ট্রেনে আগুন।

মোকছেদ আলী*

শীতকাল। ভোর বেলা। বাহিরে পাখিরা কলরব করিতেছে।

এমন সময় আমার এক পুতুরা, আওশানো দরজাটা ঠ্যালা দিয়া ঘরে প্রবেশ করিল। আমার ঘরে একশত পাওয়ারের লাইট জ্বলিতেছে। পুতুরাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি কি ঢাকা থেকে এলে?” সে একটি ছোট্ট একটি শব্দ উচ্চারণ করিল, “জ্বী”। আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “কিসে আসিলা?” উত্তর দিল, “কোচে আসিলাম।” তারপর একটা ভীত শংকিত ত্রাস কণ্ঠে কহিল, “তাঐ সাহেব”। তাহার আর্ত্ত কণ্ঠস্বরে আমি চমকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি ব্যাপার?” সে পুনরায় পূর্ব কথার জের টানিয়া কহিল, “তাঐ সাহেব, মেলা রেলবগি পুড়ে গেছে। মানুষ-পোড়া গন্ধে গাড়ির কাছে যাওয়া যাচ্ছে না।”

আমি ভীত বিহ্বল কণ্ঠে শুধাইলাম, “কোথায়!!, কোথায়!!?” প্রশ্নের জবাব দিল, “ভেড়ামারা ষ্টেশনের দক্ষিণ রেলগেটে। আমাদের কোচ গেট পার হতেই ঘটনাটি দেখলাম।” কহিলাম, “তাহলে আমি সাইকেল নিয়ে দেখে আসি।”

অতিদ্রুত সাইকেলটা রাস্তায় নামাইয়া সোজাপথে গেটের দিকে ছুটিয়া চলিলাম। শীতকাল, চারিদিকে গাঢ় কুয়াশায় আচ্ছন্ন। কানে বাতাস লাগিয়া শীত বেশী বোধ হইতেছে। রাস্তায় লোকচলাচল শুরু হয় নাই, কেবল শ্রমিক শ্রেণীর ২ জন লোক পথে হাটিয়া যাইতেছে। আমি তাহাদের পাশ দিয়া অতিদ্রুত সাইকেল চালাইয়া গেটে উপস্থিত হইলাম। ৪ খানা বগি পুড়িয়া ঝাঝড়া হইয়া গেছে। কেবল রয়েছে লোহার কাঠামোটা। গেট হইতে দক্ষিণে গাড়িগুলি দাঁড়াইয়া আছে। গেট বন্ধ হয় নাই। হাত ৩/৪ উত্তরে থাকিলে গেটে যানবাহন চলাচল বন্ধ হইয়া যাইত। নিকটবর্তী বাড়ির ১০/১৫ জন লোক এই ভয়াবহ দৃশ্য অবলোকন করিতেছে। আমি সাইকেলখানা গুমটি ঘরের দেওয়ালে ঠেস্ দিয়া একটা বগিতে উঁকি দিলাম। উহ্ বিকট ছ্যাচড়া পোড়া দুর্গন্ধে নাক জ্বলিয়া গেল। দুই আঙ্গুলে নাক বন্ধ করিয়া সাইকেলের নিকট ফিরিয়া আসিয়া সাইকেলে চাপিয়া, আমার পরম হিতৈষী মামা শ্বশুড় সাত্তার মেম্বারকে খবরটা জানাইবার জন্য ফারাকপুর অভিমুখে ছুটিয়া চলিলাম। গৃহে প্রবেশ করিয়া তাহাকে ডাক দিতেই, তিনি উত্তরে কহিলেন, “বাবাজী, এত সকালে কি মনে করে?” কোনরূপ ভূমিকা না করিয়া সোজাসুজি কহিলাম, “দক্ষিণ রেল গেটে, সীমান্ত ট্র্রেনখানায় আগুন লেগে বহুলোক মারা গেছে। যান, দেখে আসেন।”

‘যান দেখে আসেন’ বলিয়াই আর কোন কথা না বলিয়া আবার সাইকেল চাপিয়া অকুস্থলে রওনা দিলাম। সাত্তার বাবাজীও মোটর বাইক টপ গিয়ারে চালাইয়া গেট অভিমুখে ছুটিয়া চলিলেন। গেটে ফিরিয়া দেখি লোকে লোকারণ্য। কুষ্টিয়া হইতে এম্বুলেন্স আসিয়াছে। স্থানীয় যুবক, বয়স্করা আহতদের ধরিয়া এম্বুলেন্সে তুলিয়া দিতেছে । দুর্ঘটনার সময় মানবিক দায়িত্ব বাড়িয়া যায়। এতে সাধ্য মোতাবেক সাহায্য করা প্রয়োজন। অবশ্য এসময় চোর ছেচ্চরদেরও আমদানী ঘটে। প্রচন্ড ভীড়ের ভিতর না ঢুকিয়া তফাৎ থাকিয়া কিছুক্ষণ পর গৃহে ফিরিতে লাগিলাম। গ্রাম হইতে লোকসকল দলে দলে গেটের দিকে ছুটিয়া যাইতেছে। ট্রেন পোড়ার খবরটা ছড়াইয়া পড়ার সাথে সাথে মানুষ তাহা এক নজর দেখিবার জন্য ছুটিতেছে।

