ব্যক্তিসৃজনশীলতার প্রতি একটি শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ
আমরা ‘নারীবাদ’, ‘পুরুষবাদ’, ‘ধর্ম’, ‘জাতি’, ‘সম্প্রদায়’ ইত্যাদি নিযে় লড়াই করি। কিন্তু একথা ভুলে যাই যে দিনশেষে একটি পরিচয়ই থাকে – ‘আমি’। মানুষের সব সমাজ, রাষ্ট্র, মতবাদ, জাতি, সম্প্রদায় সবই এই ‘আমি’র সমষ্টি। প্রতিটি মানুষ একটি স্বত্ত্বা, একটি মনন, একটি স্বাধীন অস্তিত্ব। ‘আমি’র চেযে় স্বাধীন অস্তিত্ব, স্বার্ভভৌমত্ব আর কি আছে? ‘আমি’র যোগফল রাষ্ট্র, সমাজ, মতবাদী সম্প্রদায়। প্রতিটি ‘আমি’র অনুভূতি, আবেগ নিজস্ব। আমরা একতাবদ্ধ হই কিছু মতবাদের মিলে, বর্ণের মিলে, ভৌগোলিকতার মিলে, বিশ্বাসের মিলে অথবা যুক্তি দিযে়, পারষ্পরিক স্বার্থে, অথবা নিজের স্বার্থে। ‘আমরা’ তৈরী করি সমাজ, রাষ্ট্র। আমরা আগুণ জ্বালিযে়ছি, চাকা ঘুরিযে়ছি, ‘আমাদের’ স্বার্থে এই জ্ঞান বিনিময় করেছি। ‘আমাদের’ জন্য সমাজ-রাষ্ট্র তৈরী করেছি, অথচ ভিন্ন বিশ্বাসীদের ইচ্ছায় কেনো আমার আমিত্বকে বিসর্জন দেবো? ভিন্ন লিঙ্গের ‘আমি’ কেনো ‘অন্য’ ‘আমি’দের শাসন করবে?
আমরা অনেক অনেক তন্ত্র নিযে় ঝগড়া করি। ‘আমি’র তন্ত্র নিযে় কথা বলি না। কারণ অন্য ‘আমি’-দের স্বীকৃতি দিতে ভয় পাই। কথা বলি শুধু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীতন্ত্রের। এখানে নিজেদের সমমনাদের নিযে় অন্যদের অবদমন করা যায়। করতে হয়, কারণ শতভাগ ‘আমি’ কখনো হুবহু এক হয় না। গোষ্ঠী তৈরী করা মানুষের নেচারাল ইন্স্টিংট্। গোষ্ঠী, দল, সমাজ বদ্ধতা মানুষের অন্যতম মৌলিক পরিচিতি। তাই ‘আমরা’ ‘তোমরা’ থাকবেই। কিন্তু গোষ্ঠীবদ্ধতার ভেতরেও মূল একক থেকে যায় একটি বিষয় – ‘আমি’। ‘আমার’ শরীর, অস্তিত্ব, মনন, সৃষ্টিশীলতা সবমিলিযে় বিশ্বজগতে একটি একক অস্তিত্ব, একটি সত্য। ‘আমি’র চেযে় সত্য জগতে কিছু নেই। অন্যকে ‘আমি’ দেখি, শুনি, স্পর্শ করি, অনুভব করি ‘আমার’ জ্ঞান দিযে়, ‘আমার’ অনুভূতি দিযে়।
কিছু মানুষ নিজের মতাদর্শের লোক খুঁজে জোট গডে়, সংখ্যা বাডি়যে় ক্ষমতা দখল করে, অন্য ‘আমি’দের অবদমিত করে, কারণ ‘আমার রুচি’ সেরা, ‘আমার মত’ সত্য, ‘অন্য’ সবসময়ই ‘অন্য’। কিছু মানুষ নিজ ভাষা, নিজ বর্ণের লোকদের জাতীয়তাবাদ, বিশ্বাস কিংবা আঞ্চলিকতার ধুঁয়া তুলে প্রভাবিত করে। অন্য মানুষেরা কিছু মানুষের পক্ষে লড়াই করে প্রাণ দেয়, ‘শহীদ’ হয়, ‘জাতি’র স্বাধীনতা আনে। কিছু মানুষেরা অন্য মানুষের আবেগকে বিশ্বাসকে পুঁজি ক’রে তাদের শাসন করে, শোষণ করে, ভিন্নমতবাদীদের ‘জাতি’ বিরোধী বলে। কিছু মানুষ ভিন্নমতবাদীদের মেরে ফেলে বিপ্লবের নামে।
জাতীয়তাবাদ, মতবাদ, আঞ্চলিকতা, আবেগ, পেশাগত ঐক্য থাকতেই পারে কিন্তু ‘আমার’ ব্যক্তিস্বত্ত্বা এবং ‘আমার’ আবেগের স্বাতন্ত্র্যকে বাদ দিযে় নয়।
স্বাধীনতা ও ঔপনিবেশিক শাসন কাকে বলে? ‘আমি’ কি রাষ্ট্রের উপনিবেশ? উদাহরণ দেখুন :
