১: কেন আর কি নিয়ে এই লেখা?
মোহাম্মদ ইউনুসকে নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতি ক্ষুদ্রঋন-গ্রামীন-ইউনুস ট্রায়োলজিকে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছিল। ঘটনাপ্রবাহ অংশত আশংকিত পরিনতির দিকেই গিয়েছে। তবে এই সুযোগে দারিদ্র বিমোচনে কি ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দরকার, সেগুলোর কার্যকারিতার মূল্যায়ন এবং সাফল্য-ব্যর্থতার আলোচনার পাশাপাশি এই ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার মৌলনীতির আলোচনাও প্রাসংগিক হয়ে উঠেছিল — যেটার চর্চা আশানুরূপ মাত্রায় হয়নি। “ক্ষুদ্রঋণ পশ্চিমা পুঁজিবাদি ধারনার প্রসারের ফল” এমন একটা ধারনা মোটামুটি জনপ্রিয় [১, ২]। পশ্চিমা উন্নয়ন মডেল সেই অর্থে “বিদেশি মডেল” বিধায় ক্ষুদ্রঋনকে ছেটে ফেলার আকাঙ্খা আমাদের আত্মাভিমানকে নাড়া দেয়। আর পশ্চিমা বিশ্ব দারিদ্র বিমোচনের কার্যকরি মাধ্যম হিসাবে ক্ষুদ্রঋনকে বেশ উচু স্থানে তুলে ধরেছে। ফলে “বিদেশি মডেল” সন্দেহটি আরো দানা বেঁধেছে। তবে সহজ কান্ডজ্ঞান বলবে, পশ্চিমারা সমর্থন করলকি করলনা সেটা কোন ধারনা বা ব্যবস্থার গ্রহনযোগ্যতার মাপকাঠি হিসাবে দুর্বল এবং অপর্যাপ্ত। এই ধারনাটির মূল্যায়নের উদ্দেশ্যেই এই লেখা।
ক্ষুদ্রঋনের মডেলটি গত কয়েকদশক ধরে বাংলাদেশ ছাপিয়ে বিশ্বের কোনায় কোনায় চলে গেছে, পুঁজিবাদি-অপুঁজিবাদি নির্বিশেষে, এরজন্য বাংলাদেশকেই বহির্বিশ্বে ক্ষুদ্রঋণ ধারনার উৎস্যস্থল মনে করা হয়। এটা অবশ্যই সম্রাজ্যবাদি ষড়যন্ত্রতত্ত্বের বিপরীত অবস্থান। এই পরস্পরবিরোধী অবস্থানের প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাদি অর্থনীতির মৌলিক মতাদর্শের সাপেক্ষে ক্ষুদ্রঋনের মূলনীতির সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা এই লেখার উদ্দেশ্য। মোহাম্মদ ইউনুস সামাজিক ব্যবসার (Social Business) একটা বিশেষ উদাহরন হিসাবে ক্ষুদ্রঋনকে তুলে ধরেন। কাজেই এটাও ব্যাখ্যা করা দরকার পড়ে যে সামাজিক ব্যবসা কি, আর ক্ষুদ্রঋন কি করে সামাজিক ব্যবসার উদাহরন। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের যায়গা থেকে গ্রামীনের সমালোচনার প্রকৃতিও পর্যালোচনায় রাখার চেষ্টা থাকবে।
২: বাজার অর্থনীতির নীতি নিয়ে কাটাছেড়া
পুঁজিবাদি অর্থনীতিতে বাজার নিজে থেকেই গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রশ্ন যেমন কে,কি বা কতটা উৎপাদন করবে, কিভাবে সম্পদের বন্টন হবে এগুলোর উত্তর দিয়ে দেয়। যাবতিয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মূলে থাকে “ব্যাক্তিস্বার্থ”– ব্যক্তি নিজস্বার্থ তাড়িত হয়েই অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ নেবে, আর সামাজিক কল্যান কোন বাহ্যিক প্রভাব ছাড়াই অর্জিত হবে — ব্যক্তি তার উদ্দেশ্য অনুযায়ি কর্মপন্থা নেবে — এবং সেই ভিত্তিতেই রচিত হবে তার ভবিষ্যত এবং বৃহত্তর অর্থে সমাজের ভবিষ্যত। কৃষক-শ্রমিক-পিঠাওয়ালা-মজুর-চিকিৎসক নির্বিশেষে সকলেই নিজের স্বার্থের তাড়নাতেই তাদের শ্রমকে বা উৎপাদিত পন্যকে বাজারে নিয়ে আসে, সমাজসেবার উদ্দেশ্যে নয় — কাজেই রাষ্ট্রব্যবস্থার বড়মাপের কোন হস্তক্ষেপ ছাড়াই রচিত হয় একধরনের কল্যানমুখি সামাজিক অবকাঠামো — যাতে থরে থরে সাজানো হয় নানা প্রতিষ্ঠান। নিজেদের মধ্যে দরকষাকষি করেই একটা সমাজের মানুষ ঠিক করে নিতে পারে কে তার শ্রম/পন্য কতদামে বেচতে বা অন্যেরটা কতদামে কিনতে রাজি। কাজেই বাইরে থেকে কাউকে এসে বলে দিতে হয় না কত দাম হতে হবে বা কতটা উৎপাদন করতে হবে। কোন কিছু দরকারের বেশি উৎপন্ন হলে সেটার দাম পড়ে যাবে ফলে পরের বার সেটা কম করে উৎপাদন হবে যাতে করে দাম আবার স্বাভাবিক হবে। এভাবে কোন বাহ্যিক প্রনোদনা ছাড়াই বাজার ব্যবস্থা সম্পদের বন্টন করবে। সেখানে মুনাফা হবে, সঞ্চয় হবে, সেটা চলে আসবে পুঁজি বাজারে যেটা বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করবে, যা থেকে তৈরি হবে নতুন কর্মসংস্থান… ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষ মূলত স্বার্থতাড়িত হয়েই অর্থনৈতিক কার্যকলাপে অংশ নেয় এটাই এই ধারনার মূল প্রতিপাদ্য। আজকের পৃথিবীর মূল ধারার অর্থনীতি এবং উন্নয়ন আলোচনা গড়ে উঠেছে একে কেন্দ্র করেই। বাজার মৌলবাদিদের একটা ক্ষুদ্র অংশকে বাদ দিলে সবাই নানা অঙ্গিকে এই আপাত চমৎকার ধারনার নানা সীমাবদ্ধতাও তুলে ধরেছেন। এর বিরোধীদের একটা বড় অংশই অবশ্য বাজারের শক্তিকে অস্বিকার না করেই এর সীমাবদ্ধতা কাটানোর কথা বলেছেন। আধুনিক ক্ষুদ্রঋন ব্যবস্থাও ডানা মেলেছিল বাজার অর্থনীতির এরকম কিছু সীমাবদ্ধতাকে কাটানোর উদ্দেশ্যেই।
২(১): সন্দেহের সূত্রপাত
আমেরিকা থেকে অর্থনীতি বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনা শেষে দেশে ফেরত এসে বাংলাদেশের অর্থসামাজিক বাস্তবতা ফ্রেমে যখন তাত্ত্বিক অর্থনীতিকে স্থাপন করেন তার তখন তার মনে নানা সংশয় জাগতে শুরু করে। সেগুলোর আলোচনা আমরা তাঁর লেখাতেই পাই। “পশ্চিমা তত্ত্ব” হিসাবে ক্ষুদ্রঋন ব্যবস্থার মূল্যায়নে এই উপাখ্যানটার পর্যালোচনা দরকার। ১৯৯৮ সালে জার্নাল অব ইন্টারন্যাশনাল এফ্যারসএ দারিদ্র বিমোচন সম্পর্কে তাঁর চিন্তাধারার বিবরন সংবলিত একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় [২]। ঠিক কি পরিস্থিতিতে বাজার অর্থনীতির মূলনীতিগুলোকে নতুন ভাবে দেখার প্রয়োজন বোধ করেন ইউনুস সেটার একটা বর্ণনা আমরা শুনি সেখানে।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ যখন দুর্ভিক্ষের মুখে পড়ে তখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন। সেসময় দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশে অবর্ণনিয় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। তার একটি খন্ডচিত্র পাওয়া যাবে জন পিলজারের প্রামান্য তথ্যচিত্রে [১৪]। দুর্ভিক্ষজনিত বিপর্যয় অনেকের মত তাকেও বিচলিত করে, প্রচলিত অর্থনীতির তত্ত্বগুলো কোন কাজেই আসছিলনা এই অবস্থার সমাধানে। সেই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি লেখেনঃ
By 1974, Bangladesh was suffering its worst famine in 30 years. All the “brilliant” theories that I was teaching my students were of no assistance in reducing the hunger and starvation of millions of people. It became exceedingly difficult for me to focus on the hypothetics of classroom economics with my fellow human beings dying around me. At that point, I lost faith in textbooks and the world of abstraction.
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে তাহলে এইসব “ব্রিলিয়ান্ট তত্ত্ব” বা “এবস্ট্রাকশন” -এর বাইরে গিয়ে তিনি কোথায় পৌছালেন?
২(২): কোনটা নিলেন কোনটা ছাড়লেন
প্রচলিত অর্থনৈতিক তত্ত্বকে তিনি প্রশ্নের মুখে ফেলেন। মুনাফা সর্বোচ্চ করনের (Profit Maximization) নীতিকে একচ্ছত্র বলে ভাবার ক্ষেত্রে আপোষহীন দৃষ্টিভঙ্গীকে তিনি অপর্যাপ্ত মনে করে। তার মতে মানুষ কেবল নিজ স্বার্থের জন্যই নয় আরো অনেক প্রেরণা দ্বারাই চালিত হতে পারে। সেক্ষত্রে প্রচলিত অর্থনীতি এই তাত্ত্বিক অনুমিতির ভিত্তিতে মানুষের অন্যান্য বৈষিষ্ট্যকে আমলে নিচ্ছে না। অন্যভাবে বলতে গেলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহনের ক্ষেত্রে স্বার্থচিন্তাই “একমাত্র নিয়ামক” এই ধারনাকে তিনি অসম্পুর্ণ মনে করেন। প্রতিযোগীতার প্রয়োজনকে সাধুবাদ তিনি জানান কেননা এটা তার মতে “প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং উদ্ভাবনের চালিকা শক্তি”। স্বার্থতাড়না থেকে জাত “মুনাফা সর্বোচ্চকরন” ছাড়াও ব্যবসায়িক উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে এটা তিনি গুরুত্বের সাথে বলে আসছেন। তাছাড়া পুঁজিবাদকে এর ক্লাসিকাল রূপে রেখে দেয়ার মানে হচ্ছে এর মধ্যে গজিয়ে ওঠা সমস্যাগুলিকেও টিকিয়ে রাখা এবং মেনে নেয়া। এই অবস্থানের নিরিখে তিনি তার মূল অর্থনৈতিক চিন্তাকে প্রকাশ করেছেন নিচের মত করেঃ
What I disagree with is the feature of profit maximization seemingly embedded in capitalism. Economic theory portrays the entrepreneur as one who ensures the optimal use of scarce resources to produce the greatest possible financial return, ignoring any social dimensions or returns. But even if the presence of social considerations is a small one in the investment decision of an entrepreneur, it is one that should be promoted for the greater interest of society. Economic theory cannot easily explain an entrepreneur or a firm taking a lower financial return in his business to ensure a higher social return. By contrast, sociologists have ready explanations as to why families accept lower-paying jobs in order to have more time together.
