ঐ তুই আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বুঝস?
– সামান্য ধারণা তো আছেই।
বিশ্বাস তো করস?
– এইটা আবার কেমন কথা। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব তো বিজ্ঞানের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আর এই ধারণা আইনস্টাইন কই থেকে পাইছে জানস তো?
আরে জানবো না ক্যানো। প্রতিদিন সকালে উঠে তো তিনি দুই ঘণ্টা ঐ বই পড়তেন। আচ্ছা তুই কি বিবর্তন তত্ত্ব বুঝস?
– ভালো মতোই বুঝি।
বিশ্বাস করস?
বিশ্বাস করার কি আছে এতে? বিবর্তনবাদ হলো পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া নাস্তিক প্রোপাগান্ডা। ডারউইন নামক এক বান্দর এই বান্দর তত্ত্ব দিছে। সারা দুনিয়ার মিডিয়া কারা নিয়ন্ত্রণ করে জানস তো? ইহুদি। আর ইহুদির একমাত্র কাজ ইসলাম ধ্বংস করার ফন্দি ফিকির করা। এরাই এই বান্দর ডারউইনকে তেল দিয়ে গাছ উঠাইছে। আচ্ছা দোস্ত তুই বল- এমনি এমনি জগতে কোনো কিছু হয়? সবকিছু বাদ দিয়ে মানুষের চোখের কথাটাই ধর। একটা ক্যামেরার সাথে চোখের কতো মিল। অথচ বান্দরওয়ালারা বলে এই চোখ নাকি এমনি এমনি প্রাকৃতিক ভাবে উদ্ভব হইছে। এমনি এমনি হরলিক্স খাওয়া যেতে পারে, কিন্তু চোখের মতো একটা দুর্দান্ত জটিল জিনিসের তাকালে যেকোনো বাচ্চাও বুঝবে কেউ একজন নিপুণভাবে এটা সৃষ্টি করেছে। আর তিনিই হলেন …

এমন কথোপকথনের ঘটনা আপনার জীবনে ঘটেছে কিংবা ঘটেনি কিন্তু আমার জীবনে ঘটেছে। গণনায় যদি নিয়ে আসি ইন্টারনেট তাহলে ঘটেছে বেশ কয়েকবারই। বিবর্তন আলোচনায় অসংখ্য মানুষ ‘চোখের মতো এতো জটিল একটা অঙ্গ কি এমনি এমনি সৃষ্টি হয়েছে?’ নামক প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়ে জীব বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি বিবর্তন তত্ত্বকে একেবারে নায়ক অনন্ত স্টাইলে ঘায়েল করে ফেলেন, অন্তত নিজের কাছে তো বটেই। ঘায়েলটি আবার মঞ্চস্থ হয় একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য নাটক আকারে। আজকের যাত্রা শুরুর আগে নাটকটির কথা বলা যাক।

নাটকটির স্থান পৃথিবীই হয় সাধারণত। তবে কেন্দ্রীয় চরিত্র অতিকল্পবিলাসী হয়ে মাঝে মাঝে মঙ্গলেও চলে যেতে পারেন। কেন্দ্রীয় চরিত্র পৃথিবী কিংবা সেই মঙ্গল গ্রহে হেঁটে যেতে থাকেন মেঠো কিংবা অমেঠো পথ দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কেন্দ্রীয় চরিত্রের চোখে পড়ে একটি পাথর, পাথর দেখে চরিত্রটি নিজেকে প্রশ্ন করেন- পাথরটি এখানে কেমন করে এলো? নাটক এবার নাটকীয়তায় মোড় নেয়। চরিত্রটির শরীর থেকে আরেকটি চরিত্র বের হয়ে প্রশ্নটির উত্তর দেয়- প্রকৃতির অন্য অনেক কিছুর মতো পাথরটাও হয়ত সবসময়ই এখানে ছিল। উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট চরিত্রটি আবার হাঁটা শুরু করে। মেঠো কিংবা অমেঠো পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এবার তার চোখে পড়ে একটি ঘড়ি, কিংবা একটি নাইকন ক্যামেরা। ঘড়িটি কোথা থেকে আসলো? ঘড়ি কিংবা নাইকন ক্যামেরার মতো একটি জটিল যন্ত্র তো আর এমনি এমনি এখানে হাজির হয়নি। কোনো কারিগর কিংবা নাইকন কোম্পানি তৈরি করেছে সেটা। চরিত্রটি এবার নাটকের ইয়ে মেরে দিয়ে সরাসরি লেকচারে চলে যায়- তাহলে আমরা কি বুঝলাম? ক্যামেরা কিংবা ঘড়ির মতো একটা জটিল জিনিস যেমনি প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্টি হতে পারেনা, কাউকে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সেটি তৈরি করতে হয়, তেমনি চোখের মতোও একটি জটিল অঙ্গ কখনও প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্টি হতে পারেনা। নাইকন ক্যামেরাটি যেমন জানান দিয়েছিলো নাইকন কোম্পানির কথা ঠিক তেমনি চোখের অস্তিত্ব আমাদের জানান দেয়, এক বুদ্ধিমান, মহা পরিকল্পনাকারী স্রষ্টার কথা- যিনি সর্বজ্ঞানী, সর্বদ্রষ্টা এবং মহাবিশ্ব হাউজিং সোসাইটির গর্বিত মালিক।

