“it matters not what you think, it matters how you think” — ক্রিস্টোফার হিচেন্স
ব্রেভিক বিষয়ে বিপ্লব পালের চমৎকার লেখাটি পড়তে গিয়ে জর্জ অরওয়েলের Notes on Nationalism (১৯৪৫) প্রবন্ধের কথা মনে পড়ে গেল। প্রবন্ধটি অনুবাদ করা শুরু করলাম। চার বা পাঁচ পর্ব লাগবে। প্রবন্ধে অরওয়েলের নিজের কিছু ফুটনোট আছে, সেগুলি ১, ২, ৩…এভাবে নম্বরীকৃত হবে। নানান কারণে অনুবাদকের কিছু ফুটনোটও দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি, সেগুলির নম্বর হবে ১অ, ২অ, ৩অ …ইত্যাদি।
Longeur শব্দটি ব্যবহার করার প্রসঙ্গে বাইরন কোথাও লিখেছিলেন, এই ফরাসী শব্দটি যদিও ইংরেজী ভাষায় নেই, তবুও longeur বস্তুটির অভাব নেই ইংরেজী ভাষায় [১অ]। একই ভাবে, ইদানীং একটি বহুবিস্তৃত মনোভাব প্রায় প্রতিটি বিষয়ে আমাদের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করছে, কিন্তু এই মনোভাবের কোন সাধারণ নাম এখনও প্রচলিত হয়নি। কাছাকাছি কিছু একটা খুঁজতে গিয়ে “জাতীয়তাবাদ” শব্দটি বেছে নিচ্ছি। অবশ্য শব্দটি ঠিক প্রচলিত অর্থে ব্যবহার করছি না। যে আবেগের কথা বলছি তা “জাতি”-র (অর্থাৎ একটি বিশেষ নৃগোষ্ঠী বা ভৌগলিক এলাকা) সাথে সবসময় সংশ্লিষ্ট নয়। এই আবেগ সংযুক্ত হতে পারে কোন শ্রেণী বা ধর্মীয় গোত্রের সাথে, এবং এটি কোন কোন ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে মূলত ঋণাত্মক ভঙ্গিতে, অর্থাৎ সাধারণ জাতীয়তার মত নিজ জাতির পক্ষে নয়, বরং কোন একটা কিছুর বিপক্ষে।
জাতীয়তাবাদ বলতে আমি দুটি প্রবণতাকে বোঝাচ্ছি। প্রথমত, মানুষকে কীটপতঙ্গের মত বিভিন্ন প্রজাতিতে ভাগ করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে গাদা ধরে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে “ভাল” বা “মন্দ” ঘোষণা দেয়া সম্ভব, এটা ধরে নেয়ার অভ্যাস[১]। কিন্তু দ্বিতীয়ত, এবং এই ব্যাপারটি আরো গুরুত্বপূর্ণ, নিজেকে একটি বিশেষ জাতি বা এরকম কোন গোত্রের সাথে সম্পূর্ণ একীভূত করে, এই গোত্রকে ভাল মন্দের ঊর্দ্ধে বিবেচনা করে তার স্বার্থ উদ্ধারকে পরমার্থ গণ্য করার প্রবণতা। জাতীয়তাবাদকে দেশপ্রীতির সাথে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। এই দুই শব্দই এত বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয় যে যেকোন সংজ্ঞাই বিতর্কিত হতে বাধ্য, কিন্তু এদুটির মধ্যে পার্থক্য সূচনা করা জরুরী, কারণ এখানে দুটি ভিন্ন, এমনকি বিরোধী আদর্শের ব্যাপার রয়েছে। দেশপ্রীতি বলতে আমি বোঝাচ্ছি একটি বিশেষ জায়গা ও একটি বিশেষ জীবনসংস্কৃতির প্রতি ভালবাসা, যেটিকে কেউ বিশ্বসেরা বলে ভাবতেই পারে, কিন্তু অন্যের উপর তা চাপানোর ইচ্ছা তার নেই। দেশপ্রীতি তাই সাংস্কৃতিক ও সামরিক ভাবে প্রতিরক্ষামূলক। কিন্তু জাতীয়তাবাদ ক্ষমতার লোভের সাথে অবিচ্ছেদ্য। প্রতিটি জাতীয়তাবাদীর অপরিবর্তনীয় লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতা ও সম্মান, তার নিজের জন্য নয়, কিন্তু যে গোত্রের কাছে নিজের ব্যক্তিত্বকে সে বিসর্জন দিয়েছে তার জন্য।
জাপান বা জার্মান জাতীয়তাবাদের মত কুখ্যাত ও সুস্পষ্ট উদাহরণের ক্ষেত্রে আমি যা বলছি তা খুব বিতর্কিত কিছু নয়। নাৎসীবাদের মত একটি আন্দোলনের মুখোমুখি হয়ে আমাদের প্রায় সবার মুখ দিয়ে একই ধরণের মন্তব্য নির্গত হয়। কিন্তু আগে যা বলেছি তা আবারও বলি, “জাতীয়তাবাদ” শব্দটি আমি ব্যবহার করছি এর চেয়ে ভাল শব্দ পাচ্ছি না বলেই। যে বৃহত্তর অর্থে “জাতীয়তাবাদ” শব্দটি ব্যবহার করছি, সে অর্থে কমিউনিজম, রাজনৈতিক ক্যাথলিসিজম, জায়নবাদ, ইহুদী-বিদ্বেষ, ট্রটস্কিবাদ ও প্যাসিফিজম — এসবই জাতীয়তাবাদ। কোন বিশেষ সরকার বা দেশের প্রতি আনুগত্য এক্ষেত্রে জরুরী না, বা দেশ হলেও যে নিজের দেশ হতে হবে তাও নয়। বস্তুত, জাতীয়তাবাদী আবেগের পাত্রটি অস্তিত্ববান হওয়ারও দরকার নেই। কিছু সহজ উদাহরণ হতে পারে ইহুদী জাতি, ইসলাম, খ্রীস্টধর্ম, প্রলেতারিয়েত বা সাদা জাত — এসবই প্রবল জাতীয়তাবাদী আবেগের পাত্র, কিন্তু তাদের অস্তিত্ব নিয়ে কঠিন প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, এবং এদের কোন সর্বজনীন সংজ্ঞা নেই।