পুঁজিবাদের বিকল্প, রাষ্ট্রের ভূমিকা এসব প্রসংগেও তিনি তার অবস্থান কিছুটা তুলে ধরেন। সরকার বা বাজারের দিকে মুখ তুলে বসে থাকলে চলবে না এই নীতির রূপরেখা তাই এভাবে নির্মান করেন তিনিঃ
In the contemporary world, no visible competitor remains for capitalism. Communism, socialism and even social democracy are in retreat-to the extent they are believed in at all. The idea that the public sector should be an economic actor (rather than simply a rule maker intervening as little as possible in economic affairs) is in disrepute. What does the future hold? With the demise of the public sector, is the only alternative left for the world a private sector that is based on profit maximization? That is certainly not an inspiring prospect. To find a competitor for capitalism as is currently practiced, one can go to the core of the philosophy of capitalism itself. Contrary to popular belief, it is not “free enterprise” which is the essence of capitalism, but rather freedom of individual thought and action. Somehow, we have managed to persuade ourselves that the capitalist economy must be fueled only by profit maximization. Since that belief is shared by many it has become a self-fulfilling prophecy. Of course, it is easy to condemn the private sector for all its mistakes. What is truly unacceptable, however, is our failure to change things. The private sector, after all, is open to everyone, even to those who are not interested in making a profit.
দুর্ভিক্ষকালীন সময়ে প্রচলিত অর্থনীতির মুলধারনা সম্পর্কে তার সংশয়ের যায়গা থেকেই তাকে আমরা অনুসন্ধানি হয়ে উঠতে দেখি। এখানে তার কিছু তাত্ত্বিক প্রস্তাব রয়েছে; তিনি বলতে চেয়েছেন ক্ষুদ্রঋনকে লাভজনক কারবার হিসাবে প্রতিষ্ঠা না করে সামাজিক লক্ষ্য অভিমুখি করা যায়, আর বাজার ব্যবস্থায় মুনাফা সর্বোচ্চকরন ছাড়াও এটা করা সম্ভব, এবং তেমনই করা উচিত। ইউনুস বলছেনঃ
Grameen’s experience substantially affirms the notion that profit maximization is not the only force stimulating free enterprise. … [apart from profit maximizing capitalists] are those entrepreneurs who are driven solely by social consciousness. As long as the enterprise remains financially viable (i.e. it does not lose money) they choose to invest only if their investment maximizes social returns.
এরকমের মূলনীতি নির্ভর কারবারকে মোহাম্মদ ইউনুস বলছেন সামাজিক ব্যবসা। তিনি বিশ্বাস করেন সমাজের উপকারে আসার ইচ্ছা থেকে অনেকেই এই ধরনের ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে। কাজেই ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে মূলত সামাজিক ব্যবসারই উদাহরন হিসাবে। অবশ্য মোটাদাগে প্রচলিত ধারনা হচ্ছে ক্ষুদ্রঋন ব্যবস্থার পর এখন নতুন ধারনা হিসাবে মোহাম্মদ সামাজিক ব্যবসার ধারনা প্রচারে নেমেছেন। যেহেতু বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে মুনাফা সর্বোচ্চকরন ছারাই তিনি একটি টেকসই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এবং সেটাকে জনপ্রিয় করেছেন সেহেতু সামাজিক ব্যবসার ব্যপারে তার আশাবাদের দাবি একটা তাত্ত্বিক অনুমিতিমাত্র নয় বরং পরীক্ষিত দাবি। তাই সামাজিক ব্যবসার ধারনাকে ক্ষুদ্রঋনের ক্ষেত্র থেকে পন্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রসারের চেষ্টা করছেন তিনি সামাজিক ব্যবসার ব্যনারে। মুনাফা সর্বোচ্চকরনের বিপরীতে যাবার দরুন সামাজিক ব্যবসার ধারনাকে “নরম পুঁজিবাদ” (Soft Capitalism) বলা যায় যেখানে পুঁজিবাদকে একটা মানবিক রূপে কল্পনা করা হয়।
সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ বা অন্য যেকোন গ্র্যান্ড মতাদর্শ এগুলো নিজস্ব ভাবে নির্মানবাদি জ্ঞানতত্ত্ব (Constructivist Epistemology) দ্বারা চালিত। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র বা মধ্যবর্তী অন্য যেকোন পর্যায়ের সংগঠনের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষনযোগ্য আচরনের ওপর ভিত্তি করে একটা তাত্ত্বিক অবস্থানের মধ্যে থেকে সমাজের চরিত্র সম্পর্কে গড়ে ওঠা কিছু বিশ্বাস বুনিয়াদি ধারনা বা তত্ত্ব প্রস্তাব করে। মানুষের ব্যক্তিগত এবং গোষ্ঠীবদ্ধ চরিত্রের সাথে মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে সেগুলোর ওপর থরে থরে সাজানো হয় প্রতিষ্ঠান, সামাজিক নিয়ম কানুন, আইন নৈতিকতা এরকম খুটিনাটি পরিকাঠামো। কিন্তু এইসব বুনিয়াদি ধারনাগুলি মানুষের আচরন সম্পর্কে যেই মোটাদাগের অনুমান করে সেখানে ফাক থাকে, স্বাভাবিক নিয়মেই। সব সমাজই কোননা কোন নির্মানবাদি ধারনা নির্ভর। আর সমাজের সমস্যাগুলোর উৎস্যমূলে সেই সব বুনিয়াদি ধারনার অনুমিতিগুলোর দিকে চোখ দেয়াই জরুরী — এই কাজ সজ্ঞানে হোক আর অজান্তে — এই ধরনের ব্যতিক্রম স্থানকাল নির্বিশেষে অনেক প্রাতিষ্ঠানিক শুন্যস্থান পুরনে সাহায্য করেছে। হয়ত এটাকেই প্র্যাগমেটিজম বলা চলে। উপরে বাজার অর্থনীতির সাথে ক্ষুদ্রঋণ এবং সামাজিক ব্যবসার যেই মতভেদ সেটা নিয়ে এরকম একটা আলোচনা হতে পারত তবে আপাতত তোলা থাকল অন্য সময়ের জন্য। কিন্তু পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের ডাইকটমির বাইরে ক্ষুদ্রঋণ বা যেকোন প্রতিষ্ঠান বা প্রাতিষ্ঠানিক আচরনকে আলোচনা করার তাগিদ থেকেই এই মাত্রাটা উল্লেখ করা জরুরী মনে হোল। এখন দেখা যাক পুঁজিবাদের বুনিয়াদি ধারনার মধ্যে কাটাছেড়ার কোন প্রতিক্রিয়া কি হয়েছে? বাজার অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থাকি এই “মানবিয় পুঁজিবাদকে” সহজে মেনে নিচ্ছে।
২(৩): কাটাছেড়ার প্রতিক্রিয়া কী?
প্রচলিত পুঁজিবাদি অর্থনীতির একটা মূল অনুমিতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেই ক্ষুদ্রঋনের যাত্রা শুরু। এটা পশ্চিম থেকে অনুসৃত নয়, বাংলাদেশের জন্য এটা একান্তই গৃহজ, মৌলিক এবং প্রয়োগিক বিস্তারে অভূতপূর্ব। কিন্তু মুনাফাভিত্তিক পুঁজিব্যবস্থার মধ্যে এই মডেলটি স্বভাবতই চাপের সম্মুখীন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এনিয়ে বিস্তর আলোচনা সত্ত্বেও গ্রামীন ব্যঙ্কের “পুঁজিবাদি ইমেজের” দরুন বাংলাদেশি সমালোচনার টেবিলে এই আলোচনাটি এখনো তেমন ওঠেনি। যেটুকু উঠেছে সেখানেও মূল চিত্রটি অসম্পূর্ন থাকায় সেটা মূল দ্বন্দ্বটাই চাপা পড়ে যাচ্ছে সেখানে। বলছিলাম অধ্যাপক আনু মোহাম্মদের কালের কন্ঠে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ সম্পর্কে [৬]। সেখান থেক এই সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যের পুরোটাই উদ্ধৃত করছি নিচেঃ
৮০ দশকে এর সাফল্যের গতি বিশ্বে লগি্ন পুঁজির মালিক সংগঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কেননা ততদিনে বিশ্বজুড়ে পুঁজি বিনিয়োগের ভগ্ন গতিমুখ অনেক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় শিল্প পুঁজির চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে অর্থকরী বিনিয়োগ, ফাটকা পুঁজি। পুঁজিবাদের রক্ষাকবচ হিসেবেই যে ঋণ অর্থনীতির প্রসার ঘটেছিল, তা ততদিনে এক দানবীয় আকার ধারণ করেছে; কিন্তু তার বিনিয়োগ ক্ষেত্র হয়ে পড়েছে সঙ্কুচিত। শিল্পোন্নত দেশের নাগরিকদের আয়ের চেয়ে ঋণ অনেক বেশি। সেই বাজারের অধিক সম্প্রসারণের সম্ভাবনা সঙ্কুচিত হওয়ার মুখে পুঁজি ঝুঁকেছে নান বিপজ্জনক ফটকাবাজারি তৎপরতায়। এই সময়েই ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য এক বিশাল সম্ভাবনাময় বাজারকে বৃহৎ বিনিয়োগকারীদের সামনে হাজির করে। গরিবরাও ঋণের বাজার হতে পারে এটা তত দিনে প্রমাণিত। কাজেই শুরু হয় নতুন পর্ব।
১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তৎপরতা তৎপরতা শুরু করে। ১৯৯৬ সালে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ অফিস এ দেশের সব এনজিওকে বাণিজ্যিক অর্থবাজারে যুক্ত করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানায়, যাতে বৃহৎ এনজিওগুলো নিজেরাই ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং ক্ষুদ্র এনজিওগুলোর মাধ্যমে গরিব মানুষের সঞ্চয় এই বৃহৎ বাণিজ্যিক তৎপরতায় যুক্ত করে।
১৯৯৭ সালে ওয়াশিংটনে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্রঋণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর উদ্যোক্তা এবং সহযোগীদের অন্যতম ছিল বিশ্বব্যাংক, ইউএসএইড, ইন্টার-আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইউএনডিপি এবং সিটি ব্যাংক। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক সম্মেলনে আংকটাড যে রিপোর্ট প্রকাশ করে সেখানে বলা হয়, ক্ষুদ্রঋণের বিষয়টি এতদিনের অব্যবহৃত এক বিশাল সম্ভাব্য বাজারের সন্ধান দিয়েছে। ১০ হাজার কোটি ডলার বা প্রায় সাত লাখ কোটি টাকার সম্ভাব্য ঋণবাজার এটি। এগুলোর মধ্য দিয়ে বলিভিয়ার বানকোসল এবং কেনিয়ার কে-রেপ পৃথিবীর বৃহত্তম ও শ্রেষ্ঠ ব্যাংকগুলোর চেয়েও অধিক মুনাফাযোগ্যতা দেখিয়েছে। ২০ বছর আগে যেটি আন্দোলন আকারে শুরু হয়েছিল সেই ক্ষুদ্রঋণ এখন বিশাল শিল্প, এটি এখন মূলধারার অর্থবাণিজ্য তৎপরতার অংশ হয়ে গেছে।
অতএব খুবই স্বাভাবিকভাবে জাতিসংঘ ২০০৫ সালকে আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্রঋণ বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। একই বছর সিটিব্যাংক প্রাথমিকভাবে লন্ডন, নিউইয়র্ক, ইন্ডিয়া এবং কলম্বিয়া ও সিটি মাইক্রোফিন্যান্স খুলেছে। ২০০৬ সালে যে ক্ষুদ্রঋণ সম্মেলন হয় যেখানে বৃহৎ বহুজাতিক ব্যাংক ও সংস্থার সমাবেশ ঘটে। এই সম্মেলনের অন্যতম উদ্যেক্তা ছিল মনসান্টো ও সিটি গ্রুপ। এ বছরই ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষুদ্রঋণের সাফল্যের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।
২০০৭ সালে বিশ্বব্যাংকের অঙ্গসংগঠন বাণিজ্যিকভাবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান আইএফসি এশিয়া-আফ্রিকায় মার্কিন বৃহৎ ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ প্রসারের জন্য ৩৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। একই বছর জেপি মরগান তার বিনিয়োগ ক্ষেত্রের একটি বিশেষ অঙ্গ হিসেবে ক্ষুদ্রঋণ তৎপরতা শুরু করেছে।
এসব সংস্থা থেকে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে বৃহৎ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে বিশ্বে। বিভিন্ন পুঁজি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান যেগুলো বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টির পেছনে অন্যতম দুর্বৃত্ত ভূমিকা পালনকারী হিসেবে চিহ্নিত তারাও ক্ষুদ্রঋণে বিনিয়োগ শুরু করেছে। মেঙ্েিকার কমপার্টোমাস ৬০ লাখ ডলার দিয়ে ক্ষুদ্রঋণ বাণিজ্য শুরু করার পর এখন বিলিয়ন ডলার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ইউএসএইডও এর সঙ্গে যুক্ত বলে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানিয়েছে। এর মুনাফার হার এখন শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ। ক্ষুদ্রঋণ এখন তাই বিশ্বব্যাপী বৃহৎ বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে প্রায় প্রতিষ্ঠিত।
এখানে ক্ষুদ্রঋনের বৈশ্বিক বাজারের একটা অংশের চিত্র সম্পর্কে যথার্থই বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা গ্রামীন ব্যঙ্ক এবং এই মডেলের আলোতে তৈরি পৃথিবীর নানা দেশের ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোযে এই চাপের বিরুদ্ধে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটছে সেই সংগ্রামের রাজনীতি কিন্তু এখানে উঠে আসে নি। বরং আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে প্রতিযোগীতা মূলক পূজি ব্যবহার করেই হয়ত সব ক্ষুদ্র ঋন প্রতিষ্ঠানগুলো চলছে বাংলাদেশে। সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋন বিষয়ক সমালোচনা যদি সত্যিই পশ্চিমা নিওলিবারাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরোধীতা করতে চায় তাহলে গ্রামীন মডেলের অলাভজনক মডেলটার স্বিকৃতি ছাড়া সেই সমালোচনা বস্তুনিষ্ঠ হতে পারে না। এছাড়াও সংবাদ মাধ্যম অথবা রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ফোকাসও মূল যায়গা থেকে সরে গিয়ে বুরোক্রেসির লালফিতার দিকে ধাবিত হয়। এই ফাকে সম্রাজ্যবাদিতার জন্যই সুযোগ তৈরি করে দেয়া হবে দিনের শেষে, যেটা এই আলোচনায় অংশ নেয়া কোন পক্ষই চাননা বলে আমার বিশ্বাস।
২(৪): ক্ষুদ্রঋনের যত রূপ — কার পিন্ডি কার ঘাড়ে?
