২০০৯ সনে ফাল্গুনের (ফেব্রুয়ারী) বসন্তে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম আমার ছেলে রাশাদের সাথে। উদ্দেশ্য ছিল অমর একুশে উদ্যাপণ করা এবং মার্চ মাসে স্থলপথে সিলেট হয়ে শিলং, গৌহাটি, শিলিগুড়ি, কালিম্পং, দার্জিলিং এসব শহরগুলো পরিভ্রমন করে আবার স্থলপথে লালমনিরহাটে এসে বাস যোগে ঢাকায় ফেরা। রাশাদের ঢাকায় বাংলা একাডেমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এসিয়াটিক্ সোসাইটি, এসব জায়গায় বাংলাভাষা সংক্রান্ত কিছু কাজ ছিল সে’ জন্য আমরা শাহবাগে সেরাটন হোটেলে এক সপ্তাহের জন্য ছিলাম যাতে ঢাকার অভাবনীয় যানজটের হাত থেকে রেহাই পেতে পারি।
সেরাটন থেকে ঢাবি, বাংলা একাডেমী, এসব খুব কাছেই; পদব্রজে নিরানন্দে সে’সব জায়গায় যাওয়া যায়। আরেকটি ‘এট্রাকশন’ ছিল একুশের বইমেলাতে যাওয়া। সেরাটন থেকে পায়ে হেটেই বইমেলায় যাওয়া যায় যদি শাহবাগ-শিশু পার্কের সামনের রাস্তাটি নির্বিবাদে পার হওয়া যায়। একদিন তো একটা বাস এসে আমাকে প্রায় ধাক্কা মারে মারে। আমার ছেলে খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিল এই ঘটনা দেখে।
১৮ই ফেব্রুয়ারীর সকাল সোয়া দশটায় আমি সেরাটনের লবীতে বসে আছি, অপেক্ষা করছিলাম রাশাদের জন্য। সে যেকোনো সময় রুম থেকে নেমে আসবে। আমাদের গন্তব্য স্থান ছিল ঢাবির কলাভবন। আমার ডিজিটাল-SLR ক্যামেরা হাতেই ছিল। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম যে একজন বয়স্ক লোককে নিয়ে কয়েকজন লোক এলিভেটর থেকে বের হয়ে লবীর দিকে এগিয়ে আসছে। তারা প্রৌড় লোকটিকে একটি সোফায় বসিয়ে কোথায় যেন সবাই চলে গেল। ভদ্রলোক আমার মুখোমুখি আরেকটি সোফায় বসলেন আর আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। আমিও প্রতিঊত্তরে মাথা নেড়ে তাকে অভিবাদন জানালাম। নিমিষের মাঝে বুঝতে পারলাম ইনি কে? আমরা হোটেলের বুলেটিন বোর্ডে একটা পোস্টারে দেখেছিলা যে মান্না দে কোথায় যেন ফাংশনে গান গাইবেন। তাই তো! ইনি তো মান্না দে।
আমি তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আর বললাম, “আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি। আপনার কাছে আমার কিছু প্রশ্ন ছিল ।”
– “আসুন, এখানে বসুন।”
– “আমার নাম জাফর উল্লাহ, সেই আমেরিকার নিউ ওর্লিয়ান্স শহর থেকে এসেছি ভাষা দিবস উদযাপন করতে। আপনি তো এখানে কনসার্ট দিতে এসেছেন?।”
– “আপনি কি এখানকার লোক?”
– “হ্যা, তবে চল্লিশ বছর ধরে মার্কিনমুল্লুকে আছি।”
– “সেখানে করেন কী ?”
– “আমি বায়োকামিস্ট্রিতে ডক্টোরেট করে প্রথম দুটো ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ করে গত ২৫ বছর ধরে মার্কিন সরকারের এগ্রিকালচারাল ডিপার্ট্মেন্টে গবেষণা করি।”
– “আমার মেয়েও আপনার মত আমেরিকায় লিখাপড়া করে এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় সিলিকন ভ্যালীতে হাই-টেক কোম্পানীতে চাকরী করে।”
– “আমি কি আপনার দুটো ছবি তুলতে পারি?”
– “নিশ্চয়, নিশ্চয়।”
– “আমি ষাট দশক থেকে আপনার গান শুনি, বিশেষ করে রাগপ্রধান গানগুলো। তবে, আপনার কন্ঠে আমার সবচেয়ে পছন্দের রাগ ভীমপলশ্রীতে কোন গান এখন পর্যন্ত শুনি নি। অবশ্য আপনি মন্দ্ রাগে যে গানটি গেয়েছেন সেটি সবাই পছন্দ করে।”
– “সেটি কোন গান?”
– “ললিতা গো, ওকে আজ চলে যেতে বল না।”
– “হ্যা, তাই তো। এ তো মন্দ্ রাগে বাধা।”
– -“ফোক্ রাগ কি না, সে জন্যই এই গানটির এপিল সার্বজনীন!”
আমাদের আলাপটি যখন জমে উঠেছিল, সেই তখন, এক ইয়াং ম্যান হন্তদন্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কড়া ভাষায় বললো – “হু আর ইউ? ইউ আর নট সাপোসড টু টক্ টু হিম।”
মান্না দে বিরক্তির ভাব নিয়ে সেই ম্যানেজার গোছের লোককে বললেন – “ওফ্, তুমি এসব কী বলছো ইনাকে? আমাদেরকে বিরক্ত করো না, তুমি এখন যাও।”
মান্না দে আমার হাত ধরে টেনে সোফাতে বসালেন আমাকে। ম্যানেজারের কড়া কথা শুনে আমি সোফা ছেড়ে যে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম সেটি খেয়ালই করিনি। মান্না দের ধাতানি খেয়ে ম্যানেজারটি কোথায় যেন উধাও হলো নিমেষের মধ্যে। মান্না দে আমার গা ঘেষে বসলেন এবার। গান নিয়ে আবার কথোপকথন আরেক বারের মত চালু হোলো।
– “গান গাওয়ার চর্চা আছে বুঝি?”
– “এখন নেই, তবে ছোট বেলায় গাইতাম। বাবার মুখে রাগপ্রধান গান শুনতাম। তবে নিউ ওর্লিয়ান্সে ওয়েস্টার্ন্ ক্লাসিক্যাল ও জ্যাজ মিউজিক্ গান রেকর্ড করি হবি হিসেবে।”
– “বেশ তো। আপনি আমার ললিতা গো গানটির যে মন্দ্ রাগে বাঁধা তা ঠিকই ধরেছেন।”
– “আপনার হিন্দী গানগুলোও আমার খুব পছন্দ।”
আমাদের আলাপ জমতে না জমতেই সেই ছোকরা ম্যানেজার আবার এসে উপস্থিত হলো। মান্না দের চেহারায় আবার বিরক্তির ভাব প্রকাশ পেল। তার সাথে আরো কিছু লোকদের দেখা গেলো। এরা বোধ হয় মান্না দের সাথে দেখা করতে এসেছে। ম্যানেজার মান্না দে কে বললো – “স্যার, উই হেব টু গেট গোয়িং ওর এলস্ উইল্ মিস দ্যা প্লেন।”
এবার ম্যানেজারটি অন্যান্যদের দিকে তাকিয়ে বললো – “ উই ডোন্ট হেব মাচ টাইম। ছবিটবি যা তোলার এখনই তুলে নিন।”
মান্না দে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন আর সঙ্গে সঙ্গে এক শুভার্থী এসে পা ছুঁইয়ে তাঁকে প্রণাম করলো। তার পর ছবি তুলার পর্ব চালু হলো। আমি এই সুযোগে মান্না দে ও তাঁর সাথে আগন্তুকদের কয়েকটা ছবি তুললাম। ম্যানেজার এবার আমার কাছে এসে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো – “আপনি থাকেন কোথায়?”
আমার উত্তর শুনার পর সে বললো – “হাও ফার ইজ নিউ জার্সী ফ্রিম ইউওর প্লেস? মাই সিস্টার এন্ড ব্রাদার ইন লো লীভ দেয়ার।” এবার সে আগন্তুকদের উদ্দেশ্য করে বললো – “হারি, হারি, উই হ্যাব টু গেট গয়িং।”
মান্না দে আমাকে তাঁর মেয়ের নাম ও ফোন নাম্বার দিয়ে বললেন – “আমার মেয়ের সাথে যোগাযোগ করে আমার ছবিটা তাকে ই-মেইল করে দেবেন।”
ম্যানেজার এবার মান্না দের হাত ধরে বলতে গেলে টানতে টানতে হোটেলের ফ্রন্ট ডোরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। তাকে বলতে শুনলাম, “স্যার, উই আর লেট, মে মিস দ্যা ফ্লাইট।”
মান্না দে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন আর বললেন, “গুড বাই ডক্টোর, ললিতা গো – মন্দ্ রাগ – ললিতা গো – মন্দ্ রাগ।”
———-
বিঃ দ্রঃ এই লিখার সাথে দুটো ছবি সেঁটে দিলাম। একটি মান্না দের আর অপরটি গেস্টদের সাথে। শাড়ী পড়া মহিলাটি মান্না দের গিন্নি কি না তা হলপ করে বলতে পার বো না, তবে কোথায় যেন পড়েছি যে মান্না দে মহারাষ্ট্রের এক মহিলাকে সাত পাকে বেঁধেছেন অনেক ক’টি বছর আগে।
মান্না দে’র ভক্ত জ্ঞান হওয়া অবদি। অসাধারণ কন্ঠের যদুকর তিনি। খুব ভালো লাগলো আপনার লেখাটা। তবে একটা অনূযোগ আপনার প্রতি,
এমন সুন্দর সুন্দর লেখা দিয়ে যাচ্ছেন,অথচ এর পরে আর আপনাকে পাইনা। মানে বলতে চাইছি আমাদের মন্তব্যের জবাব পাইনা 🙁 ।ভুল বলে থাকলে ক্ষমা করে দেবেন। 🙂
@আফরোজা আলম,
আপনার মারফত অন্যান্য সবাইকে যারা এই লিখার উপর মন্তব্য রেখেছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।
আমি সুদীর্ঘ ৪১ বছর একটানা মার্কিনমুল্লুকে থেকে লিখিত বাংলার কোনো চর্চা করতে পারিনি। ১৯৯৬ সন থেকে ২০০৯ সন পর্যন্ত কেবল ইংরেজীতে নিবন্ধ লিখাছি প্রায় প্রতিদিনই। তাই বাংলায় কিছু লিখা আমার জন্য বেশ দুরহ। কীবর্ডে হাত পড়লে আঙ্গুলে আড়ষ্টতা চলে আসে। আর বাংলা বানানের নাই বা বললাম! প্রায়ই অভিধানের স্মরণাপন্ন হতে হয়। এ’সব কারণে আপনাদের মন্তব্যের প্রতুত্তর দেয়া হয়ে উঠেনা মনে ইচ্ছা জাগলেও। ভাল কথা, ১৯৬৭-৬৯ আমার বয়স যখন ২০-২১ ছিল তখন আমি ঢাকা রেডিও তে একাঙ্কিকা, জীবন্তিকা এসব লিখতাম। আমেরিকায় এসে সব গুলিয়ে গেল। ভাগ্যিস এক বাঙ্গালী ললনাকে বিয়ে করেছি। সে; কারণে বাংলায় কথা বলার চর্চাটা আজ অবধি বজায় আছে। ২-৩ বছর ধরে আবার নুতন করে বাংলা সাহিত্য পড়া শুরু করেছি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, তারাশংকর, শরৎচন্দ্র, এদের রচনাবলী পড়া আরম্ভ করেছি। মধ্যযুগীয় বাংলার রস আস্বাদনের জন্য পড়তে শেরু করেছি কাশী দাসের মহাভারত আর কাব্যরসের জন্য পড়ছি বৈষব পদাবলী। এতসব বলছি এই কারণে যে বাংলার সাথে পুনর-পরিচয়ের জন্য আবার উঠে পড়ে লেগেছি।
আগামীতে চেষ্টা করবো লিখতে। তবে আমার লিখা দিয়ে কতটুকু আনন্দ আপনাদেরকে দিতে পারবো সেটি নিয়ে আমার সবিশেষ সন্দেহ আছে।
@এ.এইচ. জাফর উল্লাহ, ভাই,
ভাই ডাকাকে অন্য কিছু হিসেবে নেমেন না অনূগ্রহ করে। আপনি গুরুজন, আপনার লেখনী সহ আরো বিস্তারিত জানার পরে আমার একটা কথা মনে হল আপনি আমার কথার জবাব দিয়েছেন তাতেই নিজকে ধন্য মনে করছি। যে যে বই এর নাম উল্ল্যেখ করলেন তা অনেক আগেই পড়া হয়ে গেছে।তথাপি আবার নতূন করে পড়তে স্বাদ জাগে। আগেকার এই সব লেখক,যেমন বিভূতি ভূষন,বিমল মিত্র, মানিক বন্দোপাধ্যায়, সৈ্যদ মুজতবা আলি, তারা শংকর, জরাসন্ধ, শরৎ চন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, হালে শমরেশ মজুমদার,বুদ্ধ দেব, আরো আরো অনেকের নাম বলছিনা দীর্ঘ হয়ে যাবে তালিকা,এঁদের অবদান অসামান্য। কবিদের তালিকা আপাততঃ থাক। আপনি আবার নতূন করে ঝালাই করছেন জেনে খুব আনন্দিত হলাম। সব শেষে অত্যান্ত আনন্দিত আমার জবাব পেয়ে কেননা ,আপনাকে আমরা সবাই কাছে পেতে চাই। ভূল বানান শুদ্ধ বানান যায়ই হোক না কেন আপনি আমাদের সাথে থাকবেন এই আমাদের ঐকান্তিক ইচ্ছে।আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
বাহ! :yes:
মান্না দে-র স্ত্রীর কেরালার মেয়ে। নাম সুলোচনা কুমারন।
সুন্দর।
:yes:
ধন্যবাদ মান্না দে কে নিয়ে সুন্দর একটি লেখা উপহার দেয়ার জন্য। দুইবার মান্না দের লাইভ কনসার্ট দেখার সৌভাগ্য হয়েছে যেখানে বেশীর ভাগ গানই ছিল হিন্দিতে গাওয়া যদিও প্রত্যাশা ছিল বাংলা গান শুনা। অসাধারন একজন শিল্পী।
সুর, সঙ্গিত, তাল এসব বিষয়ে ছোটকাল থেকে আমি পাগল। কিন্তু এত শিখার জানার আগ্রহ থাকার পরেও কেন জানি জানতে পারলাম না। তবে আজও পাগল এইসব বিষয়ে জানার। যাইহোক,
একদা মান্না দে আর নচিকেতার সাথে একটি টকশো হয়েছিল কলকাতার কোন এক টিভি চ্যনেলে। দুই প্রজন্মের দুই হিরো, সামনা সামনি। আর টকশো ছিলও বটে সেই রকম। কে কার যুগে কি করছে, কার সঙ্গিতে কি কি… যেন মনে আসছেনা, এই তুমুল ঝগরা উপভোগ করার মত ছিল। নচিকেতার ডায়লগ ছিল বুলেটের মত, অনেক জায়গায় মান্না দে’কে বিমর্ষ হতে দেখলাম, বেশ মজার ছিল।
আপনার লেখাটা বেশ ভাল লাগল। ধন্যবাদ
অসাধারন একজন শিল্পী, কথা বার্তায় মনে হল অসাধারন মানুষও বটে। জাফর স্যারকে অনেক ধন্যবাদ সুন্দরভাবে এই লেখাটা উপস্থাপনের জন্য।
উনি খুব ভাল মানুষ। ইনার সাথে আমার দেখা হয়েছিল যখন আমার বয়স ৮। আজও উনার মিষ্টি হাসিটুকু মনে আছে।
গায়কদের সাথে আলাপ চারিতা পড়তে বা শুনতে আমার ভালোলাগে আর মান্নাদে’র মত বড় মানের শিল্পী হলেতো কথাই নেই। এ সুযোগ সৃষ্টি করে দেবার জন্য লেখক এবং মান্নাদে উভয়কে ধন্যবাদ।
জাফর ভাই,
তাহলে এবার হয়ে যাক না আপনার পছন্দের সেই গান টা-
httpv://www.youtube.com/watch?v=vaFHdIlllj8&p=5C0E1A33C343CE45&playnext=1&index=44
ধন্যবাদ ছোট কিন্তু চমতকার লেখাটির জন্য।
শুনেছিলাম মান্না দে নাকি বেশ খেয়ালী গোছের, মনে হচ্ছে সত্যতা আছে। এ বয়সেও তিনি যেভাবে অক্লান্ত ভাবে একের পর এক গেয়ে যেতে পারেন তা সত্যিই অতূলনীয়।