(দশম ও শেষ পর্ব)
(প্রথম পর্ব) , (দ্বিতীয় পর্ব) , (তৃতীয় পর্ব) , (চতুর্থ পর্ব) , (পঞ্চম পর্ব) , (ষষ্ঠ পর্ব) , (সপ্তম পর্ব), (অষ্টম পর্ব), (নবম পর্ব)
অগাস্টের কোন এক সময়ে আমরা শহরে ফিরে এলাম। খবর নিয়ে জানলাম, আমার সমমতের সাথীদের অনেকেই তখনো নিজ নিজ গ্রামে – কেউ কেউ সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে ইতিমধ্যে। এদের একজন নিয়মিত আসা যাওয়া করেন এপারে। আমরা যারা তখন শহরে ছিলাম তাদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন। চট্টগ্রামে আমাদের ছাত্র সংগঠনের (বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন) নেতৃস্থানীয় কর্মী ছিলেন তিনি। তাঁর কথাবার্তা শুনে আমার হতাশা আরো বেড়ে গেল। যুদ্ধের ভারত-নির্ভর চরিত্রটা মেনে নিতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। আমার মনে হলো, ভারতের মাটিতে থেকে যতই স্বকীয়তা বজায় রেখে আমরা বামপন্থীরা যুদ্ধ করতে চেষ্টা করিনা কেন, এইভাবে যুদ্ধ করা আর আওয়ামী লীগের লেজু্ড়বৃত্তি করা একই কথা।
মস্কোপন্থী সমাজতন্ত্রীরা এই লেজুড়বৃত্তি করাটাকেই তখন সঠিক স্ট্র্যাটেজি মনে করেছিল। আন্তর্জাতিক রাজনীতির মেরুকরণের ফলে তখন ভারতের ইন্দিরা সরকারের সাথে ব্রেজনেভের সোভিয়েত রাশিয়ার দারুণ মাখামাখি। স্বভাবতই ভারতের মস্কোপন্থী কম্যুনিস্টরা তখন ইন্দিরা-তোষনে ব্যস্ত। একই কারণে বাংলাদেশের মস্কোপন্থীরা ভারতে অন্যান্য বামপন্থীদের তুলনায় অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল।
হায়দার আকবর খান রনোর লেখা থেকে জানতে পারছি [১],
“বামপন্থীদের আরেক অংশ মনি সিংহের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন মিলিতভাবে বাহিনী গড়ে তুলেছিল, যা ছিল সরকারি মুক্তিফৌজ থেকে স্বতন্ত্র। ভারত সরকার তাদের স্বতন্ত্রভাবে ট্রেনিং ও অস্ত্র দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের মৈত্রীর কারণে ভারত সরকার এটা করতে বাধ্য হয়েছিল”।
তবুও, সিপিআই (মস্কোপন্থী কম্যুনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া)-এর অভিভাবকত্বে থাকা সত্ত্বেও, আওয়ামী লীগ আর ভারত সরকারের হাতে তাদের কম হেনস্থা হয় নি। আওয়ামী লীগের একাংশ (শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বাধীন) তাদেরকে ভীষণ অপছন্দ করতো। আর আমরাতো আওয়ামী লীগের কাছে চিহ্নিত শত্রু ছিলাম আগে থেকেই। আওয়ামী লীগও আমাদের বিবেচনায় মিত্র ছিল না।
আমাদের নেতারা ভারতে সিপিএম (কম্যুনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-মার্ক্সিস্ট)-এর সহানুভূতি পেয়েছিলেন। সিপিএম-এর সাহায্য এবং আশ্রয় তাদের জন্য ভারতে অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। সিপিএম তখন সোভিয়েত রাশিয়া আর চীনের প্রভাবমুক্ত হয়ে এক স্বতন্ত্র ধারার ‘কম্যুনিস্ট’ রাজনীতির সূচনা করেছিল ভারতে। তারা ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছিল, মূলত পশ্চিম বাংলায় আর কেরালায়।
বুর্জোয়া পার্লামেন্টারি ধারার রাজনীতির সাথে সিপিএম-এর রাজনীতির তেমন কোন বৈপরীত্য ছিল না। তবে, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন আর নির্বাচনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী হলেও বামপন্থী হওয়ায় এই দলটির মেনিফ্যাস্টোতে কৃষক-শ্রমিকদের দাবীদাওয়ার কথা অন্যান্য বুর্জোয়া দলের চেয়ে বেশি থাকতো। পশ্চিম বাংলায় তারা তাদের এই ধারার রাজনীতিতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা আর সাফল্য লাভ করতে পেরেছিল। কয়েক বছরের মধ্যে রাজ্য সরকারের ক্ষমতাও দখল করেছিল । শুধু তখনই নয়, পরবর্তীতেও বেশ কয়েক বছর ধরে তাদের এই জনপ্রিয়তা অক্ষুন্ন থাকে। দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর ধরে তারা পশ্চিম বাংলার রাজ্য সরকারের ক্ষমতায় ছিল। অতি সম্প্রতি, এই বছরের (২০১১) মে মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তারা হেরে যায়। তবে এদের রাজনীতিকে সত্যিকারের কম্যুনিস্ট রাজনীতি বলা যায় না। কাস্তে-হাতুড়ি প্রতীক নিয়ে রাজনীতি করলেও শেষ পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির কাজ একটাই – পুঁজিবাদ টিকিয়ে রাখা। তাই হয়েছে পশ্চিম বাংলায়। নান্দীগ্রাম আর সিঙ্গুরের ঘটনায় সিপিএম হালে কৃষকের স্বার্থবিরোধী দল হিসেবে কুখ্যাতি পেয়েছে।
একাত্তরে পশ্চিম বাংলায় সিপিএম অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি ছিল। প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় আমি এখানে হায়দার আকবর রনোর লেখা বই থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি। এ থেকে সিপিএম-এর প্রভাব সম্পর্কে যেমন একটা ধারণা পাওয়া যাবে, তেমনি বাংলাদেশের বামপন্থীরা ভারতে কেমন ‘আপ্যায়ণ’ পেতেন তারও কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে [২] ।
“শুধু আর্থিক সাহায্য বা আশ্রয়দানই নয়, ভারতে আমাদের নিরাপত্তার প্রশ্নেও সিপিআই(এম)’র ভূমিকা ছিল বড় রকমের। তখন ভাসানী ন্যাপ বা বাম কমিউনিস্টদের ভারত সরকার মোটেই ভালো চোখে দেখত না। প্রায়ই আমাদের কর্মীরা গ্রেফতার হতেন। কেউ কেউ নিখোঁজও হয়েছেন। একবার আগরতলায় ভাসানী ন্যাপের কয়েকজন গ্রেফতার হন। আমাদের কর্মীরা ছুটে গেল কমরেড নৃপেন চক্রবর্তীর কাছে। সব শুনে কমরেড নৃপেন চক্রবর্তী সোজা চলে গেলেন আগরতলাস্থ আওয়ামী লীগ অফিসে। শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন সেখানে। কমরেড নৃপেন চক্রবর্তী জানতে চাইলেন, ‘ন্যাপ কর্মীরা এ্যারেস্ট হয়েছেন কেন?’ শেখ মনি বললেন, আমি কি জানি দাদা, এতো ভারত সরকারের ব্যাপার’। এবার নৃপেন চক্রবর্তী বললেন, ‘আপনারা না বললে ভারত সরকার কিভাবে জানবে কে ন্যাপ, কে কমিউনিস্ট, কে আওয়ামী লীগ? – আমি চাই আজকেই এদের মুক্তির ব্যবস্থা করবেন। মনে রাখবেন, এখানে সিপিআই(এম) একটা শক্তি। আমাদের সহযোগিতা না পেলে, যেখান থেকে এসেছেন সেখানে চলে যেতে হবে। মাসি-পিসি (অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধী) আপনাদের রক্ষা করতে পারবে না। ত্রিপুরা ও পশ্চিম বাংলার জনগণের সমর্থন নিয়েই থাকতে হবে’। এই ধমকে কাজ হয়েছিল। বন্দী ন্যাপ কর্মীরা সেইদিনই ছাড়া পেয়েছিলেন”।
আগেই বলেছি মস্কোপন্থীরা ছাড়া অন্য সব বামপন্থীদের বড়ই দূর্দিন যাচ্ছিল তখন। চীনপন্থীরাতো বটেই, স্বতন্ত্র ধারার বামপন্থীরাও বেকায়দায় ছিলেন। নির্মল সেন ও তাঁর দল আর এস পি’র (রেভ্যুলিউশনারি সোস্যালিস্ট পার্টি) রাজনীতি চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভাবিত ছিল না। কিন্তু দুয়েকটা ট্রেড ইউনিয়ন ছাড়া তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড ছিল সীমিত। ভারতে তাঁদের অবস্থাও ভালো ছিল না। তাঁর মুখেই শুনি [৩]।
“ইতিমধ্যে আমসদের দলের কিছু ছেলেদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। ওরা কুষ্টিয়া সীমান্ত দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া সীমান্তে ঢুকেছিলো। …… ওখানে ওরা মুক্তিবাহিনীর শিবির গড়ে তুলেছে। ওটাই বোধ হয় ভারতের মাটিতে প্রথম মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প। ওখান থেকে আমাদের কিছু কিছু ছেলে ট্রেনিং নেবার জন্যে বিহারের চাকুলিয়ায় গিয়েছে। প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে গেছে যুদ্ধ করার জন্যে। তবে পরবর্তীকালে এই ক্যাম্পটি নিয়ে একটি ভিন্ন ইতিহাস সৃষ্টি হয়। এই ক্যাম্প সফরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন ও প্রধান সেনাপতি ওসমানী এসেছিলেন। ছেলেদের উৎসাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলা সরকার এই ক্যাম্পটিকে বাতিল করেন। কারণ এই ক্যাম্প বামপন্থীদের দখলে। ৭১ সালের এই ঘটনা আজকে অনেককে হয়তো অবাক করবে। কিন্তু এই ধরনের ঘটনা সেকালে অনেক ঘটেছিলো। যা আজকে বিশ্বাসযোগ্য নয়”।
একই বইয়ের অন্য জায়গায় নির্মল সেন লিখেছেন [৪],
“আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো, দলীয় পরিচয় দিয়ে এখানে কোন প্রশিক্ষণ নেয়া যাবে না। ব্যক্তি হিসেবে আমি পরিচিত বলে হয়তো কিছু সুযোগ সুবিধা পাবো। কিন্তু আমাদের দলের কারো পক্ষে সরাসরি রিক্রুট হয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যাওয়া সম্ভব নয়। রিক্রুটের কালে রাজনৈতিক পরিচয়ই হবে বড় পরিচয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সুসম্পর্ক না থাকলে প্রশিক্ষণের জন্যেও গ্রহণযোগ্য হবে না” ।
অন্যান্য বামপন্থীরা তখন কি করছিল? তখন আমার পক্ষে বিস্তারিত জানা সম্ভব ছিল না। পরে জানতে পেরেছি, বেশ কয়েকটা বামপন্থী দল বা উপদল বিভ্রান্তি সত্ত্বেও, নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দেশব্যাপী সাংগঠনিক বিস্তার না থাকলেও শক্তিশালী আঞ্চলিক সংগঠন ছিল এইসব দলগুলির।
সিরাজ শিকদারের পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল বরিশালের পেয়ারাবাগানে। এই প্রতিরোধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছেন, এমন একজন, ঝালকাঠির অঞ্জলি রায় গুপ্তার মুখে শোনা যাক [৫],
“একসময় গুলি থেমে গেলে গর্ত থেকে বেরিয়ে দেখি, পুরো জঙ্গল পরিষ্কার হয়ে গেছে। ওদিকে আগুনে আমাদের বিশাল বাড়ি পুড়ে ছাই। সেই ছাই ছুঁয়ে আমরা ভাইবোনরা শপথ নিলাম, দেশ শত্রুমুক্ত করব। বাবা সুশীল কুমার রায় শুধু একটি বাক্যই উচ্চারণ করলেন। বললেন, ‘মরতে যখন হবেই, একটা পাকিস্তানি সেনা মেরে তারপর মরো।’ আমরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তারিখটা মনে নেই। যতটা মনে পড়ছে, তখন ছিল মে মাস। বাড়ি থেকে আড়াই কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বিলের মধ্যে পেয়ারাবাগানে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করলাম। আমার সঙ্গে একমাত্র ভাই শ্যামল রায় আর তিন বোন_ সন্ধ্যা রায়, মণিকা রায় ও সুদীপ্তা রায় সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে পেয়ারাবাগানে যুদ্ধে অংশ নেয়”।
সিরাজ শিকদারের দলে যুদ্ধ করেছেন, এমন আরেকজন, আলমতাজ বেগম – যুদ্ধের সময় নবম শ্রেণীতে পড়তেন। আলমতাজ লিখেছেন [৬],
“ আমার নেতৃত্বেও হানাদার বাহিনীর সঙ্গে গেরিলাযুদ্ধ হয়েছিল। ঝালকাঠির গাবখান চ্যানেল দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি স্পিডবোট যাচ্ছিল। খবরটা আমরা আগেই পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, সেখানে ছয়-সাতজন মিলে হামলা চালাব। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করার মতো অস্ত্র আমাদের ছিল না। সিরাজ শিকদারের নির্দেশে আমি গেরিলা কায়দায় পাকিস্তানি গানবোটে গ্রেনেড আর হাতবোমার হামলা করি। আমার হামলায় গানবোট নদীতে ডুবে যায়। এবারও গানবোটের সব পাকিস্তানি সৈন্য মারা যায়”।
সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, সদ্যবিধবা শোভা রানী মন্ডল, নিজ ভাষ্য অনুযায়ী, স্বামী হত্যার প্রতিশোধ নিতে। যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ঊনিশ বছর। তিনি বলছেন [৭],
“সিরাজ শিকদার ছিলেন এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। তিনিই আমাকে ট্রেনিং দিয়েছেন এবং বুঝিয়ে-শুনিয়ে মুক্তিবাহিনীতে নেন। সেখানে তিনি ছেলেমেয়েদের ট্রেনিং দিতেন এবং বিভিন্ন জায়গায় তাদের অপারেশন করতে পাঠাতেন”।
মুক্তিযুদ্ধে নিজ দল কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির তৎপরতা সম্পর্কে হায়দার আকবর খান রনো বলছেন [৮],
“শিবপুর থেকে অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। এছাড়া ভারতের কলকাতা ও আগরতলা থেকেও মুক্তাঞ্চলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা হয়েছিল। সমন্বয় কমিটির যুদ্ধ কৌশল ছিল দ্বিবিধ। এক, দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা ঘাঁটি গড়ে যুদ্ধ করা। সে ক্ষেত্রে প্রধানত শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অস্ত্রই ছিল আমাদের অস্ত্র সংগ্রহের প্রধান উৎস। আমরা ভারত সরকারের কোনো রকম সাহায্য পাইনি। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে মুক্তিবাহিনীর মধ্যে আমাদের কর্মীদের ঢুকিয়ে দেওয়া। কারণ মুক্তিবাহিনীতে রিক্রুট করার ক্ষেত্রে বাম কমিউনিস্ট ন্যাপ কর্মীদের বাদ দেওয়ার নির্দেশ ছিল। তবে জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, কর্নেল নুরুজ্জমান (তিনি নিজেও মার্কসবাদে বিশ্বাসী ছিলেন), মেজর জলিল, মেজর মনজুর আহমেদ প্রমুখের যথেষ্ট সহযোগিতা আমরা পেয়েছিলাম। তারা বামপন্থীদের ঘাঁটি এলাকায় অস্ত্র সরবরাহ পর্যন্ত করেছিলেন। বামপন্থীদের পক্ষে সবচেয়ে আন্তরিক ছিলেন সেক্টর কমান্ডার কর্নেল নুরুজ্জমান”।
অন্য এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন [৯],
“যুদ্ধ সম্পর্কে মূল্যায়নে ভ্রান্তি থাকলেও ইপিসিপি (এল)-এর বিভিন্ন অংশও বিচ্ছিন্নভাবে সাহসী যুদ্ধ করেছেন। যেমন নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ এলাকায় যথা চর জঙ্গলিয়া ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে ঘাঁটি এলাকা তৈরি হয়েছিল মহম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে। সশস্ত্র তৎপরতা রামগতি ও সুধারাম থানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দেবেন শিকদার-আবুল বশারের নেতৃত্বাধীন বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির বিএম কলিমুল্লাহর নেতৃত্বে চাঁদপুরে এক বিশাল বাহিনী ও ঘাঁটি এলাকা গড়ে উঠেছিল।
ঢাকায় যুদ্ধরত ক্র্যাক প্লাটুনেও ছিলেন বামপন্থী ছাত্রকর্মীরা। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটির অধীনস্থ বরিশাল অঞ্চলের যুদ্ধ (অধ্যাপক আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন), কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম অঞ্চলের যুদ্ধ, বাগেরহাটে রফিকুল ইসলাম খোকনের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ ও বিশাল গেরিলা বাহিনী এবং সাতক্ষীরার তালা থানায় কামেল বখতের নেতৃত্বাধীন গেরিলা সংগ্রাম বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে”।
ভাষা আন্দোলনের কিংবদন্তীতূল্য সৈনিক আব্দুল মতিনও চীনপন্থী পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেন [১০],
“স্বাধীনতার তিরিশ বছর পরেও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এখনও চলছে। কে বলে আমরা মুক্ত হয়েছি? আপনি যে অভিযোগ করলেন ১৯৭১ সালে আমরা কিছু করিনি। আমাদের পার্টি খুবই সক্রিয় ছিল। আমরা আর্মির সাথে লড়াই করেছি। তোয়াহা সাহেব তার এলাকায় নোয়াখালীতে ফাইট করেছেন। কয়েক জায়গায় সম্মুখ যুদ্ধও করেছেন তিনি। কোনোদিন প্রকাশ্যে আহাজারি বা দাবি করেন নাই যে, তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। প্রকৃত দেশপ্রেমিকের মতো তিনি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন।
আমাদের এলাকায় উত্তরবঙ্গে আমরা ফাইট করেছি। ভারতে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। পাকবাহিনীর অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে যুদ্ধ করেছি। আওয়ামী লীগের বড় নেতারা আমাদের খবর জানতেন। তাজউদ্দীন আমাদের ত্যাগের কথা জানতেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে স্বাধীনতাকে তাদের একমাত্র অর্জন করে অন্যদের করলেন উপেক্ষা। সব পদক খেতাব নিয়ে গেলেন তারা। যুদ্ধ তারা একাই করেছেন বোঝালেন শেখ সাহেবকেও। জাতীয় চিন্তার ফাটল তারাই ধরিয়েছেন। আমরা আওয়ামী লীগের অত্যাচারের বিরোধিতা করেছি। কোথাও আমাদের এতটুকুও জায়গা দেয়া হয় নাই। আমাদের অনেক নেতা-কর্মীকে নির্মমভাবে বিনা বিচারে তারা হত্যা করেছে। এখনও এই হীন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন দেশ স্বাধীন হলো আমরা দেশের ভেতরেই ছিলাম। তারা সব ভারত থেকে এসে বড়াই করা শুরু করল। কিন্তু দেশের মধ্যে থেকে পাকবাহিনীর অস্ত্র ছিনিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা যোদ্ধা আমরা। আমরা তো এখানে ছিলাম। আর্মিরা আমাদের মা-বোনদের অত্যাচার করেছে। গুলি করে মেরেছে। গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। এসবের মধ্যে আমরা যুদ্ধ করেছি। ভারতে আমাদের দু’চারজন কর্মী যখন ট্রেনিং ক্যাম্পে গেছে তাদেরকে ট্রেনিং না দিয়ে হাত-পা বেঁধে হত্যা করা হয়েছে”।
আর ছিলেন লেঃ কর্নেল তাহের। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গোপনে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত হয়ে এই বীর যোদ্ধা দেশে এসেছিলেন, যুদ্ধে অংশগ্রহন করার জন্য। তাহের ময়মনসিং-এর হালুয়াঘাটে সম্মুখ যুদ্ধ করে পা হারিয়েছেন। তিনিও দেশের মাটিতে থেকেই যুদ্ধ করার পক্ষপাতী ছিলেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চরিত্র কিরকম হওয়া উচিত এ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ছিল তাহেরের। তাই হয়তো পরে বলতে পেরেছিলেন [১১],
“১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য স্বাভাবিক বিজয়ের ফলশ্রুতি ছিল না। ১৬ ডিসেম্বর ছিল দেউলিয়া রাজনীতির অধৈর্যতার ফল। তথাপি মুক্তিযোদ্ধারা তখন সশস্ত্র চরম শক্তির অধিকারী। কিন্তু নেতৃত্বের শূন্যতায় কখন যে নেতৃত্ব ও ক্ষমতার হাত বদল হয়ে গেলো তা মুক্তিযোদ্ধারা উপলব্ধি করতে পারলো না। শুধু মুক্তিযোদ্ধা কেন , সরল প্রাণ বাংলার মানুষও বুঝতে পারলো না যে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃতরুপে নিশ্চল করে দেয়া হয়েছে। জয়ী হয়েও মুক্তিযোদ্ধারা হেরে গেছে”।
বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না, কিন্তু দেশের মাটিতে থেকে যুদ্ধ করেছেন এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়ে কাদের সিদ্দিকী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। তিনি ছুটিতে ছিলেন নিজ এলাকা টাঙ্গাইলে। তিনি টাঙ্গাইলের ছাত্রযুবকদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ব মেনে নিয়েও তিনি স্বতন্ত্র ধারায় দেশের মাটিতে থেকে নিজস্ব কাদেরিয়া বাহিনী সংগঠিত করেন। তাঁর বাহিনীতে তিনি বামপন্থীদেরও যোদ্ধা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
ভারতে আর দেশের মাটিতে বামপন্থী দলগুলোর ভুমিকা আর কার্যক্রম সম্পর্কে আমি একাত্তরের সেই দিনগুলোতে তেমন কিছুই জানতাম না। জানার উপায়ও ছিল না। ওপরে যা লিখলাম তা জেনেছি অনেক পরে। জেনে বুঝতে পেরেছি, আমাদের যুদ্ধের ওপরে ভারত সরকারের কর্তৃত্ব, আমি তখন যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও, অনেক বেশি প্রবল ছিল।
উপলদ্ধি করতে পেরেছি, কেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, অভিজ্ঞ, আর স্বাধীনচেতা রাজনীতিক শেখ মুজিব ভারতের নুন খেতে চান নি, কেন তিনি পঁচিশে মার্চের রাতে ভারতে যাওয়ার সুযোগ থাকা সত্বেও, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে বসেছিলেন। সাহসী মানুষ ছিলেন তিনি। ছিলেন বিচক্ষণও, অন্তত তাঁর ভারতে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে এ কথা বলা চলে। আমরা জানি, মওলানা ভাসানীকেও গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল ভারতে। ভারতে গেলে শেখ মুজিবেরও যে একই পরিণতি হতো না, নিশ্চিত করে বলার উপায় নাই।
স্বভাবতই, বামপন্থীরা (মস্কোপন্থীদের বাদ দিয়ে) গণচীনের ভূমিকায় বিভ্রান্তিতে থাকলেও, আশাহত হলেও, হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে নি। পাকিস্তানীদের সহযোগিতা, বা রাজাকারি করা তো দূরের কথা, তারা বীরত্বের সাথে পাকসেনাদের সাথে যুদ্ধ করেছে। তোয়াহার নেতৃত্বাধীন অংশটি, যারা একাত্তরের যুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি’ হিসেবে মূল্যায়ন করেছিল, তারাও মূলতঃ একটা কুকুরকেই ঠ্যাঙ্গানি দিতে ব্যস্ত ছিল। যদিও অন্য কুকুরটার কামড় থেকেও আত্মরক্ষা করে চলতে হয়েছিল তাদের। তবে এধরনের অসময়োচিত আর হঠকারি বাগাড়ম্বরের জন্য লাগামহীন অপপ্রচারের আর অপবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাদের তখন, যুদ্ধপরবর্তী সময়ে এবং এখনও। সেই সময়ে বামপন্থীদের মানসিক দোলাচল চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে [১২],
“১৯৭১ সালের সংগ্রামে এই ছিল এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব। আমি বাঙালি। আমি বাংলাদেশ চাই। আমি চাই বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধে জয়লাভ করুক। কিন্তু আমি জানি এ যুদ্ধে বাঙালির মুক্তি আসবে না। এ যুদ্ধে শোষণমুক্ত বাংলাদেশ হবে না। … সুতরাং বাংলাদেশের যুদ্ধের ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিত্ব দ্বিধাবিভক্ত। আমার জন্মভূমির টান আমাকে আবেগমথিত করে। আমার যুক্তি ও প্রজ্ঞা আমাকে বিপরীত কথা বলে।
“১৯৭১ সালের সংগ্রাম তত্ত্ব ও ব্যবহারিক জীবনের মাঝখানে ছিল এক পর্বতপ্রমাণ দেয়াল। আমি তত্ত্ব দিয়ে বুঝেছি এ সংগ্রাম সঠিক নয় বলে ব্যাখ্যা দিয়েছি। কিন্তু নিত্যদিনের জীবনে এ সংগ্রামকে সফল করার জন্যে সর্বস্ব দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছি। তবুও বিতর্কের শেষ হয় নি।…”
যাই হোক, ফিরে আসি আবার চট্টগ্রাম শহরে, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিনগুলোতে। গভীরভাবে চিন্তা করার পর, ঝুঁকিপূর্ণ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিলাম। পরে জানতে পেরেছিলাম সেই নেতৃস্থানীয় কর্মী, যার কথা একটু আগে বলছিলাম, তাঁর উদ্যোগে চাটগাঁ শহর থেকে আমাদের দু’জন দলীয় সহকর্মী সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে। অকথ্য অত্যাচারের পরে একজন মারা যায়, আরেকজনকে মৃতপ্রায় অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কারা যেন ফেলে যায়। সে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। অপু, যে মারা যায়, আমার কাছাকাছি বয়সের ছিল, একসাথে মিছিল-সমাবেশ করেছি। তাঁর মৃত্যুর কথা জানতে পেরে ভীষণ মানসিক আঘাত পেয়েছিলাম আমি। অপু নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ছিল। উপার্জনক্ষম হয়ে পরিবারের হাল ধরবে এই ছিল তার বাবা-মায়ের আশা। কিন্তু অপু শুধু তার পরিবারের কথাই ভাবে নি, ভেবেছিল পুরো দেশের কথা। দেশের মানুষকে বাঁচাতে চেয়েছিল সে, শুধু নিজে বাঁচতে নয়।
চট্টগ্রাম শহরে আমাদের দলের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে সেনাবিরোধী কর্মকান্ডের সাথে তখন যারা জড়িত ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন শফিক ভাই, সৈয়দ শফিকউদ্দিন আহমেদ (এখন যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাটে থাকেন)। তাঁর সাথে যোগাযোগ হলো। মনে হলো আমাকে কাজে লাগাতে চান। যুদ্ধকালীন অবস্থায় প্রথম সাক্ষাতেই জানতে চাইলেন, আমার ভাই-টাই আছে কি না। প্রথমে বুঝি নি, এমন প্রশ্ন কেন। একটু পরেই বুঝলাম, আমি যদি বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে হই, শফিক ভাই প্রাণের ঝুঁকি আছে এমন কাজে আমাকে পাঠাতে চান না। ওনার জন্য মনে নতুন করে শ্রদ্ধা জাগলো। তবে ভাই থাকা না-থাকাটা অন্তত আমার কাছে বিবেচ্য ছিল না তখন। নানা কারণে আমার মন দোদুল্যমান ছিল। তেমন কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শেষপর্যন্ত আমি যাই নি।
প্রায় পাঁচ মাস পরে কলেজে (চট্টগ্রাম কলেজ) গেলাম। সামরিক সরকার জনজীবনে স্বাভাবিকতা আনার প্রয়াসে কলেজ খুলে দিয়েছিল। এইচএসসি পরীক্ষার তারিখও ঘোষণা করা হয়েছে দেশব্যাপী। কাগজে-কলমে আমিও পরীক্ষার্থী। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, পরীক্ষা দেবো না। বাবা-মাও সায় দিয়েছেন আমার এই সিদ্ধান্তে। আমি এবং আমার এক সমমনা বন্ধু মিলে ঠিক করলাম আমাদের পরিচিত সব পরীক্ষার্থীদের বাড়ির ঠিকানা যোগাড় করে চিঠি পাঠানো হবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করার আবেদেন জানিয়ে। আমরা শহরের একটা প্রেস থেকে প্রচারপত্র ছাপিয়ে ব্যাপকভাবে প্রচারকাজ চালিয়েছিলাম। কাজটা খুব একটা কঠিন না হলেও কিছুটা ঝুঁকি আমরা নিয়েছিলাম।
মজা লাগছিল যখন পরিচিত বন্ধুবান্ধবরা এই চিঠি পেয়ে তাদের শঙ্কার কথা জানাচ্ছিল আমাদেরই কাছে। আমি আর আমার সেই সহযোগী বন্ধু বাধ্য হয়ে কিছু না জানার ভান করছিলাম। বলেছিলাম, আমরাও এ ধরনের চিঠি পেয়েছি আর পরীক্ষা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
অবাক হয়ে দেখলাম আমার চেয়েও রাজনীতিতে (ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন) যারা বেশি সক্রিয় ছিল তাদের মধ্যে অনেকেই পরীক্ষা দেয়ার ব্যাপারে উৎসাহী। জামাতে ইসলামী সমর্থিত ইসলামী ছাত্র সংঘের অনুসারীরা তো আছেই। শুধু আমার হিন্দু সহপাঠীদের দেখা পাচ্ছিলাম না। খুব দুর্দিন তখন ওদের। হয়তো ভারতের কোন শরণার্থী শিবিরে কষ্টে দিন গুজরাণ করছিল তখন ওরা। হয়তো হানাদারদের হাতে প্রাণ দিয়েছে কেউ। আর কেউ হয়তো প্রাণ হাতে নিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে কোথাও। হয়তো ট্রেনিং নিচ্ছে কেউ সীমান্তের ওপারে, কেউ হয়তো অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নেমেছে দেশের ভেতরেই। কি ভাবে জানবো? জানার কোন উপায় ছিল না। ওদের জন্য মন খারাপ হতো খুব। আর কিছু না হলেও শুধু ওদের কথা ভেবেই আমাদের পরীক্ষা দেয়া উচিৎ হবে না ভেবেছিলাম আমি।
সেপ্টেম্বর মাসের কোন একদিন হবে, দুপুরে একাই হেঁটে যাচ্ছিলাম কে.সি. দে রোডের মোড়ে অবস্থিত সিনেমা প্যালেসের দিকে – কেন যাচ্ছিলাম মনে নেই, তবে ছবি দেখতে নয়। দূর থেকে দেখলাম হোটেল ডালিমের সামনে একদল তরুণ জটলা পাকিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। হোটেল ডালিমের মালিক ছিলেন এক হিন্দু ভদ্রলোক। ইসলামী ছাত্র সঙ্ঘের ছেলেরা হোটেলটা দখল করে তাকে আলবদরের ঘাঁটি বানিয়েছে। নুতন নাম দিয়েছে হোটেল সলিম। রং দিয়ে ‘ডা’-কে মুছে বানিয়েছে ‘স’। শুনেছি এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের আর হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের ধরে এনে অত্যাচার করা হতো।
দেখলাম তাদের মধ্যে একজন আমার চেনা, ছাত্র সঙ্ঘের কর্মী। আমি একটু দূর থেকেই দেখেছিলাম, ছেলেটা আমাকে দেখতে পায় নি। আমার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা তার অজানা নয়। মনে হলো, এই সময়ে, তাও আবার হোটেল সলিমের সামনে, তার চোখে পড়াটা ঠিক হবে না। এবাউট টার্ণ করে উলটোদিকে হাঁটতে শুরু করলাম আবার। কি ভয়ঙ্কর সময়টাই না গেছে তখন!
মাঝে মাঝেই আলবদরের বা আলশামসের ছেলেরা তাদের চোখে সন্দেহভাজনদের বাড়ি-বাড়ি তল্লাশি করতো। আমার এক সহপাঠী বন্ধুকে তারা ধরে নিয়ে গেল তাদের ঘাঁটিতে, অপরাধ – তার কাছে শংকরের লেখা ‘এপার বাংলা, ওপার বাংলা’ বইটা পাওয়া গেছে। যারা বইটা পড়েছেন তারা জানেন এটি কোন রাজনৈতিক বা ‘দুই বাংলার এক হওয়া’ নিয়ে লেখা কোন বই নয়। ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’ শংকরের আমেরিকা ভ্রমণ আর আমেরিকায় প্রবাসী, তাঁর দেখা বাঙালিদের নিয়ে লেখা। কিন্তু ধর্মান্ধদের কাছে বইয়ের শিরোনামটাই তার অধিকারীর অপরাধ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট ছিল তখন, বিজাতীয় শক্তি কর্তৃক অধিকৃত আমার জন্মভূমিতে।
আমার বন্ধুটিকে তার বাবা অবশেষে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম হন। তিনি একটা বীমা কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন। সেখানে সেক্রেটারির কাজ করতেন আকর্ষণীয় ফিগারের অধিকারী এক তন্বী-তরুণী, নাট্যাভিনেত্রী। তার সাথে নাকি পাক আর্মি অফিসারদের দহরম-মহরম ছিল। অনন্যোপায় হয়ে তার শরণাপন্ন হলেন আমার বন্ধুটির বাবা। শুনেছিলাম, কাজ হয়েছিল ওতেই।
আমাদের পাড়ার তরুণদের মধ্যে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তথ্য সংগ্রহের কাজ করতেন। এমন একজন ছিলেন ছাত্রলীগের কর্মী মনসুর ভাই। একদিন আমার বাবার বন্ধুস্থানীয় একজন সরকারী অফিসার বাবাকে খবর দিলেন, পাড়ার কিছু তরুণ যুবকের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজের অভিযোগ রয়েছে সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে – তিনি জানতে পেরেছেন গোপন সূত্রে। ভাগ্যক্রমে আমাদের দুই ভাইয়ের নাম এই লিস্টে ছিল না। যাদের কথা বললেন, তাঁর ধারণা, এদেরকে অচিরেই ধরে নিয়ে যাবে আর্মি। তাদের মধ্যে একজন আমার পরিচিত, মনসুর ভাই। সাথে সাথে মনসুর ভাইকে খবর দিলাম। কেন জানি না, তিনি পাত্তা দিলেন না, গা ঢাকাও দিলেন না। সপ্তাখানেকের মধ্যে কারা যেন তাঁকে একরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। আর তাঁর খবর পাওয়া যায় নি। স্বাধীনতার পরে চট্টগ্রাম শহরে ছাত্রলীগ তাদের কার্যালয়ের নাম দেয় মনসুর ভবন।
মনসুর ভাইয়ের মতো এমন অনেকেই হারিয়ে গেছেন, দেশের মুক্তি চেয়ে, দেশের মানুষকে ভালোবেসে। মনসুর ভাইয়ের নামে তবুও একটা ভবনের নাম হয়েছিল। সেই যে অপুর কথা বলেছিলাম, তার নামে কিছুই হয় নি।
পাড়ায় যুবা বয়সের এক হিন্দু ভদ্রলোকের সাথে দেখা হতো, কথা হতো। কেরানির চাকরি করতেন কোন এক সরকারি অফিসে। কেন জানি না, উনি দেশেই থেকে গিয়েছিলেন, ভারতে যান নি। একদিন কথায় কথায় বলছিলেন, দেশ স্বাধীন হলে আর চাকরি করবেন না, একটা দোকান দেবেন, স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে উপার্জন করবেন। দোকানের নাম হবে ‘বাংলাদেশ স্টোর’। স্বাধীনতার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা আরো অনেক গভীরতর স্বপ্নের জন্ম দিয়েছিল তাঁর মনে। স্বাধীন দেশ আর মুক্ত জীবনের স্বপ্ন একাকার হয়ে গিয়েছিল তাঁর চোখে। এরি মধ্যে একবার সপ্তাহান্তে দেশের বাড়িতে গিয়েছিলেন। আর ফিরে আসেন নি। বাস থেকে নামিয়ে আরো কয়েকজনের সাথে তাকেও পাকিস্তানী সৈন্যরা গুলি করে মারে। হতভাগ্য সেই ভদ্রলোকের নাম এখন আর আমার মনে নেই, চেহারাটা এখনো স্মৃতির পটে উজ্জ্বল।
দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষ। গ্রামে-গঞ্জে যুদ্ধও করেছিলেন তাঁরাই। কৃষক, শ্রমিক আর তাদের সন্তান, ছাত্রযুবারা। আর তাঁদের অধিকাংশ যুদ্ধ করেছিলেন দেশে থেকেই। তাঁদের রক্ত ঝরেছে দেশের মাটিতে। ভারতে গেলেও ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র নিয়ে দ্রুতই তাঁরা ফিরে এসেছেন দেশে যুদ্ধের জন্য। যাঁরা ট্রেনিং আর অস্ত্র দেশের মাটিতেই পেয়েছেন, তারা ভারতে গিয়ে সময় নষ্ট করেন নি। ভারতে অবকাশযাপনের মতো করে সময় কাটিয়েছেন মূলত রাজনীতিকেরা। আর উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের কয়েকজন। এমন কি বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীও। তিনি নাকি গেরিলা যুদ্ধকে যুদ্ধই মনে করতেন না।
অথচ, মুক্তিযুদ্ধের আলোচনায় সাধারণ লুংগি-গেঞ্জি পরা যোদ্ধাদের কথা বলাই হয় না। শোভারানী মন্ডল বা আলমতাজ বেগমদের মতো গ্রাম্য মেয়েদের কথাতো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ঠাঁই পায় নি। তাঁরা বামপন্থীদের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছিল সে দোষে তো বটেই তবে সবচেয়ে বড় কারণ মনে হয় এই যে, এঁরা গ্রাম্য চাষা-ভূষা-মজুর শ্রেণীর মানুষ ছিল।
সাহেব-বাবুদের সামনে আজীবন বিনয়ে বিগলিত হতে অভ্যস্ত যে কৃষক, শহুরে বড়লোকদের লাথি-লাঠিতে গা সওয়া যে শ্রমিক, আর তাঁদের সন্তানেরা -আমি তাঁদেরকেই দেখেছি অসীম সাহসের সাথে, তীব্র আত্মমর্যাদার অনুভূতি নিয়ে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। কিন্তু কোন কৃষক পেয়েছেন বীর প্রতীক উপাধি, কোন শ্রমিককে দেয়া হয়েছে বীর উত্তম খেতাব, আমি শুনি নি।
এতে মর্মাহত হয়েছি, বিস্মিত হই নি। যুদ্ধের কর্তৃত্বটা যাদের হাতে ছিল তাদের শ্রেনী চরিত্রের কারণে এর অন্যথা হতে পারতো না।
এরি মধ্যে শীতকাল এসে গেল। কিন্তু শুকনো মওসুমের সুবিধা নিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের যুদ্ধ করার খায়েশ বুঝি আর মিটলো না। ভারত সরকার আর অপেক্ষা করতে রাজি নয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উভয় পক্ষের কূটনৈতিক তৎপরতা তুঙ্গে উঠেছে। জাতিসঙ্ঘে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসছে ঘন ঘন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পাকিস্তানী লবি চাচ্ছে ভারতকে ঠেকাতে তথাকথিত যুদ্ধবিরতি চাপিয়ে দিয়ে। আর অন্য দিকে ভারতের অভিপ্রায় হচ্ছে স্বল্পমেয়াদী যুদ্ধে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলাদেশে পাকবাহিনীকে পরাভূত করা আর আওয়ামী লীগের জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা নিশ্চিত করা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সোভিয়েত রাশিয়া আছে ভারতের পক্ষে।
ভারত কি সরকারীভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করবে? প্রশ্নটা আর ‘যদি’ দিয়ে শুরু হয় না, শুরু হয় ‘কবে’ বা ‘কখন’ দিয়ে। অবশেষে ডিসেম্বরের তিন তারিখ থেকে আকাশযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। চট্টগ্রামে আমরাও প্রতিদিন ভারতীয় যুদ্ধবিমানের গগনবিদারী আওয়াজ শুনতে থাকলাম। এই যুদ্ধে যে পাকিস্তানের শোচনীয় পরাজয় অত্যাসন্ন এ সত্যটা সবাই উপলদ্ধি করতে পারছিল তখন।
বিবিসি’র খবরেই সব জানা হতো। লুকিয়ে বিবিসি শুনতাম আমরা। পাড়ার আলবদর-আলশামসদের উপদ্রব ছিল। রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো তারা কেউ বিবিসি বা স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শুনছে কিনা দেখার জন্য।
রেডিও পাকিস্তানের খবরও শুনতাম আর হাসতাম। সরকার কবীরউদ্দিন বাংলায় খবর পড়তেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। একবার শুনলাম, “আমাদের সোনারা বীরবিক্রমে…”। আমাদের ‘সেনারা’ বলতে গিয়ে বলেছেন আমাদের ‘সোনারা’। ইচ্ছে করে এমনটা বলেছিলেন কিনা জানি না, তবে সেই বিপদের মধ্যেও একচোট হেসে নিলাম আমরা। প্রতিবেশীদের একজনের মন্তব্য এখনো কানে বাজে, “আহারে, সোনারা!”
খবরে জানা গেল বঙ্গোপসাগরে কাছাকাছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর পাঠাচ্ছে পাকিস্তানের পক্ষে। এই খবরে উদ্বিগ্ন আমরা। ভারত-সোভিয়েত অক্ষকে ভয় পাইয়ে জাতিসঙ্ঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব গেলানো ছিল এই আস্ফালনের উদ্দেশ্য। কাজ হয় নি তাতে। সোভিয়েত রাশিয়া সময়মতো নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দিয়ে ঠেকিয়ে দেয় যুদ্ধবিরতি। ঢাকায় পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর পতন সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
পাড়ার বিহারী প্রতিবেশীরা উদ্বিগ্ন। পাশার দান উলটে গেছে তাদের জীবনে। কিছুদিন আগেও তারা দাপটের সাথে হেঁটে বেরিয়েছে রাস্তায়।
ষোলই ডিসেম্বর। ঢাকার পতন হয়েছে। বিকেলে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেছেন আত্মসমর্পণকারী নিয়াজী আর বিজয়ী ভারতীয় সেনাবাহিনীর অরোরা।
সতেরই ডিসেম্বর, ঊনিশশো একাত্তর। শুক্রবার। বিজয় দিবসের পরের দিন। কিন্তু চট্টগ্রামে সেদিনই আমরা প্রথম বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করছিলাম। আগেরদিন ঢাকায় যে কি হচ্ছে তা নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা শুনেছি, নিশ্চিতভাবে কিছু জানার উপায় ছিল না। মা বললেন, ভারত যেদিন স্বাধীন হয়েছিল (সাতচল্লিশের পনেরই আগস্ট) সেদিনটাও শুক্রবার ছিল। মা’রা তখন কোলকাতায় ছিলেন। সেই কবেকার কথা, কিন্তু তাঁর তখনও মনে ছিল। আজ এত বছর পরে আমারও মনে আছে একাত্তরের সতেরই ডিসেম্বর শুক্রবার ছিল।
রাস্তায় বেরিয়ে পরলাম। বেরোতেই দেখলাম, এক চুনোপুটি রাজাকারকে ধরে উত্তম-মধ্যম দিচ্ছে পাড়ার ছেলেপিলেরা। পালাবার সুযোগ পায় নি বদমাইশটা।
সাধারণ মানুষের চোখেমুখে আনন্দ। বিরাট এক ফাঁড়া থেকে রেহাই পাওয়া গেছে। পাক মিলিটারির হাতে বেঘোরে প্রাণ হারাবার ভয়টা আর নেই। যুদ্ধের সেই নয় মাস মৃত্যু আমাদের খুব কাছেই ছিল, অদৃশ্য সাপের মতো যেন পায়ের কাছেই ঘুরঘুর করছিল, ছোবল মারার অপেক্ষায়। বেঁচে যে গেছি, সেটাই এক আশ্চর্য ব্যাপার। মনে আছে যুদ্ধের পরে কলেজে বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখা হলে স্বাভাবিক সম্ভাষণ ছিল, “বেঁচে আছিস তাহলে”!
ভারতীয় সৈন্যরা ঘাঁটি গেড়েছে শহরের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র স্টেডিয়াম সংলগ্ন সার্কিট হাউস ভবনে। ভবনের চত্বরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেপাইরা।
মানুষ এদের দেখে আমোদিত। হাত মেলাতে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। ‘স্ট্যান্ডএটইজ’ ভঙ্গীতে দাড়ানো কৃশকায়, সমরক্লান্ত, ভিন্নভাষী ভারতীয় সৈন্যদের কেউ কেউ নিস্পৃহ ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, কেউ দিচ্ছে না।
সার্কিট হাউস থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলাম। নানা চিন্তা মনে আসতে থাকলো। আমরা কি চেয়েছিলাম আর কি পেলাম, হিসেব মেলাতে পারছিলাম না। তখনই মনে হয়েছিল, দেশের ‘মুক্তিযুদ্ধ’ হয়তো শেষ হয়েছে, গণমানুষের মুক্তির যুদ্ধ শেষ হতে এখনো অনেক বাকী।
[চল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে, তবুও মনে হয় মাত্র সেদিনের কথা। যা নিজের চোখে দেখেছি তাকে ইতিহাস ভাবা যায় না, আমি ভাবতে পারি নি। তাই আমি যা লিখেছি তাকে ইতিহাস বলা যাবে না। স্মৃতিচারণ বলা যাবে কি? যেতে পারে, তবে এ শুধুই স্মৃতিচারণ নয়। আমার মনের অনুভূতি, আবেগ, পক্ষপাত, মতাদর্শ – সবকিছুর প্রতিফলন ঘটেছে এতে। প্রতারণাপরায়ন স্মৃতির সাথে লড়াই করতে হয়েছে নিরন্তর – সবসময় জিতেছি বলা যাবে না। তারপরেও কিছু কিছু ঘটনা যে ছায়াছবির দৃশ্যের মতো মনের বর্ণিল পর্দায় এমন স্পষ্ট হয়ে আঁকা আছে দেখে নিজেই অবাক হয়েছি। স্মৃতিচারণ না হলেও লেখাটা স্মৃতিনির্ভর। লিখেছি মনের তাগিদে, স্বতস্ফুর্ততার সাথে। এতে লেখাটা সমৃদ্ধ হয়েছে না তার অঙ্গহানি ঘটেছে – বিচারের ভার পাঠকের ওপরে রইলো।
মুক্তমনা আর অভ্র না থাকলে এই লেখাটা শুরুই হতো না, আর লেখাটা শেষ হতে পেরেছে মুক্তমনার ফরিদ আহমেদ, অভিজিৎ রায় আর কেয়া রোজারিও’র উৎসাহ আর তাগাদার জন্য। তাঁদেরকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ পাওনা মুক্তমনার পাঠকদেরও, অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন আপনারাই।]
তথ্যসূত্রঃ
[১] হায়দার আকবর খান রনো, “ফিরে দেখা বিজয় দিবস”, দৈনিক আমারদেশ, ১৬ ডিসেম্বর ২০০৭। http://events.amardesh.com/articles/33/1/aaaa-aaaa-aaaa-aaaa/Page1.html
[২ ] হায়দার আকবর খান রনো, “শতাব্দী পেরিয়ে”, তরফদার প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৫, পৃ. ২৭৬।
[৩] নির্মল সেন, “আমার জবানবন্দী”, তরফদার প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৬, পৃ ২৭৮।
[৪] ঐ, পৃ ২৭৫।
[৫] বাড়িপোড়া ছাই ছুঁয়ে পাঁচ ভাইবোন শপথ নিই দেশ শত্রুমুক্ত করব, “প্রিয় মুক্তিযুদ্ধ”,
Submitted by Tuhin Khandakar on Mon, 2011/03/21,
[৬] একাত্তরের বিজয়িনীঃ শত্রুর গানবোট গ্রেনেড মেরে ডুবিয়ে দিই, “নিউজ বাংলা”, http://www.news-bangla.com/index.php?option=com_content&task=view&id=6081&Itemid=53
এবং “কালের কন্ঠ”,
http://www.dailykalerkantho.com/print_news.php?pub_no=361&cat_id=1&menu_id=13&news_type_id=1&index=4
[৭] শোভা রানী মন্ডল, স্বামী হত্যার প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধে যাই, “প্রথম আলো”, তারিখ: ১৬-১২-২০১০। http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-04-08/news/116204
[৮]হায়দার আকবর খান রনো, “ফিরে দেখা বিজয় দিবস”, দৈনিক আমারদেশ, ১৬ ডিসেম্বর ২০০৭। http://events.amardesh.com/articles/33/1/aaaa-aaaa-aaaa-aaaa/Page1.html,
[৯]হায়দার আকবর খান রনো, স্বাধীনতা সংগ্রামে বামপন্থীদের ভূমিকা,সাপ্তাহিক বুধবার, ২৪-৩-২০১১। http://budhbar.com/?p=4681
[১০] http://boirboi.com/ এখন amarboi.com (এই লিঙ্কে এখন লেখাটা পাওয়া যাচ্ছে না, পরে খুঁজে দেখবো আবার।)
[১১] লেঃকঃ তাহের, মুক্তিযোদ্ধারা আবার জয়ী হবে,
http://www.col-taher.com/writtings3.html
[১২]নির্মল সেন, “আমার জবানবন্দী”, তরফদার প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৬, পৃ ৩২১।
স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলিকে এত কাছে থেকে যারাঁ দেখেছেন তাঁদের নিজেদের স্মৃতিচারণ স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ ইতিহাস। ইরতিশাদ্ ভাইকে ধন্যবাদ।
অবশেষে বরিষণ! দু’চোখের ধারায় একটুখানি স্নাত।
@স্বপন মাঝি,
আশা করি, বরিষণ গর্জন অনুযায়ী হয়েছে! মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আপনার লেখা পরে হচ্ছিল আমি ই যেন সেই একাত্তরে আছি। ধন্যবাদ আপনার লেখনী শক্তিকে। (Y)
@কামরুল আলম,
ধন্যবাদ আপনাকেও, পড়ার এবং মন্তব্য করার জন্য। আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম।
তহা সাহেবের কাজের বেপারে জেড ফোর্সের কাসের উল্টা কথা সোনা গেসে , আর চীনপন্থী কমুনিস্ট দেরকে সাধু পুরুস বানানো যাবে না.
সে সময়ে ট্রেড ইউনিয়ন গুলোর ভুমিকা কেমন ছিল জানতে ইচ্ছে করে।
শেষ পর্যন্ত শেষ পর্ব ছাপালেন, সঙ্গে সঙ্গে অলিখিত চুক্তি করলেন পাঠকের সাথে আগামীতে আরো একটি সিরিজ শুরু করার।
@কেয়া রোজারিও,
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
তোমার ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত এবং অবশ্যই অসম্পূর্ণ একটা উত্তর দিচ্ছি। সত্তরে ট্রেড ইউনিয়নগুলো প্রায় সবই বামপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। (সত্তর সালে প্রথম আওয়ামী লীগের শ্রমিক সংগঠন শ্রমিক লীগ গঠিত হয়, তাও নির্মল সেনের দল থেকে কয়েকজন শ্রমিকনেতাকে ভয়-প্রলোভন দেখিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে।)
কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকাতে কমিউনিস্ট রাজনীতিকেরা প্রকাশ্যে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন করতেন। আদমজী, টঙ্গি, বাড়বকুন্ডের শিল্পাঞ্চলে শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন ছিল। আরো ছিল রেল শ্রমিক, প্রেস (ছাপাখানা) শ্রমিক, এবং এই ধরনের পেশাভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন। অনেক শিল্প-কারখানার মালিক ছিলেন অবাঙ্গালি। সে জন্যে এই শ্রমিক সংগঠনগুলো একইসাথে জাতীয়তাবাদী এবং শ্রেনীচেতনায় উজ্জীবিত ছিল।
কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে শ্রমিকেরা যে যার অঞ্চলে চলে যায়, এবং বিচ্ছিন্ন ভাবে যুদ্ধে অংশ নেয়। যে এলাকায় যেমন প্রভাব তার ওপরে নির্ভর করে। এটাকে বামপন্থীদলগুলোর আরেক ব্যর্থতা বলা যায়।
“কিন্তু কোন কৃষক পেয়েছেন বীর প্রতীক উপাধি, কোন শ্রমিককে দেয়া হয়েছে বীর উত্তম খেতাব, আমি শুনি নি।”
নাহ আমিও শুনিনি। কিন্তু হতে যে পারত না তা কিন্তু নয়। তারামন বিবি কে বীর প্রতীক দেয়া হয়েছিল অনেক বছর পর। আরো অনেক কে ই হয়ত দেয়া হত। আমাদের বীর শ্রেষ্ঠ দের নাম এর তালিকা দেখলে মনে হতে পারে শুধু সেনাবাহিনীর সদস্যরাই মুক্তিযুদ্ধ করেছিল।কিন্তু আমার মনে হয় এই পক্রিয়া টি অব্যাহত থাকত যদি কিনা ৭৫ এর ১৫ এ আগস্ট এ আমাদের স্বাধীনতা বা সাধিনতার চেতনা ছিনতাই না হত। এখন ত বিদেশীদেরও যাদের কিনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবদান ছিল তাদেরো সম্মানিত করার চিন্তা ভাবনা চলছে। প্রাথমিক ভাবে শুধু সেনাবাহিনীর সদস্যদের ই হয়ত করা হয়েছিল,কারন তারা শুধু যুদ্ধই করেননি , সঙ্ঘটিত এবং প্রশিক্ষণ ও দিয়েছিলেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা খাওয়া পরার নিশ্চয়তা দিতে পারি নাই, এটা আমাদেরর লজ্জা। কিন্তু মুক্তিজদ্ধা কল্লান ট্রুস্ট কিন্তু করা হয়েছিল যার মালিকানায় অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান ও সিনেমা হল ছিল। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হতে দেখেছি সত্যিকার এর মুক্তিযোদ্ধা কখনো মুখ ফুটে বলেন নাই তিনি মুক্তিযোদ্ধা এবং এর বিনিময় এ কিছু চান ও নাই। চাইতে দেখেছি রাজনৈতিক দালালদের ,কে প্রথম জাতীয় পতাকার নক্সা করেছে,কে পতাকা প্রথম সেলাই করেছে,কে পতাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে প্রথম তুলে দিয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে জিয়া কে স্বাধীনতার ঘোষক ও দাবী করেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা পপ শিল্পী আজাম খান এর অবদান কেউ ত জানতই না ,জাহানারা ইমাম এর একাত্তরের দিঙ্গুলি না পড়লে। বাঙালি জাতির বিরাট একটি অংশ মনে করে ১৯৭৫ এর ১৫ ই অগাস্ট যদি বঙ্গবন্ধু কে হত্যা করা না হত তা হলে তিনি আমৃত্যু বাংলাদেশের একনায়ক হিসেবে আসিন থাকতেন এবং এরপর শেখ কামাল ক্ষমতা নিত এবং সেখ জামাল সেনাবাহিনীর প্রধান হত। এই হোল বঙ্গবন্ধু কে হত্যা করার যুক্তি। যদি ধরেও নেই শেখ কামাল খুব খারাপ একজন মানুষ ছিল এবং বঙ্গবন্ধু একনায়ক হিসেবে টিকে থাকতে চেষ্টা করতেন তাইলে কি পারতেন?। আয়ুব খান ত পারে নাই। বাঙালি প্রয়োজন হলে বঙ্গবন্ধুর ও পতন ঘটাত। এটাই হোত বাঙালীর স্বাভাবিক সংগ্রাম এর ধারাবাহিকতা। কিন্তু বাঙালী পাকিস্তানের এক ই খোঁয়াড় হতে (পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী) আগত কিছু জেনারেল নামক জানোয়ার এর ওপর ভরসা করেছে। ফল যা হবার তাই ত হয়েছে।এক যাত্রায় দুই ফল হয় না।জানোয়ার কখনো মানুষ হয় না। আমাদের এখন যা অবস্থা বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তাঁর কি সেই ক্ষমতা ছিল এর চেয়ে খারাপ অবস্থা বানানোর!!।বিকলাঙ্গ এ জাতির কাফফারা দিতে হবে আরো অনেক… ততদিনে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের অস্তিত্ত বিলীন হলেও পৃথিবীর একমাত্র আপোষহীন বাঙ্গালী বেঁচে থাকবেন আমাদের মত নাড়ী ছেড়া বাঙ্গালীর মাঝে। নাহ ব্যক্তি পুজা নয় ,সত্যি কথা। উন্নাসিকরা বঙ্গবন্ধ কে সম্মান করতে লজ্জা পায় , এটা নাকি ব্যক্তি পুজা। হায়রে বাঙ্গালী যে ভগবান এর অস্তিত্ব নেই তাঁর পুজায় দিন যায় , জলন্ত অস্তিত্ব এর তাতে কি ই বা এসে যায়।
অনেকদিন পর মুক্ত-মনায় পদার্পন এবং একটা লেখা নিয়ে। ধারাবাহিকটি শেষ করার জন্য ধন্যবাদ।ঐতিহাসিক এ সিরিজটি ভাল লেগেছে।
@গীতা দাস,
সিরিজটা শেষ করতে পেরে আমারো ভালো লাগছে। ধৈর্য ধরে সাথে ছিলেন, অনুপ্রেরণাও যুগিয়েছেন, সেজন্য অনেক অনেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
খুবই মূল্যবান কিছু কথা!
@অভিজিৎ,
সহমর্মিতার জন্য ধন্যবাদ।
একাত্তর নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বেশিরভাগ লোকই আবেগপ্রবন হয়ে পড়েন। ফলে, অনেক সময়ই লেখাগুলো একপেশে হয়ে যায়। ইরতিশাদ ভাইয়ের এই স্মৃতিচারণটা সেই ধারার একেবারেই বিপরীত। একাত্তর নিয়ে এরকম নির্মোহ স্মৃতিচারণ সত্যিই বিরল। এই দশ পর্বকে একত্রিত করে একটা ই-বুক করা খুবই প্রয়োজন।
@ফরিদ আহমেদ,
অবশ্যই। শুরু করব খুব তাড়াতাড়ি।
@ফরিদ,
লেখায় যেমন বলেছি, তোমাদের অনুপ্রেরণা না পেলে মনে হয় লেখাটা শেষ করতে পারতাম না। তোমাদের ভালো লেগেছে জেনে আমারো ভালো লাগছে।
ইরতিশাদ ভাই,
সিরিজটা শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এবার সবগুলো পর্ব একসাথে পড়বো। একাত্তরের ইতিহাস যারা লেখেন, তারা বিভিন্ন কারণে পরিবর্তন করে লেখেন। খুব ইচ্ছা ছিলো আমাদের মাঝের কারো থেকে ইতিহাসটা একটু জানবো। আপনি সেই ইচ্ছা পূরণ করলেন।
পুরো সিরিজের জন্য অভিনন্দন আপনাকে। 🙂
@মইনুল রাজু,
খুব ভালো লাগলো তোমার মন্তব্য পড়ে। ধন্যবাদ।
যুদ্ধের স্মৃতিচারণ নিয়ে খুবি চমৎকার লেখা। আগের পর্ব যদিও একটাও পড়া হয়নি, এই পর্ব পড়ে মনে হল আগের পর্ব না পড়লে যুদ্ধ সম্পর্কে অনেক কিছু অজানাই থেকে যাবে।
@রাজেশ তালুকদার,
পড়েছেন, পড়বেন জেনে খুশি হলাম।
যাক, সিরিজের এই পর্বটা এলো তাহলে। আমি তো ভেবেছিলাম ইরতিশাদ ভাইকে আর খুঁজেই পাবো না।
সঠিক দিনে সঠিক পোস্ট। এবারে সবগুলো পোস্ট একসাথে করে পড়া শুরু করতে হবে। আপনার লেখা শুধু নয়, রেফারেন্সগুলোও খুব গুরুত্বপূর্ণ। (Y)
@অভিজিৎ,
অনেক ধন্যবাদ।