ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেবার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মহাসড়ক তৈরির কাজে যাঁরা আত্মনিয়োগ করেছিলেন, পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক বিক্রম সারাভাই তাঁদের অন্যতম। ভারতে মহাকাশ গবেষণা ও রকেট প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে বিক্রম সারাভাই’র অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এবং সুদূরপ্রসারী নেতৃত্ব ও পরিকল্পনায়। আজকের ভারত টেলিযোগাযোগে যে এত উন্নতি করেছে, টেলিভিশন সম্প্রচারে পরিমাণগত দিক থেকে বিশ্বের প্রথম দিকে স্থান করে নিয়েছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পূর্ব-সতর্কীকরণ সহ চব্বিশ ঘন্টা প্রকৃতির ওপর নজর রাখছে – ষাটের দশকের শুরুতেও এসব কিছুই ছিল না। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে সেদিন যেসব সুবিধে ছিল তা ভারতের মত স্বল্প-আয়ের দেশে প্রয়োগ করার চিন্তাও ছিল অসম্ভব। কিন্তু মাত্র এক দশকের মধ্যেই যিনি এই অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছেন তিনি বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাই [1, 2]। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত মাত্র বাইশ জন নবীন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীর উদ্যম ও অক্লান্ত পরিশ্রম কাজে লাগিয়ে বিক্রম সারাভাই মহাকাশ গবেষণা ও রকেট প্রযুক্তির বিশ্বসভায় ভারতকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উপমহাদেশের দরিদ্র মানবগোষ্ঠীর দারিদ্র্যমোচনে বিশাল ভূমিকা রেখেছেন তিনি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেছেন বিজ্ঞান গবেষণাগার – ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাব। বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের নাগালে পৌঁছে দেবার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন “কমিউনিটি সায়েন্স সেন্টার”। বিক্রম সারাভাইর হাত দিয়ে তৈরি হয়েছে ভারতের প্রথম পেনিসিলিন তৈরির কারখানা। ভারতে ইলেকট্রনিক্স শিল্পের বিকাশ ঘটেছে তাঁর হাতে। পারিবারিকভাবে শিল্প-কারখানার মালিক হওয়া এবং অনেকগুলো কারখানা নিজে তৈরি করা সত্ত্বেও বিক্রম সারাভাই কখনো ব্যক্তিগত লাভের কথা ভাবেন নি। এমনকি পারমাণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ও পারমাণবিক শক্তি বিভাগের সচিব হবার পরও রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে কোন ধরণের ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধে নেন নি। বাৎসরিক বেতন নিয়েছেন মাত্র এক রুপি। কারণ হিসেবে বলেছেন, “পারিবারিকভাবে আমার যা কিছু অর্জন তার সবই তো এ দেশ থেকেই পেয়েছি। আমাদের মত যারা যথেষ্ট সম্পদশালী তাদের উচিত নিজের দেশের জন্য বিনা বেতনে কাজ করা” [3]। প্রখ্যাত রকেটবিজ্ঞানী ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের মতে “বিক্রম সারাভাই ছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞানের মহাত্মা গান্ধী, যিনি তাঁর দলের প্রত্যকে কর্মীর মধ্যে সঞ্চালন করেছেন নেতৃত্বের গুণাবলী” [4]।
বিক্রম সারাভাইয়ের জন্ম ১৯১৯ সালের ১২ আগস্ট। বিক্রমের বাবা আম্বালাল সারাভাই আঠারো বছর বয়সেই উত্তরাধিকারসূত্রে দুটো টেক্সটাইল মিলের (ক্যালিকো এবং জুবিলি) মালিক হয়েছিলেন। আম্বালাল জৈন সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট নেতা হয়েও নিজের সম্প্রদায়ের অনেক কুসংস্কারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর বোন অনসূয়ার বিয়ে হয়েছিল খুব ছোটবেলায়। কিন্তু সে বিয়ে সুখের ছিল না। আম্বালাল সমাজের অনুশাসন উপেক্ষা করে বোনের বিবাহবিচ্ছেদের ব্যবস্থা করেন। পরে অনসূয়া ইংল্যান্ড থেকে ডাক্তারি পাস করে আসেন। দেশে ফিরে নারী-অধিকার বিষয়ে সোচ্চার কর্মীতে পরিণত হন অনসূয়া। নিজের সম্প্রদায়ের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আম্বালাল বিয়ে করেন নিম্ন মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারের এক উকিলের মেয়ে সরলা দেবীকে। আম্বালাল ও সরলাদেবী তাঁদের আটটি সন্তানের সবাইকে পারিবারিক প্রগতিশীল শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছেন। সরলা দেবী ছিলেন সেই সময়ের তুলনায় খুবই প্রগতিশীল, সামাজিক উন্নয়নের সক্রিয় কর্মী। বিক্রমের বোনেরাও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন। এক বোন আহমেদাবাদের টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।
সরলাদেবী নিজের ছেলেমেয়েদের জন্য বাড়িতেই পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। তাঁদের বাড়িতে থাকতেন তেরো জন শিক্ষক যাঁদের মধ্যে তিন জনের ছিল ইউরোপিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রি [3]। বিক্রম বাড়িতে বসেই গণিত ও বিজ্ঞানের সবগুলো বিষয়ে পড়াশোনার সু্যোগ পান। পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের জন্য ব্যবহারিক পরীক্ষাগারও ছিল তাঁদের বাড়িতে। গরমের ছুটির সময় যখন সবাইকে নিয়ে সারাভাই-পরিবার পাহাড়ে বা অন্য কোথাও ছুটি কাটাতে যেতো তখন শিক্ষকরাও সাথে যেতেন যেন ছুটিতেও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় কোন ছেদ না পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে শিলং পাহাড়ে বেড়াতে যাবার সময়ও পারিবারিক স্কুল সাথে ছিলো তাঁদের। নেহেরু পরিবারের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ ছিল সারাভাই পরিবার। মতিলাল নেহেরু ও জওহরলাল নেহেরু সারাভাইদের পরিবারে নিয়মিত আতিথ্য গ্রহণ করতেন। ইন্দিরা গান্ধী যখন পুনায় পড়াশোনা করতেন তখন আম্বালাল ও সরলা দেবী তাঁর অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এলাহাবাদে এলে সারাভাইদের বাড়িতেই থাকতেন। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী, সিভি রামন, মৌলানা আজাদ সহ ভারতীয় ব্যক্তিত্বের অনেকের সাথেই ঘনিষ্ঠতা ছিল আম্বালাল সারাভাই এবং তাঁর পরিবারের। ১৯৩০ সালে গান্ধীর লবণ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন বালক বিক্রম সারাভাই। গান্ধীর সান্নিধ্যে বিক্রম আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন এবং দেখেছিলেন দাবি আদায়ে নম্রভাবেও কত কঠোর হওয়া যায়।
