আফ্রিকায় দুই রং-এর মানুষ আছে- এক আছে হাড়ীর কালী, আরেক আছে তামাটে। স্যাম মোবাওয়া শেষের দলে। তাই বলে এই এতবড় কর্পোরেট অফিসে নির্ভয়ে কাজ করতে তার এতটুকুন অসুবিধে হয়নি। ভয় কেন থাকবে? লোকেরা একটু বাড়িয়ে বলে, বৈসাম্য খুজে পায় যত্রতত্র। তার এসব কখনও মনে হয়নি অথবা মনে হবার মত কোন কারনও ঘটেনি। স্যাম কাজ জানে। মার্কেটিং বিভাগে তার সমান কাজ জানা আর কেউ নেই। প্রত্যেকদিন কেউ না কেউ তার কাছে আসে কোন না কোন কাজের সমস্যা নিয়ে। সাধ্যমত তাদের সাহায্য করতে হয় তাকে। মার্কেটিং কি এতই জটিল? রকেট তৈরীর থেকেও জটিল? অবাক লাগে স্যামের। বসও মাঝে মাঝে আসে তার কাছে, সমস্যার জট খুলতে। সমাধান পেয়ে একটার জায়গায় পাঁচটা ধন্যবাদ দিয়ে ফেলে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কোন কার্পণ্য নেই। ভাল লাগে স্যামের। লোকেরা আসলে ভুল বলে। বৈসাম্য ভাবলে আছে- না ভাবলে নাই। সবাই মানুষ। ওদের গায়ের রং সাদা তাতে কি হয়েছে, আমেরিকান হয়েছে তাতেই বা কি এমন হলো! সবাইকে তো সেই একই আকাশের নীচে বাস করতে হয়। আর ঐ আকাশটা হলো ঈশ্বরের রঙিন ছাতা। অন্যের কথায় কান দিয়ে সে নিজেকে ছোট ভাবতে যাবে কোন দুঃখে! গায়ের বাদামী রংটা, আর জিহবার উচ্চারণ ছাড়া আর কোন ব্যাপারে তো ওদের সাথে অমিল নেই তার- তাহলে? স্যামের মাথায় এই সব হাবিজাবি ঢুকিয়েছে ইরিত্রিয়ান লোকটা। এই বিভাগের অফিস বেয়ারার সে। একই দেশের, একই রং এর মানুষ ওরা। লোকটা কেমন জানি। মাঝে মাঝে হীনমন্যতায় ভোগে বলে মনে হয়। আশপাশে কেউ না থাকলে দেশী জবানে কথা বলে, তবে সবার সামনে শুধুই ইংরাজী ছোটে মুখ দিয়ে।
“বাহির চকচকে ফর্সা হলেই ভেতরটা সুন্দর হয় না। এদের মনে ফাক- বাইরে এক, ভেতরে আরেক, মোনাফেক যারে কয়। বুঝবেন, বুঝবেন, সময় মত সব বুঝবেন” -স্যামকে নির্জনে পেয়ে প্রায়ই কথাগুলো বলে লোকটা। কেন বলে, ঐ জানে। লোকটা আসলে ভুল বলে। সবার দৃষ্টি এক হয় না।
সোমবারটা কেমন জানি- একঘেয়ে উদ্দমহীন। মনে হয় শনি-রবি একটানা দুইদিন ছুটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এটা। ছুটির আমেজটা শুরু হয় আসলে শুক্রবার রাত্রের হৈ হৈ পাগলামীর ভেতর দিয়ে। উত্তর আমেরিকার নাকি এটাই নিয়ম। যে দেশে যে রীতি। মাঝে মাঝে সব দেশ-কাল ভুলে যায় স্যাম অন্যমনস্কতায়। তখন নিজেকে কেমন জানি ঝড়ে উপড়ে পড়া গাছের মতো লাগে। মনে হয় কে যেন বেশ অচেনা পুষ্ট মাটিতে এনে আবার লাগিয়েছে তাকে। যাক সেসব কথা। এখন দুপুরের বিরতী। খেতে যাবার সময় হলো। কাছের রেস্তোরাটায় যেতে হবে তাকে। কই, বসতো তাকে আজ ডাকলো না। মনে হয় ভুলে গেছে। ম্যানেজার সাহেবের কিছু পছন্দের মানুষ আছে। প্রতিদিন তাদের নিয়েই দুপুরের খাবারটা খান তিনি। খাবার সময় স্যামকে সঙ্গে নিতে ভোলেন না। আজ হয়তো কোন কারণে ভুলে গেছেন- সে যাকগে। প্রায় সবাই চলে গেছে খেতে। বাদামী দেশি লোকটাও চলে গেছে। রেস্তোরায় পৌছায় স্যাম। আজকে জায়গাটা বেশ গরম- তাপে নয়, কথার ভাপে। এত জোরে জোরে কি সব আলাপ করছে সহকর্মীরা? কারও কথা বুঝার যো নেই- সব জগাখিচুড়ী। লেইলা, ক্রিষ্টি, রবার্ট উৎফুল কণ্ঠে চিৎকার করে হাত নেড়ে তাদের কাছে ডাকলো স্যামকে। টেবিলে এখনও একটা আসন খালি আছে। সেখানে স্যামকে বসালো তারা।
