ভাষা মানুষের সাংস্কৃতিক বিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভাষার উদ্ভব ও তার বিকাশের পরিপূর্ণতা আমাদের মানব সভ্যতায় বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করেছিলো। তাই সভ্যতার ক্রমবিকাশে ভাষাকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নাই।
মানুষের জন্ম ও বিকাশের সাথে তার মাতৃভাষার প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে। শিশু এই পৃথিবীতে এসে প্রথম যেই ভাষার, যেই ধ্বনির সাথে পরিচিত হয় তা তার মাতৃভাষা হতেই আসে, সবচেয়ে ভালোবাসা আর উষ্ণতা লাভ করে যে মায়ের কাছ থেকে তার ভাষাই তার আপন হয়ে ওঠে অনেক বেশি। তাই মায়ের ভাষা মানুষের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। শোকে- ক্ষোভে- আনন্দ- উচ্ছ্বলতায় মানুষের সব অনুভূতির সত্যিকার প্রকাশ ঘটে তার মাতৃভাষাতেই।
বাঙালি জাতির মাতৃভাষা বাংলা। তাই সে বাংলাতে কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা গিয়েছে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বাঙালির প্রাণের ভাষাকে দমিয়ে রাখা হয়েছে অথবা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলার দামাল ছেলেরা তাদের মায়ের ভাষার জন্য অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দেয় কতটুকু দামী আমাদের এই মাতৃভাষা আর সেই সাথে প্রতিষ্ঠিত করে আমাদের মাতৃভাষার অধিকার।
প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে বাংলাদেশের বাঙালীরাই একমাত্র জাতি নয় যারা আপন মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছে এবং বুকের রক্ত ঝরিয়েছে। কিন্তু এই রকম উন্নাসিক চিন্তা ও মিথ্যা বয়ানের প্রচুর নজির আমরা পাই আমাদের গল্প ও ইতিহাসের বইগুলোতে যা ভাষার জন্য আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এই জাতির সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে প্রকারন্তরে প্রশ্নবিদ্ধ করে, বাংলাভাষী সংগ্রামী জাতি হিসেবে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত লজ্জিত করে। বাংলার জন্য শুধুমাত্র বাংলাদেশের বাঙালিরাই জীবন উৎসর্গ করেনি, করেছে আসামের জনগণও। এছাড়াও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলন ইতিহাসের আরেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আসামের বাংলা ভাষা আন্দোলন
বাহান্নর ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রাণ দিয়েছেন সালাম, রফিক, সফিয়ুর, বরকত ও জব্বার। বাহান্নর চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ১৯৬১ সালের মে মাসে বাংলা ভাষার ব্যবহার বন্ধ করার প্রতিবাদে ভারতের রাজ্য আসামের শিলচর শহরে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন এগারো জন ভাষাশহীদ। দুঃখের বিষয় ইতিহাস তাঁদের তেমন মনে রাখেনি।
আসাম রাজ্যর প্রধান ভাষা অহমীয়া হলে বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ,কাছাড় এবং শিলচর হলো বাঙালীদের ঘাঁটি। দেশবিভাগের একবছর পর ১৯৪৮ সালে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সুরমা ভ্যালী (বর্তমান সিলেট বিভাগ) পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয় । কিন্তু বৃহত্তর সিলেটের তিন চতুর্থাংশ নিয়ে বরাক ভ্যালী থেকে যায় আসামে । ১৯৬১ সালে আসাম প্রাদেশিক সরকার শুধু অহমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারী ভাষা ঘোষনা দিলে ক্ষোভ দানা বাঁধে বাঙালীদের ভেতর । ক্রমশঃ তা রূপ নেয় আন্দোলনে। প্রথমে সত্যাগ্রহ, পরে সহিংস ।
১৯৬১ সালের ১৯ মে । আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্বে এদিন শিলচরে সকাল ৬টা-সন্ধ্যা ৬টা ধর্মঘট পালন করে। বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে ভাষাবিপ্লবীরা যখন স্থানীয় রেলওয়ে ষ্টেশনে রেলপথ অবরোধ পালন করছিল তখন নিরাপত্তারক্ষায় নিয়োজিত আসাম রাইফেলসের একটি ব্যাটালিয়ান তাদের বাধা দেয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে আসাম রাইফেলস গুলবর্ষন করলে ঘটনাস্থনে প্রান হারান ১১ জন ভাষাবিপ্লবী। আহত হন অর্ধশতাধিক। রাজ্য সরকার শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়। এরপর আসামে বাংলাকে ২য় রাজ্যভাষা হিসাবে ঘোষনা দেয়া হয়।
সেদিন মাতৃভাষার জন্য যে ১১ জন বীর শহীদ আত্মবলি দেন তাদের মধ্যে ছিলেন পৃথিবীর প্রথম নারী ভাষাশহীদ সতের বছরের তরুনী কমলা ভট্টাচার্য। পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র দুজন নারী মাতৃভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন- একজন শহীদ কমলা ভট্টাচার্য, দ্বিতীয় জন শহীদ সুদেষ্ণা সিংহ যিনি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতির আন্দোলনে শহীদ হন।
১৯ মের ১১ জন ভাষাশহীদদের তালিকা –
১. শহীদ কমলা ভট্টাচার্য
২. শহীদ শচীন্দ্র পাল
৩. শহীদ বীরেন্দ্র সূত্রধর
৪. শহীদ কানাইলাল নিয়োগী
৫. শহীদ চন্ডিচরন সূত্রধর
৬. শহীদ সত্যেন্দ্র দেব
৭. শহীদ হীতেশ বিশ্বাস
৮. শহীদ কুমুদরঞ্জন দাস
৯. শহীদ তারিণী দেবনাথ
১০. শহীদ সুনীল সরকার
১১. শহীদ সুকুমার পুরকায়স্থ
আসামে ১৯ মে এখনও ভাষাদিবস পালন করা হয়।
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলন
১৯৫৫ সন থেকেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা মাতৃভাষার অধিকারের আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলন(১৯৫৫-১৯৯৬) শুরু হয় ‘নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মহাসভার’ ১৯৫৫ সালের দাবীর ভেতর দিয়েই, যেখানে তাদের দাবী ছিল আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং ভাষার অধিকারের দাবীতে ভাষা পরিষদের উদ্যোগে গড়ে উঠে ‘সত্যাগ্রহ আন্দোলন’। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সাতটি দাবীর ভেতর ছিল : আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতি, আসামের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে রাষ্ট্রীয় বেতার কার্যক্রমে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম প্রচার, নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান, কেন্দ্র ও রাজ্য সভাতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের আসন সংরক্ষণ, সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের কোটা সংরক্ষন, ভাষিক সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং ১৯৬১ সালের আদমশুমারীর সংশোধন।
সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬১ সালের ২ জুলাই ভাষা পরিষদ ভাষা দাবী দিবস পালন করে। ১৯৬১ সনের ২৫ জুলাই আসাম রাজ্যের শিক্ষা বিভাগের সাথে যোগাযোগ করা হয়। ১৯৬৩ সনের ২২ মার্চ শ্রী ডি এন বাজপেয়ি নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদের সাথে দেখা করেন। ভাষা পরিষদ ১৯৬৪ সালের ৭ জুলাই আসামের মূখ্যমন্ত্রীর কাছে একটি মেমোরান্ডাম পেশ করেন। ১৯৬৪ সালেরই ২৮ জুলাই বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য রাজনৈতিক বিভাগের কাছে পাঠানো হয়। ১৯৬৫ সালের ২-৮ জুলাই ভাষা দাবী সপ্তাহ পালন করা হয়। ১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা পরিষদ স্টেট বোর্ড অব ইলিমেন্টারি এড্যুকেশন এর সেক্রেটারি শ্রী কে কে শর্মার সাথে সাক্ষৎ করেন এবং তাকে আসামে দ্রুত বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে চালুর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। ১৯৬৭ সালের ২ জুলাই দাবী সপ্তাহ ১২ দিন দীর্ঘায়িত করা হয় এবং কাছাড় জেলার সর্বত্র পাবলিক সভা সমাবেশ করা হয়, এইসব সভায় আদমশুমারী জালিয়াতির বিরুদ্ধে জোড়দার বক্তব্য রাখা হয়। ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে ভাষা পরিষদ নিজেরাই নিজস্ব উদ্যোগে জনপরিসংখ্যান উত্থাপন করেন এবং কাছাড়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের জনসংখ্যা দেখান ৬৬,৬২৩ জন। ১৯৬৮ সালের মে মাস থেকেই স্কুল, কলেজসহ রাস্তা ঘাটে পিকেটিং, ধর্মঘট, গণশ্লোগানের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসেই পাবলিক সভা গুলো আরো ব্যাপক বিস্তৃত হয় এবং ১৯৬১ সনের উপনিবেশিক আদমশুমারী প্রতিবেদন পোড়ানো হয়। ১৯৬৮ সনেরই ২৫ জুলাই আসামের শিক্সমন্ত্রী জে বি হেগজার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের দাবীর প্রেক্ষিতে ভারত সরকারের ভাবনা তুলে ধরেন। একই সনের ৩০ আগস্ট কাছাড়ের জনগণ আবারো আসামের মূখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবী দাওয়া সংবলিত মেমোরান্ডাম