রাত তখন প্রায় ৩ টা। জনশূন্য হাসপাতাল করিডর ধরে এগিয়ে এল একটি মেয়ে। দাড়াল আই.সি.ইউ কেবিনের সামনে। সেখানে বিছানায় শুয়ে থাকা রোগাটে ফ্যাকাসে মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে নিঃশব্দ আগমনকারীর গাল অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে। মনে পড়ে যায় গতকাল বিকালে মেয়েটির সাথে হওয়া কথোপকথন-
“নীলা, আমি আমার মেয়েকে নিয়ে চলে যাচ্ছি, অনেক দূরে। যেখানে হাসিমুখে গালের কাটা দাগ, হাতের কালশিরা ঢাকতে বলতে হবেনা- ভাবি বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলাম। একটি পশুর মনে মনুষ্যত্ব সৃষ্টি করার কাজে আমি ইস্তফা দিচ্ছি। প্রতিনিয়ত লড়াই করতে করতে আমি ক্লান্ত নীলা। শরীর আর মনের উপর এ চাপ আর সইতে পারছিনা আমি। এবার আমি এবার মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে চাই, আমি আর আমার মেয়ে মিলে শান্ত নিরুপদ্রব একটি জীবন চাই।”
“কিন্তু কোথায় যাবি মিলি? তোর বাবা তো-”
“না, বাবা মাকে আমার ভাল নিয়ে চিন্তা করার দায় থেকে মুক্তি দিলাম। আমার শরীরের অংশ, আমার আত্মার অংশকে সেলিমের ভয়ে মেরে ফেলার মাঝে আমার কোন ভাল নেই কোন সুখ নেই এ আমি জানি। বাবা মার ভীরু স্নেহের কাছে আমার মাতৃত্বকে বিসর্জন দেবনা আমি।”
একটু থেমে মিলি বলল, “নীলা, দোয়া করিস আমরা যেন ভাল থাকি।”
কিছুক্ষন পরে আবার ফোন বাজল। যন্ত্রনাকাতর কন্ঠে মিলি বলল, “নীলা আমার বাচ্চাটাকে বাঁচা।”
“মিলি, কি হয়েছে মিলি?” জবাবে মিলির আর্তনাদ শুনতে পেল নীলা।
তড়িঘড়ি করে মিলির বাসায় গিয়ে দেখা গেল ঘরের মেঝেতে নিথর মিলি পড়ে আছে। নীলার পায়ের আওয়াজ পেয়ে নড়ে উঠল সে।যন্ত্রনায় নীল হয়ে আসা মুখটি দেখে নীলার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল।
“মিলি! এ অবস্থা কিভাবে হল? অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে-” কম্পমান কন্ঠে চিৎকার করে উঠল নীলা।
যন্ত্রনায় দাঁতে দাঁত চেপে মিলি বলল “নীলা, তুই আমার বাচ্চাটাকে বাঁচা। আমার বাচ্চাটাকে আর বাচঁতে দেবেনা ওরা। মারধোর করে আমাকে এখানে ফেলে গেছে ওরা।”
“কিন্তু কিভাবে? এখানে আমি কিভাবে কি করব? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।”
“ওরা আমাকে এই নরক থেকে বেরোতে দেবেনা। তুই আমার বাচ্চাটাকে বাঁচা। আমাকে শুধু একবারের জন্য আমার মেয়েটার মুখ দেখতে দে-” বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল মিলি।
কিন্তু নীলা তখন দিশেহারা। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে নিজের প্রিয় বন্ধুটির এই অসহায় অবস্থা দেখেছে সে। সবেমাত্র ইন্টার্ন ডাক্তার হিসেবে কাজ করছে নীলা। এরকম অবস্থায় কখনো কোন রোগীর সম্মুখীন হয়নি।
মিলির কাতর আর্তনাদে সম্বিত ফিরতেই নীলা বুঝল তাকে চেষ্টা করতেই হবে। আরো বুঝল সময় যতই যাচ্ছে মিলির সাথে সাথে ওর বাচ্চার বেঁচে থাকার ক্ষীণ আশাটাও নিভে যাচ্ছে।
অবশেষে মৃতপ্রায় মায়ের কোলে অর্ধমৃত কন্যাশিশুটিকে তুলে দিতে পারল নীলা। এজন্য অবর্ণনীয় কষ্ট সইতে হল মিলিকে। তবে মেয়ের কপালে একটা চুমু খাওয়ার পর মিলির যন্ত্রনায় নীল হয়ে যাওয়া ঠোঁটে একটু হাসি ফুটল। বলল, “নীলা আমাকে নিয়ে আর ভাবার কিছু নেই, তুই জানিস। তুই আমার বাচ্চাটাকে বাঁচা।”
মিলির মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে বেরিয়ে গেল নীলা।
