অনেক দিন আগে এক সরকারী কর্মকর্তার সাথে আলাপের সুযোগ হয়েছিল। ভদ্রলোক বাংলাদেশের পশ্চাৎপদতা নিয়ে স্পষ্টতই খুব হতাশ ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, ‘এই জাতির কোন উন্নতি হবে না। মুসলমানদের রক্ত গরম। নইলে দেখেন, নজরুল এত মেধা থাকার পরও নোবেল জিততে পারল না। নজরুল আর রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাশাপাশি পইড়া দেইখেন। তাইলেই বুঝতে পারবেন, কি আকাশ-পাতাল তফাত। কারণ আর কিছু না। ঐ যে মাথা গরম! না হলে, নজরুলরে আল্লাহ পাক যে মেধা দিছিল, সে তা ঠিকঠাক ব্যবহার করলে, রবীন্দ্রনাথ তার ধারে-কাছেও ঘেঁষতে পারত না।‘
বলা দরকার, ঐ সরকারী কর্মকর্তা কিন্তু ধার্মিক মুসলমান ছিলেন। তাহলে, তার ভিতর এই মুসলিম বিদ্বেষ বা আরও স্পষ্ট করে বললে নজরুল বিদ্বেষ কেন? গভীরভাবে চিন্তা করলে প্রতীয়মান হয়, আসলে লোকটির ভিতর কোন মুসলিম বা নজরুল বিদ্বেষ ছিল না। আমরা প্রায়শই অনেক বাবা-মাকে তাদের সন্তানদের নিয়ে আক্ষেপ করতে দেখি, ‘ব্রেন তো আল্লাহপাক কম দেয় নাই, শুধু যদি একটু মনোযোগী হইত..’। নজরুলকে নিয়ে ঐ কর্মকর্তার আক্ষেপ অনেকটা ওরকমই মনে হয়। উনি নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের তুলনায় আপন মনে করেন, কিন্তু কেন সে তার মেধার সদ্ব্যবহার করে নোবেল ছিনিয়ে আনতে পারল না, তা নিয়েই তার যত আক্ষেপ।
প্রশ্ন উঠতে পারে, নজরুলকে নিয়ে ঐ কর্মকর্তার মূল্যায়ন কি সঠিক? সোজাসুজি উত্তর হল, না। সত্যি বলতে কি, নজরুল বা রবীন্দ্রনাথ কাউকেই মূল্যায়ন করার যোগ্যতা বা সাহিত্যিক বোধ তার নেই। তার চিন্তা-ভাবনা বরং নানাবিধ সংকীর্ণতায় বন্দী। নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ দুজনেই পশ্চিমবঙ্গে জন্মেছেন এবং বাংলা সাহিত্যে যে যার অবস্থানে স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল। দুজনেই বাংলার প্রধান দুধর্মের মানুষের জীবনকে তুলে এনেছেন সাহিত্যে। কিন্তু তবু আমাদের আলোচিত সরকারী কর্মকর্তা নজরুলকে যে আপনার লোক মনে করেন আর রবীন্দ্রনাথকে মনে করেন পর, তার কারণ আর কিছুই নয়, লোকটির ধর্ম-কেন্দ্রিক ক্ষুদ্র জাতীয়তা-বোধ। দুঃখের বিষয় হল, এমন জাতীয়তা-বোধে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা আমাদের দেশে নেহাত কম নয়! ঘটা করে রবীন্দ্রনাথে জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন বা রবীন্দ্রনাথের গান জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পাওয়ায় তারা সর্বদাই মনোবেদনায় ভোগেন।
কথা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ কি সত্যি আমাদের নন? মনে পড়ছে, প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের কথা, যিনি মৃত্যুর কয়েক মাস পূর্বে রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশ বিরোধী আখ্যায়িত করেছিলেন এই যুক্তিতে যে, রবীন্দ্রনাথ নাকি পূর্ববঙ্গের (আজকের বাংলাদেশ) প্রতি বিরাগ থেকেই শান্তিনিকেতন এখানে না করে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন! একই কারণে নাকি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন! সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, একই ঘরানার বুদ্ধিজীবীগণ আরেকটি দাবী করেন যে, রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি লিখেছেন বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে, যাতে পূর্ববঙ্গের প্রতি লোক দেখানো ভালবাসা প্রকাশ করা হয়েছিল শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ রক্ষার তাগিদে! এইসব দাবীর অসারতা নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, কিন্তু সেসব লেখা সংকীর্ণতার দেয়াল ভেদ করতে সক্ষম হচ্ছে না কিছুতেই! তবে নিন্দুকেরা একটি বিষয় বেমালুম ভুলে যান, তা হল, রবীন্দ্রনাথের সাথে আজকের বাংলাদেশের যে এক আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে এবং তা যে কিছুতেই ঘুচবার নয়।