গল্প লিখতে বিশেষ অভ্যস্ত নই। তবুও মনে হলো, দেখিনা চেষ্টা করে! অনেক অনেক চেষ্টার পরে,
অবশেষে প্রসবিলাম যা,
“ইফেক্ট অব গাঁজা!”
প্রিয়তমা বলবেন নিশ্চয়ই।
আতঙ্কে উৎকর্ণ হয়ে রই।
ঈশানে জমেছে মেঘ
কালো, ভারী আর স্লথ বেগ!
চেঁচিয়োনা, বলোনা কিছু, কিছু নয়- দিলেম আভাস!
যদিও বইছে হেথা পাল ছেঁড়া ঝড়ো বাতাস।
বেলা শেষের গান
কেশব কুমার অধিকারী
প্রকান্ড দেয়ালঘেড়া বাড়িটার এক কোণে ছোট্ট একটা ঘরে তার বাস। বাড়ির মালিক দারুন দয়ালু, এরকম প্রাক্ প্রৌঢ় মানুষটির একাকী জীবনে যদি একটু স্বস্তির বাতাস ওকে সতেজ রাখে তো বিশ্বসংসারে এমন কোন ঘাটতি বোধ হয় দেখা দেবে না। দুই বুড়ো-বুড়ির তাই এতো প্রাণান্ত। সাগর সুমন্ত বাড়ি ফিরে নিত্যদিনের মতো আজো স্তব্ধ! ঘরের বাঁ দিকের কোণে ছোট্ট একটা এয়ারকন্ডিশন সংযোজিত হয়েছে। ফুরফুরে ঠান্ডা বাতাস আর কেমন যেনো একটা যান্ত্রিক মিষ্টি গন্ধ! ওপরের শার্টটা খুলে হ্যঙ্গারে ঝুলালো সাগর সুমন্ত। লাল কার্পেটের মেঝেতে বসে বিছানায় পিঠটা এলিয়ে দিতেই দুচোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুমেরা হামাগুড়ি দিয়ে এলো।
অসম্ভব পরিশ্রমী বলে সর্বত্র সুমন্তবাবুর বেশ নাম ডাক। সেই কবে আট-ন’ বছর আগে এখান থেকেই পি. এইচ. ডি-র তখমাটা যোগাড় করেছিলেন তিনি। তারপরে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক, এখান থেকে ওখান থেকে ডাক আসছেই! এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। তার অবয়বটাই এমন যে যতোটা জ্ঞান-বুদ্ধি ওর মাঝে আছে যেনো চোখের তাড়ায় তার উজ্জ্বল স্ফিতি এবং দীপ্তিতে তা আরোও ঊদ্ভাসিত হয়ে উঠে। পোষাক আসাকে আতিশয্য তেমন না থাকলেও বেশ বোঝা যায় একটা সম্ভ্রান্ত ভাব।
কলিংবেলটা বেজে উঠতেই চমকে উঠলো সুমন্তবাবু। এক অনিচ্ছা ভঙ্গীতে উঠে গেলো বহির্দরজার বৈদ্যুতিক সুইচের দিকে। ঘাড়ে টাওয়েলটা টেনে নিয়ে বাট্নটা চেপেই স্নানাগাঢ়ে ঢুকে পড়লো সে। একটু দূরেই বুড়ো-বুড়ি বসেছিলো টেলিভিশনের সামনে আর একটু একটু করে ওভেনে পোড়ানো মিষ্টিআলু ভেঙ্গে পুড়ছিলো মুখে। টক্ টক্ করে আলতো একটা মেয়েলী পায়ের শব্দ ভেসে আসতেই দুজনেরই নজর গেলো দরজার দিকে। বিদেশী একটি মেয়ে বাড়িয়ে দিলো তার মুখ। পরষ্পর পরষ্পরের দিকে নির্বাক চেয়ে রইলো কিছুক্ষন। নিজেকে সামলে নিয়ে ভাষাহীন নিপুণ অভিনয়ে লতা জানতে চাইলো সুমন্তবাবুর কথা। বুঝতে পেরে বুড়ি উঠে এলো, দুহাতে লতাকে টেনে নিয়ে নিজেদের মাঝে বসালে। যেনো ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরেছে!
এই বৃদ্ধযুগলের একমাত্র ছেলেটি থাকে ভিয়েতনামে। বিদেশী এক কোম্পানীতে চাকুরী করছে বহুদিন। মাঝে মাঝে দেশে আসে, ক’দিন থাকে স্ত্রীর আ্যপার্টমেন্টে আবার ক’দিন থাকে বাবা-মা এর সাথে নিজ আলয়ে। পাশ্চাত্যের হাওয়ায় এদেশের ছেলেমেয়েরাও আজকাল নিজেদের গড়ে তুলছে পশ্চিমী অধুনা সভ্যতার ধাঁচে। এই অশিতীপর বৃদ্ধার বুকের ভেতরটা খচ্ খচ্ করলেও বলার জো নেই! বার কতক টেলিফোন সংলাপ ছাড়া বৌমার দর্শন বোধ করি বিগত বছর চারেকে একটি বারের জন্যেও ঘটেনি। একমাত্র নাতনীটি মাঝে মাঝে এ বাড়িতে আসে পারিবারিক কোন আয়োজনে পিসতুতো ভাইবোনদের সাথে। এও একদিক দিয়ে বুড়ো-বুড়ির মন্দের ভালো। বছরে হাতে গোনা কয়েকটা দিন-তো অন্ততঃ নাতি নাতনীদের মিষ্টি মুখগুলোকে দুচোখ ভরে দেখা যায়, গালের মিষ্টি ছোঁয়ায় অন্তর টুকু ভিজে উঠে! জীবনের পড়ন্ত বেলায় এই যেনো ঢেড় প্রাপ্তি ওদের!
সুমন্ত বাবুও একেবারেই ছেলের বয়েসী! সেইযে প্রথমদিন, একটা চাকাওয়ালা লালরং এর স্যুটকেস টানতে টানতে এবাড়ির ভেতরে এসে ঢুকলো তার পরে আর ভাবতে হয়নি কিছু। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানেই এই যুগলের বুকের খালি জায়গাটির দখল নিয়ে নিয়েছিলো সে। সেই থেকেই এরা সাগর সুমন্তের মা এবং বাবা। ছেলের জন্যেও এদের চিন্তার অন্ত নেই! সাগর ভাত রেধেছে কিনা, তরিতরকারি কিছু আছে কিনা, সকালের খাবার প্রস্তুত কিনা, গভীর রাতে বাড়ি ফিরে সাগর খাবে কি? এগুলোই প্রথম প্রথম এদের প্রধান চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ক্রমান্বয়ে সন্তানের মঙ্গল-অমঙ্গল চিন্তাও এসে ভীড় করে মনে। খেতে নাপারলেও সাগরের কাছে পুরো ব্যপারটি ছিলো আশীর্বাদের মতোই। ভাজা ঈলিশ আর পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ সহযোগে পান্তাভাতে যার রসণা বরাবর পরিতৃপ্তির ঢেঁকুড় পরিপার্শিকতাকে জানান দেয়, সেখানে এদের গাঁজানো খাবারে রসনা পরিতৃপ্তিরতো কোনই সম্ভাবনা নেই। তবুও মা-বাবা-র কাছে তার এই অনুভুতি না কষ্টের কারন হয়ে দাঁড়ায়, সেই ভয়ে সাগর কৃত্রিম পরিতৃপ্তির ছদ্মাবরণে নিজেকে অভ্যস্ত করতে থাকে। একসময় তা হয়েও যায়! এইভাবেই একদিন এক বিদেশী পরিবারের সন্তানে পরিনত হয় সাগর সুমন্ত। আন্তর্জাতিকতাবাদে প্রবল আস্থাশীল এই মানুষটি গোটা বিশ্বের প্রায় সাড়ে ছ’শ কোটি মানুষেরই একজন নিজেকে ভাবে। তাই মা-বাবা সহ তাবৎ সম্পর্কের মাঝের যে টানাপোড়েন, সেই টানাপোড়েনের দ্বান্দ্বিকতার মধ্যথেকেই বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে সে স্থির করতে চায় বিশ্বমানবতার নিরীখে নির্নীত মানুষে মানুষে যে নিবীড় যোগসুত্র, তার স্বরূপ!
