১৯৪৫ সাল। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধ চলছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। স্বার্থের স্রোতে সমগ্র পৃথিবীর জাতিগুলো আলাদা হয়ে গিয়ে একে অন্যকে আঘাত করে চলেছে। আক্রান্তরাও ঘায়েল পশুর হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী হামলায়। মরছে, মারছে, আবার মরছে, আবার মারছে। স্বার্থ আর আদর্শের জন্য দ্বন্দ্ব ছাপিয়ে উঠেছে শান্তি আর নিরাপত্তার প্রয়োজনকে। ১৯৪৫ এর মাঝামাঝিতে যুদ্ধ প্রায় থেমে এসেছে। ছয় বছরের লড়াইয়ের ভিত্তিতে জয়-পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে অংশগ্রহনকারী জাতিগুলো।
১৯৪৫ এর ৬ই আগস্ট, সকালে জাপানের হিরোশিমায় পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম অ্যাটম বোমা লিটল বয় নিক্ষেপ করা হয়। নিমেষে নরক হয়ে ওঠে সাড়ে তিন লাখ মানুষের শহর। পরের আঘাতটি হানা হয় নাগাসাকিতে ৩ দিন পর। এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। লেখা হয়েছে গান, কবিতা, নাটক। তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র, ডকুমেন্টারী ইত্যাদি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের ক্ষয়ক্ষতির কথা বলা হলে হিরোশিমা আর নাগাসাকির কথা খুব জোরালোভাবে উচ্চারিত হয় এবং তা প্রাসঙ্গিকও।
কিন্তু যুদ্ধের শেষ দিকে জাপানের ছোট বড় সব শহরকেই (সংখ্যা ৬৭) আমেরিকান বিমান আক্রমণের অভিজ্ঞতা নিতে হয়েছিল। এতেও যে ভয়াবহতা আর মৃত্যু ছিল তাও নগণ্য নয়। জাপানের উপকূলীয় কোবে শহরে বিমান আক্রমণ এবং তার ফলে ঘর বাড়ি, আত্মীয় পরিজন হারানো দুই নাবালক ভাইবোনের বেঁচে থাকার সংগ্রামকে চিত্রিত করে ১৯৮৮ সালে নির্মিত হয় জাপানী চলচ্চিত্র হোতারু নো হাকা (গ্রেভ অব দ্যা ফায়ারফ্লাইজ)। কোবে শহর ছিল জাপানের ৬ষ্ঠ বৃহত্তম শহর এবং বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত আগ্নেয় গোলার আক্রমণে শহরটির ৫৫.৭% এলাকা ধ্বংস হয়।
ছবিঃ ১৯৪৫ সালে বিমান হামলার পর কোবে শহর
ইসাও তাকাহাতার পরিচালনায় এবং স্টুডিও ঘিবলির প্রযোজনায় এই অ্যানিমেশন ফিল্মটি তৈরি হয়। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সমালোচক ও চিত্রনাট্যকার রজার ইবার্টের মতে এটি সর্বকালের অন্যতম শক্তিশালী যুদ্ধবিরোধী চলচ্চিত্র। উল্লেখ্য, চলচ্চিত্র সমালোচনা করে ইবার্টই প্রথম পুলিৎজার পুরষ্কার লাভ করেন। অ্যানিমেশন ইতিহাসবিদ আর্নেস্ট রিস্টার একে স্টিভেন স্পিলবার্গের অস্কার বিজয়ী সিনেমা শিন্ডলার্স লিস্ট এর সাথে তুলনা করেছেন। কিন্তু পরিচালক তাকাহাতা একে যুদ্ধবিরোধী চলচ্চিত্র হওয়ার চেয়েও সংগ্রামের সময়ে ভাইবোনের যে আত্মিক সম্পর্ক ফুটে উঠেছে তাকেই মূল প্রসঙ্গ বলে বর্ণনা করেছেন।
