টেলিফোন
মোকছেদ আলী*
মোজার কারাখানা ও গেঞ্জির দোকানঘর লইয়া ইউনুসের সঙ্গে গোল বাধিল। দীর্ঘ ১৫ বৎসর ঘরে বাস করছি। প্রতি মাসের ঘর ভাড়া দিয়া সত্যেন কুন্ডুর নিকট হইতে পাকা রশিদ গ্রহণ করিয়াছি।
হিন্দুর সম্পত্তি। ইউনুস তহশিল অফিসে চাকরী করিত, খুব ধূর্ত লোক। সত্যেন কুন্ডুকে কিছু টাকা দিয়া আসল মালিকের ভূয়া স্বাক্ষরে বায়নামা করিয়া শতকরা ৮০ ভাগ ওয়াশিল দেখাইয়া, উকিলের পরামর্শে কেচ করে। অফিসে ঘুষ ঘাষ দিয়া কেচের রায় বাহির করিয়া মূল্যের অবশিষ্ট ২০ ভাগ টাকা সরকারে জমা দিয়া, জজের মারফত নিজ নামে কবালা করিয়া লয়। এ সমস্ত কার্য খুব সংগোপনে করে। পরে আমি সত্যেন কুন্ডুর নিকট সব শুনিয়াছি।
যাকগে, ওসব লইয়া আমার মাথা ঘামাইবার দরকার নাই। আমার তো শুধু মালিক বদল হইল। আগে ভাড়া দিতাম নির্মলকুন্ডুকে, আদায়কারী ছিল সত্যেন কুন্ডু। নির্মল কুন্ডুরা দেশ ভাগের পরে ইন্ডিয়ায় চলিয়া যায়। আদায়কারী হিসাবে সত্যেনকুন্ডু আদায় করে।
একদিন সরকারী অফিসারগণ আসিয়া ফিতা দিয়া মাফ জোক করিয়া আমাকে কহিলেন- এটা ইনেমী প্রোপার্টি অর্থাৎ পাকিস্থান সরকারের আইনমতে শত্রু সম্পত্তি। যাহা হোক, ধূর্ত ইউনুস তহসিল অফিসে চাকরী করিত-ওটা ইনেমী প্রপার্টি কাটাইয়া কিভাবে হিন্দু নাগরিক সম্পত্তি করিল তাহা আমার জানার কোন প্রয়োজন নাই। আগে ভাড়া দিতাম হিন্দুকে এখন দিব ইউনুসকে।
কবালা দলিল বাহির করিয়াই আমার কাছে ছয় বৎসরের ভাড়া দাবী করিল। আমি সত্যেনকুন্ডুর হাল রশিদ দেখাইলাম। সে অগ্রাহ্য করিল এবং আমার বিরুদ্ধে মার্শাল ল’ কোটে কেচ দায়ের করিল।
সমন আসিল। আমি আর আজাহার খলিফা, দুইজনে কুষ্টিয়া মোহিনী মিলের এরিয়ার মধ্যে সামরিক আদালতে হাজির হইলাম। গেটে লেখা আছে- “সামরিক আদালত।” গেটে একটা উচু টুলের উপর একজন ২২/২৪ বৎসর বয়সের সৈনিক বসিয়া আছে। তাহাকে সমনের কথা বলিলে, সে সমনটি লইয়া ভিতরে চলিয়া গেল। আমরা গেটে দাঁড়াইয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। প্রায় ১৫ মিনিট পরে সৈনিক প্রবর ফিরিয়া আসিয়া কহিল, অপেক্ষা করেন। এখন একটা কেচ হইতেছে, ডাক পড়িলে যাইবেন।
আমরা তাহার কথামত গেটে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। প্রায় ঘন্টা খানেক পরে অন্য একজন সৈনিক ভিতর হইতে সমন হাতে করিয়া আসিয়া আমার নাম আমাদের নাম জিজ্ঞাসা করিল। নাম বলিলাম।
সে কহিল, চলেন, আমরা তাহার পশ্চাৎ অনুগমন করিয়া বেশ কিছুদুর একটা দ্বীতল দালানের নিকট আসিলাম। দ্বীতলে উঠিবার সিড়ির মুখে আমাদের দাঁড় করাইয়া সৈনিক একাই দোতলায় উঠিয়া গেল। মিনিট ৫/৬ পরে উপর হইতেই আমাদের ডাক দিল।
আমরা সিড়ি বাহিয়া দ্বীতলে উঠিলাম। সৈনিক প্রবর হাতের ইশারায় একটি কক্ষ দেখাইয়া কহিল, “ভিতরে যান।” আমরা কক্ষের দরজার সামনে গিয়া ভিতরে নজর করিয়া দেখি- একজন কৃশকায় ব্যক্তি, গায়ে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি, চুলগুলি ছোট করিয়া ছাঁটা। নাকের নিচে হিটলারি গোঁফ। গাল ও থুতনি সদ্য শেফ করা, মোলায়েম। সামনে টেবিল। চেয়ারে বসিয়া আছে। আমরা ভিতরে প্রবেশ করিয়া তাহাকে ইসলামী পদ্ধতিতে সালাম দিলাম। তিনি সালামের কোন জবাব দিলেন না।
মনে মনে ভাবিলাম, হয়ত ইনি হিন্দু লোক, অথবা সামরিক আদালতে সালামের জবাব দেবার রীতি নাই। আমরা দুইজনে তাহার সামনের টেবিলের এপাশে দাঁড়াইয়া রহিলাম। তাহার পিছনে আরেকটি টেবিলের উপর ফোন। চেয়ারে উপবিষ্ট অফিসার আমার দিকে মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কি?” আমি বিনয়ের সঙ্গে আমার নাম বলিলাম।
তিনি ক্রুদ্ধসারমেয় সুলভ কণ্ঠে বলিলেন- তুমি তোমার এলাকার খুব বদ, তোমাকে লটকামু, লটকাইয়া চাপকামু। আমার মনের অগোচরে আমার বাহুসংলগ্ন ডান হাতের তালুখানা মুষ্ঠিবদ্ধ হইল। সঙ্গী আজাহার মিঞা তাহা লক্ষ্য করিয়া তাহার বা হাতখানা আমার পৃষ্ঠদেশে স্থাপন করিল। আমি সম্বিত ফিরিয়া পাইলাম। একজন সম্ভ্রান্ত বংশীয় শিক্ষিত ব্যক্তির মুখ দিয়া এরূপ বাক্য বাহির হইতে পারে, বিশেষ করিয়া, সামরিক আদালতের বিচারকের পক্ষে- এ বিষয়ে আমার মনে দারুন সন্দেহের সৃষ্টি হইল।
আমি বিনয়ের সহিত কহিলাম, স্যার আমার সঙ্গে আপনার পরিচয় নাই, আপনি দয়া করিয়া আমার এলাকায় যান এবং আমার সম্পর্কে তথ্য নেন, যদি আমি সত্যিই বদ প্রমাণিত হই তবে আপনার ন্যায় বিচারে যে শাস্তি হয় দিবেন। আমার ডান হাতের শিরার ভিতর নিসপিস করিতেছে। তিনি ক্রুদ্ধকণ্ঠে কিছু বলিতে উদ্যত হইতেই পিছনের টেলিফোনটি বাজিয়া উঠিল। তিনি ত্বরিৎ গতিতে উঠিয়া ফোনের রিসিভারটি তুলিয়া কানে সঙ্গে স্থাপন করিয়া কহিলেন, “হ্যালো…,
তারপর ২/৩ মিনিট ধরিয়া কি সব কথাবার্তা হইল। তিনি রিসিভারটি নামাইয়া চেয়ারে বসিলেন। ঘাড়খানা ঈষৎ উচু করিয়া, ছাদের দিকে দৃষ্টি দিয়া ক্ষণিক কি যেন চিন্তা করিলেন। তারপর সহাস্য মুখে বলিলেন, আপনারা চলিয়া যান। বাড়ি গিয়া ইউনুস মিঞাকে আমার নিকট আসিতে বলিবেন। আমি তাহার এরূপ ঁঢ়ংবঃ- এ একেবারে বিস্মিত হইয়া কহিলাম, স্যার তিনি যদি আমার কথায় না আসে। তিনি ক্রুদ্ধকণ্ঠে কহিলেন, “যদি না আসে তবে কিভাবে আনিতে হয় সে আমার জানা আছে। আর শুনেন- আপনি ভাড়া দিবেন না এবং ঘরও ছাড়িয়া দিবেন না।” আমরা তাহাকে সালাম দিয়া যাইতে উদ্যত হইলাম। তিনি এবার আমার সালামের জবাব দিলেন, এবং হাত বাড়াইয়া করমর্দন করিলেন। আমরা বাড়ি ফিরিয়া অফিসারের নির্দেশ ইউনুস মিয়াকে জানাইয়া দিলাম। যে অফিসার আমাকে লটকাইয়া চাপকাইতে চাহিলেন, হঠাৎ তাহার মত পরিবর্তনের কারণ আজো বুঝিতে পারি নাই। তিন দিন পর ইউনুস মিয়ার সঙ্গে দেখা, তিনি আমাকে খুব তাজিম করিলেন।
===================================
*মোকছেদ আলী (১৯২২-২০০৯)।
@ লেখক,
বুঝিতে পারিয়াছি উপর মহলে আপনার অতি ক্ষমতাবান একজন মামা/দুলাভাই ছিল। তাহার টেলিফোনে অসাধ্য সাধন হইয়াছিল। কিন্তু আপনি ইহা কেন গোপন করিলেন তাহা বুঝিতে পারিলাম না।
মাহফুজ,
অনেকদিন পর মোকছেদ আলীকে সংবেদনশীল বিষয়সহ উপস্থিত করলেন। একটি হিন্দুদের অর্পিত সম্পত্তি আর অন্যটি সামরিক আদালত। তবে যত সহজে মোকছেদ আলী পার পেয়ে গেছেন এক অদৃশ্য টেলিফোনিক নির্দেশে, সবার ক্ষেত্রে তা ঘটে না।
যাহোক, মোকছেদ আলীর অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ কথা আরও শোনাবেন আশা করছি।
হিন্দুদের অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে আরও জানতে আবুল বরকতের Deprivation of Hindu Minority in Bangladesh: Living with Vested Property পড়ার জন্য পাঠকদের কাছে পরামর্শ রইল।
@গীতা দাস,
গীতা দি, বাংলাদেশে এখনও কি এনিমী আইন চালু আছে?
(থাকারতো কথা না কারন ওটা ছিল পাকিস্তানি আইন। তাই নয় কি?)
@সেন্টু টিকাদার,
কথা ছিল না, কিন্তু আছে।
@Truthseeker,
হে জননী জন্ম ভুমি স্বর্গাদপি গরিয়ষী,
কেন এত অবিচার নির্বিচার তব বক্ষে?
মাতা,ভালবাসা শুধু দিলে ওদের
উজাড় করে তব সন্তান,
কি পাপ করেছিলাম যে দিলে না স্তান
তব চরনে মাতঃ ।
করলে বিতাড়িত পরদেশে,
যারা রইল করলে তাদের সম্পত্তি গ্রাস,
মা হয়ে একি পরিহাস।
হে মাতঃ তবুও তুমি মাতা
ভালবাসি তোমায় শুধু ভালবাসি।
@সেন্টু টিকাদার,
দুঃখিত একটি ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য। ক্ষমা চাচ্ছি।
অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের গত অধিবেশনে ( ডিসেম্বর ২০১০) উপস্থাপিত হয়েছে, পাশ হয়নি। এখন তা সংসদীয় কমিটিতে গেছে যাচাই, বাছাই ও পর্যালোচনার জন্য।
@সেন্টু টিকাদার,
অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের গত অধিবেশনে
( ডিসেম্বর ২০১০) পাশ হয়েছে। গেজেট এখনও দেখিনি। কাজেই বিস্তারিত বলতে পারছি না। তবে ধারণা করছি হিন্দুর সম্পত্তি গ্রাস নির্মুল না হলেও কমবে। কারণ দেশে তো দুর্বল মুসলমানের সম্পত্তি গ্রাসও অব্যাহত রয়েছে। এমনকি মুক্তিযদ্ধাদের সম্পত্তি পর্যন্ত।
বুঝিতে পারিয়াছি যে টেলিফোনটা “উপরওয়ালার” নিকট হইতে আসিয়াছিল! 🙂
@শ্রাবণ আকাশ,
আপনার ইমেইল চেক করুন এবং লগ ইন করে মন্তব্য করুন। লগ ইন করে মন্তব্য করলে মন্তব্য মডারেটরের এপ্রুভালের জন্য পড়ে থাকবে না; সাথে সাথেই ব্লগে এসে যাবে।
@মুক্তমনা এডমিন, ধন্যবাদ। ইমেইলগুলো ইনবক্সে না গিয়ে অন্য ফোল্ডারে চলে গিয়েছিল বলে আগে চোখে পড়েনি।