প্রচলিত স্কুল-ব্যবস্থায় পড়াশোনা করতে হয়নি বলে বিক্রম নিজের পছন্দমতো বিষয়গুলোর অনেক গভীরে ঢুকতে পেরেছিলেন অনেক কম বয়সেই। মাধ্যমিক পর্যন্ত বাড়িতে পড়াশোনার পর বিক্রম ভর্তি হলেন আহমেদাবাদের গুজরাত কলেজে। উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করার পর ১৯৩৫ সালে ১৯ বছর বয়সে কেমব্রিজের সেন্ট জোন্স কলেজে ভর্তি হন বিক্রম। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে লেখা প্রশংসাপত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উল্লেখ করেন, “বিক্রম সারাভাই এবং তার পরিবারের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় অনেকদিনের। বোম্বের একটি সম্ভ্রান্ত ও সংস্কৃতিবান পরিবারে তার জন্ম। বিক্রমের এক ভাই ও এক বোন বর্তমানে কেমব্রিজে পড়াশোনা করছে” [3]। ১৯৩৯ সালে ন্যাচারাল সায়েন্সে প্রথম শ্রেণীর স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন বিক্রম সারাভাই। তারপর কেমব্রিজেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার কারণে কেমব্রিজে বিক্রমের পড়াশোনায় ছেদ পড়ে। ১৯৪০ সালের শুরুতে যুদ্ধ ইউরোপে ছড়িয়ে পড়লে বিক্রম দেশে ফিরে আসেন। যুদ্ধ কতদিনে শেষ হবে তার ঠিক নেই। তাই দেশে আসার আগে বিক্রম কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে ব্যবস্থা করে আসেন যেন ভারতে বসেই গবেষণার কাজ এগিয়ে নেয়া যায়।
কেমব্রিজ থেকে ফিরে এসে স্যার সি ভি রামনের সাথে যোগাযোগ করেন সারাভাই। রামন তখন ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের পরিচালক। কেমব্রিজ থেকে হোমি ভাবাও তখন দেশে বেড়াতে এসে যুদ্ধের কারণে আর ফিরে যেতে পারেন নি। ফলে কাজ শুরু করেছেন ব্যাঙ্গালোরে। মহাজাগতিক রশ্মির ধর্ম ও প্রভাব সংক্রান্ত গবেষণা শুরু করেছেন তিনি। বিক্রম সারাভাইয়েরও গবেষণার বিষয় মহাজাগতিক রশ্মি। তরুণ বিক্রমের সাথে পরিচয় হলো বৈজ্ঞানিক হোমি ভাবার। হোমি ভাবার সান্নিধ্যে এবং স্যার সি ভি রামনের তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু করলেন বিক্রম সারাভাই। হোমি ভাবা গবেষণা করছিলেন মহাজাগতিক রশ্মি ও মেসন তত্ত্ব বিষয়ে। বিক্রম সারাভাই মহাজাগতিক রশ্মির তীব্রতা মাপার জন্য গেইগার মুলার কাউন্টার লাগিয়ে যন্ত্রপাতি সেট করেন। ব্যাঙ্গালোরে কসমিক রে’র তীব্রতা মাপার পর কাশ্মির ও হিমালয়ে গিয়েও মহাজাগতিক রশ্মির তীব্রতা মাপেন বিক্রম। বিশাল আকৃতির বিপুল যান্ত্রিক আয়োজনে মাঝে মাঝে সেনাবাহিনীর সাহায্য নেন বিক্রম সারাভাই। গবেষণা শুরুর দু’বছরের মাথায় বিক্রমের প্রথম গবেষণাপত্র “টাইম ডিস্ট্রিবিউশান অব কসমিক রে” প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে ইন্ডিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের প্রসিডিংস-এ [5]।
ব্যাঙ্গালোরের ইনস্টিটিউটে কাজ করার সময় বিক্রম সারাভাইয়ের সাথে পরিচয় হয় মৃণালিনী স্বামীনাথনের। কেরালার মেয়ে মৃণালিনী দক্ষিণ ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যের নামকরা শিল্পী। বিক্রমের মা সরলা দেবীর মত মৃণালিনীর মা-ও সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। মৃণালিনীর প্রেমে পড়েন বিক্রম। কালিদাসের ‘মেঘদূত’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ভালোবাসা জানিয়ে চিঠি লেখেন মৃণালিনীকে। মৃণালিনী সাড়া দেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা আশ্রয় করে। ১৯৪২ সালে বিয়ে করেন বিক্রম ও মৃণালিনী। কিন্তু বিয়ের কারণেও বিক্রমের গবেষণায় ছেদ পড়েনি একটা দিনের জন্যেও।
আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট মিলিক্যান ইলেকট্রনের চার্জ নিরুপণ করার জন্য নোবেল পুরষ্কার পান ১৯২৩ সালে। তারপর তিনি মহাজাগতিক রশ্মির গবেষণা শুরু করেন। বিষুব রেখার কাছাকাছি হওয়ার কারণে মহাজাগতিক রশ্মির ধর্মাবলি পরীক্ষণের জন্য ভারত উপযুক্ত স্থান। মিলিক্যান ও তাঁর গবেষকদল ভারতের বিভিন্ন জায়গায় মহাজাগতিক রশ্মির তীব্রতা পরিমাপ করেন। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে গেইগার-মুলার কাউন্টার স্থাপন করার কাজে বেলুন ব্যবহার করেন মিলিক্যান। হোমি ভাবাও অনুরূপ পরীক্ষা করেন, তবে তিনি বেলুনের পরিবর্তে আমেরিকান বিমান বাহিনীর বিমান ব্যবহার করেন। বিক্রম সারাভাই যোগ দিলেন ভাবার সাথে। ১৯৪৩ সালে বিক্রম তাঁর গবেষণার যন্ত্রপাতি সহ কাশ্মিরে গিয়ে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে চার কিলোমিটার উঁচু পাহাড়ে উঠে মহাজাগতিক রশ্মির তীব্রতা মাপেন এবং মেসন কণার ধর্ম ও গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করেন। কাশ্মিরে যাবার সময় বিক্রম তাঁর নব-বিবাহিতা স্ত্রী মৃণালিনীকেও সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন [3]। মৃণালিনী বুঝতে পারেন তাঁর স্বামীর কাজের নেশা কত তীব্র। কিন্তু স্বামীর সাথে সারাক্ষণ এক ঝাঁক গবেষক ও কারিগরী সহকারীর মাঝে শিল্পী মৃণালিনী খুব একটা সহজ হতে পারছিলেন না। মৃণালিনী বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর স্বামীর কাছে কাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নয়।
কাছাকাছি সময়ে পরপর দুটো বিপর্যয় ঘটে বিক্রমের জীবনে। হঠাৎ অসুখে বিক্রমের সবচেয়ে বড় ভাই মারা যান। তার কিছুদিন পরেই এক দুর্ঘটনায় মৃণালিনীর পা ভেঙে যায়। নৃত্যশিল্পী মৃণালিনীর পায়ের আঘাত এতই বেশি ছিল যে তাঁর নাচের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবার আশংকা ছিলো। কিন্তু এ দুঃসময়ে শক্ত হাতে হাল ধরলেন বিক্রম। তিনি তাঁর পারিবারিক শিল্পকারখানা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ভার নিলেন। বোম্বের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মৃণালিনীর সর্বোৎকৃষ্ট চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করলেন। বিক্রম তখন একই সাথে ব্যাঙ্গালোরে গবেষণা চালাচ্ছেন, তারপর ছুটে যাচ্ছেন বোম্বেতে তাঁর অসুস্থ স্ত্রীর কাছে, পরদিনই ছুটছেন আহমেদাবাদ ও বরোদায় পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের কাজে। দিনে পনেরো ষোল ঘন্টা কাজ করতে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন বিক্রম সারাভাই।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে পিএইচডি থিসিস সম্পূর্ণ করার কাজে কেমব্রিজে ফিরে গেলেন বিক্রম। মৃণালিনী ততদিনে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। বিক্রম সাথে নিয়ে গেলেন মৃণালিনীকেও। মধুচন্দ্রিমার উদ্দেশ্যে যাওয়া, কিন্তু কেমব্রিজে যাবার পর মৃণালিনী দেখলেন বিক্রম সারাদিন ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবেই কাটাচ্ছেন। দু’বছর ধরে কাজ করে বিক্রম প্রস্তুত করলেন তাঁর পিএইচডি থিসিস “কসমিক রে ইনভেস্টিগেশান্স ইন ট্রপিক্যাল ল্যাটিচিউড্স”। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে কেমব্রিজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিজ্ঞানীদের অনেকেই চলে গেছেন বিভিন্ন জায়গায়। ফলে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। বিক্রমের থিসিস পরীক্ষা করে দেখার জন্য উপযুক্ত অধ্যাপক পাওয়া যাচ্ছিলো না কেমব্রিজে। ফলে বিক্রমকে যেতে হলো ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর ব্ল্যাকেটের কাছে। ১৯৪৭ সালে ম্যানচেস্টারে গেলেন বিক্রম। প্রফেসর ব্ল্যাকেট নিজের তৈরি ক্লাউড চেম্বারে মহাজাগতিক বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করে নতুন ধরণের কণা “ধনাত্মক ইলেকট্রন” আবিষ্কার করেন এবং ‘ইলেকট্রন-পজিট্রন পেয়ার’ নিশ্চিত করেন। এ কাজের জন্য ১৯৪৮ সালে নোবেল পুরষ্কার পান প্রফেসর ব্ল্যাকেট। ইতোমধ্যে ১৯৪৪ সাল থেকে নিয়মিত গবেষণা-পত্র প্রকাশ করতে থাকেন সারাভাই। বিক্রম সারাভাই-ই সর্বপ্রথম ধীর গতির মেসন সংক্রান্ত গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন ফিজিক্যাল রিভিউতে। প্রফেসর ব্ল্যাকেট বিক্রম সারাভাইয়ের পিএইচডি থিসিস পরীক্ষা করেন এবং ১৯৪৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন বিক্রম সারাভাই।
১৯৪৮ সালে সদ্য স্বাধীন ভারতে ফিরে আসেন ডক্টর সারাভাই। দেশে ফিরেই লেগে গেলেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরির কাজে। ১৯৪৩ সাল থেকেই পরিকল্পনা করছিলেন নিজের একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার। কেমব্রিজ থেকে ফিরে এসে প্রতিষ্ঠা করলেন ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবোরেটরি (পি-আর-এল)। পুনা মেটিওরোলজিক্যাল অবজারভেটরির পরিচালক বিশিষ্ট আবহাওয়া বিজ্ঞানী কে আর রামানাথনকে দায়িত্ব দেয়া হলো পি-আর-এল পরিচালনার। আহমেদাবাদের এম জি কলেজ অব সায়েন্সের দুটো কক্ষে কাজ শুরু হলো পি-আর-এল এর। আহমেদাবাদ এডুকেশান সোসাইটি থেকে পি-আর-এল ভবন তৈরির জন্য জমি পাওয়া গেলো। ১৯৫২ সালে হোমি ভাবা, শান্তিস্বরূপ ভাটনগর সহ আরো অনেক বিজ্ঞানীর উপস্থিতিতে পি-আর-এল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্যার সি ভি রামন। বিক্রম সারাভাইয়ের তত্ত্বাবধানে দু’বছরের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেলো পি-আর-এল এর নতুন ক্যাম্পাস। ১৯৫৪ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু পি-আর-এল ভবন উদ্বোধন করেন।
ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাব ছিল বিক্রম সারাভাই’র বৈজ্ঞানিক সাধনার প্রধান ক্ষেত্র। মাত্র তেইশ বছর বয়সে যে গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন- ঊনত্রিশ বছর বয়সেই তা বাস্তবায়িত করেন। প্রশাসনিক কাজের শত ব্যস্ততার মাঝেও পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মিত গবেষণা চালিয়ে গেছেন বিক্রম সারাভাই। তাঁর তত্ত্বাবধানে ঊনিশজন গবেষক পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন পি-আর-এল থেকে। মহাজাগতিক রশ্মির ধর্মাবলি পরীক্ষা করে মহাকাশকে গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করেছেন বিক্রম সারাভাই ও তাঁর নিবেদিতপ্রাণ গবেষকদল।
মহাজাগতিক রশ্মিগুলোর শক্তি ও গতি এতই বেশি যে এই রশ্মিগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পৃথিবীর অন্যান্য বস্তুর সাথে কোন ধরণের মিথষ্ক্রিয়া করে না। ফলে এই রশ্মিগুলোকে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। গ্যালাক্সি থেকে উৎপন্ন হয়ে মহাজাগতিক রশ্মিগুলো প্রায় পঁচিশ লক্ষ বছর পর্যন্ত মহাকাশের চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে ক্রমাগত বিক্ষিপ্ত হতে হতে একসময় যখন সৌরমন্ডলে প্রবেশ করে তখন তাদের গতির সুনির্দিষ্ট কোন দিক অবশিষ্ট থাকে না। ফলে তারা হয়ে পড়ে পুরোপুরি আইসোট্রপিক বা দিক-নিরপেক্ষ। তাদের তীব্রতা তখন সব দিকেই প্রায় সমান। কিন্তু আমাদের সৌরজগতের চৌম্বকক্ষেত্রে প্রবেশের পর এদের দিক-নিরপেক্ষতা হ্রাস পায়। ফলে সৌরজগতের গ্রহগুলোর কাছে মহাজাগতিক রশ্মির তীব্রতা সব দিকে সমান থাকে না। ১৯৫০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়েই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে স্থান ও কাল ভেদে মহাজাগতিক রশ্মির তীব্রতার তারতম্য পরিমাপ করে মহাকাশের পরিবেশ সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানা সম্ভব [5]। বিক্রম সারাভাই তাঁর গবেষকদল নিয়ে নিয়মিত ভাবে মহাজাগতিক রশ্মির তীব্রতার তারতম্য পরিমাপ করার ব্যবস্থা করেন। ফলে স্থান-কাল ভেদে মহাকাশের তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্রের অসামঞ্জস্যতা হিসেব করা সহজ হলো। এ সময় এম-আই-টি’র বিজ্ঞানীরা বলিভিয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৩৪০ মিটার উঁচুতে একটা বিশাল ‘মেসন মনিটর’ স্থাপন করছিলেন। সারাভাই তাঁর দল নিয়ে যোগ দিলেন এ প্রকল্পের সাথে। মেসন কণা শনাক্ত করার এই পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রতি ঘন্টায় মহাজাগতিক রশ্মির তীব্রতা পরিমাপ করা সম্ভব হলো। প্রাপ্ত উপাত্ত কাজে লাগিয়ে সারাভাই ও তাঁর দল মহাকাশের বিভিন্ন গ্রহের মধ্যে এবং পৃথিবীপৃষ্ঠের বিভিন্ন উচ্চতা ও স্থানের তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের বর্ণালীর পরিবর্তনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে সমর্থ হলেন।
সারাভাইয়ের পি-আর-এল এর গবেষণা অচিরেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিপুল ভাবে সমাদৃত হলো। আণবিক শক্তি বিভাগ থেকে পি-আর-এল এর গবেষণা প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হলো। পি-আর-এল এ খোলা হলো বেতার-জ্যোতির্বিদ্যা, আবহাওয়া-বিজ্ঞান, পরিবেশ-বিজ্ঞান প্রভৃতি নতুন নতুন বিভাগ- যেগুলো মহাকাশ গবেষণার পরিপূরক। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাই নেতৃত্ব দিতে শুরু করলেন। তিনি ইন্টারন্যাশনাল ‘সাব কমিটি অন কসমিক রে ইনটেনসিটি ভেরিয়েশান্স’ এর সচিব নির্বাচিত হলেন। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব পিওর এন্ড এপ্লাইড ফিজিক্স’ এর অন্তর্ভুক্ত ‘কসমিক রে কমিশন’-এরও অন্যতম সদস্য মনোনীত হলেন বিক্রম সারাভাই। তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের সবগুলো তরঙ্গদৈর্ঘ্যেই মহাকাশ-পর্যবেক্ষণের প্রকল্প হাতে নিলেন বিক্রম সারাভাই। ১৯৫৭ সালের মধ্যেই পি-আর-এল এর গবেষণাগারে ‘ইন্ডিয়ান স্পেস প্রোগ্রাম’ দ্রুত বাড়তে শুরু করলো।
আহমেদাবাদে সারাভাইদের পৈতৃক টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির বেশ কিছু দায়িত্ব নিতে হলো বিক্রম সারাভাইকে। তিনি দেখলেন টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির উন্নতির জন্য কোন ধরণের গবেষণা ভারতে হয় না এবং এর জন্য কোন প্রতিষ্ঠানও নেই। বিক্রম সারাভাই আহমেদাবাদে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। আহমেদাবাদের আরো সব ইন্ডাস্ট্রি মালিকের সাথে কথা বললেন তিনি। কস্তুরবাই লালভাই ছিলেন আহমেদাবাদের প্রভাবশালী শিল্পপতি। সরকার ও কংগ্রেস পার্টির সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। আহমেদাবাদের বস্ত্রশিল্পের উন্নয়নে গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে বিক্রম সারাভাইর উদ্যোগে খুশি হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন কস্তুরবাই লালভাই। প্রতিষ্ঠিত হলো ‘আহমেদাবাদ টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি রিসার্চ এসোসিয়েশান’ (এ-টি-আই-আর-এ বা আটিরা)। কারখানার মালিকদের আর্থিক সহযোগিতায় আটিরা’র কার্যক্রম চলতে শুরু করলো। ভারতের বস্ত্র শিল্পের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে আটিরা। শুরু থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত এর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন বিক্রম সারাভাই। কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠান থেকেই কোন বেতন নিতে রাজি হন নি তিনি। এরপর সারাভাই শান্তিস্বরূপ ভাটনগরকে রাজি করান আটিরা’র পরিচালনার ভার নিতে। কে এস কৃষ্ণান ও কস্তুরবাই লালভাই আটিরার পরিচালনা পরিষদে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু আটিরা’র কার্যক্রমে খুব খুশি ছিলেন এবং অন্যান্য রাজ্যেও এরকম শিল্প-গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের উৎসাহিত করতেন।
পারিবারিক শিল্প-প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেয়ার পর অনেকগুলো শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন বিক্রম সারাভাই। ‘সারাভাই কেমিক্যাল্স’, ‘সারাভাই গ্লাস’, ‘সুহৃদ গেইগি লিমিটেড’, ‘সিমবায়োটিক লিমিটেড’, ‘সারাভাই মার্ক লিমিটেড’, ‘সারাভাই ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ’ ইত্যাদি বিক্রম সারাভাইয়ের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে তৈরি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বিক্রম সারাভাই আহমেদাবাদে প্রতিষ্ঠা করেন ‘অপারেশান্স রিসার্চ গ্রুপ’ নামের গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ঔষধ তৈরির প্রাকৃতিক উপাদান নিয়ে গবেষণা করার জন্য বরোদায় প্রতিষ্ঠা করেন সারাভাই রিসার্চ সেন্টার। তৈল ও প্রসাধনী শিল্পের উন্নয়নে প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্বস্তিক অয়েল মিল্স’। দেশের ঔষধ কারখানার উন্নয়ন ও পেনিসিলিনের মত জীবন রক্ষাকারী ঔষধ- যেগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো- তা দেশেই উৎপাদনের লক্ষ্যে কলকাতার স্ট্যান্ডার্ড ফার্মাসিউটিক্যালের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেন বিক্রম সারাভাই। একই সাথে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান পরিচালনার আশ্চর্য দক্ষতা ছিল বিক্রম সারাভাইয়ের।
বিভিন্ন রকমের প্রতিষ্ঠানের নানা রকমের পেশা ও দক্ষতাসম্পন্ন মানুষের কর্মপদ্ধতি ও কর্মক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করে বিক্রম সারাভাই উপলব্ধি করেছেন যে কর্মীদের মানসিক সন্তুষ্টি না থাকলে জোর করে শিল্পোৎপাদন বাড়ানো যায় না। আটিরায় একটা শিল্প-মনোবিজ্ঞান বিভাগ (ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাইকোলজি ডিভিশান) খোলার ব্যবস্থা করলেন সারাভাই। এ বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হলো পাঞ্জাবি মেয়ে কমলা চৌধুরিকে। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করা কমলা চৌধুরির কর্মদক্ষতায় আটিরার কাজে দ্রুত গতিসঞ্চার হলো। বিক্রম সারাভাই’র সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো কমলা চৌধুরির। সারাভাই গ্রুপের শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলার সময়েই আহমেদাবাদে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট’ (আই-আই-এম) এর প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়লেন বিক্রম সারাভাই। শুরুতে ফোর্ড ফাউন্ডেশান সারা ভারতে মাত্র দুটো আই-আই-এম গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে – যাদের একটা কলকাতায় এবং অন্যটা বোম্বেতে। কিন্তু বিক্রম সারাভাই আহমেদাবাদের প্রভাবশালী নাগরিক ও রাজনীতিবিদদের বুঝিয়ে অনেক দেন-দরবার করে আহমেদাবাদেও একটা আই-আই-এম প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত আই-আই-এম এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বিক্রম সারাভাই। এসময় কমলা চৌধুরিকে তিনি আটিরা থেকে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টে নিয়ে আসেন। কমলা চৌধুরির সহযোগিতায় সারাভাই হার্ভার্ড, এম-আই-টি সহ আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে গবেষণা-সহযোগিতা গড়ে তোলেন।
পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করার পর হোমি ভাবা এটমিক এনার্জি ডিপার্টমেন্ট থেকে নিয়মিত রিসার্চ ফান্ডের ব্যবস্থা করে দেন সারাভাই’র ‘ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাব’-এর জন্য। মহাকাশ গবেষণায় দ্রুত অগ্রগতি ঘটতে থাকে। ১৯৬২ সালে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কমিটি ফর স্পেস রিসার্চ’-এর সভাপতির দায়িত্ব পান বিক্রম সারাভাই। তাঁর নেতৃত্বে মহাকাশ গবেষণায় একের পর এক সাফল্য আসতে শুরু করে। ১৯৬২ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বিজ্ঞান-পুরষ্কার ‘শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরষ্কার’ পান বিক্রম সারাভাই। ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের সভাপতি’র দায়িত্ব পালন করেন তিনি ১৯৬২ সালে। ১৯৬৩ সালে ‘ইলেকট্রনিক্স কমিশন’-এর সদস্য মনোনীত হন তিনি। হোমি ভাবার সাথে প্রশাসনিক ও বৈজ্ঞানিক দায়িত্ব পালন করতে করতে সারাভাই ক্রমে ক্রমে হোমি ভাবার উত্তরসূরি হয়ে ওঠেন। ১৯৬৫ সালে এটমিক এনার্জি কমিশনের সদস্য মনোনীত হন সারাভাই।
সারাভাই’র নেতৃত্বে স্থাপিত হয় ‘থুম্বা ইকুয়েটরিয়েল রকেট লঞ্চিং স্টেশন’। কেরালা রাজ্যের ত্রিবান্দ্রামের কাছে একটি ক্ষুদ্র জেলেপাড়ার নাম থুম্বা। পৃথিবীর চৌম্বক-সাম্যতা রেখার খুব কাছে বলে এই গ্রামেই বেছে নেয়া হয় রকেট লঞ্চিং স্টেশনের জায়গা। রকেট বিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালাম তাঁর ‘উইংস অব ফায়ার’ গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন কীভাবে বিক্রম সারাভাই ভারতীয় রকেট-বিজ্ঞান গড়ে তুলেছেন [4]। যে কোন কাজের জন্য উপযুক্ত লোক নিয়োগ করার চাইতেও উপযুক্ত লোক গড়ে তোলার দিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন সারাভাই। রকেট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এপিজে আবদুল কালামকে নিয়োগের সময় ইন্টারভিউতে ডক্টর সারাভাই তাঁকে যেসব প্রশ্ন করেছিলেন তিনি “কী জানেন তা জানার জন্য নয়, বরং কী সম্ভাবনা তাঁর মধ্যে আছে তা খুঁজে বের করার জন্য” [4]। ১৯৬৩ সালের ২১ নভেম্বর ভারতে প্রথম রকেট উৎক্ষেপণ করা হয় সারাভাইর নেতৃত্বে। রকেটটি ছিল নাসায় তৈরি। নাসার কাছ থেকে সরাসরি বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা লাভের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন সারাভাই। তরুণ প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের জন্য নাসায় পাঠানো হতো। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন উপযুক্ত সুযোগ ও প্রশিক্ষণ পেলে নিজের দেশের তরুণরা অসাধ্য সাধন করতে পারে।
এপিজে আবদুল কালাম বলেন, “ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এক নতুন ফ্রন্টিয়ার সৃষ্টি করেছিলেন সারাভাই। এক নতুন প্রজন্ম, তিরিশ ও চল্লিশ দশকের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী, সবাই স্পন্দিত হচ্ছিল অভূতপূর্ব এক গতিশীলতায়। আমাদের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা ছিল আমাদের ডিগ্রি বা প্রশিক্ষণ নয়, আমাদের সামর্থ্যের ওপর অধ্যাপক সারাভাই’র বিশ্বাস”[4]। তাই একদল তরুণ, অনভিজ্ঞ কিন্তু উদ্যমী ও উৎসাহী ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছিল মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীলতা প্রতিষ্ঠার কাজ। রকেট তৈরির প্রকল্পের সাথে সাথে দেশের মাটিতেই তৈরি করা হয় রকেট ফুয়েল সহ যাবতীয় সরঞ্জাম। ফলে দেশের মাটিতেই তৈরি হয় এক ঝাঁক তরুণ বিজ্ঞানী ও বিপুল সংখ্যক দক্ষ জনশক্তি। সারাভাই বিশ্বাস করতেন “ভারতীয়রা যদি বিশ্ব-সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা অর্থপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে চায়, তাহলে অবশ্যই তাদের বাস্তব জীবনের সমস্যায় প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে”।
১৯৬৬ সালে বিমান দুর্ঘটনায় হোমি ভাবার মৃত্যুর পর বৈজ্ঞানিক-প্রশাসনে হঠাৎ একটা শূন্যতার সৃষ্টি হলো। ভাবা ছিলেন এটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান, এটমিক এনার্জি ডিভিশানের সেক্রেটারি, টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের পরিচালক, ইলেকট্রনিক্স কমিশনের চেয়ারম্যান। এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার মত উপযুক্ত মানুষ খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হলো নতুন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। তখন কেবিনেট সচিব ছিলেন ধর্ম বীর। তাঁকে সার্চ কমিটির সভাপতি নিয়োগ করা হয়। কিন্তু এটমিক এনার্জি কমিটির মেম্বাররা চাইলেন প্রধানমন্ত্রী সরাসরি হস্তক্ষেপ করুন। শেষ পর্যন্ত এটমিক এনার্জি কমিটির প্রেসিডেন্ট ও এটমিক এনার্জি ডিভিশনের সেক্রেটারি পদে নিয়োগ করা হলো বিক্রম সারাভাইকে। এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে গিয়ে বিক্রম সারাভাইকে নিজেদের প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হয়। দেশের কাজের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিলেন সারাভাই।
১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ এই পাঁচ বছরে ভারতের বিজ্ঞান জগতে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন সারাভাই। নিজেদের স্যাটেলাইট নির্মাণ ও উৎক্ষেপণে দেশীয় সামর্থ্য অর্জনের লক্ষ্যে পুরোদমে এগিয়ে গেলেন সারাভাই। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি হয় ভারতীয় রকেট ‘রোহিনী’ ও ‘মেনকা’। ১৯৬৮ সালে গঠিত হয় ‘ইন্ডিয়ান রকেট সোসাইটি’। ডিভিশান অব এটমিক এনার্জির অধীনে গঠিত হয় ‘ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশান’। যে কোন কাজে শুধু দায়িত্ব বন্টন করেই দায়িত্ব শেষ করতেন না সারাভাই। নিজেও সরাসরি অংশগ্রহণ করতেন অনেক কাজে। স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল ও বড় আকৃতির রকেট উৎক্ষেপণের জন্য উপযুক্ত জায়গার সন্ধানে আকাশ থেকে উপকূল পর্যবেক্ষণে অংশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সারাভাই। পৃথিবীর পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘূর্ণনের পুরো সুবিধে যেন কাজে লাগানো যায় সেজন্য মাদ্রাজ থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তরে শ্রীহরিকোটা দ্বীপে স্থাপিত হয় স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল স্টেশন।
প্রতিদিন আঠারো ঘন্টার বেশি কাজ করতেন সারাভাই। কাজের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেতে হতো তাঁকে। কিছুদিন পর পর দেশের বাইরেও। ট্রেন স্টেশনে, বা বিমান বন্দরের লাউঞ্জে বসেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সভা করে সিদ্ধান্ত দিতেন সারাভাই। এপিজে আবদুল কালাম উল্লেখ করেছেন সারাভাই তাঁকে একবার দিল্লীর অশোকা হোটেলে দেখা করার জন্য সময় দিয়েছিলেন রাত সাড়ে তিনটায়। তারপর ভোরে একঘন্টা গাড়ি চালিয়ে তাঁরা গিয়েছিলেন রকেট রেঞ্জে। সেখান থেকে সকালে হোটেলে ফিরে সারাভাই চলে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে প্রাতকালীন বৈঠকে। বিক্রম সারাভাই ছিলেন অফুরন্ত কাজ ও উৎসাহের খনি। তিনি যখন যেখানেই যেতেন একটা কর্ম-প্রবাহ সঞ্চার করতেন সবার মনে। তিনি যে কোন কাজেই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি যেটুকু সফলতা অর্জিত হয়েছে সেটুকুর জন্য প্রাপ্য প্রশংসা দিতে কার্পণ্য করতেন না।
১৯৬৬ সালে ভারত সরকার পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করেন সারাভাইকে। ‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক ইউনিয়ন’ এর সদস্য ছিলেন সারভাই। ১৯৬৮ সালে জাতিসংঘের ‘কনফারেন্স অন দি এক্সপ্লোরেশান এন্ড পীসফুল ইউজেস অব আউটার স্পেস’ এর সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭০ সালে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি এজেন্সির ১৪তম সাধারণ সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন বিক্রম সারাভাই। সম্মেলনের অতিথিদের জন্য তিনি বিশেষ বিমানে করে ভারত থেকে খাবার নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের ‘কনফারেন্স অন দি পীসফুল ইউজেস অব এটমিক এনার্জি’র সহ-সভাপতি ছিলেন বিক্রম সারাভাই।
পদার্থবিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাই শত ব্যস্ততার মাঝেও পরিবারের জন্য, ছেলেমেয়েদের জন্য সময় করে নিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী। কিন্তু গুজরাত রাজ্য নাচের ব্যাপারে কিছুটা রক্ষণশীল। ফলে মৃণালিনী বিয়ের পর কিছুটা হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলেন। বিক্রম মৃণালিনীর নৃত্যকলার বিকাশের জন্য প্রতিষ্ঠা করলেন ‘দর্পণ একাডেমি অব পারফর্মিং আর্টস’। তাঁদের কন্যা মল্লিকাও পরবর্তীতে শিল্পী হিসেবে বিখ্যাত হন। ছেলে কার্তিকেয় ও মেয়ে মল্লিকার সাথে খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল বিক্রমের। একবার মেয়েকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাবার জন্য বিক্রম ভিয়েনায় কনফারেন্সে যাবার প্রোগ্রাম বাতিল করে দেন। বিক্রমের নিজের ছেলেমেয়েরা যেমন সমস্ত সুযোগ সুবিধা পেয়ে বড় হয়েছে- তেমনি সুবিধা-বঞ্চিত ছেলেমেয়েদের জন্যও ভেবেছেন বিক্রম। স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘কমিউনিটি সায়েন্স সেন্টার’। বিজ্ঞানের জীবন্ত-জাদুঘর বলা যায় সারাভাইয়ের সায়েন্স সেন্টারকে। সেখানে যে কেউ এসে হাতে কলমে বিজ্ঞান-চর্চা করতে পারেন। নেহেরু ফাউন্ডেশানের সহযোগিতায় বিক্রম গড়ে তোলেন বিজ্ঞান-চর্চার মাধ্যমে কুসংস্কার দূর করার জন্য নানারকম প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। বিক্রমের ইচ্ছে ছিল সমস্ত দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণের পর এসব প্রতিষ্ঠানে এসে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞান শেখানোর। কিন্তু বিক্রমের সে ইচ্ছে পূর্ণ হয়নি।
দৈনিক আঠারো-উনিশ ঘন্টা কাজ করতে করতে শরীর ভেঙে যাচ্ছিলো সারাভাইর। ঠিকমতো ঘুমাতে পারতেন না। ঘুমের মধ্যেও বিড়বিড় করে কাজের কথা বলতেন। হার্টের অবস্থা ভালো ছিল না। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তাঁর। ইন্দিরা গান্ধীও সারাভাইকে পরামর্শ দিতেন কাজের চাপ কিছুটা কমাতে। তিনি সরাসরিই বলতেন, “এত বেশি কাজ করলে তুমি মরে যাবে বিক্রম” [3]। কিন্তু বিক্রম কাজ কমাতে পারছিলেন না বা চাচ্ছিলেন না। ইন্দিরা গান্ধী নিজেই উদ্যোগ নিলেন বিক্রমের কাজ কমাতে। তিনি এটমিক এনার্জি কমিশন ও এটমিক এনার্জি ডিভিশনকে আলাদা করে বিক্রমকে বললেন এর যে কোন একটা দায়িত্ব অন্য কাউকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু বিক্রম তা করার সময় পেলেন না। ১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর লঞ্চিং স্যাটেলাইট ভেহিকল ডিজাইন দেখার জন্য থুম্বা সফর করছিলেন সারাভাই। সেদিনই তাঁর এলাহাবাদের বাড়িতে ফিরে যাবার কথা। থুম্বা থেকে এপিজে আবদুল কালামকে টেলিফোন করে বললেন ত্রিবান্দ্রাম বিমানবন্দরে তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে। সেখানে তিনি কিছু নির্দেশনা দেবেন। কিন্তু তার একঘন্টা পরেই হৃদপিন্ড বন্ধ হয়ে গেলো বিক্রম সারাভাইয়ের। মাত্র ৫২ বছর বয়সে মারা যান ‘কর্মযোগী’ বিক্রম সারাভাই।
উপমহাদেশের জন্য আকাশছোঁয়া স্বপ্নই শুধু তিনি দেখেননি আকাশ জয়ের কাজে সাফল্যও তিনি অর্জন করেছিলেন। একটা উজ্জ্বল বৈজ্ঞানিক মহাসড়ক তিনি তৈরি করে গিয়েছেন যেখান দিয়ে শুরু হয়েছে উপমহাদেশের বৈজ্ঞানিক সাফল্যের পথচলা। বিক্রম সারাভাই ছিলেন বিশাল মাপের অসাধারণ মানুষ – যিনি মিশে যেতে পারতেন একেবারে সাধারণ মানুষের সাথে। তাঁর আচার-ব্যবহার, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস সবকিছুতেই ছিল পুরোপুরি ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতিফলন। ফলে তাঁকে সবসময়েই মনে হতো নিজেদেরই একজন। বিক্রম সারাভাই ছিলেন অনুপ্রেরণার অফুরান উৎস। তাঁর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কথায় সারাভাই সম্পর্কে সবার কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে – যদি কখনো হতাশা আসে, মনে হয় বিক্রম এসে বলছেন হতাশ হবার কিছুই নেই, কাজ করে যাও – সাফল্য আসবেই [3]। বিক্রম সারাভাই’র কাছে বিজ্ঞানের গবেষণা ছিল ‘প্রকৃতিকে গভীরভাবে ভালোবাসার আরেক নাম’ [5]। বিক্রম সারাভাই’র মত বিজ্ঞান-প্রেমিক আমরা পেয়েছিলাম বলেই আজ এ উপমহাদেশের বিজ্ঞানীরা পৌঁছে যাচ্ছে শিখর থেকে শিখরে, এবং হাতের নাগালে চলে আসছে বিজ্ঞানের সুফল।
1. K. Kasturirangam, Dr Vikram Sarabhai – The light that leads the indian space program. Resonance, 2001. December: p. 3-4.