-কেমন আছ স্যাম? আজকে আমরা সবাই ভীষণ উত্তেজিত। গত শুক্রবার রাতের পার্টি নিয়ে আমরা মেতে আছি এখনও। ম্যানেজার সাহেবের বিবাহ বার্ষিকীর পার্টি। কত কি মজা যে হলো ওর বাড়ীতে। কিন্তু তুমি আসলে না কেন স্যাম? কি হয়েছিল তোমার? তুমি বাদে সবাই ছিল পার্টিতে।
লেইলা দ্রুত কথা বলে। মুখে তার শব্দের খই ফোটে। মনের সব আনন্দ উত্তেজনা বিজলীর গতিতে মুখ দিয়ে বের করে ফেলতে চায়। হাত পা নেড়ে মাথা দুলিয়ে পাতলা লিকলিকে সুন্দরী সেদিনের পার্টিটাকে স্যামের সামনে তুলে ধরে। এই মেয়েটার প্রশ্নের কী উত্তর দেবে স্যাম? কয়েক মুহুর্ত ভাবে। মাথা তার কাজ করে দ্রুত। সে দাওয়াত পায়নি- একথা কি কাউকে বলা যায়, না বলতে আছে? মনের কোন এক অচেনা পেশীতে গরম লোহার স্যাক লাগে স্যামের। পরের ভাবনা পরে, আগে লেইলার প্রশ্নের একটা মানসম্মত সামাজিক উত্তর দিতে হবে তাকে।
-একটা জরুরী কাজ ছিল, তাই আসা হয়নি।
বেশি কথা আর বলা হয় না স্যামের। জবান নিরবতায় চলে যায়- সতর্ক নিরবতায়। যেন মৌনতার অন্য অর্থ আবিস্কৃত না হয় কারও দ্বারা। হারতে চায় না স্যাম কারও কাছে, কোনভাবে।
অফিস ছুটি হতে আর কিছু সময় বাকী। নিজের দপ্তরে এসে কাজে ডুব দেয় স্যাম। কিন্তু মন তার অন্য কোথাও। ম্যানেজার সাহেবের সাথে তার সম্পর্ক আজকের নয়- অনেক দিনের পুরাণ। দিনে দিনে কাজে কথায় উঠা বসায় সে সম্পর্ক যথেষ্ট গভীর। অনেক ব্যক্তিগত আলাপ চারিতায়ও অনেক সময় গেছে তাদের। এ সব কিছু কি ছোট্ট একটা সামাজিক নিমন্ত্রণ পাবার জন্য যথেষ্ট নয়? বিষয়টার এপিঠ ওপিঠ উল্টে ভাবে স্যাম- বার বার তা ভাবে। একবার মনকে বলে, বাদ দে ওসব। কিন্তু অবোধ মন ভঙ্গ দেয় না। বাদামী দেশী লোকটার কথা মনে পড়ে সহসা। তাহলে কি দেশীর কথাই সত্য। ও কি গিয়েছিল পার্টিতে? দাওয়াত পেয়েছিল? এসব কি ভাবছে সে? যা সে ভাবছে, তা তো নাও হতে পারে। এগুলো জেনে তার এখন কি লাভ? এই পরদেশের অচেনা মাটিতে দেনা-পাওনার কথা মনে জাগে। দেনার থেকে পাওনার কথাটা বেশী করে মনে আসে। এই মাটিতে কি সেবাটা পায়নি সে! ছেড়ে আসা মাটিতে মাটির সন্তান হয়ে জন্মেও সে কি তা কোন দিন স্বপ্নেও পাবার কথা ভাবতে পারতো? ছিঃ স্যাম ছিঃ। হঠাৎ করে নিজেরে খুব ছোট মনে হয় তার। সেই সাথে অসহায়ত্ব ভর করে মনে। কাঁচের জানালা দিয়ে দৃষ্টি অদূরে একটা কিছুর উপর আটকে যায়। বাইরে অবিরাম তুষার ঝরে চলেছে ক্লান্তিহীন। ওজনহীন কার্পাস তুলোর মতো ওরা আয়েশে ঝরছে তো ঝরছে। মাধ্যাকর্ষণকে ওরা যেন থোড়াই কেয়ার করে। স্যামের নজর আটকে গেছে অদূরে শীতের ভেতরে জবুথবু একটা মানুষের উপরে। খোলা আকাশের নীচে ম্যানহোলের উপর বসে কি করছে আদম? সভ্যতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো, ভয়-ভাবনাহীন কে ঐ মানুষটা? ম্যানহোলের ঢাকনার ছিদ্র দিয়ে গরম বাস্প বেরিয়ে আসছে স্বচ্ছন্দে। তার তাপটুকু শুষে নেবার চেষ্টা করছে গৃহহীন, বসে আছে অনড়। কারও কাছে তার কিছু চাওয়ার নেই। নিজের মনের ভেতরে একটা ক্ষতের উপস্থিতি টের পায় স্যাম। দৈবাৎ গৃহহীন আদমের সাথে নিজের কি যেন এক সাদৃশ্য খুজে পায় সে। কে ঐ অনড় মানুষটা- তার ভাই বা বাবার মত কেউ? কেন সে কারও থেকে কিছু পাবার আশা ত্যাগ করেছে? স্যাম কি তার মত গৃহহীন?
সহসা ছুটির ঘন্টা বেজে যায়। কিন্তু স্যামের ভাবনার শক্ত সুতোটা ছেড়ে না। সবাই যার যার মত চলে যায় ঘরে, কিন্তু অটুট ভাবনা নিয়ে পায়ে পায়ে স্যাম এসে দাড়ায় গৃহহীন আদমের সামনে। হঠাৎ করে আরও কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে লোকটাকে। লোকটার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে স্যাম- “তুমি আমার ভাই। আমার আসল ভাই। তোমারও ঘর নেই, আমারও ঘর নেই”।
ধুলো কাদায় মাখামাখি শতছিন্ন পোশাক পরা গৃহহীন নির্বাক তাকিয়ে থাকে স্যামের চোখে- ভাবে, লোকটা পাগল নাকি? মুখের সাদা জমিনে তার তেমন কোন অভিব্যক্তি নেই।
-আমার ভাই তুমি হতেই পার না, ভাই হলে আমার মত সাদা হতে- বাদামী হতে না।
মানুষটার মুখে একটা বাঁকা উপেক্ষার হাসি লেগে থাকে। বেশি কথা সে জানে না। ঐ কথা কটি বলে নীরব হয়ে যায় যেন চিরকালের মত। পাতানো ভাইয়ের বাহু বন্ধন থেকে মুক্ত করে ফেলে সে নিজেকে। একটুখানি দূরে সরে দাড়ায় স্যাম। ছিন্নমূল লোকটার কথায় মুগ্ধ হয় সে। সত্য কথা বলার সাহস আছে তার। মানুষটার মনে কোন ফাঁক নেই। একসময় সুন্দর সুচারু পোশাকের আড়াল থেকে হাত দুটো বের করে বার বার দেখে- হাতের, গায়ের রং দেখে, চামড়ার রং দেখে স্যাম। যেন নতুন করে দেখছে সব। তাইতো, সে বাদামীই তো। কি ভুলো মন তার! নিজের সব ভুলে বসে আছে? হঠাৎ করে দেশি বাদামী লোকটার কথা মনে পড়ে গেল। নিজের দেশ-বাড়ী-ঘর স্মরনে এলো। আকাশের দিকে চোখ পড়ে গেল সহসা তার। সেখানে বড় এক রঙিন ছাতা- নিপূণ কারুময় বহুরঙা ছাতা। সে ছাতায় অজস্র ফুটো। কিন্তু একি, ফুটো গুলো বড় হচ্ছে, আরও বড় হচ্ছে কেন? এক সময় ছিদ্র গুলো বড় হতে হতে পুরো ছাতাটাই অদৃশ্য হয়ে গেল। এখন সব প্রাণ একই জমাট নীলিমার তলে। সবাই এখন নীল। নীল ছাড়া আর কোন রং নেই পৃথিবীতে, মাথার উপরে। নিমেষে স্যামের মনের অটুট ধুসর ভাবনাগুলো উড়াল দিয়ে আকাশে হারিয়ে গেল। স্যাম এখন সত্যিকারের সাহসী-স্যাম, অসম সাহসী ঐ গৃহহীন আদমটার মত। কারও কাছে তার আর কিছুই চাওয়ার নেই।
বটম লাইনে বাজিমাত। শাবাশ! (Y)
@বিপ্লব রহমান,
কী আর এমন! অনেক ধন্যবাদ। :thanks:
‘বৈসাম্য’ শব্দটির ব্যবহার ইচ্ছেকৃত?
কাদের গায়ের রংয়ের কথা বলা হচ্ছে? আমেরিকান বুঝিয়ে থাকলে আগে তাদের উল্লেখ থাকতে পারত! কর্পোরেট অফিসটা তাহলে আমেরিকায়? আর তাছাড়া আপনার কথিত ‘বৈসাম্য’ কাদের নিয়ে? তামাটে, হাড়িকালো, সাদা- কাদের নিয়ে বৈসাম্য?
ইরিত্রিয়ান লোকের কন্ঠে এই সংলাপ বিশ্বাসযোগ্য হয়নি!
গল্পটি এ জায়গায় দারুণ জমে উঠেছে! শেষের প্যারার লাইনগুলোও অসাধারণ!
@কাজি মামুন,
সুন্দর গঠন মূলক সমালোচনা। অনেক ধন্যবাদ।
(F) (F) (F)
@শান্ত,
:thanks:
অনেক ধন্যবাদ।
বেশ মনোরম লেখা- (Y)
@আফরোজা আলম,
অনেক ধন্যবাদ।