পশ্চিমের দিগন্তে ঠেস দিয়েছে সূর্যটা, ঘুমের চোটে তার সমস্ত মুখ লাল হয়ে গেছে। হায় তুলতে তুলতে কিছুক্ষণের মধ্যে সে তলিয়ে যাবে পৃথিবীর ঐ ওপারে, ওখানেই যে ওর বাস! ভুলু তার মায়ের সাথে জমির আইল ধরে বাড়ির পথ ধরেছে। ধান কাটার সময় হয়ে এল, গোধূলির মিষ্টি আলোয় মনে হচ্ছে ধান গাছে সোনা ফলেছে! সোনায় সোনায় ভরে গেছে সমস্ত মাঠ। কৃষকদের জন্যে এ এখন সোনায় বটে। ধানের ভারে এমনিতেই গাছগুলোর মাথা ঝুঁকে গেছে- যেন নামাযের মধ্যে রুকুতে আছে। এখন শিশির এসে দলে দলে মাথায় চেপে বসছে, ধান গাছগুলোকে পেড়ে ফেলল বলে! শিশিরে ভিজে জবজব করছে ভুলুর পা চারটে। খুব ভোরে যেদিন মাঠে আসে, কচি ঘাসের ডগা থেকে শিশির চেটে চেটে খায় ভুলু। একঝাঁক রাম শালিক ভুলুর পিঠের উপর দিয়ে পত পত করে উড়ে গেল দূরের ঐ বাঁশ বাগানকে তাক করে। উড়তে পারলে বেশ হত- মনে মনে ভাবে ভুলু। তাহলে এক চক্করে সমস্ত মাঠ ঘুরে আসা যেত! পাখিদের নাকি কখনও হাফ ধরে না, যত উড়ে তত উড়তে ইচ্ছে করে- একটি ফিঙে রাজা মাঝে মধ্যে ভুলুর পিঠে চেপে ঘাস খায়। ওর কাছ থেকেই জানতে পেরেছিল। যত উপরে যায় পৃথিবী নাকি ততই নেই হয়ে যায়! এই, একেবারে এইটুকু!- ফিঙে দুই পাখা কাছাকাছি এনে দেখিয়েছিল। এই ভয়ে নাকি ফিঙেরা বেশি উপরে ওড়ে না। ভুলুরও ভয় করে শুনে। তাহলে থাক বাবা, উড়ে কাজ নেই!
ওরা এখন মাঠ পেরিয়ে বাস বাগানের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এখানে আবার স্যাঁতস্যেঁতে অাঁধার। বাঁশবাগানে আসলেই ভুলুর খুব ভয় করে- বাঁশ গাছে নাকি ভূত-পেত্নী বাস করে! সে সব সাংঘাতিক সাংঘাতিক ভূত! সবুজ-সাথীকে একদিন বাড়ির বুড়িটা বলছিল সে কথা। ভয়ে ভয়ে ভুলু মার কোল ঘেষে হাঁটে। তখন থেকে মা একটাও কথা বলছে না। এ কয়দিন সবার কি যেন একটা হয়েছে!
আচ্ছা মা, আজ আমার সাথে কেউ খেলল না কেন? সবার কেমন জানি মন খারাপ খারাপ ভাব?- মাকে প্রশ্ন করে ভুলু।
মা কথা বললে ভয়টা একটু কাটবে তার।
কই বাবা, নাতো! মন খারাপ হতে যাবে কোন দুঃখে!
ছেলেকে কিছু একটা লুকাতে চায়ছেন লালি বেগম। ভুলু কিছুটা হলেও অাঁচ করতে পারে তা।
মা, একটা কিছু নিশ্চয় হয়েছে! আমাকে বলো মা; আমি কথা দিচ্ছি কাওকে বলবো না; এবং যত কষ্টের কথায় হোক না কেন আমি কোন কষ্টই পাবো না। দেখলে না- আজ মাঠে সবাই কেমন গুমড়ো মুখে বসে থাকলেও আমি ঐ ঘাসফড়িংটার সাথে কি লাফালাফিটাই না করলাম!