2. Mrinalini Sarabhai, Vikram A Sarabhai. Resonance, 2001. December: p. 5-7.
3. Robert Anderson, Nucleus and Nation. 2010, Chicago: University of Chicago Press.
4. A. P. J. Abdul Kalam, Wings of Fire, ed. Translated by Promit Hosen. 2002, Dhaka: Anyadhara.
5. U R Rao, Vikram Sarabhai, the Scientist. Resonance, 2001. December p. 10-18.
থুম্বার রকেট লঞ্চিং একটা বড় সাফল্য যেটা পত্রিকায় ততটা বড় করে প্রচারিত হয় না। এখানে দেখুন থুম্বায় রকেট নিয়ে যাওয়ার ছবি, সাইকেলে চড়িয়ে –
[img]http://gconnect.in/images/stories/2009/mar/space1.jpg[/img]
@দিগন্ত, অনেক ধন্যবাদ ছবিটি শেয়ার করার জন্য। সারাভাই নিজেদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাফল্য পেয়েছিলেন – কারণ তিনি সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রকেট তৈরির অনেক যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ ভারতে তৈরি করা শুরু হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশান করা হয়েছিল ইসলামিক গোঁড়ামিকে পাশ কাটাবার জন্যেই।যেন অন্তত ধর্মটা অন্তত কিছু শিক্ষিত মানুষের হাতে থাকে কিছুটা সভ্য মানুষের হাতে থাকে। যখন ব্রিটিশ আমলে মুসলিমদের শিক্ষিত বানাবার চেস্টা করে ব্রিটিশ রা ,মুসলিম নেতারা মক্তব , মাদ্রাসা আকড়ে থাকতে চেয়েছিল। এটা এ অঞ্চলের ধর্মান্ধ মানুষের দায় । ভারতের সুবিধা ছিল ভারত স্বাধীনতা উপহার হিসেবে পেয়েছিল, অর্জন করে নাই। কাজেই যা ভারতের পক্ষে সহজ ছিল তা বাংলাদেশের জন্য নয়। লক্ষ লক্ষ মসজিদ,মাদ্রাসার জন্য দায়ী জাতি নিজে ,পশ্চাদপদতা। আর এতিমখানা খারাপ কি?।
বিজ্ঞানীদের জীবনী আপনি এত সুন্দর করে লিখেন যে, প’ড়ে মুগ্ধ হয়ে যাই। যথারীতি চমৎকার (F) (F)
@তামান্না ঝুমু, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। যাঁদের কথা লিখি তাঁদের জীবন এত সুন্দর যে আমাকে বিশেষ কিছু করতেই হয় না।
আমাদের মুসলমানদের সমাজে জন্মের পরেই অভিভাকগন শিশুদেরকে মসজিদ মাদ্রাসার মৌলবী সাহেবদের হাতে ন্যস্ত করিয়া দেন,কোরান হাদিছ নামাজ রোজা ইত্যাদি ধর্মীয় বিষয় গুলীর শিক্ষা দেওয়ার জন্য।
জীবনের প্রথম লঘ্নেই তারা যে শিক্ষাটি পায় তা হল কোরান হাদিছের মধ্যে রসুলের জীবনের মধ্যেই ইহকাল ও পরকালের একমাত্র শান্তিময় জীবন ও সমাজ ব্যবস্থা রয়েছে।এর বাইরে আর যত শিক্ষা আছে তা ইহুদি নাছারাদের হতে আগত হারাম শিক্ষা ও জাহান্নামে লয়ে যাওয়ার শিক্ষা। আর জীবনের প্রথম লঘ্নে যে ধারনাটি মস্তিস্কে একবার ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তা মনস্তাত্বিক কারনে হোক আর যে কোন কারনেই হোক আজীবন তাকে এটা বয়ে লয়ে বেড়াতে হয়।
এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞান শিক্ষা করিয়া উন্নতি করার কোন ধরনের উৎসাহ বা আকাংখা কিছুই আসবার সম্ভাবনা থাকতেই পারেনা।
কী দরকার আছে এত বিজ্ঞান বিজ্ঞান করে?সর্ব সমস্যার এবং সর্ব রোগের প্রতিকার তো নবীজির দেওয়া কোরান হাদিছেই পাওয়া যাচ্ছে।
মুসলমান জাতির কোনদিন জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা সন্দেহ হয়।
@আঃ হাকিম চাকলাদার,
এতটা সরলীকরণে আমার আপত্তি আছে। বাংলাদেশের কথা যদি ধরেন সেখানে ছিঁটেফোঁটা যে বিজ্ঞানচর্চা হচ্ছে এখনো – যাঁরা করছেন তাঁদের বেশিরভাগই কিন্তু মুসলমান।
পুরা লেখাটা এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম। সারাভাই একজন অবিসশ্বাস্য রকমের কর্মযোগী। এই রকম আর ও অনেক মানুষের আত্মত্যগে ভারত আজ এত উন্নত। আমাদের দেশের নেতৃত্ব অনেক শিখতে পারে। লেখাটাও খুবই ঝরঝরে হয়েছে।
@শাখা নির্ভানা, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই বিজ্ঞানচর্চা শুরু হয়েছিল। আমাদের অঞ্চলের মানুষেরা কেন বিজ্ঞানের দিকে আগ্রহী হয়ে ওঠেন নি এটাই একটা রহস্য।
স্বাধিনতার পরে ভারত সরকার তার মেধাবী মানুষদেরকে নিয়ে সারা দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা প্রসারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, প্রতিভাবান মেধাবী মানুষগুলোকে যোগ্য মূল্যায়ন করে। সেখানে বাংলাদেশের কি অবস্থা? সেখানে স্বাধীনতার পর পরেই সরকার ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে ইসলামকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য, মাদ্রাসা শিক্ষাকে মর্যাদায় সমুন্নত করে। এর হাত ধরেই মানুষ বিজ্ঞান শিক্ষাকে বর্জন করে ধর্ম প্রচারে বেশী ব্রতী হয় , সারা দেশে গড়ে ওঠে লক্ষ লক্ষ মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা। আর তার ফলাফল এখন হাতে নাতে। শোনা যায়, ড: কুদরত ই খুদা স্বাধীনতার পরে একটা শিক্ষা নীতিমালা তৈরী করেছিলেন বিজ্ঞানকে শিক্ষার মূল ভিত্তি করে , কিন্তু সে নীতিমালা কোনদিন আলোর মুখ দেখেনি। গোটা দেশ ও জাতি এখন অন্ধকারের চর্চায় উন্মত্ত। আজ থেকে এক দশক পরে বাংলাদেশ আফগানিস্তানের মত হয়ে পড়লে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
@ভবঘুরে, আমাদের দেশে বিজ্ঞান প্রসারে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য কোন কাজই হয়নি। ষোল কোটি মানুষের একটা দেশে কোন নিয়মিত বিজ্ঞান সাময়িকী নেই। এর জন্য শুধুমাত্র সরকারকে দায়ী করার পক্ষপাতী নই আমি। বিজ্ঞানচর্চা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো মূল ক্ষেত্র। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সুযোগ আছে সেগুলোকে কাজে লাগিয়েই বিশ্বমানের গবেষণা করা সম্ভব। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সময় কোথায়?!!
বিক্রম সারাভাইয়ের কথা পড়েছি প্রথম উইংস অফ ফায়ারে… কি অদ্ভুত যে লাগতো। এই মানুষটার কথা ভাবি, আর ভাবি, বদলে ফেলা সম্ভব আমার জন্মভূমির বর্তমানকে। এইসব স্বপ্নের কথাই শোনান রাব্বানী স্যার, এমনকি আমার বর্তমান প্রফেসরও। শুধু মনে রাখি এটুকু, যেতে হবে এখনো অনেকদূর!উনত্রিশ বছর বয়সে বিক্রম সারাভাই যা পেরেছেন, তার একটা বড় কারণ ছিল, অর্থের যোগান নিয়ে তাকে ভাবতে হয়নি খুব বেশী, যেটা আমার মত অনেক স্বপ্নবাজ তরুণকেই ভাবতে হয়। এইসব বাধা যেদিন অতিক্রম করতে পারবো, সেদিন সেসব কাজে নেমে পড়ব। আপাতত বাধা অতিক্রমের পথ খুঁজি।
@নীল রোদ্দুর, বিক্রম সারাভাইদের মত ধনী পরিবার আমাদের বাংলাদেশেও অনেক আছে। কিন্তু কোনদিন শুনিনি তাঁরা বিনা পারিশ্রমিকে দেশের জন্য কাজ করেছেন।
আপনার অন্যান্য প্রবন্ধগুলীর মত এটাও অত্যন্ত ভাল লাগল।আমাদের দেশের স্কুল কলেজের বিজ্ঞাণের ছাত্রদের জন্য এধরনের প্রবন্ধ নিসন্দেহে প্রচন্ড প্রেরনার উৎস হইবে।
ধন্যবা।
@আঃ হাকিম চকলাদার, ধন্যবাদ আপনাকে। আমাদের দেশে বিজ্ঞানের বইতে যে বিজ্ঞান আছে তাই-ই ঠিকমত পড়ে না কেউ। বাংলাদেশের গ্রামের স্কুল-কলেজ থেকে যে ক্রমশ বিজ্ঞান উঠে যাচ্ছে তা দেখলে কী যে কষ্ট হয়।
সারা ভাইয়ের কথা এপিজে আব্দুল কালামের বইয়ে পড়েছি। সেখানে তার নেতৃত্ব দেবার গুণাবলী কালামের লেখনীতে দারুনভাবে ফুটে ওঠেছে।
এই মানুষদের জীবনী পড়লে আসলে দারুন ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে মন। মনে হয় ইশ আমিও যদি মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে গবেষণা করতে পারতাম! তাদের খ্যাতি আমাকে বিমোহিত করে না। গবেষণার করার মধ্যে যে অকৃত্রিম আনন্দ সারা ভাইয়ের মতো ব্যক্তিত্বরা পেয়ে থাকেন, সেই আনন্দের ছিটেফোটা পাবার জন্য মন সদাই আকুলি-বিকুলি করে।
হিন্দুদের পুনর্জন্মবাদ সত্যি সত্যি থাকলে বোধহয় বড় ভাল হত। আরেকবার জীবনটা নতুন করে শুরু করতে পারতাম।
@রনবীর সরকার,
মহাজাগতিক রশ্নি নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছেন কখনো? করে কি ব্যার্থ হয়েছেন? নাকি স্বপ্ন ছোঁয়া যাবে না এই কথা চিন্তা করে আগান নি আর।
যদি চেষ্টা না করে থাকেন তাহলে একবার চেষ্টা করেই দেখুন না, বিরামহীন চেষ্টা। আমি একতা ভুল পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম, কিন্তু আমি সেই ভুল পথ ধরে থাকিনি, এমনিওকি থাকবোও না। ইতিমধ্যে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী আছে, এখন পড়ছি আরেকটা ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে। কিন্তু আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আমি ইঞ্জিনিয়ারিং ভালোবাসিনা। আমি ভালোবাসি নিউরোসায়েন্স। 🙂
বর্তমানে কোর্সগুলো যখন নিতে হয়, তখন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী হওয়ার কারনে, স্কুল অফ মেডিসিনের কোর্স নিতে পারিনা, এক্যাডেমিক বাধা আছে, কিন্তু রিসার্চ যেহেতু নিউরোসায়েন্স রিলেটেড, কোর্সের বাইরে পুরো পড়ালেখাটাই থাকে, ওই সংক্রান্ত। এই পর্যায়ে এসে কোর্সওয়ার্ক যে আসলে খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ না, তাতে বাঁচা গেছে, এখন কোর্সের সিজিপিএ কেউ দেখবে না, দেখবে রিসার্চ কি করি বা করেছি। মজার কথা হচ্ছে, ফিজিক্স পড়তে ভালো লাগে, তাই কোর্স নেই ফিজিক্স বেসড, আর বাকিটা আমার ইচ্ছেমত পড়ালেখা। চার পাঁচ বছর পরে যদি দেখি, এতেও আমার মন ভরছে না, পুরা ডিসিপ্লিন শিফট করে ফেলব। 😀
আমি জানিনা, মহাজাগতিক রশ্নি নিয়ে কাজ করতে কি কোয়ালিফিকেশন লাগবে, বা আপনার পড়ালেখার স্ট্রিমটাই বা কি। (নিশ্চিত না যদিও, তাও বলি, ফিজিক্সে সাবজেক্ট জি আর ই দিতে পারেন, এরপর সমানে প্রফেসরদের মেইল করতে থাকেন, আপনার রিসার্চের প্ল্যান সমেত, বিস্তারিত না হলেও গভীর, শুধু ওই মেইল পড়ে কোন প্রফেসর সন্তুষ্ট হলেই হবে।) চেষ্টা করে দেখেন না একবার। বাবা মায়ের চাপে পড়ে ভুল পথে পা মাড়াতে হয়েছিল আমার, সে পথে পা মাড়াতে না হলে এতোদিনে হয়ত, ঠিক পথেই ৬/৭ বছর এগিয়ে থাকতাম, কিন্তু পথ একবার ভুল হয়েছে বলে সারাজীবন তাই বয়ে বেড়াতে হবে নাকি? জীবন একবারেরই, পূর্নজন্মে কোন লাভ হবে না। যা করার এই জন্মেই করতে হবে। 🙂
@রনবীর সরকার, মহাজাগতিক রশ্মির গবেষণা এখন অনেকটাই বদলে গেছে সেই সময়ের তুলনায়। শক্তিশালী কম্পিউটার আসার পর অনেক বেশি কম্পিটিটিভ হয়ে উঠেছে সবকিছু সাথে সাথে সুযোগও কিন্তু বেড়েছে অনেক। নীল রোদ্দুর ঠিকই বলেছেন। ইচ্ছা এবং চেষ্টা থাকলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। আইনস্টাইন বলতেন প্রতিষ্ঠার পেছনে মেধার অবদান খুবই সামান্য – কিন্তু পরিশ্রমের অবদান অসীম।
বরাবরের মত খুবই ভাল লাগল। বৈজ্ঞানিকদের জীবণী আপনার কলমে চমৎকারভাবে ফুটে উঠে। বৈজ্ঞানিক বিক্রম সারাভাইয়ের চরিত্রের বিভিন্ন দিক জানাবার জন্য ধন্যবাদ।
@গীতা দাস, অনেক ধন্যবাদ দিদি সময় করে পড়ার জন্য।
এপিজে আব্দুল কালাম’এর বই-এ সারাভাই সম্পর্কে জেনেছি।
@রঞ্জন বর্মন, ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আবদুল কালামকে রকেট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন বিক্রম সারাভাই। ‘উইংস অব ফায়ার’এ বিস্তারিত বিবরণ আছে কীভাবে সারাভাই’র হাতে প্রাণ পেয়েছে ভারতের রকেট প্রকল্প, কীভাবে এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আরো অনেক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট।