আমার হাজব্যান্ড ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকারী চাকরি থেকে অবসর কালীন ছুটিতে(LPR) যাবে। সময় পেলেই পেনসনের টাকার হিসাব করে আর সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। পেনসনের টাকা এককালীন তুলে ফেলবে না আজীবন এর সুযোগ ভোগ করবে। হিসাবের বাইরেও দুয়েক জনের সাথে পরামর্শ করে কোনটা লাভজনক, নিশচয়তা, ঝামেলাবিহীন ইত্যাদি ইত্যাদি। এককালীন সব টাকা তুলে ফেললে কোথায় বিনিয়োগ করবে এ নিয়েও পরিকল্পনা চলছে।
এ নিয়ে আমার বেশ মজার অভিজ্ঞতা হচ্ছে।
কিছু মুসলিম পরিচিতজন আগেই জানে যে হিন্দুরা পেনসনের টাকা এককালীনই তুলে ফেলে। পরে সুযোগ বুঝে ভারতে চলে যায়। কাজেই আমার হাজব্যান্ড তো তা করবেই। এ নিয়ে আর ভাবাভাবির কিছু নেই। সংখ্যালঘুদের দেশপ্রেম মূল্যায়নের এক অভিনব নির্দেশক জানলাম।
কিছু হিন্দু পরিচিতজন পরামর্শ দেয় হিন্দুদের পেনসনের টাকা এককালীনই তুলে ফেলা উচিত। কখন এ দেশ থেকে বিতারিত হতে হয়! আগে ভাগেই প্রস্তুতি থাকা বুদ্ধিমানের কাজ। সরকারী চাকরীজীবীদের পেনসনের টাকা উত্তোলন নিয়ে সংখ্যালঘুদের দেশপ্রেম নির্ণীত করলাম।

কেউ কেউ ধর্ম নির্বিশেষে বুদ্ধি দেয় পেনসনের টাকা এককালীনই তুলে ফেলা ভাল। তা না হলে প্রতি মাসেই টাকা তুলতে ঝামেলা পোহাতে হবে। এমন গল্পও প্রচলিত আছে যে, যার পেনসন তাকেই বলা হয় আপনি যে মৃত নন এ রকম সার্টিফিকেট নিয়ে আসেন। দেশ সম্পর্কে এক হতাশার চিত্র।
সংখ্যায় কম হলেও কয়েকজন হিসাব ছাড়াও মতামত দিয়েছে যে ডিজিটাল বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে। কাজেই ভবিষ্যতে পেনসনের টাকা মাসে মাসে খুব সহজেই উঠানো যাবে।

আবার আলাপ আলোচনায় বুঝা যায় কয়েকজন কট্টর আওয়ামীলীগপন্থী পেনসনের টাকা একবারেই তুলেছন এবং অন্যকেও পরামর্শ দেন একবারে টাকা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য। ডিজিটাল বাংলাদেশে তাদেরও আস্থা নেই। তারা অন্যকে স্বপ্ন দেখায়, কিন্তু নিজেরা দেখে না। সে স্বপ্নে বিশ্বাসও করে না। তাদের একজন অবশ্য অজুহাত হিসেবে বলেছেন, বাড়ির কাজ শেষ করার জন্য টাকাটা একবারে তুলেছেন।

যাহোক, আমার বিশ্লেষণ হলো আমার পরিচিত কিছু হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকই পরিস্থিতি বিবেচনা না করে ঢালাওভাবে সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করে। এর মধ্যে শতকরা হিসেবে প্রায় ৬০ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর মতামত পেনসনের টাকা এককালীন তুলে নেওয়াই উত্তম। কারণ তারা এদেশে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, অনিশ্চয়তার মধ্যে বসবাস করে। এ দলটি এদেশে কোন স্থাবর সম্পত্তি করতেও নারাজ।
মুসলমানদের মধ্যেও শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ হিন্দুদের দেশপ্রেম নিয়ে সন্দিহান। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস হিন্দুদের এক পা ভারতে আরেক পা এদেশে। তারা মনে প্রাণে চায় হিন্দুরা এদেশ ছেড়ে দিলে সংখ্যাধিক্য কমবে এবং দেশ যখন ছাড়বেই তখন যত আগে যায় তত কম সম্পদ পাচার হবে।
আমার কাছ মনে হয় পেনসনের টাকা উঠানোর ব্যবস্থা এক সময় এ টি এম কার্ডে টাকা উঠানোর পদ্ধতির মতই সহজ হবে। তা না হলে কিসের ডিজিটাল বাংলাদেশ! কোন ঝক্কি ঝামেলা ঘাটতে হবে না। অথচ অন্য অনেকেই তা বিশ্বাস করছে না। আর আমি এটাও বিশ্বাস করি যে তা কোন একক রাজনৈতিক দলের সাফল্যের জন্য নয়। যুগের বাতাসে, সময়ের টানে, বিজ্ঞানের উৎকর্ষে , নাগরিক অধিকার উপভোগের দাবিতে আর জনমানুষের সেবা পাবার তাগিদ থেকেই তৈরি হবে এসব সুযোগ সুবিধা।
আমার পরিচিত এক সরকারী কর্মকর্তা যিনি সরকারী চাকরি থেকে কিছুদিন আগে এককালীন পেনসন নিয়েছেন। তার কঠোর হুঁশিয়ারি —- রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য পেনসনের টাকা উঠানোর পদ্ধতি বান্ধব না হয়ে বন্ধুরই থাকবে। কাজেই একবারে উঠিয়ে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমাকে দেখলেন না? আমিই ভরসা করতে পারি না। আর আপনারা? ভেবে পাই না আমরা কি? আমরা কি উনার চেয়ে আলাদা কেউ?
উনার সাথে সম্পর্কটি মোলায়েম বলে প্রশ্ন করেছি, আমরা কী?
আরে ম্যাডাম,আপনারা হিন্দু মানুষ। কখন রাজাকারেরা দৌড়ানি দিবে এর ঠিক আছে না কি? এখন নব্য রাজাকারে চারপাশ ভরপুর। তখন তো ইন্ডিয়া দৌড়াতে হবে।
এ শুধু মুসলিম বন্ধুদের কথা নয়। হিন্দু আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে বেশীর ভাগের অভিমতেও একই সাম্প্রদায়িক সুর —- হিন্দুদের এদেশে দীর্ঘমেয়াদী আশায় থাকা অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত।

আমার ধারণা ছিল পেনসনের টাকার সাথে শুধু আর্থিক লাভালাভ জড়িত। এখন এর সাথে সামাজিক, রাজনৈতিক এমনকি সাম্প্রদায়িক প্রেক্ষাপটও জড়ো করার অনেক অভিজ্ঞতা হলো। এতে আমার হাজব্যান্ডের হিসেবের কাটাকুটি বেড়েছে বৈ কমেনি। এর সাথে তার সিদ্ধান্তহীনতায় কাঁপছে মন।
আমার এক ছোট ভাই পরামর্শ দিয়েছে, সামাজিক সম্পর্কের চাপে পেনসনের টাকা ধার দিতে গিয়ে কিছু খোয়াবেন। কাজেই সব টাকা তুলে কাজ নেই। আর টাকা তুলে বিনিয়োগ করবেন কোথায়?
আমি ৯০ এর দশকে দেখেছি নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরের অনেক বিহারী রেলওয়ে থেকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক নিয়ে পাকিস্তানে চলে গেছে। তাদের অনেকেই ভারত হয়ে পাকিস্তানে গেছে। তাহলে বাংলাদেশী বিহারী আর বাংলাদেশী বাঙালী হিন্দুদের মধ্যে পার্থক্য রইল কোথায় ? একটি সম্প্রদায় এদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, অন্যরা জাতিগত সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘুত্বের মানও কি একই? নিজেকে বিহারীদের সাথে তুলনা করতে গিয়ে আমি অসহায় বোধ করি।
আমার তখন মহাদেব সাহার ‘দেশপ্রেম’ কবিতাটি মনে পড়ে—-
‘তাহলে কি গোলাপেরও দেশপ্রেম নেই
যদি সে সবারে দেয় ঘ্রাণ,
কারো কথামতো যদি সে কেবল আর নাই ফোটে রাজকীয় ভাসে
বরং মাটির কাছে ফোটে এই অভিমানী ফুল
তাহলে কি তারও দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ উঠবে
চারদিকে!’
আমি কিন্তু এত সব বিশ্লেষণের আগেই আমার অভিমত দিয়েছিলাম আজীবন এর সুবিধা ভোগ করার জন্য। কারণ — প্রথমত, এককালীন টাকা তুলে তা বিনিয়োগ করা নিয়ে অহেতুক ঝামেলা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয়ত,আমাদের পরিবারের বেলায় প্রযোজ্য না হলেও আমার আশেপাশের কমপক্ষে এক ডজন পরিচিতজনের বেলায় দেখেছি পেনসনের টাকার জন্য ছেলেমেয়ে বা মেয়ের জামাই অথবা পুত্রবধূ কিংবা ভাই অথবা ভগ্নিপতি, অনেক সময় অন্যান্যদের বিভিন্ন প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এ টাকার প্রতি লোভ। ধার নেওয়া, ব্যবসায় খাটানোর প্রলোভনসহ বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ। কাজেই মাসিকভাবে নিয়মিত টাকা নেওয়াই উত্তম। হাঁস মেরে একবারে সব সোনার ডিমের লোভে লাভ নেই। তৃতীয়ত, আরও একটা লাভ আছে, লোভও বলা যায়। আজীবন সরকারী ব্যবস্থার সাথে যোগসূত্র থাকবে। এদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সাথে, নিয়মনীতির সাথে সক্রিয় ও সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ।
চতুর্থত,আমার হাজব্যান্ডের আগে আমি না মরলে আমিও একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আজীবন পাব। কাজেই মাসে মাসে পেনসন নেওয়ার সিদ্ধান্তই বলবৎ থাকবে। আমিও কি তবে নিজের স্বার্থে অসাম্প্রদায়িক হলাম?