এরই মধ্যে স্নানাগাঢ় থেকে সাগর বেরিয়ে আসতেই লতাকে চোখে পড়ে। অবাক হয়! একদন্ড অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে-
– কি ব্যাপার, তুমি?
ঈষৎ শ্যামল মেয়েটির অসম্ভব সুন্দর মৌন মুখশ্রীতে যে স্মিত হাসির রেখাটি দেখাদিল যেন দিকচক্রবালের এ-প্রান্ত হতে ও-প্রান্ত অবধি মুহূর্তেই ছিট্কে বেড়িয়ে আসা এক বিদ্যুৎরেখা! সাগর সুমন্তের দেহাভ্যন্তরে অজানা অব্যক্ত কাঁপন। বুকের কোথায় যেনো শিরা উপশিরা গুলো জট পাকিয়ে ক্রমাগত তাকে অন্তঃধ্যান মগ্ন করে তুললো।
– বসো
বলেই সাগর নিজ ঘরে এসে ঢুকে পড়লো। দ্রুত কাপড়-চোপড় বদলে নিলে। মাথায় চিরুনীটা আলতো করে বুলিয়ে এপাশ ওপাশ করে হালকা অবাধ্য চুলগুলো একটু সাজিয়ে নিলে, দাঁড়িয়ে অনেকটা লাফাতে লাফাতে কালো মোজা জোড়া পায়ে সেঁধিয়ে বেড়িয়ে এলো ঘর হতে। জগৎ-সংসারটাকে আজ একটু বেশীই উজ্জ্বল মনে হলো, মনে হলো পৃথিবীতে যেনো আনন্দ স্থায়ী ভাবে তার জায়গা করে নিয়েছে! বুকের ভেতরে তার যে জমাট বাঁধা কষ্টগুলো, অব্যক্ত কথাগুলো, তার যে অভিযোগ গুলো, ওগুলো আর নেই! দেয়ালে সারি সারি ব্যাঙের ছাতায় তৈরী সৌখিন সজ্জার আড়ালে দাঁড়িয়ে অপলক তাকিয়ে রইলো সাগর! লতা মগ্ন টেলিভিশনের পর্দায়। মা’য়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায় সাগর।
– তোমরা বসে খেয়ে নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে যাও।
সাগর চেয়ে দেখলে, এরই মধ্যে এই বৃদ্ধা তাদের দু’জনের খাবার, টেবিলে সাজিয়েছেন। বৃদ্ধ এনেছে এক বান্ডিল সুদৃশ্য প্যাডের কাগজ। লতাকে জিজ্ঞেস করছে দরকার কিনা তার। দুর্বোধ্য ভাষায় লতা খানিকটা আড়ষ্ঠ! সাগর এগিয়ে গিয়ে ইঙ্গিত করলে প্যাড গুলো নিতে। দুহাত জোড় করে বাড়িয়ে দেয়া লতার আঙ্গুলের মাঝে বৃদ্ধ কাগজের বান্ডিলটি গুঁজে দিলে। পরম সন্তুষ্টিতে আস্বস্ত করলে এই বলে যে প্যাড গুলো খুব সুন্দর! ভাবখানা এই যে এগুলো এই করমঙ্গলেই মানায়! সাথে স্থানীয় ভাবে তৈরী একখানা সৌখিন কলমও দিলে! মাথাটাকে যতোদূর সম্ভব সামনে নুইয়ে বো-করে সম্মান জানালে লতা। সাগর তাকে শিখিয়েছিলো স্থানীয় ভাবে কি করে বো-করে সম্মান করতে হয় বয়োজ্যোষ্ঠদের! বৃদ্ধ যারপরনাই কৃতার্থ ভঙ্গীতে আলতো করে হাত রাখলে মাথায়। দৃশ্যটি দেখে সাগরের বুকের একেবারে ভেতরে কোথায় যেনো হাহাকার করে ঊঠলো! এযেনো সদ্য আসা বৌমার মাথায় তারই বাবার হাতের স্পর্শ! বাবা আজ বেঁচে থাকলে ঠিক এমন করেই হয়তো আশীর্বাদ করতেন! মুহূর্তেই সাগরের বুকের ভেতরটা এক অজানা আশংকায় কেঁপে উঠলো। এ কি ভাবছে সে! মানস পটে ভেসে উঠলো ছেলেটার মুখাবয়ব, প্রিয়তমা স্ত্রী জর্জ হ্যারিসনের কথা মনে হলো তার, সাগর আদর করেই কবিতাকে জর্জ হ্যারিসন বলে ডাকতো! দেশাত্ববোধের কারণেই হয়তো মার্কিন সংগীত শিল্পী জর্জ হ্যারিসন ছিলো সাগরের প্রিয় সংগীত শিল্পীদের অন্যতম। প্রিয়তমা জর্জ হ্যারিসন আর ছেলে তমাল গত দু’টি বছর ধরে তার পথ চেয়ে বসে আছে। একে একে মনে হলো স্ত্রীর টেলিফোন সংলাপ। কতো তার প্ল্যান! কি করে সাগরকে সে অভ্যর্থনা জানাবে এয়ারপোর্টে যখন সে পৌঁছুবে! বুকের ভেতরটা ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো সাগরের!
চিন্তাক্লিষ্ট অন্যমনষ্ক সাগরের ধ্যান ভঙ্গ হলো লতার ডাকে!
– এই সাগর, তোমার মা যে ডাকছেন! কি হয়েছে তোমার? এসো….
বলেই হাত ধরে ডাইনিং টেবিলের দিকে সাগরকে টানতে শুরু করলে লতা। সাগর জানে না তার হঠাৎ কি হয়েছে! মনটা বিষন্ন। একটু আগের ভালোলাগা গুলো এখন আর নেই। মুহূর্তেই মনে হলো যেনো কোথাও বাতাস বইছে না, ভারী গুমট মনে হচছে! চারদিক যেনো কেমন আলোহীন অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে! তবুও যতদূর সম্ভব নিজেকে সামলে নিলে সাগর। খেতে গিয়েও বিশেষ খেলে না! লতা যাতে খেয়ে নিতে পারে, তাই যতদূর সম্ভব নিজেকে স্বভাবিক করে ধরে রাখতে সচেষ্ট হলে সাগর।
কিন্তু সাগরের এই আনমনা ভাব লতার চোখ এড়িয়ে গেলোনা। খেতে খেতে লতা তার মাথাটি সাগরের চিবুকে স্পর্শ করালে। চুলের একটা মিষ্টি গন্ধে সাগর একটু সচকিত হয়ে সরে এলে খানিক। লতা তাকালে সরাসরি সাগরের চোখে। কি যেনো দেখলে গভীর মনোযোগে! কপালে আলতো করে বাঁ-হাতটি ছোঁয়ালে!
– শরীর খারাপ লাগছে সাগর? তোমার মন খারাপ দেখলে, জগতের সবই যে আমার কাছে নিরানন্দ, বিস্বাদ মনে হয়, জানোনা? কবিতা আর তমালের সাথে কথা হয়েছে আজ? ওরা ভালো আছে সবাই?
সাগর মাথা নাড়লে। মুখে কিছু বললে না। লতা আরোও কাছে সরে এসে সাগরের হাতে তার হাতটা আলতো করে রাখলে। সাগর হাতখানি সরিয়ে নিতে চাইলে লতা আরোও শক্ত করে হাত দুখানি মৃদু ঝাঁকি দিয়ে জানতে চাইলে-
– তাহলে মন খারাপ করে আছো কেনো?
– জানিনে জানিনে জানিনে। তোমার খাওয়া হয়েছে? তবে ওঠো, দেরী হয়ে যাচ্ছে।
সাগর একটু অসহিষ্ঞু এবং উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। তবুও নিজেকে সামলে নিতে মনে মনে আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগলে। সাগর ঊঠে প্লেট, চামচ আর গ্লাস গুলো ধুতে গেলে লতা উঠে এসে বাধা দিলো, সাগর তাতে বাধা না দিয়ে ধীরে চলে এলো ঘরে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলো দূরের সবুজ পাহাড়টার দিকে। সব কিছুই তার কাছে ঘোলা আর অস্পষ্ট মনে হলো। একখন্ড ধুসর মেঘ স্থির হয়ে জমে আছে পাহাড়ের চূড়োয়। পাশের একটা গাছের লালচে হলুদ পাতা ওর চোখের সামনে দিয়ে ঝড়ে পড়লো নীচে। ঝি ঝি ঝি ঝড় ড় ড় ড়…….. কোন একটা বুনো পোকার বিরতিহীন একটানা শব্দে পরিবেশটাই যেনো কেমন নিঃসঙ্গ একাকীত্ত্বের ক্লান্তিতে ভারী হয়ে উঠেছে। একটা প্রচন্ড কষ্ট ওর বুকের ভেতর থেকে গুমরে গুমরে উঠছে। এরই মাঝে লতা এক গ্লাস জল সাগরের জন্যে নিয়ে কিছুক্ষন হলো ওর পেছনে এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছে। হাতের গ্লাস টি পাশের টেবিলে রেখে সাগর সুমন্তের পাশে এসে দাঁড়ালো। আস্তে করে মাথাটা সাগরের হাতের ডানায় এলিয়ে দিয়ে বললে,
– সাগর!
– হুমম্
– আমাকে তুমি বুঝতে পারোনা তাইনা? আমি কি চাই, কি ভাবি, তুমি কিচ্ছু অনুভব করোনা তাইনা?
সাগর কোন উত্তর দেয়না, শুধু ভাবে, ওর এখন কিইবা বলা উচিৎ? ওর দৃষ্টি লতার চোখ থেকে ওর মাথার উপর দিয়ে ঐ দূরে দিগন্তের ওপাড়ে চলে যায়! লতা তাকিয়ে থাকে সাগরের নির্মিলিত খানিক ভেজা ভেজা চোখের দিকে! কি যেনো খোঁজে সেখানে! একটু হতাশ হয়, বুক চিরে চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো একটি দীর্ঘ-নিঃশ্বাস বেড়িয়ে যায়। হু হু করে বুক চিরে কান্না বেড়িয়ে আসতে চায়। লতা তার মনের গভীরে এতোদিন যে বিশ্বাসকে লালন করে এসেছে, আজ যেনো ওখানেই একটা ক্ষত সৃষ্টি হলো। হোচট্ খেলো আত্মবাশ্বাস! অনেকটা অভিমানে, ক্ষোভে রাগে লতা ধীরে ধীরে বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে এলো।
লতার এমনিতর বেড়িয়ে আসাতে সাগরের চিরন্তন পুরুষালী স্বভাবে তার মনুষত্বে আঘাত পেলো প্রচন্ড। নিজের সাথে নিজের যে নিরন্তর যুদ্ধ, সেই যুদ্ধে ক্রমশঃ তার আপাতঃ বোধের ক্ষয় হতে শুরু করলে। লতার বোধ গুলোকে মেলে ধরলে নিজের দৃশ্যায়ীত মানসপটে! যেখানে পটে আঁকা ছবির মতো ভেসে উঠে লতার আকুতি, ভাল লাগার প্রত্যয়দীপ্ত চোখ! স্থির থাকতে পারলে না সাগর, এক লহমায় বেরিয়ে এসে লতার পিছুধরতে চাইলে, কিন্তু ততক্ষনে লতা অন্দর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে পথে। লতা কিছুটা ধীর লয়ে এগিয়ে চলেছে আগে, আর সাগর তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গীতে দ্রুতলয়ে পেছনে। সামনের জেব্রাক্রসিং-এ ওদের দেখা হলো।
– এতো দ্রুত অঙগার থেকে আগুনে পরিনত হলে আমার জল ঢালার অবসরটি কোথায়!
আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখেনিলে আপাদমস্তক মানুষটিকে! কি অদ্ভূত সাদামাটা একটি মানুষ, অথচ কোথায় যেনো এক দৃঢ়তা ওকে সবার থেকে আলাদা করে ফেলেছে। রাস্তা পার হতে হতে বড় উচ্ছ্বসিত হয়ে ঊঠে লতা। মনে হতে থাকে ওর তাৎক্ষনিক ভাবনা গুলো এখনি বলে ফেলে। প্রাণ থেকে উৎসারিত দশহরার সম্মিলিত শক্তি দিয়ে নিজেকে তখনকার মতো নিবৃত্ত করলে লতা। বললে,
– এতো অপারগ হলে কপালে ছাই ছাড়াতো আর কিছু জুটবে না বালক! বলেই হেসে ফেললে খিল খিল করে।
লতার এহেনো হঠাৎ দার্শনিক মন্তব্যে চমৎকৃত সাগর খানিক বিষ্মিত হলেও ততধিক স্মিতহাস্যে বললে,
– তাইতো বলি, এত্তো এত্তো কাজ পড়াশুনা করেও আমার কপালে কেবল ছাই-ই জোটে কেনো! সন্দেহ নেই, আগামীতেও কপালে এই-ই আছে!
বলেই লতার পানে এক নজর চেয়ে মুচকী একটু হাসলে। লতা এগিয়ে এসে সাগরের বাঁ-হাতের আঙ্গুল গুলো নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আলতো করে চেপে ধরলে। কোথা থেকে যেনো রাজ্যের সমস্ত বন্যতা এবার সাগরের উপড়ে ভর করতে শুরু করলে। নিজেকে দারুন কৌশলে সামলে নিয়ে বললে,
– লতা, ল্যবরেটরীতে অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। আজ আমাকে সহযোগীতা একটু করো সম্ভব হলে।
– মাথা নাড়লে লতা, যেনো দেবরাজ ইন্দ্রের নির্দেশ পেয়েছে সে!
এই থেকেই শুরু সাগর আর লতার পারস্পরিক সহযোগীতার মেলবন্ধন! কে বলবে ওরা আলাদা সত্ত্বা? দুটি হৃদয় মিলে মিশে যেনো একাকার!
সেদিন বিশ্ব-শিশু দিবসের হৈ-হুল্লরে ঢেকে গেল ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক দৈনন্দিনতা। ওরইমাঝে নীরবে হেঁটে চললে দুটি মিশে যাওয়া প্রাণ আরো আরো সরব প্রাণের স্পন্দনে। কখনো হাতে হাত ধরে কখনো গায়ে গায়ে মিশিয়ে ! এইযে অব্যক্ততার যাত্রা, তবুও যেনো ব্যক্ত সবই! সবাই জানে মিশে যাওয়া দুটি প্রাণের কথা। আর একদিন অরুনাভ সন্ধ্যায়, শীতের প্রাক্কালে জুবুথুবু হয়ে বসে রইলো সাগর আর লতা পুকুর ধারের পাশাপাশি দুটি পাথরের গায়ে। একমনে চেয়ে রইলো টলমলে জলের ভেতর। ছোট ছোট কচ্ছপ আর অসংখ্য ছোট বড় রঙ্গিন মাছেদের ভীড়ে! দুটি মাছ বারবার ওদের সামনে এসে টুপকরে দেখে যাচ্ছিলো এক নজর! লতা আনমনা সাগরের আরো কাছে সরে এলো। সূর্য তখনো মুখ লুকোয়নি। পুকুরের চার ধারের ঝুলে পড়া রেইনট্রির ঝলমলে সবুজ পাতাগুলো আরো গাঢ় হয়ে হৃদয়ের কান্না-হাসি সমেত একখানি ছবির ফ্রেমে চির বন্দীত্বের বন্ধনে স্থায়ী হয়ে রইলো।
– সাগর! পুকুরের গভীর এতো অন্ধকার কেন? আশে পাশেটা দেখো, কেমন যেনো হলদেটে হয়ে উঠেছে! দারুন রং! তাইনা?
জলের সামান্য ওপরে স্থির ভাবে উড়ন্ত এক ফড়িং এর পানে অপলক তাকিয়ে আছে সাগর। পায়ের জুতোর ওপড় দিয়ে দ্রুত চলে গেলো কালো এক ডেও পিঁপড়ে। চারপাশে শন্ শন্ বাতাসে ঝিরঝির করে শব্দের শৃঙ্খলিত ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলেছে সাগরের বুকে। হঠাৎ ওর নজর পড়লে লতার দুষ্টুমীভরা মুখটার দিকে। চোখে চোখে চোখ পড়তেই কেমন যেনো চমকে উঠলে সাগর। পুকুরের স্বচ্ছ জলের মাঝে যেমন আশ-পাশের গাছ-পাথরের অবয়ব গুলো স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে, ঠিক তেমনি লতার স্থির তাকিয়ে থাকা স্বচ্ছ চোখের তারায় সাগর নিজেকে যেনো নতুন করে আবিষ্কার করলে!
ভাল লেগেছে। (Y)
ধন্যবাদ গীতা দাস। আপনার মন্তব্যই প্রথমে আসবে আশা করেছিলাম, পেলামও তা। বানান দুটো ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।
আপনার প্রশ্নের আলোয় ব্যপারটাকে এভাবে কি আনতে পারি? আসলে তো সাগর আর কবিতার সহাবস্থানের ব্যত্যয় ঘটবে না বা ঘটার কথাও না, আপাতত ছোট গল্পের নিরীখে তা বলে দেওয়াই যায়, যেখানে তমালের জীবন আর তার স্বাভাবিক বেড়ে উঠা আজকের সমাজ কাঠামোর একটি প্রত্যাশিত অভিপ্রায়। কিন্তু জীবন আর জীবনের জটিল উপাদান গুলো কখনো কখনো স্বাভাবিক গতিপথটাকে আগলে ধরে না? ধরুন না ঠিক এইখানেই এই আপাত সুশিক্ষিত দুটি মানুষ পরষ্পরের আস্থার জায়গাটি খুঁজছে! সে যেকোন আঙ্গিকেই হোক না কেনো। গল্পের মাঝে কবিতা আর তমালের প্রতি উভয়ের উৎকন্ঠা আর ভালোবাসার প্রকাশও ঘটেছে। কবিতা এবং সাগর সুমন্তের সমান্তরালে লতার অবস্থানকে একটা আবহ হিসেবে দেখা গেলেও তা কেবল স্থান-কালের সীমার মাঝেই বোধ হয় আবদ্ধ। অর্থাৎ বলতে চাইছি যে, স্বদেশে বাবা-মায়ের পাশাপাশি যদি বিদেশী বাবা-মা প্রকৃত বাবা-মায়ের ভূমিকায় এসে দাঁড়াতে পারে, তাহলে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে একজন আস্থাশীল মানুষের অবস্থানের দ্বন্দ্বটাকে কিভাবে মূল্যায়ন করা যেতে পারে যদি তা সচেতন ভাবে নির্মোহ হয়?
কবিতা ও গল্প দুটোই তো লেখা হয়ে গেল। তবে দুটো লিখতে গিয়ে বোধ হয় গল্পের বানানে মনযোগ দেওয়া যায়নি। প্রথম লাইনেই ঘর না হয়ে ঘড় আর আর প্রৌঢ় না হয়ে প্রৌড় বানান দেখে নিশ্চয়ই অনেকে পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
আর গল্পে যেভাবে চিত্রায়িত সেভাবে সাগরের জীবনে কি কবিতা আর লতার সহাবস্থান সম্ভব?