বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির আয়োজনে যুক্তিবাদীদের বিয়ে
কল্যাণ বিশ্বাস
গত ০৩ জুন ২০১০ তারিখে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির পরিচালনায় আবারো দু’জন যুক্তিবাদীর মধ্যে সমকালীন চিন্তা-চেতনার আলোকে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যুগান্তকারী বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।পূর্বে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র আয়োজনে আরো দুটি বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে বিশাল পরিসরে, প্রকাশ্যে।এ খবর ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম, ওয়েব সাইট, এবং ব্লগে প্রকাশ পেয়েছে।
যাহোক, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে দীর্ঘদিন ধরে দু’জনে পরস্পরকে জানা ও বোঝার মধ্য দিয়ে ভালো লাগা থেকে গভীর ভালোবাসা সৃষ্টির কারণে বর্তমান বিবাহ-প্রার্থী দু’জনে আলোচনা করে বিবাহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন এবং সেই সিদ্ধান্ত সমিতির নেতৃত্বকে জানানো হয়েছে। সমিতির নেতৃত্ব ও সহযোদ্ধারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের সহযোদ্ধা ভাবী বর ও কনে-কে নিয়ে নান্দনিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও শপথ গ্রহণের আয়োজন করেন। প্রবীর সাহা এবং প্রতিমা বিশ্বাস শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে ‘যৌথ জীবনে’ প্রবেশ করেন।
বিবাহ অনুষ্ঠানটির উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ এখানে উপস্থাপন করা হলো। সমগ্র অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন কার্তিক বক্সী (সদস্য, “বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি” হাজিরহাট বাজার শাখা, মনিরামপুর, যশোর)।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সমিতির বক্তব্য পাঠ করেন “বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি” কপিলমুনি শাখার সদস্য বিপ্লব কান্তি মণ্ডল (অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট, খুলনা)।
প্রবীর-প্রতিমা’র বিয়েতে ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র বক্তব্য
সম্মানিত সুধীজন,
আজকে বেজপাড়া, যশোর-এ প্রবীর-প্রতিমা’র বিয়ের এই অনুষ্ঠান আঙ্গিনায় আপনাদের আন্তরিক উপস্থিতি আমাদেরকে ধন্য করেছে। অতীতে বিভিন্ন সময়ে আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে আজকের এই বিবাহ অনুষ্ঠানকে সুন্দর ও প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য আপনাদের অনুরূপ সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি।
বিয়ে হচ্ছে একটি সামাজিক বন্ধন। আধুনিক বিশ্বে যার রয়েছে আইনগত রেজিস্ট্রেশন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এবং সমাজে বিয়ের রীতি-নীতি বিভিন্ন রকম। বিবাহের যাবতীয় রীতি-নীতি ও আইন-কানুনের কথা স্মরণ রেখেই বিবাহ রীতি-নীতিকে আরো একটু অগ্রসর করে নেওয়ার যে প্রয়াস, এ অনুষ্ঠান তারই অংশ। যুগে যুগে বিবাহ রীতি-নীতি ও আইন-কানুনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়েই সমাজ সভ্যতা আজকের এই পর্যায়ে এসেছে।মানুষ তার নিজের প্রয়োজনেই সেগুলোকে ক্রমাগত আরো উন্নততর পর্যায়ের দিকে নিয়ে চলেছে।কারণ মানুষের চেতনা, মূল্যবোধ আরো বেশি বেশি করে মানবিক হচ্ছে- মানুষ এগিয়ে চলেছে মানবতার চরম বিকাশ মনুষ্যত্বের দিকে।
রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিয়ের অনেক অমানবিক প্রথার বিলোপ সাধন করেন এবং অনেক মানবিক প্রথা ও ধারার প্রচলন করেছেন। যেখানে মনু’র বিধানে বাল্যবিবাহ ছিল বাধ্যতামূলক, সেখানে রায় বাহাদুর হরিবিলাস সারদা’র ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯২৯ সালের ১৯ নং আইনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহকে সম্পূর্ণ বেআইনি ঘোষণা করা হয়, যা মনু’র বিধানের সম্পূর্ণ বিপরীত। আজকের সমাজে কোনও সুস্থ মানুষ বাল্যবিবাহকে সমর্থন করেন না। অর্থাৎ এখানে মনু’র বিধানের পরিবর্তে আধুনিক চিন্তা-চেতনা ও আইনকে সমর্থন করেন এবং মানেন।
একদল মানুষের আপত্তি সত্ত্বেও- আরেক দল মানুষ অগ্রসর চিন্তা-চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে উন্নত মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য ইতিবাচক পরিবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। কাজেই আমাদের মহত্তম দায়িত্ব হচ্ছে- আগামী প্রজন্মের জন্য এমন একটি উত্তরাধিকার দিয়ে যাওয়া; যার জন্য তারা গর্ববোধ করবে।
আজকে, প্রবীর-প্রতিমা নিজেদের জীবনে দাম্পত্য সম্পর্ক সৃষ্টিতে যে নিষ্ঠা ও সাহসের সঙ্গে এগিয়ে এসেছে- আসুন, আমরা সবাই মিলে ওদেরকে স্বাগত জানাই। উত্তর প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আমরা বর্তমানকে উৎসর্গ করি।
“সুন্দর আসে ঐ যুক্তির পথে
সাদরে লও তারে আপনার সাথে।”
আপনাদেরকে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা প্রবীর-প্রতিমা’র বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু করছি।
ধন্যবাদ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বিবাহ বিষয়ক সমিতির ভাবাদর্শকে তুলে ধরার জন্য ‘বিয়ে এবং কিছু কথা’ শিরোনামে একটি লিফলেট উপস্থিত সুধীজনদের হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং পরে এটি পাঠ করে শোনান ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র অন্যতম সংগঠক ডাঃ বাবলু কিশোর বিশ্বাস (সহকারী রেজিষ্টার (সার্জারী), ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, যশোর)। প্রবীর-প্রতিমার বিয়ে উপলক্ষে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক প্রবীর ঘোষ শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন। প্রবীর ঘোষের বার্তাটি পাবেন এখানে (ডাউনলোড করে নিন, মাত্র 260 KB)।
এরপর রনজিৎ বাওয়ালী-র (সভাপতি, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি, মশিয়াহাটি শাখা, অভয়নগর, যশোর) লেখা ‘বিয়ের পদাবলী’ আবৃত্তি করেন কবি নিজেই।
বিয়ের পদাবলী
বিবর্তনে সৃষ্টি-ধারা জীব মধ্যে বয়,
এককোষী হতে জীব বহুকোষী হয়।
একমাত্র মানুষের যৌন ক্ষুধা নয়,
যৌনমিলন আকাঙ্খা প্রাণীজগতময়।
ঋতু ছাড়া অন্য প্রাণী করে না বিহার,
জীবশ্রেষ্ঠ মানুষের নাই কোন বিচার।
আদিকালে মানুষের দল ঘুরতো জঙ্গলে,
মুক্তপ্রেম, মুক্তবিহার ছিল সেইকালে।
পরিবর্তনশীল জীবজগত হচ্ছে রূপান্তর,
স্মৃতিচিহ্ন থাকে তার এই ধরণীপর।
জাতি, ধর্ম, রাষ্ট্র ছিল না সেইকালে,
নারী ছিল সমাজকর্তা ইতিহাস বলে।
খাগড়াছড়ি, বান্দরবন, ময়মনসিং উত্তরে
মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা আদিবাসীর ঘরে।
মামাতো, পিসতুতো বোন দক্ষিন ভারতে
ভাইয়ের সাথে করে বিয়ে পরম আনন্দেতে।
ভারতের বিবাহের আছে ইতিহাস,
সেই তত্ত্ব এইখানে করিব প্রকাশ।
মহাভারতে সুভদ্রাকে অর্জুন করে বিয়ে,
পিসেতো বোন ইরাবতী, পরীক্ষিত যায় নিয়ে।
উপস্থিত সুধীজন শোনেন দিয়া মন,
বৈদিক যুগের কথা কিছু করিব বর্ণন।
স্বাধীনভাবে চলতো নারী,স্বাধীন অধিকার,
পতি নির্বাচন করতো যেমন ইচ্ছা যার।
আপস্তম্ভ ধর্মসুত্র পরিষ্কার বলে,
বংশের ভাই নয় শুধু সহোদরও চলে। (৭/২/৫)
বৈদিক বিয়ের সুচনায় নাহতো অনুষ্ঠান,
পিতামাতা হাত ধরে করতো কন্যাদান।
বেদোত্তর যুগে চার বিয়ে দেখতে পাই,
আসুর,রাক্ষস,গান্ধর্ব, পৈশাচিক জানাই।
পণ লেনদেন নিয়ে যত বিয়ে হয়,
আসুর বিবাহ ইহা জানিবে নিশ্চয়।
চুরি করে,বলপূর্বক নারী হরণ করে,
রাক্ষস বিয়ে গণ্য হয় শাস্ত্রীয় বিচারে।
প্রবঞ্চণা, ছল করি নিয়ে যায় ঘরে,
পৈশাচিক বিয়ে ইহা বলে শাস্ত্রকারে।
নির্জনে প্রেমালাপ করে মাল্যদান,
গান্ধর্ব বিয়ে এই শাস্ত্রেতে প্রমাণ।
গঙ্গা সাথে শান্তনুর গান্ধর্ব মতে বিয়ে
শুদ্রকন্যা হিড়িম্বা বরে ভীমে মাল্য দিয়ে।
মহাকাব্যিক মহাভারত শুনে মধু ভরে,
জোর করে রুক্কিনীরে কৃষ্ণ বিয়ে করে।
দেবকের রাজসভায় সিনির গমন,
গায়ের জোরে দেবকীরে করিল হরণ।
বাসুদেবের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়েছিল।
মামাতো বোন অর্জুন হরিয়া আনিল।
এইসব রাক্ষস বিয়ে মহাভারতে গাঁথা,
হাজারো কাহিনী ভরা মহাভারতের পাতা।
বিধবা বিবাহ মহাভারত যুগে ছিল,
ঐরাবত দুহিতার স্বামী গরুড়ে মারিল।
সযত্নে অর্জুন বীর বিয়ে করে তারে,
ইরাবন নামে পুত্র বিখ্যাত সংসারে।
ভিক্ষা মাগি গৌতম ঋষি শুদ্রদ্বারে যায়,
শুদ্রাণী এক বিধবাকে বিয়ে করে লয়।
ব্রাহ্মণকন্যার সাথে শুদ্রের বিয়ে হতো,
সেই গর্ভে সন্তান হলে চন্ডাল বলিত।
চন্ডালকন্যা বিয়ে ব্রাহ্মণে বৈধ ছিল,
তার গর্ভে পুত্র হলে গলায় পৈতা দিল।
এক পুরুষের বহুপত্নী বিয়ের প্রথা ছিল,
শর্মিষ্ঠা, দেবযানী যযাতিকে বরিল।
শকুন্তলা,লক্ষণারে দুষ্মন্ত আনে ঘরে,
গঙ্গা আর সত্যবতী শান্তনু বিয়ে করে।
ষোল হাজার মুনিকন্যা কৃষ্ণ আনে হরে,
অবৈধ শৃঙ্গার করে রাখিয়া অন্দরে।
কন্যাগন বলে কৃষ্ণ মোদের বিয়ে করো,
অনূঢ়া শৃঙ্গার করে কেন ইজ্জত মারো।
বিবাহের পরে তাদের মনের দুঃখ গেল,
দশটি করে পুত্র তাদের গর্ভে জন্মিল।
এক নারী বহুপতি মহাভারতে আছে,
পঞ্চপাণ্ডব সকলে যায় দ্রৌপদীর কাছে।
ঋষিকন্যা বাক্ষীকে দশ ভাই বিয়ে করে।
জ্যেষ্ঠ ভাইয়ে করলে বিয়ে অধিকার দেবরে।
বিবাহকালে দ্রোপদীরে ব্যাস ডেকে কয়,
বহুপতি পেলে নারী সনাতন ধর্ম পায়।
দক্ষরাজের ষোল কন্যা ভিন্ন প্রথায় বিয়ে,
একসাথে ষোল কন্যা ধর্ম যায় নিয়ে।
সত্যবতী খেয়া বায় যৌবনে যমুনায়,
প্রাতঃকালে পরাশর ঘাটেতে উদয়।
অপূর্ব রূপসী যেন ফোটা গোলাপ ফুল,
মধু পেয়ে মধুকর কামেতে ব্যাকুল।
হাসিয়া বলেন মুনি সত্যবতীর ঠাই,
তোমারূপে মুগ্ধ আমি কাম ভিক্ষা চাই।
নিশি অবসানে, এখন অরুণ উদয়,
চারিদিকে কলরব, লোক লাজ-ভয়।
হেন বাক্য শুনি মুনি ছাড়েন হুংকার,
কুয়াশায় ঢেকে গেল, হলো অন্ধকার।
আনন্দে কাম তৃপ্তি করে পরাশর,
কুমারী গর্ভে জন্মে ব্যাস এই ধরাপর।
বিপ্রশা মুনির ঔরসে গঙ্গার উদরে,
কুরুকুল চুড়ামণি জন্মলাভ করে।
যৌবনে শান্তনুরাজ গঙ্গা বিয়ে করে,
শান্তনুর ঔরসে ভীষ্ম গঙ্গার উদরে।
সত্যভঙ্গ করলে রাজা গঙ্গা চলে যায়।
ঘুরতে ঘুরতে নৃপতি গেলেন যমুনায়।
গঙ্গাজ্ঞানে সত্যবতী গৃহেতে আনিল,
সুচিত্রবীর্য, বিচিত্রবীর্য দুই নন্দন জন্মিল।
অম্বিকা, অম্বালিকা এনে পুত্রবধু করিল,
বংশরক্ষা না হতে তারা যমালয়ে গেল।
বিপদ বুঝে সত্যবতী ভীষ্মে ডেকে কয়,
কুরুকুল হয় নির্মূল করহে উপায়।
ভীষ্মদেব বলে মাতা তোমারে জানাই,
চির ব্রহ্মচারী আমি কোন উপায় নাই।
বিপদ ভারী চিন্তা করি ব্যাসকে ডাকিল,
তার ঔরসে রানীদ্বয়ের গর্ভে পুত্র হলো।
ধৃতরাষ্ট্র, পান্ডু ভাই দুইজন,
দাসী গর্ভে জন্মিলেন বিদুর সুজন।
ছোট ভাইবৌয়ের গর্ভে সন্তান জন্মদান,
হেন নীচ কাজ করলেন ব্যাস মতিমান।
মাতা-পুত্রে বিয়ে হতো মহাভারত যুগে,
শান্তনু গঙ্গার বিয়ে আর কি প্রমাণ লাগে?
ঢাক-ঢোল-কাসর বাজে, বাজে সানাই বাঁশী,
শাস্ত্রকথা ছেড়ে দিয়ে মূল কথায় আসি।
গুরুচান্দ চরিতে এই কথাটা কয়,
বিবাহ স্বীকৃতিমাত্র আর কিছু নয়।
বর্তমান বিজ্ঞানযুগ চারিদিকে আলো,
কুসংস্কার ছেড়ে এবার বাস্তবেতে চলো।
পাত্র-পাত্রী জেনে নেবে নিজেদের মন,
মনে মনে মিল হলে হবে একমন।
ছেলে-মেয়ে দুইজনে মেডিকেল করাবে,
মল-মুত্র, রক্ত-বীর্য পরীক্ষা করে নেবে।
মালা বদল নাচ গান কর আয়োজন,
এই বিয়েতে লাগেনা নাপিত ব্রাহ্মণ।
বিয়ের পর পাত্র-পাত্রী আদালতে যাবে,
আইন মোতাবেক বিয়ে রেজিষ্ট্রি করাবে।
শাস্ত্র মধ্যে পেয়েছি যাহা করেছি বর্ণন,
ভুল ত্র“টি করবেন ক্ষমা যত সুধীজন।।
এরপর বর ও কনে-কে মঞ্চে আসার জন্য আহ্বান করা হয়। বর ও কনে-কে শপথ বাক্য পাঠ করান ডাঃ জিষ্ণুপদ মুখার্জী (মেডিকেল অফিসার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কপিলমুনি, পাইকগাছা, সাতক্ষীরা এবং ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’ কপিলমুনি শাখা, সাতক্ষীরা- এর সাধারণ সম্পাদক)।
-
বিয়ের শপথনামা
আমি প্রবীর কুমার সাহা, পিতা: মৃত শংকর চন্দ্র সাহা, মাতা: বাসনা রাণী সাহা, গ্রাম: চাটমোহর, থানা: চাটমোহর, জেলা: পাবনা।
আমি প্রতিমা বিশ্বাস, পিতা: হাজারী বিশ্বাস, মাতা: সবিতা বিশ্বাস, গ্রাম: ডাঙ্গা মহিষদিয়া, থানা: মনিরামপুর, জেলা: যশোর।
যে আদর্শ মানুষকে মানুষ হিসাবে ভাবতে শেখায়, মানুষকে সবার উপরে স্থান দেয় এবং মানুষের সার্বিক মুক্তির পথ দেখায় আমরা উচ্চনিনাদে মুক্তকন্ঠে সেই মানবতাবাদী আদর্শ যুক্তিবাদের জয় ঘোষণা করছি।
আমরা মুক্তমনা, আধুনিক চিন্তা-চেতনায় আস্থাশীল মানবতাবাদী যুক্তিবাদী। আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন স্বাধীনচেতা প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষ। গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করি মানুষের মর্যাদা ও স্বাধীনতায়।
আমরা একে অপরকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি, বিশ্বাস করি, ভালবাসি এবং জীবনসঙ্গী হিসাবে জীবন-যাপনের জন্য আমরা উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার সিদ্ধান্ত নিয়ে শপথ করছিঃ
আজকের এই প্রাণময় উজ্জ্বল মুহূর্তে স্বপ্নময় ভবিষ্যতের লক্ষ্যে একে অপরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা ও আস্থা প্রকাশ করে উভয়ে উভয়কে বিবাহিত হিসাবে গ্রহণ করছি।
মর্যাদার সঙ্গে সমাধিকারের ভিত্তিতে দাম্পত্য জীবনের সকল দায়িত্ব পালন করব। উভয়ে উভয়ের অধিকার ও স্বাধীন ব্যক্তিসত্বাকে সচেতনভাবে সম্মান জানাব। দুজনই যাতে নিজেকে সুস্থ ও স্বাধীনভাবে বিকশিত করতে পারি সে ব্যাপারে পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার ভূমিকা স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে পালন করব। প্রভু-দাসীর অমানবিক সম্পর্ক নয়, বন্ধুত্বের মানবিক সম্পর্কই আমাদের দাম্পত্যজীবনের প্রাণ-প্রদীপ।
আমাদের চিন্তা-চেতনায় বৈচিত্র্য থাকবে কিন্তু বৈপরীত্য থাকবে না। দু’জনকে একই ফুল ভালবাসতে হবে, একই গায়কের গান ভালো লাগতে হবে এমনটা নয়। এই ধরনের প্রশ্নাতীত সহমত অনেক সময় দাসত্বের প্রকাশ। আমরা ভিন্নমত পোষণ করতেই পারি কিন্তু আদর্শকে ভালবাসার ক্ষেত্রে আমরা অভিন্ন থাকব।
আমাদের মধ্যে কেউ আদর্শচ্যুত হলে সঙ্গত কারণেই উভয়ের মধ্যে দেখা দেবে দ্বন্দ্ব। আর সেক্ষেত্রে শ্রদ্ধাহীন বন্ধুত্বহীন দাম্পত্যজীবন অটুট রাখা অসম্ভব ও সুস্থমানসিকতার পরিপন্থী।
নরের দৃষ্টিতে নারীকে দাসী হিসাবে দেখার ব্রাহ্মণ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর বিপরীতে নর-নারী পরস্পরকে মানুষ হিসাবে দেখার মানবিক যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করছি। আমরা কোন অন্ধ আবেগের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারস্পারিক শুভেচ্ছা, উৎফুল্লতা ও যুক্তিবোধের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যৌথ জীবনে প্রবেশ করছি।
আমাদের নিখাঁদ বন্ধুত্ব, ভালবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, নির্ভরতা, সহমর্মিতা ও সহযোগীতার সম্পর্ক আনন্দঘন এই অনুষ্ঠানে, এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে প্রাণের জোয়ার এলো। আমরা প্রগাঢ় ভালবাসার মধ্য দিয়ে সুস্থ-সুন্দর দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করছি।
শপথ পাঠ শেষে বর ও কনে মালাবদল করেন, যা অনুষ্ঠানটিকে আরও নান্দনিক করে তোলে। তারপর নব দম্পতি যৌথভাবে আবৃত্তি করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নির্ভয়’ কবিতাটি, যা প্রকাশ করে মুক্তমনা দম্পতির স্বপ্ন ও আদর্শের অভিব্যক্তি।
নির্ভয়
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমরা দুজনা স্বর্গ-খেলনা গড়িব না ধরণীতে
মুগ্ধ ললিত অশ্র“গলিত গীতে।
পঞ্চশরের বেদনামাধুরী দিয়ে
বাসররাত্রি রচিব না মোরা প্রিয়ে!
ভাগ্যের পায়ে দুর্বলপ্রাণে ভিক্ষা না যেন যাচি।
কিছু নাই ভয়, জানি নিশ্চয়- তুমি আছ, আমি আছি।।
উড়াব ঊর্ধ্বে প্রেমের নিশান দুর্গম পথমাঝে
দুর্দম বেগে, দুঃসহতম কাজে।
রুক্ষ দিনের দুঃখ পাই তো পাব,
চাই না শান্তি, সান্ত্বনা নাহি চাব।
পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি,
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব – তুমি আছ, আমি আছি।।
দুজনের চোখে দেখেছি জগৎ, দোঁহারে দেখেছি দোঁহে –
মরুপথতাপ দুজনে নিয়েছি সহে।
ছুটি নি মোহন-মরিচিকা-পিছে-পিছে,
ভুলাই নি মন সত্যেরে করি মিছে –
এই গৌরবে চলিব এ ভবে যতদিন দোঁহে বাঁচি।
এ বাণী, প্রেয়সী, হোক মহীয়সী – তুমি আছ আমি আছি।
বিয়ের কিছু ফটোর লিংক নিচে দেয়া হল –
http://www.flickr.com/photos/shoikot/5085415255/
http://www.flickr.com/photos/shoikot/5086011694/
http://www.flickr.com/photos/shoikot/5086010996/
http://www.flickr.com/photos/shoikot/5086009754/
http://www.flickr.com/photos/shoikot/5085411773/
ভাল লাগল লেখাটা পড়ে। চিরাচরিত নিয়মের বাঁধন ভেঙ্গে এগিয়ে চলেছি আমরা। জয় হক মুক্ত চিন্তার জয় হক মানবিকতার। নবদম্পতিকে শুভেচ্ছা জানাই তাদের সাহসী পদক্ষেপের জন্য।
একই সাথে একটা ইচ্ছে মনে জেগেছে- কবে যে আমারও…………
অনেকে বিষয়টা সম্ভবত আঁচ করতে পারেন নাই। এখানে যারা বিবাহ করেছেন বা বিবাহের আয়োজন করেছেন তারা সবাই ধর্মে অবিশ্বাসী। এই বিবাহে বর ও কনে শুধুমাত্র একটা শপথ পাঠ করেছেন যার সাথে ধর্মীয় প্রথার কোনো সম্পর্ক নেই। “রনজিৎ বাওয়ালী” একজন স্বশিক্ষিত মানুষ ও স্বভাবকবি। তিনি বিয়ের পদাবলী পাঠ করেছেন যা অনেকটা ধর্মের বিরোধিতাই করে। তারা যা করেছেন এগুলোকেও তারা আবার প্রথা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা পোষণও করেন নি। যেহেতু তারা প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাস করেন না তাই এগুলো ধর্মীয় প্রথার মত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই এবং তারা এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। যাদের প্রবীর ঘোষ সম্পর্কে জানা-শোনা আছে তারা ব্যাপারটা বোঝতে পারবেন।
এভাবে সম্পূর্ণ ধর্মহীন উপায়ে বিয়ে করাটা কতটা কঠিন একটু ভাবলেই বোঝা সম্ভব।
ধর্মের সাথে কোন পার্থক্য চোখে পড়ল না। হতাশ হওয়া ছাড়া আর কিই বা হওয়া যায়। 🙁
@সাইফুল ইসলাম, হতাশ হওয়ার কিছূ নেই ধীরে ধীরে চেঞ্জ আনতে হবে।বিবর্তন একদিনে হয় না ধীরে ধীরে হয়। অতি দ্রুত সমাজকে বদলে ফেলা সম্ভব নয়। ধাপে ধাপে এগুতে হবে।
@সুমিত দেবনাথ,
যারা এই বিয়েতে অংশগ্রহন করেছেন তারা কিন্তু একটি ব্যতিক্রমী চিন্তাকেই বিদ্রোহ করে প্রতিষ্ঠিত করছে। সেখানে তারা যদি এইসব মন্ত্র টন্ত্র পাঠ না করে বিয়েটা করত তাতে কি এমন হত? মন্ত্র টন্ত্র পাঠ করলেই কি ধার্মিকরা এই বিয়ে মেনে নিবে নাকি? 🙂 আর যদি মেনে নেয়ার ব্যাপারই থাকে তাহলে আর এত হ্যাপা পুষিয়ে নাস্তিক হওয়ার কি দরকার। আস্তিক থেকে ধর্ম পালন করলেই পারে। 😀
আমার মনে হয় মুক্ত মনাদের জন্য কোন রিচুয়ালের প্রয়োজন নেই।
সিদুর দেওয়ার বিষয়টি গ্রহনজগ্য নয় কোন মতেই।আর বিয়ের ছড়াটির অনেক্ষানি হিন্দুয়ানি।বিবাহের জন্য মনের মিল এবং রেজিস্ট্রেশানই যথেস্ট আমার মনে হয়।নতুন দম্পতিদের অনেক শুভ কামনা রইলো।
পুরা ব্যাপারটা পড়ে যা মনে হল হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের বাইরে ডকিনস ডারউন সম্প্রদায় নামে আরেকটা গোষ্ঠীর আবির্ভাব হচ্ছে যারা তাদের পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের রিচুয়াল না মানলেও তাদের পূর্ববর্তি সম্প্রদায়ের অনুকরণ করে নিজেদের উপযোগী কিছু রিচুয়াল বানাছে
বর কনে কে অভিনন্দন। তাদের আগামী জীবন সুখে সমৃদ্ধ হোক।
হিন্দুরা উদার মানসিকতার হয় সেটা জানি। কিন্তু মুসলমানরা কবে এরকম মুক্তমনের হবে, তাদের বিবাহ অনুষ্ঠানও কবে যুক্তিবাদী হবে তাই ভাবছি।
ভাল লাগল এই বিয়েটি দেখে। চিরাচরিত নিয়মের বাঁধন ভেঙ্গে এগিয়ে চলেছি আমরা। জয় হক মুক্ত চিন্তার জয় হক মানবিকতার। নবদম্পতিকে শুভেচ্ছা জানাই তাদের সাহসী পদক্ষেপের জন্য। তাদের দাম্পত্য সুখ কামনা করি।
বাহ! এই বিয়ের খবর জেনে খুবই ভালো লাগলো। একই সাথে একটা ইচ্ছে মনে জেগেছে- কবে যে আমারও………… 😀
নবদম্পতিকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
সব ঠিক আছে। বিয়ে এবং জীবিকার মধ্যে নাস্তিকতা না ঢোকালে আস্তিকতা যাবে না আমি আগেও বলেছি। কিন্ত তিনটে জিনিস ভালো লাগলো না…
[১] কন্যাটিকে সিঁদুর এবং বালা পড়তে হল কেন? ও দুটোই পুরুষতন্ত্রের চিহ্ন। তাছারা সিঁদুরে মার্কারি আছে। চর্মরোগ হতে পারে। সিঁদুর বর্জন করাই শ্রেয়।
[২] ওই ছড়াটি কি নিতান্তই দরকার ছিল? নাস্তিকতা কোন আনুগত্যের প্রশ্নে তৈরী হয় নি। শপথবাক্যই যথেষ্ঠ।
[৩] রবীন্দ্রনাথ লোকটাকে এখানে টানা কেন?
আর এসবের কোন দরকার নেই। সরকারি রেজিস্ট্রেশনের পর, সবাইকে ডেকে খাওয়াইলেই হইল। আস্তিক আচার বিচারকে কেন হনুকরন করতে হবে?
এটিই আসল কথা। নব দম্পতিকে আন্তরিক অভিনন্দন। :rose:
বিবাহিত দম্পতিকে শুভেচ্ছা। তাদের এই বিয়ে প্রথা ও ধর্মের অচলায়তন ভেঙ্গে এগিয়ে যেতে সবার জন্য প্রেরণা হয়ে থাকবে।