ফিল্মটির অনন্যতা এখানেই যে এটি সৈনিকদের বীরত্ব আর জাতিগুলোর আদর্শকে বিশেষিত বা সুষমামন্ডিত করার চেয়েও ব্যক্তিগত হাহাকারকেই বড় করে দেখিয়েছে। যুদ্ধকালীন সময়ে নিরীহ মানুষদের রক্ষা করার ব্যাপারে সমাজের ব্যর্থতাই এর উপজীব্য। সহজ, সরল, সাধারণ মানুষ যুদ্ধের তীব্রতায় একটুখানি বাঁচার জন্য কিভাবে স্বার্থপর হয়ে ওঠে তাই বারে বারে দেখা যায় এর কাহিনীতে। সাধারণত এমন বিষন্ন একটি গল্পকে অ্যানিমেশন ফিল্মে রূপান্তর করা হয় না। কিন্তু তাতেও এই ফিল্মটিতে যুদ্ধের ভয়াবহতা কম বোধ হয় নি, বরং অনেক বীভৎস্য দৃশ্য আর্ট ডিজাইনার নিজো ইয়ামামোটোর শৈল্পিক অঙ্কনের গুণে এড়িয়ে যাওয়া গিয়েছে।
ইংরেজি সাবটাইটেলে ফিল্মটি দেখা হলেও জাপানী কুশলী কন্ঠ অভিনেতাদের দক্ষতার কারণে ভাষা না বুঝলেও কোন দৃশ্যের তীব্রতা সহজেই অনুধাবন করা যায়। এর প্রত্যেকটি চরিত্রই বিকাশের সুযোগ পেয়েছে এবং প্রয়োজনে কিছু দৃশ্যে নিঃশব্দের ব্যবহার যেন দৃশ্যটিকে আরও সরব করে তুলেছে। এমনকি তীব্র মুহূর্তগুলোতে (ক্লাইম্যাক্স) কোন সংলাপই ছিল না এবং দৃশ্যায়নের গুণে এর প্রয়োজনও বোধ হয় নি। স্থানে স্থানে দর্শককে ভাবার জন্য যথেষ্ঠ অবকাশও দেওয়া হয়েছে।
গল্পের মূল চরিত্র দুই ভাইবোন, সীটা আর সেটসুকো। সীটার বয়স বার আর ছোটবোন সেটসুকোর আনুমানিক পাঁচ। তাদের বাবা জাপান নেভীর অফিসার। বাবার অবর্তমানে বড় সন্তান হিসেবে সীটাকে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। হামলাকারী বিমান এগিয়ে আসতে দেখা গেলেই শহরের লোকজনকে নিকটবর্তী আশ্রয়স্থলে যাওয়ার জন্য হুঁশিয়ারী জানানো হয়। তেমনই এক আক্রমণের দিনে সীটা আশ্রয়স্থলে যাওয়ার আগে মাটির নিচে খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিরাপদে পুঁতে রাখে। তাদের মা হৃদরোগী বলে তিনি আগেই আশ্রয়স্থলে রওয়ানা হয়ে যান। সীটা ছোট্ট বোন সেটসুকোকে পিঠে নিয়ে নিরাপদ স্থানে ফিরে যাওয়ার আগেই বিমান হামলা শুরু হয়ে যায়, ছড়িয়ে পড়ে কালো ধোঁয়া।
ছবিঃ বোমা হামলার সময় আতঙ্কিত সীটা ও সেটসুকো
সে দিগ্বিদিক পালাতে থাকে। লোকজনও যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। তারা উপকূলের দিকে ছুটে যায়। কিছুক্ষণ পর আক্রমণ বন্ধ হতে না হতেই বৃষ্টি শুরু হয়, বোমা আক্রমণ পরবর্তী ব্ল্যাক রেইন।
লোকালয়ে ফিরে এসে তারা দেখে পুরো শহর যেন নেই হয়ে গেছে। চারপাশে পোড়া ঘরবাড়ি, পোড়া লাশ, জ্বলন্ত শহর; অসহায়, নিঃস্ব মানুষ। এর মাঝে একজন সজোরে হেঁকে ওঠে, Long live the emperor !
কাছের একটি স্কুলে আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে সীটা দেখে তাদের মা সারা শরীরে ব্যান্ডেজ অবস্থায় পড়ে আছেন। আংটি দেখে তাঁকে সনাক্ত করা হয়। বোমা হামলা থেকে তিনি নিজেকে বাঁচাতে পারেন নি। সেই সন্ধ্যায়ই তিনি মারা যান। সীটা বোনের কাছে একথা গোপন করে। ছোট মেয়েটি মায়ের সাথে দেখা করতে চাইলে সীটা বলে তিনি অন্য শহরের হাসপাতালে আছেন। সেটসুকো একপাশে বসে নীরবে কাঁদতে থাকে, আর সীটা নিরন্তর চেষ্টা করে যায় বিভিন্ন রকম শারীরিক কসরত করে ছোট শিশুটিকে দুঃখ ভুলিয়ে রাখতে।
তারা নিশিনোমিয়া শহরে তাদের এক দূর সম্পর্কের মাসির বাসায় থাকতে যায়। একদিন সীটা মাটির নিচে রাখা খাবার, জিনিসপত্র ইত্যাদি তুলে নিয়ে এসে মাসিকে দেয়। এর মধ্যে অনেক কিছুই তাদের বাবার নেভীতে থাকার সূত্রে পাওয়া। সীটা তাদের অবস্থার কথা জানিয়ে বাবাকে চিঠি পাঠায় কিন্তু কোন উত্তর পায় না। তাদের নিঃসঙ্গ জীবনে প্রিয় বিনোদন ছিল সন্ধ্যায় জোনাকী দেখা আর দু’হাতের তালুতে আলতো করে জোনাকী ধরা। এর মাঝে একটি উজ্জ্বল, সুন্দর দিনে দুই ভাইবোন সৈকতে বেড়াতে যায়, যা তাদের নিরানন্দ জীবনে কিছুটা হলেও আনন্দ আনে।
একদিন মাসি চাল কেনার জন্য তাদের মায়ের কয়েকটি কিমোনো (জাপানী মহিলাদের পোষাক) বিক্রি করে দেন। মায়ের স্মৃতির চিহ্ণ ছিল বলে ছোট্ট মেয়েটি চিৎকার করে কেঁদে বাধা দিতে চায়। বিনিময়ে পাওয়া চাল থেকে তারা সামান্যই নিজেদের ভাগে পায়। এদিকে যুদ্ধের সংকট মুহূর্তে চারদিকে কাজের অভাব, খাদ্যের ঘাটতিতে তাদের জীবন যাপনকে মাসির অলস বোধ হয়। তিনি তাদের ব্যাপারে অসহিষ্ণু হয়ে প্রকাশ্যে বিরক্তি দেখাতে থাকেন। অসন্তোষ বাড়তে থাকায় একদিন সীটা রান্নার তৈজসপত্র কিনে এনে আলাদাভাবে রান্নার ব্যবস্থা করে। কিন্তু তাতেও অশান্তি দূর হয় না। কোন রাতে সেটসুকো মায়ের কথা ভেবে কাঁদলে ঘুমের অসুবিধার কথা জন্য তাদের তিরষ্কার করা হয়।
একদিন বিমান হামলা শুরু হলে দিগ্বিদিক পালাতে গিয়ে জলাশয়ের ধারে তারা একটি পরিত্যাক্ত ঘর আবিষ্কার করে। একেই নিজেদের উপযুক্ত করে তৈরি করে নিয়ে তাদের নতুন স্বাধীন জীবন শুরু হয়। বিনিময়যোগ্য যা কিছু ছিল তাই দিয়ে এক কৃষকের কাছ থেকে তারা চাল, সবজি কিনে রান্না করে নিত।
একরাতে তারা অনেকগুলো জোনাকী ধরে এনে মশারীর ভেতর ছেড়ে দেয়। ছোট্ট জায়গায় তাদের তীব্র আলো উজ্জ্বল দেখাতে থাকে।
ছবিঃ রাতের আঁধারে জোনাকীর আলোর খেলা
পরদিন সেটসুকো মৃত জোনাকীগুলোকে সমাধিস্থ করতে করতে সীটাকে জিজ্ঞেস করে, “কেন জোনাকীরা এত তাড়াতাড়ি মরে যায়? কেন তাদের মাকেও মরে যেতে হল?” সেই প্রথম সীটা বুঝতে পারে সেটসুকো তাদের মায়ের মৃত্যুর কথা জানে, সে জেনেছে মাসির কাছ থেকে। সীটা কান্না ধরে রাখতে পারে না।