পেশ করেন। ১৯৬৯ সালের ১৫ অক্টোবর কাছাড়ের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী শিক্ষার্থী ও যুবসমাজ রক্ত দিয়ে রক্তস্বার কর্মসূচি পালন করে। এর পর পরই ভাষা আন্দোলন আরো চূড়ান্ত গণ রূপ নেয় এবং ব্যাপক ধর্মঘট, ধরপাকড়, বন্ধ কর্মসূচি চলতে থাকে। ১৯৬৯ সালের ২২ অক্টোবর কাতিগড়া বন্ধ কর্মসূচি থেকে ৭ জন ভাষাবিদ্রোহীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৯ সনে পূর্ব পাকিস্থানে একদিকে যেমন চলতে থাকে গণঅভুত্থান একই দিকে বরাক উপত্যকায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের ভাষা আন্দোলন বন্ধ-ধর্মঘট- ঘেরাও-গ্রেফতারের ভেতর দিয়ে জনরূপ নেয়। নরসিংহপুর, রাতাবাড়ি, শালচাপড়া বন্ধ(৫-২৯ অক্টোবর,১৯৬৯)। জাপিরবন্দ বন্ধ(৩০ অক্টোবর ১৯৬৯) থেকে ২৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়, এই পয়লা কোনো নারী ভাষাবিপ্লবীও গ্রেফতার হন। মেহেরপুর বন্ধ (৩১ অক্টোবর ১৯৬৯) থেকে ৫ জন নারী আন্দোলনকারীসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পয়লা নভেম্বর’ ১৯৬৯ সালের পিকেটিং থেকে ২৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়, ৩ নভেম্বর ১৯৬৯ গ্রেফতার হন ৩৮৫ জন, ১-৫ নভেম্বরের ভেতর তিন জেলার ডিসি অফিসে পিকেটিং করে চেয়ার দখল করে নেয়া হয়, ৪-৫ নভেম্বর ১৯৬৯ গ্রেফতার করা হয় ১১১ জনকে। রাষ্ট্রের ধরপাকড় ও নির্যাতনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে ১১-১৩ নভেম্বর ১৯৬৯ তারিখে শিলচর শহরে বিশাল গণসমাবেশের আয়োজন হয়। শিলচর, নরসিংহপুর, হাইলাকান্দি ও পাথারকান্দিতে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে ফেলেন ভাষাবিপ্লবীরা, এই ঘটনায় সরকার ২৩৮ জনকে গ্রেফতার করে। ১৭ নভেম্বর ১৯৬৯ শিলচর বন্ধ থেকে ৩০০ জন সত্যাগ্রহীকে গ্রেফতার করা হয়। হাইলাকান্দির ওএসএ মাঠে বিশাল সমাবেশ ডাকা হয় একই সনের ২১ নভেম্বর, হাইলাকান্দি বন্ধ থেকে সবচে’ ব্যাপক ধরপাকড়টি হয় প্রায় ১৫০০ জন ভাষাবিদ্রোহীকে সরকার অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে। ১৯৬৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর ‘ডিসি অব লিংগুস্টিক মাইনরিটিস ইন ইন্ডিয়া’ শিলচর আসেন এবং মহাসভার সাথে বৈঠক করেন।
১৯৭০ সাল থেকে ভাষা আন্দোলন অন্য মোড় নেয়। ১৯৭০ সালের ১৯-৩০ এপ্রিলের ভেতর কাছাড়, ত্রিপুরা ও শিলং-এ ২৪ ঘন্টার গণঅনশণ করেন বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষাবিদ্রোহীরা। ১৯৭২ সালের ১২ ডিসেম্বর কাছাড়ের সর্বত্র ৪৮ ঘন্টার গণঅনশণ, ১৯৭৪ সালের ৯ মার্চ কাছাড়ের সর্বত্র ৭২ ঘন্টার গণঅনশণ পালন করা হয়। ১৯৭৮ সালের ২ ডিসেম্বর করিমগঞ্জ ও কাছাড়ের সর্বত্র ‘সংখ্যালঘু বাঁচাও দিবস’ পালন করা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি যেদিন বাঙালির মাতৃভাষা দিবস, সেই তারিখে ১৯৭৯ সালে সমগ্র কাছাড়ে পালিত হয় অবস্থান ধর্মঘট।
১৯৮২ সালের ২৫ জানুয়ারি আসামের শিল্প মন্ত্রণালয় ও ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়নের’ ভেতর একটি বৈঠক হয়। ‘নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মহাসভা’ এবং ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়ন’ যৌথভাবে অবিলম্বে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে স্বীকৃতির দেয়ার বিষয়ে পদপে নেয়ার জন্য আসামের মূখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়ার কাছে মেমোরান্ডাম পেশ করেন। ১৯৮৩ সালের ২৫ অক্টোবর আসামের রাজ্য সরকারের কেবিনেট মিটিং-এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, কাছাড় ও করিমগঞ্জ জেলার স্কুল গুলোতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তর্ভূক্ত করার। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত কেবলই সিদ্ধান্তই থেকে যায় এর কোনো বাস্তবায়ন হয় না। ১৪ নভেম্বর ১৯৮৩ তারিখে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা চালু বিষয়ক একটি নোটিফিকেশন হয়, কিন্তু দুঃখজনকভাবে ৮ ডিসেম্বর ১৯৮৩ তারিখে তা স্থগিত করা হয়। ১৯৮৪ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদ ঠার ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ যাত্রা ও দাবীসমূহ নিয়ে প্রকাশিত দলিল (Let history and facts speak about Manipuris) আকারে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাাৎ করে। কিন্তু তারপরও রাষ্ট্র কোনো উদ্যোগ নেয় না। আবারো ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়ন’ আন্দোলনের ডাক দেয়। ১৯৮৫ সালের ২ জুলাই ‘ নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়ন’ দাবীদিবস পালন করে। ১৯৮৯ সালের ১৯ জানুয়ারি পুনরায় জাপিরবন্দ-সোনাপুরে জনসভা ও রক্তস্বার কর্মসূচি পালন করে ছাএ ইউনিয়ন। আসামের রাজধানী গুয়াহাটিতে কেন্দ্রীয়ভাবে ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিবাদ মিছিল করে ১৯৮৯ সালের ২৫ এপ্রিল। ১৯৮৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নলিনী সিংহ, নির্মল সিংহ, কৃপাময় সিংহ, সুরচন্দ্র সিংহদের নেতৃত্বে ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা ১২ ঘন্টা ‘রেল রোকো কর্মসূচি’ পালন করে। ১৯৮৯ সালের পয়লা ডিসেম্বর বিধান সভা চলাকালীন সময়ে দিসপুরে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রিলে অনশন পালিত হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭ জুলাই তারিখে সরকার আবারো বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা চালুর জন্য আরো একটি নোটিফিকেশন করে এবং ৬ আগস্ট ১৯৮৯ তারিখে তা স্থগিত করে। ১৯৯০ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যুষিত অঞ্চলে এল.পি স্কুলের ক্লাস বয়কট করা হয়।
১৯৯১ সালের সালের ২৬ জানুয়ারি রাজকুমার অনিলকৃষ্ণ মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এবং সুরচন্দ্র সিংহ সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। এদের নেতৃত্বেই ১৯৯২ সালের ৬,১০,১৯ আগস্ট শিলচর, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ জেলার ডিআই অফিসে অনশন ধর্মঘট পালিত হয়। লড়াকু ছাত্ররা সম্মিলিতভাবে ১৯৯২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ১৫ দিনের ভেতর বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা চালু করার দাবী জানিয়ে চরমপত্র দেয়। ঐদিন শিলচর গান্ধিবাগ ময়দানে প্রায় দশহাজার মানুষের এক বিশাল জমায়েতের মাধ্যমে এই চরমপত্র দেয়া হয়। কিন্তু ঐ চরমপত্রকে কোনো গুরুত্ব না দেয়ায় ভাষা-আন্দোলন আরো দ্রোহী হয়ে উঠে এবং ১৯৯২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রবিশংকর সিংহ ও কুলচন্দ্র সিংহের নেতৃত্বে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী গণসংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর বরাক উপত্যকার বারমুনি, কাটাখাল, কালানি, পাথাবরকান্দিতে ২৪ ঘন্টার জাতীয় সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। ১৯৯২ সালের পয়লা নভেম্বর আন্দোলনকারীরা জাতীয় কনভেনশনের আয়োজন করে। ১৯৯২ সালের ১৬ নভেম্বর ৩৬ ঘন্টার সড়ক অবরোধ কর্মসূচি আহবান করা হয়। ১৯৯২ সালের ৩ ডিসেম্বর আসামের মূখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়া দিসপুরে এক বৈঠক আহবান করেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে রাষ্ট্রের মূখ্যমন্ত্রী স্তরে এটিই ছিল কোনো প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক। রাষ্ট্রীয় বৈঠকে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না হওয়ায় আন্দোলনকারীরা পুনরায় ১৯৯৩ সালের ৮ ফেব্র“য়ারি হতে ৪৮ ঘন্টার সড়ক অবরোধ শুরু হয়। আসামে বিধানসভা চলাকালীন সময়ে দিসপুরে ১৯৯৩ সালের ২২ মার্চ ৩৬ ঘন্টার গণঅনশণ কর্মষূচি পালিত হয়। বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১০১ ঘন্টার রেল রোকো কর্মসূচি আরম্ভ হয় ১৯৯৩ সালের ২৭ এপ্রিল হতে বুরুঙ্গা, কাটাখাল, পাথারকান্দি এলাকায়। এই কর্মসূচির ফলে বরাক উপত্যকায় রেল চলাচল কার্যত বন্ধ ছিল। এই রেল রোকো কর্মসূচির ফলে অনেক সত্যাগ্রহী আন্দোলনকারী গ্রেফতার হন। ১৯৯৩ সালের ১০ মে কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দির তিন জেলার ডিআই এবং ডিইইও অফিসে ১২ ঘন্টা পিকেটিং করা হয় এবং এর ফলে শিক্ষা বিভাগের অফিস পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। ১৯৯৩ সালের ২০ ডিসেম্বরও বরাক উপত্যকার অনেক সড়কে ৭২ ঘন্টার অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালের ২৬ মে ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ত্রিপুরা রাজ্যের প্রাথমিক স্কুল গুলোতে(মূলত: বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যূষিত এলাকায়) বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে অন্তর্ভূক্ত করে। কিন্তু আন্দোলনের কেন্দ্রীয় এলাকা আসাম রাজ্যে এই সিদ্ধান্ত নিতে সরকার তখনও গড়িমসি ভাবই বজায় রেখেছিল।
আসামের বরাক উপত্যকায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের দীর্ঘ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৬ মার্চ একটি রক্তক্ষয়ী দিন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ভাষাবিপ্লবীরা বরাক উপত্যকায় ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে ৫০১ ঘন্টার রেল অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ ভাষা আসামের পাথারকান্দির কলকলিঘাট রেলস্টেশনে আন্দোলনকারীদের একটি মিছিলে রাষ্ট্রের পুলিশ গুলি করে আন্দোলনকারীদের উপর। এই ঘটনায় অনেক ভাষা বিদ্রোহী আহত হন এবং ব্যাপক ধড়পাকড় হয় এবং মাতৃভাষার অধিকার চাইতে গিয়ে রাষ্ট্রের নৃশংস বন্দুকের গুলিতে জান দেন বিলবাড়ি গ্রামের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী বিপ্লবী সুদেষ্ণা সিংহ। বরাক উপত্যকাতেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতির আন্দোলনে ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ শহীদ হোন বিশ্বের দ্বিতীয় নারী ও প্রথম আদিবাসী নারী ভাষাশহীদ সুদেষ্ণা সিংহ। ঐদিন পুলিশের গুলিতে আহত হোন সহস্রাধিক বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাযোদ্ধা এবং পরে হাসপাতালে প্রান হারান আরো একজন শহীদ সলিল সিংহ। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাসকে আর উপক্ষা করতে পারে না আসাম রাজ্য সরকার। আসাম রাজ্যের ইলিমেন্টারি এডুকেশন এর ডেপুটি ডিরেক্টর ২০০১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বরাক উপত্যকার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যূষিত গ্রামের ৫২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার প্রথম পাঠ্য পুস্তক ‘কনাক পাঠ’ তৃতীয় শ্রেণীতে চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০০৬ সালের ৮ মার্চ ভারতের সুপ্রিমকোর্ট ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ শব্দটি লেখার রাষ্ট্রীয় অনুমোদন দেয়। দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা মৈতৈ মণিপুরী এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী বিতর্কের একধরনের স্থিতি ঘটে। ভাষা বিদ্রোহীদের দাবী বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী এলাকার জন্য সীমাবদ্ধ না রেখে সকল এলাকাতেই চালু করার। তাছাড়া এখনও স্কুল গুলোতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী শিক্ষকেরা পড়ানোর দায়িত্ব পাচ্ছেন না।শহীদ সুদেষ্ণার স্মরণে ভারত ও বাংলাদেশের মণিপুরীরা ১৬ মার্চ ভাষাদিবস পালন করে থাকে।
এছাড়াও, ১৮ শতকে বুলগেরীয়দের ভাষা আন্দোলন অন্যতম। বুলগেরীয় জনগন তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে বুলগেরীয় ভাষার রাষ্ট্রীয় অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলো। ভাষার জন্য এরকম আরো সংগ্রাম ও ইতিহাসের খোঁজ পাওয়া যায় সময়ের প্রতিটি স্তরে।
তাই গবেষক পাভেল পার্থ’র সাথে একমত পোষণ করেই বলতে হয়, বাংলাদেশের সকল জনগনের রাষ্ট্রের সংবিধান কেবল বাংলা ভাষাকেই রাষ্ট্রের একমাত্র সাংবিধানিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। উপরন্তু রাষ্ট্র, প্রচারমাধ্যম ও প্রকাশনাগুলো পৃথিবীর ভাষাসংগ্রামের ইতিহাস সম্বন্ধে ভুল এবং খন্ডিত তথ্য ক্রমাগতভাবে প্রচার করে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে এবং অপরাপর জাতিসমুহের ভাষা ও অস্তিত্ত্বের লড়াইকে অগ্রাহ্য করছে । এটি মহান ভাষা আন্দোলনের মনস্তত্ত্বের সাথে কোনক্রমেই সঙ্গতিপুর্ণ নয়। ২১ ফেব্রুয়ারি যদি আজ আন্তর্জাতিকভাবে সকলের মাতৃভাষার অধিকারের দাবী তুলতে পারে তবে যে রাষ্ট্র এই দ্রোহের জন্ম দিয়েছে সেই রাষ্ট্রই কেন আজ অপরাপর জাতির মাতৃভাষাকে মেনে নিতে বা স্বীকৃতি দিতে নারাজ?