প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাষ্ট্র ছিলো রাজবংশ-কেন্দ্রিক (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে)। রাজার প্রতি আনুগত্যের দাবী ছিলো যাকে আজকের যুগে দেশপ্রেম বলি। সাধারণ মানুষ ছিলো প্রজা, নাগরিক নয়, তারা রাজা নির্বাচনে অংশ নিত না। দেশের মালিকানা ছিলো রাজার। ব্রিটিশ রাজ শাসনে গণশিক্ষা, সবার জন্য সরকারী চাকুরীর অধিকার (পূর্বযুগের তুলনায়), আধুনিক বিচার ব্যবস্থা (পূর্বযুগের তুলনায়), গণরাজনীতি এবং ভোটের অধিকার এসেছে। কিন্তু অনেক আইন সাম্রাজ্য টিকিযে় রাখার স্বার্থে করা হযে়ছিলো। ব্রিটিশ সরকার নির্বাচিত হতো ব্রিটিশ জনতার দ্বারা, ভারতের জনতা কর্তৃক নয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ছিলো উর্দূ ও বাংলা – সমান মর্যাদায়। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অর্ধেকের বেশি আসন ছিলো পূর্ব পাকিস্তান থেকে। আরও অধিক স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবী বিভিন্ন প্রদেশে ছিলো। বর্তমান বাংলাদেশের সাথে পূর্ববর্তী পাকিস্তান রাষ্ট্রের পার্থক্য প্রতীকী। সিস্টেমগত পার্থক্য কম। ভারত নাগরিক অধিকারে, বিচারব্যবস্থায়, নির্বাচনব্যবস্থায় পাকিস্তানের চেযে় উন্নত, কিন্তু আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন অল্প, অঞ্চলগুলোর স্বাধীনতা দাবীর প্রতি দমনমূলক এবং সামাজিক জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর রাষ্ট্র। ব্রিটিশ ভারতের সাথে তার মৌলিক পার্থক্য – ভারত সরকার ভারতীয় জনতা দ্বারা নির্বাচিত ও স্বার্বভৌম এবং কিছু ঔপনিবেশিক আইনের পরিবর্তন সাধিত। ভারত-পাকিস্তানীরা সাধারণভাবে মনে করে পূর্বতন রাজাদের সমযে় তারা স্বাধীন ছিলো, ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিক শক্তি। আর হিন্দুদের পৃথকভাবে বিশ্বাস মুসলিম শাসন প্রবর্তনের আগে তারা স্বর্গরাজ্যে ছিলো। বাংলাদেশীরা মনে করে তারা এখন স্বাধীন, পাকিস্তানে তারা পরাধীন ছিলো। আসলে স্বাধিনতা ও ঔপনিবেশিক শাসনের সীমারেখা কি? সমাজশাসকরা কেউ ক্ষমতা অর্জন করে অন্যদের আবেগকে বিশ্বাসকে পুঁজি ক’রে, কেউ ক্ষমতা ক্রয় করে আবেগ ও বিশ্বাস বিক্রী ক’রে। কিন্তু ‘আমি’রা থেকে যায় রাষ্ট্রের উপনিবেশ।
উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলোর সবচেযে় বড় সমস্যা – এখানে ব্যক্তির চেযে় সমাজ বড় এবং রাষ্ট্র হচ্ছে সমাজ সংরক্ষক শক্তি। সমাজগুলো কিছু পুরুষের, কিছু নারীর, কিছু ধর্মবিশ্বাসীর – এই ‘কিছু’রা ‘সংখ্যাগুরু’ হতে পারে কিন্তু ‘সব আমি’রা নয়, এরা বাকী ‘আমি’গুলোকে বাধ্য করে সংখ্যাগুরুদের মতে চলতে। ‘আমি’ কোন্ সংখ্যা? ‘আমি’ তো এক – সব সংখ্যার মূল।
গোষ্ঠীবদ্ধতা মানুষের সহজাত, তার প্রাণিপরিচযে়র অংশ। কিন্তু একে পুঁজি করে কিছু মানুষ ক্ষমতা অর্জন করে – রাজক্ষমতা, অর্থক্ষমতা, শরীরের ওপর ক্ষমতা, শ্রমের ওপর ক্ষমতা।
‘আমার’ পরিচযে় গোষ্ঠী-সমাজ পরিচয় থাকবেই। প্রাণী হিসেবেই মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ। কিন্তু কে বড় – ব্যক্তি না সমাজ? সমাজের জন্য মানুষ জন্মে, নাকি মানুষের জন্য সমাজের সৃষ্টি? সব ‘আমি’ যদি স্বাধিনতা অর্জন করে তবে সমাজ কিভাবে চলবে? আসলে রাষ্ট্র এমন একটি শক্তি যে পারে দলবদ্ধতা ও ব্যক্তির ভেতরে ভারসাম্য তৈরী করতে।
প্রকৃত স্বাধীনতা আসলে ‘আমার’ স্বাধীনতা। আমার লিঙ্গের, আমার মতের, আমার ভাষার মানুষের কিছু ব্যক্তির শাসন ‘আমার’ স্বাধীনতা নয়, স্বগোত্রশাসন মাত্র। ‘আমরা’ গোষ্ঠীগতভাবে জাতি তৈরী করতে পারি কিন্তু ‘আমি’ জাতির অধীন কেনো হ’বো, হ’বো জাতির একক। ‘আমার’ ব্যক্তিত্বের চারপাশের বৃত্তে রাষ্ট্র কতটুকু প্রবেশ করবে? ‘আমি’ কি স্বায়ত্বশাসিত হতে পারি না যেখানে আমার সীমানায় আমি স্বার্বভৌম, রাষ্ট্র ‘সব আমি’দের কন্ফেডারেশন?
আজকে সময় এসেছে “স্বায়ত্বশাসিত ‘আমি’দের কন্ফেডারেশন” গঠনের। যেখানে নারী-পুরুষ-বিশ্বাস-বর্ণ নির্বিশেষে সব ‘আমি’র মিলিত যোগফল রাষ্ট্র। ‘আমার’ সংবিধান হতে পারে বাইবেল-কুর‘আন-গীতা-কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো-রেড বুক কিংবা নিজের রচিত সংবিধান, রাষ্ট্রের হবে ফেডারেল ‘আমি’দের সংবিধান; ‘আমার’ ফ্যাশন হতে পারে ‘আমার’ পতাকা, ‘আমার’ শিল্পরুচি ‘আমার’ জাতীয় সঙ্গীত, ‘আমার’ সৃষ্টিশীলতা ‘আমার’ জাতীয় প্রতীক, ‘আমার’ ক্ষমতা ‘স্ব-ক্ষমতায়ন’, ‘আমার’ পরিচয় ‘আমার স্বাধীনতা’।
পুনশ্চঃ ব্যক্তির সার্বভৌমত্বই হচ্ছে প্রকৃত সার্বভৌমত্ব। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি ব্যতীত গণতন্ত্র হয় না। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, জাতি, সম্প্রদায়, লিঙ্গপরিচয় – এগুলোর ভেতরে অদৃশ্য সীমারেখা রযে়ছে। সমাজভেদে এই সীমারেখা বিভিন্ন রকম। উপমহাদেশের রাষ্ট্র কাঠামো বিভিন্ন বিষযে় এখনও সমাজমুখী, এখানকার সমাজ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি দেয় না। সৃজনশীলতা সবসমযে় বৈচিত্র্যসন্ধানী, অন্যদিকে উপমহাদেশের প্রায় সমাজই বৈচিত্র্য বিরোধী। এখানকার সমাজ ও সম্প্রদায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের চেযে় সমাজ নির্ধারিত পথেই ব্যক্তিকে বেশি পরিচালিত করতে চায়। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, ব্যক্তির মেধা ও সৃজনশীলতা বিকাশের অভাব জনবহুল এই উপমহাদেশের অনুন্নয়নের একটি অন্যতম বড় কারণ। এখানে ব্যক্তির স্বাধীনতা, সৃজনশীলতা ও বিকাশের পথ ততটুকু যতটা সমাজ ও সম্প্রদায় নির্ধারণ করে, এখানে মানুষ-নারী-পুরুষ পরিচিতির সীমারেখা সমাজ ও সম্প্রদায় নির্ধারণ করে দেয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সর্বোচ্চ স্বীকৃতিদানকারী রাষ্ট্রই পারে ‘জনগোষ্ঠী’ ও ‘ব্যক্তি’র ভারসাম্য নির্ধারণ করতে।
ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনে থাকতে হয়েছিল বছর দুয়েক। অনেক আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে একটা ছিল বড় মহারাজের আলোচনা (একক!) সভা। মাসে কম করে হলেও দুবার। তো আলোচনার এক পর্যায়ে কিভাবে যেন “আমিত্ব” চলে আসত। মনে আছে, তখন গুরুগম্ভীর গলায় বলতেন- “আমিত্ব ত্যাগ কর, বৎস্য!”
তারপর গান ধরতেন-
“সকলি তোমার ইচ্ছা
ইচ্ছাময়ী তারা তুমি
তোমার কর্ম তুমি কর মা
লোকে বলে করি আমি…”
🙂
অতশত বুঝতাম না। ঘড়ি দেখতাম আর ভাবতাম কখন মুক্তি মিলবে!
আপনার লেখা পড়ে জানিনা এতদিন পর কেন এসব মনে পড়ল।
ইদানিং এই কথাটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এই সমাজের ভয়ে এখন ছেড়ে দে না কেন্দে বাঁচি অবস্থা।
মূল সমস্যা কিন্তু মধ্যবিত্তে। উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্তরা এসব সমাজের ধার ধারে বলে মনে হয় না।
মৌলবাদীরা নাকি মূল আকড়ে পড়ে থাকতে চায়, শাখা প্রশাখায় কতো মনোহর মনোরম সৌন্দর্য মুক্ত পরিবেশে খেলা করে বেড়ায় তার দিকে তাদের তাকানোর সময় নেই। কারণ যেহেতু মূল থেকেই সব কিছুর উৎপত্তি, মূল ধরে থাকলেই তো সব পাওয়া যাবে।
মহাবিশ্ব যেখানে সম্প্রসারিত হচ্ছে (বিজ্ঞানীদের মতে, আমি দেখিনি) সেখানে কেন আমি ’আমি’ হয়ে সংকুচিত হবো বুঝতে পারলাম না। পৃথিবীতে যতো মহৎ কাজে বিপত্তি বেঁধেছে তা এই ’আমি’ বা আমিত্বের কারণে। কারণ ক্ষুদ্র পরিসরের ‘আমি’র ভিতরে বৃহৎ পরিসরের ‘আমরা’ ধারণ করা যায় না। মানুষের জন্য সমাজের উৎপত্তি হলেও বিনা কারণে হয়নি অবশ্যই। যখন মানুষ উপলব্ধি করলো একা একা বড় কাজগুলো করা সম্ভব নয়, সম্মিলিত প্রয়াসে তা অনেক সহজ হয়ে যায়, ঠিক তখনই দলবদ্ধ হয়ে মানুষ বাস করতে শুরু করে, যাকে আমরা সমাজ বলছি। এক বই থেকে যেমন সব জ্ঞান পাওয়া যায় না, তেমনি শুধু ‘আমি’ নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না, প্রয়োজন হয় আরো কিছু ‘আমি’র। তকে যুগে যুগে কালে কালে আমি ছিলো, আছে (লেখকের মতো) এবং থাকবে। সমাজ যখন ‘আমি’র দিখে অধিকমাত্রায় ঝুকে পড়ে ঠিক তখনই মাছের মতো পঁচন ধরে সমাজের মাথায়।
স্বাধীনতা একটা আপেক্ষিক ধারণা। ‘আমি’র স্বাধীনতাই যদি প্রকৃত স্বাধীনতা হয় তাহলে বিশ্বের কেউই স্বাধীন নয়। নারী পুরুষের অধীন, পুরুষ নারীর নয়তো অর্থের অথবা তার চাকরিদাতার। আর সামগ্রিকভাবে সবাই প্রকৃতির অধীন। কে দেবে স্বাধীনতা, কোথায় পওয়া যায় স্বাধীনতা- সব মনের অন্ধ কুঠরিতে বিরাজমান।
অক্ষরগুলোতে কিছুটা সমস্যা আছে। যেমন: নিযে়
সেগুলো ঠিক করে নেবেন। লেখা অপূর্ব হয়েছে।