এখানে আবারো মনে করিয়ে দেয়া যেতে পারে যে জাতীয়তাবাদ পুরোপুরি ঋণাত্মক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু ট্রটস্কিবাদী স্রেফ সোভিয়েত-বিরোধিতায় মগ্ন, কোন বিকল্প গোত্রের প্রতি আনুগত্য ছাড়াই। এই ব্যাপারটার নিহিতার্থ বোঝা মাত্র জাতীয়তাবাদ বলতে আমি কি বোঝাচ্ছি, তা আরো পরিষ্কার হবে। নিহিতার্থটা হল, জাতীয়তাবাদী হচ্ছে এমন একজন যার চিন্তা ভাবনা পুরোপুরি, বা মূলত, প্রতিযোগিতা ও মান-সম্মানের ধারণা দিয়ে আচ্ছন্ন। সে ধনাত্মক বা ঋণাত্মক জাতীয়তাবাদী হতে পারে — অর্থাৎ তার শক্তি ব্যবহৃত হতে পারে কুৎসা রটনায় বা প্রশংসা-সংগীতে — কিন্তু সব কিছুর পেছনে আছে জয় আর পরাজয়, লজ্জা আর বিজয়-গৌরব। ইতিহাস, বিশেষত সমকালীন ইতিহাস তার কাছে বৃহৎ গোত্রগুলির অবিরাম উত্থান-পতনের কাহিনী, এবং প্রতিটি ঘটনা তার কাছে নিজের গোত্রের উন্নতি ও ঘৃণিত অপর কোন গোত্রের পরাজয়ের একটি ধাপমাত্র। তবে জাতীয়তাবাদ মানে স্রেফ সফলতার লোভ নয়। জাতীয়তাবাদী সুবিধাবাদী নয়, সবসময় শক্তিশালী দলে ভেড়ার চেষ্টা সে করেনা। বরং, একবার দল বাছাই-এর পরে তার প্রত্যয় জন্মায় যে ওই দলই সবচেয়ে শক্তিশালী, বাস্তবতার নির্মম কষাঘাতও এই অনড় বিশ্বাসে আর হেরফের ঘটাতে পারেনা। জাতীয়তাবাদ হচ্ছে আত্মপ্রতারণা মেশানো ক্ষমতালোভ। প্রতিটি জাতীয়তাবাদী অসাধারণ মিথ্যাভাষণে পারঙ্গম, কিন্তু একই সাথে নিজের সঠিকতার ব্যাপারে সে শতভাগ নিশ্চিত — এই নিশ্চয়তা আসে নিজের চেয়ে বড় কিছুর সাথে সংযুক্তির সচেতনতা থেকে।
এই লম্বা সংজ্ঞার পরে অনেকেই বোধকরি স্বীকার করবেন, উল্লেখিত মানসিক অভ্যাস ইংরেজ বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে প্রকট, এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে যতটা না, তার চেয়েও বেশি প্রকট বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে। সমকালীন রাজনীতি নিয়ে যারা গভীরভাবে ভাবিত, তাদের মস্তিষ্কে কিছু বিষয় এই মান-সম্মানের ধারণা দিয়ে এমনভাবে বিষিয়ে গেছে যে ওই বিষয়গুলিকে যৌক্তিক ভঙ্গিতে দেখা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। শত শত সম্ভাব্য উদাহরণের মধ্যে একটা: জার্মানীর পরাজয়ের পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি — সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, না আমেরিকা? এই প্রশ্নের যুক্তিভিত্তিক, এমনকি চূড়ান্ত উত্তর না দিতে পারার এমনিতে কোন কারণ নেই। কিন্তু বাস্তবে প্রয়োজনীয় হিসেব-নিকেশ করা সম্ভব না, কারণ এ বিষয়ে যে আগ্রহ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, ধরে নেয়া যেতে পারে সে তুলনামূলক সম্মানের দাড়িপাল্লা হাতেই সেটা করছে। কাজেই সে শুরুই করবে রাশিয়া, ব্রিটেন বা আমেরিকার পক্ষ নিয়ে, তারপর সে এই সিদ্ধান্তের সমর্থনে যুক্তি খোঁজা শুরু করবে। একই ধরণের অন্য বহু প্রশ্ন আছে যেগুলোর সৎ উত্তর পেতে হলে এমন কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে যার এসব ব্যাপারে কোন আগ্রহ নেই, কিন্তু সেধরণের লোকের উত্তর তার জানাশোনার অভাবের কারণে সম্ভবত মূল্যহীন। আমাদের যুগে রাজনৈতিক ও সামরিক ভবিষ্যৎবাণী করবার ক্ষেত্রে যে চরম ব্যর্থতা দেখা গেছে, এই অবস্থা তার একটা নিশ্চিত কারণ। এটা ভেবে দেখবার মত যে আমাদের এতরকম বিশেষজ্ঞের কেউই ১৯৩৯ সালের রুশ-জার্মান চুক্তির মত একটা অত্যন্ত সম্ভাব্য ঘটনা আগে থেকে অনুমান করতে পারেননি [২] [২অ]।
তারপর চুক্তি যখন শেষ অব্দি হলই, তখন ব্যাঙের ছাতার মত অসংখ্য সংগতিহীন ব্যাখ্যার আবাদ শুরু হল, সঙ্গে বিবিধ ভবিষ্যৎবাণী যা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মিথ্যা প্রমাণিত হতে লাগল — কারণ এর প্রায় প্রতিটি ব্যাখ্যার ভিত্তি ছিল সম্ভাবনার বাস্তবধর্মী বিশ্লেষন নয়, বরং সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভাল বা মন্দ, শক্তিশালী অথবা দুর্বল দেখানোর ইচ্ছা। রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকরা, ঠিক জ্যোতিষীদের মত, পিলে-চমকানো ভুল করেও টিকে যেতে পারে, কারণ তাদের ভক্তরা তাদের কাছ থেকে খোঁজে তথ্যের বিশ্লেষণ নয়, জাতীয়তাবাদী অাবেগের সুড়সুড়ি[৩]।
নান্দনিক বিশ্লেষণ, বিশেষত সাহিত্যিক বিশ্লেষণ, রাজনৈতিক আলোচনার মত একই ভাবে দূষিত হয়। একজন ভারতীয় জাতীয়তাবাদীর পক্ষে কিপলিং পড়ে আনন্দ পাওয়া প্রায় অসম্ভব, একই কথা খাটে একজন রক্ষণশীলের মায়াকভস্কি পড়ার ক্ষেত্রে। যে বইয়ের রাজনীতির সাথে আমি একমত নই, তা সাহিত্যিক দিক থেকে নিম্নমানের, এমন দাবী করার একটা প্রবণতা সবসময়ই বিদ্যমান। উগ্র জাতীয়তাবাদী অনেক সময়ই প্রায় অচেতন ভাবেই এই ফাঁদে পা দেন।
ইংল্যান্ডে, স্রেফ সংখ্যার দিক থেকে যদি বিচার করা যায়, সবচেয়ে প্রচলিত জাতীয়তাবাদ সম্ভবত উগ্র ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদের পুরনো কাসুন্দি। এই জাতীয়তাবাদ এখনও বহুবিস্তৃত সন্দেহ নেই, এবং একযুগ আগে যতটা মনে করা গিয়েছিল, তার চেয়ে অনেকটাই বেড়েছে বরং। কিন্তু এই প্রবন্ধে আমি মূলত বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে চিন্তিত, যাদের মধ্যে এই পুরনো জাতীয়তাবাদ আর নেই বললেই চলে, যদিও একটি সংখ্যালঘু গোত্রের মধ্যে তা আবার দেখা দিতে চলেছে।
বলার অপেক্ষা রাখেনা, বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে কমিউনিজম হচ্ছে সবচেয়ে বহুল প্রচলিত জাতীয়তাবাদ। “কমিউনিজম” শব্দটা আমি আলগা ভাবে ব্যবহার করছি, শুধুমাত্র কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা নয়, এই পার্টি সংলগ্ন বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণভাবে সোভিয়েত-প্রেমীরা এর অন্তর্ভুক্ত। আমি যে অর্থে ব্যবহার করছি, সে অর্থে একজন কমিউনিস্ট হচ্ছে এমন একজন যে সোভিয়েত ইউনিয়নকে তার পিতৃভূমি মনে করে, সোভিয়েত পলিসির সমর্থনকে পবিত্র দায়িত্ব মনে করে, এবং যেকোন মূল্যে সোভিয়েত স্বার্থসাধনে লিপ্ত। ইংল্যান্ডে বর্তমানে এধরণের লোক যে অসংখ্য, তা সন্দেহাতীত, এবং তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাব বিস্তর। কিন্তু অন্য বহু ধরণের জাতীয়তাবাদ বর্ধমান, এবং ভিন্ন এমনকি আপাত-বিরোধী এসব প্রবণতার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে আরো স্পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব।
আজকে কমিউনিজমের যে অবস্থান, বছর দশ বা বিশেক আগে কতকটা সেই অবস্থানে ছিল রাজনৈতিক ক্যাথলিসিজম। এই আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ ধ্বজাধারী ছিলেন জি. কে. চেস্টারটন, যদিও ঠিক প্রতিনিধিত্বকারী নমুনা না বলে তাকে বরং একটি চরম নিদর্শন ধরা যেতে পারে। এই মেধাবী লেখক তার সংবেদনশীলতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সততা জলাঞ্জলী দিয়েছিলেন রোমান ক্যাথলিক প্রপাগান্ডার বেদীতে। জীবনের শেষ বিশ বছরে তার প্রতিটি লেখাই ছিল একই জিনিসের চর্বিতচর্বন, কষ্টকল্পিত উপরচালাকির আড়ালে যার মূল কথা “জয় মা কালী”-র মতই সরল ও ক্লান্তিকর। প্রতিটি বই-য়ে, প্রতিটি ডায়লগে ওই একই কথা — প্রোটেস্টেন্ট এবং অখ্রীস্টানের তুলনায় ক্যাথলিক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক বা আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্ব চেস্টারটনের জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাঁর লক্ষ্য ছিল জাতীয় মর্যাদা ও সামরিক শক্তি। এর ফল হয়েছিল ল্যাটিন দেশগুলি (বিশেষত ফ্রান্স) সম্বন্ধে তার অজ্ঞতাপ্রসূত স্বপ্নবিলাস। চেস্টারটন ফ্রান্সে বেশিদিন বাস করেননি, এবং ফ্রান্সের যে ছবি তিনি এঁকেছেন — ক্যাথলিক কৃষকেরা যেখানে কিনা রক্তিম ওয়াইনের গ্লাসে ঝড় তুলে মারসেই গেয়ে চলেছে অনবরত — এর সাথে বাস্তবের মিল ততটুকুই, যতটুকু Chu Chin Chow এর সাথে সত্যিকারের বাগদাদের [৩অ]। ফরাসী সামরিক শক্তির ব্যাপারে তাঁর ছিল অদ্ভুত অতিকৃত বিশ্বাস (প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আগে তার ধারণা ছিল ফ্রান্স একাই জার্মানীর চেয়ে শক্তিশালী, যুদ্ধের পরেও তার এই ধারণার কোন হেরফের ঘটেনি), পাশাপাশি লিপ্ত হয়েছিলেন যুদ্ধের অশ্লীল রোমান্টিকরনে। তাঁর যুদ্ধ-কবিতাগুলির (যেমন, লেপান্টো বা দ্য ব্যালাড অভ সেইন্ট বারবারা) তুলনায় চার্জ অভ দ্য লাইট ব্রিগেডকে[৪অ] গান্ধিবাদী লেখা বলে ঠাহর হয় — চেস্টারটনের এই কবিতাগুলি সম্ভবত ইংরেজী ভাষার সবচেয়ে রুচিহীন বাগাড়ম্বরের পুরস্কার জিতে নেবে। কৌতুহলের ব্যাপার হল, যে রোমান্টিক আবর্জনা ফ্রান্স ও ফরাসী সেনাবাহিনী সম্বন্ধে চেস্টারটন উগরে চলেছিলেন, ব্রিটেন ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ব্যাপারে অন্য কেউ যদি একই কাজ করত, তিনিই সর্বাগ্রে নাক সিঁটকাতেন। অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে তিনি ছিলেন Little Englander, জিংগোইজম ও সাম্রাজ্যবাদের সত্যিকারের বিরোধী, গণতন্ত্রের সত্যিকারের বন্ধু। অথচ, এই একই লোক যখন আন্তর্জাতিক রাজনীতির ময়দানে প্রবেশ করতেন, তখন তার আদর্শ বিসর্জন দিতেন অলক্ষ্যেই। গণতন্ত্রের প্রতি তার প্রায় আধ্যাত্মিক প্রেমও তাই মুসোলিনীর গুণ গাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। যে দুটি জিনিসের জন্য স্বদেশে এত সংগ্রাম করেছেন চেস্টারটন, প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ও প্রেসের স্বাধীনতা, সে দুটি জিনিসকে ধ্বংস করলেন মুসোলিনী — কিন্তু মুসোলিনী ইতালিয়[৫অ] এবং একটি শক্তিশালী ইতালীর স্থপতি, কাজেই কাকস্য পরিবেদনা। একই ভঙ্গিতে, ফরাসী ও ইতালীয়রা যখন সাম্রাজ্যবাদের চর্চা করেছে, অ-ককেশীয় জাতিগুলিকে করেছে পদানত, তখন তার বিরূদ্ধে চেস্টারটনের মুখ দিয়ে কথা বেরোয়নি একটাও। জাতীয়তাবাদ চেস্টারটনের সাহিত্য-রুচী, বাস্তবতাবোধ, এমনকি নৈতিকবোধকে পর্যন্ত বিষিয়ে তুলতে পেরেছিল।
চলবে…
ফুটনোট
[১] জাতি, এমনকি জাতির চেয়ে অস্পষ্টতর গোত্র, যেমন ক্যাথলিক চার্চ বা প্রলেতারিয়াতকে প্রায়ই একজন ব্যক্তি ধরে নেয়া হয়, এবং “সে” হিসেবে অভিহিত করা হয়। “জার্মানী মজ্জাগত ভাবে বিশ্বাসঘাতক” এধরণের হাস্যকর বক্তব্য সংবাদপত্রে সুলভ, এবং জাতি ধরে সাধারণীকরণ (“স্পেনীয় স্বভাবতই অভিজাত” বা “ইংরেজ মাত্রেই মোনাফেক”) করতে প্রায় কেউই পেছপা নয়)। মাঝে মাঝে এসব উচ্চারণ অসত্য বলে প্রমাণিত হয়, কিন্তু তাতে অভ্যাসটির বিলুপ্তির কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আপাত দৃষ্টিতে আন্তর্জাতিকতাবাদী, এরকম লোকের মধ্যেও এই দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে পাওয়া যায় — যেমন তলস্তয় বা শ।
[২] পিটার ড্রাকারের মত কিছু রক্ষণশীল লেখক জার্মানী ও রাশিয়ার মধ্যে চুক্তির কথা লিখেছিলেন, কিন্তু তারা দুদেশের জোট বা স্থায়ী একত্রীকরণের কথা ভাবছিলেন। মার্কিস্ট বা বামপন্থী বলা যেতে পারে, এমন কোন লেখক ভবিষ্যৎবাণীর ধারপাশেও আসতে পারেননি।
[৩] সংবাদমাধ্যমে যেসব বিশ্লেষক মন্তব্য করেন, তাদেরকে প্রো-রুশ বা রুশ-বিরোধী হিসেবে ভাগ করা যায়। মাজিনো লাইন অভেদ্য, রাশিয়া তিন মাসে জার্মানীকে পরাজিত করবে, এরকম ভুলভাল ভবিষ্যৎবাণী তাদের নামডাকের কোন হেরফের ঘটাতে পারেনি, কারণ তাদের পাঠকেরা যা শুনতে চেয়েছে, তাই তারা বলে গেছে। বুদ্ধিজীবিদের প্রিয় দুই সামরিক বিশ্লেষক হচ্ছে ক্যাপটেন লিডেল হার্ট এবং মেজর-জেনারেল ফুলার। প্রথমজনের মতে আক্রমণের চেয়ে প্রতিরক্ষা ভাল, দ্বিতীয়জন বলে তার ঠিক উল্টোটা। এই পরস্পরবিরোধিতা সত্বেও একই গ্রুপের কাছে দুজনেই বিশেষজ্ঞ হিসেবে গৃহিত। তাদের প্রতি বামপন্থীদের ভালবাসার গোপন কারণ হচ্ছে দুজনেরই War Office এর সাথে খারাপ সম্পর্ক।
[১অ] সম্ভবত অরওয়েল বানান ভুল করেছেন এখানে। যে শব্দটি নিয়ে কথা হচ্ছে তা হল এই।
[২অ] অরওয়েল এখানেও কিছুটা ভুল করেছেন বলে সন্দেহ হয়। ট্রটস্কি জার্মান-রুশ চুক্তির কথা অনেকদিন ধরে বলে আসছিলেন।
[৩অ] চেস্টারটনের বিচারের অধিকার অরওয়েলের আছে, ফ্রান্সের বাস্তবতার সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল — বই লিখেছেন।
[৪অ] টেনিসনের বিখ্যাত কবিতা
[৫অ] অর্থাৎ ল্যাটিন ও ক্যাথলিক, কাজেই চেস্টারটনের প্রিয়পাত্র।
আপনি জ্ঞানীলোক। লেখাটা অনুবাদ হলেও বিভিন্ন প্রশ্নে আপনার দেওয়া উত্তর দেখে সেটা বুঝা যায়। মজার ব্যাপার হলো প্রশ্ন-উত্তর পর্বে আমি অনেকটা দাবা খেলার সাধ পেলাম। আমার ধারনা আপনাকে বাজিমাত করা মুশকিলই না প্রায় অসম্ভব। আপনার প্রতিটা কথায় একটা সুদূর প্রসারি লক্ষ্য থাকে।
একটু বেশিই প্রশংসা করে ফেললাম মনে হয়। 🙂
আজকেই এই লেখাগুলো একজনকে লিখেছিলামঃ
@রূপম (ধ্রুব),
(Y) ক্ষমা-টমা চাওয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে একটু মধ্যযুগীয়ই মনে হয়। তবে ব্যক্তির কাছে কি ব্যবহার আশা করা যেতে পারে সেটা একটা ভাল প্রশ্ন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অধিবাসীদের কাছ থেকে বিশেষ প্রত্যাশা থাকতে পারে, যেহেতু তার সরকার of the people।
@রূপম (ধ্রুব) @রৌরব
সুন্দর একটা পয়েন্ট এসেছে। আরেকটু উস্কিয়ে দিই, পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে সাপোর্ট করা আর পাকি দলকে নাপাকি দল ডাকা এগুলোকে কেমন চোখে দেখেন?
@টেকি সাফি,
প্রথম কথা, এরকমটা করবার আইনী অধিকার সক্কলের থাকা উচিত। এর পরের কথা, এই সাপোর্ট বা বিরূদ্ধাচরণের কারণের উপর বিচার নির্ভর করবে নিশ্চয়। খেলার উৎকর্ষের কারণের পাকিস্তানকে সাপোর্ট করলে এক কথা, আর বিস্ময়কর হীনমন্যতা বোধ থেকে বাংলাদেশ-পাকিস্তান খেলার সময় পাকিস্তান সাপোর্ট করা আরেক ব্যাপার। পাকিস্তান বিরোধিতাকেও এভাবে ভাগাভাগি করে নেয়া যেতে পারে। প্রশ্নটা আরেকটু ডিটেইলড হলে জবাবও হয়ত ডিটেইলড হতে পারবে 🙂
@রৌরব,
আচ্ছা, আরেকটু তাহলে স্পেসিফাই করি। আমি আসলে বিরুদ্ধাচারনের কারণটা বলছি, ৭১ এর পাকিস্তান শাসকদের নির্দেশে তাদের মিলিটারি কতৃক বাঙ্গালী হত্যা, ধর্ষন ইত্যাদি কারণে তারা বর্তমান পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে সাপোর্ট করেনা এবং যারা ধরুন পাকিস্তান ভার্সেস অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে পাকিস্তান সাপোর্ট করে তাদেরকেও দেখতে পারেনা। খেয়াল করুন এরা বাই ডিফল্ট ধরে নিচ্ছে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড আর পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সদস্যরা আমাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয় যেহেতু তাদের প্রত্যেকে লিখিতভাবে এ নিয়ে বিবৃতি দেয়নি।
আরেকটা কথা আগেই বলে রাখি, পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে সাপোর্ট করা মানে পাকিস্তানকে সাপোর্ট করা নয়, এর প্রমাণ হচ্ছে, কে একজন বলেছিল ইন্ডিয়া বাজেভাবে হেরেছে ফলে কোর্ট থেকে তাকে তলব করা হয়েছিল যে ইন্ডিয়া ক্রিকেট দল হারতে পারে, ইন্ডিয়া বাজে ভাবে হেরেছে কেন বলা হলো।
আরেকটা সিমিলার কেস দেখাই, মেহেরজান আমি নিজে দেখিনি তাই উপাত্তে ভুল হলে আগেই ক্ষমা চাচ্ছি তবে আমি যতদূর জানি যারা মেহেরজানের বিরুদ্ধে মিটিং মিছিল করে হেনস্থা করেছে তাদের দাবী ছিল কেন পাকি সৈন্যের সাথে বাঙ্গালী মেয়ের প্রেম দেখান হবে? এখানে কথা আছে, বিচারটা কি আমাদের করা উচিত ইন্ডিভিজুয়ালকে নিয়া নয়? এমনকি যে জওয়ানের সাথে প্রেম হয়েছে সে যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাও হয় তবু প্রেম তার সাথে হতেই পারে। কারণ প্রেম এক অতি উদ্ভট, নিয়মের বালাইহীন আবেগীয় অবস্থা…সাধে কী ক্লাস সিক্সে ইংলিশ টিচারের প্রেমে পড়ি? 😛 যাইহোক তবু এরা মানবে না কারণ তারা পাকিস্তান মিলিটারি গোষ্ঠিকেই দেখতে পারেনা সুতরাং তাদের সাথে কোন বাঙ্গালীর প্রেমও তারা দেখতে পারেনা। শিল্পের সংজ্ঞা ফংগার দিকে না গিয়ে লেখার বিষয়বস্তুর দিকটা থেকে বলছি আমি।
@টেকি সাফি,
মেহেরজান। ছবিটি আমিও দেখিনি এবং এর প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারেও সম্যক জ্ঞান নেই, কিন্তু লোকমুখে আপনি যা বলছেন সেরকমই শুনেছি। এবং আমার প্রতিক্রিয়া ঠিক আপনারই মত। নিঃসন্দেহে এটা অরওয়েলীয় অর্থে “জাতীয়তাবাদ”-এর প্রকাশ। অরওয়েল বলছেন দেখুন “(জাতীয়তাবাদ হচ্ছে) মানুষকে কীটপতঙ্গের মত বিভিন্ন প্রজাতিতে ভাগ করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে গাদা ধরে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে “ভাল” বা “মন্দ” ঘোষণা দেয়া সম্ভব, এটা ধরে নেয়ার অভ্যাস”। ঠিক এ ব্যাপারটাই এখানে ঘটেছে:
১. বাঙালী নারীকে “আমাদের” সম্পত্তি মনে করে সে কেন পাকিস্তানীর সাথে প্রেম করতে গেল সে বিষয়ক আপত্তি
২. পাকিস্তানী জওয়ানেরও ব্যক্তিত্ব (individuality অর্থে) অস্বীকার করে তাকে স্রেফ “হানাদার” গোত্রের মধ্যে ফেলে দেয়া
অরওয়েলের আরেকটা কথার সাথে কিরকম মিলে যাচ্ছে দেখুন: ‘জাতীয়তাবাদী হচ্ছে এমন একজন যার চিন্তা ভাবনা পুরোপুরি, বা মূলত, প্রতিযোগিতা ও মান-সম্মানের ধারণা দিয়ে আচ্ছন্ন” — মেহেরজানকে এরা দেখছে পাকিস্তান-বাংলাদেশ আইডিলজিকাল যুদ্ধেরই একটি উপাদান হিসেবে।
@রূপম (ধ্রুব), আপনার উক্তিটি পড়তে গিয়ে একটা মজার ব্যাপার ঘটল। যদি জাতির যায়গায় আমরা ব্যক্তিত্ব শব্দটি ব্যবহার করি, তাহলে কেমন হয়? মানুষের ব্যক্তিত্ব তো একই থাকে না, সময়ের সাথে, পরিবেশ- পরিস্থিতির সাথে তা বদলায়। সেক্ষেত্রে মানুষের বিচার(judgment) করাই দায়।
মহান রৌরব। এমন গুরুত্বপূর্ণ লিখাটি অনুবাদ করলেন। কোন সাড়া শব্দটি হইলো না। জাতীয়তাবাদ তো আনাচে কানাচেতেই বর্তমান। যাই হোক। উক্তিগুলা জমায়ে রাখতেছি। আশা করি অন্তত প্রয়োজনের দিন লেখাটা প্রয়োজন মেটাবে।
তো মুসলমান-বিরোধী বা আল্লাহভক্ত-মুহাম্মদভক্ত-বিরোধী জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে কী বলেন? যারা মানুষরে তার বিশ্বাস ধইরাই খালি চেনে। আর কিছু চেনে না। সাপ মনে কইরা মাথা ভাইঙা দিতে চায়। সবাইরেই তো লাইনে খাঁড়া করায়া দিলেন। ও না। ওখান থেকেই তো দেখা যাচ্ছে লেখার উৎপত্তি (বিপ্লব পালের লেখা)।
“জাতীয়তাবাদ বলতে আমি দুটি প্রবণতাকে বোঝাচ্ছি। প্রথমত, মানুষকে কীটপতঙ্গের মত বিভিন্ন প্রজাতিতে ভাগ করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে গাদা ধরে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে “ভাল” বা “মন্দ” ঘোষণা দেয়া সম্ভব, এটা ধরে নেয়ার অভ্যাস।” – এই জিনিস এখন পাইকারি হয়ে গেছে। যত্রতত্র।
লেখার জন্য (B) । অপেক্ষায় থাকলাম।
@রূপম (ধ্রুব),
আপনাকে ছিপে তোলা গেছে এই যথেষ্ট পুরস্কার 🙂 ।
ঠিকই ধরেছেন, র্যাডিক্যাল ইসলামের বিরুদ্ধাচরণের ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়ে মুসলিম-বিরোধী “জাতীয়তাবাদী”-দের কর্মকাণ্ড থেকেই লেখাটি অনুবাদ করার অনুপ্রেরণা এসেছিল। লেখাটিতে অবশ্য সে বিষয়ে সরাসরি কোন কথা নেই, তবে সেটাই point — একটু সাধারণীকৃত ভাবে দেখার চেষ্টা আর কি।
(B) চাখলাম। এখন একটু হ্যাং-ওভারড।
এক টানে পড়ছিলাম…ইন্টারেস্টিং হতে শুরু করেছে আর আপনি দিলেন পর্ব শেষ করে। টিভি সিরিয়াল দেখে এই বুদ্ধি পেয়েছেন? :))
আচ্ছা তাহলে যত ব্রাদারহুড আছে…এইযে মুসলিম ব্রাদারহুড, নাস্তিকব্রাদারহুড এগুলো সবই জাতীয়তাবাদ এ পড়ে…ফেসবুকে ইদানিং নাস্তিকব্রাদারহুড গড়ে উঠছে…আমিও একটু আধটু আছি এদের সাথে কিন্তু আমি যদি এদের সিদ্ধান্তের যৌক্তিক সমালোচনা করি তাহলে আমি জাতীয়তাবাদে পড়ব?
আরেকটা প্রশ্ন উপরে কাজী মামুন বলেছেন যেমনটা তেমনই যে দেশপ্রেম কখনো কখনো জাতীয়তাবাদকে আলিঙ্গন করতে পারেনা?
@টেকি সাফি,
সমালোচনা যতক্ষণ করছেন, ততক্ষণ নিজের ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দেননি ধরে নেয়া যায় :-), কাজেই এখনও জাতীয়তাবাদী নন। অরওয়েল কিন্তু বরাবর সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন নিজেকে। গোষ্ঠীবদ্ধতাটা সমস্যা না, অন্ধ আনুগত্যই সমস্যা।
নিশ্চয়ই পারে। অরওয়েল ওই লাইনটি লিখেছেন “পাস্তা-পিজার চেয়ে মাছ-ভাত আমার পছন্দ” ধরনের দেশপ্রেম বোঝাতে গিয়ে। হয়ত একটি জাতির self determination এর অধিকারও এর মধ্যে পড়ে। ভদ্রলোক নিজে ইংরেজ সংস্কৃতি ও জীবনের ভক্ত ছিলেন। এখন নাৎসীজম এড়াতে গিয়ে যদি এধরণের দেশপ্রেমও এড়াতে হয়, তাহলে তো বিপদ! সেক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের মত করে ক্ষুদ্রজাতিসত্বার অধিকার হরণের দিকে পা পা এগোনোর একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়। সবই balance-এর ব্যাপার।
চমৎকার অনুবাদ হচ্ছে।
একটু কথা থেকে এই জায়গাটাতেঃ
ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। আমি যদি এই তিনটি দেশের প্রতি কোন ভাবেই বায়াসড না হই তাহলে আমার জাজমেন্ট কেন সঠিক হবে না? এখানে লেখক কি আগে থেকেই ধরে নিচ্ছে না, যে এই ব্যাপারে কেউই নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ করবে না? এমন হলে তো যেকোন ঘটনার ক্ষেত্রেই এটা হতে পারে যে, আমি বলে দিলাম আপনি যে সিদ্ধান্তই নিন না কেন সেটা আপনি আগে থেকেই ধরে বসে আছেন এবং সেজন্যই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম। 🙂
@সাইফুল ইসলাম,
লেখক ওই সময়ের কথা বলছেন। তাঁর মতে, ঠিক ওই সময়টায় ব্রিটেনে নিরপেক্ষ কেউ ছিল না। নিরপেক্ষ হলে যে জাজমেন্ট সঠিক হত, সেটা তো বলে নিয়েছেন।
@রৌরব,
তাহলে ঠিক আছে। বুঝতে ভুল হয়েছিল আর কি। ধন্যবাদ।
পরের পর্বটা কবে পাচ্ছি? একটু তাড়াতাড়ি ছাড়ুন। 🙂
অনুবাদ দারুন হয়েছে…সহজ ও সাবলীল…
ধন্যবাদ।
@রাহনুমা রাখী,
ধন্যবাদ আপনাকেও (F)
@রৌরব, আমার কাছে কেন যেন মনে হচ্ছে ওরওয়েল এখানে ‘নেশনালিজম’ বলতে মৌলবাদকে(এর বিস্তৃত সংজ্ঞা সহ) বুঝিয়েছেন।আমি বুঝলাম না ১৯২০ এ ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ শব্দটি গঠিত হলেও ওরওয়েল এ শব্দটি ব্যবহার করেন নি কেন। ‘নার্সিসিজম’ শব্দটিও মনে হয় ওরওয়েলের ‘ন্যাশনালিজম’ শব্দটির সাথে খাপ খায়।আমি ঠিক নিশ্চিত না।তারপরও মন্তব্য করলাম।
আর অনুবাদ দারূণ হচ্ছে।
@ইমরান মাহমুদ ডালিম,
ভাল একটা প্রশ্ন করেছেন। জানিনা fundamentalism শব্দটি কবে থেকে এই অর্থে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়েছে।
(Y)
@হেলাল,
ধন্যবাদ 🙂
জাতীয়তাবাদ জিনিসটা বলতে গেলে উনবিংশ শতকে গতি সঞ্চার করার পর বিংশ শতকে চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌছায় যা অতীব দুঃখজনক। অথচ ইতিহাসের বড় বড় সাম্রাজ্যবাদীরা আর যা হোক জাতীয়তাবাদী ছিলেন না। রোমান সাম্রাজ্যের হর্তাকর্তাদের বেশীরভাগই রোমের স্থানীয় ছিলেন না। সিরিয়া কিংবা গল থেকে কেউ রোমে এসে নিজ যোগ্যতা বলে সাম্রাজ্যের উঁচু পদে আসীন হতে পারতেন অথবা নিদেনপক্ষে রোমের নাগরিকের মর্যাদা পেতেন। বৃটিশ , অটোমান কিংবা মোঘল সাম্রাজ্যের অনেক হর্তাকর্তারা নানা জাতি থেকে আসতেন। সোভিয়েট সাম্রাজ্যের বড় নেতাদের অনেকেই জাতিতে রুশ ছিলেন না।
যে কোন রকমের জাতীয়তাবাদই একটা পর্যায়ে বিপজ্জনক আকার ধারণ করতে পারে। সুন্দর একটা লেখা আমাদের উপহার দেয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
@সংশপ্তক,
জ্ঞানগর্ভ মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। অরওয়েলের জাতীয়তাবাদের ধারণা কিন্তু একটু বিস্তৃত। তার সংজ্ঞানুসারে কমিউনিজমও “জাতীয়তাবাদ” (যদিও কমিউনিজম পুরোনো অর্থে জাতীয়বাদের বিরুদ্ধে)। এই পর্বের মূল উদাহরণটি লক্ষ্য করুন। চেস্টারটন ইংরেজ, কিন্তু তার জাতীয়তাবাদ একধরনের বিদেশী ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ধারণাকে ঘিরে।
@সংশপ্তক,
ভাল কথা, আপনি তো ফরাসী জানেন। Longeur বিষয়ে যে ফুটনোট দিয়েছি সেটার সাথে কি আপনি একমত?
@রৌরব,
longueur আক্ষরিক অর্থে দৈর্ঘ্য যা সাধারনত গননা করা যায় না এমন কিছুর দৈর্ঘ্য বোঝায়। à longueur de journée (আ লঙ্গৌর দ্য জুরনে ) বলতে সারা দিন কিংবা traîner en longueur (ত্রেনে অ লঙ্গৌর) বলতে প্রলম্বিত বোঝায়।
১১ শতকে ইংরেজ বিচারালয়ে ফরাসীকে প্রধান ভাষা হিসেবে গ্রহন করা হয় এবং পরবর্তীকালে ইংরেজীতে বেশীরভাগ স্যাক্সন শব্দকে চিরতরে প্রতিস্হাপিত করে , কখনও এমনকি মূল ফরাসী ভাবকে পরিবর্তন করে। লাতিন- ফরাসী শব্দ information স্যাক্সন শব্দ enlightment এর জায়গা দখল করে নেয়। ইংরেজ আইজাক নিউটন ইংরেজীতে নয় বরং ফরাসী এবং লাতিনে তাঁর গবেষণাগুলি প্রকাশ করেন।
এমন একটা লেখার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। লেখককে ধন্যবাদ সময়োপযোগী অনুবাদটি করার জন্য।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, দেশপ্রেম থেকেই উগ্র জাতীয়বাদ সৃষ্টি হয়, যা সর্বগ্রাসী ও সভ্যতা বিনষ্টকারী যুদ্ধ ডেকে আনে বারবার। আর তাই আমি দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখি না। যদিও জর্জ অরওয়েল দেশপ্রেমকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছেন। আমার কাছে, যেকোনো দেশপ্রেম/স্বজাতি-প্রেম/গোত্র-প্রেমই খারাপ; মানুষের থাকা উচিত শুধু ‘ন্যায়-প্রেম’ অথবা ‘সত্য-প্রেম’। তা না হলে, মনমোহনের আসন্ন সফরে ভারত যদি তার দক্ষ কূটনীতিকে কাজ লাগিয়ে তিস্তার পানির ন্যায্য হিসসা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে, তাকে আমরা কোনভাবেই দোষ দিতে পারব না; কারণ এখানে, ভারতের কূটনীতিকরা দেশপ্রেম (অর্থাৎ ভারতের নাগরিকদের জীবন-সংস্কৃতিকে বিশ্বসেরা মনে করে তাকে অটুট ও উন্নত রাখার উদ্দেশ্য) থেকে কাজটি করবেন , কোন প্রকার ক্ষমতা বা সন্মান পাওয়ার লোভে নয় যাকে অরওয়েল জাতীয়তাবাদ বলে অভিহিত করেছেন। একই ভালো দেশপ্রেমের কারণে ওয়াঙ্গারি মাথাই নোবেল পেলে আমরা চাইলেও খুশি হতে পারি না, কারণ তাঁর জন্যইতো আমাদের মহম্মদ ইউনুসের দেরিতে নোবেল পুরুষ্কার পান।
আশা করছি, আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর পাবো সামনের পর্বগুলোতে।
@কাজি মামুন,
পাঠ ও উৎসাহের জন্য ধন্যবাদ 🙂
ব্যাপারটা কি বলুন তো? আপনার এই মতকেও অরওয়েল “জাতীয়তাবাদ” বলবেন, যদি সেটা একটা বিশেষ রূপ ধারণ করে। প্রবন্ধের শুরুতে হিচেন্সের উদ্ধৃতিটি লক্ষ্য করুন।
(Y) রৌরবের অনুবাদ সব সময়েই দারুণ – গুণে, মানে!
অনেকদিন পরে মুক্তমনায় পুনরায় লেখা শুরু করার জন্য ধন্যবাদ!
@অভিজিৎ, 🙂
চলুক।
এই অংশে লেখক যেটা বলেছেন সেটাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে সেলফ অর্গানাইজেশন-আদর্শবাদ এবং লজিস্টিকের কারনে [ বা বেঁচে থাকার জন্যে] গ্রুপ বানাতে বাধ্য হয়।
এই নিয়ে লেখক কিছু ফুটনোট দিলে ভাল হয়।
@বিপ্লব পাল,
ধন্যবাদ :-)। সেলফ অর্গানাইজেশন নিয়ে আপনিও মন্তব্য বা লেখা দিতে পারেন।
চলুক (Y) জর্জ ওরওয়েলের “এনিমেল ফার্ম” আমার কাছে অসাধারণ লেগেছিল। 1984 পড়া শুরু করেছিলাম, কিন্তু বইটার মুডটা এত বেশি ডার্ক যে শেষ করে উঠতে পারিনি। “বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ” কথাটা বোধহয় সর্বকালের জন্য প্রাসঙ্গিক।
@পৃথিবী,
আমারও একই অভিজ্ঞতা 🙂