(আগের পর্বের পর…)
…
৩.০ : চার্বাক ও বৃহস্পতি
…
চার্বাক দর্শন সম্পর্কে যেটুকু নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে এই মতবাদের সূচনার কাল বা ‘চার্বাক’ নামের সঙ্গে এর সংযুক্তির কাহিনী কিছুই সঠিকভাবে নির্ণয় করা এখনো সম্ভব নয়। তাছাড়া এই চিন্তাধারা চার্বাক দর্শন নামে পরিচিতি লাভ করলেও চার্বাক নামে কোন ব্যক্তিকে এর প্রবর্তক বলে স্বীকার করার কোন প্রমাণও এযাবৎ পাওয়া যায়নি। তবে ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’, ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ প্রভৃতি গ্রন্থে এই মতবাদের আদি প্রচারক হিসেবে বৃহস্পতির নাম উল্লেখ করা আছে। ব্যক্তিরূপী চার্বাক এসব গ্রন্থে স্বীকৃতি পেলেও তা উদ্ধৃত হয়েছে বৃহস্পতিশিষ্য হিসেবে।
যেমন চতুর্দশ শতকের মাধবাচার্য তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদ ‘চার্বাক-দর্শনম’-এর শুরুর দিকে বলছেন-
‘অথ কথং পরমেশ্বরস্য নিঃশ্রেয়স-প্রদত্বমভিধীয়তে ? বৃহস্পতি-মতানুসারিণা নাস্তিক-শিরোমণিনা চার্বাকেণ তস্য দুয়োৎসারিতত্বাৎ।’ -(সর্বদর্শনসংগ্রহ, পৃষ্ঠা ০২)।
অর্থাৎ : আপনি কিভাবে পরমেশ্বরকে নিঃশ্রেয়সপ্রদ বলছেন ? বৃহস্পতির মতানুসারী নাস্তিক শিরোমণি চার্বাক কর্তৃক তিনি দূরোৎসারিত- দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন অর্থাৎ তাঁদের মতে ঈশ্বর নামক কোন পদার্থ নাই।
.
আর কৃষ্ণমিশ্র রচিত একাদশ শতকের রূপক নাটক ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’-এ বলা হচ্ছে-
‘লোকায়েতামেব শাস্ত্রং… …বাচস্পতিনা প্রণীয় চার্বাকায় সমর্পিতম্ ।
তেন চ শিষ্যপ্রশিষ্যদ্বারেনাস্মিল্লোকে বহুলীকৃতং তন্ত্রম্ । -(প্রবোধচন্দ্রোদয়, পৃষ্ঠা-৬৪)।
অর্থাৎ : বাচস্পতি বা বৃহস্পতি প্রণীত এই লোকায়ত শাস্ত্রমতটিকে চার্বাক শিষ্য-প্রশিষ্যের মাধ্যমে চতুর্দিকে প্রচার করেন। (মুক্ত তর্জমা)।
.
অন্যদিকে অষ্টম শতকের জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরীর ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা হিসেবে চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে রচিত আরেক জৈন দর্শনকার গুণরত্নের ভাষ্যগ্রন্থ ‘তর্করহস্যদীপিকা’য় ‘যদুবাচ বাচস্পতিঃ’ অর্থাৎ ‘বাচস্পতি যা বলেন’ উল্লেখ করে বাচস্পতি বা বৃহস্পতির উক্তি হিসেবে তিনটি সূত্র উদ্ধৃত করেন। সেগুলো হচ্ছে-
‘অথাতস্তত্ত্বং ব্যাখ্যাস্যামঃ।’ – (বৃহস্পতি সূত্র)
‘পৃথিব্যাপস্তেজোবায়ুরিতি তত্ত্বানি।’ – (বৃহস্পতি সূত্র)।
অর্থাৎ : পৃথিবী (মাটি), জল, অগ্নি ও বায়ু- এই চারটিই তত্ত্ব।
‘তৎসমুদায়ে শরীরেন্দ্রিয়সংজ্ঞা।’ – (বৃহস্পতি সূত্র)
অর্থাৎ : এর (তত্ত্ব চতুষ্টয়) সমন্বয়ে শরীর, ইন্দ্রিয়, চৈতন্য ইত্যাদি সৃষ্ট।
.
লক্ষ্য করার বিষয় যে, সম্ভাব্য অষ্টম শতকের প্রথমদিকে রচিত জয়রাশি ভট্টের ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে রচয়িতার নাম উল্লেখ না করে এই তিনটি সূত্রই উদ্ধৃত হয়েছে বস্তুবাদী নিদর্শন হিসেবে। আবার বৌদ্ধ পণ্ডিত কমলশীলের (অষ্টম শতক) ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’য় লোকায়তসূত্র হিসেবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সূত্রেরই উদ্ধতি রয়েছে। যদিও সূত্র দুটি কমলশীলের উদ্ধৃতিতে সামান্য পরিবর্তিত আকারে দেখা যায়, যেমন- ‘পৃথিব্যাপস্তেজোবায়ুরিতি চত্বারি তত্ত্বানি তেভ্যশ্চৈতন্যম্’ এবং ‘তৎসমুদায়ে’। এতে অবশ্য ভাবগত অর্থে শ্লোকগুলির মধ্যে খুব একটা পার্থক্য হয় না। যেমন বাংলা তর্জমায় সূত্র দুটির সমন্বিত অর্থ দাঁড়ায়- ‘পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু- এই চারটি তত্ত্বের সমন্বয়ে চৈতন্যের জন্ম ও অভিব্যক্তি হয়।’
.
অন্যদিকে উল্লেখিত প্রথম সূত্রটি (অথাতস্তত্ত্বং ব্যাখ্যাস্যামঃ)-কে জয়ন্ত ভট্টের (নবম শতক) ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে চার্বাক দর্শনের আদি সূত্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। (ন্যায়মঞ্জরী ১, পৃঃ-৫৯)। অথচ সংকলিত বার্হস্পত্যসূত্রে এই সূত্রটির অন্তর্ভুক্তিই পাওয়া যায় না কোথাও। এসব দেখেশুনে মনে হয় যে চার্বাক গ্রন্থকাররা প্রত্যেকে তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অনুকরণে এই আদি সূত্রে অন্তর্ভুক্ত তত্ত্বের ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, যদিও প্রত্যেকেরই ধারণায় তাঁদের নিজ নিজ ব্যাখ্যাটি প্রকৃত সূত্রকারেরই অনুমোদন-সাপেক্ষ। সপ্তম থেকে চতুর্দশ শতকের মধ্যে বিভিন্ন দার্শনিক গ্রন্থের ভাষ্যকারদের রচনায় এরকম প্রচুর সূত্রের উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। এগুলির প্রচারক কখনও চার্বাক, কখনও লোকায়ত, আবার কখনও বা বার্হস্পত্য বিশেষণে বিশেষিত হয়েছে।
.
সায়ণ মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের চার্বাক দর্শনের বর্ণনায়ও এরকম কিছু শ্লোকের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। মাধবাচার্যের মতে এগুলি চার্বাক সিদ্ধান্তের প্রবর্তক বৃহস্পতির উক্তি।
‘অর্থ-কামৌ এব পুরুষার্থৌ’- (অর্থাৎ : অর্থ ও কামই পুরুষার্থ)।
‘তত্র পৃথিব্যাদীনি ভূতানি চত্বারি তত্ত্বানি।’- (অর্থাৎ : পৃথিবী, জল, তেজঃ ও বায়ু- এই চারটি ভূতই চারটি তত্ত্ব।)
‘কিণ্বাদিভ্যো মদশক্তিবৎ চৈতন্যমুপজায়তে।’- (অর্থাৎ : কিণ্ব বা বৃক্ষবিশেষ হতে মদশক্তির ন্যায় চৈতন্য জন্মে।)
‘ত্রয্যা ধূর্ত্তপ্রলাপমাত্রত্বেন’- (অর্থাৎ : বেদত্রয়ী ধূর্তের প্রলাপমাত্র।)
‘অগ্নিহোত্রাদের্জীবিকামাত্রপ্রয়োজনত্বাৎ।’- (অর্থাৎ : অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ কর্মের প্রয়োজন জীবিকামাত্র, অন্য কিছু নয়।)
‘লোক-সিদ্ধো রাজা পরমেশ্বরঃ।’- (অর্থাৎ : লোকপ্রসিদ্ধ রাজাই পরমেশ্বর।)
‘দেহোচ্ছেদো মোক্ষঃ।’- (অর্থাৎ : দেহের উচ্ছেদই মোক্ষ।)
ইত্যাদি।
.