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের দিকটি সবচেয়ে ভালভাবে তুলে ধরেন শান্তিনিকেতনের ছাত্র প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক প্রমথনাথ বিশী। তার মতে, রবীন্দ্রনাথ যদি বাংলাদেশের শিলাইদহ, সাজাদপুর বা পতিসরের জমিদারিত্ব না পেয়ে ভারতের কোন অনুর্বর জায়গার জমিদারিত্ব (বাংলা ছাড়া ভারতবর্ষের আরও কিছু জায়গায় ঠাকুর পরিবারের বিশাল ভূসম্পত্তি ছিল) পেতেন, তাহলে তিনি হয়ত বাংলা ভাষার বড় কবি হতেন, কিন্তু বিশ্বকবি হতেন না। প্রমথনাথ বিশীর মতে, বাংলাদেশের পদ্মা নদী রূপে-গুনে-চরিত্রে বিশ্বের একটি অনন্যসাধারণ নদী, যে কিনা অপেক্ষা করছিল বিশ্বের একজন অনন্যসাধারণ কবির সাথে মিলিত হবার জন্য। তার মতে, রবীন্দ্রনাথের অক্ষয় কীর্তি ‘ছিন্নপত্রের’ নায়িকা পদ্মা আর নায়ক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ!
রবীন্দ্রসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ তার ছোট গল্প। আর তার সেরা ছোটগল্পগুলোর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে আজকের বাংলাদেশ। ১৯৩৬ সালে ভারতের ফরোয়ার্ড পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাতকারে রবীন্দ্রনাথ নিজেই আমাদের জানাচ্ছেন,
ছোটগল্প আমি লিখতে শুরু করেছিলুম একেবারে যৌবনে। জমিদার হওয়ার কারণে আমাকে গ্রামে যেতে হতো আর এর ফলে আমি গ্রামের মানুষের আর তাদের সাধারণ জীবন-যাপনের সংস্পর্শে আসতে পেরেছি। উপভোগ করতুম গ্রামবাংলার আপন সৌন্দর্য আর আশেপাশের দৃশ্য।এই প্রদেশের শ্রেষ্ঠে অংশ নদীমাতৃক বাংলাদেশ আমাকে মুগ্ধ করেছে এবং এই নদীগুলোকে আমি ভাল করেই চিনি। যেসব মানুষের জীবন আমি দেখেছি তা আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে। কলকাতায় জন্মগ্রহণ আর সেখানে বড় হওয়ায় প্রথমত গ্রামের জীবনের সাথে আমি একেবারেই অপরিচিত ছিলাম। আর সে কারণে আমার কাছে এটা একটা রহস্যময় ব্যাপার ছিল। তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আসার পর থেকেই আমার সমগ্র হৃদয় গ্রামের মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তাদেরকে মনে হয়েছে ভিন্ন এক জগতের মানুষ, কলকাতা থেকে খুবই আলাদা। আমার প্রথমদিককার গল্পগুলোয় এই পটভূমি রয়েছে আর সেগুলোতে গ্রামের মানুষের সাথে আমার যোগাযোগের কথা আছে, তাদের মধ্যে যৌবনের একটা সজীবতা রয়েছে। এই গল্পগুলো লেখার আগে বাংলা সাহিত্যে এ ধরণের কিছু ছিল না।
অথচ নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা ঘিরে ধরাতে রবীন্দ্রনাথের শেষের দিকের গল্পগুলো তার নিজের কাছেই ঠিক সেরকম মর্যাদা পায়নি,
আমি অনুকূল পরিবেশ বেশ পছন্দ করি এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনও বিশেষ আবহে আসছি ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও শৈল্পিক কাজ করতে পারি না। যৌবনে আমি যা কিছু দেখতাম তা-ই আমার কাছে বেশ গভীর বেদনা নিয়ে হাজির হতো আর তাই আমার প্রথমদিককার গল্পগুলোর স্বতঃস্ফূর্ততার কারণে একটা বড় ধরণের সাহিত্যমূল্য রয়েছে। কিন্তু এখন তো ভিন্ন রকম। আমার শেষদিকের গল্পগুলোতে টেকনিকটা বেশ আছে বটে কিন্তু আমি ভাবি যদি আমার আগের জীবনে একবার ফিরে যেতে পারতাম।
এভাবেই তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আজকের বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথকে ‘অনুকূল পরিবেশ’ যুগিয়েছে, দান করেছে শৈল্পিক কাজ করার আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। তাইতো রবীন্দ্রনাথ তার গীতাঞ্জলীর ইংরেজি অনুবাদ (যা তাকে এশিয়ার প্রথম নোবেল জয়ী সাহিত্যিক বানিয়েছিল) করার জন্য কোন এক ছুটিতে চলে আসেন এই বাংলাদেশের শিলাইদহে। শিলাইদহের জমিদারী পাট চুকে যাবার পরও সময় পেলেই পূর্ববঙ্গে এসেছেন। প্রমথনাথ বিশীর মতে, পূর্ববঙ্গ ও পদ্মা শেষ জীবন পর্যন্ত তার সাহিত্যে বিশাল প্রভাব ফেলেছে।
সুতরাং, এ ব্যাপারে দ্বিমত থাকতে পারে না যে, তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আজকের বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথকে অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠে, এই দান কি একতরফা? রবীন্দ্রনাথ কি কিছুই দেননি বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মানুষকে? বস্তুত রবীন্দ্রনাথের বিশাল সাহিত্য-সম্ভারের দিকে তাকালে দেখা যায়, এর একটা বড় অংশের সাথেই জড়িত রয়েছে বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রকৃতি-মানুষ।
এ কথা বলা খুব অযৌক্তিক শোনাবে না যে, রবীন্দ্রনাথ আমাদের শিখিয়েছেন প্রকৃতিকে ডাকার ভাষা। শিলাইদহে রচিত তার অমর একটি গানের দিকে লক্ষ্য করা যাক:
আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়
লুকোচুরির খেলা।
নীল আকাশে কে ভাসালে
সাদা মেঘের ভেলা।
আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে,
উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে,
আজ কিসের তরে নদীর চরে
চখাচখির মেলা।
ওরে যাবো না আজ ঘরে রে ভাই,
যাবো না আজ ঘরে!
ওরে আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ
নেব রে লুঠ করে।
যেন জোয়ার জলে ফেনার রাশি
বাতাসে আজ ফুটেছে হাসি,
আজ বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি
কাটবে সারা বেলা।
উপরের গানটির যে বর্ণনা তা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশের হতে পারে? আর বাংলাদেশের এই চিরন্তন প্রকৃতি রবীন্দ্রনাথের হাতেই কি সবচেয়ে বেশী প্রাণ পায়নি?
রবীন্দ্রনাথ চলন-বিলে ঝড়ের মুখে বোটে বসে রচনা করেন নীচের গানটি:
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা
মম শুন্যগগণ বিহারী
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা-
তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম অসীমগগন বিহারী।।
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা
প্রেম-পূজার এমন অনবদ্য ও অনির্বচনীয় ভাষা আমদের জন্য রবীন্দ্রনাথের এক অবিস্মরণীয় অবদান নয় কি? আমরা যদি বাঙ্গালি হয়ে থাকি, তাহলে কি করে এমন সম্পদকে এড়িয়ে যেতে পারব? আমরা যদি বাংলা ভাষাতে ছাড়তে না পারি, তাহলে রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়া সম্ভব হবে না আমাদের পক্ষে, কারণ বাংলা ভাষার তাজমহলে মহামূল্যবান পাথর হয়ে পরতে পরতে গেঁথে রয়েছে রবীন্দ্রনাথে শব্দ, চিন্তা, আর আবেগ!
এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কবি জয় গোস্বামী এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ হলেন দিনের বেলার তারার মত বাস্তব। দিনের সূর্যের প্রভাবে তার চেয়েও বড় নক্ষত্রদের আমরা দেখতে পাইনা সত্যি, কিন্তু তাই বলে সেইসব নক্ষত্ররা অবাস্তব হয়ে যায় না আমাদের কাছে। একইভাবে বলা যেতে পারে, আজকের বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথকে আমরা সরাসরি দেখতে পাচ্ছি না সত্যি, কিন্তু তিনি আমাদের মাঝে বিরাজ করছেন দিনের বেলার নক্ষত্রদের মতই। তার অস্তিত্ব এক অবশ্যম্ভাবী সত্য আমাদের জাতীয় জীবনে।
বস্তুতু, রবীন্দ্রনাথ যেমন পূর্ববঙ্গ ও আজকের বাংলাদেশের কাছে ঋণী, তেমনি আমরা বাংলাদেশিরাও সমান ঋণী তার কাছে।এই পারস্পরিক ঋণ আমাদের উভয়কে (রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ) এক চিরকালীন আত্মীয়তার সম্পর্কে বেঁধে রেখেছে, যাকে কখনোই বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়।
তথ্যসূত্র:
১.শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথনাথ বিশী
২.কথোপকথন, রাজু আলাউদ্দিন
৩.উইকি ও অন্যান্য ইন্টারনেট উৎস
ভাল লাগল। তবে মনে হল হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল!! টু বি কন্টিনিউড হলে ভাল হবে!!
@আমি কোন অভ্যাগত নই,
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। আসলে টু বি কন্টিউড লেখা নামানোর মত রসদ আমার নেই। অনেকটা আবেগের বশে লিখেছি, স্বল্প পুজির উপর ভর করেই, কোন ভুল ত্রুটি হলে মার্জনা করবেন। ভাল থাকবেন।
@জটিল বাক্য,
অনেক ধন্যবাদ, আপনার মন্তব্যের জন্য! আর সত্যি, শনিবারের চিঠির মন্তব্যটি ছাঁদহীন লেখাটিতে কিছুটা প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।
পরবর্তী রূপরেখা বলতে কি বোঝাতে চাচ্ছেন, একটু পরিষ্কার করবেন, ভাইয়া? পঞ্চবার্ষিকি পরিকল্পনা টাইপের কিছু? কিন্তু সেগুলো তো রাজনীতিবিদদের কাজ। কবিরা স্বপ্নদ্রষ্টাই হন সাধারণত। নজরুল কিন্তু প্রগতিশীলতার বীজ বপন করেছিলেন বাঙালি জাতির মগজে, বিশেষ করে বাঙালি মুসলিম সমাজের মধ্যে যারা একটা সময় পর্যন্ত নিজেদের জাতীয় পরিচয় নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিল। নজরুল তার সর্বহারা কাব্যগ্রন্থে যেসব উচ্চ আদর্শের কথা বলে গেছেন, তা কি একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল জাতি গঠনে যথেষ্ট রূপরেখা নয়?
ভাল থাকবেন। মন্তব্যের জন্য আবারো ধন্যবাদ।
লেখাটি ভালো লাগলো। আমার একটি প্রিয় গান দেখলাম। নজরুলকে অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান ধার্মিক কর্মকর্তার মতোই মূল্যায়ন করেন। কিন্তু নজরুল নিজেকে কখনো অতি মূল্যায়ন করেন নি। কবির সহজ সরল স্বীকারোক্তি ছিলো
পরাধীন বঙ্গে নজরুল ছিলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর কবিতায় শেকল ভাঙ্গার কথা ছিলো কিন্তু পরবর্তী কোনো রূপরেখা ছিল না।
শনিবারের চিঠির মন্তব্য আলোচনাকে অনেক পুষ্ট করেছে। ধন্যবাদ।
—————————————————————
আমি অনেক উচ্চ শিক্ষিত মানুশকেও বলতে শুনেছি, রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ছিলেন। তিনি জমদারপুত্র জমিদার ছিলেন। তাই নাকি সাধারণ মানুশের দুঃখ ব্যাথা ও জীবনের মাঝে ঢুকতে পারেননি। শুধু প্রেম ভালবাসার কথা লিখেছেন আর আরাম আয়েশ করেছেন। এসব কথা যারা বলে তারা কখনো রবীন্দ্র বা নজরুল সাহিত্য পড়েনি। পাস করার জন্য যা দরকার তা-ই পড়েছে। অনেকে আবার রবীন্দ্রনাথ পড়েনা। কারণ তিনি মুসলিম ছিলেন না। এই রকম কট্টর কয়েকজন পাঠকেও চিনি। না পড়েই ভাল মন্দ রায় দিয়ে দেয়!
@তামান্না ঝুমু,
একমত। মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ, আপু! (F)
লেখাটি সত্যিই অনেক সুন্দর আর তথ্যবহুল। সুন্দর আলোচনার জন্যে ধন্যবাদ।
@বিভা,
পাঠ ও মন্তব্যের জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ! ভাল থাকবেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের কিছু মুসলমানদের নিকট কতোটা নিন্দনীয় এবং তাদের আক্ষেপ দেখুন। জানিনা একে কি বলবেন?
http://www.sabujbanglablog.net/8607.html
মুসলমান বিদ্বেষী যবন, ম্রেচ্ছ, অস্পৃশ্য রবীন্দ্রনাথ
লিখেছেন: ১.৯২.৫ বিভাগ: আন্তর্জাতিক | 40 বার পঠিত
বাংলাদেশ শতকরা ৯৭ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত দেশ। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে একজন মুসলমান বিদ্বেষী যবন, ম্রেচ্ছ, অস্পৃশ্য হিন্দু মালাউনকে এদেশে বিশ্বকবি মর্যাদা দেয়া হয়েছে। (নাউযুবিল্লাহ)। মালাউন রবীন্দ্রানাথ তার বিভিন্ন সাহিত্য কর্মে প্রতিনিয়ত মুসলমানদেরকে ইহানত করে বিভিন্ন কথা লিখে গেছে। তার কিছু তুলে ধরা হলো। লিখাগুলো পড়ে পাঠকদের চিন্তা করা উচিৎ এই কুলাঙ্গার মালাউন কতটা মুসলমান বিদ্বেষী।
(১) “পৃথিবীর দু’টি সম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র–সে হচ্ছে খৃস্টান আর মুসলমান ধর্ম। তারা নিজের ধর্মকে পালন করেই সন্তুষ্ট নয়, অন্য ধর্মকে সংহার করতে উদ্যত। এইজন্যে তাদের ধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া তাদের সঙ্গে মেলবার অন্য কোনো উপায় নেই।” (হিন্দুমুসলমান, কালান্তর, রবীন্দ্র রচনাবলী, দ্বাদশ খণ্ড, বিশ্বভারতী, কলিকাতা ১৪০২, পৃষ্ঠা ৬২০।)
(২) “মুসলমানদের ইতিহাসে দেখি উদ্দাম প্রবৃত্তির উত্তেজনার সম্মুখে ক্ষমতা লাভ স্বার্থসাধন সিংহাসন প্রাপ্তির নিকটে স্বাভাবিক স্নেহ দয়া ধর্ম সমস্তই তুচ্ছ হইয়া যায়; ভাই-ভাই, পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, প্রভু-ভৃত্যের মধ্যে বিদ্রোহ বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, রক্তপাত এবং অকথ্য অনৈসর্গিক নির্মমতার প্রাদুর্ভাব হয়…” (মুসলমান রাজত্বের ইতিহাস, আধুনিক সাহিত্য, রবীন্দ্র-রচনাবলী পঞ্চম খণ্ড, বিশ্বভারতী, কলিকাতা ১৪০২, পৃষ্ঠা ৫৯১)
(৩) একদিকে হিন্দুমেলা অন্যদিকে বিখ্যাত জ্যোতিদাদার হিন্দু বীর বিক্রমের স্তব, যবন নিধনের পালা বালক রবীন্দ্রনাথের মনে প্রভাব ফেলতে পারে। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ হিন্দুমেলায় সক্রিয় অংশগ্রহণের কথা লিখেছেন। যোগেশচন্দ্র বাগল জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ ‘হিন্দুমেলার উপহার’ নামক কবিতা এই মেলায় পড়েছেন। হিন্দুমেলার প্রত্যক্ষ প্রভাবে যবনবিদ্বেষী পৃথ্বীরাজ পরাজয় গ্রন্থটি লেখেন। এই গ্রন্থটি পরে হারিয়ে গেলে একই বিষয় নিয়ে লেখেন রুদ্রচণ্ড। রুদ্রচণ্ড প্রথম প্রকাশ হয় জুন ১৮৮১-এ। এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করেন ‘ভাই জ্যোতিদাদা’কে, যথার্থ উৎসর্গই। পৃথ্বীরাজ কর্তৃক অরণ্যে বিতাড়িত জাতহীন রুদ্রচণ্ড দূতের মুখে মহম্মদ ঘোরীর আক্রমণের সংবাদ শুনে বলে, ‘কি বলিলি দূত! তোর ম্লেচ্ছ মহম্মদ ঘোরী পৃথ্বীরাজে আক্রমিতে আসিতেছে হেথা! (রুদ্রচণ্ড, রবীন্দ্ররচনাবলী চতুর্দশ খণ্ড, বিশ্বভারতী, কলিকাতা, ১৪০২, পৃষ্ঠা ৬৪৪।)
(৪) অন্যত্র, দ্বিতীয় সেনাপতি যুদ্ধের সংবাদ দেয় এভাবে, ‘শুনিনু যবনগণ যুঝে প্রাণপণে অতিশয় ক্লান্ত নাকি হিন্দু সৈন্য যত। (রুদ্রচণ্ড, রবীন্দ্ররচনাবলী চতুর্দশ খণ্ড, বিশ্বভারতী, কলিকাতা, ১৪০২, পৃষ্ঠা ৬৪৬।)
(৫)রুদ্রচণ্ড প্রকাশের দুইবছর আগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৭৯তে প্রকাশিত অশ্রুমতী নাটক উৎসর্গ করেন অনুজ রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ তখন প্রথমবারের মতো বিলাতপ্রবাসী। অশ্রুমতী নাটকের বিষয় প্রেম হলেও চরিত্র এসেছে রুদ্রচণ্ড গীতিনাটকের পটভূমির ইতিহাস থেকে–পৃথ্বীরাজ, প্রতাপসিংহ, আকবর, মানসিংহ, সেলিম, অশ্রুমতী প্রমুখ। এবং যবনবিদ্বেষ যথারীতি বর্তমান। রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করা এই নাটকের সৈন্যগণ বলছে ‘আজ আমরা যুদ্ধে প্রাণ দেব–চিতোরের গৌরব রক্ষা করব–মুসলমান রক্তে আমাদের অসির জ্বলন্ত পিপাসা শান্ত করব…। (অশ্রুমতী : জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নাটকসমগ্র, সাহিত্য সংসদ, কলিকাতা, ২০০২, পৃষ্ঠা ১১৩।)
(৬)বনবিদ্বেষে তিনি ঐতিহাসিক আলাউদ্দিন খিলজিকে সরোজিনী নাটকে আল্লাউদ্দিন নামে অভিহিত করে সংলাপে সংলাপে আল্লাউদ্দিন-এর প্রথমাংশ শুধু ‘আল্লা’ করে ফেলেছেন। নাটক পড়তে হবে, সরোজিনী ‘আল্লা’কে বলছে, ‘নরাধম! ঐখানে দাঁড়া, আর এক পা’ও অগ্রসর হোস নে। (নাটকসমগ্র : পটকথা, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নাটকসমগ্র, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলিকাতা, ২০০২, পৃষ্ঠা ১০১।)
বাঙলাদেশে নজরুল চর্চার বৈশিষ্ট্য নিয়ে নির্মোহ আলোচনার আবশ্যকতা থাকলেও, সুযোগ নেই। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এখনও ধর্মীয় মৌলবাদের নখরে বিদ্ধ এবং সে রাষ্ট্রের প্রাণময় সত্তাগুলো বারবার রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক বিষশরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়। অতএব- নজরুল তাঁর সাহিত্যের উদ্বেল প্রখরতা নিয়ে সাধারণ বাঙালির হৃদয়ে কতোটুকু ‘আসন’ দখল করে আছেন আর এগারোই জ্যৈষ্ঠ ও বারোই ভাদ্র আসলে বাঙালির ‘ভাষণে’ কতোটুকু ফুটে ওঠে, তার বিবেচ্য সমীকরণ দেখতে হবে। নজরুল কেবল বুক শেলফের কবি নন, তিনি হৃদয়রাজ্যের অধিপতি; কেবল বাঙলা একাডেমি হতে প্রকাশিত ‘নজরুল রচনাবলী’তেই নজরুল থাকেন না, তাঁর বাস নিঃশ্বাসের গভীরতায়-দৃষ্টির স্নিগ্ধতায় এবঙ তিনি চিরঞ্জীব।
সমান বক্তব্য রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক; মজার ব্যাপার হলো- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবঙ নজরুল ইসলামের মধ্যে কিন্তু বেশ হৃদ্যতার সম্বন্ধ ছিলো। কিন্তু অধিকাঙশ বাঙালির ঊণ মানসিকতার দরুন আমরা নিজেরা সমস্যা তৈরি করে দিচ্ছি। নজরুল বিশ্বমানব এবঙ বিশ্বকাব্যের মানুষ, কিন্তু তারপরেও তিনি আমাদেরই লোক, আমাদের বুকের বারান্দার এক চিলতে দুর্লভ রোদ্দুর। নজরুল চর্চার বৈশিষ্ট্য এলেই বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নজরুল ইসলামের মধ্যে একটা যেনো চৌকাঠ জুড়ে দিতে চায়, মানে জুড়ে দিতে পারলেই যেনো বাঙালির শান্তি। যদিও বাঙালি বুঝতে চায় না শান্তি আর সান্ত্বনা এক বিষয় নয়। পৃথিবীতে এমন জাতি খুব কমই পাওয়া যাবে- যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবঙ কাজী নজরুলের মতো অসীম প্রাণময়, মহাপ্রতিভাধর দুজন প্রতিনিধি আছেন। আমার ব্যক্তিগত ধারণা- এমন জাতিও পৃথিবীর বুকে আর নেই, যারা নিজেদের দুই মহাপ্রতিভাধর সৃষ্টিমুখর প্রতিনিধিকে নিয়ে ধর্মের পর্দায় বিভেদের ছবি আঁকে। নজরুল সাহিত্য নিয়ে আলোচনায় বাঙালি যতোটা না দক্ষ, রবীন্দ্র-নজরুল নিয়ে সাম্প্রদায়িক মিথ্যাচারে বাঙালি নামের কুলাঙ্গারেরা তার চেয়েও পটু। তবে এরা বাঙালি তো নয়ই, কুলাঙ্গারও নয়- এরা শুয়োরের বাচ্চা; সাম্প্রদায়িকতা চিরকালই শুয়োরের বাচ্চাদের কাছ থেকে সুড়সুড়ি ধার করেছে।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের হৃদ্যতার সম্বন্ধের একটি পরিচয় উঠে আসে নিশিকান্ত রায়চৌধুরীর একটি লেখায়। ১৯২১ সালে নজরুলকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ; শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎকারের স্মৃতিচারণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের তখনকার একান্ত সচিব কবি সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর ভাই নিশিকান্ত রায়চৌধুরী। তিনি লিখেন-
তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ নিজেই তো ‘স্ফুলিঙ্গ’ নামের একটা ছোটো কবিতা আছে। শিরোনামহীন সংখ্যাচিহ্নিত এই কবিতাটি অন্তত দুটি সংখ্যায় বিন্যস্ত। কবিতাটি পড়া যাক :
বলাই বাহুল্য, এটি আকাশের রবি তথা সূর্যকে নিয়ে লেখা। কিন্তু মর্ত্যের রবি অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এই মন্তব্য সমান অথবা ততোধিক সত্য। তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা সহজই শুধু নয়, আমাদের এখানে মুর্খের মতো তা করাও হচ্ছে। কিন্তু আকাশের রবি যেমন নিন্দুকের সকল মূর্খতা ও আস্ফালন সত্ত্বেও আপন আলোকে নিজের প্রকাশকে অমলিন ও স্বতঃস্ফূর্ত করে তোলে, মর্ত্যের রবিও তেমনি তাঁর অসামান্য ভালবাসাকে অক্ষুন্ন রাখেন, আশা করি তিনি রাখবেনও। 🙂
তাতে নজরুলের কিছু যায় আসেনা। নজরুলের একটি কবিতা-
httpv://www.youtube.com/watch?v=5PWyp5rJTx0