প্রেম
মোকছেদ আলী*
ডাক্তার আব্দুল গাফফার ভিলেজ হেলথ কম্প্লেক্সের বড় ডাক্তার।
ডাক্তার রোগী দেখিতেছেন। আর কলম দিয়া খচ খচ করিয়া ঔষধের ব্যবস্থাপত্র লিখিয়া দিতেছেন।
এক বুড়া গায়ের চাদ্দরের ঝুলায় পিঠে করিয়া আসিয়া হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়াইল। ঝুলার মধ্যে এক বুড়ি, মাথার চুলগুলি সাঁচি পাটের মতন সাদা। বুড়ির সারা গায়ে ঘা থ্যাক থ্যাক করছে। দুর্গন্ধে সারা বারান্দার বাতাস ভারী হইয়া উঠিল। সবাই নাকে কাপড় দিয়া বুড়াকে ধমকাইতে লাগিল- এই পঁচা রোগী এখান থেকে সরাইয়া নিয়া যাও। বুড়া বুড়ির কাছে বসিয়া বুড়ির মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকাইয়া রহিল।
ডাক্তার সাহেব বুড়াকে কহিল, তুমি তোমার এই রোগীকে ঐ কড়ই গাছতলায় লইয়া যাও। আমি পরে আসিয়া দেখিব। ডাক্তারের কথামত বুড়া চাদরে জড়াইয়া পাঞ্জা কোলা করিয়া কড়ই গাছের তলায় গিয়া নামাইল। ডাক্তার দুই নাকে উগ্র অডিকোলনে তুলা ভিজাইয়া গুজিয়া কড়ই তলায় গিয়া বুড়াকে কহিল, রোগীনির নাম কি? বুড়া ডাক্তারের দিকে মুখ তুলিয়া কহিল, “মহাজেদা খাতুন।” ডাক্তার একটা খাতায় বুড়ির নাম লিখিলেন। তারপর আবার কহিলেন, ইহার স্বামীর নাম কি? বুড়া কহিল, আমিই ইহার সোয়ামী। ডাক্তার কহিল, বুঝিলাম, কিন্তু তোমার নাম কি?
আমার নাম পরান মন্ডল। ডাক্তার তাহার খাতায় নাম লিখিল। বুড়া খুব অনুনয় বিনয় করিয়া কহিল, ডাক্তার সাহেব, আজ দুই বৎসর হইল আমার স্ত্রীর গায়ে এই কুড়ি কুষ্ঠি হইয়াছে। এর চিকিৎসা বাবদ জমি জাতি ঘর দুয়ার বেঁচিয়া এখন পথের ফকির হইয়াছি। আপনাকে কল দিয়া নিয়া যামু সেই সাধ্য নাই, তাই ওকে হাসপাতালেই আনিলাম। কোনো রিক্সাওয়ালাই এই পচা গন্ধ রোগী রিক্সায় তুলিল না। কহিল ৫০ টাকা ভাড়া দিলেও এই পচা দুর্গন্ধ রোগী রিক্সায় তুলিব না। তাই নিজেই পিঠে করিয়া আনিয়াছি।
ডাক্তারের নাকের অডিকোলনের তুলা ভেদ করিয়াও পঁচা দুর্গন্ধ নাকে ঢুকিল। ডাক্তার কহিলেন- তুমি আমার চেম্বারে আস, ঔষধ লিখিয়া দিব। পরান মন্ডল কহিল, পঁচা গন্ধ পাইয়া যদি কোন কুকুর আসিয়া বুড়িকে খাইয়া ফেলে। ডাক্তার কহিলেন, ভয় নাই; হাসপাতালের এরিয়ার মধ্যে কোনো কুকুরকে আসিতে দেওয়া হয় না, গেটে দারোয়ান আছে। ডাক্তারের চেম্বারে গিয়া দাঁড়াইল। ডাক্তার মনে মনে ভাবিলেন, এ রোগী তো বাঁচিবে না। তবুও বুড়ার মনের শান্তির জন্য একটা সিরাপ লিখিয়া দিলেন।