এই প্রশ্ন আজ সকল প্রগতিশীল মানুষের মনে। প্রশ্নটির সমাধানের সময়ও ঘনিয়ে আসছে। তাই, একুশের চেতনার সঠিক উপায়ে বাস্তবায়নের জন্য আজ আমাদের নিজেদের সকল ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীসমূহের ভাষা ও সংস্কৃতিকে যেমন নির্দ্বিধায় সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হতে হবে, তেমনি অপরাপর ভাষাভিত্তিক জাতিসমূহের স্ব স্ব ভাষার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংগ্রামের সত্যবয়ানকে জনমানষে পরিচিত করে দিতে হবে শ্রদ্ধার সাথে। তাহলেই আমাদের মাতৃভাষা আন্দোলনের প্রকৃত সার্থকতা অনুধাবনে আমরা সক্ষম হব।
তথ্যসূত্রঃ
• ভাষা আন্দোলনের আগে ও পরেঃ মুহাম্মদ শফী
• ভাষার জন্য একটি প্রান্তিক জাতিসত্তার সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস: বাংলাদেশে কি সকল জাতির সকল ভাষা সমান স্বীকৃতি ও মর্যাদা পাবেঃ পাভেল পার্থ, গবেষক, জনউদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
• ইন্টারনেট এর বেশ কিছু সাইট।
এই চমৎকার লেখাটি প্রিয় পোস্টে যুক্ত। লেখাটি ফেসবুক গ্রুপ ‘পাহাড়ের রূদ্ধকণ্ঠ CHT Voice’ এ শেয়ার করা হয়েছে। চলুক। (Y)
নি:সঙ্গ বায়সরে নিয়া ভয়ে আছি….ও মনে হয় সক্রেটিসের ভাবশিষ্য….সক্রেটিস কইছিল ‘যার ঘরের ঘরণী ভাল সে সবচেয়ে সুখী মানুষ, আর যার ঘরণী খারাপ সে দার্শনিক’….
হাহাহা…..চালায়া যা
@চয়নিকা,
ভাই , কপি পেস্ট মন্তব্য করা ঠিক না… :ban: আর এই ভাবে অপমান করলেন!!! :-Y :-Y :-Y
নিঃসঙ্গ বায়স,
এ লেখাটি মুক্তমনার অন্যতম ব্যতিক্রমধর্মী লেখা হিসেবে নিঃসন্দেহে টিকে থাকবে অনেকদিন।
আমি বারবারই বলি, দেশপ্রেম, স্বজাত্যবোধ এগুলোও একধরণের ডগমা। আমি এ নিয়ে আগে লিখেছিলামও (দেখুন এখানে, এখানে, কিংবা এখানে)। সেই ডগমার অন্ধবিশ্বাসে আমরা ভাবি আমাদের ইতিহাস এমনই ইউনিক যে বিশ্বাসের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। একদিকে আমরা ভাষা আন্দোলন নিয়ে যার পর নাই গর্বিত থাকি, আবার একই হাতে আবার আদিবাসীদের উপদেশ দেই তাদের ভাষা সংস্কৃতি সব ভুলে গিয়ে ‘বাঙ্গালি হয়ে’ যেতে। তাদের গায়ে ট্যাগ লাগাই বিচ্ছিন্নতাবাদের। কী মহান আমাদের প্রকৃতি! আমি উপরে সফিকের সাথে খুবই একমত। এই উপমহাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে মাতৃভাষা-নিজ সংষ্কৃতির জন্যে অনেক রক্ত ঝড়েছে। সে ইতিহাসগুলো উঠে আসা দরকার।
ধন্যবাদ এ গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি লিখবার জন্য। আপনি মুক্তমনায় অনেক কম লিখেন, আলোচনায় অংশ নেন আর কম। আশা করব ভবিষ্যতে আপনার সক্রিয়তা বাড়বে অনেক।
@অভিজিৎ দা,
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
মুক্তমনায় আসলে আমি অনেক আগে থেকেই আসতাম। কিন্তু তখন আসতাম শুধুই পড়ার জন্য। আসলে বিজ্ঞানের বিশেষায়িত শাখাগুলোর সরাসরি ছাত্র না হওয়ায় ঐ বিষয়গুলো আপনাদের লেখার ভিতর দিয়ে জানার চেষ্টা করেছি। মুক্তমনায় লেখা শুরু পোশাক শিল্পীদের গানের অনুষ্ঠানের উপর একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনামূলক লেখার মধ্য দিয়ে। আমি মূলত কবিতা ও স্যোশাল ফ্যাক্টগুলো নিয়েই লিখে থাকি। কিন্তু মুক্তমনার একটি নিয়ম অন্য ব্লগে প্রকাশিত লেখা এখানে সরাসরি প্রকাশ করা যায় না, কবিতা লেখাটাকে কিছুটা নিরুৎসাহিত করা হয়। কিছু লেখা তাই অন্য ব্লগে প্রকাশিত হওয়ায় সেগুলো আর মুক্তমনায় দেওয়া সম্ভব হয় না। কখনো দিলেও মুক্তমনার সেই লেখাটাতে প্রচুর মডারেশন করে দিতে হয় যাতে দুইটি লেখা হুবহু এক না হয়ে যায়… এই কারণে লেখা একটু কম হয়। আর অনেক বিষয়েই আমি কম বুঝি বিধায় শুধু পড়ি। যে বিষয়ে জ্ঞান খুবই কম, সেই বিষয়ে অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য করার কী দরকার!?! আর সবশেষ কিন্তু মূল যে বিষয়টি, সেটি হল, একটি ছাত্র সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় নিজের ডিপার্টমেন্ট আর সংগঠনের কাজের পরে লেখার জন্য সময় বের করাটা একটু কঠিন হয়ে দাঁড়ায় প্রায়শই। এই সব কিছু মিলেই ধারাবাহিকভাবে লেখা অথবা মন্তব্য করাটা হয়ে ওঠেনা। সেজন্য দুঃখিত। তবে চেষ্টা করবো এখন থেকে যতটা সম্ভব বেশি অ্যাক্টিভ থাকতে। ভালো থাকুন।
আপনার লেখাটি অত্যন্ত তথ্যবহুল একটি লেখা। অনেক ভাল লাগল্, কিন্তু কিছু মন্তব্য আমাদের ভাষা আন্দোলনকে অতি সাধারনিকরন করে ফেলেছে। আসলে আমাদের আন্দোলন আর বাকি সব আন্দোলন এর মাঝে একটা মৌলিক পাথক্য হল, বাকি সব আন্দোলন একটা সাধীন জাতির জন্মের বীজ বপন করতে পারেনি। এই জন্য আমাদের ভাষা আন্দোলন অন্যতম। তবে এ কথা বলাটা বতুলতা যে কেবল আমরাই ভাষার জন্য জীবন দিয়াছি///////////
@প্লাবণ ইমদাদ,
আপনার শেষোক্ত মন্তব্যটি একটু একপেশে মনে হল। উদাহরণ দিলেই বুঝা সম্ভব। ভাষা আন্দোলন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা ছিলো। কী হত যদি আমরা না জিততাম যেই যুদ্ধে? ভাষার জন্য আমাদের আত্মত্যাগ কী এতে এতোটুকু মলিন হতো? আসাম – ত্রিপুরা- ভারতের এই সকল রাজ্যের ভিতরও কিন্তু একধরনের স্বাধীনতার সংগ্রাম অনেক বছর ধরেই চলছে, আমরা হয়তো অনেকেই কৌশল্গতভাবে তাকে বলি “বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন”! সেটি সফল হয় নি/ হচ্ছে না বলেই কী তাদের ভাষার জন্য আত্মত্যাগ আমাদের থেকে কম মহিমান্বিত হয়ে যাবে? অথবা কোনোদিন তারা স্বাধীন হলে সেইদিন তাদের ভাষা আন্দোলনের মাহাত্মকে আমরা সমপরযায়ের বলে মনে করবো? নিশ্চয়ই বিষয়টি সেরকম না। সকল দেশের সকল মানুষের চেতনার যে বহ্নিশিখা, তার তেজ সর্বত্রই সমান, এতোটুকু কম-বেশি না।
@নিঃসঙ্গ বায়স, কারো আবেগকে ছোট করে নয়, বরং তাদের আন্দোলনের প্রতি গভির সম্মান জানিয়েই বলছি, সফল হোক সব ভাষার আন্দোলন।
@প্লাবণ ইমদাদ,
ভীষণভাবে সহমত আপনার সাথে। সাথে ধইন্যাপাতা ফ্রি দিলাম… (D) (G) (F)
অনেক ধন্যবাদ এমন একটা গুরুত্ত্বপুর্ণ লেখা দেবার জন্য। যা কিনা অনেকেরই অজানা।
@আফরোজা আলম,
🙂 উৎসাহ প্রদানের জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
জানতামই না এত জাতি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে…বিশ্বের প্রিতিটি দেশের মাটিতে ন্যায়, দেশপ্রেম ও ভাষার জন্য যাদেরই রক্ত ঝরেছে, তাদের জন্য রইল সশ্রদ্ধ প্রণতি।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এই লেখাটির জন্য। যতটা পারি ছড়িয়ে দিচ্ছি লেখাটি বন্ধুদের মাঝে…
@লীনা রহমান,
ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য।
অসংখ্য ধন্যবাদ এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির জন্যে। আমাদের দেশে অনেক দেশপ্রেমী আছেন যারা কথায় কথায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজ দেশের অনন্যতা ঝান্ডার মতো তুলে ধরেন। আর এব্যপারে প্রশ্ন তুললেই শুরু হয় চিরাচরিত stock in trade লেবেলগুলোর পাইকারী ব্যবহার। এদের দেশপ্রেম এতই ঠুনকো যে কোনো কিছুতে অনন্য না হলে তা আর গর্ব করার মতো বলে মনে করেন না। আমার মনে হয় মুক্তমনার উচিত পুরো ফেব্রুয়ারী মাস জুড়ে এই লেখাটি প্রথম পাতায় ধরে রাখা। কারন এই লেখাটি অনেকের ভ্রান্ত চিন্তার অবসান তো ঘটাবেই, সেই সাথে আমরা পৃথিবীর সকল জাতির নিজ নিজ ভাষা-সংষ্কৃতির অধিকারের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে পারবো। এটি বাংলাদেশের জন্যে আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ কারন আমরা প্রায়শই ভুলে যাই এদেশে বাংলাভাষী ছাড়াও অন্যজাতি আছে।
এই উপমহাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে মাতৃভাষা-নিজ সংষ্কৃতির জন্যে অনেক রক্ত ঝড়েছে। ইউরোপে বিশেষ করে ১৯ শতকে অস্ট্রো-হাংগেরীয়ান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জাতি নিজ নিজ ভাষা ও সংষ্কৃতির জন্যে আন্দোলন করেছে।
@সফিক,
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকেও এতটা অনুপ্রেরণামূলক মন্তব্যের জন্য।
আমার মনে হয় বাংলা একাডেমী’র উচিত নিজ উদ্যোগে ও রাষ্ট্রীয় প্রিষ্ঠপোষকতায় সারা বিশ্বের ভাষা আন্দোলনের সকল ইতিহাসকে একসুতায় গাঁথার উদ্যোগ নেওয়া। তা না হলে, বাংলা ভাষা’র “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা” হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়াটা বড়ই বেমানান ফয়ে উঠবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও বিশ্ববাসীর কাছেও।
খুব ভালো করেছেন এমন একটা লেখা লিখে। ভাষার জন্য প্রানদান, এই এত কাছে আসামেও এই সেদিনই ঘটেছে জানতাম না। আমরা কতই না কম জানতে চাই। নিজেরটা পেয়ে গেলেই হোল, বাকি সব ক্ষান্ত দিয়ে বসি। আদর্শিক ব্যাপার গুলি এখন মনে হয় অন্যরকম। তবে সংস্কৃতির শক্তি স্থানিকও বটে। তাই আসামের অন্তত সাংস্কৃতিক বিজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র। তথ্যভিত্তিক লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।
@কাজী রহমান,
জাতীয়তাবাদ মাঝে মাঝে যে কী রকম উটকো উন্নাসিকতা ও দম্ভের জন্ম দেয় তা আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পড়তে গেলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আর তার মূল বাহক ও পরিচালক হয় এই জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবিদেরই একটা বড় অংশ। আর সংস্কৃতির তো স্থানিক আর বৈশ্বিক- দু’টো বৈশিষ্ট্যই প্রবল। যেকোনো এক্টাকে বাদ দিতে গেলেই তখন বড়ো ধরনের বিপত্তিগুলো সৃষ্টি হয়।
আপনাকেও ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
@নিঃসঙ্গ বায়স
এই ফেব্রুয়ারি মাসে লেখাটা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অনেক আগেই এ নিয়ে একটা খুব ভালো লেখা পড়েছিলাম, তার পরে যাদের সাথেই এ প্রসঙ্গে কথা হয়েছে তাদের প্রায় সবাই অবাক হয়ে বলেছেন, ওহ তাই, জানতাম না তো যে আমরা ছাড়াও আরও মানুষ ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে! এই মিথগুলো ভাঙ্গা খুব জরুরী। জাতীয়তাবাদ এবং অজ্ঞতা অনেক সময়েই অন্ধ আবেগ, গর্ব এবং ঔদ্ধত্যের জন্ম দেয়!
আপনার লেখাটায় প্যারাগ্রাফগুলোর পরে কিছু স্পেস দিলে পড়তে সুবিধা হত।
@বন্যা আহমেদ,
ধন্যবাদ দিদি আপনার মন্তব্য ও পরামর্শের জন্য। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কথা বাদই দিলাম, আমি বাজি ধরতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতকরা ৮০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী এই সকল তথ্য জানেনা। দোষ তাদের দেওয়া যায় না। আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে সেই ছোটবেলা থেকে আমাদের গর্বিত পাঠ ও শিখন-
“মাতৃভাষার জন্য একমাত্র বাঙালিরাই প্রাণ দিয়েছে। আর কোনো জাতি ভাষার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করে নি!!!”
বাংলাদেশে প্রতিবছর ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারিকে পালন করা বিপুল সমারোহে, যার অন্যতম অনুষঙ্গ “একুশে বইমেলা”। আজ পর্যন্ত একটা বইমেলাতেও এই আসামের বাংলা বা মনিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা্র যে সুদীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাস, জনসাধারণে তার প্রচারের ব্যবস্থা দেখিনি, সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি দূরে থাক। বুঝিনা এটা কী আমাদের ইতিহাস চর্চার ব্যর্থতা, নাকি জাতীয় সংস্কৃতির অপ্রয়োজনীয় অহংবোধের দুর্বিনীত প্রকাশ!!!
আর, লেখায় স্পেস দেওয়া হলো। ভালো থাকবেন দিদি।
@নিঃসঙ্গ বায়স,
আপনার সাথে সম্পূর্ণ এক`মত। আমরা নিজেদের ছাড়া কাউকে চিন`তে চাই না।
আপনি খুব সত্য কথা ্লিখেছেন। কিন্তু অনেকেই আপনাকে ভর্তসনা করতে পারে।
আপনাকে ধন্যবাদ সত্যি কথা বলার জন্য।
@আবুল কাশেম,
আপনি তো করেন নি!!! এতেই চলবে 😀 ধন্যবাদ আপনাকে সত্য বলতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য। (*)
@নিঃসঙ্গ বায়স,
চমৎকার তথ্য-সমৃদ্ধ লেখা।
সকল মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা হোক। আদিবাসী মানুষের সংগ্রাম সফল হোক।। (Y)
@বিপ্লব রহমান,
আপনারে ধইন্যাপাতা বিপ্লব দা… (D) (B) (C) লগে সব রকম পানীয় ফ্রি দিলাম 😉 :lotpot: