লেকে পৌঁছে তিনি সেখানে অনেক প্রতিমা-মন্দির দেখতে পেয়ে আল্লাহ ও নবীর সাহায্যে সেগুলো ধূলায় মিশিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। সেখানে আবাস স্থাপনের পর খাজার ভক্তরা প্রতিদিন একটি বিখ্যাত মন্দিরের সামনে একটি গরু (হিন্দুরের কাছে পবিত্র) আনতো, যেখানে রাজা ও হিন্দুরা পূজার্চনা করতো; তারা সে গরু সেখানে জবাই করে তার মাংস কাবাব বানিয়ে খেত, যা ছিল হিন্দুধর্মের প্রতি তার ইচ্ছাকৃত ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। বলা হয়, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য তিনি না কি সেখানকার হিন্দুদের অতি পবিত্র বিবেচিত দু’টি হ্রদ ‘আনাসাগর’ ও ‘পানসেলা’ শুকিয়ে দিয়েছিলেন তার আধ্যাত্মিক শক্তির তেজ দিয়ে। মঈনুদ্দিন চিশ্তীও তার ভক্তদের নিয়ে ভারতে এসেছিলেন বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার লক্ষ্যে এবং সুলতান মুহাম্মদ ঘোরীর বিশ্বাসঘাতী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আজমীরের সে যুদ্ধে ক্ষত্রিয় হিন্দু রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান পরাজিত হন। চিশ্তী তার জিহাদী উদ্দীপনায় এ যুদ্ধে বিজয়ের সমস্ত গৌরব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বলেছিলেন: ‘আমরা পিথাউরাকে (পৃথ্বীরাজকে) জীবন্ত আটক করে ইসলামের বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছিলাম।’
ওদিকে মুলতানে হিন্দুদের বিরুদ্ধ নাসিরুদ্দিন কিবাচার এক জিহাদী মুসলিম বাহিনী যখন বিপন্ন অবস্থায় পরাজয়ের মুখোমুখি, তখন চিশ্তীর সুবিখ্যাত শিষ্য ও সূফীসাধক কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকী কিবাচার কাছে গিয়ে তাকে একটি যাদুকরী বা অলৌকিক তীর দিয়ে বলেন: ‘বিধর্মী বাহিনীর দিকে এ তীর নিক্ষেপ করো… তার কথামত কিবাচা তা করেন এবং পরদিন যখন দিনের আলো ফুটে উঠে, তখন একজন অবিশ্বাসী সেনাকেও যুদ্ধ ক্ষেত্রে দেখা যায় নি; তারা সবাই পালিয়েছিল।’ এবং সে যাদুকরি সূফীসাধককে সম্মানিত করতে সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেক দিল্লীর আশেপাশের মন্দিরগুলো ভেঙ্গে সেগুলোর মাল-মসলা দিয়ে সুবিখ্যাত ‘কুতুব মিনার’টি নির্মাণ করেন।
আমির খসরু (১২৫৩-১৩২৫): শেখ নিজামুদ্দিন আউলিয়ার কৃতী শিষ্য আমির খসরু মধ্যযুগীয় ভারতের এক উদার সূফী কবি হিসেবে পরিচিত। অনেক আধুনিক ইতিহাসবিদের দৃষ্টিতে তার ভারতে আগমন ছিল এ উপমহাদেশের জন্য এক আশীর্বাদ। পরপর তিন সুলতানের রাজদরবারে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। তৎকালীন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে সুখ্যাত আমির খসরু ভারতে ক্লাসিক্যাল মিউজিক বা ধ্রুপদী বাদ্যের এবং কাওয়ালী গান (সূফীদের নিবেদনমূলক গান)-এর প্রতিষ্ঠাতা। তবলা আবিষ্কারের কৃতিত্বও তাকে দেওয়া হয়ে থাকে।
গান ও কবিতায় আমির খসরুর কৃতিত্ব ও সাফল্যের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যখন পতিত অবিশ্বাসী ও তাদের ধর্মের প্রশ্ন আসে, তখন তার ইসলামের গোঁড়ামিপূর্ণ আবেগ স্পষ্ট হয়ে উঠে। হিন্দু রাজাদের উপর মুসলিম বিজয়ের বর্ণনায় তিনি তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য, যেমন বৃক্ষ ও প্রস্তরমূর্তি পূজা ইত্যাদির ব্যাপারে বিদ্রূপ করেন। মুসলিম বীরদের দ্বারা পাথরের মূর্তি ভাঙ্গার ঘটনায় ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতঃ তিনি লিখেন: ‘মুহাম্মদের ধর্মের বিজয়োল্লাসের জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ। কোনো সন্দেহ নেই যে ‘গাবর’রা (পৌত্তলিকদেরকে খর্বিত করতে গালি) পাথর পূজা করে, কিন্তু পাথর তাদের কোন সেবায় আসেনি; তারা পরপারে গেল শুধু সে পূজার অর্থহীনতার সাক্ষ্য বহন করে।’
আমীর খসরু মুসলিম বীরদের দ্বারা হিন্দুদেরকে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনায় আনন্দ প্রকাশ করেন। ১৩০৩ সালে চিতোর বিজয়ের পর খিজির খান কর্তৃক ৩০,০০০ বন্দীকে হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে উল্লসিত আমির খসরু লিখেন: ‘আল্লাহকে ধন্যবাদ যে তিনি বিধর্মী-ছেদনকারী তলোয়ার দ্বারা ইসলামের চৌহদ্দি থেকে সকল হিন্দু নেতাদের হত্যার আদেশ দেন… ঈশ্বরের এ খলীফার নামে ভারতে অবিশ্বাসের কোনই স্থান নেই।’ মালিক কাফুরের দক্ষিণ ভারতের একটি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে সেখানে হিন্দুদের ও তাদের যাজক ব্রাহ্মণদের উপর চালানো নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিতে গিয়ে খসরু কাব্যিক আনন্দে উল্লসিত হন। হত্যাকাণ্ডটির বর্ণনায় তিনি লিখেন: ‘…ব্রাহ্মণ ও মূর্তিপূজকদের গর্দান থেকে মস্তক নাচতে নাচতে মাটিতে তাদের পায়ের উপর গড়িয়ে পড়লো ও রক্তের স্রোত বয়ে গেল।’ ভারতে হিন্দুদের দুর্দশাপূর্ণ বশীভূতকরণ ও ইসলামের বর্বরোচিত বিজয়ে গোঁড়ামিপূর্ণ উল্লাসে তিনি লিখেন:
সমগ্র দেশ আমাদের পবিত্র ধর্মযোদ্ধাদের তরবারী দ্বারা আগুনে ভস্মিভূত কণ্টকশূন্য জঙ্গলের মত হয়ে গেছে। ইসলাম বিজয়ী হয়েছে, পৌত্তলিকতার পতন ঘটেছে। জিজিয়া কর প্রদানের মাধ্যমে মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তির আইন মঞ্জুর না করা হলে, হিন্দুদের নামটি শিকড় ও শাখাসহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।
আমীর খসরু হিন্দুদের উপর মুসলিম বিজয়ীদের দ্বারা সংঘটিত বহু বর্বরোচিত সর্বনাশা নিষ্ঠুরতার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এসব বর্ণনায় তিনি কোথাও একটু দুঃখ বা অনুশোচনার চিহ্ন দেখান নি, বরঞ্চ আবেগ জড়িত উল্লাস প্রকাশ করেছেন। ওসব বর্বর ঘটনার বর্ণনায় তিনি সর্বদা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং নবী মুহাম্মদের প্রতি গৌরব প্রকাশ করেছেন – সে কৃতিত্বপূর্ণ কাজে মুসলিম যোদ্ধাদেরকে সক্ষমতা দানের জন্য।
অপর যে এক শ্রেষ্ঠ সূফী সাধক ভারতে আসেন তার নাম শেখ মখদুম জালাল আদ-দীন বিন মোহাম্মদ, যিনি হযরত শাহ জালাল নামে সমধিক পরিচিত ও বাংলার সিলেটে স্থিত হয়েছিলেন (পরে বর্ণিত)। এ সকল অতি শ্রদ্ধাবান সূফী সাধক ছাড়া আরও অনেক সূফী ব্যক্তিত্ব রয়েছেন – যেমন শেখ বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, শেখ নূরুদ্দিন মোবারক গজ্নবি, শেখ আহমদ শিরহিন্দী ও শেখ শাহ ওয়ালিউল্লাহ প্রমুখ – যারা অধিকতর গোঁড়া ধ্যান্তধারণার জন্য প্রায়শঃই আধুনিক ইতিহাসবিদ ও লেখকদের দ্বারা নিন্দিত হন। উদাহরণস্বরূপ, সুহরাওয়ার্দী তরিকা বা গোত্রের এক বিখ্যাত সূফী সাধক ও ইসলামী পণ্ডিত শেখ মুবারক গজ্নবি অমুসলিম (কাফির) ও তাদের ধর্মের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা ও অসম্মান প্রকাশ করতেন। তিনি সুলতানকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, ‘রাজারা কাফির ও কুফরি (নাস্তিকতা), শিরক (বহুঈশ্বরবাদ) ও মূর্তিপূজা উচ্ছেদ না করা পর্যন্ত তাদের ধর্ম রক্ষার দায়িত্ব পূরণ হবে না – যার সবই আল্লাহর উদ্দেশ্যে ও তাঁর নবীর ‘দ্বীন’ রক্ষার জন্য।’ কিন্তু কোন অসম্ভব পরিস্থিতিতে তার উপদেশ ছিল: ‘কুফরের গভীর ও দৃঢ় শিকড় এবং কাফির ও মুশরিকদের ব্যাপক সংখ্যাধিক্যের কারণে যদি পৌত্তলিকতা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা না যায়, তাহলে রাজাদের উচিৎ অন্তত মুশরিক ও মূর্তি-পূজক হিন্দুদের অমর্যাদা, অসম্মান ও মানহানি করা, যারা ঈশ্বর ও তাঁর নবীর নিকৃষ্টতম শত্রু।’
আধুনিক ইতিহাসবিদগণ কর্তৃক নিন্দিত হলেও এসব সূফী-সাধকরা তাদের সময়ে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন, বিশেষ করে উলেমা ও শাসক শ্রেণীর দ্বারা সম্মানিত হওয়ায় তারা রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নে যথেষ্ট প্রভাব খাটাতেন। সূফী সাধক বাহাউদ্দিন জাকারিয়া ও নুরুদ্দিন মুবারক ইসলামের সর্বোচ্চ ‘শেখ আল-ইসলাম’ খেতাবে ভূষিত হন, যা সাধারণত ইসলামের সবচেয়ে জ্ঞানী পণ্ডিতগণকে দেওয়া হত। ওসব অধিকতর গোড়া অথচ জনপ্রিয় সূফীদের ধ্যান ধারণা সম্পর্কে আরো বিশদ আলোচনায় না গিয়ে ইসলামের বিস্তারে সূফীরা কী ভূমিকা রেখেছিল, এখন তা বিশ্লেষণ করা যাক।
উমর উদ্দিনের মতে, ‘অগ্রগতির প্রাথমিক স্তরে সূফীবাদ ইসলাম (অর্থাৎ গোঁড়া ইসলাম) থেকে খুব বেশী পৃথক ছিল না। …এক পর্যায়ে কিছু পথভ্রষ্ট সূফী অনইসলামিক সর্বেশ্বরবাদে পৌঁছে, যা সৃষ্টিকর্তার সাথে ব্যক্তি ও সমগ্র সৃষ্টিকে একটা একক সত্তায় ঐক্যবদ্ধ করে। আত্মমগ্নতা, আত্মলোপ ও আত্মধ্বংস ঘোষণাকারী সর্বেশ্বরবাদ, যা ব্যক্তিকে ঈশ্বরের সঙ্গে মিলনের দিকে নিয়ে যায়, সেটি ইসলামের মূল ধারণায় একটা অপবিত্র মতবাদ। অগ্রগতির এ স্তরে তাদের কোনো পথ-নির্দেশক (অর্থাৎ নবী) অথবা আইন গ্রন্থের (অর্থাৎ কুরআন) প্রয়োজন পড়ে না। তারা শরীয়া আইনের প্রয়োজনীয় প্রায় সব আচার-আনুষ্ঠানিকতা – যেমন রোজা, নামাজ, হজ্ব, জাকাত প্রভৃতি – পরিত্যাগ করে। ইসলামী সমাজে তারা ‘বেশরীয়া’ অর্থাৎ শরীয়া বা ইসলাম বহির্ভূত বলে পরিচিতি পায়।
বেঞ্চামিন ওয়াকারের মতে:
সন্ন্যাসের নীতিতে অনেক সূফী ধারা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিশিষ্ট সূফীরা দারিদ্র্য, ‘ফকির’ বা ভিক্ষুক ও দরবেশী জীবনধারার স্তুতিতে লেখালেখি করেন। খুব অল্প সংখ্যক সূফী ইহলৌকিক আনন্দ, যেমন ধন্তসম্পদ, খ্যাতি, ভোজ, নারী সম্ভোগ ও সঙ্গী-সাথী পরিত্যাগ করে নিদারুণ দারিদ্র্য, নাম-নিশানাহীনতা, ক্ষুধা, চিরকুমারত্ব ও নিঃসঙ্গ জীবন গ্রহণ করে; এমনকি তারা তাদের আধ্যাত্মিকতাকে আরো শক্তিশালী করতে গালিগালাজ ও ঠাট্টা-বিদ্রূপে উদাসীন থাকার মাধ্যমে দুর্ব্যবহার ও অসম্মানকে স্বাগত জানায়।
@কামালউদ্দিন আহমেদ,
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ শত শত বছর ধরে স্বচ্ছ চরিত্রের অধিকারী বলে আরোপিত, অলৌকিকতার আধারে নিমজ্জিত ভাবনার বিপরীতে প্রখ্যাত সুফীদের সম্পর্কে এম.এ.খানের “জিহাদ” বইয়ের কিছু চুম্বক অংশ তুলে ধরে জন্য। :clap :clap :clap
@মাহমুদ ইমরান, আপনি বৌদ্ধ ধর্ম অধ্যয়ন করুন , তখন জানতে পারবেন কেন মানুষ এক সময় এই ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন এবং হিন্দু রাজা এবং বাইরের মুসল মান আগ্রাসন কারী দের আঘাত যদি এদের উপর না পড়তো তাহলে,ভারতের ধর্মীয় পরিচয় অন্যরকম হতো বলে মনে করি। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস নিশ্চয় জানেন। পাল রাজারা যে সহিংস ছিলেন তা ইতিহাসে দেখিনি।
রাজেশ তালুকদার, অনেক অজানা তথ্য জানলাম। এ জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। তবে একটা কথা, এই `সুফি মতবাদ’ এক অর্থে মন্দের ভাল। আজকের ভয়ংকর ইসলামের (সৌদি ইসলাম) চেয়ে অনেক উদার। এটা বলা যায়, যদি ধর্ম বিশ্বাসীরা সুফি মতবাদে বিশ্বাসী হতো তাহলে অন্তত অন্যের ধর্মকে সামান্য হলেও সহ্য করার একটা মন তাদের থাকতো। গান-বাজনা নিত্যর মত মানুষের অনন্য প্রকাশকে হারাম বলে আহাম্মুকি দেখাতো না।আজকের বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে রকম হিংস্র ধর্মীয় মনভাব দেখছি তাতে সুফিবাদ একটু হলেও তাদের মনকে কোমল করতো। যেহেতু বেশিরভাগ মানুষ ধর্ম নিয়েই থাকবে তাই তারা যদি ওহাবি মতবাদের বদলে সুফিবাদ গ্রহণ করতো তা অনেক বেশি স্বস্তির কারণ হতো। আপনাকে ধন্যবাদ রাজেশ।