সুইজারল্যান্ডে কয়েকদিন

সারা বছর কাম কাজের ভিড়ে ঘোরাঘুরির যে খুব একটা সময় পাই তা  নয়। তারপরেও চেষ্টা করি বছরে দুই একবার যাবতীয় কাজ কর্ম সব শিকোয় তুলে সপ্তাহ-খানেকের জন্য লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার। লাপাত্তা মানে কেবল বাড়ি কিংবা শহর থেকে হাওয়া নয়, একেবারে বারাক রাজার দেশ থেকেই সপরিবারে পলায়ন। এতে করে দুটা উপকার। একঘেয়ে কাম কাজের আবর্জনা থেকে অন্ততঃ সপ্তাহ-খানেকের জন্য হলেও রেহাই পাওয়া যায়, এতে দেহ মনে কেমন একটা ফুর্তি ফুর্তি ভাব আসে, মন প্রাণ চাঙ্গা হয়; আর এর পাশাপাশি নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ, নতুন কৃষ্টির সাথে একটা পরিচয় ঘটার সুযোগ হয়ে যায় (নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ, নতুন কৃষ্টি! কী বড় বড় কথা !হু! আসলে কিন্তু সবই অফিস ফাঁকি দিয়ে ঘোরাঘুরির ধান্ধা)।

কৃষ্টি হোক আর ধান্ধা হোক, সুইজারল্যান্ড দেশটা নেহাত মন্দ না। ছবির মতন দেশ। একবার গেলে আর ফিরতে মন চাইবে না। আমারো কি ছাই চাইছিলো? এ বছরের (২০১২) মার্চ মাসের শেষ থেকে এপ্রিলের পুরো প্রথম সপ্তাহটা কাটিয়ে এলাম সুইজারল্যান্ডে। কেমন যেন ঘোরলাগা পরিবেশ। সবুজ প্রান্তর ঘেঁষে উঁচু পাহাড়, সুনীল আকাশ আর বহমান নদীর তীর ঘেঁষা শহর। আমরা ছোটবেলায়  ছবি আঁকার খাতায় যে অবারিত সবুজের যে ছবি আঁকতাম, পুরো সুইজারল্যান্ডই যেন সেরকম সবুজ প্রান্তরের এক ছিমছাম ক্যানভাস। এই যে এই ছবিটার কথাই ধরুন –

এরকম কত ছবিই তো আমরা ছেলেবেলায় এঁকেছি, তাই না! বয়ে চলা নদী, দু-পাশে বিস্তীর্ণ মাঠ  আর মাঝে সাঝে ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর;  দূরে ঝাউ-বন আর উপরে নীল আকাশের ফালি। খুব চেনা নয় কি ছবিটা? আমারো খুব চেনা চেনা লাগে দেখলেই, মনে পড়ে যায় ছোটবেলাকার ছবি আঁকার খাতাটার কথা। এ ছবিটা দেখলে কে বলবে এটা আমাদের পুরনো ভাঙ্গাচোরা ক্যামেরায় তোলা, জুরিখ লেকে নৌ-ভ্রমণের সময়?

তবে সুইজারল্যান্ডে কেবল নদী আর সবুজ মাঠই নেই, উপরি পাওনা হিসেবে আছে শ্বেত শুভ্র বরফাচ্ছাদিত পাহাড়।  ভাবছেন কয় ছিলিমের গাঁজা খেয়ে লিখতে বসেছি!  মার্চ মাসের গরমে আর বরফ কোথায়। এই বার বুঝি রাম ধরা! তবে কানে কানে বলে রাখি সুইজারল্যান্ডের কোন কোন জায়গায় সারা বছরই তুষারাচ্ছন্ন থাকে। তবে সে সমস্ত জায়গায় আপনি হেঁটে বা বাসে করে যেতে পারবেন না।  আপনাকে চাপতে হবে এক বিশেষ ধরণের বাহনে। নাম তার গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেস।  সুইসরা আদর করে বলে – ‘স্লোয়েস্ট ফাস্ট ট্রেন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’।  আট ঘণ্টা ধরে আপনি ট্রেনে চেপে গজকচ্ছপ গতিতে চলতে চলতে সুইজারল্যান্ডের এ মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত মোহনীয় সব দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন, আর মাঝে মধ্যেই পেয়ে যাবেন পরম আরাধ্য তুষারাচ্ছাদিত হিমশৈলের দেখা।  গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেসে চরবেন, কিন্তু গ্লেসিয়ার দেখবেন না তা হয় নাকি!

তো আমরাও দেখলাম।  জুরিখের অদূরে chur নামে একটা জায়গা আছে, ভুলেও এটাকে  ‘চার’ উচ্চারণ করবেন না।  সটান তাইলে শচীন তেণ্ডুলেকরের পিটা খেয়ে বাউন্ডারির বাইরে চলে যেতে হবে। ওখানকার লোকে ওটাকে ‘ক্ষুর’ বলে। যস্মিন দেশে  যদাচার। ক্ষুরই সই। সেই ঘোড়ার ক্ষুর থেকে গজেন্দ্র গমনে গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেস করে নানা চড়াই উৎরাই পার করে অবশেষে জার্মেট নামে একটা জায়গায় পৌঁছলাম। এর মধ্যে সমভূমি, মালভূমি, মরুভূমি, পর্বতভূমি, পাথুরে ভূমি হিমশৈলভূমি সহ সব ধরণের ভূমিরাজি তো বটেই  এমনকি ট্রেনের জানালা দিয়ে এ ধরণের কিছু ছোটখাটো প্রস্রবণও দেখা হল। এমনি একটি ক্ষুদে প্রস্রবণের ছবি দিলাম (ট্রেনের জানালার পুরু কাঁচ ভেদ করে তোলা ছবি বলে খানিকটা ঝাপসা লাগলেও, এর বন্য সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে খুব একটা কষ্ট হবার কথা নয়) –

এভাবে সব কিছু পার টার করে জার্মেট এসে থামলেন গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেস ইতি কুঞ্জরঃ। জার্মেট জায়গাটা গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেসের একেবারে শেষ স্টেশন। সেখানে নেমে ম্যাটারহর্ন দেখা হল।  ও ভাল কথা – ম্যাটারহর্ন হচ্ছে একটা সুইস-ইতালি সীমান্তের একটা পর্বতশৃঙ্গের নাম। ইতালিয়ান নাম মন্টে কার্ভিনো। আর ফ্রেঞ্চ নাম মন্ট কার্ভিন। তবে ইতালি, ফ্রান্স জার্মনরা যে নামেই ডাকুক না কেন উচ্চতায় সাড়ে চোদ্দ হাজার ফুটকেও ছাড়িয়ে যাওয়া পাহাড়টা পৃথিবীতে সুইস বা সুইজারল্যান্ডের ছাপ্পা মারা পর্বতশৃঙ্গ হিসেবেই বেশি বিখ্যাত; এমনকি এটা অনেকের কাছেই এখন সুইস-আল্পস পর্বতমালার প্রতীক। ভারতে কাঞ্চন জঙ্ঘা দেখতে যেমন লোকে ভিড় করে, ঠিক তেমনি বহু লোক জার্মেট স্টেশনে নেমেও উদাস নয়নে ম্যাটারহর্নের দিকে তাকিয়ে থাকে।  তখন সূর্য ডুবে প্রায় সন্ধ্যা। আমরাও তাকালাম।  পুব আকাশের পর্বত শৃঙ্গটা দেখতে অনেকটা এরকমের লাগলো  –

ভাবছেন এ আর এমন কী!  সামান্য পাহাড় বই তো কিছু নয়।  কিন্তু ম্যাটারহর্নের আসল মজাটা সন্ধ্যে বেলায় নয়। সকাল বেলায় সূর্যোদয়ের সময়।  প্রভাত-বেলার  ম্যাটারহর্নের ছবি একেবারেই আলাদা, সূর্যের প্রথম কিরণ আকাশের ফালি ভেদ করে পর্বতশৃঙ্গে পড়ছে আর ধীরে ধীরে গোটা পাহাড়টা যেন লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠছে, পুরো দৃশ্যটা আমাদের পরিচিত কাঞ্চনজঙ্ঘাকে মনে করিয়ে দেয় অনেকটা এরকমভাবে –

তবে একটা সত্য কথা চুপি চুপি বলে রাখি, প্রত্যুষ-বেলায় ম্যাটারহর্নের লজ্জায় আরক্তিম মুখ দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি।  ম্যাটারহর্নের প্রথম ছবিটা (মানে সন্ধ্যে বেলার ছবিটা) আমার ক্যামেরায় তোলা হলেও  দ্বিতীয়টা নয়, ওটা ইন্টারনেট থেকে মেরে দেওয়া (উৎস এখানে)।

এমন নয় যে ম্যাটার্হনে সূর্যোদয় দেখায় আমাদের কোন আগ্রহের কমতি ছিল, কিন্তু তার চেয়েও বড় একটা কৌতূহল আমাদের সে সময় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সে সময়। কৌতূহলের  মাত্রা এতোই বেশি ছিলো যে জার্মেটে ম্যাটারহর্নের লজ্জাবিধুর নববধুকে এক ঝলক দর্শন করেই বিদায় দিয়ে উঠে পড়তে হয়েছিল লোকাল ট্রেনে।  কারণ যেতে হবে জেনেভা।  আমাদের পরম আকাঙ্ক্ষিত সার্ন তো ওখানেই!