হুমায়ুন আহমেদ

ছোটবেলার প্রিয় লেখক। ছোট বেলায় বোধহয় মাথায় বেশি প্রেশার নেওয়া যায়না, প্রেশার নিলেও খুব একটা কিছু ঢুকেনা। সেই ছোটবেলায় মুখ ডুবিয়ে পড়েছি হুমায়ুন আহমেদ। এবং একদিন বড় হয়ে গিয়েছি। বড় হওয়ার পর থেকে দিন দিন তার প্রতি বিরক্ত বেড়েছে। যে বিরক্তের সূচনা হয়েছিলো “জোছনা এবং জননীর গল্প” উপন্যাস পড়ে। রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের করা রক্তপাত শুকিয়ে গেছে, সেই সাথে শুকিয়ে গেছে আমাদের স্মৃতিও। আমরা আজ আবার মৌলবাদীদের সমর্থন করি কিংবা না করলেও তাদের চিন্তা-চেতনা ধারণ করি। আমাদের হুমায়ুন আহমেদরাও আমাদেরই মতো। তারাও জোছনা ও জননীর ঋণ শোধ করেন আমাদের রি-রাইটেবল মস্তিষ্কে “তিনারাও” ভালো কথাটি লিখে দেবার প্রচেষ্টা করে।

সাহিত্যে তিনি বিজ্ঞান ধর্ষণ করেছেন নিয়মিত। সাহিত্যে সেটা করা বোধহয় জায়েজ। উপন্যাস কিংবা গল্পে পিএইচডি করা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কিংবা অন্য কারও মুখ দিয়ে বিজ্ঞানের রূপে অনর্গলে বয়ান করে গিয়েছেন কুসংস্কার। আমরা সহজ শব্দ এবং সরল বাক্য বিলাসী পাঠকেরা উপন্যাসে একটুখানি বিজ্ঞানের স্বাদ পেয়ে গপাগপ করে গিলে ফেলেছি সেটা কারণ সত্যিকারের বিজ্ঞান বই পড়াটা খুব বেদনাদায়ক। এতো কঠিন কঠিন শব্দ! ছোটবেলায় হুমায়ুন আহমেদের হাত ধরে বিশ্বাস করেছি টেলিপ্যাথি- অনেক রাত পার করেছিলাম দূরের নিশি আপুর সাথে কথা বলে বলে। বিশ্বাস করেছিলাম ইএসপি। বড় বেলায় এইসব কুসংস্কার অবাক হয়ে দেখলাম, ঝেড়ে ফেলেনি অনেকেই, তারা হয়তো শৈশব ভালোবাসে খুব, তাই বড় হয়েও শিশু থাকতে চায়। শুধু তাই নয় শিশুসুলভ ধ্যান ধারনার জন্য তারা গর্বও বোধ করতে চায়।

গল্প উপন্যাসের বাইরে তিনি আত্মকথনও করেছেন প্রচুর, দিয়েছেন প্রচুর সাক্ষাৎকার। অজস্র মানুষ তাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, সেটা অনুভব করে তিনি মাঝেই মাঝেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে নিজের গুরুত্বপূর্ণ অভিমত জানান দিয়েছেন। এই যেমন স্টিফেন হকিং এর কথাতেই আসা যাক। বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ হকিং তার গ্র্যান্ড ডিজাইন বইয়ের মাধ্যমে ঘোষণা করলেন- “ ঈশ্বর এবং আত্মা বলে কিছু নেই। স্বর্গ-নরক নেই। সবই মানুষের কল্পনা। মানব-মস্তিষ্ক হলো একটা কম্পিউটার। কারেন্ট চলে গেলে কম্পিউটার বন্ধ হয়ে যায়। মৃত্যু হলো মানব-মস্তিষ্ক নামক কম্পিউটারের কারেন্ট চলে যাওয়া” উদ্ধৃত অংশটুকু হুমায়ুন আহমেদের ‘মহেশের মহাযাত্রা’ লেখা থেকে উদ্ধৃত। ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’ সংক্রান্ত অভিমত তিনি বইটি পড়ে নয় দিয়েছেন বই সম্পর্কিত পত্রিকার প্রতিবেদন পড়ে। এরপরেই গুরুত্বপূর্ণ মতামত জাহির করার পালা। সে গুরুত্বপূর্ণ মতামত নিয়েই আজকের সামান্য লেখা। তিনি অলৌকিক পীর ছিলেন কিনা আমার জানা নেই, তবে প্রথম আলো তাকে বানাতে চায় নিশ্চিত। তার মহাপ্রয়াণ উদযাপন উপলক্ষে প্রথম আলো গত ২৭-০৭-২০১২ তে কিছু ‘অলৌকিক ঘটনার বয়ান’ শিরোনামে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে যেখানে পীর সাহেব বেশ কিছু অলৌকিক ঘটনার বয়ান করেন। সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে বলার জন্য তিনি পুনরায় হকিং কে ডেকে এনে বলেন-

আমি মনে করি, ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে। আমি স্টিফেন হকিংয়ের একটা লেখা পড়লাম। প্রকৃতির মধ্যে কিছু নিদর্শন তো আছেই। তোমাকে একটা যুক্তি দিই, শোনো। এটা আমার সবচেয়ে প্রিয় যুক্তি। তুমি মঙ্গল গ্রহে গিয়েছ। সেখানে গিয়ে তুমি দেখলে পাহাড়, পর্বত, পাথর। পাথর দেখে তুমি বলবে, বহুকাল থেকে, সেই আদ্যিকাল থেকে পাথরগুলো এভাবেই আছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তুমি দেখতে পেলে একটা নাইকন ক্যামেরা। তুমি সেটা হাতে নেবে। তখন তোমাকে বলতেই হবে, এর একজন স্রষ্টা আছে। ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে তুমি এ কথা ভাবতে পারবে না যে শূন্য থেকে এটা আপনা-আপনি এসে হাজির হয়েছে। কারণ, এটা একটা জটিল যন্ত্র। এবার, আরেকটু এগিয়ে গেলে। কোত্থেকে একটা খরগোশ বেরিয়ে এসে তোমার দিকে তাকাল। নাইকন ক্যামেরা কী করে? ছবি তোলে। খরগোশ কী করে? অনেক কাজই করে। খরগোশের একটা কাজ হলো দেখা। এই খরগোশের চোখ নাইকন ক্যামেরার চেয়ে হাজার গুণ বেশি জটিল। নাইকন ক্যামেরাটা দেখে তোমার যদি মনে হয় যে এর একটা নির্মাতা থাকা দরকার, তাহলে খরগোশের বেলায় এটা তোমার মনে হবে না কেন? আমার প্রথম যুক্তি যদি গ্রহণ করো, আমার দ্বিতীয় যুক্তিটাও তোমাকে গ্রহণ করতে হবে।

ঈশ্বর আছে কি নেই সেই আলোচনা আজকে অবান্তর কিন্তু অবান্তর নয় হুমায়ুন আহমেদ ঈশ্বরের অস্তিত্ব ব্যবহার করতে যেয়ে যে যুক্তিটি তার ভক্ত সমাজে ছড়িয়ে দিলেন মীম আকারে সেই যুক্তির আলোচনা। তার এই বাক্যটুকুর শক্তি কতোটা এটা আমরা হয়তো অনেকেই জানি এবং এটাও জানি নেট জগতের এক কোনায় মুক্তমনা নামক ওয়েবসাইটে ছাপা হওয়া আমার এই ব্লগ খানির শক্তিহীনতা। তারপরও দলিল রইলো। ভিন্নমত খুঁজতে এসে কেউ যেনো বিফল না হয়।

নাইকন ক্যামেরা কাম ঘড়ি কাম খরগোস কাম চোখের গল্পযুক্তিটি প্রথম মাথায় এসেছিলো উইলিয়াম প্যালের সেই ১৮০২ সালে। এরপর থেকে দেশ থেকে দেশান্তরে অসংখ্য মানুষের মনে তার বসবাস। যুক্তিটির একটি গালভরা নামও আছে ‘ডিজাইন আর্গুমেন্ট’। এই আর্গুমেন্টটিতে জীব জগতের জটিলতা দেখে অতি চিন্তিত মানুষেরা কারিগর হিসেবে এক স্রষ্টার কথা ভেবেছে। আর আমি চিন্তিত অন্য আরেক বিষয় নিয়ে। ঘড়ির চেয়ে ঘড়ির কারিগর জটিল, চোখের চেয়ে চোখের কারিগর জটিল ঐকিক নিয়মে এই অংক সমাধান করার জন্য পরের লাইন লিখতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে যাই, সেই অতি জটিল চোখের কারিগর তবে কিভাবে আপনা আপনি কিংবা এমনি এমনি সৃষ্টি হয়ে গেলেন? তাকে সৃষ্টি করতে কি আরও জটিল কোনো সৃষ্টিকর্তা প্রয়োজন না? সেই জটিল জটিল সৃষ্টিকর্তাই বা সৃষ্টি হলেন কিভাবে? এইসব কথা বললেই- আইসে ব্যাটা নাস্তিক। দুই কলম পইড়া বিদ্বান হয়া গেছে।

ঐকিক নিয়মের যাঁতাকলে পিষ্ট করা ছাড়াও নাইকন যুক্তিটি আরেকটি ঝামেলা সৃষ্টি করে। হুমায়ুন আহমেদ যেমন বলেছেন: আমার প্রথম যুক্তি যদি গ্রহণ করো, আমার দ্বিতীয় যুক্তিটাও তোমাকে গ্রহণ করতে হবে। প্রথম যুক্তিটিই বা কিভাবে গ্রহণ করি। সৃষ্টিবাদের বিপরীত তত্ত্ব তো প্রাণ এমনে এমনে সৃষ্টি হয়েছে তত্ত্ব না। বিবর্তনের পথে জীবের উদ্ভব ক্যামনে ক্যামনে হয়েছে তা প্রমাণ আকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে/ হচ্ছে/ হতে থাকবে। প্যালের এই যুক্তির পর দুইশ বছরের বেশি অতিক্রান্ত হলো। কতো লক্ষ বার যুক্তির এই সীমাবদ্ধতাগুলো দেখানো হয়েছে, কতো লক্ষ ভাবে দেখানো হয়েছে তার তো হিসাব রাখা মুশকিল। তারপরও কেনো এই যুক্তি আমাদের এতো প্রিয় যুক্তি?

সেকথায় যাওয়ার আগে দ্য চোখ নামক জটিল অঙ্গটির এমনি এমনি ক্যামনে হবার কথা জানা যেতে পারে। যারা জানেন, তারা লাফ দেন।

ও পোড়া চোখ সমুদ্রে চল

ক্যামেরার মতো চোখেরও আলোকরশ্মি কেন্দ্রীভূত করার জন্য লেন্স, আলোকরশ্মির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইরিশ, আর এই আলোকরশ্মি থেকে ছবি আবিষ্কার করার জন্য একটি ফটোরিসেপ্টর প্রয়োজন। এই তিনটি যন্ত্রাংশ একসাথে কাজ করলেই কেবল চোখ দিয়ে কিছু দেখা সম্ভব হবে। এমন জটিল একটা অঙ্গের উদ্ভব কেমন করে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক হতে পারে?

ক্যামব্রিয়ান যুগে শরীরের ওপর আলোক সংবেদনশীল ছোট একটি স্থানবিশিষ্ট প্রাণীরা আলোর দিক পরিমাপের মাধ্যমে ঘাতক প্রাণীদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার অতি সামান্য সুযোগ পেত। সময়ের সাথে সাথে এই রঙিন সমতল স্থানটি ভেতরের দিকে ডেবে গিয়েছে, ফলে তাদের দেখার ক্ষমতা সামান্য বেড়েছে। গভীরতা বাড়ার পাশাপাশি পরবর্তীকালে আলো ঢোকার স্থান সরু হয়েছে। অর্থাৎ দেখার ক্ষমতা আরও পরিষ্কার হয়েছে। প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবর্তন প্রাণীকে সামান্য হলেও টিকে থাকার সুবিধা দিয়েছে। আর জগতে টিকে থাকাটাই সবচেয়ে বড় কাজ।

সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড্যান এরিক নিলসন গবেষণার মাধ্যমে বের করে দেখান যে, কীভাবে একটি প্রাণীর শরীরের ওপর আলোক সংবেদনশীল ছোট এবং রঙিন স্থান পরবর্তীকালে মানুষের চোখের মতো জটিল যন্ত্রে পরিবর্তিত হতে পারে।


ছবিঃ এক


ছবিঃ দুই

উপরের ছবি দুটি লক্ষ করুন। দ্বিতীয় ছবিতে একটি রুম, যেখানে একটি মাত্র বাতি বা আলোর উৎস আছে। প্রথম ছবিতে হাতে ধরা থাকা বোর্ডটি দিয়ে আমরা সে উৎসের দিকে তাকাই। সবচেয়ে বামের গর্তে সমতল কাগজ লাগানো। যার মাধ্যমে আমরা শুধু বুঝতে পারছি আলো আছে। কিন্তু কোথা থেকে আলো বের হচ্ছে কিংবা বাতিটি কোথায় তেমন কিছুই জানা যাচ্ছে না। তারপরের গর্তে একটি পিংপং বল রাখা। যে বলটির আলো প্রবেশের স্থানটি চওড়া আর গভীরতা কম। এর মাধ্যমে আগের সাদা কাগজ থেকে কিছুটা ভালোভাবে আলোর উৎস সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব হচ্ছে। তার পরেরটার আলো প্রবেশের স্থান আগেরটার চেয়ে সংকুচিত এবং গভীরতা বেশি। সর্ব ডানেরটার আলো প্রবেশের স্থান সবচেয়ে সংকুচিত এবং গভীরতা সবচেয়ে বেশি। আর এটি দিয়েই আমরা সবচেয়ে ভালোভাবে আলোটির উৎস বুঝতে পারছি।

এখন প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রতিটি পরিবর্তনই প্রাণীকে কিঞ্চিৎ হলেও আক্রমণকারীর হাত থেকে বাঁচার সুবিধা প্রদান করেছে। যারা সামান্য দেখতে পাচ্ছে তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়েছে, বেড়েছে তাদের সন্তান বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনা। অপরদিকে অথর্বরা হারিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে বংশানুক্রমে উন্নতি হয়েছে দৃষ্টিশক্তির। সময়ের সাথে সাথে শুরুর এই আলোক সংবেদনশীল স্থান রেটিনায় পরিণত হয়েছে, সামনে একটি লেন্সের সৃষ্টি হয়েছে।

