১.

খুব বলশালী ও পালোয়ান এক লোক বনে যায় গাছ কাটতে। বিপুল বিক্রমে চলতে থাকে পালোয়ানের কর্তন ক্রিয়া। কুঠারের ঠোকরে যাতনাবিষ্ট বনভূমিতে ভেসে বেড়ায় কাঠোরির কঠিন সুর। যন্ত্রজালে আপাদমস্তক বন্দী হয়ে পড়ে গাছগুলো। । হঠাৎ চিৎকার করে উঠে একটি গর্জন গাছ, ‘’আমাকে আর কুঠ্রাঘাত করো না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।‘’

গাছকে কথা বলতে দেখে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে বিশালকায়া কাঠুরিয়া। ওদিকে আহত গর্জনের আর্ত চিৎকারে বনের আকাশ-বাতাস তখন ভারাক্রান্ত কৃষ্ণগহবর।

২.

বনভূমিতে ঘুরঘুর করছিল সদা রোমাঞ্চপ্রিয় এক অনুসন্ধানী। তার চোখ প্রকৃতির প্রেম-সুধায় জর্জরিত। অরণ্যের সঙ্গে নিবিড় বন্ধনের কারণে, সে এমনকি গাছের শ্বাস-প্রশ্বাসও টের পায়। তাই আহত গাছটির করুন নিনাদ মুহূর্তের মধ্যেই পৌঁছে যায় তার কানে। সরেজমিন দেখতে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় প্রকৃতিপ্রেমী। কিছুদূর এগোতেই কাঁঠালের মত পড়ে থাকতে দেখে কাঠুরিয়াকে। কিন্তু ভূমিসাৎ কাঠুরিয়ার জন্য কোন দয়া উদ্রেক হয় না প্রকৃতিপ্রেমীর মনে।

চোখে এক রাশ ঘৃণার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সে অবশেষে ছুটে যায় কোপের মুখে পড়া নিপীড়িত গাছটির দিকে। গাছটির দুঃখ দেখে বুক ফেটে যায় প্রকৃতিপ্রেমীর। গায়ে হাত বুলাতেই দ্বিতীয়বারের মত কথা কয়ে উঠে গাছটি, “আমাকে আবার মারতে এসেছো? দোহাই তোমার, ছেড়ে দাও আমাকে!‘’

প্রকৃতিপ্রেমী এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিয়ে বলে, ‘’ওহ!, দুঃখিত! দুঃখিত! আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি তোমাকে মারতে আসিনি। বরং তোমাকে উদ্ধার করতে এসেছিলাম।‘’ গাছ বলে, ‘’ও, তাই বল! আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি ঐ কেঠো মিনসেটাই। কিন্তু ভাই, তুমি আমাকে কেন উদ্ধার করতে এলে? আমাকে বাঁচিয়ে তোমার লাভ কি?’’

প্রকৃতিপ্রেমী বলে, ‘’লাভালাভির কিছু নেই। তোমার কান্নার শব্দ আমার হৃদয়কে বিদীর্ণ করেছে। তাই ছুটে এসেছি তোমাকে বাঁচাতে’’। গাছ বলে, ‘’আমি অনেকগুলো বছর কাটিয়ে দিয়েছি বনে বাদাড়ে। কিন্তু বিশ্বাস কর, আজ পর্যন্ত কেউ আসেনি বাঁচাতে। ভাগ্যিস তুমি ছিলে আজ এই বনে। নইলে কত গাছের যে শরীর কাটা পড়ত। গাছের রক্তে রঞ্জিত হয়ে যেত আজ পুরো বন পথ। সত্যি, কি দৈবভাগ্য আমাদের! আজ তুমি কাছে না থাকলে..’’

আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল গর্জন; কিন্তু প্রকৃতিপ্রেমী থামিয়ে দেয় তাকে, ‘’অন্তত আমি থাকতে আর কেউ তোমাদের গায়ে হাত তোলার সাহস পাবে না। আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পার।‘’

এরপরই প্রকৃতিপ্রেমী গাছটির গায়ে হাত রাখে। আলতোভাবে গাছের পিঠ বুলিয়ে দিতে থাকে। আবেগের আতিশয্যে একসময় জড়িয়ে ধরে গাছের নিম্নদেশ। এরপর বেয়ে বেয়ে উঠতে থাকে উপরের দিকে। এবং এক সময় মগডালে উঠে বসে থাকে। কিছুদিন পর প্রকৃতিপ্রেমী অস্থায়ী এক বন-বাসা বাঁধে সেখানে।

৩.

বেশ কিছুদিন হল, বনভ্রমন শেষে প্রকৃতিপ্রেমী ফিরে এসেছে নগরে। ধূলি-ধোঁয়ার আটপৌরে ভিড়ে প্রকৃতিপ্রেমীর তৃষ্ণা মেটায় এখন তার পোষা গাছগুলো।

ছোটবেলা থেকেই গাছ পোষার সখ প্রকৃতিপ্রেমীর; ছোট্র বাড়িটিতে প্রায় শদুয়েক টব রয়েছে। পোষা গাছগুলোর যত্ন-আত্তির কোন ত্রুটি করে না সে। প্রকৃতিপ্রেমীর আদর-সোহাগে গাছগুলোও বেশ ভুলে থাকে দেশের কথা, বনভূমির কথা। মনিবের হুকুম তামিল করে যথাসময়ে ফুলও ফোটায়। পলিমাখা পাপড়ির গন্ধে প্রকৃতিপ্রেমীর মন হয় উতলা। মনের আনন্দে সে বোঁটাসুদ্ধ ফুল তুলে নেয় হাতে। পাপড়ির তুলতুলে নরম পালকে নাক-মুখ গুঁজে দিয়ে পরমানন্দে বুঁদ হয়ে থাকে প্রকৃতিপ্রেমী।

৪.

প্রতিদিনের মত সেদিনও প্রকৃতিপ্রেমী তার বাসার গাছগুলোকে জলখাবার সরবাররহ করছিল। এক সময় সে তার টবে মোড়া ঘর-বাগান থেকে কিছু পুষ্প খসিয়ে নিতে উদ্যত হয়। কিন্তু অনেকটা আচমকাই কথা কয়ে উঠে একখানি ফুলবতী বেলি, ‘’তোমার পায়ে পড়ি, মনিব। আর ছিনিয়ে নিয়ো না আমাদের জীবন। ছেড়ে দাও! মুক্তি দাও আমাদের!’’

গাছের কথা সম্পূর্ণ অচেনা আর অশরীরী ঠেকে প্রকৃতিপ্রেমীর কাছে। পৃথিবীটা অর্থহীন মনে হয় তার কাছে। ভালবাসা হারানোর ভয়ে হতবিহবল হয়ে পড়ে সে। বিচ্ছেদের সম্ভাবনায় নেতিয়ে পড়ে দেহ-মন। তীব্র চিৎকার করে এক সময় জ্ঞান হারায় সে।

এরপর থেকে সেই প্রকৃতিপ্রেমী অপ্রকৃতিস্থ।