বুলু, আমার বাপধন- মা বললেন। মার মুখ দিয়ে ভুলু বের হয়না বলে বুলু বলেই ডাকেন। কথা দে, জীবনে যত ঝড়-ঝঞ্ঝা আসুক না কেন সব এমন করে হাসি মুখেই বরণ করে নিবি! হারানোর বেদনায় কখনো ভেঙ্গে পড়বিনা!
মা, কি-যে বল না তুমি! তোমার মাথাটা বুড়ো ব্যাঙটার মতো গেছে। সবসময় খালি ঘ্যাং ঘ্যাং করে, কিছুই বোঝা যায় না! আমি আবার কি হারাবো?
না, বলছিলাম কি- কোনদিন যদি আমি কিংবা তোর ভাই তোকে ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাই, তবে আমাদের ভুলে গিয়ে তুই এমনি করে সকলের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে দিবি। বল দিবি?
তোমরা আবার কোথায় যাবে? আর তাছাড়া তুমি আর ভাই যেখানে যাবে সেখানে আমি আর বাধ থাকবো কেন!
বাবা, ভুলে গেলে চলবে না আমরা গরু- মানুষের সেবা করার জন্যেই আমাদের জন্ম। কোন কারণে যদি ওরা আমাদের অন্য কোথাও বিক্রি করে দেয়…কিংবা..?
কি আবোল-তাবোল বলছ! ওরা তোমাদের কি জন্যে বিক্রি করতে যাবে? ভাইয়া না থাকলে ওদের ক্ষেতের কাজ কেমন করে হবে? আর তোমার বুকের দুধ খেয়েই না সাথী আর সবুজ বড় হয়েছে? তুমি না বল, ওরা তোমারও সন্তান?
তারপরও বাবা.., মানুষদের ভরসা নেই! প্রয়োজন ফুরালেই কিংবা প্রয়োজন হলেই ওরা আমাদের নিয়ে অনেক কিছুই করতে পারে!
না মা, তুমি দেখো- ওরা তোমাদের কখনো বিক্রি করবে না। চাচা না বলে- মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, ওরা কখনো উপকারীর অপকার করে না।
কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আমরা ওদের দয়াদাক্ষিণ্যে বেড়ে উঠি, বেঁচে থাকি। ওদের প্রয়োজনই আমাদের ধর্ম।
হু, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে- ওরা না থাকলে আমরা বুঝি বেঁচে থাকতাম না! বরং ভালো ভাবেই থাকতাম। চাচা না বলেন- আমাদের মতো অনেক জীব জঙ্গলে বাস করে, আর তারা আমাদের থেকে ঢের বেশি শক্তিশালী হয়। আমি তো দেখি, ওরাই আমাদের দয়ায় বেঁচে আছে; আমরা না থাকলে কে ওদের ফসল ফলাতো, কে সেই ফসল বাড়ি বয়ে আনতো, কে মাড়াই করে দিত সেই ফসল? ওদের শিশুরা কার দুধ খেত, শুনি?
কিন্তু এখন সে সব প্রয়োজন অনেকাংশে কমে এসেছে; ওরা এমন সব যন্তু তৈরি করেছে যা আমাদের থেকে অনেক দ্রুত কাজ করে অথচ তারা আমাদের মতন এত খাবারও খায় না আবার আমাদের মতো তাদের এত অসুখ বিসুখও হয় না।
তাহলে ওরা আমাদের এভাবে বন্দি করে রাখছে কেন, জঙ্গলে ছেড়ে দিলেই পারে!- অভিমানের সুরে বলে ভুলু।
ওদের আরো অনেক বড় প্রয়োজনের খাতায় যে আমাদের নামটা রয়ে গেছে!
ভুলু বলতে যায়- আমরা সকলে মিলে চেষ্টা করলেই তো ওদেরকে উচিত শিক্ষা দিতে পারি, কিন্তু এমন সময় রাস্তার মাঝ বরাবর দিয়ে বুক ফুলিয়ে ঝড়ের গতিতে একটা ট্রাকটর চলে যায়- মা ছেলে রাস্তার দু’দিকে ছিটকে পড়ে। ট্রাক চলে যেতেই ভুলু মার পায়ের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। কথা বলতে বলতে কখন যে মা ছেলে রাস্তায় উঠে এসেছে টেরই পায়নি। ভুলু প্রশ্নটি আর মাকে করে না যেন উত্তরটি ট্রাকের কাছ থেকে পাওয়া হয়ে গেছে।
সেদিন সন্ধ্যার পর পরেই গোয়াল ঘরে ফিরে আসে লালি আর ভুলু। গোয়াল ঘরে বেশিক্ষণ মন টেকে না ভুলুর। প্রতিদিনকার মতো লাফালাফি করে হাজী রহমান সাহেবের বাড়ি মাথায় তুলে রাখে। হাজি সাহেবের পাঁচ বছরের ছেলে সবুজ আর আট বছরের মেয়ে সাথীর খেলার সঙ্গী হয়ে ওঠে। খেলার একপর্যায়ে সবুজ পায়ে পা বেঁধে পড়ে গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিলে হাজি সাহেবের স্ত্রী ছুটে এসে সবুজকে বুকে তুলে নিয়ে সাথীকে বকাবকি শুরু করে দেয়। তার ধারণা, সবুজের সকল প্রকার অমঙ্গলের কারণ এই সৎ মেয়েটি। মা মরা মেয়েটিও অঝরে কাঁদতে শুরু করে; হাজী সাহেব বাইরে ছিলেন কান্নার শব্দ শুনে দ্রুত ভেতরে এসে হাতের লাঠি দিয়ে বৌয়ের গায়ে সড়াৎ করে এক ঘা কষে বললেন- মাগি, ছেলে মেয়ে দুটো ঠিকমত সামলাতে পারিস না তো কি জন্যে আছিস? হাজী সাহেবের স্ত্রী চিৎকার দিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। তিনজনের কান্নার ঢঙ দেখে মনে হচ্ছে কান্নার প্রতিযোগিতা চলছে এবং হাজী সাহেব সেই প্রতিযোগিতার একমাত্র বিচারক। অবস্থা বেগতিক দেখে ভুলু ছুটে চলে আসে মার কাছে। মার কাছে কিছুক্ষণ ঘুর ঘুর করে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে চলে যায় বড় ভাই ধলার কাছে। ধলা তখনও নাদায় বাঁধা। ভুলু ধলার পায়ের মাঝখানে মাথা ডলতে থাকে। ধলা ধমকের সুরে বলে, আজ আর বিরক্ত করিস না, ভুলু; রাত হয়ে এল, ঘুমু-গে।
ধলার মুড অফ দেখে ভুলুর আবার মাঠের কথা মনে পড়ে যায়- ধলাকে বলে, এ কয়দিন থেকে তোমাদের এত মন খারাপ কেন?
ধলা বলে, পরশু কুরবানীর ঈদ যে!
সেটা আবার কি? অবুঝের মতন প্রশ্ন করে ভুলু।
মনিবদের সব থেকে আনন্দের দিন।
তাহলে তো খুব মজা হবে। ওদের আনন্দ দেখতে আমার খুবই ভালো লাগে। আবারো ভাইকে প্রশ্ন করে, এতে মন খারাপ করবার কি আছে?
ঐ দিন…!
ঐ দিন কি…থামলে কেন…ওরা কি আমাদের দিয়ে অনেক কাজকর্ম করিয়ে নেবে?
না। কোন কাজই করতে হবে না আমাদের।
তাহলে তো খুবই মজার কথা, বলেই আর কিছুই শোনার অপেক্ষা না করে লাফাতে লাফাতে বাড়ির পেছন দিকের পুকুর ঘাটটা একবার ঘুরে আসে ভুলু। পুকুর চারপাশে লাফাতে ভুলু খুবই পছন্দ করে কারণ পুকুরের জলে সে নিজের লাফালাফির দৃশ্যটা দেখতে পায়। অন্ধকার জলে কিছুই ঠাওর করতে না পেরে সে ফিরে আসে গোয়াল ঘরে। আকাশে তখন চাঁদ ফুটেছে। গোয়াল ঘরের ফুটো চাল দিয়ে চাঁদের সাথে কথা বলে ভুলু- তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কেমন করে চল, একটু বলবে কি? চলতেই যখন পারো তখন আর একটু জোরে জোরে যেতে পারো না? তুমি সূয্যিকে ডেকে দিলে তবেই তো ভোর হবে। আমার রাত একটুও ভালো লাগে না। তারপর ভুলু তার সারাদিনের বৃত্তান্ত বলতে বলতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে, চাঁদটাও সেই ফাঁকে সরে পড়ে ভুলুর আকাশ থেকে।
পরদিন, প্রতিদিনকার মতই হাজী সাহেবের রাখাল ভুলুদেরকে মাঠে চরাতে নিয়ে যায়। আজ ভুলুর খুবই ভালো লাগছে। চারিদিকে কেমন একটা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠান ভাব। রাস্তায় আলপোনা অাঁকা হয়েছে। আলপোনার মাঝখানে ভুলুর মতো একটা বাছুরের ছবি অাঁকা হয়েছে। ভুলুর ধারণা, এটা তারই ছবি। সে ভালো করে ছবির বাছুরটির সাথে নিজেকে মিলিয়ে নেয়। ছবির বাছুরের লেজ যে এঙ্গেলে বাঁকানো আছে ভুলু সেই এঙ্গেলে নিজের লেজটি বাঁকিয়ে হাঁটার চেষ্টা করে।
মাঠের চারপাশে গরুগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এটাই মহেষখালীর সবথেকে বড় চারণভূমি; আসেপাশের গ্রামগুলো থেকেও রাখালরা এখানে গরু চরাতে আসে। বিষয়টি ভেবে ভুলু ভেতরে ভেতরে বেশ গর্ব অনুভব করে; তবে একটা হিসেব সে কিছুতেই মেলাতে পারে না- গরুরা প্রাণি সমাজে শ্রেষ্ঠ হলেও গ্রামটির নাম গরুখালী না হয়ে মহেষখালী হল কি করে!
গতকালের থেকে আজকের পরিবেশটা আরো ভারী। ভুলু মনে মনে ভাবে- সবাই ছাগল নাকি, কাল একটা এতবড় আনন্দের দিন অথচ কারো কোন ফিলিংস নেই; মানুষ কি আর সাধে গাধা-গরু বলে বোকাদের গালি দেয়!
গরুদের মধ্যে সবথেকে প্রবীণ গরুটির আহবানে সবাই মাঠের এককোণে জড়ো হলো। ভুলু তাকে হুলু দাদা বলে ডাকে। হুলু সাথী সবুজের পোষা বেড়ালের নাম। বেড়ালটির মতোই দাদা কথায় কথায় কাশে, এ জন্যে সে তাকে হুলু দাদা বলে ডাকে। ভুলু থাকে সবার সামনে; তার ধারণা- এখন বোধহয় হুলু দাদা সবাইকে আনন্দ না করার জন্যে বকাবকি করবে। কয়েকবার কেশে তিনি বলা শুরু করলেন- ভাই ও বোনেরা আমার, আগামীকাল আমাদের গরু জাতির জন্যে জাতীয় শোক দিবস এবং কঠিন পরীক্ষার দিন। কাল যারা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে তারা সবাই স্বর্গের সবচেয়ে উঁচু স্থানটিতে ঘাস খাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবে। ওখানকার ঘাস পৃথিবীর ঘাসের থেকে অনেক বেশি সবুজ আর সতেজ।
বৃদ্ধ কয়েকবার কেশে আবার বলতে শুরু করলেন- সৃষ্টিকর্তার দয়ার ভান্ডার অফুরন্ত, তাঁর অশেষ কৃপায় আমরা বেঁচে আছি; তাঁরই উদ্দেশ্যে আমাদের কুরবানী করা হয়, গরু-জীবনে এর থেকে সৌভাগ্যের আর কিইবা হতে পারে! আমাদের এই ক্ষুদ্র জীবন দিয়ে যদি স্রষ্টার ঋণ কিছুটা শোধ করতে পারি, মন্দ কি? তাই কাল যেমনি অনেকের কাছে প্রিয়জন হারানোর দিন তেমনি অনেকের কাছে খুদার সাথে দোস্তি হবার দিন। মৃত্যু সকলের হবে, আজ অথবা কাল। বনের হাতি ঘোড়া বাঘ ভাল্লুক কি মরে না? তোমরাই বল- কে বেশি ভাগ্যবান? আমাদের মধ্যে অনেকেই কাল থেকে স্বর্গের সবথেকে উঁচু স্থানটাতে চরে বেড়াবে। তাই বন্ধুরা, আসো এই বিদায়ী অশ্রুকে আমরা আনন্দের অশ্রুতে রূপান্তরিত করি। বলতে বলতে বৃদ্ধের চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সবাই যেমন করে নীরবে সমবেত হয়েছিল তেমন করেই যে যার মতো সরে পড়ল। ভুলু কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। কাউকে যে প্রশ্ন করবে, সাহসে কুলায় না।
প্রতিদিন বাড়ি ফিরবার সময় ভুলু মার সাথে প্রাণ খুলে গল্প করে, বিষয়বস্ত্তর অভাব হয় না তাদের। আজ এ কয়দিন একটি কথাও হয়নি। মার চোখের দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটা কেমন জানি মোচড় দিয়ে ওঠে। শত চেষ্টাতেও আজ আর ভুলু লাফাতে পারে না। মনে হয় কে যেন পায়ে বড় একটা পাথর বেঁধে রেখেছে। নতুন পোষাকে সবুজ আর সাথীকে দেখে ভুলু দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগে। একবার মায়ের অশ্রুসিক্ত নয়নের দিকে তাকায় আর একবার দেখে হাজী বাড়ীর মানুষগুলোর অট্রহাসিতে ফেটে পড়া। একই সৃষ্টিকর্তার পৃথিবীতে এত বৈচিত্র্য কেন- মনে মনে ভাবে সে। হাসি কান্নার এত কাছাকাছি সহবস্থান দেখে খুব ঘাবড়ে যায় ভুলু। গোয়াল ঘর থেকে বেরুবার সাহস হয় না তার। আজ আর আকাশের চাঁদটাকেও দেখা যাচ্ছে না। অবস্থা বেগতিক দেখে সেও বুঝি সটকে পড়েছে! মার কোলের ভেতর ঢুকে ঘুমাবার চেষ্টা করে ভুলু। তার অবস্থান টের পেয়ে মা লালি বেগম বলেন-
ভুলু, বাপ আমার..?
হ্যাঁ মা।
কাল বোধহয় আমি আর ধলা স্বর্গে চলে যাচ্ছি।
আমি যাবো না মা?
সময় হলে তুমিও যাবে। আমরা তোমার জন্যে অপেক্ষা করব। পৃথিবীতে সবাই একটা উদ্দেশ্য নিয়ে আসে আর সেটা পূরণ হয়ে গেলে আবার স্বর্গে ফিরে যায়।
আমার উদ্দেশ্য কি মা?
আমাদের সব গরুর উদ্দেশ্য এক- মানুষের সেবা করা।
মানুষদের খুব মজা, তাই না মা? পরের জন্মে আমি মানুষ হয়ে জন্মাতে চাই।
হবি। মন প্রাণ দিয়ে হাজী সাহেবের সেবা করবি, আল্লাহ তোকে পরের জন্মে মানুষ করেই পাঠাবে।
আচ্ছা মা, স্বর্গের ঘাস খুব সুস্বাদু, তাই না?
হ্যাঁ বাবা- বলেই টানা নিঃশ্বাস ছাড়েন লালি বেগম।
ভুলু মনে মনে ভাবে, কাল সারাদিন মার পিছে পিছে ঘুরবে সে, মা যখন স্বর্গে যাবে তখন সে স্বর্গে যাবার পথটা ভলো মতো চিনে রাখবে। তারপর সুযোগ পেলে একদিন চুপিচুপি স্বর্গের সবুজ ঘাসটা একবার চেখে আসবে।
পরদিন সকালে একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙ্গে ভুলুর। ঘুম থেকে উঠে দেখে বাড়ীতে হৈ হৈ রৈ রৈ কারবার কিন্তু কোথাও মা আর ভাইকে খুঁজে পাই না সে। গোয়াল ঘরে এসে অন্যান্য গরুদের জিজ্ঞেস করে কিন্তু কেউ কোন উত্তর দেয় না। খুঁজতে খুঁজতে ভুলু পুকুর ধারে চলে যায়; দেখে- জায়গায় জায়গায় দলা বেধে আছে রক্ত, রক্তের গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস। ভুলু বিবর্ণ দেখে চারপাশ; পুকুরের জলে কাঁপতে থাকা নিজের প্রতিচ্ছবিকে প্রশ্ন করে- স্বর্গে যাবার পথ এত বিভৎস কেন? একঝাঁক পায়রা ভুলুর পিঠের উপর দিয়ে পত পত করে উড়ে যায় শুণ্যের দিকে। উড়তে পারলে বেশ হত- মনে মনে ভাবে ভুলু। তাহলে এক নিমিষে সূর্যের পথ ধরে দিগন্তে পেরিয়ে পৃথিবীর ঐ ওপাশে চলে যেতাম।
এক বিশেষ বিষয়কে কেন্দ্র করে লেখা। খুব উপভোগ্য হয়েছে। এমন লেখা কমই দেখা যায়।
বর্নণা , সময়কে সুচারু ভাবে তুলে ধরেছ নিখুঁত ভাবে। ভালো লাগলো মুজাফফর (F)
@আফরোজা আলম, ধন্যবাদ । ভাল লাগলো শুনে।
গ্রাম-জীবন নিয়ে লেখা, গ্রামের গন্ধ পাইনি।
‘মুড অফ’ কি গ্রাম বাংলার সমাজে ঢুকে গিয়েছে?
মা ছেলের কথোপকথনে সংলাপ, আমি জানি না, কেন জানি মিশে যেতে পারিনি। আধেয় চমৎকার কিন্তু আধার যেন পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ালো।
ভাল থাকবেন।
@স্বপন মাঝি, ধন্যবাদ। এত সুন্দর করে সমস্যাগুলো ধরিয়ে দেবার জন্যে। আমি পুনরায় গল্পটি নিয়ে বসবো। ভাইয়া, আপনি কি এইবার মেলায় আসবেন ?
@ মোজাফ্ফর,
বরাবরের মতোই লেখাটি ভাল হয়েছে। তবে এই নিষ্ঠুর জগতে প্রতিনিয়তে বাস করে নিষ্ঠুরতার গল্প সব সময় এড়িয়ে চলি। মেকি ভান করে জীবন অতিবাহিত করি, যেন এ জগতে বীভৎস কোন ঘটনা ঘটেনা। কি করব, বর্বরতাকে থামানোর ক্ষমতা যে নেই।
গল্পটি মন ছুঁয়ে গেল।
@হেলাল, ধন্যবাদ। আপনার ভাললেগেছে জেনে লাগলো..