লাভজনক আর অলাভজনক ডাইকোটমি ছাড়াও একটা ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার অনেকগুলো অনুসঙ্গ বা নিয়ামক থাকে যেটা সেই কার্যক্রমের প্রকৃতি বা সাফল্যকে নিয়ন্ত্রন করে থাকে। কিন্তু গ্রামীনের বিশ্বব্যপী রেপ্লিকেশনের ক্ষেত্রে মূলরূপটি সবক্ষেত্রে যেমন অবিকৃত থাকেনা তেমনি একই মডেল সব ধরনের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কাজ করবে সেটা ভাবাও ভুল। সেক্ষেত্রে রেপ্লিকেশনগুলো উল্লেখিত সামাজিক প্রেক্ষাপটের ভেতরকার কাঠামোকে কতটা আমলে নিতে পারল সেটার বিবেচনা অত্যন্ত জরুরি। কাজেই কোন একস্থানে ক্ষুদ্রঋণ ব্যর্থ হলে সেটার দায় সামগ্রিকভাবে ক্ষুদ্রঋনের ওপর পরে কিনা সেটা বিবেচনার দাবি রাখে। কিন্তু ক্ষুদ্রঋনের সম্পর্কে মোটাদাগে যেই স্টেরিওটাইপ তৈরি হয়ে বসে আছে সেটার বাইরে আসার প্রবনতা এই সংক্রান্ত আলোচনায় দুঃখজনক ভাবে অনুপস্থিত। ভারতের ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে নানারকম অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। এই বিষয়ে ইউনুসের দিক থেকে উত্থাপিত সমালোচনার কিছু মিডিয়াতেও দেখা যায় [৪] গ্রামীনের অলাভজনক ক্ষুদ্রঋণ মডেল প্রচলিত মুনাফা ভিত্তিক অর্থনৈতিক ধারনার হেজিমনির সাথে বোঝাপরা করেই টিকে আছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। এই বিষয়ে নানামুখি আলোচনা পর্যালোচনাগুলো তুলে ধরে আলোচনা করেছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্যা রায় [৫]।
… drawing a sharp line between institutions that depend on subsidies and those that do not, Christen provides a more nuanced debate about subsidies. In one of the Boulder sessions, Christen “defended”Yunus and the Grameen Bank. Noting that Grameen covers its operating costs, thus achieving operational self-sufficiency (OSS), he credited Yunus, “despite all the smoke and mirrors,” for having produced “the pioneering institution that provides financial services to the poor.” But he also noted that Grameen fails to achieve financial self-sufficiency (FSS) and insists on providing subsidized interest rates that do not reflect the real cost of money.Christen argued that Grameen would have to raise its interest rates in order to achieve FSS, a choice that Grameen has been unwilling to make. Grameen’s choice was compared to that of the Bolivian market leader, BancoSol, whose effective interest rate of 46 percent is considerably higher than Grameen’s 12 percent……..
After his animated “defense” of Grameen, Christen posed the questions that seal the deal:
“Should not those most worried about a poverty alleviation agenda be those most committed to full financial sustainability, to an industry that reflects the real costs of money? If they really care to reach the greatest number of poor families, would they not also care to ensure the most efficient use of subsidies?”
মুনাফানির্ভর ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা প্রবর্তনের চাপ মূলত এসেছে বাজার মৌলবাদিদের দিক থেকে, যারা পুঁজির সুযোগ মূল্যকেও (Opportunity cost of Capital) ক্ষুদ্রঋনের মধ্যে বিবেচনায় নিয়ে আসার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। তাদের দাবি পুঁজিকে ক্ষুদ্রঋনে বিনিয়োগ না করে প্রচলিত লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করলে যেই মুনাফা হোত সেটাও ক্ষুদ্রঋনের মধ্য থেকেই তুলে আনতে হবে, এতে করে ক্ষুদ্রঋণ খাতে প্রতিযোগীতামূলক পুঁজিও প্রবেশ করবে এবং তাতে ক্ষুদ্রঋনের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। তখন ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো শেয়ার মার্কেট থেকেও পুঁজি উত্তোলন করবে, যেমনটা ভারতসহ পৃথিবীর নানাস্থানে শুরু হয়েছে [৯, ১১, ১২]। কাজেই লাভাজনক ক্ষুদ্রঋণ প্রবর্তনে ভারতের ভূমিকার দায় ঘুরেফিরে বাংলদেশের গ্রামীনকেই নিতে হচ্ছে। কিন্তু মুনাফা বর্জিত সামাজিক ব্যবসার প্রবক্তা ইউনুস এই তাগিদের বিরোধীতা করে আসছেন দৃঢ়তার সাথে [৩, ৪]। ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনার উচ্চ ব্যয় বিবেচনা করলে দেখা যাবে এই খাতে প্রতিযোগীতামূলক পুঁজির যায়গা করে দিতে হলে ক্ষুদ্রঋনকে আবারো পুরোনো মহাজনি উচ্চসুদের জগতে ফিরে যেতে হবে, তাতে করে দারিদ্র বিমোচনে এই ঋন ব্যবস্থা কার্যকর থাকবে না, ভারতের মত নির্মম পরিস্থিতি আরো অনেক যায়গাতেই ঘটতে থাকবে; এমনকি সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে এই ধরনের ক্ষুদ্রঋণ কারবার বাংলাদেশেও শিকর গাড়তে শুরু করে দিতে পারে। এই বিবেচনায় ক্ষুদ্রঋনের মুলোৎপাটনের ভাবনা ভাবার আগে ক্ষুদ্রঋনের শ্রেনীবিন্যাস বা টেক্সনমিটা আমাদের এই সংক্রান্ত আলোচনার অংশ হতে হবে। আমরা কোন ক্ষুদ্রঋনের সমালোচনা করছি? আলোচনা সমালোচনা ইনফরমড হচ্ছে কিনা সেটা যাচাইয়ের জন্য এই সময়টা গুরুত্বপূর্ণ।
৩: বাম পন্থী সমালোচনা সম্পর্কে দু’টি কথা
ক্ষুদ্রঋণ সম্পর্কে দুটি প্রধান অনুমিতি এবং দারিদ্র সংশ্লিষ্টতা এই ক্ষেত্রেটিকে বাম ভাবধারার বৌদ্ধিক আলোচনার সহজ টার্গেটে পরিনত করেছে। অনুমিতিগুলো হচ্ছে (১) এটা একটা পুঁজিবাদি ব্যবস্থা (২) এটা পশ্চিমা চাপিয়ে দেয়া মডেল। বামপন্থী সমালোচনার স্বরূপে এগুলো প্রথাবদ্ধ। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার পথে বাঁধা হতে পারে এমন যেকোন কিছুর সমালোচনা করতে না পারলে সমাজতানত্রিক আদর্শের দায় মেটানো যায় না। কাজেই ক্ষুদ্রঋনের নির্মোহ সমালোচনা বামপন্থীরা আদৌ করতে পারবে কিনা, করলেও সেটা কিভাবে সম্ভব এসব প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋনের কার্যক্ষেত্রে হচ্ছে সমাজের সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। তারা ক্ষুদ্রঋনের ফলে দারিদ্র থেকে মুক্তি পেলে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কারা করবে? দুঃখজনক হলেও সত্য পরোক্ষভাবে এই কথার মধ্যে দিয়ে ক্ষুদ্রঋনের সফলতার সবচেয়ে বড় স্বিকারোক্তিটা বামপন্থী সমালাওচকরাই করে আসছেন, নিজেদেরই অজান্তে, নিচে বদরুদ্দিন ওমরের লেখার উদ্ধৃতিঃ
দারিদ্র্য সমস্যার সমাধান সম্ভব একমাত্র রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে; দেশে দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ এবং শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ওই সংগ্রামের পথ থেকে দরিদ্র জনগণকে সরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেই সাম্রাজ্যবাদীরা ইউনূসের মতো লোককে ব্যবহার করে থাকে।
— বদরুদ্দীন ওমর [২]
যখনি এই কথা বলা হচ্ছে সংগ্রাম থেকে দরিদ্র জনগনকে *সরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে* সম্রাজ্যবাদিরা ইউনুসকে ব্যবহার করে তখন তাদের বামপন্থী সমালোচনায় চিরাচরিত স্বার্থের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয় এবং এই নিরিখে তাদের কাছে থেকেই চলে আসে ক্ষুদ্রঋনের সফলতার সবচেয়ে বড় সমর্থন। কিন্তু এর একটা পীড়াদায়ক দিক আছে। এই ধরনের সমালোচনা প্রশ্ন যাগায় তাহলে আমাদের বামপন্থীরা কি বসে আছে এদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীরা কষ্টে কষ্টে দেয়ালে তাদের পিঠ ঠেকে গেলে বিপ্লবের পরিবেশ তৈরি হবে? তাহলে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ফল হিসাবে আমরা সতস্ফুর্ত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দেখতাম — একজন ইউনুসকে ফিল্ড রিসার্চ করে গ্রামীন ব্যঙ্ক তৈরি করতে দেখতামনা।
দ্বিতীয়ত এটা পশ্চিমা বিশ্ব থেকে কপি করা একটা পুঁজির কারবার এই ধারনা ঠিক কি ভাবে তৈরি হয়েছে সেটা বেশ রহস্যজনক। আমেরিকাতে গ্রামীন ব্যঙ্কের অনুকরনে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। তার আত্মজীবনি থেকে [৭] এই সম্পর্কে যা জানা যায় তার সরাসরি উদ্ধৃতিঃ
The main focus of my economic development efforts was to increase investment and opportunity for poor people and distressed areas, most of them in rural Arkansas. The most important proposal was to provide more capital to people who had the potential to operate profitable small businesses but couldn’t borrow the money to get started. The South Shore Development Bank in Chicago had been instrumental in helping unemployed carpenters and electricians set themselves up in business on the city’s South Side to renovate abandoned buildings that otherwise would have been condemned. As a result, the whole area recovered.