ধীরে ধীরে তাদের খাবার কেনার জন্য বিনিময় করার জিনিস ফুরিয়ে আসতে থাকে। কৃষকেরও নিজের জন্য বাঁচিয়ে বিনিময় করার মত কিছু থাকে না। এই অভাবের দিনেও তারা ঐ মহিলার কাছে ফিরে যায় নি। নোংরা, অস্বাস্থ্যকর জলাশয়ের পরিবেশ তাদের ত্বকের উপর বিরূপ প্রভাব রাখে। অপুষ্টিতে সেটসুকো দুর্বল হতে থাকে, খাদ্যে রূচি হারায়, দূষিত পানি খেয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ক্ষুধার যন্ত্রণায় সীটা কয়েকবার পার্শ্ববর্তী এলাকার কৃষকের ক্ষেত থেকে চুরি করে। এক রাতে সে ধরা পড়ে যায়। কৃষক তাকে নিষ্ঠুরভাবে মারতে মারতে নিয়ে যায় থানায়। পুলিশ অফিসারের দয়ায় সে যাত্রা রক্ষা পায় কিশোর ছেলেটি। কিন্তু অভাবের সাথে লড়াই করে টিকে থাকা অসম্ভবের কাছাকাছি হয়ে পড়ে।
এরপর থেকে বিমান আক্রমণের সময় জীবন ঝুঁকি নিয়ে সীটা লোকজনের বাড়িতে ঢুকে খাবার ইত্যাদি জিনিসপত্র চুরি করে আনত। অনাহারী কিশোরটি গোলাবৃষ্টির মধ্যেও কারও ঘরে যা পেত তাই খেয়ে নিত। সবাই যখন সবকিছু ছেড়ে নিরাপত্তার জন্য আশ্রয়স্থলে যেত, সীটাকে তখন ছুটতে হত লোকজনের ঘরবাড়ির দিকে। যেখানে ক্রমাগত বোমাবর্ষন করে চলেছে যুদ্ধবিমান। যখন চারপাশে ধ্বনিত হত মানুষের আর্তনাদ, সীটাকে তার মধ্যে করতে হত ভাগ্যের অনুসন্ধান।
বিমান আক্রমণের শব্দ শুনলেই সীটাকে যেতে হয় লোকজনের ঘরে। সেটসুকো অসুস্থ শরীরে ঘরে একা থাকতে থাকতে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, লবণাক্ত পানির কারণে ঘামাচি, ফুসকুড়িতে তার ত্বক ভীষণ আক্রান্ত হয়, তার উপর ছিল ডায়রিয়া। কিন্তু সীটাকে তখন প্রায়ই ভাগ্যের খোঁজে বাইরে থাকতে হয়। একদিন সীটা ফিরে এসে বোনকে অজ্ঞান পড়ে থাকতে দেখে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার জানায় সে অপুষ্টিতে ভুগছে, তার দরকার ভাল খাবার। কিন্তু আর কোন সহায়তা দেয় না।
বিশুদ্ধ পানির অভাব ছোট মেয়েটিকে মৃতপ্রায় করে ফেলে। এক শ্রমিককে বরফ কাটতে দেখে মাটিতে পড়ে থাকা বরফ তুলে বোনকে খেতে দেয় সীটা একটুখানি পানির জন্য। সীটা সিদ্ধান্ত নেয়, মায়ের ব্যাঙ্কের সব টাকা তুলে সে বোনকে বাঁচাবে। কিন্তু খাদ্যের চেয়েও নিঃসঙ্গতা ছোট মেয়েটির কাছে বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।
ব্যাঙ্কে সীটা জানতে পারে যুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের কথা। সে বুঝতে পারে, তার বাবার দীর্ঘ নৈশব্দের সম্ভাব্য কারণ। বোনের কাছে এসে দেখে ক্ষুধার তীব্রতায় তার দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছে। একপাশে এলিয়ে পড়ে থেকে দুর্বলভাবে ফ্রুট ড্রপ ভেবে মার্বেল চুষে খাচ্ছে, সীটার জন্য সে ভাত ভেবে কাদার বল তৈরি করে রেখেছে। সীটা তাকে একটুকরো তরমুজ কেটে দিয়ে দ্রুত রান্না করতে ছুটে যায় কিন্তু সেটসুকো এর মাঝেই মারা যায়। সে রাতে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। সীটা সারারাত নিজের বোনের লাশ জড়িয়ে পড়ে ছিল।
পরদিন পাহাড়ের উপর সেটসুকোর লাশ পুড়িয়ে সৎকার করে সীটা। একসময় আগুন নিভে যায়। সন্ধ্যা নামে, জোনাকীরা বেরিয়ে আসে। আলোকিত করে তোলে শিশুটির শ্মশান।
সীটা আর কখনো তাদের ছোট্ট ঘরটিতে ফিরে যায় নি। পরে একটি রেলস্টেশনে সন্ধ্যায় তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কাহিনীতে যদিও সরাসরি দেখানো হয় নি, তবুও অনুমান করা যায়, সীটা আর বাঁচার চেষ্টা করে নি। কারও কারও জন্য পরিস্থিতিই এমন হয়ে ওঠে যে, বাঁচার ইচ্ছাই চলে যায়।
জাপানী সুরকার এবং ক্লাসিক্যাল মিউজিশিয়ান মিশিও মামিয়া এই ফিল্মটির আবহ সুর করেছেন। বিশেষত চরম মুহূর্তের সুরগুলোতে চোখের জল আটকাতে রীতিমত লড়াই করতে হয়। ফিল্মটির পরতে পরতে জাপানের সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
সিনেমাটিতে জোনাকী শব্দটি বহুলার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সীটা এবং সেটসুকো জোনাকীদের ধরে তাদের ছোট্ট ঘরটি আলোকিত করেছিল এবং পরদিন মৃত জোনাকীগুলোকে সেটসুকো মাটি চাপা দিয়েছিল। এই ঘটনার তাৎপর্যকে জোরালো করে ফুটিয়ে তুলতে সিনেমাটির নাম রাখা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ জোনাকীর জীবনকাল খুবই ছোট, দুই থেকে তিন সপ্তাহ। ক্ষণস্থায়ী কোন কিছু বোঝাতে জাপানে জোনাকীর উপমা দেওয়া হয়। জোনাকী তাই জীবনের অস্থায়ীত্ব, অনিশ্চয়তার প্রতীক। জাপানী সাহিত্য এবং উপকথায় মানুষের আত্মাকে বর্ণনা করা হয় ভাসমান, টিম টিম করে জ্বলতে থাকা ক্ষুদ্র অগ্নিগোলক হিসেবে। সে অর্থে জোনাকী আত্মা (জাপানী প্রতিশব্দ হিতোদামা) হিসেবেও প্রতীকায়িত হয়।
শিশু দুটিকেও ক্ষণজীবী জোনাকীর সাথে তুলনা করা যায়, বিশেষত সেটসুকোকে, যে খুব কম বয়সে পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছিল। আক্রমণকারী বিমানকে রাতের আকাশে দেখে ছোট মেয়েটির জোনাকীর মত মনে হয়েছিল। আবার আকাশ থেকে ধেয়ে আসা প্রজ্বলিত বোমাগুলো দূর থেকে দেখতে জোনাকীর মত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জাপানের ক্ষুদ্র উপাখ্যান বা কাহিনীগুলোতে বিস্ফোরক অগ্নিগোলকগুলোকে জোনাকী বলে উল্লেখ করা হত।
সিনেমাটি বিশ্বব্যাপী ভূয়সী প্রশংসিত হয়েছে। ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেস (আই.এম.ডি.বি.)এর শীর্ষ ২৫০ ফিল্মের তালিকায় এটি ১০ এর পূর্ণমানে ৮.৪ স্কোর পেয়ে ১২৪ তম স্থানে আছে। আর শুধুমাত্র অ্যানিমেশন ফিল্মের বিচারে এটি ৬ষ্ঠ স্থানে আছে। টাইম আউট লন্ডনের অ্যানিমেশন মুভি র্যাঙ্কিংয়ে এর স্থান দ্বাদশ।
১৯৮৯ সালে ব্ল্যু রিবন অ্যাওয়ার্ডসে পরিচালক ইসাও তাকাহাতা বিশেষ পুরষ্কার পান। ১৯৯৪ সালে শিকাগো ইন্টারন্যাশনাল চিল্ড্রেন্স ফিল্ম ফ্যাস্টিভালে তাকাহাতা অ্যানিমেশন জুরি অ্যাওয়ার্ড এবং রাইটস অব দ্যা চাইল্ড অ্যাওয়ার্ড জিতে নেন।
জাপানের গায়ক, গীতিকবি ও ঔপন্যাসিক আকিয়ুকি নোসাকার আংশিক আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস থেকে কাহিনীটি নেওয়া হয়েছে। উপন্যাসের নামও একই। বাস্তব জীবনে নোসাকার পালক পিতা যুদ্ধে ছিলেন এবং ছোট বোনের অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর কারণে তিনি নিজেকে দায়ী করতেন। যুদ্ধের সময় কিশোর নোসাকা চরম খাদ্যাভাবের দিনগুলোতে প্রথমে নিজের খাওয়া নিশ্চিত করেছিলেন, পরে বোনের। ক্ষুধার তাড়ণায় বোনের মৃত্যু তাঁকে বছরের পর বছর যে অপরাধবোধে ভুগিয়েছে, তার থেকে নিস্তারস্বরূপ তিনি নিজের অতীতের কিছুটা ছায়া অবলম্বনে এই উপন্যাসটি লিখেছিলেন। তারই চলচ্চিত্ররূপ গ্রেভ অব দ্যা ফায়ারফ্লাইজ। এর শেষ দৃশ্যে দেখানো হয় বর্তমানের ঝলমলে আধুনিক কোবে শহর। সারি সারি সুউচ্চ আলোকিত দালান। যার অতীতে ঘুমিয়ে আছে অসংখ্য জোনাকীরা, যারা আলো ছড়ানোর আগেই সমাধিতে চলে গেছে।
চলচিত্রটার পটভূমি ও তাৎপর্য খুব ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছিস। (Y) যুদ্ধের সময় লাঞ্ছিত মানবতার আর্তনাদ যে জয় পরাজয় সবকিছু ছাড়িয়ে যায় ছবিটা দেখার পর তা যেন নিজের মনেও উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম, প্রবলভাবে…
আপনার লেখাটা পড়তে পড়তে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘শঙখচিল’ গানটা মনে পড়ে গেল। এ গান যতবার শুনি, মনে এই প্রথম শুনলাম। কষ্টের দানাগুলো শরীর জুড়ে।
মানুষ খুব সহজে
অতীত ভুলে যায় বলে
খুব অনায়সে ভবিষ্যতের
চিতা সাজাতে পারে।
@স্বপন মাঝি,
আপনার অণুকবিতা আগেই মুগ্ধ করেছে। এটা কি আপনার লেখা আর কোন অণুকবিতা?
@তুহিন তালুকদার,
@স্বপন মাঝি,
সুন্দর কবিতাময় পাঠ প্রতিক্রিয়া। :clap
পোস্টটিকে অলঙ্কৃত করলেন।
কিন্তু এখানে যে অণুকবিতাটি লিখে ফেললেন, হয়তো অনেকের চোখে পড়বে না। অল্পকথন এর পরবর্তী কোন পর্বে লিখলে হয়তো উপযুক্ত মূল্যায়ন পেতেন।
@তুহিন তালুকদার,
তথাস্তু।
httpv://www.youtube.com/watch?v=PRmB3NswWZA
@স্বপন মাঝি,
গানটি আমি এখান থেকে অনেকবার শুনেছি, কিছু শব্দ বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। আপনার কাছে পুরো লিরিকটি আছে কি?
যতটুকু বুঝতে পেরেছি, তার মধ্যেও গানটি অসাধারণ। শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
@তুহিন তালুকদার,
গানের কথাগুলো উদ্ধার করে সময় পেলে আপনাকে জানান দেব।
অনেক ধন্যবাদ!
যুদ্ধ আর দূর্ভিক্ষের কাহিনীগুলো পড়লে মনটা হাহাকারে ভরে যায়!
@লাইজু নাহার,
স্বাগতম। পাঠ প্রতিক্রিয়ার জন্য ধন্যবাদ।
লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ ।
@রুপম,
স্বাগতম আপনাকে।
কালকে রাতেই ডাউনলোড করেছি। মুভি দেখে লেখাটা পড়বো। লেখাটা পড়লাম না যদি মুভি দেখার আনন্দটা মাটি হয়ে যায়, এই ভয়ে।
@স্বাধীন,
আসলে আপনিই প্রকৃত ফিল্ম বাফের মত কাজ করেছেন। ফিল্ম দেখার পর আপনার প্রতিক্রিয়া আশা করছি।
গল্প পড়েই তো চোখ ভিজে উঠেছে; মূল ছবিটি কেমন আবেদন তৈরি করেছে, তা সহজেই অনুমেয়। অ্যান ফ্রাঙ্কের উপর নির্মিত চলচ্চিত্রটার কথা মনে পড়ছে; কিশোরী অ্যান এর উপর কি অমানুষিক নির্যাতনই না হয়েছিল!
“ফিল্মটির অনন্যতা এখানেই যে এটি সৈনিকদের বীরত্ব আর জাতিগুলোর আদর্শকে বিশেষিত বা সুষমামন্ডিত করার চেয়েও ব্যক্তিগত হাহাকারকেই বড় করে দেখিয়েছে। যুদ্ধকালীন সময়ে নিরীহ মানুষদের রক্ষা করার ব্যাপারে সমাজের ব্যর্থতাই এর উপজীব্য।”
আসলেই বেশিরভাগ ছবিতেই জাতিগুলোর আদর্শ, বিশেষ করে বিজয়ী পক্ষের আত্মত্যাগকে মহীয়ান করে দেখানোর প্রয়াস থাকে; কিন্তু যুদ্ধে যখন মানবতাকে হত্যা করা হয়, তখন ‘নীতি-আদর্শ-বড় প্রাপ্তির জন্য ব্যক্তিগত ত্যাগ’ বিষয়গুলোকে আমার কাছে নিতান্তই ঠুনকো মনে হয়। যেমন, সেটকুকোর কাছে তার মাতৃভূমির সুনাম, সন্মান বা সম্ভ্রম বা নৈতিক সততার চেয়ে বেশি দরকারি ছিল প্রয়োজনে চুরি করে হলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বোনের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করা।
লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ এরকম অসাধারণ একটি গল্প শেয়ার করার জন্য।
@কাজি মামুন,
ধন্যবাদ পড়ার জন্য এবং আপনার সুচিন্তিত পাঠ প্রতিক্রিয়ার জন্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের উপর যে নির্যাতন হয়েছিল, তা বলার মত না। অ্যান ফ্রাঙ্কের ডায়েরী বইটি পড়ে অনেকদিন পর্যন্ত মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলাম। ফিল্মটি দেখা হয় নি, এর নামটা জানালে ভালো হত।
একই কথা শহীদ নাট্যকার মুনীর চৌধুরী বলেছিলেন, তাঁর রক্তাক্ত প্রান্তর নাটক নিয়ে – রক্তাক্ত প্রান্তরের চেয়েও বেশি প্রাধান্য পায় রক্তাক্ত অন্তর।
আপনার মন্তব্যের জন্য আবারও ধন্যবাদ।
পড়েই বিষন্নতা বোধে আক্রান্ত হয়েছি হয়তো মুভি দেখা আর সম্ভব হবে না।
@রাজেশ তালুকদার,
কাহিনীটি বিষন্ন ঠিক। কিন্তু একটা কথা আছে না,
Our sweetest songs are those always say our saddest thoughts.
(F) (F) (F)
@পারভেজ রাকিব,
(L) (L) (L)
লেখাটি পুরোটা পড়লে মুভি দেখার মজা হারাবো নাতো?
@রামগড়ুড়ের ছানা,
এই পোস্টটিতে মুভির বাইরেও যথাসাধ্য তথ্য সন্নিবেশের চেষ্টা করেছি। এতে সিনেমাটির পটভূমি বুঝতে আরও সহায়ক হওয়ার কথা। আর পোস্টটিতে কাহিনীর একটা রূপরেখা দেওয়া হয়েছে মাত্র। মুভিটিতে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় যেভাবে বাস্তব করে দেখানো হয়েছে তাতে আমার মতে এটা দেখাটা জীবনের একটা মূল্যবান অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মত।
পুরো মুভিটিকে লেখার ভেতরে তুলে আনা আমার সামর্থ্যের বাইরে। 🙁
(W)
@রৌরব,
🙂