স্বচ্ছ তরলে পরিপূর্ণ।

স্বচ্ছ তরলে পরিপূর্ণ।

তরল ঘন হচ্ছে

তরল ঘন হচ্ছে

ঘন হতে হতে লেন্সের সৃষ্টি

ঘন হতে হতে লেন্সের সৃষ্টি

ধারণা করা হয়, প্রাকৃতিক ভাবে লেন্সের সৃষ্টি হয়েছে যখন চোখকে পূর্ণ করে রাখা স্বচ্ছ তরলের ঘনত্ব সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে। উপরে দেখুন, সাদা অংশটি তৈরি হচ্ছে চোখকে পূর্ণ করে রাখা স্বচ্ছ তরলের মাধ্যমে। তরলের ঘনত্ব যত বেড়েছে লেন্সের গঠন তত ভালো হয়েছে, প্রখর হয়েছে দৃষ্টিশক্তি।

বলে রাখা প্রয়োজন বিজ্ঞানীদের দ্বারা বর্ণিত চোখের বিবর্তনের প্রতিটি স্তর বর্তমানে জীবিত প্রাণীদের মধ্যেই লক্ষ করা যায়। এছাড়াও শুধু আলোক সংবেদনশীল স্থান বিশিষ্ট প্রাণী ছিল আজ থেকে ৫৫ কোটি বছর আগে। বিজ্ঞানীরা গণনা করে বের করেছেন, এই আলোক সংবেদনশীল স্থানটি মানুষের চোখের মতো হওয়ার জন্য সময় প্রয়োজন মাত্র ৩৬৪ হাজার বছর।

উৎপত্তি নিয়ে তো জানা হলো। কিন্তু চোখটা কি আসলেই সুনিপুণ কোনো অঙ্গ?

মানুষের চোখের অক্ষিপটের ভেতরে এক ধরনের আলোগ্রাহী কোষ আছে যারা বাইরের আলো গ্রহণ করে এবং একগুচ্ছ অপটিক নার্ভের (আলোকগ্রাহী জাল) মাধ্যমে তাকে মস্তিষ্কে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করে, ফলে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, অক্ষিপটের ঠিক সামনে এই স্নায়ুগুলো জালের মতো ছড়ানো থাকে, এবং এই স্নায়ুগুলোকে যে রক্তনালীগুলো রক্ত সরবরাহ করে তারাও আমাদের অক্ষিপটের সামনেই বিস্তৃত থাকে। ফলে আলো বাধা পায় এবং আমাদের দৃষ্টিশক্তি কিছুটা হলেও কমে যায়। স্নায়ুগুলোর এই অসুবিধাজনক অবস্থানের কারণে আমাদের চোখে আরেকটি বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্নায়বিক জালটি মস্তিষ্কে পৌঁছনোর জন্য অক্ষিপটকে ফুটো করে তার ভিতর দিয়ে পথ করে নিয়েছে। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে একটি অন্ধবিন্দুর (blind spot) ।


চিত্র : মানুষের চোখের ভেতরে তৈরি হওয়া অন্ধবিন্দু।

কুকুর, বিড়াল কিংবা ঈগলের দৃষ্টিশক্তি যে মানুষের চোখের চেয়ে বেশি তা সবাই জানে। মানুষ তো বলতে গেলে রাতকানা, কিন্তু অনেক প্রাণীই আছে রাতে খুব ভালো দেখতে পায়। আবার অনেক প্রাণীই আছে যাদের চোখে কোনো অন্ধবিন্দু নেই। যেমন, স্কুইড বা অক্টোপাস। এদের মানুষের মতোই এক ধরনের লেন্স এবং অক্ষিপটসহ চোখ থাকলেও অপটিক নার্ভগুলো অক্ষিপটের পেছনে অবস্থান করে এবং তার ফলে তাদের চোখে কোনো অন্ধবিন্দুর সৃষ্টি হয় নি।
গুড ডিজাইনের আলোচনা যেহেতু বার বার চোখকে ডেকে আনে তাই কিছু বদ মানুষ চোখের এই সীমাবদ্ধতাকে ‘ব্যাড ডিজাইন’ বলে অভিহিত করেন। অবশ্য চোখ দিয়ে যেহেতু ভালোভাবেই কাজ চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে তাই ‘ব্যাড ডিজাইন’-এর মতো শব্দ প্রয়োগে নারাজ জীববিজ্ঞানী কেনেথ মিলার। তাঁর মতে, চোখের এমন হওয়ার কারণ বিবর্তন তত্ত্ব দিয়ে বেশ ভালোভাবে বোঝা যায়। বিবর্তন কাজ করে শুধু ইতোমধ্যে তৈরি বা বিদ্যমান গঠনকে পরিবর্তন করার মাধ্যমে। মানুষের মতো মেরুদণ্ডী প্রাণীর চোখের উদ্ভব হয়েছে অনেক আগেই সৃষ্টি হওয়া মস্তিষ্কের বাইরের দিকের অংশকে পরিবর্তন করে। বহুকাল ধরে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কের বাইরের দিক আলোক সংবেদনশীল হয়েছে, তারপর ধীরে ধীরে অক্ষিপটের আকার ধারণ করেছে। যেহেতু মস্তিষ্কের পুরোনো মূল গঠনটি বদলে যায় নি, তাই জালের মতো ছড়িয়ে থাকা স্নায়ুগুলোও তাদের আগের অবস্থানেই রয়ে গেছে। কিন্তু অন্যদিকে স্কুইড জাতীয় প্রাণীর চোখ বিবর্তিত হয়েছে তাদের চামড়ার অংশ থেকে, মস্তিষ্কের অংশ থেকে নয়। এক্ষেত্রে ত্বকের স্নায়ুগুলো মস্তিষ্কের মতো ঠিক বাইরের স্তরে না থেকে ভেতরের স্তরে সাজানো থাকে, আর এ কারণেই স্নায়ুগুলো চোখের অক্ষিপটের সামনে নয় বরং পেছনেই রয়ে গেছে। চোখের ক্ষেত্রে তাই গুড ডিজাইন বা ব্যাড ডিজাইন তর্ক অপ্রাসঙ্গিক। এটাকে তো ডিজাইনই করা হয় নি।

বিবর্তনের পথে অন্তত চল্লিশ রকমভাবে চোখ তৈরি হতে পারত। আলোক-রশ্মি শনাক্ত এবং কেন্দ্রীভূত করার আটটি ভিন্ন উপায়ের সন্ধান দিয়েছেন নিউরো-বিজ্ঞানীরা। কিন্তু পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের যুদ্ধে অসংখ্য সমাধানের মধ্যে একটি সমাধান টিকে গিয়েছে। সংক্ষেপে, চোখের গঠন যদি বাইরের কারও হস্তক্ষেপ ব্যতীত, শুধু বস্তুগত প্রক্রিয়ায় উদ্ভব হতো তাহলে দেখতে যেমন হওয়ার কথা ছিল ঠিক তেমনই হয়েছে। চোখের গঠনে কারও হাত নেই, নেই কোনো মহাপরাক্রমশালী নকশাকারের নিপুণতা।

তারপরও আমরা মানিনা কেনো, কেনো, কেনো?

আগেই বলেছি, নাইকন ক্যামেরার এই গল্পের উৎপত্তি হয়েছে সেই ১৮০২ সালে কিংবা হয়তো আরও আগে। মজার ব্যাপার হলো, ১৮২৭ সালে চার্লস ডারউইন (মৃত্যু : ১৮৮২) যখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য, তখন তাঁকে বরাদ্দ করা হয় ৭০ বছর আগে উইলিয়াম প্যালে যে কক্ষে থাকতেন সেই কক্ষটিই। ধর্মতত্ত্বের সিলেবাসে ততদিনে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া প্যালের কাজে গভীরভাবে আলোড়িত ডারউইন পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ইউক্লিডের রচনা আমাকে যেরকম মুগ্ধ করেছিল ঠিক সেরকম মুগ্ধ করেছিল প্যালের বই’। কিন্তু পরবর্তীকালে এই ডারউইনই প্যালের প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক জবাব দানের মাধ্যমে এই যুক্তিকে সমাধিস্থ করেন। তারপর থেকে অসংখ্য বার এই যুক্তিকে সমাধিস্থ করা হয়েছে। কিন্তু প্যালের ঘড়ি কিংবা হুমায়ুনের ক্যামেরার মৃত্যু নেই, সমাধিস্থ হওয়া তো দূরের কথা।

কিন্তু কেন? বোধহয় আমাদের বিশ্বাস নামক গুনটির জন্যই। আমরা মানুষেরা বিশ্বাসে বিশ্বাসী। আমাদের এই বিশ্বাস নামক গুনটির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিশ্বাস নামক এই সহজাত প্রবৃত্তির কারণে যেকোনো ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সময় আমরা কেবল মাত্র যা ‘দেখতে চাই’ সেটাই দেখি, ঘটনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপসংহারে পৌঁছাবার কথা থাকলেও বিশ্লেষণে না গিয়ে আমরা সাধারণ যেই উপসংহারে পৌঁছাতে চাই, সেখানেই পৌঁছাই। উদাহরণ হিসেবে পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোর কথা বলা যায়। রাশাদ খলিফা নামক এক ব্যক্তি কোরান শরীফ পর্যালোচনার মাধম্যে প্রমাণ করেছিলেন, মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরীফকে আল্লাহ উনিশ নামক সংখ্যা দ্বারা বেঁধে দিয়েছেন। তার এই বিশ্লেষণের পরেই বিভিন্ন মানুষেরা তার বিশ্লেষণের ফাঁক তুলে ধরে দেখিয়েছিলেন খলিফা আসলে ছলচাতুরী ছাড়া আর কিছু করেন নি। কিন্তু মুসলমানদের কাছ খলিফার বিশ্লেষণ যতোটা জনপ্রিয় হয়েছে তার তুলনায় একেবারেই ভাত পায়নি ভিন্ন মানুষদের করা তার বিশ্লেষণের বিশ্লেষণ। কারণ মুসলমানরা পবিত্র কোরআন যে একটি অলৌকিক গ্রন্থ মনে প্রাণে সেটা বিশ্বাস করে। রাশাদ খলিফা যেহেতু এই অলৌকিকতার একটি প্রমাণ হাজির করেছেন তাই সেটি তারা বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করেছেন, তাঁদের মাথাতেই আসেনি এটা ভুল হবার সম্ভাবনার কথা। সবক্ষেত্রেই দেখা যায়, আমাদের আগে থেকে ধারণ করা বিশ্বাসের সাথে খাপে খাপ মেলে এমন ঘটনা আমরা যুগের পর যুগ, শতবর্ষের পর শতবর্ষ মনে রাখি, আর মুহূর্তের মাঝে আস্তা-কুড়ে ফেলে দেই, যা মেলেনি আমাদের বিশ্বাসের সাথে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাথে আমাদের পূর্ববর্তী বিশ্বাসের বিরোধ না থাকায় আমরা সেটা বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করেছি আবার একই সাথে বিনা দ্বিধায় অবিশ্বাস করেছি বিবর্তনকে। ফ্রান্সিস বেকন এসব দেখেই হয়তো বলেছিলেন- ‘আমরা কেবল মাত্র সেটাই বিশ্বাস করি, যেটা আমাদের কাছে সত্য মনে হয়’। ঠিক তাই, যৌক্তিকভাবে বাঁদরের আত্মীয় হবার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো আমরা নিজেরা কি হতে চাই, আমাদের পূর্ববর্তী বিশ্বাস আমাদের কি হবার কথা বলছে। বিশ্বাস আমাদের কাছে অনেকটা পার্থিব সম্পদের মতো। কখনও বংশানুক্রমে আমরা বিশ্বাসের মালিক হই, কখনো জমি-জমার মতো অন্যের বিশ্বাস গ্রহণ করি আবার কখনোবা বিশ্বাস ত্যাগ করি। আমাদের বিশ্বাস আমাদের পরিচয় প্রকাশ করে।

আমাদের ধারণকৃত অসংখ্য বিশ্বাসের দিকে তাকালে দেখা যায় এই বিশ্বাসগুলো মূলত কোনো ঘটনার উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা কিংবা ঘটনাটির অভীষ্ট লক্ষ্যের উত্তর। আমরা মানুষেরা শুধু কাজ সহ্য করতে পারিনা- কাজ দেখলেই আমরা ধরে নেই অবশ্যই কাজটা হবার পেছনে কোনো কারণ আছে- আগে cause তারপর effect। শুধু কাজের কথা জেনে আমরা শান্তিতে থাকতে পারিনা, আমরা কারণ খুঁজি। দুনিয়াবি সব ঘটনার সঠিক কারণ জানা ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে অসম্ভব কিন্তু যে মানুষেরা নিজেদের সৃষ্টি সেরা জীব দাবী করে তারা অল্প খরচে সকল ঘটনার কারণ জানা পার্টি। তাদের সকল ধরণের কারণের কারণ ঈশ্বর। এবং তারপর দাঁড়ি মানে একেবারে দাঁড়ি। ঈশ্বরের কারণ জানা যাবেনা।

এ কথাগুলো নতুন করে বলার কিছু ছিল না। অবিশ্বাসের দর্শন বইয়ে আমরা ইতোমধ্যেই এগুলো বলেছিলাম, মুক্তমনার বিবর্তন আর্কাইভেও প্যালের যুক্তির খণ্ডন আছে।  উইকিতেও চোখের বিবর্তন খুব পরিস্কার করেই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে । তারপরেও আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই পুরোন কথাই আবারো নতুন করে বলতে হয়। পীরের দাপট তো কম নয়! সে যাই হোক, গতকাল খবর পেলাম মুক্তমনা ব্লগার শফিউল জয় অবিশ্বাসের দর্শন বইটার চমৎকার একটা রিভিউ করেছেন, সেটি বের হয়েছে বইয়ের জগৎ এর এবারের সংখ্যায় (নবম সংকলন)। সেখানে তিনি লিখেছেন  –

…হুমায়ূন আহমেদ তাঁর আরেকটি লেখায় মঙ্গলগ্রহে ক্যামেরা পাওয়ার উদাহরণ টেনে ঈশ্বরের সপক্ষে যুক্তি দিয়ে একটা অবৈজ্ঞানিক লেখা লিখেছিলেন,

“…যদি মঙ্গল গ্রহে হাঁটতে হাঁটতে একটা ডিজিটাল নাইকন ক্যামেরা পেয়ে যান, তাহলে তাঁকে বলতেই হবে এই ক্যামেরা আপনা-আপনি হয় নি। এর একজন সৃষ্টিকর্তা আছে।” [হুমায়ূন আহমেদ, মহেশের মহাযাত্রা, কালের কণ্ঠ, ১৭ জুন ২০১১]

এই ডিজাইন আর্গুমেন্টের বিপক্ষ যুক্তি অনেক আগেই অবিশ্বাসের দর্শন বইতে দেয়া আছে দ্বিতীয় অধ্যায়ে। লেখকেরা জানিয়েছেন, উইলিয়াম প্যালে ১৮০২ সালে প্রকাশ করেন ‘Natural Theology, or Evidence of Existence and Attributes of the Deity, Collected from the Appearances of Nature’ নামের বইটি। ধর্ম ও দর্শনের এই বিখ্যাত বইয়ে প্যালে রাস্তার ধারে একটি ঘড়ি এবং পাথর পড়ে থাকার উদাহরণ হাজির করেছিলেন …

নিঃসন্দেহে ঘড়ির (কিংবা ধরা যাক হুমায়ূন আহমেদের ক্যামেরার কথাই) গঠন পাথরের মতো সরল নয়। একটি ঘড়ি দেখলে বোঝা যায় – ঘড়ির ভিতরের বিভিন্ন ছোট ছোট অংশগুলো কোনো এক কারিগর এমনভাবে তৈরি করেছেন যেন সেগুলো সঠিকভাবে সমন্বিত হয়ে কাঁটাগুলোকে ডায়ালের চারপাশে মাপমতো ঘুরিয়ে ঠিকঠাক মতো সময়ের হিসেব রাখতে পারে। কাজেই পথে ঘড়ি কুড়িয়ে পেলে যে কেউ ভাবতে বাধ্য যে ওখানে আপনাআপনি ঘড়ির জন্ম হয়নি বরং এর পেছনে একজন কারিগর রয়েছেন যিনি অতি যত্ন করে একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ঘড়িটি তৈরি করেছেন। ধর্মবেত্তা উইলিয়াম প্যালে যেখানে ঘড়ির কথা বলেছিলেন, হুমায়ূন আহমেদ একই ধরনের যুক্তির অবতারণা করেছেন মঙ্গল গ্রহে ‘হাঁটতে হাঁটতে’ একটা ডিজিটাল ‘নাইকন ক্যামেরা’ পাওয়ার কথা উল্লেখ করে। বলাবাহুল্য, আমরা জানি এই জনপ্রিয় ভাববাদী যুক্তিগুলো খণ্ডিত হয়েছে অন্তত কয়েক দশক আগেই। বস্তুত ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব আসার পর প্যালের ডিজাইন-তত্ত্বের অপমৃত্যুই ঘটেছে বলা যায়। যেমন, জীবজগতে চোখ বা এ ধরনের জটিল প্রত্যঙ্গের উদ্ভব ও বিবর্তনের পেছনে ডারউইন প্রস্তাব করেছিলেন প্রাকৃতিক নির্বাচন নামক বস্তুবাদী প্রক্রিয়ার, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লাখ লাখ বছর ধরে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা পরিবর্তনের ফলে চোখের মতো অত্যন্ত জটিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গড়ে ওঠা সম্ভব। একাধিক ধাপে ঘটা এ প্রক্রিয়াটির নাম ক্রমবর্ধমান নির্বাচন (Cumulative selection)। একাধিক ধাপের এই ক্রমবর্ধমান নির্বাচনের মাধ্যমে যে ধাপে ধাপে জটিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উদ্ভূত হতে পারে তা ইতোমধ্যেই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। বইয়ের লেখকেরা অজস্র রেফারেন্সের মাধ্যমে বিষয়টি পাঠকদের জন্য পরিষ্কার করেছেন। ডারউইনের অনেক আগে জন্মানো প্যালেকে না হয় ক্ষমা করা যায় বিবর্তন তত্ত্ব না জানা থাকার অজুহাতে – ১৮০২ সালের একটি লেখায় ঝোপঝাড়ে পড়ে থাকা ঘড়ির মধ্যে ঈশ্বর আবিষ্কার করতে, কিন্তু এর দুশ বছর পরে যখন বিবর্তন একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাপার, যখন স্টিফেন হকিং-এর মতো পদার্থবিদেরা ঈশ্বরের অনুকল্প ছাড়াই মহাবিশ্বের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে পারছেন (এ প্রসঙ্গে স্টিফেন হকিং এবং লিওনার্ড ম্লোডিনোর লেখা The Grand Design বইটি পড়া যেতে পারে), এই আধুনিক সময়ের বাসিন্দা হয়েও হুমায়ূন আহমেদ এখনো মঙ্গল গ্রহে ক্যামেরার দোহাই দিয়ে ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, এটি দেখেই বরং অবাক হতে হয়; রবিঠাকুরের ভাষায় – ‘বড় বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে’! …

যেকোনো ঘটনা দেখলেই এর পেছনে উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা বা ঘটনাটির লক্ষ্যের কথা আমাদের মাথায় আসে বলে বিবর্তনের মতো একটি লক্ষ্যহীন বাস্তবতা আমরা এখনও গ্রহণ করতে পারিনি। এককোষী ব্যাকটেরিয়া একদিন বড় হয়ে হুমায়ুন আহমেদ হবে এমন চিন্তা করে নিজেদের বিবর্তন করা শুরু করেনি। বিবর্তন হলুদ হিমুর মতো লক্ষ্যহীন, উদ্দেশ্যহীন। লক্ষ্যহীনতা, উদ্দেশ্যহীনতা আমাদের ভালো লাগেনা। আমরা লক্ষ চাই, উদ্দেশ্য চাই। আমরা ঈশ্বরকে চাই। আমরা চিন্তাহীন, শান্তিময় জীবন যাপন করতে চাই।

আমাদের সমাজে হুমায়ুন আহমেদ আর নাইকনের গল্প জনপ্রিয় হবেনা তো কি মঙ্গলগ্রহে হবে?