I knew about the bank because one of its employees, Jan Piercy, had been one of Hillary’s best friends at Wellesley. Jan told us South Shore got the idea to fund artisans who were skilled but not creditworthy by conventional standards from the work of the Grameen Bank of Bangladesh, founded by Muhammad Yunus, who had studied economics at Vanderbilt University before going home to help his people. I arranged to meet him for breakfast in Washington one morning, and he explained how his “microcredit” program worked. Village women who had skills and a reputation for honesty but no assets were organized in teams. When the first borrower repaid her small loan, the next one in line got hers, and so on. When I first met Yunus, the Grameen Bank already had made hundreds of thousands of loans, with a repayment rate higher than that for commercial lenders in Bangladesh.
অনেকে ভাবেন ক্লিনটান আগে থেকেই ইউনুসের বন্ধু ছিলেন বলে গ্রামীনের মডেল আমেরিকাতে কপি করায় তিনি তার বন্ধুকে সাহায্য করেন। কিন্তু উপরের বর্ণনায় আমরা অন্য একটা চিত্র জানতে পারি। মাঝখানে একজন Jan Piercy ঢুকে বসে আছেন, আর আমেরিকায় অনুসরনের আগেই গ্রামীন মোটামুটি প্রসারমান। এবারে এই চিত্রটাকে আমরা ইউনুসের বর্ণনার সাথে মেলানোর চেষ্টা করি [৮]।
It was not until mid 1980s that people in the United States began showing real interest in applying Grameen principles to their own poverty problems. I suppose it all began in 1985, when Bill Clinton, then governor of Arkansas, was looking for ways to create new economic opportunities for the low income people of his state. Hillary Rodham Clinton’s college roommate, Jan Piercy, had just returned from working in Bangladesh with an American organization and was at the South Shore Bank of Chicago. She introduced the Clintons to Ron Grzywinsky and Mary Houghton, Chicago are Bankers who had done much to convince the Ford Foundation to Support Grameen…. Ron and Mary…… suggested that he [Clinton] set up a bank designed specifically for the poor in Arkansas. The Governor was intrigued and he invited me to Arkansas.
এর পর আমেরিকায় ইউনুসের পরবর্তি সফরে রন মেরি এবং দুই ক্লিনটনের সাথে ডিসিতে সাক্ষাত করেন ইউনুস এবং আরকানসাসে গ্রামীনের মত করে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা তৈরি হয়। কাজেই বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় গ্রামীনের নীতি অনুসরনে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার প্রসার বাংলাদেশের এর সাফল্যের হাত ধরেই সামনে আগায়। গ্রামীনের মূলনীতির কার্যকারিতাই এর প্রধান নিয়ামক ছিল। ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাপনার ব্যয় বেশি হবার দরুন প্রচলিত ব্যঙ্ক ব্যবস্থায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঋন দেয় না প্রথাগত ব্যঙ্ক ব্যবস্থা। কিন্তু ক্ষুদ্রঋনকে অলাভজনক সামাজিক ব্যবসার আদলে গড়ে তোলা এবং গ্রুপ লেন্ডিং এর ফলে পিয়ার মনিটরিং নিশ্চিত করে ক্ষুদ্রঋনের পরিচালন খরচ কমিয়ে আনেন অনেকাংশে। ফলে ক্ষুদ্রঋণ সহজের কাজ করে, ঋনগ্রহীতারা ঋন নেয় ফেরত দেয় আবার ঋন নেয়। এই দুটি বৈশিষ্ট্যের দরুন ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা পৃথিবীর যেকোন দেশে, যেখানেই দরিদ্র জনগোষ্ঠী আছে, সেখানেই কাজ করবে বলে দাবি করেন ইউনুস, এবং তার দাবির সত্যতা সময়ের সাথে প্রতিষ্ঠিত হয়।
এখন এই মডেলে পশ্চিমা উৎস্য বিষয়ক অনুমিতি আরেকটু আলোচনা করা যাক। পশ্চিমে মূলধারার অর্থনীতি, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারনার সাথে জড়িত নামগুলোর অবস্থান মূল্যায়ন করতে গিয়ে দুজনের কথা বলব। আমেরিকান এজেন্ডার অন্যতম প্রবক্তা জেফ্রি সাক্স ক্ষুদ্রঋনের ব্যপারে উচ্চ ধারনা পোষন করেন [১০], তার ভাষায়ঃ
BRAC and its famed counterpart, Grameen Bank, pioneered this kind of group lending, in which impoverished recipients (usually women) are given small loans of a few hundred dollars as working-capital for microbusiness activities. Such women were long considered unbankable, simply not creditworthy enough to bear the transaction costs to receive loans. Group lending changed the repayment dynamics: default rates are extremely low, and BRAC and Grameen have figured out how to keep other transaction costs to a minimum as well.
এটা গেল মুদ্রার একপিঠ। অন্যপিঠ দেখি। জেফ্রি সাক্সের উন্নয়ন ধারনার সবচেয়ে উচ্চকন্ঠ সমালোচক উইলিয়াম ইস্টারলি প্রাক্তন বিশ্বব্যাঙ্কার অর্থনীতিবিদ। সাদাসাহেব দের উন্নয়ন ধারনার সমালোচনা করে তিনি লিখেছেন “দ্যা হোয়াইট ম্যানস বারডেন”। তারমতে সাদা সাহেবরা নিজেদের ত্রাতার ভূমিকায় দেখতে পছন্দ করেন অথচ সত্যিকারে উন্নয়ন সম্ভব দেশজ উন্নয়ন মডেল থেকে। তিনি বলতে চেয়েছেন পশ্চিমের উন্নয়ন মডেল তৃতীয় বিশ্বের যতটুকু উপকার করেছে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে [১৩]। তার আলোচনায় আবশ্যকীয় অনুসঙ্গ হিসাবে ইউনুস এবং গ্রামীন ব্যঙ্কের উল্লেখ আছে। যারা উন্নয়ন নিয়ে ভাবেন তার মতে তারা প্রশংসার দাবিদার হলেও এদের ভাবনা গুলো কাজ করবে কিনা সেটা নির্ভর করে তাদের এনগেজমেন্টের ধরনের ওপর। অর্থনৈতিক উন্নয়নের তৎপর ব্যক্তিদের এই হিসাবে তিনি দু’টি শ্রেনীতে ফেলেন একশ্রেনী যারা প্রচলিত উন্নয়ন অর্থনীতির রীতিনীতিগুলোর ওপর ভিত্তি করে উন্নয়ন “পরিকল্পনা” করেন — মানে প্ল্যানার; আরেক শ্রেনী হচ্ছে যারা নির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতে সমাধান খুঁজে বের করেন যাদের তিনি বলেন সার্চার। এই প্ল্যানার সার্চারের দ্বৈততায় সার্চাররাই উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে মত দেন ইস্টারলি। তিনি ইউনুসের মডেলটিকেও একজন সফল সার্চারের মডেল হিসাবে দেখান। একটা বক্সের মধ্যে বেশ আবেগ নিয়ে তিনিও ইউনুসের ঘটনাকে বিবৃতি করেন এভাবেঃ
SNAPSHOT: THE SECRET HISTORY OF GRAMEEN BANK
MOHAMMAD YUNUS OF BANGLADESH, the founder of the Grameen Bank and the main inventor of microcredit schemes, didn’t start off with the goal of giving poor people credit. As Columbia University Business School professor Bill Duggan tells the story in a great book about people who find things that work, Napoleons Glance, Yunus started off with the conviction that the Green Revolution, and irrigation, was the answer to poverty in Bangladesh. His doctoral dissertation at Vanderbilt University was titled “Optimal Allocation of Multi-Purpose Reservoir Water: A Dynamic Programming Model.” His first attempt to help the poor was to sponsor tube wells for irrigation during the dry season so farmers could grow two crops a year. Yunus gave the farmers a loan out of his own money to finance the scheme. The farmers reaped a good harvest. Ironically for the founder of the idea that the poor can be a good credit risk, the farmers didn’t fully repay Yunus, and he lost money. But he persisted, with the city boy visiting as many rural villages as possible to try to understand how to help. He encountered a woman named Sufiya Begum making a bamboo stool. Begum made a pitiful two cents on every stool, ……
বাকিটুকু আমাদের জানা কাজেই ইস্টারলির কাছ থেকে না শুনলেও চলে আপাতত।
৪: সাম্প্রতিক সংকট সম্পর্কে
ইউনুসকে গ্রামীন ব্যংক থেকে আলাদা করেছে সরকার — মূলত রাষ্ট্রযন্ত্রের বুরোক্রেসির অস্ত্র ব্যবহার করে — বিচারিক প্রতিষ্ঠানের ঘাড়ে বন্দুক রেখে। রাষ্ট্রই একসময়ে তাকে ৬০ বছরের বেশি সময় গ্রামীনের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে থাকার অনুমতি দিয়েছিল এই পদে তার যোগ্যতা এবং উপযুক্ততার বিবেচনায়। গ্রামীনের পরিচালনায় ইউনুসের দক্ষতার নতুন করে কোণ ঘাটতি দেখা গিয়েছে এমন কোন মূল্যায়ন জানা যায়নি। আগের বছর অর্থমন্ত্রিকে চিঠি দিয়ে গ্রামীনের পরিচালনা থেকে সরে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ সত্ত্বেও সরকারের তরফ থেকে একরকম জবরদস্তি করেই তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এই রকম অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক-ঋনগ্রহীতাদের আস্থা শেষ পর্যন্ত অটুট থাকবে আশা করি। সরকারের দিক থেকে টানা হেচরার ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ভাবনের এই অর্জনটা শুন্যে পর্যবসিত না হয়ে যাক একজন বাংলাদেশি হিসাবে এমন প্রত্যাশা করি। ক্ষুদ্রঋনের বৃহত্তর চিত্রপটে মোহাম্মদ ইউনুসের অবস্থান হয়ত এখন আর আগের মত জোরালো থাকবেনা — সেটা বাংলাদেশের জন্য, ক্ষুদ্রঋনের জন্য কতটা মঙ্গলময় সেটার মূল্যায়ন আপাতত করবনা — তবে ক্ষুদ্রঋন ব্যবস্থাটি নিয়ে আরো আলাপ আলোচনা — বিশেষত গবেষনা অব্যাহত থাকবে এমন প্রত্যাশা থাকল।
[১] Muhammad, Anu (2009) “Grameen and Microcredit: A Tale of Corporate Success”, Economic and Political Weekly, 44 (35):35-42
[২] ওমর, বদরুদ্দীনঃ ইউনুসের ধান্দাবাজির ইমারত খসে পড়ল; লিঙ্কঃ http://blog.priyo.com/2010/dec/10/421.html
[৩] Yunus, M. (1998) “Poverty Alleviation Is Economics Any Help?”, Journal of International Affairs, 52(1):47-65
[৪] Yunus slates ‘loan shark’ microlenders লিঙ্কঃ http://www.thedailystar.net/story.php?nid=174858
[৫] Roy, Ananya (2010) Poverty Capital: Microfinance and the Making of Development, Routledge, NY & London
[৬]মোহাম্মদ, আনুঃ ক্ষুদ্রঋণ, দারিদ্র্য এবং বৃহৎ বাণিজ্য; লিঙ্কঃ http://tinyurl.com/46m3z6y
[৭] Clinton, Bill (2004) My Life, NY
[৮] Yunus and Jolis (1997) Banker to the Poor: Micro-lending and the Battle against World Poverty
[৯] Cull, R, Demirguc-Kunt, A. and Morduch, J. (2009) “Microfinance Meets the Market”, Journal of Economics Perspectives, 23(1):167-192
[১০] Sachs, J (2005) The End of Poverty: Economic Possibilities of our Time, Penguin Books, NY
[১১] India’s Microfinance Industry Trying to Scale, লিঙ্কঃ http://tinyurl.com/4shl976
[১২] CDC to Boost Microfinance Industry in India with USD10m investment; লিঙ্কঃ http://tinyurl.com/4wgqdxy
[১৩] Easterly, W. (2006) The White Man’s Burden – Why the Wests Efforts to Aid the Rest Have done so Much Ill and So Little Good, Penguin Books
[১৪] ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ প্রসঙ্গে জন পিলজারের তথ্যচিত্রঃ
প্রথম অংশঃ
httpv://www.youtube.com/watch?v=iiWlsOnzhtM
দ্বিতীয় অংশঃ
httpv://www.youtube.com/watch?v=64htOibIEM4
তৃতীয় অংশঃ
httpv://www.youtube.com/watch?v=_hZMuuNziDM
দেরীতে হলেও পড়লাম।
কিছু পর্যবেক্ষণ
একঃ ক্ষুদ্রঋণ কিংবা সামাজিক ব্যবসা দিনশেষে পুজিবাদী তন্ত্র, ইউনূসের ভাষায় সফট ক্যাপিটালিজম এই সিদ্ধান্তে সহমত। সেই সাথে যোগ করবো বামেরা যতই পুজিবাদের বিরুদ্ধে গলা ফাটাক এই পুজিবাদ নানান বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়ে টিকে রয়েছে এবং থাকবে। এটা বামেরা যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করবে তত তাদের জন্যে মঙ্গল।
দুইঃ বামদের সমালোচনা নিয়ে বক্তব্যের সাথেও সহমত।
তিনঃ লেখাটি যথেষ্ঠ ভালো হয়েছে। একটি সামগ্রিক চিত্র উঠে এসেছে। তবে আমি তোমার কাছে আরো কিছু লেখা চাইবো চিত্রটি পরিপূর্ণ করার জন্যে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে শুধু ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে এবং আরেকটি হচ্ছে শুধু সামাজিক ব্যবসা নিয়ে।
এই পর্যন্ত ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে অনেক লেখাই পড়েছি, তা হয় এক পক্ষের না হয় আরেক পক্ষের। কিন্তু কারো লেখাতেই ক্ষুদ্রঋণ এর সামগ্রিক চিত্র আসেনি। আমি ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে একটি লিটেরাচার রিভিউর মতো লেখা চাইছি যেখানে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে প্রকাশিত গবেষণার ফলাফল গুলো থাকবে। যে রিভিউটি পড়ে একজন পাঠক জানতে পারলো ক্ষুদ্ঋণ আসলেই কতটা কার্যকরী দারিদ্র বিমোচনে। ক্ষুদ্র ঋণ এর পক্ষে বা বিপক্ষে যে সব গবেষণা (পত্রিকায় প্রকাশিত নয়, স্বীকৃত জা্নাল) হয়েছে সেগুলো নিয়ে একটি লিটেরাচার রিভিউ। তুমি হয়তো এটি পরে কোন জার্নালেও প্রকাশ করতে পারবে।
দ্বিতীয় লেখাটি চাইছি অন্যান্য সামাজিক ব্যবসাগুলো নিয়ে। সামাজিক ব্যবসার মডেল হিসেবে নানা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে বাবসা করছে গ্রামীন, যেমনঃ ডানোন, ইন্টেল, জিই এদের সাথে। এই ব্যবসাগুলো আসলে কতটুকু সামাজিক কল্যান করবে সেটি নিয়ে একটি লেখা।
তাড়াহুড়া নেই, সময় করে লিখো।
মুক্তমনায় আবারো স্বাগতম। (F)
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। (F)
১)
ক্ষুদ্রঋন পুঁজিবাদি ধারনা কিনা এটাকে হ্যা/না এর মাধ্যমে কতটা মীমাংসা করা যায় বা করা উচিত সেটা একটা প্রশ্ন। প্রথমত — “ক্যপিটালিসম” শব্দটি দিয়ে একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সার্বিক চরিত্রের অল্পই প্রতিফলিত হতে পারে — কারন পুজিবাদি ব্যবস্থার অনেক রকম ফের আছে। ইউনুস ক্ষুদ্রঋনের ব্যপারে সফট ক্যাপিটালিজম কথাটি ব্যবহার করেছিলেন কিনা মনে করতে পারছিনা — সম্ভবত অনন্য রায়ের বইতে কোথাও পড়েছিলাম। তবে প্রচলিত পুঁজিবাদ যদি ক্ষুদ্রঋনকে যায়গা করে দিতে পারত তাহলে গ্রামীন ব্যঙ্কের উদ্ভাবনমূলক কার্যক্রমের প্রয়োজন পড়ত না। পুজিবাদি ব্যবস্থা মানুষের যেই বৈষিষ্ট্য কল্পনা করে সেটার মৌলিক কিছু অনুমিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে ক্ষুদ্রঋন এবং সামাজিক ব্যবসার ধারনাকে গ্রহনযোগ্যতা দেয়া যায়না। ফলে পুজিবাদ আর অপুজিবাদ এই ডাইকটমিতে ক্ষুদ্রঋনকে ফিট করার কাজটা কঠিন।
২) ধন্যবাদ।
৩) দাবি সঙ্গত — তবে একাডেমিক পর্যায়ে ইম্পিরিকাল এবং একই সাথে মেটা এনালিটিক আনেক কাজ হয়েছে। সময় পেলে রিভিউ দেবার চেষ্টা করব।
আর সামাজিক ব্যবসার সামাজিক কল্যান সম্পর্কে আপাতত একটা মন্তব্য রাখব — সামাজিক ব্যবসায় অন্য দিকগুলো আপাতত আলোচনার বাইরে রেখে। বিশ্বায়নের সুবাদে এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি যে বৈশ্বিক বাস্তবতায় বিরাজ করে সেখানে বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানানোকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। আজকের প্রথম আলোর এই খবরটাই দেখুন — ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী “বিনিয়োগ বাড়ানোর” প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের সরকার এবং দেশবাসিদের ধন্যই করে দিলেন। পত্রিকার খবরেও কেমন একটা অনুগ্রহের আনন্দের ছাপ। কিন্তু সেরকম কিছু যদি আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে সামাজিক ব্যবসার নামে হয় সেটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এই বৈপরিত্যটাকে কোন কাঠামোতে ব্যখ্যা করা যায়? অন্য যেকোন ক্ষেত্রেই আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আসছে দেখলে আহ্লাদিত হচ্ছি — কিন্তু ইউনুস বা গ্রামীনের সামাজিক ব্যবসার হাত ধরে সেটা হলে আমাদের এত আপত্তি করি কেন? উত্তরটা হয়ত আমরা সবাই জানি — তারপরও জনমতের গুনগত পরিবর্তন আর আইডিয়লজিকাল কাঠামোপ্রীতি কাটিয়ে নিজস্ব যুক্তিধারা তৈরির চেষ্টাকে জাগাতে না পারলে এই বন্দিদশা কাটানো কঠিনই হবে।
মুক্তমনায় স্বাগতম রিয়াজ। একটি কনফারেন্স এ গত দশদিন ব্যস্ত ছিলাম তাই মুক্তমনায় ঢুকা হয়নি। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যে কোন লেখাই আমার আগ্রহের বিষয়। এই লেখাটি এখনো পড়া হয়নি। সময় নিয়ে লেখা ও মন্তব্য গুলো পড়ে আবার না হয় মন্তব্য করবো।
@স্বাধীন ভাই,
এখানে আপনাকে দেখ ভাল লাগল। পোস্ট পড়ে যেই মন্তব্য দেবেন সেটার জন্য অপেক্ষা থাকলাম।
কাদা ছোড়াছুড়ি, ধুলোর মেঘ তৈরী করে প্রকৃত অবস্থাকে আরো ঘোলাটে করে ফেলা, সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক বিষয় টেনে এনে স্টান্টবাজী দেখানো এসবের পেছনে যত কথা আর বুদ্ধি খরচ করার লোক দেখি সত্যকে খোলা চোখে দেখার লোক ও লেখকের এই আকালের দিনে আপনার প্রবন্ধটি আশার সঞ্চার করলো ৷ সমস্যাকে নির্মোহভাবে দেখার ও দেখানোর এই প্রয়াস বলছে সমাধান আর দূরে নেই ৷
@শুভ্র, অনেক ধন্যবাদ। লেখাটা লেখবার সময় সেরকম একটা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই লিখেছিলাম। আপনি যেভাবে বললেন তাতে উদ্দেশ্য আংশিকভাবে হলেও সফল হয়েছে এমন একটা ভরসা পেলাম। অল্প অল্প করে হলেও নাগরিকদের বুঝতে হবে কারো শেখানো ছাঁচে কথা বললে, চিন্তা করলে নাগরিকের স্বার্থ রক্ষা হয়না। সেই গরজ থেকেই নির্মোহ বিশ্লেষনের ধারাটাকে জোরালো করতে হবে। আর সেটা যেকারো আয়ত্বের ভেতরে।
@রিয়াজ উদ্দীন,
একেবারে মনের কথা বলেছেন ৷ এরকম সুন্দর আরো লেখার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম ৷
@রিয়াজ উদ্দীন,
“নির্মোহ বিশ্লেষনের” কোন ধারা, ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি আমাদের দেশে এখনো গড়ে উঠেনি। বিশেষ করে যারা দেশের মতনায়ক (opinion leaders) তারা তাদের নিজস্ব মতাদর্শ, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ কিংবা গোষ্ঠিগত স্বার্থের গন্ডী থেকে বেরিয়ে এসে চিন্তা করার ক্ষমতা এখনো অর্জন করেননি। আপনার লেখাটা দেখে ভরসা হচ্ছে সেরকম একটা সংস্কৃতি আমরা হয়ত ভবিষ্যতে তৈরী করতে পারব।
আয়ত্বের ভেতরে থাকলেও সেটার কোন বহিঃপ্রকাশ এখন পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিনা। আশা করছি অদুর ভবিষ্যতে দেখতে পাব।
ক্ষুদ্রঋন ও ইউনুসকে নিয়ে সুন্দর বিশ্লেষন ভাল লাগল!
অর্থনীতি নিয়ে এরকম আরো লেখা আশা করছি।
@লাইজু নাহার, অনেক ধন্যবাদ। মাঝে মাঝে লেখার চেষ্টা করব।
পড়লাম। কেন যেন মূল পাতা থেকে লেখাটি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে আপনার নাম দিয়ে সার্চ করে তবে পেলাম। লেখাটি চমৎকার লাগল, এমনকি, একটু সময় নিয়ে পড়তে বসার পর মনে হল লেখাটা আরো লম্বা হলে ভাল লাগত। ওপরের মন্তব্যগুলির পরে খুব বেশি কিছু বলার নেই, তারপরও….
