আমি পূর্ববর্তী অধ্যায়ের লিংক দিয়েছিলাম; কিন্তু লিংক কাজ করে না। এ ব্যাপারে মুক্তমনা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
আবুল কাশেম
নানা কারণে এই ধারাবাহিক রচনাটি কিছুদিনের জন্য স্থগিত ছিল। বাকী অংশ এখন নিয়মিত প্রকাশের আশা রাখছি।
[রচনাটি এম, এ, খানের ইংরেজি বই থেকে অনুবাদিত “জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও ক্রীতদাসত্বের উত্তরাধিকার” গ্রন্থের ‘ইসলামি ক্রীতদাসত্ব’ অধ্যায়ের অংশ এবং লেখক ও ব-দ্বীপ প্রকাশনের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত হলো।]
ইসলামি ক্রীতদাসত্ব, খণ্ড ১৬
লেখক: এম, এ, খান
ইউরোপীয় ক্রীতদাস
ইউরোপ থেকে মুসলিম বিশ্বে আগত ক্রীতদাসদের সম্বন্ধে লুইস লিখেছেন:
ইউরোপেও গুরুত্বপূর্ণ দাস-বাণিজ্য ছিল, যাদের মধ্যে ছিল মুসলিম, ইহুদি, পৌত্তলিক, এমনকি গোঁড়া খ্রিষ্টান ক্রীতদাস। সাধারণত ‘সাকালিবা’ (অর্থাৎ ক্রীতদাস) নামে পরিচিত মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় ক্রীতদাসদেরকে আমদানি করা হতো প্রধান তিনটি পথ দিয়ে: স্থলপথে ফ্রান্স ও স্পেনের ভিতর দিয়ে, ক্রিমিয়া হয়ে পূর্ব-ইউরোপ থেকে এবং সমুদ্রপথে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে। তারা সবাই নয় কিন্তু অধিকাংশই ছিল স্লাভ ক্রীতদাস। তাদের কিছু সংখ্যককে মুসলিম নৌদস্যুরা ইউরোপীয় উপকূলে, বিশেষত ডালমাশিয়ান অঞ্চলে হানা দিয়ে ধরে আনতো। অধিকাংশই সরবরাহ হতো ইউরোপীয়, বিশেষত ভেনিসের বণিকদের দ্বারা, যারা স্পেন ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম বাজারগুলোতে তাদের বহর পাঠাতো।
ইউরোপীয় ক্রীতদাসদের বিশেষ চাহিদা ছিল যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহারের জন্য, রাজকীয় সেনাবাহিনী ও প্রাসাদসমূহে কাজ করার জন্য, এবং মরক্কো, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া ও লিবিয়ার ধনীদের বাড়িঘর ও প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য। জাইলস্ মিল্টনের ‘হোয়াইট গোল্ড’ ও রবার্ট ডেভিসের ‘ক্রিশ্চিয়ান শ্লেইভস্, মুসলিম মাস্টার্স’ গ্রন্থদ্বয় অনুযায়ী, ১৫৩০ সাল থেকে দীর্ঘ তিন শতাব্দব্যাপী উত্তর আফ্রিকার মুসলিম জলদস্যুরা সিসিলি থেকে কর্নওয়াল পর্যন্ত ইউরোপীয় উপকূলের বিভিন্ন শহর ও গ্রাম এবং ইউরোপীয় জাহাজগুলোতে হানা দিতে থাকে এবং ১৫ লাখেরও বেশি ইউরোপীয়কে ক্রীতদাস করে (যার মধ্যে ছিল আমেরিকার নাবিকও)। এ ক্রীতদাসকরণ সম্পর্কে মানবতাবাদী ব্রিটিশ লেখক ক্রীস্টোফার হিচেন্স আক্ষেপমূলক জিজ্ঞাসার সুরে লিখেছেন: ‘কজন