এসব শ্লোকেরই অনুরূপ কিছু শ্লোক ভারতীয় সাহিত্যের বিভিন্ন পাতায় ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে, কোথাও বা চার্বাক দর্শনের সাথে যুক্ত হয়ে, কোথাও অন্যভাবে দেখা যায়। শ্লোকগুলির রচয়িতা প্রকৃতই বৃহস্পতি নামে কোন ব্যক্তি কিনা তা বলা কঠিন। তবে যথার্থ ইতিহাসের পর্যায়ে ফেলা না গেলেও চার্বাক মতবাদের সাথে বৃহস্পতির নামে যোগ বহন করে ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যে কয়েকটি উপাখ্যান প্রচলিত আছে।
.
দেবতাদের গুরুর নাম বৃহস্পতি। কথিত চার্বাক আচার্য বৃহস্পতির প্রকৃত পরিচয় যা-ই হোক না কেন, তিনি যে ক্রমে এই দেবগুরু বৃহস্পতির সঙ্গে একাত্মতা লাভ করেছেন তা ওই উপাখ্যানগুলোর কাহিনী থেকে প্রতীয়মান হয়। ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ নাটকে চার্বাক মতের প্রচারক বৃহস্পতি যে এই দেবগুরুর সঙ্গে অভিন্ন এবং বাচস্পতি আখ্যায় অভিহিত, তা ইতঃপূর্বে সংশ্লিষ্ট শ্লোক উদ্ধৃত করে দেখানো হয়েছে। বাচস্পতি শব্দের অর্থ বাক্যের অধিপতি এবং দেবগুরু বৃহস্পতি সাধারণত এই নামের সঙ্গে যুক্ত। এক্ষেত্রে বৃহদারণ্যক উপনিষদ স্মর্তব্য-
এষ উ এব বৃহস্পতি। বাগ্ বৈ বৃহতি, তস্যা এষ পতিঃ, তস্মাদ্ উ বৃহস্পতি।। ১/৩/২০।। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ)।
অর্থাৎ : প্রাণের আর-এক নাম বৃহস্পতি। বাক্যকে বলে বৃহতী। যেহেতু তিনি বাক্যের গতি, তাই বৃহস্পতি।
.
প্রচলিত বৈদিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে ধারণা এই চার্বাক মতবাদের মাধ্যমে প্রচারিত, দেবতাদের গুরুর সঙ্গে সে ধারণার মিল বা সংগতি খুঁজে পাওয়া কঠিন বৈকি। তাই হয়তো এ ক্ষেত্রে উভয়ের যোগের সামঞ্জস্য বজায় রাখার চেষ্টা হয়েছে কিছু কল্পনার মাধ্যমে। আর এই কল্পনা বিভ্রান্তি বা মায়ামোহের রূপ নিয়ে বিভিন্ন প্রাচীন উপাখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
.
বিষ্ণুপুরাণে (৩/১৮/১৪-২৬) বলা হয়েছে, অসুরদের মোহগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যেই মায়ামোহ তাঁদের মধ্যে এই মারাত্মক মতাদর্শ প্রচার করেছিলেন। এরই মোহে পড়ে অসুরেরা বৈদিক জ্ঞানকে উপহাস করতে শিখলেন; অতএব তাঁদের দারুণ অধঃপতন ঘটলো। সেই অবকাশে দেবতারা শক্তি সঞ্চয় করে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযান করলেন এবং সহজেই অসুরদের পরাজিত করলেন।
.
এই মায়ামোহ যে মূলত দেবগুরু বৃহস্পতি তা স্পষ্ট হয় সম্ভাব্য বুদ্ধ-পরবর্তী কালে সৃষ্ট মৈত্রায়ণীয় উপনিষদের (৭,৮,৯) অন্তর্ভুক্ত অনুরূপ একটি পৌরাণিক উপাখ্যানের মধ্যে। এই উপাখ্যান অনুযায়ী- দেবগুরু বৃহস্পতি অসুরগুরু শুক্রের ছদ্মবেশ ধারণ করে ইন্দ্রের নিরাপত্তার উদ্দেশ্যেই অসুরদের মধ্যে এই মারাত্মক অবিদ্যা-মূলক মতাদর্শ প্রচার করেছিলেন। সেই অবিদ্যার প্রভাবেই অসুরেরা অধর্মকে ধর্ম এবং ধর্মকে অধর্ম মনে করতে শুরু করে।
.
বেদ বিরোধী এই মতাদর্শ যে আসলে চার্বাক দর্শনেরই অন্তর্ভুক্ত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যা বৃহস্পতির বচন হিসেবেই বিভিন্ন স্থানে পরিদৃষ্ট হয়। এই উপাখ্যানের মাধ্যমে দেবগুরু বৃহস্পতির কুল রক্ষা করা গেলো বটে, তবে একই সাথে এই চার্বাক মতকে অমঙ্গলের প্রতীক অসুর মত হিসেবেও প্রচার করার প্রয়াসও দেখতে পাই আমরা। এই অসুর বলতে যাঁদেরকেই বোঝাক না কেন, তাঁদের সংস্কৃতি যে বেদবিরোধী ছিলো এ নিয়ে সন্দেহ নেই। ফলে বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকেরা তাঁদেরকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখেই দেখার চেষ্টা করেছিলেন। বৈদিক সংস্কৃতিতে এই অসুর মত যে একান্তই পরিত্যাজ্য সে সম্পর্কে যথোপযুক্ত প্রচারণার লক্ষ্যে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন-
দ্বৌ ভূতসর্গৌ লোকেহস্মিন্ দৈব আসুর এব চ।
দৈবো বিস্তরশঃ প্রোক্ত আসুরং পার্থ মে শৃণু।। ১৬/৬।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা)।
অর্থাৎ : হে পার্থ, এই জগতে দেবস্বভাব ও অসুরস্বভাব- এই দুই প্রকার মানুষ সৃষ্ট হয়েছে। দেবস্বভাবসম্পন্ন মানুষের কথা বিস্তৃতভাবে বলেছি। এখন অসুরস্বভাববিশিষ্ট মানুষের কথা আমার নিকট শ্রবণ কর।
.
প্রবৃত্তিঞ্চ নিবৃত্তিঞ্চ জনা ন বিদুরাসুরাঃ।
ন শৌচং নাপি চাচারো ন সত্যং তেষু বিদ্যতে।। ১৬/৭।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা)।
অর্থাৎ : অসুরস্বভাব ব্যক্তিগণ ধর্মবিষয়ে প্রবৃত্ত এবং অধর্মবিষয় হতে নিবৃত্ত হতে জানে না; তাদের শৌচ নাই, সদাচার নাই এবং সত্যও নাই।
.
অসত্যমপ্রতিষ্ঠং তে জগদাহুরনীশ্বরম্ ।
অপরস্পরসম্ভূতং কিমন্যৎ কামহৈতুকম্ ।। ১৬/৮।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা)।
অর্থাৎ : আসুরভাববিশিষ্ট ব্যক্তিগণ বলে, এই জগৎ সত্যশূন্য; ইহা ধর্মাধর্মের ব্যবস্থাহীন। ইহার কর্মফলদাতা ঈশ্বর নাই এবং কামবশতঃ স্ত্রী-পুরুষের সংযোগেই ইহা উৎপন্ন; ইহার উৎপত্তির অদৃষ্ট ধর্মাধর্মাদি অন্য কারণ নাই।
.