ভোরের দিকে সে ফোন করল রাসেলকে। রাসেল বাসায় আসার পর ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে নিজের ঘরে রেখে বসার ঘরে এল নীলা। রাসেলকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সে।
“মিলি আর বাচ্চাটাকে ওরা-” কান্নার তোড়ে কথা আটকে গেল নীলার।
“নীলা শান্ত হও। এটা একটা দুর্ঘটনা। আমরা সবাই বাসার বাইরে ছিলাম। ভাবি একা বাসায় ছিল। হঠাৎ হোচঁট খেয়ে পড়ে গিয়ে ভাবির এই অবস্থা।”
নীলা কঠিন কন্ঠে বলল, “তুমি কি বোঝাবার চেষ্টা করছ আমাকে? তুমি ভাল করেই জানো মিলির মেয়েটাকে সেলিম ভাই কখনোই চায়নি। সে সবসময় মেয়েটাকে মেরে ফেলতে চেয়েছে। মেয়েটাকে বাচিয়ে রাখার চেষ্টায় মিলিকে কত কষ্ট কত নির্যাতন সইতে হয়েছে।”
রাসেল এবার কঠিন কন্ঠে বলল, “নীলা, আমি তোমার কষ্ট বুঝতে পারছি। আমি জানি মিলি ভাবি তোমার ছোটবেলার বন্ধু। একে তো ভাবির এই অবস্থা আর তার উপর বাচ্চাটাও মারা গেছে। তুমি তো জানো। কিন্তু তোমাকে মানতে হবে যে এটা ছিল শুধুই একটা দুর্ঘটনা।”
একটু থেমে সে আবার বলল, “অবশ্য মিলি ভাবি খুব জেদী ছিল। সেলিম ভাইয়ার সাথে জেদ দেখানো যে বোকামি তা তার বোঝা উচিত ছিল। যা হোক, ভাবি এখন আই.সি.ইউ তে আছে। ভাইয়া আর আমরা শুধু দোয়া করছি যাতে ভাবি সুস্থ হয়ে ওঠে। ভেবোনা নীলা, ভাবি সুস্থ হয়ে উঠবে। সুস্থ হয়ে উঠে আবার যদি ভাবি কনসিভ করে তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আর এবার হয়ত ভাইয়া ছেলের মুখ দেখবে।”
নীলা আর কোনো কথা বললনা। শুধু ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তার একসময়ের ভালবাসার মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল।
হঠাৎ একজন নার্সকে করিডোর ধরে আসতে দেখে চমকে বাস্তবে ফিরে এল নীলা। এরপর অচেতন মেয়েটির ফ্যাকাসে মুখের দিকে চেয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমি জানি তুই চলে যাবি। চলে যা মিলি-”

“কেদোঁনা নীলামণি” বলল মিলি। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর দৃঢ়পায়ে বেরিয়ে গেল ১৮ বছর বয়সী মিলি। সি.এন.জি দিয়ে কিছুক্ষণ পর এসে থামল বিশাল কঠিন চেহারার একটি বাড়ির সামনে। দারোয়ানকে বলল, “সেলিম সাহেবের সাথে দেখা করতে চাই।” দারোয়ানের উপর কড়া নির্দেশ আছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কাউকে ঢুকতে না দেয়ার। আর সে তার দায়িত্ব পালনে অটল। ঠিক তখনই গেটের কাছে বাগানে চায়ের টেবিলে বসে থাকা এক প্রৌঢ় দারোয়ানকে ডেকে বলল মেয়েটিকে ভেতরে পাঠাতে। লোকটি কেন যেন চমকে উঠেছিল দূর থেকে মেয়েটিকে দেখে।
“আপনি সেলিম সাহেব?”
মানুষটি আবার চমকে উঠল। ভাবল, অবিকল সেই একই কন্ঠ, তবে তাতে নমনীয়তার জায়গায় দৃঢ়তা।
“হ্যাঁ। আমিই সেলিম চৌধুরী।”
“আমি মিলি। আমি আপনার কাছে স্বীকৃ্তি চাইতে আসিনি। আপনাকে মিলির খুনী হিসাবে শাস্তিও দিতে আসিনি। কারণ আপনি মিলিকে খুন করতে পারেননি, শুধুমাত্র কিছু মানুষের মনে নিজের জন্য ঘৃণার জন্ম দিতে পেরেছেন। আর সেই মানুষগুলোর মনে, যারা আপনার একান্ত আপনজন হিসেবে পরিচিত হবার কথা।”
একটু থেমে আবার বলল, “আমি কিছু নিতে আসিনি। কিছু দিতেও নয়। আপনার প্রতি অশেষ ঘৃণা আমাকে এখানে টেনে এনেছে। আমি জানিনা আপনার এতে কিছু আসবে যাবে কিনা। তবুও আমি আমার ধারনা জানিয়ে যাচ্ছি-
একথা বলে মেয়েটি প্রৌঢ়ের পায়ের কাছে ঘৃণাভরে থু থু ফেলে চলে গেল।