জানে যে, ১৫৩০ থেকে ১৭৮০ সালের মধ্যে ইসলামি উত্তর আফ্রিকায় সম্ভবত দেড় মিলিয়ন (১৫ লাখ) ইউরোপীয় ও আমেরিকানকে ক্রীতদাস করা হয়েছিল; আয়ার্ল্যান্ডের বাল্টিমোর শহরের লোকেদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল? এক রাত্রিতে মুসলিম জলদুস্যুরা হানা দিয়ে সবাইকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।’[১৯৮]
বার্বার মুসলিম জলদস্যুরা উত্তর আফ্রিকার উপকূলীয় জলপথ দিয়ে যাওয়া বাণিজ্য-জাহাজে হানা দিয়ে ইউরোপীয়দেরকে অপহরণ করতো। তারা আটলান্টিকের ইউরোপীয় উপকূলীয় মৎস্যজীবী গ্রাম ও শহরগুলোতে গিয়ে হানা দিয়ে ব্যাপক লুটতরাজ করে ও বাসিন্দাদেরকে বন্দি করে নিয়ে আসতো। ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল ও ফ্রান্সের উপকূলীয় গ্রাম ও শহরগুলো তাদের আঘাতে সবচেয়ে বেশী জর্জরিত হয়। মুসলিম ক্রীতদাস শিকারি হানাদাররা এমনকি আরো দূরবর্তী ব্রিটেন, আয়ারাল্যান্ড ও আইসল্যান্ডেও হানা দিয়ে গ্রাম ও শহরের বাসিন্দাদের অপহরণ করতো।
জিহাদি মুসলিম হানাদাররা ১৫৪৪ খ্রিষ্টাব্দে নেপলসের অদূরবর্তী ভূমধ্যসাগরীয় ইশ্চিয়া দ্বীপে হানা দিয়ে লুটপাট করার পর ৪,০০০ বাসিন্দাকে আটক করে নিয়ে যায় এবং সিসিলির উত্তর উপকূলের অদূরে লিপারি দ্বীপের ৯,০০০ বাসিন্দাকে ক্রীতদাস করে।[১৯৯] ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তুরগুত রাইস নামের এক তুর্কি জলদস্যুপ্রধান গ্রানাডার (স্পেন) উপকূলীয় বসতিগুলোতে হানা দিয়ে লুণ্ঠন করার পর ৪,০০০ বাসিন্দাকে ক্রীতদাস হিসেবে ধরে নিয়ে যায়। ১৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে বার্বার জলদস্যুরা ব্রিস্টল চ্যানেলের লান্ড দ্বীপ দখল করে সেখানে ইসলামের ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে। এ ঘাঁটি থেকে তারা আশেপাশের গ্রাম ও শহরগুলোতে হামলা করে লুটপাট ও দাঙ্গাহাঙ্গামার মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড ও লুটতরাজের এক ভয়ঙ্কর দৃশ্যের অবতারণা করে। মিল্টন জানান: দিনের পর দিন তারা নিরীহ-নিরস্ত্র জেলেদের বসতবাটির উপর হানা দিয়ে বাসিন্দাদেরকে বন্দি ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। ১৬২৫ সালের সে ভয়ঙ্কর গ্রীষ্মের শেষে প্লাইমাউথের মেয়র হিসাব করে জানান: ‘তারা ১,০০০ মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস করে এবং সহস্রাধিক গ্রামবাসীকে ক্রীতদাসরূপে বিক্রির জন্য ধরে নিয়ে যায়।’[২০০] ১৬০৯ থেকে ১৬১৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বার্বার জলদস্যুরা ‘প্রায় ৪৬৬টি ইংরেজ বাণিজ্য-জাহাজ আটক করে।’
ইসলামে ধর্মান্তরিত জনৈক ইউরোপীয় মুরাদ রাইস পরবর্তীকালে মরক্কোর অদূরে উপকূলীয় জলদস্যু বন্দর-শহর সালে’র বার্বার জলদস্যুদের নেতা হয়েছিল। ১৬২৭ সালে সে এক লুটতরাজ ও ক্রীতদাসকরণ অভিযানে আইসল্যান্ডে যায়। রিকইয়াভিকে নোঙ্গর ফেলে তার বাহিনী শহরটিকে তছনছ করে এবং ৪০০ পুরুষ, নারী ও শিশুকে ধরে নিয়ে এসে আলজিয়ার্সে বিক্রি করে দেয়। ১৬৩৭ সালে ২০০ সদস্যের এক রাহাজান জলদস্যুর দল নিয়ে সে আয়ারল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে নৌ-অভিযান চালায় এবং বাল্টিমোর গ্রামের বাড়িঘর তছনছ ও লুটপাট করে এবং ২৩৭ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে ধরে নিয়ে যায় আলজিয়ার্সে।[২০১]
মুসলিম জলদস্যুদের বর্বর ক্রীতদাস শিকারমূলক অভিযান ইউরোপকে মারাত্মকভাবে জর্জরিত করেছিল। ফ্রান্স, স্পেন ও ইংল্যান্ডকে তাদের হাজার হাজার জাহাজ হারাতে হয়েছিল জলদস্যুদের সেসব হামলায়, যা তাদের সামুদ্রিক বাণিজ্যকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিল। উনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত স্পেন ও ইতালির দীর্ঘ উপকূল প্রায় সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত থাকে এবং সেখানকার মৎস্য শিল্প দৃশ্যত ধ্বংস হয়ে যায়।
পল বায়েপলার্স তার ‘হোয়াইট শ্লেইভস, আফ্রিকান মাস্টার্স: অ্যান অ্যান্থোলজি অব আমেরিকান বার্বারি ক্যাপটিভিটি ন্যারেটিভস’ গ্রন্থে উত্তর আফ্রিকায় ধৃত ৯ জন আমেরিকান বন্দির লেখা কতকগুলো নিবন্ধ একত্রিত করেছেন। সে গ্রন্থ অনুসারে, ১৬২০ সালে কেবলমাত্র আলজিয়ার্সেই ২০,০০০-এরও বেশি খ্রিষ্টান শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস ছিল। ১৬৩০ সালে এ সংখ্যা স্ফীত হয়ে ৩০,০০০ পুরুষ ও ২,০০০ নারীতে গিয়ে ঠেকে। আহমেদ এজ্জায়ানি লিখেছেন: ‘সুলতান মৌলে ইসমাইলের প্রাসাদে যে কোনো সময়ে কমপক্ষে ২৫,০০০ শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস থাকতো।’ ১৫৫০ থেকে ১৭৩০ সালের মধ্যে আলজিয়ার্সে ২৫,০০০ শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস সর্বদাই থেকেছে। কোনো কোনো বিশেষ সময়ে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যেতো। একই সময়কালে তিউনিস ও ত্রিপোলিতে কমপক্ষে ৭,৫০০ জন করে শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস থাকতো। বার্বারি জলদস্যুরা দীর্ঘ তিন শতাব্দেরও বেশি সময় ধরে প্রতি বছর গড়ে ৫,০০০ করে ইউরোপীয়কে ক্রীতদাস করেছিল।[২০২]
বার্বারি মুসলিম আফ্রিকায় সবচেয়ে বিখ্যাত যে ইউরোপীয় খ্রিষ্টান ক্রীতদাস হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন বিখ্যাত মহাকাব্য ‘ডন কুইকজোট’-এর লেখক মিগুয়েল ডি সারভান্ডিস। বার্বারি জলদস্যুদের দ্বারা ১৫৭৫ সালে তিনি বন্দি হন এবং পরে মুক্তিপণ দিয়ে তাকে মুক্ত করা হয়। ১৩৫০ সালের দিকে অটোমানদের ইউরোপে অনুপ্রবেশ এবং পরবর্তীতে ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল অধিকার করায় ইউরোপীয় সীমান্ত থেকে অবারিত ক্রীতদাস সরবরাহের দুয়ার খুলে যায়। ১৬৮৩ সালে অটোমান বাহিনীর ইউরোপ বিজয়ের সর্বশেষ প্রয়াস ব্যর্থ হলেও, ভিয়েনা গেট থেকে ফেরার পথে তারা ৮০,০০০ শেতাঙ্গকে বন্দি করে নিয়ে আসে।[২০৩] ক্রিমিয়া, বলকান অঞ্চল ও পশ্চিম এশিয়ার সমভূমি অঞ্চল থেকে বিপুলসংখ্যক ক্রীতদাস ইসলামি বিশ্বের বাজারগুলোতে ঢুকে পড়ে। বি. ডি. ডেভিস দুঃখ করে বলেন: ‘তাতার ও কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের অন্যান্য লোকেরা (মুসলিম) লাখ লাখ ইউক্রেনীয়, জর্জিয়, সার্কাসিয়ান, আর্মেনীয়, বুলগেরীয়, স্লাভ ও তুর্কিদেরকে ধরে এনে বিক্রি করে দিয়েছিল, যা কারো নজরেই পড়েনি।’[২০৪]
১৪৬৮ ও ১৬৯৪ সালের মধ্যে ক্রিমিয়ার তাতাররা ১,৭৫০,০০০ ইউক্রেনীয়, পোল ও রুশকে ক্রীতদাস হিসেবে শিকার করে এনে বিক্রয় করে দেয়।[২০৫] আরেক হিসাব অনুযায়ী, ১৪৫০ ও ১৭০০ সালের মধ্যে ক্রিমিয়ার তাতাররা কিছু সার্কাসিয়ানসহ প্রতি বছর ১০,০০০ করে ক্রীতদাস ধরে এনে (অর্থাৎ সর্বমোট প্রায় পঁচিশ লাখ) অটোম্যান সাম্রাজ্যে রপ্তানি করে।[২০৬] ক্রীতদাস শিকারি তাতার খানরা ১৪৬৩ সালে পোল্যান্ড থেকে ১৮,০০০, ১৪৯৮ সালে লভোভ থেকে ১০০,০০০, ১৫১৫ সালে দক্ষিণ রাশিয়া থেকে ৬০,০০০, ১৫১৬ সালে গ্যালিসিয়া থেকে ৫০,০০০ থেকে ১০০,০০০, ১৫২১ সালে মস্কো থেকে ৮০০,০০০, ১৫৫৫ সালে দক্ষিণ রাশিয়া থেকে ২০০,০০০, ১৫৭১ সালে মস্কো থেকে ১০০,০০০, ১৬১২ সালে পোল্যান্ড থেকে ১০০,০০০, ১৬৫৪ সালে ইউক্রেন থেকে ৩০০,০০০, ১৬৭৬ সালে ভ্যালিনিয়া থেকে ৪০০,০০০ এবং ১৬৯৪ সালে পোল্যান্ড থেকে হাজার হাজার ক্রীতদাস নিয়ে ফিরে যায়। এসব বড় বড় শিকার-অভিযান ছাড়াও, তারা একই সময়ে আরো বহু জিহাদ-অভিযান পরিচালনা করে হাজার হাজার ক্রীতদাস বানায়।[২০৭] তাতারদের দ্বারা ক্রীতদাসকরণের সংখ্যাটি এ প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে যে, সে সময় তাতারস্থানের মোট জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৪০০,০০০-এর মতো।[২০৮]
[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ ভাইকিং দাস-ব্যবসা ও মুসলিম সম্পৃক্ততা]
সূত্রঃ
198. Hitchens C (2007) Jefferson Versus the Muslim Pirates, City Journal, Spring Issue
199. Povoledo E (2003) The Mysteries and Majesties of the Aeolian Islands, International Herald Tribune, 26 September.
200. Milton, p. 11
201. Milton, p. 13-14; Lewis B (1993) Islam and the West, Oxford University Press, New York, p. 74
202. Milton, p. 99, 217-72
203. Erdem YH (1996) Slavery in the Ottoman Empire and Its Demise, 1800-1909, Macmillan, London, p. 30
204. Lal (1994), p. 132
205. Fisher AW (1972) Muscovy and the Black Sea Slave Trade, in Canadian-America Slavic Studies, 6(4), p. 577-83, 592-93
206. Inalcik H (1997) An Economic and Social History of the Ottoman Empire, 1300-1600, Cambridge University Press, Vol. I, p. 285; Fisher, p. 583-84
207. Bostom, p. 679-81
208. Williams BG (2001) The Crimean Tatars: The Diaspora Experience and the Forging of a Nation, E J Brill, Lieden, p. 69-72
————–
ইসলামি ক্রীতদাসত্ব, খণ্ড ১৭
লেখক: এম, এ, খান
ভাইকিং দাস-ব্যবসা ও মুসলিম সম্পৃক্ততা
ইসলামের জন্মের পর সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে মুসলিম আক্রমণকারী ও শাসকরা অগণিত সংখ্যক বিধর্মীকে ক্রীতদাসকরণের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে দাস-বাণিজ্যকে একটা বৃহৎ ব্যবসায়িক উদ্যোগে পরিণত করে। অষ্টম শতাব্দীর শেষ দিকে ইউরোপে ‘ভাইকিং’ নামে একদল অমুসলিম দাস-শিকারির উত্থান ঘটে। ভাইকিংরা ছিল উত্তর ইউরোপীয় স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলো (সুইডেন, ডেনমার্ক) থেকে উদ্ভব হওয়া, যারা অষ্টম ও একাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে নিষ্ঠুর হানাদার রাহাজানে পরিণত হয়। তথাকথিত ‘বর্বর’ জার্মান জাতির এসব লোক ব্রিটিশ দ্বীপ ও ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের উপকূল ও রাশিয়ার ভলগা নদী বরাবর দূরপ্রাচ্যে হামলা ও জলদস্যুবৃত্তিতে লিপ্ত হয়। লম্বা জাহাজের জন্য খ্যাত ভাইকিংরা দীর্ঘ তিন শতাব্দীরও বেশি সময় ইউরোপের মূল ভূখন্ড, আয়ারল্যান্ড, নরম্যান্ডি, শেটল্যান্ড, ওরকনি এবং ফারো দ্বীপপুঞ্জ, আইসল্যান্ড, গ্রীনল্যান্ড ও নিউফাইল্যান্ডের উপকূল ও নদীর তীর বরাবর বসতি স্থাপন করে। তারা দক্ষিণে উত্তর আফ্রিকায় এবং পূর্বে রাশিয়া ও কনস্টান্টিনোপলে পৌঁছে যায় লুণ্ঠনকারী, ব্যবসায়ী কিংবা ভাড়াটিয়া বাহিনীরূপে। এরিক দ্য রেড-এর উত্তরসূরী লেফ এরিকসন-এর অধীনে ভাইকিংরা ১০ম শতাব্দীতে উত্তর আমেরিকায় অভিযান চালিয়ে বর্তমান কানাডায় পর্যন্ত পৌঁছে যায়। দশম ও একাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোতে খ্রিষ্টান ধর্মের প্রবর্তন হওয়ার সাথে ভাইকিং হামলা হ্রাস পায়।[২০৯] ৭৯৩ ও ১০৬৬ সালের মধ্যবর্তীকালীন ভাইকিংদের উত্থানের ও কর্তৃত্বের সময়কাল সাধারণত ‘ভাইকিং যুগ’ নামে পরিচিত।
ইউরোপের উপকূল বরাবর বসবাসকারী নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় পরিবার ও সম্প্রদায়ের উপর বর্বর হামলার মাধ্যমে বয়স্কদেরকে হত্যা এবং নারী ও শিশুদেরকে বন্দি করে ক্রীতদাসরূপে বিক্রির পেশায় লিপ্ত হওয়ার কারণে ভাইকিংরা চরমভাবে নিন্দিত হয়েছে। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, ভাইকিংদের উত্থান ও বিস্তারের প্রধান কারণ ছিল অতিরিক্ত জনসংখ্যা, প্রযুক্তিগত আবিষ্কার ও জলবায়ুর পরিবর্তন এবং সে সঙ্গে ৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট শার্লামেন কতৃক ফ্রিজিয়ান জাহাজবহর ধ্বংসের পর বাণিজ্যিক ধারাবাহিকতা ও মধ্য-ইউরোপ থেকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় পণ্য প্রবাহ ভঙ্গ।
কিন্তু ভাইকিংদেরকে ক্রীতদাস-বাণিজ্যে জড়িতকরণে ইসলাম যে ইন্ধন যুগিয়েছিল সে বিষয়টি ঐতিহাসিকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে খুবই কম। ৭৩২ খ্রিষ্টাব্দে টুরের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ে ইউরোপীয় সীমান্তে ইসলামিক বিজয় থেমে যায়। এমনকি তাদেরকে ইতিমধ্যে দখলকৃত কিছু ভূখণ্ড ছেড়ে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। অতঃপর মুসলিম বিশ্বের হেরেমগুলোতে উপপত্নীরূপে অতি চাহিদার ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ নারীদের ক্রীতদাসকরণ ব্যাপকহারে হ্রাস পায়।
যুদ্ধ ও হামলার মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গ যৌনদাসী কব্জা করার প্রক্রিয়ায় এভাবে ভাটা পড়লে মুসলিম বিশ্বে তাদের বিরামহীন ও মোহাবিষ্ট চাহিদা পূরণের বিকল্পরূপে ক্রীতদাস হিসেবে তাদেরকে কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ভয়ঙ্কর উম্মত্ত ভাইকিং দস্যুদের উত্থানকালে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার পশম ব্যবসায়ীরা রাশিয়ার বুলগার ভলগায় অবস্থিত ইউরোপ-আরব বাণিজ্যকন্দ্রে পৌঁছে যায়। এখানে মুসলিম বিশ্বের ব্যবসায়ীদের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয় এবং তারা ইসলামি হেরেমগুলোতে শ্বেতাঙ্গ নারীদের প্রচুর চাহিদার কথা জানতে পারে। অতঃপর হিংস্র ও বর্বর ভাইকিংরা মুসলিম বণিকদের কাছে বিক্রির জন্য শ্বেতাঙ্গ সুন্দরী যুবতীদেরকে শিকার করে আনার পেশায় লিপ্ত হয়। এতে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে পূর্ব-ইউরোপের ক্রীতদাস বাণিজ্যের পথ খুলে যায়। খুব শীঘ্রই স্পেন হয়েও শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস সরবরাহের পথ উন্মুক্ত হয়। উত্তর ইউরোপে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রসারের সাথে ভাইকিং দাস-বাণিজ্য ক্রমশ স্তিমিত হতে হতে বন্ধ হয়ে যায়।
ভাইকিং দাস-বাণিজ্য সর্বোতোভাবে নিন্দিত হয়েছে। কিন্তু ভাইকিংদেরকে এ ঘৃণিত পেশায় লিপ্তকরণে ইসলাম যে বড় ইন্ধন যুগিয়েছিল সে ব্যাপারে আদৌ কিছুই বলা হয় না। ভাইকিংরা যে জঘন্য অপরাধগুলো করেছিল, তা ক্ষমাহীন। তবে ভাইকিংদের ক্রীতদাসী-বাণিজ্যে লিপ্ত হওয়ার অপরাধ থেকে ইসলামকে পৃথক করাও অসম্ভব, কেননা ভাইকিংরা প্রধানত শ্বেতাঙ্গ নারীদেরকে হরণ করতো পুরোপুরিই মুসলিম বিশ্বের অবিরাম চাহিদা পূরণে সরবরাহ করতে।
‘ভাইকিং যুগ’ শেষ হলেও ইসলামি বিশ্বে শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস সরবরাহ শেষ হয়ে যায়নি। ভাইকিং দাস-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার পর মুসলিম ক্রীতদাস শিকারিরাই ভাইকিংদের স্থান দখল করে এবং মুসলিম বিশ্বের চাহিদা পূরণে ইউরোপে ধীরে ধীরে শ্বেতাঙ্গ নারী আটকের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ১৩৫৩ খ্রিষ্টাব্দে অটোমান তুর্কিরা কনস্টান্টিনোপলকে পাশ কাটিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করে এবং বুলগেরিয়া ও সার্বিয়া দখল করার মাধ্যমে নতুন জিহাদী অভিযান শুরু করে। এ ঘটনায় স্বয়ং মুসলিমদের দ্বারা ব্যাপক সংখ্যায় শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস ধরার প্রক্রিয়া নতুন করে সূচিত হয়। ১৪৩০ সালে তুর্কিরা গ্রিসের থেসালোনিকো আক্রমণ করে ৭,০০০ শ্বেতাঙ্গকে ক্রীতদাস করে; অপরদিকে ১৪৯৯ খ্রিষ্টাব্দে অটোমান সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ গ্রিসের মিথোনে হানা দিয়ে লুণ্ঠন করে এবং নগরীর দশ বছরের উর্ধবয়সী সকল পুরুষকে হত্যা করে নারী ও শিশুকে বন্দি করে আনে।[২১০] পারস্যের শাসক শাহ তাহমাস্প (মৃত্যু ১৫৭৬) ১৫৫৩ সালে জর্জিয়া আক্রমণ করে ৩০,০০০-এর বেশি নারী-শিশুকে ক্রীতদাস করে। জর্জিয়ায় তার ১৫৫১ সালের অভিযানে গাজীরা পুরুষদেরকে হত্যা করে তাদের স্ত্রী-সন্তানদেরকে বন্দি করে। জর্জিয়ার বিরুদ্ধে সুলতান ১৫৪০ ও ১৫৪৬ সালে আরো দু’টো সফল অভিযান পরিচালনা করেন। এ দুই অভিযানে কত লোককে ক্রীতদাস করা হয়েছিল তা লেখা হয়নি।[২১১] সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিক পর্যন্ত অটোমান ও পারস্যের সাফাভিদরা ইউরোপীয় ভূখণ্ডে বহু হামলা চালায়। ১৬৮৩ সালে ভিয়েনা অবরোধকালে পরাজয় ও ব্যাপক ক্ষতি স্বীকার সত্ত্বেও অটোমান তুর্কিরা ৮০,০০০ বন্দিকে ধরে নিয়ে আসে। এটা পরিষ্কার যে, তাদের সব অভিযানেই বিপুল সংখ্যায় ক্রীতদাস আটক করা হতো।
ইতিমধ্যে তাতার খানরা পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পূর্ব-ইউরোপ ও রাশিয়ায় অসংখ্য ধর্মযুদ্ধের অভিযান (রাজিয়া) পরিচালনা করে। সেসব অভিযানে তারা হাজার হাজার, এমনকি লাখ লাখ, শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস আটক করে নিয়ে আসে, যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। উত্তর আফ্রিকার বার্বার জলদস্যুরা ১৫৩০ ও ১৭৮০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ইউরোপীয় উপকূলীয় নগরী সিসিলি থেকে কর্নওয়াল পর্যন্ত ও সমুদ্রপথের জাহাজে অব্যাহতভাবে হানা দিয়ে শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস আটকের মাধ্যমে দশ লাখ শ্বেতাঙ্গ পুরুষ-নারীকে ক্রীতদাস বানায়। ১৮২০ সাল পর্যন্ত বার্বার জলদস্যুরা শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস শিকার অব্যাহত রাখে।
[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ ইউরোপীয় দাস-ব্যবসায় ইসলামি সহায়তা]
সূত্রঃ
সূত্রঃ
209. Viking, Wikipedia, http://en.wikipedia.org/wiki/Vikings
210. Bostom, p. 613, 619
211. Ibid, p. 620-21
————–
চলবে—
খুব কাজ দিচ্ছে আপনার ধারাবাহিকটি। চলতে থাকুক…ধন্যবাদ আপনাকে।
ওফ, আমি যদিও পড়ি প্রত্যেকটা লেখাই কিন্তু প্রতিবারই গা আতকে ওঠে। আর সেই দাস ব্যবসা এখনো শেষ হয়নি। এখন মাফিয়ারা ইউরোপ থেকে সুন্দরী মেয়েদের ধরে নিয়ে আরব-মধ্যপ্রাচ্যে বিক্রি করে, এই ব্যবসা এখনো জমজমাট।
@অগ্নি,
কোরান যতদিন থাকবে–ইসলামী দাস ব্যবস্থা ততদিন থাকবে–অন্ততঃ কাগজে কলমে।
আরব দেশ গুলিতে কৃষ্ণকায় এবং ভারতীয়দেরকে দাসই ধরা হয়। ভারতীয় বলতে আমি বাঙলাদেশ এবং পাকিস্তানিদেরকেও যুক্ত করেছি। এই দুই দেশের প্রায় সবাই মুসলিম। তা সত্ত্বেও আরবরা তাদেরকে দাস বা আবদ মনে করে-
@আবুল কাশেম,
শুধু কাগজে কলমে কেন? মোহরানা, কাবিন যৌতুক তো বাস্তব রূপেই আছে। মুসলমান নারী অবশ্যই তার স্বামীর দাসী, ভোগ্য সম্পদ। মুহাম্মদ কোন ভণিতা করেন নি, নারীদেরকে সম্পদ, মাল, দাসী হিসেবে সরাসরি দেখেছেন এবং সে ভাবেই মূল্যায়ণ করেছেন। কোথাও কোনদিন মানুষ মনে করেন নি।
আদ্দুনিয়া কুল্লুহুল মা-তা, অয়া খাইরু মাতা-য়িদ্দুনিয়া আল-মারয়াতুস সালিহাহ।
সারা পৃথিবী তোমাদের সম্পদ, আর তার মধ্যে শ্রেষ্ট সম্পদ তোমাদের সতী নারী।
ব্যস এতোটুকুই, সম্পদ শ্রেষ্ট হয়েছে মানুষ হয়নি। যেমন কাম বা স্বার্থোদ্ধারের নিমিত্তে হিন্দুরা মাঝে মাঝে মাটির পুতুলকে দেবী বলে । বাস্তবের নারী উপভোগ্য সম্পদ আর দাসীই থাকে।
আল্লাহ যদি কোরান লিখতেন তাহলে কোরানে লেখা থাকতো- তোমরা দাসীদেরকে আযাদ করে দিবে। তারপর স্বাধীন কোন মুসলমান নারী যদি কাউকে বিয়ে করতে চায় তখন তোমরা বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু দেখুন মুহাম্মদ তার স্বার্থ চরিতার্থের লক্ষ্যে কোরানে কী লিখেছেন-
হে নবী! আপনার জন্য আপনার স্ত্রীগণকে হালাল করেছি, যাদেরকে আপনি মোহরানা প্রদান করেন। আর দাসীদেরকে হালাল করেছি, যাদেরকে আল্লাহ আপনার করায়ত্ব করে দেন (আল্লাহ রাজাকার হইছে মুহাম্মদের কাছে মেয়ে চালান দেয়)
কোন মুমিন নারী যদি নিজেকে নবীর কাছে সমর্পন করে, নবী তাকে বিবাহ করতে চাইলে সেও হালাল। এটা বিশেষ করে আপনারই জন্য-অন্য মুমিনদের জন্য নয়। আপনার অসুবিধা দূরীকরণের উদ্দেশ্যে
(কতো সহজ খোলা মেলা কথা, ছাগলের মগজ না হলে কেউ তো না বোঝার কথা নয়। )
মুমিনগণের স্ত্রী ও দাসীদের ব্যাপারে যা নির্ধারিত করেছি আমার জানা আছে।
(আল্লাহও এই রকম কথা কয়- আমার জানা আছে? বখরিরা জিগায়না কী জানা আছে?)
কারে কারে হালাল করা যায় এর একটা লিষ্ট দিয়ে পরে বলছেন-
এরপর আপনার জন্যে কোন নারী হালাল নয় এবং তাদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করাও হালাল নয় যদিও তাদের রূপলাবণ্য আপনাকে মুগ্ধ করে, তবে দাসীর ব্যাপার ভিন্ন।
যদিও তাদের রূপলাবণ্য আপনাকে মুগ্ধ করে– এর মা’নেটা কী? নবী কি হুমু এরশাদ না কি?
তবে দাসীর ব্যাপার ভিন্ন।
খাইছে। নিত্য নতুন মাল আসার পথটা খোলা থাক, তাই না?
@আকাশ মালিক,
থুক্কু, আমি সঠিক লিখি নাই–আসলে লেখা উচিত ছিল: আজকের দিনেও ইসলামী দাস ব্যাবস্থা বিরাজমান, শুধু কাগজে কলমে নয়।
আপনি আমার ভুল সংশোধন করলেন তার জন্য ধন্যবাদ।
এর প্রমাণ দেখুন, এহইয়া উলুম আল দ্বীনে ইমাম গাজালি কি লিখেছেন। এই বইকে কোরআনের পরেই ধরা হয়।
আরও আছেঃ
শান্তিময় ইতিহাস পড়ে ভয়ে ও ঘৃণায় গা শিউরে উঠে। আপনার অনুবাদ যথারীতি চমৎকার (F) (F)
@তামান্না ঝুমু,
হাঁ, শান্তির ধর্ম–শান্তি প্রতিষ্ঠা করে চলেছে।