(Y) নিম্নমানের রাজনীতির গন্ধ পাওয়া যায় যারা এগুলি করেন তাদের কাছ থেকে। সেকারণেই ক্লিনটন কি বলেছেন, কবে তার সাথে আসলে ইউনুসের দেখা হয়েছে, এগুলি ভীষণ অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।
এটি খুব যুক্তিগ্রাহ্য মনে হলনা কিন্তু। বাংলাদেশ থেকে উৎপন্ন বলেই সেটি “সম্রাজ্যবাদি ষড়যন্ত্রের” অংশ হবে না কেন? কেউ তো বলতে পারেন, ইউনুস সাম্রাজ্যবাদের শিক্ষাগুলি আত্মীকৃত করে নিজে থেকেই অকাজগুলি করেছেন!
চমৎকার! পুরনো কথা হলেও ইউনুস বলেছেন, এতে হয়ত কিছু লোক ব্যাপারটি বুঝবে। এখানে “মুক্তবাজার” ও “পুঁজিবাদ” -এর একটা পার্থক্যও হয়ত সূচিত করা যায়। “মুক্ত”বাজার-এ অপুঁজিবাদ বা মুনাফাহীনতা পুঁজিবাদের মতই বৈধ, সত্তরের দশকের কমিউন বা পেনসিলভেনিয়ার আমিশদের তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক নিরীক্ষা চালাতে বাধা তো দিচ্ছেনা কেউ!
এ ব্যাপার গুলি আমি একেবারেই বুঝিনা! এখানে এত চাপা-চাপির কি আছে। ইউনুসের কর্মকাণ্ড “বাজার মৌলবাদিদের” পছন্দ না, তারা করুক না গিয়ে তাদের ইচ্ছে মত লাভ জনক ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসা! ভারতের ঘটনাচক্রের দায় ইউনুসের, এই যুক্তিও আমার পক্ষে বোঝা কঠিন।
@রৌরব,
এখানে এটা পরিষ্কার থাকা উচিৎ যে “ভারতের ঘটনাচক্রের দায় ইউনুসের” উক্তিটিকে লেখক ইউনুসের বা গ্রামীণ ব্যাঙ্ক এর অপবাদকারীদের (Detractor) যুক্তি বোঝাতে চেয়েছেন। লেখক উক্তিটিকে নিজের যুক্তি বা মত হিসেবে পেশ করেন নি। এটা অন্তত আমার কাছে প্রতীয়মান। আপনিও হয়ত সেটাই বলতে চেয়েছেন। তবে যেভাবে ব্যক্ত করেছেন তাতে মনে হয় এটা লেখকের যুক্তি বলে মনে করছেন।
@অপার্থিব,
ধন্যবাদ — আপনার মন্তব্য রৌরবের মন্তব্য বুঝতে সাহায্য করেছে।
@রৌরব,
এর মধ্যে মন্তব্য এসে গেছে লক্ষ্যই করিনি। অনেক ধন্যবাদ মনযোগি পাঠ এবং মন্তব্যের জন্য। আমি আপনার মন্তব্যের উত্তর দেবার চেষ্টা করছি।
আপনার যুক্তি ভাল লাগল। তবে এখানে আমি মূলত ক্ষুদ্রঋন সম্পর্কিত দুইটি ভিন্ন ধারায় পপুলিস্ট অবস্থানের পার্থক্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করেছি। প্রথমত বাংলাদেশ থেকে যে *আধুনিক* ক্ষুদ্রঋন ধারনার উদ্ভব ঘটেছে এটা একাডেমিয়াতে বা পেশাগত পর্যায়ে সতসিদ্ধের মত ধারনা। আর বাংলাদেশে যারা ক্ষুদ্রঋনের সমালোচনা করেন তারা এটাকে সম্রাজ্যবাদিতার দায় চাপানোর সময় বিশ্বব্যপী প্রচলিত ধারনাটি সম্পর্কে সাধারনের অবগতির অভাবকে কাজিয়ে লাগান। বাংলাদেশ থেকে ক্ষুদ্রঋনের উদ্ভবের যেই প্রেক্ষাপট সেটা কমন নলেজ না হবার দরুন সমালোচনামূলক অবস্থানগুলো নিজেদেরকে জাস্টিফাই করার কোন চাপ অনুভব করেনি। আর এই লেখায় আমি তাদের এই দাবিটাকে ভুল প্রমানের চেষ্টাই করেছি (যেটার সম্পক্ষে সমালোচকদের আমি তেমন গ্রহনযোগ্য যুক্তি দিতে দেখিনি)। গ্রামীন ছাঁচের ক্ষুদ্রঋনের সাথে প্রথাবদ্ধ বাজার ব্যবস্থার দ্বন্দ্বের যায়গাটা তুলে ধরার চেষ্টা তাই এই লেখার একটা প্রধান উদ্দেশ্য। তবে সমালোচকদের সমালোচনার জোর এসেছে নানাদেশে এই ধারনার প্রতিরূপ তৈরির হিরিক থেকে — কিন্তু যেটা বিবেচনায় আসেনি তা হচ্ছে এই গ্রহন যোগ্যতা ছিল আধুনিক ক্ষুদ্রঋন ধারনার টেকসই হবার ক্ষমতার দরুন। কিন্তু এই ধারনাটির জনপ্রিয়তা বাংলাদেশে এর জন্য কাল হয়েছে — জনপ্রিয়তার ব্যপারটিকে ব্যবহার করা হয়েছে সমালোচনার হাতিয়ার হিসাবে। ইউনুস সম্রাজ্যবাদের শিক্ষাকে আত্মীকৃত করেছেন কিনা সেটার পক্ষে সমালোচকরা বাড়তি প্রমান দেবার চাপে পড়েননি।
ঠিক কি অর্থে বুঝিনা বলেছেন সেটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি। হয়ত সহমত জানিয়ে সমালোচকদের অবস্থানের অযৌক্তিকতা বোঝাতে হয়ত বলছেন। চাপাচাপি হয় — একেকটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা একেকটা মুভমেন্টের মাধ্যমে আসে। আজকে ভারতে মোটাদাগে যেই ধরনের ক্ষুদ্রঋন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে সেগুলোর চরিত্র বাংলাদেশের গ্রামীন থেকে আলাদা। কিন্তু ক্ষুদ্রঋন পৃথিবীর যেখানেই ব্যর্থ হোক সেটার দায়টা গিয়ে পড়ে ক্ষুদ্রঋন ব্যবস্থার ওপর। কারন যারা দায়গুলোর মূল্যায়ন করেন তারা একটা কেবল “ক্ষুদ্রঋন ভাল না মন্দ” এই প্রশ্নের উত্তর খুজবেন। কিন্তু কোন ক্ষুদ্রঋন, সেটা মুনাফানির্ভর নাকি মুনাফাবিহীন সেটা খতিয়ে দেখা হয়না। বানিজ্যিক ভাবে প্রচলিত ক্ষুদ্রঋন হবে এমন যেটা বাজারের মূল ধারার মুনাফার হারের সাথে প্রতিযোগীতা করবে। আপনি আমিও হয়ত সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋনে বিনিয়োগের জন্য যাব ঠিক যেই অর্থে আমরা একটা মুদির দোকান দেব সেই অর্থে। কিন্তু গ্রামীন ঘরানার ক্ষুদ্রঋনের প্রকৃতি সেটা থেকে আলাদা। ওয়ালস্ট্রিট বা স্টক মার্কেট কেন্দ্রিক যেই পুঁজি সেখান থেকে পুজি নিতে হলে ক্ষুদ্রঋনের উচ্চপরিচালন ব্যয় মিটিয়ে সেটাকে প্রতিযোগিতামূলক করতে যেই লাভ করতে হবে তাতে প্রায় ১০০% বা তারও বেশি সুদ নিতে হয় ক্ষুদ্রঋনের থেকে। এই ব্যবস্থার বানিজ্যিক আবেদন আকর্ষনিয় কিন্তু দারিদ্র বিমোচনের সম্ভাবনা নেতিবাচক। কিন্তু বাজার মৌলবাদিদের যুক্তি হোল ক্ষুদ্রঋনে মুখি পুজিকেও দক্ষ হতে হলে এই ধরনের প্রতিযোগীতায় আসতে হবে। এটা নিয়ে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক টানাপোড়েন চলমান যেখানে ইউনুস বা তার সমর্থকরা রয়েছেন একদিকে আর অন্যদিকে আছেন ওয়াল স্ট্রীটের বানিজ্যিক পুজিপতি এবং তাদের সমর্থকরা। এই হাড্ডাহাড্ডি দ্বৈরথের মুখে সম্রাজ্যবাদিদের সমালোকেরা মুলত ইউনুসের পক্ষেই যাবার কথা ছিল। কিন্তু তারা এই দুই পক্ষকে একই কাফেলার যাত্রী হিসাবে দেখে সমালোচনা করেছেন — যার শিকার হবে বাংলাদেশি ক্ষুদ্রঋন যেটা সমালোচনার রিসোর্সের একটা বড় অপচয়। যেই ব্যবস্থাকে উপযুক্ত সমালোচনার মাধ্যমে আরো ক্ষুরধার করা যেত সেটাই একটা আত্মবিধ্বংসি যুদ্ধের সূচনা করেছিল — এই অপচয়ের কোন দরকার ছিলনা।
লেখাটা বড়, তবে শুরু করেছি। যা পড়েছি ভাল লেগেছে। মন্তব্য আসবে পরে।
@রৌরব, লেখার পরই লক্ষ্য করেছি এটাতে অল্প কথা বলতে অনেক বেশি শব্দ ব্যবহার করেছি। কিছুটা আলসেমির দরুন আর সম্পাদনা করা হয়নি। এছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রামান্য উদ্ধৃতিগুলোকেও রেখেছি যাতে সেটা অন্যদের নাগালের মধ্যে থেকে যায়।
আপনার মন্তব্যের আশায় থাকলাম।
অত্যন্ত সুন্দর একটি লেখা।
ইউনুস কে নিয়ে বামেদের সমালোচনা সম্পূর্ন ফালতু-অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা বালখিল্যতা। এই লেখাটি সেদিক দিয়ে বিরাট ব্যতিক্রমী।
তবে আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দুটী কথা বলি।
[১] সোশ্যাল বিজনেস বলে কিছু হয় না-বিজনেস বিজনেসই। ভারতে যারা সোশ্যাল বিজনেস ইত্যাদি করে বেড়ায় সব ঠকবাজ। বিজনেস করা হয় লাভের জন্যে। লাভ না করতে পারলে, কোন তকমাই টেকে না। ব্যাবসা টেকনোর নুন্যতম শর্ত-মার্জিন। সেটা সামাজিক ব্যবসাই হোক বা অসামাজিক ব্যবসাই হোক।
[২] গরীবদের শুধু টাকা ধার দিয়ে মার্কেটের সাথে যুক্ত করা যায় না। বিজনেস একটা স্কিল। মানুষের আবিস্কৃত সব স্কিলের সব থেকে জটিল স্কিল যেখানে গণিত, কমিইউকেশন স্কিল, মনস্তত্ব, যুক্তি -মানব বিবর্তনের পথে আসা সব স্কিলকেই উন্নত করতে হয়। একটা নুন্যতম ট্রেনিং এর মধ্যে কিছুদিন না থাকলে শুধু দুটো টাকা ধার দিয়ে ব্যাবসা করানো যায় না। সেক্ষেত্রে এই ধরনের ঋণ সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টি হয় কারন ধার নেওয়ার পরে কিভাবে সে ব্যবসা করবে জানে না।
[৩] একটা বিজনেস কমিনিযউটি ব্যাক-আপ না থাকলে, আনস্কিল্ড শ্রমিক-কৃষক শ্রেণির ব্যাবসা করে দাঁড়ানো সম্ভব না। ব্যবসা করতে গেলে, এই ছাতাটা জরুরী-যে কারন গুজরাতি বা মারোয়ারীরা অনেক সফল ব্যবসায়ী। ঋণের পাশাপাশি এই কমিনিউটি বিল্ডিংটাও জরুরী।
