মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা
-মোকছেদ আলী*
(নিচের অংশ ‘স্মরণীয় ঘটনা’ নামক পাণ্ডুলিপি থেকে সংগৃহীত) – পর্ব -১
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী করে আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আবদ্ধ করে রাখল তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের প্রধান প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান।
শেখ মুজিবকে জেল হতে মুক্ত করার জন্য সারা পুর্ব পাকিস্তানব্যাপী গণ-আন্দোলন শুরু হল। প্রতিদিন হরতাল। গাড়ী ঘোড়া বন্ধ। স্কুল কলেজ বন্ধ করে ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল করতে লাগল। এই গণ আন্দোলনে এরূপ তীব্র আকার ধারণ করল যে ধর্মঘটের ফলে, জনজীবন সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ল। প্রচন্ড গণ আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খা পদত্যাগের মাধ্যমে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের উপর পাকিস্তানের দায়িত্বভার অর্পন করে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ালো।
জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতা লাভ করে সাধারণ নির্বাচন দিল। সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করল। ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের নেতা মুজিবকে মৌখিক অভিনন্দন জানালো ঠিক, কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি করতে লাগলো। পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর দল পিপলস পার্টী সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় ভুট্টো গো ধরল ক্ষমতা তার হস্তেই অর্পন করতে হবে। নানান ষড়যন্ত্র করে অবশেষে ২৫ মার্চ রাত্রের আধারে ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনী নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। এই ২৫ শে মার্চ তারিখেই ইয়াহিয়া দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেছিল। সেই একই তারিখে ইয়াহিয়ার বাহিনী ছাত্র শিক্ষক কর্মচারীসহ কত শত নামী দামী মানুষকে হত্যা করতে লাগলো তার হিসাব নাই। ফলে হিতে বিপরীত হল। সাধারণ ইসলামী ভাবাপন্ন মানুষ, যারা ভেবেছিল দেশ পাকিস্তান থাকুক তারাও ঘুরে দাঁড়ালো । আর যারা ইসলামী রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল, তারা পাকিস্তানীদের পক্ষে থেকেই নানাভাবে তাদেরকে সাহায্য করতে লাগলো। তখন মুক্তিবাহিনীরা ছিলো তাদের কাছে কাফেরের মত। আর হিন্দুরা তো কাফের হয়েই আছে। হিন্দুদের ঘর বাড়ি দখল করার পায়েতারা করতে লাগলো।
এপ্রিল মাসে অবস্থা ভয়াবহরূপ ধারণ করলো। লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিল। ভারতে গিয়ে অনেকেই গেরিলা ট্রেনিং গ্রহণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়লো। এদেরকে একেবারে পর্যুদস্ত করে দিল। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজী রেসকোর্স মাঠে হাজার হাজার লোকের সামনে ভারতীয় বাহিনীর নিকট আত্ম সমর্পন করল।
১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর। ভেড়ামারার স্টেশন বাজারের প্রায় সব দোকান পাটে পাক-সেনারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিল। সে রাতে আমরা ঘুমাতে পারি নাই। সেই বিভৎস দৃশ্য আজও আমার চোখের সামনে ভাসছে। মানুষ যে কত বড় হিংস্র পশু হতে পারে তা যারা সেদিন দেখেছে তারাই জানে। শুধু আগুন জ্বালিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি । যাকে সামনে দেখেছে বা পেয়েছে, তাকেই গুলি করে হত্যা করেছে।
পাকহানাদার বাহিনীর আক্রমণে আমরা আগেই বাড়ি ঘর ত্যাগ করে চলে এসেছিলাম জগন্নাথপুরে। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হল। পাকবাহিনী অবশেষে আত্মসমর্পন কোরল মুক্তিবাহিনীর হাতে।
জীবনে সবই ঘটে। যেমন অতিরিক্ত খাদ্য খাওয়ার জন্য বদ হজম হয়ে পেট খারাপ করে, তেমনি অনাহারে থেকেও কষ্ট হয়।
জয়বাংলার শ্লোগানে শ্লোগানে দেশ ছেয়ে গেছে। ভয়াবহ অবস্থা। বাজারের মধ্যে থাকি। সবাই চলে গেছে। আমি ছেলেপেলে নিয়ে বাড়িতেই থাকবো ভেবেছি। এমন সময় মসজিদের ইমাম লালমিয়া বললেন, আল্লাহর নবী হিজরত করেছিলেন, তিনি আল্লাহর উপর তাওক্কাল করে থাকতে পারেন নাই? তিনি গেলেন কেন? বিপদের সমূহ সম্ভাবনা দেখলে স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ আছে।
এবার সম্বিত ফিরে এলো। ছেলেমেয়ে বৌ সঙ্গে করে কোদালিয়া পাড়া অভিমুখে চললাম। সেখানে খালু শ্বশুড়ের বাড়ি। শহর ছেড়ে একটু দুরে নিরাপদ হতে পারে। পথে একজন বললেন, বাঘের মুখে যাচ্ছ নাকি। কোদালিয়া পাড়ার বিহারীরা এখন বাঘ। বাঙালী পেলেই প্রতিশোধ নেবে। শুনে ফিরে চল্লাম সাতবাড়িয়া অভিমুখে। খালু শ্বশুড়ের বাড়িতে যাওয়া গেল না। এবার ফুপা শ্বশুড়ের বাড়ী যাই। সেখানে হয়ত আশ্রয় পাওয়া যাবে। গিয়ে দেখি সে পাড়ার লোকেরা পালাচ্ছে। কি করব? ৬ টা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। আজ রাত তো থাকি। থাকলাম।
মধ্য রাত্রি। ভেড়ামারা বাজারে খালি আগুন আর আগুন। প্রচন্ড বিস্ফোরন ঘটছে ঘন ঘন। শুনে পিলে চমকে গেল। কেউই ঘুমাতে পারলাম না। ভোর হলে চলে গেলাম জগন্নাথপুর। সেখানে গিয়ে আশ্রয় পেলাম। ঐদিনের কথা মনে আছে। কি যে অবস্থা, আতংকে চমকে চমকে উঠি সবাই। আজও স্মরণে আছে সেই ভয়ংকর রাতের কথা। আর মনে থাকবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত।
———–
*মোকছেদ আলী (১৯২২-২০০৯)। স্বশিক্ষিত। সিরাজগঞ্জ জেলার বেলতা গ্রামে জন্ম। গ্রামটি বর্তমানে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
শুরুটা ভাল লেগেছে, যদিও আকারে ছোট।
পরের পর্বগুলির অপেক্ষায় থাকলাম।
@আদিল মাহমুদ,
পর্ব করে ভাগ করা হয়েছে বলে আকারে ছোট।
ধন্যবাদ পাঠ করার জন্য।
[img]http://media.somewhereinblog.net/images/biplob_33blog_1250404803_1-308a.img_assist_custom.JPG[/img]
ইতিহাস সাক্ষী, ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে পূর্ববাংলার সমস্ত পরিবার কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলো, নয়মাসের যুদ্ধের ভয়াবহতা ছিলো এতই।
মোকছেদ আলী তার এই স্মৃতিকথায় যুদ্ধদিনের সেই দিনগুলোকেই স্মরণ করিয়ে দেন। নির্মোহ বিচারে এই পর্বে ইতিহাসের বর্ণানাটুকুও স্মৃতিকথনের ধরণে থাকলে পড়তে আরো লাগতো। চলুক। :rose:
—
ছবি: পাক-বাহিনীর বর্বরতা, রিকশা পেইন্টিং, ন্যাট জিও ম্যাগাজিন, ১৯৭২, সংগ্রহ: মন্তব্যকারী।
মাহফুজ,
মোকছেদ আলীর ব্যক্তি জীবনের একটু তথ্য পাওয়া গেল। তাঁর মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অভিজ্ঞতা আসলে আমাদের সবার মতই —– একই ইতিহাসের অংশ।
@গীতা দাস,
ঐ সময়ে অর্থাৎ একাত্তরে তার ছয়টি ছেলেমেয়ে ছিল।
এই তথ্য দ্বারা আমরা বলতে পারবো না যে তিনি ছয় সন্তানের জনক ছিলেন। কারণ স্বাধীনতার পর আরও সন্তানের জন্ম হয়। অন্যান্য পাণ্ডুলিপিতে ছয়জন ছাড়াও আরও সন্তানের কথা উল্লেখ আছে। সর্বমোট তার সন্তানের সংখ্যা ১৩ জন।
@গীতা দাস,
মৃত্যু ভাবনা ও মুনাজাত – এটি পড়লেই সন্তানের সংখ্যা পাওয়া যায়।
ভাল লাগল!
আরও পড়ার অপেক্ষায়…
@লাইজু নাহার,
ধন্যবাদ।
শীঘ্রই পাঠাচ্ছি ২ পর্ব, একটু অপেক্ষা করুন।
স্বশিক্ষিত মোকছেদ আলীর ‘স্মরণীয় ঘটনা’ নামক একটি পাণ্ডুলিপি থেকে সংগ্রহ করে ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা’ নাম দিয়ে প্রকাশ করা হবে মোট ৩ টি পর্বে। আজ দিলাম প্রথম পর্ব।