মধ্যযুগীয় পর্ব:
আদিপর্বের ছন্দ আলোচনায় স্পষ্ট যে শুরু থেকে বাঙলী কবিরা ছন্দের ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন। আগেই বলা হয়েছে, স্বরবৃত্ত এমন একটি ছন্দ যা যেকোনো ভাষার সৃষ্টিলগ্ন থেকে ছড়া শ্লোক গীত ইত্যাদির ভেতর দিয়ে অনায়াসে উৎসারিত হয়। ছন্দের বিকাশের ক্ষেত্রে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যে আদিপর্বেই অক্ষরবৃত্তের পয়ারগুলো দানাকৃত হতে দেখা যায়। পরবর্তীতে যদিও এর মাত্রা গণনা, পর্ববিন্যাস, রূপসজ্জায় বেশ পরিবর্তন ঘটে, তব্ওু এই ছন্দটি বাংলা কবিতার সাথে সর্বদাই দৃঢ় পায়ে হেঁটেছে। মধ্যযুগে এসে ক্রম-বিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেমন অক্ষরবৃত্ত পূর্ণতা পেয়েছে ঠিক তেমনি বাংলার রূপরসগন্ধ অনুযায়ী একটি নরম ছন্দ মাত্রাবৃত্তকেও পরিস্ফূটিত হবার সুযোগ করে দিয়েছে। ভাষার দাবী অনুযায়ী এটাই হয়তো স্বাভাবিক ছিলো। কারণ, অক্ষরবৃত্তের আট-ছয় এর চাল মাত্রাবৃত্তে ছয়-ছয়-দুই এ পরিণত হতে তেমন বেগ পাবার কথা নয়। যেমন,
অঝর ঝরএ মোর/ নয়নের পাণী
অক্ষরবৃত্তের আট-ছয় চালে রচিত বড়ু চণ্ডীদাসের এই পঙক্তিটি অতি সহজে ভেঙে মাত্রাবৃত্তের ছয়-ছয়-দুই ফর্মে ফেলে দেয়া যায়।
অঝর ঝরএ/ মোর নয়নের/ পাণী
এটি সম্ভব হবার অন্যতম কারণ যে এই পঙক্তিটি কোনো যুক্তাক্ষর ব্যবহৃত হয়নি; এবং শেষ শব্দটি এসেছে দুই মাত্রার। পঞ্চদশ শতাব্দীতে বড়ু চণ্ডীদাসের কবিতায় অক্ষরবৃত্ত থেকে মাত্রাবৃত্তে ঢুকে যাবার এই প্রবণতা প্রায়সই লক্ষ্য করা যায়।
উদাহরণ:
১.
আকুল করিতেঁ কিবা কহ্মার মন।
বাজাএ সুসর বাঁশী নান্দের নন্দন।।
পাখী নহোঁ তাঁর ঠাই উড়ী পাড়ি জাঁও।
মেদনী বিদায় কেউ পসিআঁ লুকাওঁ।।
বন পোড়ে আগ বড়ায়ি জগজনে জাণী।
মোর মন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পণী।।
(কে না বাঁশী বাএ বাড়ায়ি/ বড়– চণ্ডীদাস)
পর্ববিন্যাস:
আকুল করিতেঁ কিবা/ কহ্মার মন।
বাজাএ সুসর বাঁশী/ নান্দের নন্দন।।
পাখী নহোঁ তাঁর ঠাই/ উড়ী পাড়ি জাঁও।
মেদনী বিদায় কেউ/ পসিআঁ লুকাওঁ।।
বন পোড়ে আগ বড়ায়ি/ জগজনে জাণী।
মোর মন পোড়ে যেহ্ন/ কুম্ভারের পাণী।।
অক্ষরবৃত্তে (পয়ার) আট-ছয় এর অপূর্ব চালে মাত্র একটি প্রসারণ ও একটি সংকোচনের দেখা পাওয়া যায়। “কহ্মার” শব্দে “হ্ম” সম্প্রসারিত, ও “বাড়ায়ি” শব্দে “ড়া” সংকুচিত হয়েছে। এই কাব্যাংশটুকুর বুননে অন্য কোথাও এই নিয়ম মেনে চলা হয়নি। অর্থাৎ এই পর্যায়ে এসে সব দীর্ঘধ্বনি ও হ্রস্বধ্বনি প্রসারণ-সংকোচন নিয়মটি ব্যবহার থেকে বিরত থাকার প্রবণতা এসেছে। অন্যদিকে, একটু সতর্কতার সাথে দেখলে বোঝা যায় যে বেশ কয়েক পঙক্তিতে চোরকাঁটার মতো মাত্রাবৃত্তের চাল ঢুকে গেছে। যেমন:
আকুল করিতেঁ/ কিবা কহ্মার/ মন।
…
পাখী নহোঁ তাঁর/ ঠাই উড়ী পাড়ি/ জাঁও।
মেদনী বিদায়/ কেউ পসিআঁ লু/ কাওঁ।।
মাত্রাবৃত্তে ছয়-ছয়-দুই এর চাল। প্রথম পঙক্তির দিকে আরেকটু নজর দিলে, বলা অসঙ্গত নয় যে দীর্ঘধ্বনির সম্প্রসারণই অনেক ক্ষেত্রে মাত্রাবৃত্তে প্রবেশের দ্বার খুলে দিয়েছে।
২.
দরসন লোচন দীঘল ধাব।
দিনমনি পেখি কমল জনু জাব।।
কুমুদিনী চন্দ মিলন সহবাস।
কপটে নুকাবিঅ মদন বিকাস।।
(বৈষ্ণব পদাবলী/ বিদ্যাপতি)
পর্ববিন্যাস:
দরসন লোচন/ দীঘল ধাব।
দিনমনি পেখি/ কমল জনু জাব।।
কুমুদিনী চন্দ/ মিলন সহবাস।
কপটে নুকাবিঅ/ মদন বিকাস।।
বিদ্যাপতির কাব্যের এই অংশটুকুতে তিন অক্ষরের শব্দ নিয়ে টানাটানির একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায়। “লোচন”, “দীঘল”, “কপটে”, “কমল” এবং “মিলন”─এই পাঁচটির প্রথম তিনটিকে সম্প্রসারণ করে চার মাত্রার মূল্য দেয়া হলেও, শেষ দু’টিকে দেয়া হয়েছে দুই মাত্রা ধারণ করার ক্ষমতা। অন্যদিকে চতুর্থ পঙক্তিতে “কুমুদিনী চান্দ” কে আট মাত্রার মূল্য দেবার জন্যে দীর্ঘধ্বনি “নী” ও “ন্দ”কে দুই মাত্রা করে দেয়া হয়েছে। ফলতঃ এই কবিতায় সর্বত্র সংকোচন ও প্রসারণের ধরণ এক নয়। সম্ভবত এই সময়ে এসে কবি খেয়ালের উপর বেশী জোর দিয়েছেন। অবশ্য এটি হয়তো উচ্চারণের ধরণ বদলে যাবার ফলও হতে পারে। তবে মধ্যযুগের শেষ দিকে এসে সংকোচন-প্রসারণের এই প্রক্রিয়াটি প্রায় লুপ্ত হয়ে যায়।
৩.
তিমির দিগ ভরি ঘোর যামিনী
অথির বিজুরিক পাতিয়া।
বিদ্যাপতি কহ কৈছে গোঙায়াবি
হরি বিনে দিন রাতিয়া।।
(রাধা-বিরহ/বিদ্যাপতি)
কাঠামো:
৬ + ৬
৮
৬ + ৬
৮
স্পষ্টত, এই কাব্যাংশটুকুতে যে সংকোচন-প্রসারণ ঘটেছে তা ওই অক্ষরের শব্দকে ঘিরে। অর্থাৎ তিন অক্ষর সম্বলিত শব্দের মাঝে ব্যবহৃত হ্রস্ব-ইকার যুক্ত শব্দকে হ্রস্বধ্বনি এবং শেষে ব্যবহৃত দীর্ঘ-ইকার যুক্ত শব্দকে দীর্ঘধ্বনি হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে। ফলতঃ “তিমির”, “অথির”, “পাতিয়া” ও “মাতিয়া” এই চারটি শব্দর মাঝের মাত্রাটি ফেলে দিয়ে এদের প্রত্যেককে দেয়া হয়েছে দুই মাত্রার মর্যাদা। অন্যদিকে অন্ত্যে দীর্ঘ-ইকার সম্বলিত একমাত্র শব্দ “যামিনী”কে দেয়া হয়েছে চার মাত্রা।
৪.
নব নব গুণগুণে বান্ধল মঝু মনে
ধরম হরম কোন ঠায়।।
গৃহপতি-তরজনে গুরুজন গরজনে
অন্তরে উপজয়ে হাস।
তহিঁ এক মনো রথ জনি হয় অনুরত
পুছত গোবিন্দ দাস।।
(রূপে ভরল দিঠি/ গোবিন্দ দাস)
কাঠামো:
৮ + ৮
১০
৮ + ৮
১০
৮ + ৮
৮
তৃতীয় উদাহণে বিদ্যাপতির মতো একই রকম বুনন এখানে এসে আট-আট-দশ এর ধরণ নিয়েছে, যদিও শেষ পর্বটি একটু ব্যতিক্রম। প্রসারণ ঘটেছে “বন্ধল” ও “অন্তরে” শব্দদ্বয়ে। এক্ষেত্রেও অক্ষরবৃত্ত এবং মাত্রাবৃত্ত প্রায় গলাগলি ঘরে হেঁটেছে, একমাত্র শেষ পর্ব─“পুছত গোবিন্দ দাস”─ছাড়া।
৫.
বঁধুর পিরীতি আরতি দেখিয়া
মোর মনে হেন কের।
কলঙ্কের ডালি মাথায় করিয়া
আনল ভেজাই ঘরে।।
আপনার দুখ সুখ করি মানে
আমার দুখের দুখী।
চণ্ডীদাস কহে বঁধুর পিরীতি
শুনিতে জগত সুখী।।
(এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা/ চণ্ডীদাস)
বডু চণ্ডীদাস থেকে চণ্ডীদাসের সময়ের দূরত্ব প্রায় দুশো বছরের। এই সমায় কালে আস্তে আস্তে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ একটি পরিপূর্ণ অবস্থানে এসে দাঁড়িয়ে। সংকোচেন-প্রসারণের আর যে কোনো দরকার হচ্ছে না, তার একটি উজ্জ্বল প্রমাণ চণ্ডীদাস রচিত উপরের কাব্যাংশটুকু। কি চমৎকার ছয়-ছয়-আট এর চাল। অন্যদিকে বলা যায়, “কলঙ্কের” আর “চণ্ডীদাস” শব্দ দু’টিকে বিযুক্ত অক্ষরের শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারলে, এই কাব্যাংশটুকু অনায়াসে মাত্রাবৃত্তের ছয়-ছয়-ছয়-দুই চালে ধরা দিতো।
৬.
রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গে লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।
…
রূপ দেখি হিয়ার আরতি নাহি টুটে।
বল কি করিতে পারি যত মনে উঠে।।
দেখিতে যে সুখ উঠে কি বলিব তা।
দরশ পরশ লাগি আউলাইছে গা।।
(রূপ লাগি আঁখি ঝুরে/ জ্ঞানদাস)
পর্ববিন্যাস:
রূপ লাগি আঁখি ঝুরে/ গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গে লাগি কান্দে/ প্রতি অঙ্গ মোর।।
…
রূপ দেখি হিয়ার আ/ রতি নাহি টুটে।
বল কি করিতে পারি/ যত মনে উঠে।।
দেখিতে যে সুখ উঠে/ কি বলিব তা।
দরশ পরশ লাগি/ আউলাইছে গা।।
লক্ষ্য করার মতো যে প্রথম চার পঙ্ক্তি আট-ছয় চালে রচিত হলেও শেষ দুই পঙক্তি রচিত হয়েছে আট-চার চালে। এটা একদিকে যেমন দুই-দুই লাইনে মাত্রার সমতা নির্দেশক, যেটা চর্যাপদ থেকেই ধারাবাহিক ভাবে চলে এসেছে, অন্যদিকে স্বরের ওজন নির্ণয়ে অক্ষরবৃত্তে একটি আবশ্যকীয় নীতির সমর্থক। পূর্বে অক্ষরবৃত্তের নিয়ম থেকে আমরা জানি যে এই ছন্দে বদ্ধস্বরকে কখনো দুই এবং কখনো এক মাত্রা দেয়া হয়। সেই নিয়মে “আউলইছে” শব্দে “আউ” ও “লাই” বদ্ধস্বর দু’টি প্রথম ও মাঝে অবস্থানের কারণে এক মাত্রা করে পেয়েছে; যেমন প্রথম পঙ্ক্তিতে ব্যবহৃত “কান্দে” ও “অঙ্গ” শব্দদ্বয়ে যথাক্রমে “কান” ও “অঙ” স্বরদু’টি এক মাত্র করে ধারণ করেছে। অতএব ‘আউলইছে’কে দেয়া হয়েছে তিন মাত্রার মর্যাদা। এই সময় থেকেই এই নিয়মের প্রচলন শুরু হয়। অবশ্য পরবর্তী কালে কেউ কেউ সব বদ্ধস্বরকেই দুই মাত্রা দেয়ার পক্ষেও থেকেছেন।
৭.
পাশেতে বসিয়া রামা/ কহে দুঃখবাণী।
ভাঙ্গা কুড়্যা ঘরখানি/ পত্রের ছাওনী।।
ভেরেণ্ডার খাম তার/ আছে মধ্য ঘরে।
প্রথম বৈশাখ মাসে/ নিত্য ভাঙ্গে ঝড়ে।।
(ফুল্লরার বারমাসের দুঃখ/মুকুন্দরাম)
৮.
মহা মহা মল্ল সব সিংহনাদ করে।
এথ দেখি এরাকের পৃথিম্বি বিদরে।।
সহস্র সহস্র বীর নাচে গদা ধরি।
যুদ্ধ মাঝে চলে হেন যেন মত্তকরী।।
পদাতিক পদধূলি ঢাকিল আকাশ।
দিনে অন্ধকার নাহি রবির প্রকাশ।।
(রণাঙ্গনের দৃশ্য/ জয়েন উদ্দীন)
সাত ও আট এই দুই উদাহরণেই অক্ষরবৃত্তের (পয়ার) আট-ছয় এর চাল এসেছে নির্ভুল। অর্থাৎ দেখা যায় যে ষোড়শ ও শপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলা কবিতায় পয়ারের আট-ছয় বুননটি নির্ভুল হয়ে গেছে। অবশ্য পাশাপাশি আরো একটি বুনন উঠে এসেছে আট-আট-দশ চালে, পরবর্তীতে (রোমান্টিক যুগে) যার প্রথম আট পড়ে গিয়ে মহাপয়ার নামে খ্যাত হয়।
নিন্মে আট-আট-দশ চালে দু’টি উদাহরণ দেয়া হলো।
৯.
মনোহর কণ্ঠ দেখি কম্বু হৈল মনোদুঃখী
জল মধ্যে করিল প্রবেশ।
বিবিধ রতণ-রাজ মোহন দোলরি সাজ
অপরূপ শোভিত বিশেষ।।
(লাইলীর রূপ/ দৌলত উজির বাহরাম খান)
১০.
হাতেম তাইর তরে, বিবি যে সওয়াল করে
শুনে হে হাতেম নেক মর্দ্দ।
লোক মুখে শুনা গেছে সে নাম জাহের আছে
নামেতে হাম্মাম বাদ গর্দ্দ।।
(হাসেন বানুর সাত সওয়াল/ সৈয়দ হামজা)
নয় ও দশ নম্বর উদাহরণ দু’টি শুধু যে আট-আট-দশ এর নির্ভুল চাল দেখিয়েছে তা নয়, মধ্যমিলের প্রবণতাটিও তুলে ধরেছে; পরবর্তীতে রোমান্টিক যুগে যার ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায় “শুধু বিঘে দুই ছিলো মোর ভূঁই আর সবই গেছে ঋণে/ বাবু বলিলেন, বুঝেছ উপেন, ও-জমি লইবো কিনে” ইত্যাদি কবিতায়। দশ নম্বর উদাহরণে আরো লক্ষণীয় যে “সওয়াল” শব্দটির “ও” ধ্বনি কোনো মাত্রার মর্যাদা পায়নি, অনেকটা হ্রস্বধ্বনির সংকোচনের মতো। অক্ষরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত উভয় ছন্দেই কিন্তু এই ধরণের শব্দে এই ব্যবহারটি এখনও রয়ে গেছে যেমন, “হাওয়া”, “খাওয়া”, “নাওয়া”, “যাওয়া” ইত্যাদি সব ছন্দেই দুই মাত্রা পায়।
ইতিমধ্যেই লক্ষ করা গেছে যে অক্ষরবৃত্তের আবর্তণ থেকে মাত্রাবৃত্তের অঙ্কুরিত হওয়ার সময় ছিলো মধ্যযুগ। তবে স্বরবৃত্তের চালও অপ্রচলিত ছিলো না, যদিও তা গান শ্লোক ছড়া ইত্যাদিতেই প্রকাশিত হয়েছে। এই সময়ে স্বরবৃত্ত ছন্দ ব্যবহারের কয়েকটি উদাহরণ:
১১.
ওপার হইতে বাজাও বাঁশী
এপার হইতে শুনি।
অভাগিয়া নারী হাম হে
সাঁতার নাহি জানি।
(বংশী-ধ্বনি/চাঁদ কাজী)
পর্ববিন্যাস:
ওপার হইতে/ বাজাও বাঁশী/
এপার হইতে/ শুনি।
অভাগিয়া/ নারী হাম হে/
সাঁতার নাহি/ জানি।
দুই মাত্রার অতিপর্ব রেখে স্বরবৃত্তের এই তিন পর্বের নির্ভুল পঙ্ক্তি রচনা করেন চাঁদ কাজী শোড়ষ শতাব্দীতে।
১২.
ধীরে ধীরে চল্যা কইন্যা নদীর ঘাটে আসি।
আইস্যা দেখে নদ্যার ঠাকুর বাজায় প্রেমের বাসি।।
(‘মহুয়া’/মৈমনসিংহ-গীতিকা)
পর্ববিন্যাস:
ধীরে ধীরে/ চল্যা কইন্যা/ নদীর ঘাটে/ আসি।
আইস্যা দেখে/ নদ্যার ঠাকুর/ বাজায় প্রেমের/ বাসি।।
যদিও মৈমমসিংহ-গীতিকা’র সিংহ ভাগই অক্ষরবৃত্তের পয়ারে রচিত, তথাপি এর ভেতরেও স্বরবৃত্তের চাল খুঁজে পাওয়া যায়।
১৩.
বিন্দু নালে সিন্ধু বারি,
মাঝখানে তার স্বর্গগিরি
অধর চাঁদে স্বর্গপুরী,
সেই তো তিনি প্রমাণ জানায়।
দরশনে দুঃখ হরে,
পরশনে সোনা ঝরে,
এমন মহিমা সে চাঁদের─
লালন ডুবে ডোবে না তায়।।
(লালন ফকির)
পর্ববিন্যাস:
বিন্দু নালে/ সিন্ধু বারি,/
মাঝখানে/ তার স্বর্গগিরি/
অধর চাঁদে/ স্বর্গপুরী,/
সেই তো তিনি/ প্রমাণ জানায়।/
দরশনে/ দুঃখ হরে,/
পরশনে/ সোনা ঝরে,/
এমন মহি/ মা সে চাঁদের/─
লালন ডুবে/ ডোবে না তায়।।/
১৪.
আপনে চোরা আপন বাড়ী,
আপনে সে লয় আপন বেড়ী,
লালন বলে এ লাচাড়ি
কই না, থাকি চুপেচাপে।।
(লালন ফকির)
পর্ববিন্যাস:
আপনে চোরা/ আপন বাড়ী,/
আপনে সে লয়/ আপন বেড়ী,/
লালন বলে/ এ লাচাড়ি/
কই না, থাকি/ চুপেচাপে।/
দু’টি উদাহরণেই লালন ফকির লাইনে কোনো অতিপর্ব না রেখে আট পর্বের পঙক্তি তৈরী করেছেন। অন্যদিকে তের নম্বর উদাহরণে ‘দরশনে’ ও ‘পরশনে’ শব্দদু’টি উচ্চারণ করা হয়েছে যথাক্রমে ‘দরোশনে’ ও ‘পরোশনে’।
১৫.
আমি এমন জনম পাবো কিরে আর
এমন চাঁদের বাজার মিলবে কি আবার।।
(দুদ্দু শাহ্)
পর্ববিন্যাস:
আমি এমন জনম/ পাবো কিরে/ আর
এমন চাঁদের বাজার/ মিলবে কি আ/বার।।
লক্ষণীয়, প্রতি লাইনে দুই মাত্রার একটি করে উপপর্ব এবং একমাত্রার অতিপর্ব রেখেছেন দুদ্দু শাহ্। সম্ভবত স্বরবৃত্তে রচিত এই গানগুলিতেই প্রথম পয়ার ভাঙার কাজ করা হয়, যদিও ভাবের পূর্ণ সমাপ্তিতে দুই দাড়ির ব্যবহার স্পষ্ট।
ফলতঃ মধ্যযুগ শেষ হওয়ার আগেই ধ্বনি সংকোচন-প্রসারণ বিলুপ্ত হয়ে বাংলায় স্বরবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তের একটি সুনির্দিষ্ট বুনন দাঁড়িয়ে যায়; মাত্রাবৃত্তও বেরিয়ে আসতে থাকে অক্ষরবৃত্তের শরীরের ভেতর থেকে। ক্লাসিক্যাল বা মহাকাব্যিক যুগে অক্ষরবৃত্ত পয়ারের হাত থেকে রক্ষা পাবার সাথে সাথে মাত্রাবৃত্তের চরিত্র অনেকটা উন্মোচিত ও বিস্তৃত হয়।
(চলবে)
লেখাটি পড়ে আনেক ভাল লাগলো তবে স্যারের কাছে আমার একটি প্রশ্ন, কবিরা যখন কবিতা লেখেন তখন কি এসব মাত্রার হিসাব করে লিখেন নাকি এটা লেখার সময় আপনা আপনি হয়ে হয়ে যায়?
প্রথমেই অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি লেখককে এ ধরণের মূল্যবান লেখাগুলো আমাদের উপহার দেবার জন্য। কেউ পড়ুক না পড়ুক লেখাগুলো যাদের জন্য উপকারী তাদের জন্য এ ধরণের লেখা সমূহ এক একটা অমূল্য সম্পদ। বিশেষ করে যারা কবিতার সাথে সম্পৃক্ত থাকতে চান। কবিতার মতো সাহিত্য প্রেমিক তাদের কাছে এই ধরণের লেখা অমিয় সুধার মতো। তাই কোন সাহিত্য প্রেমিকের যদি একজনও এ লেখাগুলো পড়েন , তবে তাতেই এ লেখার লেখকের পরিশ্রম স্বার্থক হবে বলে আমি মনে করি। আর তাই লেখকের পাঠক খোঁজার চেয়ে এ ধরণের আরও মুল্যবান লেখার সৃষ্টি লেখকের জন্য হবে কল্যানমুখী এক একটা সফল প্রয়াস।
লেখকের জন্য শুভকামনা নিরন্তর। (F)
আপনার লেখাগুলো পড়ছি একে একে! আমার অনেক কাজে লাগছে, ধন্যবাদ!
আফরোজা আলম, সাইফুল ইসলাম ও ‘এন্টাইভণ্ড’ আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আপনাদের দেয়া উৎসাহ আমাকে বাঁকি পথ পাড়ি দিতে সাহায্য করবে। আমি জানি এই প্রবন্ধটি অনেকটাই একাডেমিক, কিন্তু ইতিহাস জানতে আমার ভালো লাগে। ধারাবাহিক ভাবে ছন্দের বিকাশ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি যথেষ্ট উপকৃত হয়েছি।
@হাসানআল আব্দুল্লাহ,
আপনার এ পর্বগুলো সংগ্রহে রাখারা মত। প্রিন্ট করে রেখে দেব। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রবোধ সান্যালের বইসহ অন্যান্য বই সংগ্রহ করেছিলাম। কোথায় যে হারিয়ে গেল। নতুন করে আবার এ নিয়ে চর্চা করার প্রেরণা পাচ্ছি আপনার লেখা থেকে। কম পাঠক বলে হতাশ হবেন না। সব ধরণের লেখায় অনেক পাঠক পাবেন না। সবার সব কিছুতে ইন্টাররেষ্ট থাকারও কথা নয়। যে কয়জন পান তাদের নিয়েই কলম চালিয়ে যান।
আমি আপনার আগের লেখায় একটা অনুরোধ করেছিলাম। আজ আরেকটা অনুরোধ করছি জাপানী “হাইকু”এর ছন্দ নিয়ে লেখার জন্য। আমার লেখা কয়েকটা হাইকু পোষ্ট করতে পারছি না ছন্দ যাচাই এর জন্য।
ধন্যবাদ।
@গীতা দাস,
একেকটি ভাষার একেক রকম অধিকার থাকে; বলবার, বুঝবার, শুনবার কিম্বা বুঝাবার অধিকার। গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস ইত্যাদিতে তার প্রতিফলন দেখা যায়। বাংলা ভাষার একটি নরম মাধুর্য্ আছে, ফলে বাঙালীরা বেশী রোমান্টিক, এবং তার ভেতর থেকেই গীতি কবিতা উঠে এসেছে। একজন বাঙালী কবি কতো বড়ো, তা বোধ হয়, তাঁর গীতি কবিতার উৎকর্ষ দিয়ে, আজকের দিনেও, মাপা যায়।
হাইকু কিন্তু জাপানী ভাষার অধিকার; ইংরেজীতে কিম্বা বাংলায় মানায় না। বাংলায় হাইকু লিখতে গেলে অনেকটাই নীতি কথা হয়ে যায়, যা কবিতা নয়। ব্যাপারটা মজার বইকি! ফলতঃ হাইকু আমাকে কখনই টানেনি; মানে লিখতে উৎসাহ বোধ করিনি। তবে, ভেবে দেখি এ সম্পর্কে কিছু লিখতে পারি কিনা।
…প্রবন্ধটি পড়া এবং চমৎকার একটি চিঠি লেখার জন্যে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
দারূণ! খুব ভালো লাগছে। পুরোটা অবশ্য এখনো শেষ করি-নি। শেষ করে আবার মন্তব্য করার আশা রাখি।
ধন্যবাদ।
হাসান ভাই সম্পর্কে শামসুর রাহমান বলেছিলেন,
হাসান ভাইয়ের নিষ্ঠার পরিচয় আমরা পাচ্ছি এই লেখায়।
অবশ্যই এই লেখা চলবে। :yes: :yes: :yes:
এই ধরনের লেখার পাঠক সংখ্যা সীমিত। লিখতে যতো কষ্ট করতে হয়েছে সম্ভবত পাঠক পেতে তার থেকে বেশী কষ্ট করতে হয়! তারপরও যারা পড়ছেন তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে দ্বিতীয় অংশ তুলে দিলাম।
@হাসানআল আব্দুল্লাহ,
অনেকেই এই পর্বগুলো পড়ে উপকৃত হবেন। কথায় আছে অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী। ছন্দে আমার জ্ঞান নাই বললে চলে। আমার মত অকাট মূর্খদের কাজে লাগলেও লাগতে পারে। তবে আপনার এতো কষ্ট করে লেখা দেখে অবাক বিস্ময়ে মাথা নত হয়ে গেল। আরো পড়তে চাই,মনে রাখতে পারি বা নাই পারি পড়তে খুব ভালো লাগছে।