মোদ্দা কথা তত্ব দিয়ে এসব হবে না। একজন নিরক্ষর কৃষককে শুধু ঋণ দিলাম, শিক্ষা দিলাম না-আর্ সে ব্যবসা করবে-এসব চলে না। এগুলো পিউর এন্ড সিম্পল ধাপ্পা। ঋণ, ট্রেনিং, কমিনিযউটি বিল্ডিং এগুলো যদি সব একসাথে করা যায়-তবেই মাইক্রোফাইনান্স সফল হবে। নইলে, মহাজনি ব্যবসার সাথে এর পার্থক্য নেই।
@বিপ্লব পাল, ধন্যবাদ আপনার এনগেজিং মন্তব্যের জন্য। বাম ভাবধারার লেখকদের সমালোচনাটা আসলে একধরনের আইডিওলজিকাল হ্যাংগওভার (উইথ ডিউ রেসপেক্ট) বলে মনে হয় আমার কাছে। তাদের চিন্তাভাবনার একটা লোভনীয় উপাদান হচ্ছে “গুড ইন্টেনশান্স”। কিন্তু পরিবর্তনের জন্য শুভেচ্ছা যথেষ্ট নয়। কোনটা কাজ করে আর কোনটা করে না সেটা কে একটা একটা বাস্তব প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেই বিচার করা দরকার। বাস্তবতাকে অস্বিকার করে সেটা করা সম্ভব নয়।
[১] — সোশাল বিজনেসের একটা উদাহরনই আসলে ক্ষুদ্রঋন। ঋন তো ঋনই — এই ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ঋনের এই আলাদা প্রকরনের দরকারটা কি পরল? এই যায়গাটায় অনেক জটিলতার উত্তর পাওয়া যায়। অর্থনীতির ভাষার বলতে গেলে এই ক্ষুদ্রঋনের বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল ট্রানজ্যাকশান কস্ট। সহজ একটা উদাহরন দেয়া যাক — ক্ষুদ্রঋন ব্যবস্থায় কাউকে ১০,০০০ টাকা ধার দেবেন আর প্রচলিত ব্যবস্থায় একজন বড় ব্যবসায়ীকে আপনি দেবেন ১ কোটি টাকা। আপনার হাতে মোটা বিনিয়োগ যোগ্য অর্থ হচ্ছে ৫ কোটি। এখন যদি এটাকে ক্ষুদ্র ঋন হিসাবে দিতে হয় তাহলে আপনার পৌছাতে হবে ৫ হাজার গ্রাহকের কাছে। আর প্রচলিত ঋন নিয়ে আপনার ৫ জন গ্রাহকের কাছে পৌছানোই যথেষ্ট। কিন্তু এইযে গ্রহক প্রতি তাদের লোনেবিলিটি, কোলেটারাল ইত্যাদির নিরূপন — হাতে হাতে ঋন পৌছে দেয়ে টাকা ফেরত পাবার পেছনে একটা ব্যবস্থা পরিচালনা ইত্যাদি বাবদ আপনার অনেক বেশি খরচ করতে হবে যদি আপনি এই একই অর্থ ক্ষুদ্রঋন আকারে দিতে যান। এটাকেই অর্থনীতিবিদেরা বলেন “ট্রানজ্যাকশান কস্ট”। এটা প্রচলিত ব্যংক ব্যবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারছিলনা — সেই দিকেই বাংলাদেশে বিশেষত গ্রামীন ব্যংক ঘরানার মডেল কাটিয়ে ওঠার পথ তৈরি করেছে। এটাই গ্রামীন বা ইউনুসের সমাদরের কারন। যে কয়টি রাস্তা ধরে এটা করা সম্ভব হয়েছে তার একটা প্রধান রাস্তা ছিল সল্প বা শুন্য মুনাফা। হয়ত হবাক হবেন ২০% এর আশে পাশে সুদ নিলে সেটা আবার শুন্য মুনাফা কি করে হতে পারে? উত্তরটা হচ্ছে ট্রানজেকশান কস্ট। এই ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য মুলধনের তুলনায় পরিচালন ব্যয় বেশি করতে হয়। কিন্তু এটাকে সামাজিক ব্যবসার আদলে পরিচালনা করা হয়েছে বলে বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋন মডেলের গ্রহন যোগ্যতা তৈরি হয়েছে বিশ্বজোরা।
[২] অবশ্যই ব্যবসা একটা স্কিল — তবে এটাও লক্ষ্য করা দরকার যে সবকিছুরই একটা প্রথম বার আছে। কাজেই সুযোগটা কোননা কোন ভাবে তাকে পেতেই হোত!! তাছাড়া ক্ষুদ্রঋন কোন যেহেতু জবরদস্তিতে কারো উপর চাপিয়ে দেয়া হয়না একজন উদ্যোগি মানুষ নিজের ব্যবসার পটেনশিয়াল যাচাই করেই এই টুলকে ব্যবহার করার সুযোগ পায়। যারা দরিদ্র নয় তারাও নিজেদের মত একটা ঝুকির মূল্যায়ন করেই ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা থেকে ঋন নিয়ে থাকে। এই কাজটা দরিদ্র জনগোষ্ঠীও করে থাকে।
[৩] কমিউনিটি ব্যপারটাকে আসলে এন্ডোজেনাস হিসাবে দেখা চলে — মানে এটা তৈরি হবে। মানে আগে কমিউনিটি হবে — না আগে এরা ব্যবসা শুরু করার সুযোগ পাবে এটা ডিম আগে না মুরগী আগে প্রশ্নের মত অত জটিলও না বোধ হয়। কারন একটা কমিউনিটি তৈরির পূর্বশর্ত হচ্ছে এর ইন্ডিভিজুয়াল সদস্যদের উৎপত্তি। এখন এরা ঋন নিয়ে ব্যবসা করুক আর না নিয়ে সেটার উপর হয়ত তাদের কমিউনিটির সদস্যপদ আটকাবে না।
ব্র্যাক সম্ভবত শিক্ষা আর ক্ষুদ্রঋন একসাথে চালায় — আরো কিছু ক্ষুদ্রঋন প্রতিষ্ঠানেরই বহুমুখি কার্যক্রম রয়েছে। তবে কেন আমরা ক্ষুদ্রঋন প্রতিষ্ঠানের কাছেই একটা গ্র্যান্ড সমাধান আশা করব? যদি আমরা মনে করি আরো কিছু বাড়তি সামাজিক সুবিধা ক্ষুদ্রঋনকে সফল করবে (অর্থাৎ দারিদ্র বিমোচনে সাহাজ্য করবে) — তাহলে সেটাকি ক্ষুদ্রঋন ব্যবস্থাকে হটিয়ে দেওয়াকে জাস্টিফাই করে নাকি বাকি অপরিহার্যগুলোকে নিয়ে আসার তাগিদকে জোরালো করে সেটা বুঝতে কি আমরা ভুল করছি না। যদি আমরা অনেক রকম শর্ত আরোপ করি তাহলে তাহলে দিনের শেষে “নয় মন ঘিও পুড়বে না রাঁধাও নাচবে না”।
@রিয়াজ উদ্দীন,
এটা ত শুভঙ্করের ফাঁকি। যদি ধরে নিই ২০% সুদের উপায়ের পুরোটাই ট্রানসাকশনার কস্ট কভার করছে-তাহলে ব্যাঙ্কের আমানত বাড়বে কি করে? ব্যাঙ্কের পুঁজি আসবে কোথা থেকে? আমি ত সেই ব্যাঙ্কেই টাকা জমাব যে ব্যাঙ্ক আমাকে সুদ দেবে। আর আমাকে সুদ দিতে গেলে ব্যঙ্ককে লাভ করতেই হবে তার দেওয়া লোনের ওপরে। আপনার এই সামাজিক ব্যবসার ব্যাখ্যাটা সম্পূর্ন ২+ ১=৪ এর গল্প। সম্ভবত গ্রামীন ব্যাঙ্ক নিজেদের পাবলিক রিলেশন ভাল করার জন্যে বাজারে ছেরেছে। এর কোন বাস্তব বা সত্য ভিত্তি থাকতে পারে না।
গ্রামীন ব্যাঙ্ক যদি অন্য ব্যাঙ্কের সমান হারে আমানতকারীদের টাকা ফেরত না দেয়, সেই ব্যাঙ্কে লাল বাতি জ্বলে যাবে। গ্রামীন ব্যাঙ্কত বাজারের নিয়মের বাইরে না।
@বিপ্লব পাল,
ভাল পর্যবেক্ষন। তবে যদি ট্রানজেকশান কস্টের মধ্যে আমানতকারিদের মুনাফা দেবার ব্যপারটা কে অন্তর্ভুক্ত করা হলে সেই ফাকিটা আর থাকছে না। ক্ষুদ্র এবং প্রচলিত ঋনের মধ্যে পার্থক্য দেখাতেই আমি মূলৎ ট্রানজেকশান কস্টের পার্থক্যের উদাহরন দেখিয়েছি (কিছুটা হাইপোথিটিকাল অর্থে) — এইছাড়া মোটাদাগে বলতে গেলে প্রচলিত ঋন এবং ক্ষুদ্রঋনের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। তবে ঝুকি নিরূপন এবং সিলেকশানের ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সেই পার্থক্যটাও এসেছে মূলত ট্রানস্যাকশান কস্টের পার্থক্য থেকেই। অর্থাৎ ট্রানজেকশান কস্টের যেই পার্থক্য এটা কমিয়ে আনতেই ক্ষুদ্র ঋন ব্যবস্থায় সাধারনত গ্রুপ লেন্ডিং ব্যবস্থার মাধ্যমে ঋন বিতরনে ক্লায়েন্ট সিলেকশান করা হয়। সে ক্ষেত্রে সামাজিক নেটওয়ার্ক এবং ট্রাস্ট ব্যবস্থা ট্রানজেকশান কস্টের পার্থক্যটা কমিয়ে দেয়। যেকোন ব্যংকের মাথাব্যাথা থাকে এমন লোককে ঋন দেবার যাতে টাকা ফেরত পাবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। প্রচলিত ব্যঙ্ক এটা নিশ্চিত করার জন্য যেসব ব্যবস্থা নেয় ক্ষুদ্রঋন প্রতিষ্ঠানগুলোর সেই ক্ষেত্রে নিতে হয় অন্য ব্যবস্থা (গ্রুপলেন্ডিং এর মাধ্যমে সেলফ সিলেকশান — প্রয়োজনে আরো ব্যখ্যা করব — জার্গনের ব্যবহার হয়ে যাচ্ছে — অস্পষ্টতা থাকলে আস্তে আস্তে পরিষ্কার করব)। কিন্তু ওদের যেই সুদের হার এতে কোন লাভ থাকছে না এমনটা আমি বলতে চাচ্ছি না। বরং বলতে চাচ্ছি ২০% সুদ যদি একটি ক্ষুদ্রঋন প্রতিষ্ঠান নিয়ে থাকে তার একটা বড় অংশ ঋন বন্টনের খরচ হিসাবেই চলে যায়। বলা যায়, বাংলাদেশের মডেলে কস্ট কমানোর যেধরনের কৌশল ব্যবহার করা হয় সেগুলো হাতে না থাকলে ২০% দিয়েও ঋন বন্টনের খরচ তুলে আনা যেতনা। এই বাঁধাটা সরিয়ে দিতে সমর্থ হবার দরুনই ক্ষুদ্রঋনের বাংলাদেশ কেন্দ্রিক মডেলটি দেশে দেশে প্রবর্তিত হয়েছে।
@রিয়াজ উদ্দীন,
অত্যন্ত ভাল একটা লেখা। বিশ্লেষনের মান এবং গভীরতা দেখে মনে হয়েছে একজন দক্ষ পেশাদার অর্থনীতিবিদের লেখা। এই ফোরামে সাধারনত: এই মানের অর্থনৈতিক পর্যালোচনা দেখা যায়না। মুক্তমনায় আপনাকে স্বাগতম।
আপনার লেখার উপর কয়েকটা পর্যবেক্ষনমূলক মন্তব্য করব।
(১) এখনকার অধিকাংশ আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পর্যালোচনায় মতাদর্শগত গোঁড়ামী এবং পর্যালোচনার মতাদর্শিকরন (idiologization of the discourse) একটা বড় সমস্যা। সমাজতন্ত্র এবং পুঁজিবাদকে যদি আমরা মতাদর্শ (কিংবা ধর্মশাস্ত্র) হিসেবে না নিয়ে প্রথমটাকে আর্থরাজনৈতিক বিশ্লেষণপদ্ধতি (methodology) এবং দ্বিতীয়টাকে (অর্থাৎ মুক্ত বাজার ব্যাবস্থাকে) অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া (mechanism) হিসেবে নিতাম, তাহলে হয়ত একটা সমৃদ্ধ অথচ ন্যায়ানুগ একটা সমাজ এবং পৃথিবী গড়ার কাজটা অনেক এগিয়ে থাকত।
(২) সমাজতান্ত্রিক চিন্তার অন্যতম পুরোধা মার্কস দেখিয়েছিলেন যে পুঁজির মালিক শ্রমিকের উৎপাদিত বাড়তি মূল্য আত্মসাত করে। এর একটা সমাধান হল পুঁজির উপর শ্রমিকের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করা। মার্কস শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করে এটা করতে চেয়েছিলেন। ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাকে পুঁজির উপর শ্রমিককে মালিকানা দেয়ারই একটা “ক্ষুদ্র” প্রচেষ্টা বলা যায়। দর্শনগতভাবে ক্ষুদ্রঋণের সাথে মার্কসবাদের এই জায়গায় মিল আছে। কিন্তু মতাদর্শগত অন্ধত্বের জন্য অনেক বামই এটা দেখতে পাননা। বরং উল্টো এটাকে পুঁজিবাদেরই তৈরী একটা ধোঁকা বলে সমালোচনা করেন।
(৩) ক্ষুদ্রঋণ ব্যাবস্থাকে আমার কাছে বৌদ্ধিক এবং নৈতিকভাবে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটা পদ্ধতি মনে হয়। তার মানে এই নয় যে এর প্রয়োগ সমালোচনার উর্ধে থাকবে। বিশেষ করে ড: ইউনুসের নেতৃত্বে এবং ব্যবস্থাপনায় গ্রামীণ ব্যাংক দারিদ্র মোচনে কতখানি ফলপ্রসু হয়েছে সেটাকে অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। কিন্তু সেটা করতে হবে তথ্য উপাত্তের ভিত্ত্বিতে, রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়।
@মোঃ হারুন উজ জামান,
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। মুক্তমনার মিথস্ক্রিয়া আমার বেশ ভাল লাগছে। আপনার পর্যবেক্ষনমূলক মন্তব্যগুলোর সাথে অনেকটাই সহমত। এগুলো নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করা সম্ভব। তবে এখানে আপনার সাথে ভবিষ্যতে আবার দেখা হবে এই আশায় আজকের মত লোভ সংবরন করছি।
মতাদর্শের মধ্যে একধরনের রোমান্টিসিজম খুজে পান অনেকে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে অনেক ক্ষেত্রেই মতাদর্শ একটা ডেড এন্ডের মত কাজ করে — একজন মতাদর্শ বাদির পাতে আপনি যাই তুলে দেবেন তিনি সেটাকেই সেই একই ছাঁচে ফেলে বোঝার চেষ্টা করবেন — এবং অন্যন্য ছাঁচগুলর সম্ভাবনাকে অস্বিকার করবেন। এটা বেশ ভয়ংকর ফাঁদ।
আপনার তৃতীয় পয়েন্টে একটা বিষয় যোগ করব। এটা কিছুটা হতাশার যায়গা থেকে বলা। আমাদের রাজনৈতিক আলোচনা ক্ষুদ্রঋনকে দেখেছে আইদার-অর এর বাইনারি চিন্তার মধ্য দিয়ে। এর পেছনে যেই পরিমান রিসোর্স নষ্ট হয়েছে সেটা অনর্থক। ক্ষুদ্রঋন ব্যবস্থায় যেসব সীমাবদ্ধতা আছে/ছিল সেগুলোকে দূর করার চেষ্টায় যদি ঠিক এই রিসোর্সগুলি কাজে লাগানো হত — আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু সেটা করা হয়নি। বাংলাদেশের দারিদ্রের পেছনে যেই কারন তার একটা বড় অংশের জন্য আমাদের মনস্তত্ব অনেকটা দায়ি।
দারিদ্রের ফাঁদে যে পরে সে যতটা কষ্ট বা যন্ত্রনা অনুভব করে আরাম কেদারায় বসে একজন অর্থনীতিবিদের পক্ষে সেটা বোঝা কখনই সম্ভব নয়। কাজেই দারিদ্রে কবল থেকে বেরিয়ে আসার একটা গরজ তার আছে এইগুকু মোটাদাগে সতঃসিদ্ধ হিসাবেই নেয়া চলে। সেই ক্ষেত্রে একজন দরিদ্র মানুষের প্রধান প্রয়োজন সুযোগ। আয় রোজগারের এবং আত্মনির্ভরতার বোধ অর্জন। দান, চ্যারিটি সেফটি নেট এগুলো দিয়ে সেটা অর্জন সম্ভব নয়।
একটা উদাহরন হিসাবে দেখুন নিচের ভিডিও চিত্রটিঃ
httpv://www.youtube.com/watch?v=lV-iP1jSMlI
এখানে যেই শ্রমিকটিকে দেখছেন তাকে কি অলস বলবেন নাকি বুদ্ধিহীন বলবেন? এই লোকটি যদি প্রত্যাশা করে সে এমন একটি সমাজে থাকতে চায় যেখানে পরিশ্রম এবং মেধার বিনিময়ে সে সিড়ি বেয়ে কাংখিত উচ্চতায় পৌছাতে পারবে সমাজকি সেটা দিতে পারছে তাকে? যদি না পেরে থাকে তাহলে এটা একটা আনজাস্ট সমাজ — পুঁজিবাদ বলেন আর সমাজতন্ত্র বলেন একজন মানুষ কতটা পরিশ্রম করবে, সে কতটা মেধা খরচ করবে এটা তার কাংখিত জীবনমানের সমানুপাতিক হওয়া উচিত (বিনিয়োগ এবং প্রাপ্তি দুইবিবেচনাতেই)। এক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দূর করাটা জরুরী। আইডিওলজি বেসড সমাজে তার জীবনে কতটা কাজ করতে হবে — আর কতটা সমৃদ্ধি পাবার সেটার সিদ্ধান্ত নেবার কাজটি তার হয়ে অন্য কেউ করে দিচ্ছেন। আবার পুজিবাদি ব্যবস্থাতেও বটলনেক অনেক সময় অত্যন্ত সরু হতে পারে। সেটাও সচেতনভাবে কাটিয়ে ওঠা জরুরী। সেই ক্ষেত্রে আপনি যে মেকানিকম কেন্দ্রিক চিন্তার দরকারের কথা বলেছেন সেটার সাথে আমি একমত। এর জন্য দরকার ক্ষুদ্রঋন, শিক্ষা, আতসচেতনতা বোধের মত নানারকমের অস্ত্র। যদি সমাজ মানুষকে তার শ্রম বিনিয়োগ সত্বেও তাকে একটা ডিসেন্ট জীবনের নিশ্চয়তা দিতে না পারে তাহলে ব্যক্তির মত সমাজও মুখ থুবরে পরে।
@বিপ্লব পাল,
অনেক দেরীতে এখানে এলাম। লেখকের লেখাটা মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। ক্ষুদ্রঋণ ও গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে নির্মোহ বিশ্লেষণ দিয়েছেন। কিছু সাধারণ গৎবাঁধা ধারনার বিপরীতে যুক্তি খন্ডন করেছেন। ভালো লেগেছে।
তবে বিপ্লব পালের সামাজিক ব্যবসা সম্পর্কে একটা আমার চোখ পড়েছে। তিনি বলেছেন,
ভারতে যারা সোশ্যাল বিজনেজ করে তারা সবাই ঠকবাজ কি না জানি না। তবে সোশ্যাল বিজনেস সম্পর্কে তার ধারনাগত একটা সমস্যা আছে বলে মনে হলো। হ্যাঁ, সোশ্যাল বিজনেজ অবশ্যই একটি বিজনেস – পুরোপুরি বিজনেস। বিজনেসের নিয়মনীতি মেনে চলেই সোশ্যাল বিজনেস করতে হয়। এখানেও লক্ষ্য থাকে প্রফিট বা মুনাফা। তবে ঐ প্রফিট ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহৃত হতে পারবে না। সামাজিক স্বার্থে অর্থাৎ সামাজিক উন্নয়নে তা ব্যবহার হতে হবে। এককথায় সোশ্যাল বিজনেস থেকে যা প্রফিট হবে তা বোর্ড সদস্য বা প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের ব্যক্তিগত উন্নয়নে ব্যবহার করা যাবে না। অন্যদিকে, অন্য ব্যবসার ক্ষেত্রে সমস্ত প্রফিট মালিকদের পকেটে যায়। এখানেই সোশ্যাল বিজনেসের সাথে অন্যান্য বিজনেসের মধ্যে ধারনাগত পার্থক্য। এখন ড. ইউনুসের গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ থেকে যা প্রফিট আসছে সেসব প্রফিট যদি তার নিজের পকেটে বা বোর্ড অব ডিরেক্টরসদের পকেটে যেয়ে থাকে, তাহলে সেটা সোশ্যাল বিজনেস নয়। আর যদি ঐ প্রফিটের টাকা গরীব মানুষদের কল্যাণে বা সামাজিক সমস্যা সমাধানে ব্যয় হয়ে থাকে তাহলে সেটাই হলো সোশ্যাল বিজনেসের চেতনা। মূল কথা, সামাজিক কল্যাণেই সোশ্যাল বিজনেস।
@অডঙ চাকমা, সামাজিক ব্যবসা সম্পর্কে আপনার ব্যখ্যাটা মন্দ লাগেনি। এটা মোহাম্মদ ইউনুসের ব্যখ্যার সাথে পুরোপুরি মিলছে এমনটা বলতে পারছি না। তবে আপনার সংজ্ঞাটা গ্রহন করলে গ্রামীন ব্যাঙ্কের ক্ষুদ্রঋনকে সামাজিক ব্যবসা বলাটা আরো সহজ হয়। কেননা যতদূর জানি গ্রামীন ব্যাঙ্ক তার দরিদ্র জামানতকারিদের মধ্যে লভ্যাংশ ভাগ করে দেয় — ডিভিডেন্ট আকারে। যদিও আমার সাধারন জ্ঞান বলে গ্রামীন ব্যঙ্কের যেই সুদের হার তাতে সেই লভ্যাংশ খুব বড় আকারের কিছু হবার কথা নয়।
মুক্তমনায় স্বাগতম, এবং গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির জন্যও অনেক ধন্যবাদ।
ব্যস্ততার কারণে সামান্য চোখ বুলালাম। বেশ নির্মোহভাবেই ডঃ ইউনুসের ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করেছেন বলে মনে হল। পুরোটা পড়ে মন্তব্য করবো আবারো।
@অভিজিৎদা, ধন্যবাদ — আমি চেষ্টা করেছি নির্মোহ আলোচনা করার। তবে কতটা নির্মোহ হোল সেটা বুঝতে পারব যুক্তি তর্কের প্রবাহ থেকে। আপনার বিষদ মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকলাম।