মান্না দে ঢাকার সেরাটন হোটেলের লবীতে ফেব্রুয়ারী ১৮, ২০০৯

মান্না দে ঢাকার সেরাটন হোটেলের লবীতে ফেব্রুয়ারী ১৮, ২০০৯

২০০৯ সনে ফাল্গুনের (ফেব্রুয়ারী) বসন্তে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম আমার ছেলে রাশাদের সাথে। উদ্দেশ্য ছিল অমর একুশে উদ্‌যাপণ করা এবং মার্চ মাসে স্থলপথে সিলেট হয়ে শিলং, গৌহাটি, শিলিগুড়ি, কালিম্পং, দার্জিলিং এসব শহরগুলো পরিভ্রমন করে আবার স্থলপথে লালমনিরহাটে এসে বাস যোগে ঢাকায় ফেরা। রাশাদের ঢাকায় বাংলা একাডেমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এসিয়াটিক্‌ সোসাইটি, এসব জায়গায় বাংলাভাষা সংক্রান্ত কিছু কাজ ছিল সে’ জন্য আমরা শাহবাগে সেরাটন হোটেলে এক সপ্তাহের জন্য ছিলাম যাতে ঢাকার অভাবনীয় যানজটের হাত থেকে রেহাই পেতে পারি।

সেরাটন থেকে ঢাবি, বাংলা একাডেমী, এসব খুব কাছেই; পদব্রজে নিরানন্দে সে’সব জায়গায় যাওয়া যায়। আরেকটি ‘এট্রাকশন’ ছিল একুশের বইমেলাতে যাওয়া। সেরাটন থেকে পায়ে হেটেই বইমেলায় যাওয়া যায় যদি শাহবাগ-শিশু পার্কের সামনের রাস্তাটি নির্বিবাদে পার হওয়া যায়। একদিন তো একটা বাস এসে আমাকে প্রায় ধাক্কা মারে মারে। আমার ছেলে খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিল এই ঘটনা দেখে।

১৮ই ফেব্রুয়ারীর সকাল সোয়া দশটায় আমি সেরাটনের লবীতে বসে আছি, অপেক্ষা করছিলাম রাশাদের জন্য। সে যেকোনো সময় রুম থেকে নেমে আসবে। আমাদের গন্তব্য স্থান ছিল ঢাবির কলাভবন। আমার ডিজিটাল-SLR ক্যামেরা হাতেই ছিল। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম যে একজন বয়স্ক লোককে নিয়ে কয়েকজন লোক এলিভেটর থেকে বের হয়ে লবীর দিকে এগিয়ে আসছে। তারা প্রৌড় লোকটিকে একটি সোফায় বসিয়ে কোথায় যেন সবাই চলে গেল। ভদ্রলোক আমার মুখোমুখি আরেকটি সোফায় বসলেন আর আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। আমিও প্রতিঊত্তরে মাথা নেড়ে তাকে অভিবাদন জানালাম। নিমিষের মাঝে বুঝতে পারলাম ইনি কে? আমরা হোটেলের বুলেটিন বোর্ডে একটা পোস্টারে দেখেছিলা যে মান্না দে কোথায় যেন ফাংশনে গান গাইবেন। তাই তো! ইনি তো মান্না দে।

আমি তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আর বললাম, “আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি। আপনার কাছে আমার কিছু প্রশ্ন ছিল ।”

– “আসুন, এখানে বসুন।”

– “আমার নাম জাফর উল্লাহ, সেই আমেরিকার নিউ ওর্লিয়ান্স শহর থেকে এসেছি ভাষা দিবস উদযাপন করতে। আপনি তো এখানে কনসার্ট দিতে এসেছেন?।”

– “আপনি কি এখানকার লোক?”

– “হ্যা, তবে চল্লিশ বছর ধরে মার্কিনমুল্লুকে আছি।”

– “সেখানে করেন কী ?”

– “আমি বায়োকামিস্ট্রিতে ডক্টোরেট করে প্রথম দুটো ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ করে গত ২৫ বছর ধরে মার্কিন সরকারের এগ্রিকালচারাল ডিপার্ট্‌মেন্টে গবেষণা করি।”

– “আমার মেয়েও আপনার মত আমেরিকায় লিখাপড়া করে এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় সিলিকন ভ্যালীতে হাই-টেক কোম্পানীতে চাকরী করে।”

– “আমি কি আপনার দুটো ছবি তুলতে পারি?”

– “নিশ্চয়, নিশ্চয়।”

– “আমি ষাট দশক থেকে আপনার গান শুনি, বিশেষ করে রাগপ্রধান গানগুলো। তবে, আপনার কন্ঠে আমার সবচেয়ে পছন্দের রাগ ভীমপলশ্রীতে কোন গান এখন পর্যন্ত শুনি নি। অবশ্য আপনি মন্দ্‌ রাগে যে গানটি গেয়েছেন সেটি সবাই পছন্দ করে।”

– “সেটি কোন গান?”

– “ললিতা গো, ওকে আজ চলে যেতে বল না।”

– “হ্যা, তাই তো। এ তো মন্দ্‌ রাগে বাধা।”

– -“ফোক্‌ রাগ কি না, সে জন্যই এই গানটির এপিল সার্বজনীন!”

আমাদের আলাপটি যখন জমে উঠেছিল, সেই তখন, এক ইয়াং ম্যান হন্তদন্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কড়া ভাষায় বললো – “হু আর ইউ? ইউ আর নট সাপোসড টু টক্‌ টু হিম।”

মান্না দে বিরক্তির ভাব নিয়ে সেই ম্যানেজার গোছের লোককে বললেন – “ওফ্‌, তুমি এসব কী বলছো ইনাকে? আমাদেরকে বিরক্ত করো না, তুমি এখন যাও।”

মান্না দে আমার হাত ধরে টেনে সোফাতে বসালেন আমাকে। ম্যানেজারের কড়া কথা শুনে আমি সোফা ছেড়ে যে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম সেটি খেয়ালই করিনি। মান্না দের ধাতানি খেয়ে ম্যানেজারটি কোথায় যেন উধাও হলো নিমেষের মধ্যে। মান্না দে আমার গা ঘেষে বসলেন এবার। গান নিয়ে আবার কথোপকথন আরেক বারের মত চালু হোলো।

– “গান গাওয়ার চর্চা আছে বুঝি?”
– “এখন নেই, তবে ছোট বেলায় গাইতাম। বাবার মুখে রাগপ্রধান গান শুনতাম। তবে নিউ ওর্লিয়ান্সে ওয়েস্টার্ন্‌ ক্লাসিক্যাল ও জ্যাজ মিউজিক্‌ গান রেকর্ড করি হবি হিসেবে।”
– “বেশ তো। আপনি আমার ললিতা গো গানটির যে মন্দ্‌ রাগে বাঁধা তা ঠিকই ধরেছেন।”
– “আপনার হিন্দী গানগুলোও আমার খুব পছন্দ।”

আমাদের আলাপ জমতে না জমতেই সেই ছোকরা ম্যানেজার আবার এসে উপস্থিত হলো। মান্না দের চেহারায় আবার বিরক্তির ভাব প্রকাশ পেল। তার সাথে আরো কিছু লোকদের দেখা গেলো। এরা বোধ হয় মান্না দের সাথে দেখা করতে এসেছে। ম্যানেজার মান্না দে কে বললো – “স্যার, উই হেব টু গেট গোয়িং ওর এলস্‌ উইল্‌ মিস দ্যা প্লেন।”

এবার ম্যানেজারটি অন্যান্যদের দিকে তাকিয়ে বললো – “ উই ডোন্ট হেব মাচ টাইম। ছবিটবি যা তোলার এখনই তুলে নিন।”

dhaka_25

মান্না দে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন আর সঙ্গে সঙ্গে এক শুভার্থী এসে পা ছুঁইয়ে তাঁকে প্রণাম করলো। তার পর ছবি তুলার পর্ব চালু হলো। আমি এই সুযোগে মান্না দে ও তাঁর সাথে আগন্তুকদের কয়েকটা ছবি তুললাম। ম্যানেজার এবার আমার কাছে এসে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো – “আপনি থাকেন কোথায়?”

আমার উত্তর শুনার পর সে বললো – “হাও ফার ইজ নিউ জার্সী ফ্রিম ইউওর প্লেস? মাই সিস্‌টার এন্ড ব্রাদার ইন লো লীভ দেয়ার।” এবার সে আগন্তুকদের উদ্দেশ্য করে বললো – “হারি, হারি, উই হ্যাব টু গেট গয়িং।”

মান্না দে আমাকে তাঁর মেয়ের নাম ও ফোন নাম্বার দিয়ে বললেন – “আমার মেয়ের সাথে যোগাযোগ করে আমার ছবিটা তাকে ই-মেইল করে দেবেন।”

ম্যানেজার এবার মান্না দের হাত ধরে বলতে গেলে টানতে টানতে হোটেলের ফ্রন্ট ডোরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। তাকে বলতে শুনলাম, “স্যার, উই আর লেট, মে মিস দ্যা ফ্লাইট।”

মান্না দে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন আর বললেন, “গুড বাই ডক্টোর, ললিতা গো – মন্দ্‌ রাগ – ললিতা গো – মন্দ্‌ রাগ।”
———-
বিঃ দ্রঃ এই লিখার সাথে দুটো ছবি সেঁটে দিলাম। একটি মান্না দের আর অপরটি গেস্টদের সাথে। শাড়ী পড়া মহিলাটি মান্না দের গিন্নি কি না তা হলপ করে বলতে পার বো না, তবে কোথায় যেন পড়েছি যে মান্না দে মহারাষ্ট্রের এক মহিলাকে সাত পাকে বেঁধেছেন অনেক ক’টি বছর আগে।