লিখেছেনঃ সদেরা সুজন
বেঁচে থাকুন অনাদিকাল মানুষের হৃদয়ে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায়
গতকাল কাজে থেকেই পেলাম দুঃসংবাদটি। কর্মস্থলে ফোন করে জানিয়েছেন আমার স্ত্রী, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী আর নেই। চিরতরে চলে গেলেন দৃষ্টির অন্তরালে লোকান্তরে না ফেরার দেশে বিজয়ের মাসে বাংলাদেশের আরো একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র শিক্ষাবিদ সুচিন্তাশীল, সুসাহিত্যিক, সুসৃষ্টিশীল, সৃজনশীল, সুপ্রতিম, সত্য-সুন্দর প্রগতি আর অসাম্প্রদায়িকতার বটবৃক্ষ বাংলাদেশের মানুষের বড়বেশী আপনজন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। যিনি বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রতিটি অশুভ কর্মকান্ড, ক্রান্তিকালে জাতির বিপর্যয়ে, দুঃশাসনে, মানবতার লাঞ্ছনায় অপশক্তি স্বৈরাচার –মৌলবাদ-ধর্মীয় গোড়ামী-কুসংস্কার-কূপমন্ডুকতা-সাম্প্রদাযিকতা আর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াকু সেনাপতি হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর সততা-কর্মনিষ্ঠতা-দক্ষতা-প্রগাঢ়তা-সুশিক্ষা-অসাধারণ প্রতিভা-সমাজ সংস্কারতা-বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক যুক্তি-মুক্তবুদ্ধি-গণতন্ত্র ও অসীম জ্ঞানের আলো বিলিয়ে দিয়েছেন দেশে-বিদেশে মানুষের কল্যাণে। দেশ ও জাতির দুঃসময়ে জাতির বিবেক হিসেবে আলোকবর্তিকা হিসেবে নিরলসভাবে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। বঙ্গজননীর রত্নগর্ভা এমন সন্তানরা বছরে বছরে কিংবা যুগ যুগান্তরে জন্মে কি-না সন্দেহ। কবীর চৌধুরীর মতো ক্ষণজন্মা মণিষাদীপ্ত মহান ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য পাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো।
অনেক দিন আগের কথা। কানাডায় তখন কোনো বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতোনা। মাঝেমধ্যে মাসিক বাংলাদেশ পত্রিকা পেতাম। তখন ইন্টানেটের তেমন প্রচলন ছিলোনা। বাংলাদেশেও হাতেগোনা ক’টি দৈনিক ও সাপ্তাহিক ছিলো। দৈনিক বাংলা, সংবাদ, ইত্তেফাক, বাংলার বাণী, দৈনিক খবরসহ কটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। আজকের মতো এত সুন্দর সুন্দর বাহারী নামের পত্রিকা ছিলোনা, ছিলোনা বাংলা পত্রিকার ওয়েবসাইট। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারের পত্রিকা আসতো মন্ট্রিয়লে। তাও আবার শুক্রবারের পত্রিকা পরের মঙ্গলবারে। সম্ভবত ১৯৯৫ সালের কথা। আমি তখণ বাংলাদেশের দৈনিক খবর গ্রুপ অব পাবলিকেশনের কানাডা ব্যুরো প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি আমার সাথে ছিলেন সাংবাদিক দীপক ধর অপু। তখন কানাডা প্রবাসীদের সব খবরাখবর সংবাদ দৈনিক খবর-চিত্রবাংলাসহ খবর গ্রুপের পত্রিকায় প্রকাশ হতো ফলে খবর পত্রিকায় চাহিদাও ছিলো বেশী। সে বছর মন্ট্রিয়লের লাভাল শেরাটনের ফোবানা সম্মেলনে এসেছিলেন প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব সদ্যপ্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, প্রয়াত অভিনেতা আবুল খয়েরসহ অনেকেই। সেই সময়ে মৌলবাদি স্বৈরাচারী স্বাধীনতা বিরোধী জাতীয়তাবাদিদের আস্ফালনে নিপীড়ন নির্যাতন আর ইতিহাস বিকৃতির জঘন্যতম কর্মকান্ডে বাংলাদেশে স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধে- মুক্তমনে- অসাম্প্রদায়িকতা- প্রগতিতে বিশ্বাসী মানুষের ওপর চলছিলো চরম দুঃসময়। সেই সময়ের প্রেক্কাপটে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম যা দৈনিক খবরে ছাপা হয়েছিলো। এরপর ১৯৯৮ সালে মন্ট্রিয়ল থেকে প্রকাশিত আমার সম্পাদনায় দেশদিগন্তে’র বর্ষপূর্তিতে শুভ কামনা জানিয়ে বাণী পাঠিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম তখণ ফেব্রুয়ারির বইমেলাসহ বেশ ক’বার দেখা হয়েছিলো। তাঁর হাতে দেশদিগন্তের বর্ষপূর্তি সংখ্যাটি পৌঁছে দিয়েছিলাম। যা শুধুই আজ স্মৃতি। শুদ্ধতম ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই মানুষটি ছিলেন শান্ত সাদামাটা অহংকারহীন মৃদুভাষী। চল্লিশ বছর আগে এই ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকি হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকার আলবদর বাহিনীর গো আযমরা হত্যা করেছিলো তাঁর সহোদর মুনীর চৌধুরীকে। মাত্র কিছুদিন পূর্বে এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায প্রাণ হারিয়েছেন তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পর্ণ মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মিশুক মুনীর। লাখো লাখো মানুষকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা এই ঋষিতুল্য বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সম্পূর্ণ পরিবারই সংস্কৃতিমনা সুশিক্ষায় শিক্ষিত স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ মুক্তবুদ্ধি প্রগতির পতাকাবাহী।
জন্ম-মৃত্যু শ্বাশত। সবাইকেই একদিন মরতে হবে। তবে কারো কারো মৃত্যুতে দেশ ও জাতির বড় বেশী ক্ষতি হয়। যে ক্ষতি সহজে পূরণ হবার নয়। আমাদের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব কবীর চৌধুরীর অন্তিমপ্রয়ানে যে ক্ষতি হলো তা সহজে পূরণ হবার নয়। তাঁর প্রয়াণে সারা বিশ্বে বসবাসরত বাংলা ভাষাভাষী মানুষ শোকে মুহ্যমান। এমন ক্ষণজন্মা মানবের চলে যাওয়ায় গোটা জাতির সঙ্গে আমরাও গভীরভাবে শোকাহত। তাঁর প্রতি রইলো আমাদের অন্তরের গভীর শ্রদ্ধার্ঘ্য। তিনি তাঁর কর্মে বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে অনাদিকাল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়।
সদেরা সুজন/ ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
মন্ট্রিয়ল/১৪/১২/২০১১
শ্রদ্ধাঞ্জলি…
দয়া করে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ বানানটা ঠিক করে দিন। পুরো লেখার বানানগুলোও আরেকবার রিভিউ করে নিতে পারেন।
আপনার অভিজ্ঞিতা শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।