জেনেভা যখন পৌঁছুলাম তখন গভীর রাত্তির।  প্রায় মধ্যরাত। এই সময় তো আর সার্নে যাওয়া যায় না। তাই কৌতূহলের ঝাঁপি বন্ধই রাখতে হল সকাল না হওয়া পর্যন্ত।

অবশেষে সার্ন

সার্নে যাওয়া কেন?  কারণ ওটাই এই মুহূর্তে বিজ্ঞানের ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’!  জীবন জগতের  তাবৎ বড় বড় প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছেন ঝানু-মাথা বিজ্ঞানীরা ওখানে বসে।  এই যে সব পাগলাটে প্রশ্নগুলো – মহাবিশ্বটা কীভাবে তৈরি হল, এটা তৈরি হয়েছেই বা কী দিয়ে, এর পেছনে কোন্‌ কোন্‌ প্রাকৃতিক বলগুলো কাজ করছে, মহাবিশ্ব যে প্রাকৃতিক নিয়মগুলো মেনে চলে তার উৎসই বা কোথায়,  আমরাই বা এলাম কোথা থেকে, আমাদের গন্তব্যই বা  কোথায়… সবই  এখানকার বিজ্ঞানীদের গবেষণার অন্তর্ভুক্ত।  আমার কথা যদি আপনার বিশ্বাস না হয় তবে আপনাকে সার্নের ভ্রমণার্থীদের জন্য উন্মুক্ত ভবনটা ঘুরতে হবে।  ভবনটা দেখে আহামরি কিছু মনে হবে না।  ওটার ঠিক উল্টোদিকে গ্যালিলিও গ্যালিলি স্কয়ার আছে, সেটাই হয়তো আপনার নজর কাড়বে সবার আগে।  সেখানে ঢুকলে প্রথমেই মুখোমুখি হবেন জগতের অন্তিম সব প্রশ্নগুলোর যা আপনাকে আচ্ছন্ন করেছে জীবনের কোন না কোন সময় –

তবে সার্নের মূল আকর্ষণ অবশ্যই দার্শনিক কচকচানি প্রতিষ্ঠা নয়, বরং সমগ্র পৃথিবী-বাসীর যাবতীয় আকর্ষণ শ্যেন চক্ষুর নীচে আছে পৃথিবীর বৃহত্তম কণা ত্বরক হিসেবে স্বীকৃত সেই লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার, যাকে সংক্ষেপে আমরা LHC বলি।  সে এক বিশাল যন্ত্রদানব। আমাদের কোন ধারনাতেও আসবেনা কতটা বিশাল।  জেনেভার সীমান্তে জুরা পাহাড় বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে নানা কায়দা কসরত করে মাটির পঞ্চাশ থেকে একশ পঞ্চাশ মিটার (মানে প্রায় ১৬৫ ফুট থেকে পাঁচশ ফুট) নীচে ২৭ কিলোমিটার (মানে প্রায় সাড়ে সতের মাইল) পরিধির ধাতব এক টিউব বসানো হয়েছে। নীচে একটা ছবি দিলাম ব্যাপারটা বোঝাতে।

আর পাশাপাশি লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের পাশে আমার পোস মারা একটা ছবি না দিলে কি হয়?

হেঃ হেঃ লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের পাশে আমার ছবি দেখে যারা বিস্মিত হচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, নাহ ওটা আসল কোলাইডার নয়,  দর্শনার্থীদের জন্য রাখা একটা মডেল-মাত্র।

বলা বাহুল্য, এই লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার ব্যাটা শুধু সুইজারল্যান্ডেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সুইজারল্যান্ডের লেক জেনেভার নীচ দিয়ে চলে গেছে একেবারে ফ্রান্স অব্দি। এখন কথা হচ্ছে এত কষ্ট করে এই টিউব বসানোর প্রয়োজন পড়লো কেন? টিউব বললাম বটে কিন্তু টিউবের মধ্যে রয়েছে নানা ধরণের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি, যেগুলো একচুল এদিক ওদিক হলে যন্ত্রটা আর কাজ করবে না। আর তার উপরে রয়েছে আবার চার জায়গায় চার ধরণের বিশাল পার্টিকেল ডিটেক্টর বা কণা সনাক্তকারক।  এলিস (ALICE), আটলাস (ATLAS), সিএমএস (CMS) এবং এলএইচসিবি (LHCb)।  তা এই প্যাচাইন্না টিউবের যত ক্যারিশমাই থাকুক না কেন,  মনে রাখতে হবে – এই হতছারা টিউবটাই যত নষ্টের গোঁড়া, যাবতীয় কুকর্ম আর কৃষ্ণলীলার  আঁধার। ঐ যে আমরা জানি প্রায় ১৩.৭ বিলয়ন বছর আগে এক বিশাল বিস্ফোরণ হয়েছিলো আর তার ফলশ্রুতিতে তৈরি হয়েছিলো এই মহাবিশ্ব, সেটার পুরোপুরি না হলেও এক ধরণের কৃত্রিম দশা তৈরি করতে পারবেন বিজ্ঞানীরা এই ধাতব টিউবের মধ্যে। আমরা তো জানি এ মহাবিশ্বের কিভাবে শুরু হয়েছে তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের নানা তত্ত্ব ছিল, এখনো আছে। আর ধার্মিক-বাবাদের ‘কুন ফায়া কুন” কিংবা ‘ছয় দিনে বিশ্বসৃষ্টি অরে সপ্তম দিনে সাবাত’ গ্রহণের নানা গল্পকথার কথা নাহয় বাদই দিলাম। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে স্বীকৃত তত্ত্ব বলে বিজ্ঞানীরা যেটা গ্রহণ করে নিয়েছেন সেটা হচ্ছে মহাবিস্ফোরণের প্রমিত বা স্ট্যান্ডার্ড মডেল। তবে প্রমিত মডেলের  সবকিছুই  যে পরীক্ষালব্ধ-ভাবে প্রমাণিত তা নয়।  কিছু কিছু জায়গায় ফাঁক ফোঁকর আছে। কিন্তু ফাঁক ফোকর থাকলেও সে ফাঁকে কি ছাতা মাথা বসবে তা ভালই বুঝতে পারেন বিজ্ঞানীরা। আপনারা যারা jigsaw puzzle নিয়ে ছোটবেলায় খেলা করেছেন তারা জানেন ব্যাপারটা। বিভিন্ন টুকরা জোড়া দিতে দিতে আপনি যখন ক্রমশ বুঝতে পারেন আপনার সামনে একটা পরিচিত ছবি ক্রমশ ফুটে উঠতে শুরু করেছে, তখন দু একটা টুকরা বাকি থাকলেও আপনার বুঝতে সমস্যা হয় না, যে পুরো ছবিটা আসলে দেখতে কেমন হবে,  তাই না? সার্নের বিজ্ঞানীরাও  মনে করেন নানা ধরনের কণার  ধুমধাড়াক্কা সংঘর্ষ (এই সংঘর্ষ যেমনি হতে পারে প্রোটন- প্রোটনে, তেমনি আবার হতে পারে  লিড বা সীসার আয়নের মধ্যে) ঘটিয়ে জিগস পাজেলের হারানো অংশগুলো খুঁজে পাবেন আর তারপর সেগুলো জায়গা-মতো জোড়া দিয়ে প্রমিত মডেল-এর সত্যতা নির্ণয় করতে পারবেন। ঠিক এমনি একটা জিগস পাজেলের টুকরো খুঁজে পেয়ে ঠিকমতো জোড়া দিতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা, যেটা নিয়ে সারা মিডিয়া এখন তোলপাড়। হ্যাঁ এই সেই হিগ্‌স বোসন কণার সন্ধান লাভ।

সেই ষাটের দশক থেকে প্রমিত মডেলের একটা জোরালো অনুমিতি ছিল যে আমাদের এই চিরচেনা মহাবিশ্ব হিগ্‌স কণাদের সমন্বয়ে গঠিত হিগ্‌স ক্ষেত্রের (Higgs field) এক অথৈ সমুদ্রে ভাসছে। এই অথৈ সমুদ্রে চলতে গিয়েই নাকি উপপারমানবিক বস্তু কণারা সব ভর অর্জন করে। যদি হিগ্‌স ক্ষেত্র বলে কিছু না থাকতো, তাহলে কোন বস্তুকণারই ভর বলে কিছু থাকতো না, তা সে  রোগা পটকা ইলেকট্রনই হোক, আর হোৎকামুখো হিপোপটেমাস মানে টপ কোয়ার্কই হোক। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, কেবলমাত্র হিগ্‌স ফিল্ড বলে কিছু একটা আছে বলেই এই সব কণারা ভর অর্জন করতে পারছে, যা আবার ফলশ্রুতিতে তৈরি করতে পারছে আমাদের গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ সহ সবকিছুই।চিন্তা করে দেখুন, আমরা ফোটনের মত ভরহীন কণার কথা জানি যারা ছোটে আলোর বেগে। আলোর বেগে ছুটতে পারে কারণ এরা ইলেকট্রন কিংবা কোয়ার্কের মত হিগ্‌স ফিল্ডের সাথে কোন ধরনের মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায় না। হিগ্‌স ক্ষেত্রের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় না জড়ানোর কারণে তারা থেকে যায় ভর হীন। আর আগেই বলেছি –  ভর টরের ঝামেলা নেই বলেই তারা ওমনি বেগে হু হু করে ছুটতে পারে। কিন্তু ওভাবে ছুটলে কি হবে, তারা জোট বাঁধতে পারে না কারো সাথেই। জোট বাঁধতে হলে ভর থাকা চাই। এই যে আমাদের চারপাশে এত বস্তুকণার সমারোহ দেখি,  দেখি পাহাড় পর্বত, নদী নালা, গাছপালা আর মানুষ – সবারই অল্প বিস্তর ভর রয়েছে। ভর জিনিসটা তাই আমাদের অস্তিত্বের সাথেই অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত বলে আমরা মনে করি। তাই কোন কণা যদি পাওয়া যায় যেটা মহাবিশ্বের ব্রাহ্মমুহূর্তে সবাইকে ভর প্রদান করছে, করছে অস্তিত্বহীনকে অস্তিমান, তার গুরুত্ব হয়ে দাঁড়ায় অপরিসীম। বহু বছর আগে ১৯৬৪ সালের দিকে পিটার হিগ্‌স নামে এক বিজ্ঞানী ধারণা করেছিলেন এই ধরণের এক ‘হাইপোথিটিক্যাল কণা’র। যদিও ধারণাটির পিছনে কেবল পিটার  হিগসের একার অবদানই ছিল তা নয়, এর সাথে জড়িত ছিলেন রবার্ট ব্রাউট এবং ফ্রাঁসোয়া এঙ্গলার্টের মত বিজ্ঞানীরাও, তারপরেও  এক ধরণের কণা দিয়ে তৈরি ফিল্ডের ব্যাপারটা হিগসের মাথা থেকেই প্রথম বেরিয়েছিল বলে তার নামানুসারেই এই অনুকল্প-কণাটির  নাম দেয়া হয় হিগ্‌স কণা। কিন্তু নাম দিলে কি হবে, সে কণার কোন পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ বিজ্ঞানীরা কখনোই দিতে পারেননি।  ওই যে জিগস পাজেলের হারানো টুকরোর কথা বলছিলাম না? এটা ছিল তেমনি একটা হারানো টুকরো।

এই হারানো টুকরাই যেন খুঁজে পেলেন সার্নের বিজ্ঞানীরা। পেলেন হিগ্‌স কণার অস্তিত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ। জোড়া লেগে গেল জিগস পাজেলের আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, আর সেই সাথে  প্রমিত মডেলের মোনালিসা মার্কা হাসির ছবিটাও যেন আরো অনেকখানি স্পষ্ট হয়ে উঠলো আমাদের কাছে। তা কীভাবে হিগ্‌স কণার সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা? ঐ যে প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষের কথা বলছিলাম না? সেটাই তারা  ঘটিয়েছেন লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে, আর নতুন যে কণার কথা বললাম সেটা ধরা পড়েছে  কোথায়? ঐ যে কণা সনাক্তকারক বা ডিটেক্টর গুলোর কথা বলেছিলাম উপরে, তাদের দুটোতে – অ্যাটলাস এবং সিএমএস ডিটেক্টরে। এই দুই সনাক্তকারকের সাথে যুক্ত বিজ্ঞানীরা হিগ্‌স বোসন জন্মের খোঁজ দিলেন। ফলাফল বিশ্লেষণে স্পষ্ট দেখা গেল, দু’দলই পাচ্ছেন নতুন একটি কণার চিহ্ন।  সেটা একটা বিশাল ভারী একটা বোসন কণা। হিগ্‌স যার নাম।

কিন্তু বোসন কণা জিনিসটা কি? হিগসের সাথে তার সম্পর্কই বা কি?  সেখানে যাবার আগে চলুন কণা নিয়ে দু চার কথা সেরে ফেলা যাক।

কণাদের নিয়ে কানাকানি

লেখার এই অংশটা একদম বেসিক। অনেকেই হয়তো এগুলো জানেন, বিশেষত যারা কণা-পদার্থবিদ্যার সাম্প্রতিক বিষয় আশয় নিয়ে খোঁজখবর রাখেন। আমার চেয়ে অনেক ভালভাবেও ব্যাখ্যা করতে পারবেন। তারা দ্বিধা-হীনভাবে এই অংশটা পাশ কাটিয়ে যেতে পারেন। তবে যারা স্কুলের বিজ্ঞানের বই পত্তরগুলোর কথা একেবারে ভুলে গেছেন, আবার  নতুন করে ‘কেঁচে গুণ্ডুষ’ (এই অদ্ভুত শব্দটা কেন আমাদের স্কুলে শেখানো হয়েছিল সেটাও বোসন কণার চেয়ে কম রহস্যময় নয় যদিও) করতে চান, তারা সাথে থাকুন।   যাকগে, আমরা সকলেই জানি, একটা বস্তুখন্ড তা সে একটা বরফের চাঁই ই হোক আর একটা পাথর খন্ডই হোক, ভেঙে টুকরো করা সম্ভব। আবার সেই টুকরোগুলোকেও ভেঙে আরো ছোট টুকরোয় পরিণত করা যায়। এখন থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগে গ্রীক পণ্ডিতেরা এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, টুকরো করতে করতে এমন একটা সময় নিশ্চয়ই আসবে যখন পদার্থকে ভেঙে আরো ছোট টুকরায় পরিণত করা আর সম্ভব হচ্ছে না। তারা পদার্থের এই ক্ষুদ্রতম অংশের নাম দিলেন পরমাণু বা এটম। তাদের চোখে এই পরমাণুই ছিলো প্রাথমিক কণিকা। তবে আজ  স্কুলের ছোট ছেলে মেয়েরাও জানে এই পরমাণু কিন্তু পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশ বা প্রাথমিক কণিকা নয়। আমরা ছেলেবেলায় পদার্থবিদ্যার পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি যে, পরমাণুকেও ভাঙা সম্ভব। পরমাণুকে ভাঙলে পাওয়া যায় একটি নিউক্লিয়াসের চারিদিকে পরিভ্রমণরত ইলেকট্রনকে। আর নিউক্লিয়াস গঠিত হয় প্রোটন আর নিউট্রনের সমন্বয়ে। বহুদিন পর্যন্ত ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রনকে প্রাথমিক কণিকা মনে করা হত। কিন্তু ১৯৬৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির তাত্ত্বিক পদার্থবিদ মারে গেলম্যান এবং ১৯৬৮ সালে স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার একসিলেটর সেন্টারের বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে প্রমাণিত হল যে, প্রোটন ও নিউট্রনগুলো আসলে আরো ক্ষুদ্র কণার সমন্বয়ে গঠিত – যার নাম কোয়ার্ক। তা হলে এ পর্যন্ত আমরা কি পেলাম?

পেলাম যে পদার্থ ভেঙ্গে অণু। অণু ভেঙ্গে আবার পরমাণু । পরমাণু ভাঙ্গলে পাচ্ছি ইলেকট্রন আর নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসকে ভাঙলে প্রোটন আর নিউট্রন। আর ইলেকট্রনকে ইলেকট্রনের জায়গায় রেখে প্রোটন আর নিউট্রনকে ফের ভেঙ্গে পাওয়া গেল কোয়ার্ক। তাহলে এখন পর্যন্ত যা পেলাম তাতে করে কোয়ার্ক এবং ইলেকট্রনই হল পদার্থের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সত্ত্বা, যাদেরকে আমরা বলছি প্রাথমিক কণিকা।

ভাবছেন এখানেই শেষ? মোটেই তা নয়। বিজ্ঞানীরা দেখলেন কোয়ার্কগুলো একেবারে পাঁজির পাঁজহারা। তাদের আছে হরেক রকমের (আসলে ছয় রকমের) চেহারা – আপ, ডাউন, চার্ম, স্ট্রেঞ্জ, টপ এবং বটম।  এর মধ্যে প্রোটন তৈরি হয় দুটো আপ আরেকটা ডাউন কোয়ার্কের সমন্বয়ে, আর অন্যদিকে নিউট্রন তৈরি হয় একটা আপ আর দুটো ডাউন কোয়ার্ক মিলে। তাহলে আমাদের প্রাথমিক কণিকা অনুসন্ধানের ছবিটা কিরকম দাঁড়ালো?  দাঁড়ালো অনেকটা এরকমের –