এক সপ্তাহ পর ডাক্তার একটা রোগী দেখার জন্য সাইকেলযোগে যাইতেছিলেন। পথে দেখিলেন, একটা নতুন কবরের পাশে বুড়া পরান মন্ডল একখানা কুড়ে ঘর তুলিয়াছে। বুড়া কতকগুলি ইট কুড়াইয়া কাদা দিয়া কবরের চারিদিকে দেয়াল গাঁথিতেছে।
ডাক্তার সাইকেল থামাইয়া জিজ্ঞেস করিলেন- মন্ডল কি করিতেছ? মন্ডল কহিল, স্ত্রীর কবরটা বাঁধাইয়া দিতেছি।
ডাক্তার শুধু ডাক্তারই নহে। তিনি একজন দার্শনিকও বটে।
ডাক্তার ভাবিলেন- বাদশাহ শাহজাহানের চেয়ে পরান মন্ডলের স্ত্রীর প্রতি প্রেম, অনেক উর্ধ্বে।
জগতে কত দরিদ্র লোক আছে, যাহাদের দাম্পত্য প্রেম, বাদশাহ শাহজাহানের প্রেমের চেয়ে অনেক বেশি খাঁটি, অনেক উর্ধ্বে। কয়জন তার খোঁজ খবর রাখে?
==================
*মোকছেদ আলী (১৯২২-২০০৯)।
ড. বলাইচাঁদ মখোপাধ্বযায়ের নিজের পেশাগত জীবনে সত্যঘটনা অবলম্বনে লেখা ‘তাজমহল’ চুরি !! ধিক্কার, খোঁজের ক্ষমতা না দেখিয়ে যারা আবার চুরিকে প্রচার করেন তাদেরও ।
বাদশা শাহজাহান জীবিত থাকিতে কি মমতাজকে রাখিয়া সুখ বিহারে যেতেন না? তখন কি মমতাজ চাপা আর্তনাদে ডুকরে কাঁদতেন না? অবশ্যই সুখ বিহারে যেতেন, আর মমতাজ ডুকরে কাঁদতেন কিনা সেটা অজানা ! জীবিত থাকাকালীন সময়ে মমতাজের কোন মূল্য ছিল না। কিন্তু তার মৃত্যুর পর এতো কিছু হায় ভালোবাসা এটাই কি ভালোবাসা। তবে আজ মানুষ এটাকেই ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ নির্দশন হিসেবে গণ্য করছেন। কিন্তু এই পরান মন্ডলের কথা কয়জন জানে?
পরান মন্ডল আমি আপনাকে স্যালুট করি…
ভালো লাগা জানিয়ে গেলাম।
ভাই, গল্পটা বনফুলের লেখা ছোটগল্প “তাজমহল”
-এর পুরাই কাট-পেস্ট বলতে গেলে। কাহিনী অবিকল একই, শুধুমাত্র স্থান ও পাত্র পাত্রীদের নাম বদল করা হয়েছে।
দ্রষ্টব্য- নন্দন প্রকাশনা’র “বনফুলের শ্রেষ্ঠ গল্প”
@আহসান,
বলেছেন ঠিক আছে যে বনফুলের কাটকপি।কিন্তু লেখাটা মোকসেদ আলির তাহলে কাটকপির দায়ভার কার ? তাঁর তাই না?
মোকছেদ আলীর লেখা পোষ্ট করলাম ঠিকই, কিন্তু কারো মন্তব্যের জবাব দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ নেট থেকে দূরে থাকবো। গল্পটি ভালো লাগুক আর মন্দ লাগুক- উভয়ই প্রাপ্য পোষ্টম্যান এই মাহফুজের। কারণ গল্পটির মূল থিম ছিল মোকছেদ আলীর, সেই থিমটারে কিছু দূর্বল বাক্য দিয়ে গল্পটি রচনা করেছি। প্রথম পাতায় দিয়েছি বলে কেউ রাগ করলেও করার কিছু নেই। শুধু এতটুকুই বলবো- প্রেম ছড়িয়ে পড়ুক, মুক্তমনায়।