এতাং দৃষ্টিমবষ্টভ্য নষ্টাত্মানোহল্পবোদ্ধয়ঃ।
প্রভবন্ত্যুগ্রকর্মাণঃ ক্ষয়ায় জগতোহহিতাঃ।। ১৬/৯।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা)।
অর্থাৎ : এই লোকায়তিক মত আশ্রয়পূর্বক পারলৌকিক-সাধনচ্যুত ক্রূরকর্মা, অনিষ্টকারী ও অল্পবুদ্ধি আসুরপ্রকৃতি ব্যক্তিগণ জগতের বিনাশের জন্য জন্মগ্রহণ করে।
.
উল্লেখ্য, বেদের সারাংশকে উপনিষদ এবং ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’কে উপনিষদের সার বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তাছাড়া ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’ হচ্ছে মহাভারতের (আনুমানিক ৪০০খ্রীস্টপূর্ব-৪০০খ্রীস্টাব্দ) ভীষ্মপর্বের এক বিশিষ্ট অংশও। তাই গীতায় এ অসুর-মত বিষয়ক আরো শ্লোক উদ্ধৃত থাকলেও উল্লেখকৃত শ্লোক-ক’টি থেকেই কথিত অসুর মত সম্পর্কে একটা আপাত ধারণা তৈরি হয়ে যায়। বর্ণিত শ্লোক অনুযায়ী এই মতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করার পাশাপাশি তথাকথিত ঈশ্বর প্রদত্ত কর্মফল তথা এতদসংশ্লিষ্ট জন্মান্তরবাদও অসার বলে ঘোষিত হয়েছে। অসুর মতের সৃষ্টিতত্ত্বে এই জগৎ যে স্ত্রী-পুরুষের মিলনজাত ও কামোদ্ভূত এবং এর পেছনে অদৃষ্ট নামের কোন ধর্ম-অধর্ম পাপ-পুণ্য বা স্বর্গ-নরক ও আত্মা এসব অলৌকিক অবাস্তব কোন কারণ নেই তাও এই শ্লোক থেকে ধারণা করতে পারি আমরা। এবং এ শ্লোক থেকে আরেকটি যে কৌতুহলোদ্দীপক তথ্য পেয়ে যাই তা হলো, গীতায় এই অসুর মতকে লোকায়তিক মত হিসেবে আখ্যায়িত করার বিষয়টি। ফলে চার্বাক মতের আদি উৎস খুঁজতে গিয়ে বৃহস্পতির সম্পর্কসূত্রে শেষপর্যন্ত পৌঁছে যাই লোকায়ত মত নামের এক প্রাচীন ধারণার কাছাকাছি। তবে কি চার্বাক দর্শনের আদি রূপটি লুকিয়ে আছে প্রাচীন লোকায়ত মতের গভীরে কোথাও ? নিশ্চয়ই তা পর্যালোচনার দাবী রাখে। কিন্তু সে পর্যালোচনায় যাওয়ার আগে চার্বাক-বৃহস্পতি-লোকায়তের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের প্রসঙ্গে জৈন দর্শনকার গুণরত্নের ভাষ্যগ্রন্থ ‘তর্করহস্যদীপিকা’য় বর্ণিত উদ্ধৃতাংশটি প্রণিধানযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে-
।। অথ লোকায়তমতম্।।
প্রথমম্ নাস্তিক স্বরূপমুচ্যতে। কাপালিকাঃ ভস্মোদ্ধুলনপরাঃ যোগিনঃ ব্রাহ্মণাদ্যস্ত্যজাতাশ্চ কেচন নাস্তিকা ভবন্তি। তে চ জীবপুণ্যপাপাদিকং ন মন্যন্তে। চতুর্ভূতাত্মকং জগদাচক্ষতে। কেচিত্তু চার্ব্বাকৈকদেশীয়া আকাশং পঞ্চমং ভূতমভিমন্যমানাঃ পঞ্চভূতাত্মকং জগদিতি নিগদন্তি। তন্মতে ভূতেভ্যো মদশক্তিবচ্চৈতন্যমুতূদ্যতে। জলবুদ্বুদবজ্জীবাঃ। চৈতন্যবিশিষ্টঃ কায়ঃ পুরুষঃ ইতি। তে চ মদ্যমাংসে ভুঞ্জতে মাত্রাদ্যগম্যাগমনমপিকুর্বতে। বর্ষে বর্ষে কস্মিন্নপি দিবসে সর্বে সংভূয় যথানামনির্গমং স্ত্রীভিরভিরমন্তে। ধর্মং কামাদপরং ন মন্যতে। তন্নামানি চার্ব্বাকাঃ লোকায়তাঃ ইত্যাদীনি। গলচর্ব অদনে। চর্ব্বয়ন্তি ভক্ষয়ন্তি তত্ত্বতঃ ন মন্যন্তে পুণ্যপাপাদিকং পরোক্ষং বস্তুজাতমিতি চার্ব্বাকাঃ। …লোকাঃ নির্ব্বিচারাঃ সামান্যাঃ লোকাস্তদ্বদাচরন্তি স্মেতি লোকায়তা লোকায়তিকা ইত্যপি। বৃহস্পতিপ্রণীতমতত্বেন বার্হস্পত্যাশ্চ ইতি।
অর্থাৎ :
অনন্তর লোকায়ত। প্রথমে নাস্তিকদের কথা। কাপালিক :- ভস্ম আচ্ছাদিত যোগীগণ এবং অন্ত্যজ ব্রাহ্মণাদি কেহ কেহ নাস্তিক। তাহারা জীবগণের পুণ্য পাপ প্রভৃতির বিচার করে না। তাহারা জগতকে চতুর্ভূতাত্মক বলিয়া মনে করে। চার্বাক প্রভৃতি মতাবলম্বীদিগের কেহ কেহ আকাশকে পঞ্চম ভূত রূপে ধরিয়া জগতকে পঞ্চভূতাত্মক বলিয়া থাকে। তাহাদের মতে চৈতন্য মদশক্তির ন্যায় আবির্ভূত হয়। জীবগণ জলবুদবুদ্ তুল্য। পুরুষ চৈতন্যবিশিষ্ট শরীরমাত্র। তাহারা মদ্যপান ও মাংস ভোজন করিয়া থাকে এবং মাতা প্রভৃতি অগম্য নারী প্রভৃতিতেও গমন করিয়া থাকে। প্রতি বৎসর কোনো একদিনে সকলে একত্র হইয়া যথাভিপ্রেত স্ত্রীগণের সহিত রমন করিয়া থাকে। কাম ব্যতীত ধর্ম নাই। এই জন্যই চার্বাকদিগকে লোকায়ত বলা হইয়া থাকে। পরোক্ষ বস্তুসমূহ হইতে জাত গলাধঃকরণ ও চর্বণ হেতুই চার্বাক বলা হইয়া থাকে। …নির্বিচারে সাধারণ লোকের ন্যায় আচরণ করে বলিয়াই তাহাদিগকে লোকায়ত বা লোকায়তিকও বলা হইয়া থাকে। তাহাদের মত বৃহস্পতি প্রণীত বলিয়াই তাহাদের বার্হস্পত্যও বলে।
.
উদ্ধৃতিটিতে প্রাচীন তান্ত্রিক মত বামাচারের সাথে চার্বাক মতকে মিশিয়ে ফেলে তথ্য বিচ্যুতি ঘটানোর প্রবণতা অনুমান করা অস্বাভাবিক হবে না। তবে ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীন কৃষিভিত্তিক ধ্যানধারণায় প্রকৃতিস্বরূপা নারীযোনির আদিম জাদুবিশ্বাস সংশ্লিষ্ট প্রাচীন তান্ত্রিক আচারের সাথে চার্বাকী লোকায়ত মতাদর্শকে এক করে দেখানোর অন্যতম কারণ হয়তো উভয়ই বেদবহির্ভূত লোকায়তিক চিন্তা-চেতনা থেকে উদ্ভূত বলেই। কিন্তু এই তন্ত্র-সাধনার সাথে চার্বাক মতের সরাসরি পার্থক্যটাই হলো তান্ত্রিক আচার সুস্পষ্টভাবেই আধ্যাত্মিক লক্ষ্যনিষ্ট কিন্তু দেহাচারী স্বতন্ত্র সাধন-পদ্ধতি, অন্যদিকে চার্বাক মতাদর্শ সম্পূর্ণই দেহাত্মবাদী বস্তুতান্ত্রিক দর্শন। যার সাথে আধ্যাত্মিকতার কোনই সম্পর্ক নেই। তাই আধুনিক রুচি ও নীতিবোধের কাছে পঞ্চমকারপূর্ণ অর্থহীন তান্ত্রিক সাধনার বীভৎসতায় এর আদি-তাৎপর্য না খুঁজে কেবল লোকায়তিক আচারের দোহাই দিয়ে নির্দিষ্ট দর্শনদৃষ্টির সাথে মিশিয়ে ফেলাটা যথাযথ উপস্থাপন নয় বলেই মনে হয়। বিষয়টির কিঞ্চিৎ অনুধাবনের নিমিত্তে প্রাচীন তন্ত্র-সাধনার গূঢ়তত্ত্ব উদ্ঘাটন না-হলেও রহস্য-চিহ্নায়ক তন্ত্র-নির্দেশনার কিছু উদ্ধৃতি টানা যেতে পারে।
.
এক্ষেত্রে প্রাচীন ‘কুলার্ণব-তন্ত্র’-এ (সূত্র: লোকায়ত দর্শন / দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়) বলা হচ্ছে-
মদ্যং মাংসঞ্চ মৎস্যঞ্চ মুদ্রামৈথুনমেবচ।
মকারপঞ্চকং দেবি দেবতাপ্রীতিকারকম্ ।। (কুলার্ণব-তন্ত্র)।
অর্থাৎ : মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন- এই পাঁচটি বস্তুর নামের আদিতে ‘ম’ অক্ষরটি থাকায় ইহাদের সংক্ষিপ্ত নাম মকার। এই পঞ্চমকার দেবতাদিগের জন্যও প্রীতিকারক।
.
মকারপঞ্চকং দেবি দেবানামপি দুর্লভং।
মদ্যৈর্মাংসৈন্তথা মৎসৈর্মুদ্রাভির্মৈথুনৈরপি।।
স্ত্রীভিঃ সার্দ্ধং মহাসাধুরর্চ্চয়েৎ জগদম্বিকা।
অন্যথা চ মহানিন্দা গীয়তে খণ্ডিতৈঃ সুরৈঃ।। (কুলার্ণব-তন্ত্র)।
অর্থাৎ : পঞ্চমকার তন্ত্রের প্রাণস্বরূপ। পঞ্চমকার ব্যতীত তান্ত্রিকের কোনো কার্যেই অধিকার নাই। পঞ্চমকার দেবতাদিগেরও দুর্লভ ; মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন এই পঞ্চমকার দ্বারা জগদম্বিকাকে পূজা করিতে হয়।
.
পঞ্চমেন বিনা দেবি চণ্ডিমন্ত্রং কথং জপেৎ। (কুলার্ণব-তন্ত্র)।
অর্থাৎ : পঞ্চমকার ব্যতীত চণ্ডিমন্ত্র কেমন করিয়া জপ হইতে পারে ?
.
যদিও তান্ত্রিক রিচ্যুয়াল বা আধ্যাত্মিক তন্ত্রবিশ্বাস মতে বলা হয়ে থাকে, পঞ্চমকারের তাৎপর্য অতি গূঢ়, সাধারণের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয়, তবু একই প্রাকৃত উৎস থেকে উদ্ভূত এই আদিম তান্ত্রিক বিশ্বাস আর বার্হস্পত্য মতাদর্শের মধ্যে যে মাত্রাগত পার্থক্য তা বোধ করি বুঝতে অসুবিধা হয় না।
তন্ত্রসাধনায় যত গূঢ় রহস্যই থাকুক না কেন, এটা যে কামপ্রধান আচারই তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। যেমন-
কামেন মায়য়া চৈব পুটিতং কামবীজকম্ ।
তদা কামেশ্বরো মন্ত্রঃ সর্ব্বকামফলপ্রদঃ।। (কুব্জিকাতন্ত্রম্ : ২/৩৫)
অর্থাৎ : কামবীজ (কীং) এবং মায়াবীজ (হ্রীং) দ্বারা কামবীজকে পুটিত করিলে, তাহা সর্ব্বকাম ফলপ্রদ কামেশ্বর মন্ত্র হয়। (কীং হ্রীং কীং হ্রীং কীং)।
.
শ্রীপার্ব্বত্যুবাচ-
মন্ত্রার্থং মন্ত্রচৈতন্যং যোনিমুদ্রাং নবেত্তি যঃ।
শতকোটিজপেনাপি তস্য বিদ্যা ন সিধ্যতি।। (সরস্বতীতন্ত্র : ১/১)
মহাদেব মহাদেব ইতি যৎ পূর্ব্বসূচিতম্ ।
এতত্তত্ত্বং মহাদেব কৃপয়া বদ শঙ্কর।। (সরস্বতীতন্ত্র : ১/২)।
অর্থাৎ :
পার্ব্বতী বলিলেন- হে মহাদেব ! যে জন মন্ত্রার্থ মন্ত্রচৈতন্য এবং যোনিমূদ্রা জানে না, শতকোটি যপের দ্বারাও তাঁহার বিদ্যা (ইষ্টমন্ত্র) সিদ্ধ হয় না। আপনি পূর্বে এইরূপ যে সূচনা করিয়াছিলেন, হে শঙ্কর ! এই তত্ত্ব কৃপাপূর্ব্বক বলুন। ১-২।
.
তবে চার্বাকরা বেদকে প্রামাণিক হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও তন্ত্রসাধকদের ধ্যান-ধারণায় ব্রাহ্মণ্যবাদী বিশ্বাসের ছাপ পুরোদমেই বিদ্যমান দেখা যায়। যেমন-
অস্যাঃ স্মরণমাত্রেণ জীবন্মুক্তশ্চ সাধকঃ।
একোচ্চারণমাত্রেণ অশ্বমেধাযুতং ফলম্ ।। (কুব্জিকাতন্ত্রম্ : ২/৪৯)
অর্থাৎ : কালিকামন্ত্র স্মরণমাত্রই সাধক জীবন্মুক্তি লাভ করে এবং একবার মাত্র উচ্চারিত হইলে অযুত অশ্বমেধযজ্ঞ সম্পাদনের ফল লাভ হয়।
.
এই যাগযজ্ঞ বা বৈদিক বিশ্বাসের সাথে অবাধ কামাচারের মণি-কাঞ্চণ যোগের বৈধ সংকলকের ভূমিকায় তান্ত্রিকদের কালিকামন্ত্রের কার্যকর শক্তি যে কী বিপুল, তা তন্ত্রসাধনায় কুমারীতন্ত্রের ষষ্ঠ পটলের ‘কুলাচার-কথন’ উপাখ্যানের মাধ্যমে অনুধাবন করা যায়-
শ্রীদেব্যুবাচ-
দেবদেব মহাদেব জগৎপ্রলয়কারকঃ।।
কুলাচারে তু মদ্যাদ্যৈঃ কথং সিদ্ধির্ভবেৎ প্রভো।
অর্ধমকারণং হ্যেতৎ সংশয়ং ছিন্দি মে প্রভো।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/১)
শ্রীভৈরব উবাচ-
সাধু পৃষ্ঠো হি দেবেশি কথয়ামি শৃণুম্ব মে।
পুরা দারুবনে রম্যে মুনয়ো রাগমোহিতাঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/২)
পরস্ত্রিয়ং ধর্ষয়ন্তি মদ্যং পিবন্তি নিত্যশঃ।
তদ্দষ্টানুচিতং কর্ম্ম বির্ষ্ণুমাং সমুপস্থিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৩)
দেবদেব মহাদেব সৃষ্টিস্থিতিলয়াত্মকঃ।
প্রভো দারুবনে পাপা মদ্যপানরতাস্তথা।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৪)
পরস্ত্রিয়ং ধর্ষয়ন্তি মুনয়ো রাগমোহিতাঃ।
দিগম্বরাশ্চ মত্তাশ্চ কিং গতিশ্চ ভবিষ্যতি।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৫)
ইতি বিষ্ণুবচঃ শ্রুত্বা তমবাদমহং প্রিয়ে।
কালিকায়া মহাবিদ্যা অনিরুদ্ধঃ সরস্বতী।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৬)
বিদ্যারাজ্ঞীতি সা প্রোক্তা এতন্মন্ত্রপ্রজপকাঃ।
পরং মুক্তা ভবিষ্যন্তি তদ্গায়ত্রীং জপন্তি চ।। (কুমারীতন্ত্র¿ : ৬/৭)
কালিকায়াঃ প্রভাবেন সর্ব্বে দেবা বিমোহিতাঃ।
ভ্রুণহত্যা-মাতৃবধাৎ পরশুরামো বিমোচিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৮)
দত্তাত্রেয়শ্চ ত্রিপুরঃ সুরাপানাদ্বিমোচিতঃ।
ব্রহ্মহত্যা-শিরচ্ছেদাদহং রুদ্রোহপি মোচিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৯)
গৌতমস্ত্রীধর্ষণাচ্চ দেবেন্দ্রোহপি বিমোচিতঃ।
কন্যায়া ধর্ষণাদ্বাপি ব্রহ্মাবাচং বিমোচিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/১০)
চাণ্ডালীগমনাদ্বাপি বশিষ্ঠোহপি বিমোচিতঃ।
রাবণস্য বধাচ্চাপি রামচন্দ্রো বিমোচিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র¿ : ৬/১১)
.
অর্থাৎ :
দেবী কহিলেন- হে দেবদেব মহাদেব। আপনি জগৎ প্রলয়কারক। হে প্রভু ! কুলাচারবিধি-নির্দ্দিষ্ট মদ্যাদি পঞ্চমকার অধর্ম্ম অর্থাৎ পাপ সৃষ্টির কারণ। সুতরাং তৎসমুদয় কিরূপে মন্ত্রসিদ্ধি-প্রদায়ক হইতে পারে প্রকাশ করিয়া আপনি আমার সন্দেহ দূর করুন। ১।
ভৈরব কহিলেন- দেবেশি ! তুমি অতি উত্তম প্রশ্ন করিয়াছ। আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতেছি, শ্রবণ কর। পুরাকালে মুনিগণ কামমোহিত চিত্তে রম্য দারুবনে নিয়ত মদ্যপান এবং পরস্ত্রী ধর্ষণকার্য্যে ব্যাপৃত ছিল। মুনিগণের এই সকল অন্যায় কার্য্য দর্শন করিয়া, বিষ্ণু আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হন। ২-৩।
তখন বিষ্ণু আমাকে বলিতে লাগিলেন, হে দেবদেব মহাদেব ! আপনি সৃষ্টি স্থিতি এবং লয়ের কর্ত্তা। হে প্রভো ! দারুবনে কামমোহিত মদ্যপায়ী পাপাত্মা দিগম্বর ও পানমত্ত মুনিগণ পরস্ত্রী ধর্ষণ করিতেছে। ইহাদের কি গতি হইবে। ৪-৫।
হে প্রিয়ে ! তৎকালে বিষ্ণুর এই কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, কালিকা-নামক যে মহামন্ত্র এবং অনিরুদ্ধ যাহার সরস্বতী, যাহা মন্ত্রসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ- এই সকল মুনিগণ সেই মহামন্ত্র জপ করে। সেই কালিকা গায়ত্রী জপ করিয়া ইহারা সকলেই শ্রেষ্ঠ মুক্তি লাভ করিবে। ৬-৭।
কালিকাদেবীর প্রভাবে দেবতারাও বিমোহিত হইয়া থাকেন। কালিকাদেবীর প্রভাবে পরশুরাম ভ্রুণহত্যা ও মাতৃবধ পাপ হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন। ৮।
কালিকাদেবীর প্রভাবে দত্তাত্রেয় এবং ত্রিপুর সুরাপানের পাপ হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন। আমি রুদ্রও স্বয়ং ব্রহ্মহত্যা বা ব্রহ্মার শিরচ্ছেদরূপ পাতক হইতে কালিকাদেবীর প্রভাবেই মুক্তিলাভ করিয়াছিলাম। ৯।
সুরপতি ইন্দ্রও কালিকাদেবীর প্রভাবে গুরুপত্নী গৌতমীতে ধর্ষণজনিত পাপ হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন এবং ব্রহ্মাও কন্যাধর্ষণহেতু পাপ হইতে, বশিষ্ঠ চাণ্ডালীগমন পাপ হইতে এবং রামচন্দ্র রাবণবধজনিত পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়াছিলেন। ১০-১১।
.
এবং কালিকামন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে কিভাবে কুলাচার পালন করতে হবে তারও বর্ণনা রয়েছে কুমারীতন্ত্রে-
ব্রাহ্মণস্তাম্রপাত্রে তু মধুমদ্যং প্রকল্পয়েৎ।
নটী কাপালিকা বেশ্যা রজকী-নাপিতাঙ্গনা।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/২১)
ব্রাহ্মণী শূদ্রকন্যা চ তথা গোপালকন্যকা।
মালাকারস্য কন্যা চ নবকন্যা প্রকীর্ত্তিতাঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/২২)
এতাসু কাঞ্চিদানীয় ততস্তু যোনিমণ্ডলে।
পূজয়িত্বা মহাদেবীং ততো মৈথুনমাচরেৎ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/২৩)
.
অর্থাৎ :
ব্রাহ্মণ তাম্রপাত্রস্থিত মধুকেই মদ্যরূপে কল্পনা করিবে।
নটী, কাপালিকা, বেশ্যা, রজকী, নাপিতাঙ্গনা, ব্রাহ্মণী, শূদ্রকন্যা, গোপকন্যা এবং মালাকার কন্যা- ইহারা নবকন্যা বা গ্রহণীয়া কুলযুবতী বলিয়া কথিত হইয়া থাকে। ২১-২২।
এই সকল কুলযুবতী মধ্যে অন্যতমা কুলযুবতী গ্রহণ করিয়া তাহার শক্তিমণ্ডলে কালিকা দেবীর পূজা করিবে। তৎপর কুলযুবতীর মৈথুনে প্রবৃত্ত হইবে। ২৩।
.
বামাচারী তান্ত্রিক সাধনায় দেহজ কামের সাথে আধ্যাত্মিকতা মেশানো এই প্রক্রিয়া নিশ্চয়ই শুদ্ধ বৈদিক আচার বা সামাজিক রুচি ও সদাচারের পরিপন্থী ছিলো। তাই হয়তো ব্রহ্মবাদীরা একে কদাচারের তুল্য হিসেবে বিবেচনা করতে কার্পণ্য করেননি। অন্যদিকে স্রেফ বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত চার্বাক মতাদর্শকেও এই ব্রহ্মবাদীরা নিন্দনীয় দেহজ কামনা-বাসনার দর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করে গেছে সবসময়ই। ফলে এ দুটোকে এক করে দেখানোর প্রবণতা বোধ করি অস্বাভাবিক নয়। তার উপর এই বামাচারী তান্ত্রিক সাধনার নিমিত্তে যখন অতি সম্মান ও জ্ঞানীর আসনে বৃহষ্পতির নাম উদ্ধৃত হয়, তখন আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না। কেননা বৃহস্পতি তুল্য জ্ঞানবান হওয়ার যে প্রক্রিয়া এই তান্ত্রিক সাধনায় উক্ত হয়েছে, তা রীতিমতো লোমহর্ষক-
বৃহস্পতিসমো যন্তু ভবিতুং কাময়েন্নরঃ।
সর্ব্বো বৃহস্পতিসমো ভবেচ্চৈব ন সংশয়ঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/১৯)
সুন্দরীং যৌবনোন্মত্তাং নারীমানীয় নিত্যশঃ।
অষ্টোত্তরশতং জপ্তা কুলমামন্ত্র্য মন্ত্রবিৎ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/২০)
মৈথুনং যঃ করোত্যেব স তু সর্ব্বং ফলং লভেৎ।
তন্মুখে চ মুখং চ দত্ত্বা সহস্রং মানসং জপেৎ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/২১)
স ভবেৎ সর্ব্বসিদ্ধিদো নাত্র কার্য্যবিচারণা।
সর্ব্বেষাং সাধনাং মধ্যে শ্রেষ্ঠঃ স্যাৎ কুলসাধনম্ ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/২২)
তস্মাৎ সর্ব্বপ্রযতেœন সাধয়েৎ সুসমাহিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/২৩)।
.
অর্থাৎ :
যে ব্যক্তি বৃহস্পতি তুল্য জ্ঞানবান হইতে ইচ্ছা করে সে ব্যক্তি এই সাধনাপ্রভাবে বৃহস্পতিতুল্য জ্ঞানবান হইয়া থাকে, এতদ্বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। ১৯।
প্রত্যহ সুন্দরী যৌবনোন্মতা কুলযুবতী আনয়নপূর্ব্বক প্রথমে কুলাগার অভিমন্ত্রিত করিবে। তৎপর মন্ত্রজ্ঞ সাধক অষ্টোত্তর শতবার কালিকামন্ত্র জপ করিয়া ঐ কুলস্ত্রীর সহিত মৈথুনে প্রবৃত্ত হইবে। এইরূপে কুলস্ত্রীর সহিত রতিক্রিয়া সম্পন্ন করিলে সাধক পূর্ণফল লাভ করিয়া থাকে।
রতিকালে কুলযুবতীর মুখে মুখ প্রদান করিয়া এক-সহস্র সংখ্যক মানস জপ করিবে। ২০-২১।
যে ব্যক্তি এইরূপে কার্য্য করে সে সর্ব্বসিদ্ধিদাতা হইয়া থাকে। এতদ্বিষয়ে বিচার বিতর্ক অনাবশ্যক। সর্ব্বপ্রকার সাধন পদ্ধতির মধ্যে কুলাচারমতে সাধনই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ। সুতরাং সর্ব্বপ্রযত্নে অত্যন্ত একাগ্রতার সহিত কুলাচার পদ্ধতিতে সাধন করিবে। ২২-২৩।
.
বৃহস্পতির তুল্য জ্ঞানী হওয়ার এই দেহাচারী তান্ত্রিক সাধন-পদ্ধতির নমুনা থেকে প্রতীয়মান হয়, পরবর্তীকালের ভূতচৈতন্যবাদী চার্বাক দর্শনের আদিতে বৃহস্পতির নামেই এই দর্শনটিকে হয়তো নিচু ভোগবাদী মতাদর্শ হিসেবে প্রচারের প্রবণতা কার্যকর ছিলো। এবং তা হয়তো সফলও হয়েছিলো।
.
উল্লেখ্য, সহজ কথায় তান্ত্রিক মতের মূল চেতনা হলো- ‘যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তাই আছে দেহভাণ্ডে।’ তান্ত্রিক সাধনার এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুরণন আমরা নির্ব্বাণতন্ত্রে দেখতে পাই এভাবে-
মহাব্রহ্মাণ্ডকে যদ্ যদ্ প্রকারং পরমেশ্বরি।
তত্তৎ সর্ব্বং হি দেবেশি বৃহদ্ ব্রহ্মাণ্ডমধ্যতঃ।। (নির্ব্বাণতন্ত্র : ১০/১৯)
তদ্রূপঞ্চ দেহমধ্যে ভুবনানি চতুর্দ্দশ।
সৃষ্টিপ্রকারব্রহ্মাণ্ডে ভেদো নাস্তি সুনিশ্চিতম্ ।। (নির্ব্বাণতন্ত্র : ১০/২০)।
অর্থাৎ :
হে দেবাধীশ্বরি ! পরমেশ্বরি ! মহাব্রহ্মাণ্ড মধ্যে যাহা যে প্রকারে রহিয়াছে বৃহদ্ ব্রহ্মাণ্ড মধ্যেও সেই সকল সেইভাবে রহিয়াছে। ১৯।
সেইরূপ দেহমধ্যে চতুর্দ্দশ ভূবন বর্ত্তমান। সৃষ্টিপ্রকার ব্রহ্মাণ্ডে কোন ভেদ নাই ইহা সুনিশ্চয়রূপে জানিবে। ২০।
.
ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিরূপ সংস্করণ এই দেহভাণ্ডকে উপলক্ষ করে সাধনমার্গের মাধ্যমেই ব্রহ্মাণ্ডের যে সাধনা বিস্তার তান্ত্রিক বিশ্বাস-সম্মত, এর সাথে ইন্দ্রিয়াতীত কোন সত্তায় অবিশ্বাসী ভূতচৈতন্যবাদী চার্বাক মতের বিরাট দার্শনিক প্রভেদ বর্তমান। তবু হয়তো তাদের মধ্যকার অন্তর্গত সাদৃশ্য কেবল এখানেই যে, দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতায় উভয়ের লক্ষ্যই দেহপ্রত্যক্ষতা। ভাববাদী বা ব্রহ্মবাদীদের দৃষ্টিতে একটি অনাচারী, অন্যটি বেদবিদ্বেষী। ফলে প্রতিপক্ষ কর্তৃক বিরুদ্ধতার সমান্তরাল অবস্থানে উভয় মত হয়তো তাঁদের কাছে একই রেখায় মিশে গেছে একসময়। আর তাই প্রাচীন জড়বাদী লোকায়ত দর্শনের প্রতি অন্যান্য মতাবলম্বীদের দিক থেকে গুণরত্নের উপরিউক্ত বক্তব্যটি হয়তো এই সাধারণ প্রবণতারই লক্ষণ। চার্বাক মতের আদিরূপ সন্ধানে এই লক্ষণ নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।
.
তবে আমাদের মনোযোগের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে একই জড়বাদী দর্শনের বিভিন্ন নামকরণের প্রবনতা পর্যবেক্ষণ। অর্থাৎ চার্বাকই বার্হস্পত্য এবং বার্হস্পত্যই যে লোকায়ত, এ বিষয়টি ভারতীয় দর্শন ও সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সবসময়ই একে অন্যের সাথে যুক্ত হয়েই উপস্থাপিত হয়ে এসেছে। ফলে সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন থেকেই লোকায়ত মতের গভীরে চার্বাক দর্শনের আদি রূপটিকে খুঁজে দেখা যৌক্তিকভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে। হয়তো সেখানেই লুকিয়ে আছে চার্বাক দর্শনের মূল স্পন্দনটুকু। তবে লোকায়তিক আলোচনায় প্রবেশের আগে বৃহস্পতির সূত্র তথা বার্হস্পত্য-দর্শনের সাথে আরেকটু নিবিড় পরিচয়ের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয়।
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব: চার্বাক নামের উৎস] [*] [পরের পর্ব: বার্হস্পত্য, চার্বাক-মতের আদিরূপ]
…
পরে পরব ।
ভালো লাগলো। আসলে এত দুর্বোধ্য একটা বিষয়ে লিখছেন আপনি, এটা যারাই পড়বে তাদের ভারতীয় দর্শনগুলো সম্বন্ধে যদি বেসিক কিছু ধারণা না থাকে তবে অনেক কিছু ই ভুল বুঝবে। তবে একটা কথা কি, মুক্তমনা মানেই ধর্মীয় সকল বিষয়কে ভুল প্রমান করার আস্ফালন করতে হবে এমনটা মানিনা। যেগুলো ভুল বা কুসংস্কার আছে সেগুলো সুন্দর করে যুক্তি প্রমান দিয়ে তুলে ধরে সেই ধর্মের অনুসারীদের সেগুলো না করার জন্য আহ্বান করা এতটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু একটা বিষয় দেখা যায় যে ধর্মে এমন অনেক গুঢ় তত্ব থাকে যা সাধারন এক কথায় বুঝা যায়না। হঠাত একটা লাইন দেখে প্রকৃত অর্থ ধরা অনেকক্ষেত্রেই কষ্টসাধ্য। যেমন তন্ত্রসাধনার ক্ষেত্রে পঞ্চ ম কারের সাধনাকে তৎকালীণ সময়ে একটা বড়মাপের সাধনা ধরা হতো। কিন্তু যা আজকে আমাদের সময়ে অত্যন্ত গর্হিত ভাবে দেখা হয়। কিন্তু পঞ্চ মকারের সাধনা বলতে প্রকৃতার্থে কি বুঝানো হয়েছে সেটাতো অনেকেই জানিনা আমরা। আসলে ক্লাস ৮ এর ক্লাসে বসে যার ক্লাস ৩ এর জ্ঞান নাই তার বুঝতে সত্যি বেশ কষ্ট হবে। তাই আপনাকে একটু অনুরোধ করবো আমাদের মতো সাধারণদের কথা ভেবে আর একটু ভেঙে লিখবেন যেন প্রকৃত সত্যটুকু আমরা বুঝতে পারি, যদি তা না হয় তাহলে প্রত্যেকে এই চার্বাকদর্শনকে নিয়ে নিজ নিজ মতবাদ তৈরী করবে এতে যে কি অবস্থা হবে আজ থেকে কিছু বছর পরে তা তো আপনি বুঝতেছেন ই। ধন্যবাদ এত কষ্টকর কাজ করার জন্য। :guru:
😛
– একেবারে যথার্থ বলেছেন। এর পরে বা আগে নিম্নোক্ত মন্তব্যগুলো জরুরি নয় 🙂
“
”
তবে,
আপনার সব লেখায় নির্দ্বিধায় মতামত জানানোর মত পরিবেশ বজায় রাখার জন্য ধন্যবাদ। গুরুপাচক লেখা অনেকেই লেখেন, কিন্তু আমজনতা কে বোঝাবার মত সহনশীলতা অনেকেরই থাকেনা। আর লেখাগুলো যারা বিজ্ঞ তাদের থেকে বেশি জরুরি , যারা এখনও বিজ্ঞতা(ফলশ্রুতিতে মনুষ্যত্ব) অর্জন করার আশায় আমার মত আন্তঃর্জালে ঘুরে মরি, তাদের জন্য। এমতাবস্থায় লেখকদের গুরুগম্ভীর অপমানজনক একটি মন্তব্যই অনেকসময় আমাদের মুক্তোমনা হবার পথে ‘চিরস্থায়ী-হ্যাকারপ্রুফ-অগ্নিদেয়াল’ তুলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই আপনাকে ধন্যবাদ, মতামত দেয়ার দরজা সবসময় খোলা রাখার জন্য। :))
@ফ্লয়েডিয়ান, ধন্যবাদ আপনাকে আমার সীমাবদ্ধতাটুকু উপলব্ধি করার জন্য। তবে পাঠক হিসেবে আপনাদের মন্তব্যে আমি সব সময়ই উপকৃত হই আমার কাজের অগ্রগতি বোঝার ক্ষেত্রে। আর কৃতজ্ঞতাবোধটা একজন লেখকেরই থাকতে হয় পাঠকের কাছে। কেননা, পাঠক না থাকলে লেখকের অস্তিত্ব কোথায় !
এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক বক্তব্যটা আরেকটু বিস্তারিতভাবে উপরে গীতা দি’র মন্তব্যে জবাবে বলেছি। আশা করি সেটা থেকেও ব্যক্তিগতভাবে আমার মনোভাবটা কিঞ্চিৎ আঁচ করতে পারবেন। এজন্যে আপনার জবাবে সেই কথাগুলোর পুনরুক্তি করলাম না বলে কিছু মনে করবেন না আশা করি।
ভালো থাকবেন সব সময় আর নির্দ্বিধায় মন্তব্য করবেন নিঃশ্চিন্তে।
@রণদীপম বসু,
মডারেশন এর অপেক্ষায় থাকায় বুঝতে পারিনি যে মাঝে আরো মন্তব্য এসেছে। নয়ত গীতা দাস এর পোস্ট এর জবাব এর পরে আমার জবাবটা এখন দেখছি একেবারেই অপ্রয়োজনীয় দেখাচ্ছে। 🙂 যাই হোক, আপনার অভ্য় পেয়ে নিঃশ্চিন্তে মন্তব্য করে যাব 🙂 পরবর্তী পোস্ট এর অপেক্ষায় থাকলাম :))
-কৌতূহলোদ্দীপক.
অসাধারন লেখা, চালিয়ে যাবেন 🙂
তবে অনুবাদগুলোও খুব কঠিন। আপনার লেখনিও অতোটা সহজ নয় । একটু লোকায়ত পর্যআয়ে নামিয়ে আনলে আমার মত আমজনতার জন্য কম গুরুপাচক হত, 🙁 , হা হা হা।
ধন্যবাদ।
@ফ্লয়েডিয়ান, বলেন কী ! দর্শনের বিষয় একেবারে জলো করে ফেললে দর্শনে মান-মর্যাদার আর বাকি থাকবে কী বলেন !! হা হা হা !!
আসলে দর্শনের এবং দর্শনসংশ্লিষ্ট একগাদা বইপত্তর চারদিকে নিয়ে টই করে বসলে মাথার তার-তোরগুলিও মনে হয় বেশ উচ্চে গিয়ে টিউনিং হয়ে যায়। তবে অনুবাদগুলি আসলে আমার নয়। যে সব উৎস থেকে নেয়া, তা অক্ষত রেখেই উদ্ধৃত করার চেষ্টা করেছি। আমি ইচ্ছে করেই ওগুলোতে পরিবর্তন আনি নি রেফারেন্স অক্ষুণ্ন রাখতে। তারপরও আমার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করছি না কোনভাবেই। তবে দর্শনের ভাবগাম্ভীর্যটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে সরল বাক্যের বদলে যৌগবাক্যের ব্যবহার বেশি করেছি বলেই কিছুটা জটিল মনে হতে পারে। আরেকটা ব্যাপারও আছে। সামগ্রিক বিষয়টাই আসলে জটিল। এক পাঠেই তার অস্পষ্টতা কাটার কথা নয়। একান্ত কৌতুহলি হলে পুনঃপাঠ যে দরকার আছে তা আমি নিজেই টের পেয়ে আসছি গত বছর দুয়েক ধরে। একই জিনিস আমাকে বহুবার রিভাইজ করতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। যেহেতু গবেষণামূলক পর্যায়ে রয়েছে, তাই বিষয়টা আসলেই গুরুপাক। এই গুরুপাককে লঘুপাকে আনাটা আয়ত্ত না-করা পর্যন্ত আমার এ সীমাবদ্ধতাটাকে দয়া করে মার্জনা করবেন আশা করি।
নির্দ্বিধায় মতামত জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আশা করি আগামীতেও সাথে থাকবেন।
@রণদীপম বসু,
দাদা,
মুক্ত-মনায় লিখতে এসে অনেকেই এমন মুক্ত- মন নিয়ে কথা বলা তো দূরে থাক,শুনতেই পারে না। দ্বিধাহীনভাবে কথা বলার সুযোগ সৃস্টিও মুক্ত-মনাদের একটা বৈশিষ্ট্য। যা আপনার আছে।
যাহোক, তান্ত্রিক মত, নির্বাণ তন্ত্র,বামাচারী তান্ত্রিক, শুদ্ধ বৈদিক আচার (তথাকথিত?) ব্রহ্মবাদী, স্রেফ বস্তুবাদী,জন্মান্তরবাদ,জৈন মতবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে টিকাভাষ্য থাকলে দর্শনের নতুন পাঠকদের জন্য আপনার লেখাগুলো সুখপাঠ্য,সহজবোধ্য,চিন্তার পর্যায় ক্রমিক ধারণা রক্ষা করা ও বিভিন্ন চিন্তাধারার সাথে যোগসূত্র স্থাপনে আগ্রহ সৃষ্টিতে সহায়ক হত।
একবার লিখে পরে লিংক দিলেই হত।
যদি উলটা পালটা বলে থাকি মার্জনা করবেন। কারণ এর আগে একটা মন্তব্য করতে গিয়ে একজনের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কে ফাটল ধরেছে।
@গীতা দাস, অনেক ধন্যবাদ দিদি, যে বিষয়টা মাথায় রেখেই কাজ করে যাচ্ছি, আপনার মন্তব্যের যুক্তিতে সেটা আরো জোরালো হলো। আসলে ভারতীয় দর্শনের বৈশিষ্ট্যই হলো, যে কোন একটা দর্শন বুঝতে হলেই গোটা ভারতীয় দর্শন তথা সবগুলো আস্তিক নাস্তিক দর্শন সম্পর্কে ধারণা নিতেই হবে। চার্বাকের ক্ষেত্রে এটা আরো বেশি জরুরি। কেননা, সবগুলো ভাববাদী দর্শনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একা জড়বাদী চার্বাক দর্শন যুদ্ধ করে গেছে অবিরাম। আর চার্বাককে প্রতিহত করতে বাকি সবগুলো দর্শনই নিজেদের উন্নীত করেছে প্রতিনিয়ত, শানিত করেছে যুক্তিতে কৌশলে অপকৌশলেও। আর সেটা মাথায় রেখেই অন্য সবগুলো দর্শনেরও একেকটা সহজপাঠ তৈরি করছি। একটা নোট দিয়েই সেসব দর্শনের এক কানাপরিমাণও প্রকাশ সম্ভব নয় বিধায় সেগুলো আলাদাভাবে একে একে পোস্ট দিতে হবে একসময়। এজন্যেই বলেছিলাম যে, চার্বাক বুঝতে গিয়ে আসলে ভারতীয় দর্শন সমুদ্রের ফাঁদে পড়ে গেছি আমি। শেষ পর্যন্ত এটা একটা মেগা সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে যায় কিনা কে জানে ! তবে এর একটা শেষ দেখে ছাড়বো এ আশা ভেতরে পোষণ করছি।
মূলত আমরা এখনো চার্বাক দর্শনে প্রবেশ তো করিই নি, বরং অনেক দূরে আছি এখনো। চার্বাক বুঝতে হলে আমাদেরকে অনেকগুলো বিষয় বুঝে বুঝে এগুতে হবে বলেই একেকটা প্রসঙ্গ নিয়ে একেকটা পোস্ট দিচ্ছি। যেমন চার্বাক আদৌ কোন ব্যক্তি ছিলেন কিনা যিনি এ দর্শনটা জনক, বৃহস্পতি কে, লোকায়ত কী, তান্ত্রিক বামাচার বলতে কী বোঝায়, বার্হস্পত্য সূত্র কী, চার্বাক ষষ্ঠী কী, আস্তিক-নাস্তিকের শাস্ত্রীয় পার্থক্যটা কী, কর্মফল কী, জন্মান্তরবাদ কী, ষড়দর্শন কী, নাস্তিক দর্শনগুলো কী এবং এদের মধ্যকার দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতাগুলো কী, পরলোক, আত্মা ও ঈশ্বর সম্পর্কিত প্রতিটা দর্শনের ধারণাগুলো কী, জগত সৃষ্টির উপাদান হিসেবে কোন দর্শন কী ব্যাখ্যা দেয়, দর্শনের দৃষ্টিতে জ্ঞান বলতে কী বোঝায়, প্রকৃত জ্ঞান লাভের উপায় কী, প্রমাণ কী, প্রমাণের উৎসগুলো যেমন প্রত্যক্ষণ, অনুমান, উপমান, শাব্দবোধ ইত্যাদি কী, বেদ কী, স্মৃতি ও শ্রুতি কী, উপনিষদ কী, দর্শনের উন্মেষ ঘটেছে কখন কোত্থেকে ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক প্রশ্নের উত্তরগুলো সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা না পেলে চার্বাক দর্শনের মাহাত্ম্য বোঝা আদৌ কি সম্ভব ? হা হা হা ! আসলে সে কাজটাই করে যাচ্ছি। সব কিছু আলাদা আলাদা করে কাজ করতে হবে এবং এগুলোকে সংযোগ সূত্রে বেঁধেও দিতে হবে। আর তা করতে পারলে যে শেষপর্যন্ত ঢাউস একটা গ্রন্থের উপকরণ হয়ে যাবে সেটা বুঝতেই পারছি। যদি সবগুলো কাজ করে শেষ করতে পারতাম তাইলে হয়তো লিঙ্কে লিঙ্কে সয়লাব করে দিতে পারতাম। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি বলেই বিষয়গুলো নতুন পাঠকের জন্য বেশ জটিল মনে হচ্ছে। এই না-পারাটাকে দিদি এ মুহূর্তে মার্জনা করতেই হবে ! উপায় নেই যে ! হা হা হা !
তবে আমার ভুবনে পাঠকের দ্বিধাহীন মন্তব্যকে আমি খুব ইতিবাচক আগ্রহ নিয়ে স্বাগত জানাই এজন্যেই যে, আন্তরিক পাঠকেরা তাঁদের অজান্তেই আমার বেশ উপকার করে ফেলেন। কারণ এসব মন্তব্য থেকেই আমার ধারণা পেতে সুবিধা হয় যে আমার কাজটা কোন্ পথে এগুচ্ছে, কিভাবে এগুচ্ছে। চূড়ান্ত বিচারে একজন লেখকের গন্তব্য তো পাঠকই ! পাঠক না থাকলে সে লিখায় ফায়দা কী !!
অতএব পাঠক হিসেবে আপনাদের দ্বিধাহীন খোলামেলা মন্তব্য প্রকৃতই আমাকে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করছে। আপনাদের মন্তব্য লেখক হিসেবে আমার উপকারেই করছেন সেটা ভেবেই মন্তব্য করবেন আশা করি। এবং আমার সীমাবদ্ধতাকেও নিশ্চয়ই নিজ গুণে বিবেচনা করবেন এটুকু দাবী আমার পাঠকদের কাছে সব সময়ই থাকবে।
@রণদীপম বসু,
:hahahee:
দাদা এমন হলেই আমরা খুশি, চার্বাক দর্শনের পাশাপাশি ভরতীয় অন্যান্য দর্শনের ও পাঠ হয়ে যাবে ।