এগুলো তো পাওয়া গেলই, কিন্তু পাশাপাশি কিছুদিন পরে আরো পাওয়া গেল দুটো নতুন কণিকা। এগুলো দেখতে শুনতে ইলেকট্রনের মতো হলেও ওজনে কিঞ্চিত ভারী।  এরা ইলেকট্রনের খালাতো দুই ভাই – মিউওন এবং টাউ।

আর ওদিকে আরেকদল বিজ্ঞানী এর মধ্যে  খুঁজে পেয়েছেন আরো অদ্ভুতুরে ভৌতিক এক কণা – নিউট্রিনো নাম তার।  এই নিউট্রিনোগুলোও চুপা বজ্জাত। এরাও থাকে হরেক রকমের চেহারার মাঝে লুকিয়ে – ইলেকট্রন-নিউট্রিনো, মিউয়ন নিউট্রিনো, টাউ নিউট্রিনো।  আর এরা লক্ষ লক্ষ মাইল সীসার পুরু স্তরকে নাকি অবলীলায় ভেদ করে চলে যেতে পারে কোন ধরনের গুঁতাগুঁতি করা ছাড়াই।

তাহলে এ পর্যন্ত জানা জ্ঞানের সাহায্যে প্রাথমিক কণিকার তালিকা  করতে গিয়ে আমরা কি পেলাম? পেলাম ইলেকট্রন, আর তার দুই খালাতো ভাই(মিউয়ন এবং টাউ), ছয় ধরণের কোয়ার্ক আর তিন ধরণের নিউট্রিনো –এরাই হল সেই প্রাথমিক কণিকা, যা গ্রীক পণ্ডিতেরা খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন।

সহজভাবে বললে, এই বারো ধরণের প্রাথমিক কণিকা দিয়ে আমাদের চেনা জানা দৃশ্যমান সকল বস্তু তৈরি। এদের বলে ফার্মিয়ন।  এই ফার্মিয়নদের কেউ চাইলে সাবগ্রুপে ভাগ করে ফেলতে পারেন। সেই যে ছয় রকমের হতচ্ছাড়া কোয়ার্কের দল তাদের একটা গ্রুপে রেখে বাদবাকিগুলোকে (মানে ইলেকট্রন, মিউইয়ন আর টাউ) অন্য গ্রুপে পাঠিয়ে দিতে পারেন ইচ্ছে হলে।  প্রথম গ্রুপটাকে কোয়ার্কস আর  অন্যগ্রুপটাকে লেপটনস নামে অভিহিত করা হয়।  এই ফার্মিয়নগুলোর একটা ছবি দেয়া যাক । ছবিটা অনেকটা আমরা ছেলেবেলায় রসায়নের বইয়ে যে  পিরিয়ডিক টেবিল বা পর্যায় সারণীর ছবি দেখেছিলাম, তার একটা সরল ভাষ্যের মত মনে হবে। মনে রাখাও তাই সহজ।

এই ফার্মিয়ন কণাদের নিয়ে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা দরকার।  উলফগ্যাং পালি  বলে এক নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ছিলেন, স্বভাবে মহা রগচটা। কারো গবেষণা বা তত্ত্ব অপছন্দ হলে মুখের উপর বলে দিতেন – ধরনাটা ‘এতোই বাজে যে, ভুল হবারও যোগ্য নয়’। সেই পলি সাহেবের একটা নীতি ছিল কণাদের নিয়ে, যেটাকে আমরা উচ্চমাধ্যমিক বইয়ে পড়েছিলাম ‘পলির বর্জন নীতি’ হিসেবে’। এ নীতির মূল কথা হল ইলেকট্রনের ঘূর্ণন  ভগ্নাংশ আকারে মান গ্রহণ করতে পারে, যেমন ১/২ ।  এর বাইরে এই পলির বর্জন নীতি কী, এবং এটা কীভাবে কাজ করে সেটা এই মুহূর্তে আমাদের এতোটা বোঝার দরকার নেই। কেবল একটি বিষয় মনে থাকলেই চলবে –   ফার্মিয়নদের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল – এরা সব পলির বর্জন নীতির অন্ধভক্ত। চোখ বন্ধ করে এরা পলি সাহেবের নীতি মেনে চলে।

তবে মহাবিশ্বে সবাই যে অন্ধ অনুগত স্তাবক হবেন, তা তো নয়। কিছু কিছু বিদ্রোহী কণা আছে, যারা পলি সাহেবের রগচটা স্বভাবকে একদমই পাত্তা দেয় না।  এরা পলির বর্জন নীতি মানে না। অর্থাৎ এদের স্পিন বা ঘূর্ণন ভগ্নাংশ নয়, এদের স্পিন হয় পূর্ণ সংখ্যা কিংবা শূন্য। এরাই হচ্ছে বিখ্যাত বোসন কণা –   বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামে যাদের নাম।

ফোটন কণার কথা যে আমরা অহরহ শুনি সেটা একধরনের বোসন কণা। এরা কী করে? সোজা কথা আলোক কণিকা বা তরিচ্চুম্বক তরঙ্গ বয়ে নিয়ে যায়।  এরা শক্তি বয়ে নেওয়ার কাজ করে বলে একে ‘বার্তাবহ কণিকা’ বা ম্যাসেঞ্জার পার্টিকেল বলেও ডাকা হয়। তড়িচ্চুম্বক বলের ক্ষেত্রে বার্তাবহ কণিকা যেমন হচ্ছে  ‘ফোটন কণিকা’, তেমনি সবল নিউক্লিয় বলের ক্ষেত্রে আছে ‘গ্লুয়োন’ (Gluon) আর দুর্বল নিউক্লিয় বলের জন্য রয়েছে  W এবং Z কণা। এরা সবাই মিলে তৈরি করে বোসন পরিবার –গেজ বোসন।  আর হিগস কণা খুঁজে পাবার পর সেটাকেও বোসন পরিবারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হচ্ছে। কিন্তু এটা বোসন হলেও স্বভাবে একটু আলাদা। আগেই বলেছি হিগ্‌স কণা বার্তাবাহী কণার মতো শক্তি বয়ে নিয়ে যায় না। বরং এরা কণার জন্য ভর তৈরিতে সহায়তা করে।  এই বোসন পরিবারের ছবিটা তাহলে এক ঝলক দেখা যাক –

তাহলে ফার্মিয়ন আর বোসনকে একত্রিত করে আমাদের পর্যায় সারণী মার্কা ছবিটা দাঁড়াবে এরকমের –

হিগ্‌স কণা এবং তার  সনাক্তকরণ

আগেই বলেছি হিগ্‌স কণা স্বভাবে খুব অদ্ভুত।  মহাবিশ্বে উদ্ভবের পর এই কণার একটা বড় সড় ভূমিকা আছে।  হিগসের অথৈ সমুদ্রের কথা যে আমরা বলছি যেটাকে বলা হয় হিগসের ক্ষেত্র বা হিগ্‌স ফিল্ড, বিগ ব্যাঙ-এর পর সেটা তৈরি হবার আগে কণাদের ভর বলে কিছু ছিলো না।  মহা-উত্তপ্ত অবস্থা থেকে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে যখন মহাবিশ্বের উদ্ভব ঘটেছিল, তার পর সেটা কিছুটা কমে  যখন মিলিয়ন বিলিয়ন ডিগ্রীতে (দশের পিঠে পনেরটা শূন্য চাপালে যে তাপমাত্রা পাব সেটা)  পৌঁছেছিল, তখন হিগ্‌স ব্যাচারাদের এতই ঠাণ্ডা লাগা শুরু করল যে তারা সব ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে এক ধরণের করুণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, যাকে জ্যোতির্পদার্থবিদেরা বলেন ‘কসমোলজিকাল ফেজ ট্রান্সিশন’।  এর আগ পর্যন্ত মহাবিশ্বে  কণারা লাল ঝাণ্ডা তুলে সাম্যবাদের গান গাইতো।  কোন কণারই ভর বলে কিছু ছিল না, পদার্থ-প্রতিপদার্থের সংখ্যা ছিল সমান ইত্যাদি। কিন্তু যে মুহূর্তে হিগ্‌স বাবাজির ঠাণ্ডা লাগা শুরু হল, অমনি সাম্য টাম্য সব ভেঙ্গে পড়তে শুরু করল। রাতারাতি কণাদের ভর গজাতে শুরু করল, কারো কম কারো বেশি। কেউ চিকণা পটকা হালকা হয়ে রইলো, আর কেউ বা হিগ্‌স ক্ষেত্রের সাথে বেশি করে মিথস্ক্রিয়ায় গিয়ে আর রসদ খেয়ে হয়ে উঠলো হোদল কুতকুত।  যেমন ইলেকট্রন বাবাজি কিংবা লেপ্টন গ্রুপের সদস্যরা হাল্কা পাতলা থেকে গেলেও আপ কোয়ার্ক কিংবা W বা Z কণারা হয়ে উঠল গায়ে গতরে হাতির মতোন। যেমন আপ-কোয়ার্ক  কণাটা আয়তনে ইলেকট্রনের সমান হলেও ওজনে ইলেকট্রনের চেয়ে ৩৫০ হাজার গুণ ভারী।  সাম্যাবস্থা ভেঙ্গে এই যে ভ্যারাচ্যারা বিশৃঙ্খল অবস্থায় যাওয়ার ব্যাপারটাকেই কেতাবি ভাষায় বিজ্ঞানীরা বলেন ‘সিমেট্রি ব্রেকিং’, বাংলা করলে আমরা বলতে পারি ‘প্রতিসাম্যের ভাঙ্গন’। তবে এই  অসাম্য আর বৈষম্য নিয়ে আমরা যতই  অসন্তষ্ট হই না কেন, হিগ্‌স কণার কল্যাণে প্রতিসাম্যের ভাঙ্গন ব্যাপারটা  না ঘটলে পরবর্তীতে তৈরি হত না   সৌরজগত, নিহারীকা, সূর্য আর পৃথিবীর মতো গ্রহ। এই প্রতিসাম্যের ভাঙ্গন কিভাবে ঘটতে পারে সেটাই ১৯৬৪ সালে কয়েকটি জগদ্বিখ্যাত পেপারের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছিলেন পিটার হিগ্‌স, জেরাল্ড গৌরালিঙ্ক, রিচার্ড হ্যাগেন, টম কিব্বল,  রবার্ট ব্রাউট এবং ফ্রাঁসোয়া এঙ্গলার্টের মত বিজ্ঞানীরা।  সেসব পেপারের মধ্যে রয়েছে রবার্ট ব্রাউট এবং ফ্রাঁসোয়া এঙ্গলার্টের Broken Symmetry and the Mass of Gauge Vector Mesons,  জেরাল্ড গৌরালিঙ্ক, রিচার্ড হ্যাগেন এবং টম কিব্বল-এর লেখা Global Conservation Laws and Massless Particles, পিটার হিগসের Broken Symmetries and the Masses of Gauge Bosons অন্যতম। সেই সব বিখ্যাত পেপার সার্ণে কাঁচের জারে ঢুকিয়ে দর্শনার্থীদের দেখার ব্যবস্থা করেছে সার্ন কর্তৃপক্ষ। এতদিন জানতাম জীববিজ্ঞানীরা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস মানুষের মাথা, কিডনী ফরমালিনে ডুবিয়ে জারে রাখার ব্যবস্থা করেন, সার্নের পদার্থবিজ্ঞানীরাও যে জার ব্যবহারে কম যান না তা সেখানে না গেলে জানাই হত না। আমি জারে উঁকি দিয়ে তুলতে সমর্থ হলাম সেই বিখ্যাত পেপারগুলোর একটা ছবি –

সে যাক, এখন আমরা দেখি কিভাবে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের সাহায্যে প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষের মাধ্যমে হিগ্‌স কণার উপস্থিতির কথা জানা গেল।  আগেই বলেছি হিগসের সমুদ্র যদি থেকে থাকে আর সেই সমুদ্র যদি হিগ্‌স কণাদের দিয়ে তৈরি হয়, তাহলে প্রচণ্ড বেগে ধাক্কা দিলে সেখান থেক কিছু কণা বেরিয়ে আসতে পারে। আটলান্টিক মহাসাগরের নীচে প্রচণ্ড গতিতে দুটো সাবমেরিনের সংঘর্ষ হলে যেমন কিছু পানি ছিটকে চলে আসে উপরে, আর তা দেখে আমরা বুঝি নিশ্চয় পানির নীচে কিছু একটা ঘটেছে। ঠিক তেমনি ব্যাপার হবে হিগ্‌স মহাসাগরের ক্ষেত্রেও। হিগ্‌স কণা পেতে হলে  প্রচণ্ড গতিতে হিগসের সমুদ্রকে ধাক্কা দিতে হবে।  এমন জোরে ধাক্কা দেওয়ার ক্ষমতা  এই পৃথিবীতে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার ছাড়া আর কারো নেই। সেখানে প্রোটনকে আলোর গতির ৯৯.৯৯৯৯৯৯ শতাংশ গতিতে ত্বরান্বিত করা হয়।   আর এভাবে দু দিক থেকে  প্রোটনের সাথে প্রোটনের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটানোর মাধ্যমে মৌলিক কণা তৈরি করা হয়। শিক্ষানবিস তার সুবর্ণরেখা ব্লগে সুন্দর একটা উপমা দিয়েছিলো। “গ্লাস মেঝেতে ফেললে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, যত জোড়ে ফেলা হবে তত বেশি টুকরো হবে। তেমনি প্রোটনের সাথে প্রোটনের যত শক্তিশালী সংঘর্ষ ঘটানো হবে তত মৌলিক কণার সন্ধান পাওয়া যাবে”।সেই পদ্ধতিই অনুসরণ করলেন বিজ্ঞানীরা। লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে সংঘর্ষের মাধ্যমে ১৪ ট্রিলিয়ন  ইলেকট্রন ভোল্টের শক্তি উৎপন্ন হয়, আর সেই শক্তির ধাক্কায়  উপপারমানবিক কণিকারা (subatomic particles) দিগ্বিদিক হারিয়ে ছুটতে থাকে যত্র তত্র। সেগুলো আবার ধরা পরে যন্ত্রদানবের ডিটেক্টরগুলোতে। এভাবেই আটলাস আর সিএমএস ডিটেকটরে ধরা পড়ল মহামান্যবর হিগসের অস্তিত্ব।   হিগসের শক্তি অবশ্য তাত্ত্বিকভাবে হিসাব করা হয়েছিল অনেক আগেই। গতবছরের ডিসেম্বর মাস থেকেই বিজ্ঞানীরা জানতেন হিগ্‌স কণা যদি থেকে থাকে তবে সেটার ভর থাকবে ১১৪ থেকে ১৩১ বিলিয়ন ইলেকট্রন-ভোল্ট (যেটাকে নতুন এককে গিগা ইলেকট্রন-ভোল্ট বা জিইভি বলা হয়) এর মাঝামাঝি জায়গায়।  বিজ্ঞানীদের অনুমান মিথ্যে হয়নি। প্রোটন নিয়ে গুঁতোগুঁতির ফলাফল সনাক্ত করতে গিয়ে এমন একটা কণা পাওয়া গেল যার শক্তি ১২৫ গিগা ইলেকট্রন-ভোল্টের কাছাকাছি। হিগ্‌স কণার যা যা বৈশিষ্ট্য থাকার কথা তা এই ফলাফলের সাথে মিলে যায় (যদিও এটি হিগ্‌স না হয়ে সম্পূর্ণ নতুন কণিকা হবার সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না)। অধিকাংশ বিজ্ঞানীরাই মনে করেন নীচের ছবিতে ১২৫ জিইভি-র কাছাকাছি যে ঢিপি  চোখে পড়ছে সেটা হিগ্‌স কণার জন্যই হয়েছে।

 

Mass distribution for the two-photon channel. The strongest evidence for this new particle comes from analysis of events containing two photons. The smooth dotted line traces the measured background from known processes. The solid line traces a statistical fit to the signal plus background. The new particle appears as the excess around 126.5 GeV. The full analysis concludes that the probability of such a peak is three chances in a million (কৃতজ্ঞতা শিক্ষানবিস).

এবং এটাই হিগস কণার প্রথম পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ।

সত্যেন বোসের অবদান – পেছন ফিরে দেখা

প্রবন্ধের এই অংশটা লেখার সাথে একেবারেই সঙ্গতিহীন মনে হবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণে কিছু অপ্রিয় কথা বলতেই হচ্ছে। বাঙালি জাতির হুজুগ-প্রিয়তার কথা বোধ হয় সর্বজনবিদিত।  এমনিতে বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারে কারো কোন মাথা ব্যথা আছে এমন নয়, চিরায়ত-ভাবে হাসিনা-খালেদা-রাজাকার-ধর্ম  ইত্যাদির বাইরে চিন্তা বা দৃষ্টি খুব একটা অগ্রসর হতে দেখা না গেলেও হিগ্‌স বোসন কণা  নিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড় হবার সাথে সাথে  বাঙালি হুজুগের আগুনে যেন ঘি পড়ল।  ঈশ্বর কণা তত্ত্বের আবিষ্কারের পিতা হিসেবে ‘সত্যেন বোস’কে আখ্যায়িত করে গগনবিদারী কান্নাকাটির ধূম পড়ে গেল। কেউ কেউ আরো কিছুটা অগ্রসর হয়ে বলতে শুরু করলেন – সার্নের খ্রিষ্টান –ইয়াহুদি-নাসারা সায়েন্টিস্টরা নাকি বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের গবেষণা মেরে দিয়ে তাকেই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে। এমনি একটি লেখা আমার নজরে এলো একটি ব্লগে

লেখার শিরোনাম – GOD particale বা ঈশ্বর কণা ত্বত্বের আবিষ্কারের পিতা সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে এভাবে ভুলে গেল বিজ্ঞানীরা!!

লেখায় লেখকের সুনির্দিষ্ট বক্তব্য –

হিগসের উল্লেখিত ওই কণার চরিত্র সম্পর্কে প্রথম আলোকপাত করেছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। দুই বিজ্ঞানীর নামে কণাটির নাম দেওয়া হয় হিগ্‌স-বোসন। GOD particle বা ঈশ্বর কণার তত্বীয় ধারণাটা মূলত আসে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং আলবার্ট আইনস্টাইন এর যৌথ গবেষণা পত্র থেকে। জার্মানির বিখ্যাত জার্নাল ‘Zeitschrift fur Physik’ তে এটা প্রকাশিত হয়। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে এই ধারণা মূলত আসে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কাছ থেকে।  … এটাই এখন আলোচিত ও বিখ্যাত ‘বোস-আইনস্টাইন তত্ত্ব’ হিসেবে ।…

লেখার নীচে মন্তব্য-কারীদের কিছু মন্তব্যের নমুনা –

শুধু ব্লগ-আর্টিকেল হলেও না হয় কথা ছিলো, অনলাইন, অফ লাইন সব পত্রিকার সম্পাদকীয় কিংবা কলামেও এ ধরণের হাজারো ভুল অনুমানের ছড়াছড়ি। যেমন, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম নামের পত্রিকাটিতে নতুন বিতর্কে ‘ঈশ্বরকণা’ শিরোনামের কলামে সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর আমাদের জানিয়েছেন

…পিটার হিগসের সঙ্গে উপমহাদেশের ভারতীয় বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু এ কণার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা দেন। এ দুই বিজ্ঞানীর নাম থেকেই ‘হিগস-বোসন’ কণা তত্ত্বের সৃষ্টি। আজ ‘ঈশ্বরকণা’ নামে পরিচিত।…

আবেগে শুধু এরাই নয়, হয়তো বাঁধ ভাসিয়েছেন অনেক মুক্তমনাও। আমার শুভানুধ্যায়ী বন্ধু আছেন, চিন্তায় চেতনায় মুক্তমনা। দিন দুনিয়ার খোঁজ খবর ভালই রাখেন। তিনি পর্যন্ত হিগ্‌স নিয়ে মিডিয়া তোলপাড় শুরু হবার কয়দিন পরে তিনি আমায় একটি লিঙ্ক পাঠালেন – For the Indian Father of the ‘God Particle,’ a Long Journey from Dhaka। অবশ্য কেউ কোন লিঙ্ক পাঠানো মানেই যে লেখকের বক্তব্যের সাথে তিনি সহমত হবেন তা নয়, আর তাছাড়া এ লেখাটা অবশ্য উপরের বাংলা-ব্লগ লেখকের মত এলেবেলে নয়, কিন্তু মোটা-দাগে বক্তব্য একই। বোসন কণার সাথে সত্যেন বোসের নাম মিলেমিশে আছে। যেহেতু এখন ‘গড পার্টিকেল’ পাওয়া গেছে তাই তিনিই ‘ফাদার অব গড পার্টিকেল’। ইউরোপিয়ানরা তাকে ভুলে গেছে, সঠিকভাবে সম্মানিত করেন নাই। এখন বাঙালি আবেগের ঘোলা পানিতে সেন্টুওয়ায়ালা মাছ শিকার করতে আমাদের আলু-পত্রিকা নামবে না, তা কি হয় নাকি! ০৫-০৭-২০১২ তারিখে তারা অনলাইন ডেস্কের বরাত দিয়ে প্রথম আলো শিরোনাম করেছে –‘উপেক্ষিত বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু’।

এই অভিযোগগুলো সঠিক না ভুল তা জানলে হলে পদার্থবিজ্ঞানে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অবদানের কথা আমাদের ঠিকমত জানতে হবে। আমার আলো হাতে  চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী বইয়ে সত্যেন বোসকে নিয়ে পরিশিষ্টে কিছু কথা লিখেছিলাম, সেগুলো পুনরাবৃত্ত করলে  হয়তো ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।

***

১৯২৪ সাল। তখন  আক্ষরিক অর্থেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্বর্ণযুগ’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের একটি ছোট্ট কক্ষে বসে এ বিভাগের তরুণ শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসু (সত্যেন বোস হিসেবে পরিচিত) প্ল্যাঙ্ক বিকিরণ তত্ত্বের সংখ্যায়নিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে একটি নতুন সংখ্যায়নের জন্ম দেন যা পরবর্তীকালে ‘বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন’ (Bose-Einstein Statistics) নামে বিশ্বে পরিচিত হয়।  যেসব কণিকা সমষ্টি এই সংখ্যায়ন মেনে চলে ওদের ধর্ম হলো ভর শূন্য অথবা সীমিত, স্পিন শূন্য বা পূর্ণসংখ্যক- আর এদেরকে এখন বলা হয় বোসন। বলা বাহুল্য বোসের নামেই এই নামকরণ।

সত্যেন বোস সেসময় দুটি অনুমিতির ভিত্তিতে এই সংখ্যায়ন মাত্র ৪-পৃষ্ঠার এক প্রবন্ধে উপস্থাপন করেন:

১. আলোক কণিকাসমূহ (ফোটন) পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ অপার্থক্যযোগ্য

২. এদের দশাস্থানকে নূন্যতম h3 আয়তন বিশিষ্ট অসংখ্য কোষে বিভক্ত—-এ কল্পনা করা যায়।

বোস এ প্রবন্ধটি আইনস্টাইনের কাছে প্রেরণ করেছিলেন তাঁর মন্তব্যের জন্য এবং প্রবন্ধটি প্রকাশযোগ্য হলে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে জার্মানীর কোন গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন (৪ঠা জুন, ১৯২৪):

“…আপনি লক্ষ্য করবেন, আমি প্ল্যাঙ্কের সূত্রের সহগটি চিরায়ত তাড়িত চৌম্বকতত্ত্ব ব্যবহার না করে নির্ধারণের চেষ্টা করেছি কেবলমাত্র দশাস্থানের ক্ষুদ্রতম আয়তনকে যহ ধরা যায় এই অনুমিতি থেকে। যথোপযুক্ত জার্মান ভাষা না জানায় প্রবন্ধটি ভাষান্তরিত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনি এটি যদি প্রকাশযোগ্য মনে করেন, তবে সাইটশ্রিফট ফুর ফিজিকে (Zeits. für Physik) প্রকাশের ব্যবস্থা করলে বাধিত হব।…”

আইনস্টাইন কর্ত্তৃক স্বয়ং অনুদিত প্রবন্ধটি “Plancks Gresetz and Lichtquantenhypotheses”  শিরনামে প্রকাশিত হয় (Zeits. für Physik, 24, 178, 1924)। আইনস্টাইন প্রবন্ধটির শেষে একটি পাদটীকা সংযোজন করেছিলেন যা আজও বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসু পাঠককে চমৎকৃত করে-

“আমার মতে বোস কর্তৃক প্ল্যাঙ্ক সূত্র নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রধাপ। এখানে ব্যবহৃত পদ্ধতি আদর্শ গ্যাসের কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োগ করা যায়, যা আমি অন্যত্র বর্ণনা করব।”

তা প্ল্যাঙ্ক সূত্র আহরণে কি সে অসঙ্গতি যা নতুনভাবে নির্ধারণ করতে গিয়ে বোস কোয়ান্টাম সংখ্যায়নের জন্ম দান করেছিলেন? এ ব্যাপারে আমাদের আরেকটু পেছনের দিকে যেতে হবে।

১৯০৪ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তত্ত্বীয়ভাবে ‘কৃষ্ণকায়া বিকিরণের’ সূত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা পরীক্ষণের ও পর্যবেক্ষণের সাথে সুন্দরভাবে মিলে যায়। এতদিন সনাতনী তাড়িত-চৌম্বক তত্ত্বের ভিত্তিতে এই বিকিরণের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এই সূত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি দেখলেন  যে আলো তাড়িত-চৌম্বক তরঙ্গ হলেও কোন পরমাণু বা অণু কর্তৃক বিশোষণ বা নিঃসরণ প্রক্রিয়ায় এই তাড়িত-চৌম্বক শক্তি অবিরত ধারায় শোষিত বা নিঃসৃত না হয়ে গুচ্ছে গুচ্ছে শোষিত বা নিঃসৃত হয়। এখান থেকেই কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্মমুহূর্ত হিসেব করা যেতে পারে।

পরিস্থিতিটা বিবেচনা করা যাক, প্ল্যাঙ্কের দৃষ্টিতে, একটি কৃষ্ণ-বিবরের গাত্র থেকে ক্রমাগত প্ল্যাঙ্ক কল্পিত স্পন্দকসমূহ কর্তৃক গুচ্ছ তাড়িত-চৌম্বক শক্তি শোষিত এবং নিঃসৃত হচ্ছে; ফলে বিবরের অভ্যন্তরস্থ বিকিরণ একটি তাপীয় সুস্থিতিতে রয়েছে এবং এই বিকিরণ তাড়িত-চৌম্বক তরঙ্গ হিসেবে বিবর অভ্যন্তরে স্থির-তরঙ্গ প্যাটার্ন রচনা করছে। প্ল্যাঙ্ক তার স্পন্দক নিঃসৃত বিকিরণ শক্তির গড় মান নির্ধারণ করলেন এবং কম্পাঙ্ক বিস্তারে স্থির তরঙ্গের প্যাটার্ন থেকে কম্পনের প্রকার সংখ্যা বের করলেন। এই প্রকার সংখ্যাকে গড় নিঃসৃত শক্তি দিয়ে গুণ করলেই বেরিয়ে আসে প্ল্যাঙ্কের বিকিরণসূত্র। সুতরাং দেখা যাচ্ছে শোষণ ও নিঃসরণকালে বিকিরণকে গুচ্ছ গুচ্ছ শক্তি কণিকা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে , অন্যদিকে বিবর অভ্যন্তরে একে তরঙ্গ রূপে বিবেচনা করা হচ্ছে।

এটিই হলো সত্যেন বোসের দৃষ্টিতে প্ল্যাঙ্কের নির্ধারণ পদ্ধতির অসঙ্গতি; অবশ্য এ অসঙ্গতি আইনস্টাইনের চোখেও ধরা পড়েছিল। সত্যেন বোসের কৃতিত্ব হলো বিশুদ্ধ ফোটন কণিকার বন্টণবিন্যাসের সংখ্যায়ন পদ্ধতি ব্যবহার করে প্ল্যাঙ্কের সূত্রের প্রতিষ্ঠা করলেন যা প্ল্যাঙ্কের অসঙ্গতি হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। এ প্রবন্ধটি সম্পর্কে আইনস্টাইন তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সত্যেন বোসকে লেখা একটি চিঠিতে :

“আমি আপনার প্রবন্ধটি অনুবাদ করে সাইটশ্রিফট ফুর ফিজি’কে প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক অবদান বলে মনে করি যা আমাকে খুশি করেছে। আপনিই প্রথম ‘উৎপাদকটিকে’ কোয়ান্টামতত্ত্ব থেকে নির্ধারণ করেছেন, অবশ্য পোলারায়ন উৎপাদক সম্বন্ধে যুক্তি অতটা শক্তিশালী নয়। এটি প্রকৃতপক্ষেই একটি উৎকৃষ্ট বৈজ্ঞানিক গবেষণা।”

সত্যেন বোস আহৃত সংখ্যায়নকে বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন বলা হয় কেন? এর উত্তরে বলা যায় যে, বোস সংখ্যায়ন ফোটনের জন্য প্রযোজ্য, যার স্থির ভর শূন্য এ ধরণের কণিকার জন্য বোস এ সূত্রটি উদ্ভাবন করেছিলেন। অন্যদিকে আইনস্টাইন বোস পদ্ধতিকে ভরযুক্ত কোয়ান্টাম গ্যাসের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে বোসের সূত্রকে সাধারণীকরণ পর্যায়ে উন্নীত করেন, যা তিনি বোসের পত্রের পাদটীকায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

বোস সংখ্যায়নের আবিষ্কারের পর তা পদার্থবিদ্যার নানা শাখার ব্যবহৃত হচ্ছে বা হয়েছে। বোসের বণ্টন বিন্যাসের মৌলিক সূত্রকে জড় কণিকার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে আইনস্টাইন দেখিয়েছেন যে কোয়ান্টাম গ্যাসের আচরণ অতি শীতল তাপমাত্রায় বিস্ময়কর হতে পারে- যার অনিবার্য পরিণতি হলো ‘বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন’ । এই ভবিষ্যদ্বাণী পদার্থবিদ্যায় এক চমকপ্রদ সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছিল।

সত্যেন বোস কর্তৃক কোয়ান্টাম সংখ্যায়নের কাজটি কত গভীর তাৎপর্যময় ছিল বোস নিজেই সে সময় তা বুঝতে পারেননি। তার মন্তব্য:“আমার ধারণাই ছিল না যে আমি যা করেছি তা নতুন কিছু।” তবে ১৯২৫ সালে বার্লিনে আইনস্টাইনের সান্নিধ্যে এলে সত্যেন বোস তাঁর কাজের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত হন। সে সময়কার কথা তিনি এভাবে স্মরণ রেখেছেন,“…জার্মানিতে যখন উপস্থিত হলাম, তখন দেখি প্রায় সকলেই আমার প্রবন্ধ পড়ছেন ও আলোচনা করছেন। স্বয়ং আইনস্টাইন আমার নতুন সংখ্যায়ন রীতিতে বস্তুকণার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে এর প্রয়োগক্ষেত্র অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন।”

***

মুল কথা হলো পদার্থবিজ্ঞানে সত্যেন বোসের অনন্যসাধারণ অবদান আছে, এবং  সেই অবদানের স্বীকৃতি তিনি পেয়ছেন, গুরুত্বপূর্ণ একটা কণা-পরিবার তার নাম ধারণ করে আছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সম্প্রতি লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে যে হিগ্‌স কণা  আবিষ্কৃত হয়েছে সেটা তার মাথা থেকেই বেরিয়েছিল, কিংবা সত্যেন বোসের আইডিয়া ইউরোপিয়ানরা মেরে দিয়েছে। কী নিদারুণ অজ্ঞতা। পলির মতই বলতে হয়  ‘They are not even wrong’। একটা উদাহরণ দেই। নাসায় ‘চন্দ্রশেখর টেলিস্কোপ’ বলে একটা টেলিস্কোপ আছে যেটা পদার্থবিজ্ঞানে চন্দ্রশেখরের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে নামাঙ্কিত করা হয়েছে। কেউ যদি বলেন এই টেলিস্কোপের আইডিয়াটা চন্দ্রশেখরের মাথা থেকেই বেরিয়েছিল, আর নাসার বিজ্ঞানীরা তা মেরে দিয়ে একটা বড় সড় টেলিস্কোপ বানিয়ে নিজেদের করে রেখেছেন – এটা যেমন শোনাবে, সত্যেন বোসকে ‘ঈশ্বর কণার’ জনক বলে জাহির করার চেষ্টাটাও সেরকমই।

পথের পাঁচালী সিনেমাটার সাথে সত্যজিত রায়ের সম্পর্ক থাকলেও পরিচালকের নামের সাথে অভিজিৎ রায়ের সাথে কেবল নামের শেষাংশের কাকতালীয় মিল ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু এই মিলের সূত্র ধরে যদি আমি সিনেমাটির জনক সাজার চেষ্টা করি, তাহলে যেমন দেখাবে, হিগ্‌স বোসন কণায় বোসন দেখেই সত্যেন বোসকে জনক বানানোর প্রচেষ্টাটাও সেরকমই।

অবশ্য যারা রাম বললেই রামছাগল বোঝেন তাদের পদবী থেকে রাম শব্দটা কেটে ফেলাই বাঞ্ছনীয় ঠিক যেমন বাঞ্ছনীয় গড পার্টিকেল থেকে গড শব্দটা ছেঁটে ফেলার।

ঈশ্বর কণা নিয়ে অযথা বিতর্ক

এ ব্যাপারটা নিয়ে অপার্থিব ইতোমধ্যেই চমৎকার একটা লেখা লিখেছেন।  হিগ্‌স বোসনের নাম ঈশ্বর কণা মোটেই ছিলো না প্রথমে। এমনকি এখনো পদার্থবিজ্ঞানের সরকারী পরিভাষায় এটা নেই। এটা ‘ঈশ্বর কণা’ হিসেবে পরিচিতি পায় নোবেল প্রাইজ বিজয়ী বিজ্ঞানী লিওন ল্যাডারম্যানের একটি বইয়ের প্রকাশনার পর। বইটার শিরোনাম ছিলো – The God Particle: If the Universe Is the Answer, What is the Question? বলা হয় কণাটির গুরুত্ব বোঝাতে নাকি ঈশ্বর শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে মজার ব্যাপার হল, লেখক নাকি নিজেই বইটির নাম ঈশ্বর কণা না রেখে ‘ঈশ্বর-নিকুচি’ কণা (Goddamn Particle) হিসেবে রাখতে চেয়েছিলেন। ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার উৎস উল্লেখ করে লেখা হয়েছে এখানে

…অনাবিষ্কৃত কণাটির গুরুত্ব সাধারণ মানুষকে বোঝাতে ১৯৯৩ সালে কলম ধরেছেন লিও লেডারম্যান। বইয়ের নাম কী হবে? লেডারম্যান বললেন, “নাম হোক হিগ্‌স বোসন।” ঘোর আপত্তি প্রকাশকের। বললেন।, “এমন নামের বই বিক্রি হবে না। ভাবা হোক জুতসই কোনও নাম।” বিরক্ত লেডারম্যান বললেন, “তা হলে নাম থাক গডড্যাম পার্টিক্যাল।” অর্থাৎ, দূর-ছাই কণা। প্রকাশক একটু ছেঁটে নিলেন সেটা। বইয়ের নাম হল ‘দ্য গড পার্টিকল’। নামের মধ্যে ঈশ্বর! বই বিক্রি হল হু হু করে। …

ব্যাপারটা ঠিক এরকমভাবেই ঘটেছিল কিনা তা পুরোপুরি নিশ্চয়তা দিয়ে না বলা গেলেও লেখক আসলে তার বইয়ের জন্য গড পার্টিকেলের বদলে গডড্যামন পার্টিকেল (Goddamn Particle) প্রস্তাব করেছিলেন,আর প্রকাশক শেষ সময়ে সেটা পরিবর্তন করেন, তার উল্লেখ আছে  এখানে, এখানে কিংবা এখানে

অপার্থিব তার প্রবন্ধে লিখেছেন –

হিগ্‌স্‌ কণা কে ঈশ্বর কণা বলা হয় কেন? ঈশ্বর কণা পদার্থবিজ্ঞানের সরকারী পরিভাষায় নেই। নোবেল পদাথবিজ্ঞানী লীয়ন লেডারময়ান তাঁর ১৯৯৩ এর বই “The God Particle: If the Universe Is the Answer, What is the Question?” তে হিগ্‌স্‌ কণা কে ঈশ্বর কণা বলে উল্লেখ করায় সাধারণ্যের ভাষায় এই নামকরণ স্থান পেয়ে গেছে। বিজ্ঞানে কম সচেতন বা অজ্ঞদের অনেকেই এই কারণে হিগ্‌স্‌ কণা আবিস্কারকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ বলে ভুল করছে। যেমনটা স্টিফেন হকিং এর “A brief history of Time” এর উপসংহারে “ঈশ্বরের মন জানার” কথা বলায় এটাকে অনেকে হকিংএর ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসের সাক্ষ্য হিসেবে দেখেছিল। কিন্তু হকিং, লেডারম্যান এরা কেউ আস্তিক নন । হিগ্‌স্‌ কণার প্রবক্তা হিগ্‌স্‌ একজন নাস্তিক। হকিং, লেডারম্যান উভয়ই রূপক অর্থে বা আলঙ্কারিকভাবে “ঈশ্বর” শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। ঈশ্বর কণার আবিষ্কারের সাথে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্পর্ক একটা কমলার সাথে বুধবারের যে সম্পর্ক সেরকম।

তার কথা অত্যুক্তি নয়। পিটার হিগ্‌স যে নাস্তিক এবং নিজেই হিগ্‌স কণাকে ‘ঈশ্বর কণা’ বলার সাথে একদমই একমত নন, তার প্রমাণ মেলে এখানে। তার ভাষ্যেই –

I find it embarrassing because, though I’m not a believer myself, I think it is the kind of misuse of terminology which I think might offend some people.

হিগসের মতেও পদার্থবিজ্ঞানী লিওন ল্যাডারম্যান আসলে বইটার নাম ‘গডড্যামন পার্টকেল’ বা ঈশ্বর-নিকুচি কণা রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রকাশকের অপারগতায় পারেননি।

লিওন ল্যাডারম্যানের ‘গড পার্টিকেল’ শিরোনামের বইটা আমার কাছে আছে, সেটা ২০০৬ সালে পুনর্মুদ্রিত। সেটার জন্য আলাদা করে ভূমিকাও লিখেছেন তিনি। বইটা এমনিতে খুবই দুর্দান্ত, সহজ সরল এবং সাবলীল ভাষায় রসিকতা করে বইটা লেখা। আমি জানিনা পাঠকেরা বইটি পড়েছেন কিনা, বইটা কিন্তু খুব মজাদার একটা বই। এমন নয় যে ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বর কণা সম্বন্ধে শ্রদ্ধায় মরে গিয়ে কিংবা ভাবে বিগলিত হয়ে বইটি লিখেছেন, বরং বইটি পড়লে বোঝা যায়, এগুলো নিয়ে ঠাট্টা তামাসাই করেছেন বেশি। যেমন একটা জায়গায় (পৃষ্ঠা ২২) তথাকথিত ঈশ্বর কণাকে ‘সবচেয়ে বড় শয়তান/খলনায়ক’ আখ্যায়িত করে লিখেছেন …

Particle physicists are currently setting just such a trap. We’re building a tunnel fifty-four miles in circumference that will contain the twin beam tubes of the Superconducting Super Collider, in which we hope to trap our villain.
And what a villain! The biggest of all time!….

এ ধরণের রসিকতা আছে সাড়া বইটা জুড়েই। সেখানেও থেমে থাকলে অসুবিধার কিছু ছিলো না। একে তো বিশ্বাসীরা লিওন ল্যাডারম্যানের রসিকতা বোঝেননি, তার উপর এখন সার্নে ঈশ্বর কণার অস্তিত্বের প্রমাণকে ধরে নিলেন ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে  (কৃতজ্ঞতা কৌস্তুভ)–

আবার কেউ কেউ এর মধ্যেই করতে শুরু করেছেন ধর্মগ্রন্থের মধ্যে আয়াতের সন্ধান। এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোতে সংবাদটি পরিবেশনের পর ‘বিজ্ঞ’ কিছু পাঠকের মতামত  ( অপার্থিবের লেখায় আকাশ মালিকের একটি মন্তব্য দ্রঃ) –

বোঝাই যাচ্ছে রামছাগল থেকে রাম ছেঁটে ফেললেও প্রকৃতির পরিবর্তন সামান্যই হয়।

অনেকে মনে করেন, এই ঈশ্বর কণা নামকরণের পেছনে নাকি গবেষণায় সরকারী ফান্ড পাওয়ার সম্ভাবনার ব্যাপারটা  কাজ করেছিল। সেসময় রক্ষণশীলদের দখলে থাকা  কংগ্রেস  “গড” এর টোপ গিলে অর্থায়নে রাজী হবে, এমন ভাবনাও হয়তো কাজ করে থাকবে এর পেছনে। তবে পেছনে উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি হিগ্‌স বোসন কণাকে ঈশ্বর কণা হিসেবে উপস্থাপন করার  মধ্যে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে বেশি। বৈজ্ঞানিকভাবেও ব্যাপারটা অর্থহীন।  হিগ্‌স কণা যত গুরুত্বপূর্ণ কণাই হোক না কেন, শেষ বিচারে একটা কণাই। আর সবচেয়ে বড় কথা হিগসের চেয়েও প্রাথমিক কিছুর সন্ধান যদি কখনো বিজ্ঞানীরা পান – যেমন স্ট্রিং – তখন তাদের কী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে? ‘মাদার অব গড পার্টিকেল? নাকি খোদার বাপ?

আর তাছাড়া হিগ্‌স সম্বন্ধে জেনে ফেলা মানেই সব জ্ঞান অর্জিত হয়ে যাওয়া নয়। মহাকর্ষ, গুপ্ত পদার্থ, গুপ্ত শক্তি, স্ট্রিং তত্ত্বের অতিরিক্ত মাত্রা সহ অনেক অমীমাংসিত বিষয়ের সমাধান হিগ্‌স দিতে পারেনি, সেজন্যই সার্নের মেনুতে আরো অসংখ্য খাবারের অর্ডার আছে।  সেগুলো খেয়ে শেষ না করা পর্যন্ত কাউকে ঈশ্বর বানানো অনেকটা বালখিল্যই।

তবে আশার ব্যাপার হল, আমরা জেনেছি – সার্নের পুরো কনফারেন্সে বিজ্ঞানী ও সাংবাদিক সবাই এই নামটা সচেতনভাবে এড়িয়ে চলেছেন। এমনকি সাংবাদিক সম্মেলনেও সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এই নাম উচ্চারণ না করতে।চলুন আমরাও সার্ণের বিজ্ঞানীদের মতো সচেতনভাবে এটিকে ঈশ্বর কণা হিসেবে আখ্যায়িত করা থেকে বিরত থাকি, আর ডঃ ডেভ গোল্ডবার্গের মতো অন্যদেরও আহবান জানাই –

স্টপ কলিং ইট গড পার্টিকেল।

:line:
*বিদ্রঃ ও হ্যা, এটা বোধ হয় না বললেও চলে যে লেখাটির শিরোনামের শেষাংশ (প্রলয়-নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে) রবীন্দ্রনাথের একটি সুপরিচিত গানের বানী থেকে ধার করা 🙂

গানটি –

প্রলয়-নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে

হে নটরাজ, জটার বাঁধন পড়ল খুলে॥

জাহ্নবী তাই মুক্তধারায় উন্মাদিনী দিশা হারায়,

সঙ্গীতে তার তরঙ্গদল উঠল দুলে॥

রবির আলো সাড়া দিল আকাশ-পারে।

শুনিয়ে দিল অভয়বাণী ঘর-ছাড়ারে।

আপন স্রোতে আপনি মাতে, সাথি হল আপন-সাথে,

সব-হারা সে সব পেল তার কূলে কূলে॥