বেলা নয়টার সময় একটা হেলিকপ্টার আমাদের বাড়ির উপর দিয়া চক্কর দিল। ছেলেপুলেরা হেলিকপ্টার দেখিয়া গেটের দিকে দৌঁড়াইতে লাগিল।

প্রেসিডেন্ট এরশাদ ও যোগাযোগ মন্ত্রী আসিয়াছেন পোড়া ট্রেন পরিদর্শন করিতে। ইতিপূর্বে আহতগণকে এম্বুলেন্সযোগে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে পাঠানো হইয়াছে।

ঐদিন সকালবেলায়, সাতবাড়িয়া গোহাটের নিকট, জবেদ আলী নামক এক অতি দরিদ্র দিন মজুরের ৭ বৎসরের কন্যা শীত নিবারণের জন্য ধান সিদ্ধ করা চুলায় জ্বালানী দিতে গিয়া গলায় বাধা কাপড়ের আগুন ধরিয়া গুরুতর আহত হয়। তাহাকে ভেড়ামারার সিদ্দিক ডাক্তার অবস্থা গুরুতর দেখিয়া তাহাকে দ্রুত কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। সঙ্গে পিতা জবেদ আলী। হাসপাতালের ইমারজেন্সী ওয়ার্ডে তাহাকে ভর্তি করা হয়।

প্রেসিডেন্ট ও যোগাযোগ মন্ত্রী মহোদয় পোড়া ট্রেন পরিদর্শন করিয়া কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে আহতদের দেখিতে যান। ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে তখন জবেদ আলীর কন্যার অবস্থা মূমুর্ষ এবং প্রেসিডেন্টের সামনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। জবেদ আলী কন্যার মৃত্যুতে হাউ মাউ করিয়া কান্দিয়া উঠিলে প্রেসিডেন্ট জবেদ আলীকে সান্ত্বনা দিয়া মেয়ের ক্ষতিপূরণের জন্য ২৫ হাজার টাকা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন এবং তাৎক্ষণিক জবেদ আলীর হস্তে দশ হাজার টাকা প্রদান করেন। অবশিষ্ট ১৫ হাজার টাকা প্রদানের জন্য কুষ্টিয়ার ডিসি সাহেবকে নির্দেশ প্রদান করেন। দুই দিন পরে ডিসি সাহেব জবেদ আলীকে ১৫ হাজার টাকা দেন। দরিদ্র মানুষ ট্রেন পোড়ার অছিলায় মেয়ে মরার ক্ষতিপূরণ ২৫ হাজার টাকা পাইল। একেই হয়তো বলে নসীব।

রেলগাড়ি চালু হইবার পর বাংলাদেশের কোথাও এরূপ ট্রেন পোড়ার ঘটনা ঘটে নাই। পরদিন দৈনিক কাগজগুলিতে বড় হেডিং দিয়া এই মর্মান্তিক দূর্ঘটনার কাহিনী ছাপা হইল। একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করিয়া, দূর্বৃত্তদের ষঢ়যন্ত্রমূলক ধ্বংসাত্মক কার্য নাকি বৈদ্যুতিক সর্ট সার্কিট, তাহা নির্ণয় করিবার সংবাদও সম্পাদকীয় কলামে ছাপা হইল।

আগুনে পুড়িয়া মৃত্যুবরণ করিলে, হাদিসের মর্ম অনুযায়ী তাহারা শহিদী দর্জা লাভ করে। এই শহীদদের স্মৃতি রক্ষার জন্য চেয়ারম্যানকে পৌরসভার পক্ষ হইতে ছোট খাট একটা স্মৃতিসৌধ নির্মানের প্রস্তাব ছিল এলাকাবাসীর। দেব বলিয়া তিনি অঙ্গীকারও করিয়াছিলেন। কিন্তু, মর্মান্তিক ট্রেন পোড়া হতভাগ্যদের স্মৃতির প্রতি কেহই কোন মনোযোগ দিল না। হায় হাফসোস! না সরকার না জনগণ।

—————
*মোকছেদ আলী (১৯২২-২০০৯) স্বশিক্ষিত।