বিছানার জন্য জাজিম বানানো খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে, তা নাহলে ছেলে দুটো আরাম করে ঘুমোতে পারছেনা। এমাসেই জাজিম তোষক বানাবেন বলে সংসার খরচ কমিয়ে আনবার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন রাজিয়া। রুমাকে বলে রেখেছেন এমাসে টাকাটা তার ফেরত চাইই চাই। রাজিয়ার কষ্ট হচ্ছিল মেয়েটাকে এভাবে টাকার জন্য চাপ দিতে। তার এই মেয়েটি কলেজে ভর্তি হবার পর থেকেই টিউশনি ধরেছে নিজের টিফিন খরচ চালাবার জন্য আর তারপর থেকে নিজের খরচের প্রায় সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। টিউশনি, ক্লাস, বন্ধু-বান্ধব, কম্পিউটার, বই- সব মিলিয়ে বাইরেই নিজের জগৎ খুঁজে নিল মেয়েটা, কেমন যেন বাইরের মানুষ হয়ে গেল। এখন তো এমনও দিন যায় একটি কথাও হয়না মেয়েটার সাথে। রাজিয়ার খুব রাগ হয় মেয়েটার উপর, ইচ্ছে করে মেয়েটাকে কাছে বসিয়ে কথা বলেন, আর দশটা মেয়ের মত ঘরে থাকুক মেয়েটা। খুব রাগ হয় নিজের উপর মেয়েটাকে এভাবে বাইরে থাকতে দিতে হয়েছিল বলে, সে মানুষটার উপরও রাগ হয় যে মরে গিয়ে তাদের সকলকে ভাসিয়ে দিয়ে গেল অকূল পাথারে। আচ্ছা, মানুষটা বেঁচে থাকলে কি সবকিছু অন্যরকম হত? সবাই এক ঘরে বসে গল্প আর টিভি দেখা চলত?- ভাবে রাজিয়া।
-না, মেয়েটা ভয়ে কাবু হয়ে থাকত। ছোটবেলা থেকেই মেয়েটা ভয় পেত বাবাকে, অন্য ছেলেমেয়েদের মত কিছুতেই সহজ হতে পারতনা। একদিন শাহীন, ওর বাবা খুব কাঁদল, মেয়েটা কেন তাকে এত ভয় পায়? লোকটা নিজের উপর রাগটা চোখের পানিতে বের করে দিচ্ছিল। তখনই মেয়েটার দিকে চোখ পড়ল তার। মেয়েটা একা এক কোণে বসে গল্পের বই পড়তে পড়তে ভাত খাচ্ছিল। হঠাৎ শাহীনের সব রাগ গিয়ে পড়ল বইটার উপর, তার মনে হতে লাগল বইটাই যেন মেয়েটার আর তার মাঝে দেয়াল হয়ে আছে। ক্রুদ্ধস্বরে তাই বকতে লাগল মেয়েটিকে, গল্পের বইটা মেয়ের হাত থেকে ছুড়ে ফেলে দিল। মেয়েটা ভয়ে কিছুক্ষন নিস্তব্ধ হয়ে বইটার দিকে চেয়ে রইল, তারপর বাবাকে আড়াল করে চোখের পানি মুছতে মুছতে ভাতটুকু শেষ করল তাড়াতাড়ি। সে জানে বাবা আরো রেগে যাবেন ভাত ফেলে উঠে গেলে। তারপর আস্তে করে বইটা নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল। ছেড়া বইটা হাতে করে ফুলে ফুলে কাঁদতে শুরু করল। আমি দেখলাম আরো দূরে চলে গেল বাবা আর মেয়ে।
ভাবনার জাল ছিড়ল কলিং বেলের শব্দে। রুমা এসেছে। এসেই ব্যাগটা একদিকে ছুড়ে ফেলে কম্পিউটার অন করল সে। রাজিয়ের সমস্ত ভালবাসা অভিমানে আর তারপর অভিমানটুকু রাগে পরিণত হল, ক্রুদ্ধস্বরে কিছু কথা বলল মেয়েকে। মেয়ে জবাব দিলনা। গতকালই একচোট হয়ে গেছে ঝগড়া, মেয়ে হয়ত ওভিমান করে কথা বলছেনা অথবা সারাদিনের ব্যস্ততায় ক্লান্ত সে। তবু রাজিয়ার রাগ উঠতে থাকে। তার কি মন চায়না সারাদিন একা থাকার পর মেয়েটার সাথে দুদন্ড কথা বলতে? বড় মেয়ে ছিল যতদিন ততোদিন মনটা এত হুহু করতনা কথা বলার জন্য, কিন্তু বিয়ের পর সেও ঠিক রাজিয়ারই মত মায়ের বাড়িতে যখন তখন আসার স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলল। রাগটা বাড়ছে রাজিয়ার- সে তো মা, নাহয় দুকথা বলেছেই কাল। তাই বলে তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিতে হবে? মেয়ের এই এড়িয়ে যাওয়া সহ্য করতে পারেনা রাজিয়া। কর্কশ সুরে ধারের টাকা ফেরত চায় সে। মনে করিয়ে দিতে থাকে মা না থাকলে বাবা মারা যাবার পর চাচাদের চাপে কোন এক দুবাই প্রবাসীর দ্বিতীয় স্ত্রী হওয়া ছাড়া কোন গতি ছিলনা রুমার। কথাগুলো বলার সময় রাজিয়া ভেতরে ভেতরে মরে যেতে থাকে একটু একটু করে,কষ্ট হতে থাকে তার, সেদিনের মত শেষ মৃত্যু হয় তার যখন রুমা তার মুখের উপর টাকাগুলো ছুড়ে দেয়। আরো কিছু কঠিন কথা বলে বেরিয়ে যায় সে ঘর থেকে আর রুমা সশব্দে দরজা বন্ধ করে দেয়। যতদিন বেঁচে আছে ততদিনই কি বারবার মরতে হবে তাদের?
রুমা কাঁদছে, সে বুঝতে পারেনা কেন তাকে মা এমন কথা শোনায়। সে কি কখনো মায়ের অবদান অস্বীকার করেছে? সারাজীবন অসহায় থেকেছেন এই নারী, স্বামীর সংসারে সমস্ত অত্যাচার সয়েছেন, সেখানকার মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন গুরুত্বহীন আদর্শ বাঙালি নারী হিসেবে। সে অসহায় মানুষটিই স্বামীর মৃত্যুর পর পায়ের নিচে মাটিহীন অবস্থায় দাঁড়িয়েছিলেন সকল হায়েনাদের বিরুদ্ধে, তার মেয়েদের এমন একটি জীবনের জন্য যে জীবনের স্বাদ তিনি কখনো পাননি। আজ রুমা যা কিছু সবই তার মায়ের জন্য। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে সে দূর থেকে দূরে সরে পড়ছে মার কাছ থেকে। এইত সেদিন তার জ্বর হল। জ্বর হলেই রুমার ইচ্ছে করে কেউ একজন পাশে বসে থাকুক, কপালে ঠান্ডা একটা হাত রাখুক। ছোটবেলা থেকে এ কাজটি করে এসেছেন মা- আজো সে স্পর্শের জন্য কাতর রুমা, তবু সে মাকে বললনা জ্বরের কথা। গতকাল আবারো ঝগড়া হয়েছে। চিরকাল ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ ভয়ে ভীত মা তার কিছুতেই বুঝতে চায়না কতগুলো ফালতু মানুষের জন্য সে তার জীবনধারা বদলাতে পারবেনা, মাকে সে ভালবাসে কিন্তু মায়ের মত সে কিছুতেই হতে পারবেনা। আচ্ছা, মা কিজন্য এ বিষয়টাতে এত রেগে যান? নিজের মত বাঁচতে না পারার ব্যর্থতা উপলব্ধি করে? জানেনা রুমা। যাহোক, সেই সন্ধ্যায় জ্বরের ঘোরে যখন সে তন্দ্রাচ্ছন্ন তখন হঠাৎ কপালে টেল পেল ঠান্ডা হাতের স্পর্শ। মা কেমন যেন অপরাধীর মত কপালে হাত রেখেছেন, রুমা যাতে তার মায়া দেখতে না পায় এজন্যেই কি সন্ধ্যার অন্ধকার আর মেয়ের তন্দ্রাচ্ছন্নতা বেছে নিয়েছেন মা? কে জানে? মা যেন বুঝতে না পারে সে জেগে আছে তাই ঘুমের ভান করে চোখ বন্ধ করে রইল রুমা। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টায়ও চোখের দুকোণ বেয়ে গড়ানো পানি আটকাতে পারলনা। কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছিল রুমার, মনে হচ্ছিল সময় এভাবেই থেমে যাক- মা তার সন্তানের জ্বরতপ্ত কপালে শীতল হাত রেখেছেন আর সন্তানের চোখের কোণ বেয়ে পানি পড়ছে, হয়ত মায়ের চোখও ভিজে উঠেছে- দৃশ্যটা কি সত্যিই মধুর এবং অমূল্য নাকি জ্বরের ঘোরে রুমার এমন মনে হচ্ছিল?
স্বপন ভাইয়ের লেখায় আপনি বলেছেন, তবু পড়তে গিয়ে আমিও কিন্তু এ জায়গায় হোঁচট খেয়েছি। আপনি বলছেন, যেহেতু পুরো প্যারা মায়ের ভাবনা হিসাবে দেয়া হয়েছে, তাই ‘আমি’ ব্যবহার করেছেন। গল্পে কখনো লেখক কথা বলেন, আবার কখন চরিত্রের ভাবনায় কথা বলেন। আপনি দ্বিতীয়টি করেছেন। তারপরও, সরাসরি সংলাপ ছাড়া ‘আমি’ ব্যবহারে পাঠ বিঘ্নিত হয়, যদি না লেখক উত্তম পুরুষে লিখে থাকেন। এটা আমার একান্তই নিজস্ব ভাবনা।
টাইপো!
উপরের লাইনগুলোতে চরিত্র চিত্রণে আপনার অসামান্য কুশলতা প্রকাশ পেয়েছে। চরিত্রের অন্তর্জগত অব্ধি যত যেতে পারা যায়, গল্পের শিল্পমান ততই বাড়তে থাকে। এটাও আমার নিজস্ব মত।
আপনার গল্প আরও নিয়মিত পড়তে চাই।
@কাজি মামুন, ধন্যবাদ আপনাকে 🙂
গল্প তো নয় যেন বাস্তব আলেখ্য। এ জন্যেই কি বিভাগে গল্প ও ব্লগাডা দুটোই লেখা?
@গীতা দাস, হ্যা। ধন্যবাদ গীতাদি।
লীনা, উপরে রিজওয়ান যে কথাগুলো বলেছেন, সেগুলো আমারও মনের কথা। আমার মাকেও দেখেছি, কোন কিছু চাও কিনা জিজ্ঞেস করলে কেবল জবাব দিতো, ‘তোরা মানুষ হলেই আমি খুশি’। সত্যিই বিচিত্র কারণে মাকে কিছুই চাইতে দেখিনি। আমরা ভাল কিছু হলে, ভাল কিছু করলে যে খুশি তার চেহারায় দেখা যেত, আর কিছুতেই তা খুঁজে পেতাম না।
সামনেই ‘মা দিবস’। এ লেখাটি হয়তো মায়ের কথা ভাবতে পাঠকদের অনুপ্রাণিত করবে। লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
@অভিজিৎ, ধন্যবাদ অভিদা। আমাদের মায়েদের জীবনে একটা বড় ধরণের ট্রাজেডি হচ্ছে তারা আমাদের সবাইকে এগিয়ে নেবার জন্য খাটতে খাটতে নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলেন, আমরা একসময় এগিয়ে যাই, কিন্তু তারা অস্তিত্বহীন হিসেবে নিঃসঙ্গতার সাগরেই পড়ে থাকেন। আমাদের আগ্রসরমান জগতে চাইলেও তাদের ঠিক জায়গা হয়না। আমার এত খারাপ লাগে ব্যাপারটা…
মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন জীবনের গল্প ।
@মামুণ, আমার গল্পের বিষয়বস্তু ঠিক মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন জীবন নয়, ক্রমবর্ধমান নিঃসঙ্গতা। ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। 🙂
খাইছে তুমি দেহি গল্প লেহাও শুরু করছ! গুড গুড। চালাইয়া যাও। আরো বড় করতে পারতা। প্রথম লেখা গল্প নাকি এইটা তোমার? তাইলে কিন্তু ভালো হইছে অনেক। 🙂
@সাইফুল ইসলাম, এইটা মুক্তমনায় লেখা আমার ৪র্থ গল্প। আমি শুরুই করছিলাম গল্প দিয়ে। ধন্যবাদ অণুপ্রেরণার জন্য :))
জীবন থেকে নেওয়া 🙂
@রায়হান আবীর, 😉
ফুলে ফুলে – পড়ে চোখ থেমে গিয়েছিল।
আমি-র উপস্থিতি বোধগম্য হলো না।
– পড়ে আমার চোখের পাতা ভারি হয়ে উঠেছিল। তারপর, আর কিছু কি থাকে, বলার?
পাঠক হিসাবে বলবো, হয়তো আমার বলাটা ভুল, তারপরও প্রতিক্রিয়া হয়, তাই ।
ধন্যবাদ।
@স্বপন মাঝি,
এই পুরো প্যারাটা মায়ের ভাবনা হিসেবে দেয়া হয়েছে বলেই এখানে মায়ের নাম না এসে “আমি” হিসেবে মা এসেছে।
“ফুলে ফুলে কাঁদা” কথাটা বেশ প্রচলিত।
শেষ পার্টটুকু বুঝলামনা। কি বলাটাকে ভুল বলছেন আপনি? আপনি কি বলতে চাইছেন যে এর পরের অংশটুকু বাহুল্য হিসেবে এসেছে? নির্দ্বিধায় যেকোন মত বলতে পারেন।
ধন্যবাদ এত মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য। আমি সত্যি খুশি হয়েছি 🙂
@লীনা রহমান,
আপনার গল্প বা কথনে যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে –
১ অগ্রসর এবং পশ্চাৎপদ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বন্দ্ব
২ সেই দ্বন্দ্বের ভেতর কীভাবে ক্রিয়া করছে অর্থ ( যে কোন মতবাদের কথা বলতে গিয়ে আমরা তার অর্থনৈতিক সম্পর্কের কথা ভুলে যাই অথবা চেপে যাই)তার ছবি।
৩ মানবিক বোধের অভ্যুদয়।
গল্পের শরীরে ঠিক এই মানবিক বোধের অভ্যুদয় ঘটানোটা ( যা আরোপিত মনে হয় নি) আপনি নির্মাণ করেন নি, এটি সহজাতভাবে এসে গেছে। কিন্তু
মনে হয়েছিল লেখকের কথা, গল্পের নয়।
আমার ধারণা ভুল হতে পারে জেনেও বললাম, অভয় দিয়েছেন, তাই।
@স্বপন মাঝি, হ্যা, এটা আমারই কথা। আই মিন লেখকের কথা। 🙂
আর আমি একেকটা গল্পে আমার মত করে লেখকের স্বাধীনতা ব্যবহার করি। শেষ কথাটা আমার নিজের মন থেকে উঠে আসা, কারণ গল্পটা অনেকটা আমার জীবন থেকে নেয়া। এখানে আমি এসে পড়ছিলাম এবং আমি আমার আসাটাকে আটকাতেও চাইনি। 🙂
ভালো লাগলো। (Y) ।
@বন্যা আহমেদ, ধন্যবাদ আপু পড়ার জন্য 🙂
(Y) (F) (D) 🙂
@নিলীম আহসান, ধন্যবাদ আপু। 🙂
মা মেয়ের গল্প বেশ ভালো লাগলো, বাস্তবতার ছোঁয়া আছে। গৃহিণী মা’দের জীবনে আছে ভয়াবহ এক শুন্যতা। আমার মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তার জীবনের স্বপ্ন কি চায়? কি পেলে তার জীবন সফল মনে হবে? অনেক্ষন ভেবে চিন্তে কিছুই মনে হয় খুঁজে পেলনা, শেষ মেষ বলল, তোরা মানুষ হলেই আমি সফল। আমি বললাম, তা তো বুঝলাম, কিন্তু একান্তই তোমার কোন চাওয়া পাওয়া নেই? খুব শুন্য একটা দৃষ্টি দিয়ে বলল, আমার আবার কি স্বপ্ন! খুব খুব হতাশ লাগলো মা’কে। দিনের পর দিন একই ভাবে কেটে যায় এই মা’দের জীবন। সেই ঘর দোর গোছ গাছ, রান্না বান্না করেই কেটে যায় সারা জীবন। কোন উত্তেজনা নেই, কোন পরিবর্তন নেই সে জীবনে। 🙁
@রিজওয়ান, আমি প্রতি মুহূর্তে আম্মুর একাকীত্ব দেখতে পাই, কিন্তু কোনভাবেই মিশতে পারিনা তার সাথে। আমাদের মানসিকতায় এত দূরত্ব যে দুজনেই দূর থেকে একজন আরেকজনকে ভালবাসি কিন্তু এখন আর আগের মত প্রকাশ করতে পারিনা। গল্পটা অনেকটাই বাস্তব।