সেদিন এক বড় ভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিল। এক সময় কথার প্রসংগ ঈশ্বর বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়ে গিয়ে পৌছায়। উনি জানতেন আমি এসব বিশ্বাস করিনা। হয়তবা ওনার কিঞ্চিত ইচ্ছাও ছিল আমাকে যদি লাইনে আনা যায় তার একটা ক্ষুদ্র চেষ্টা করে দেখা। সত্যি কথা বলতে কি এই ব্যপার গুলো এত বেশি কচলানো হয়েছে বা আমি এত বেশি কচলেছি যে স্বাদ প্রায় তেতোয় গিয়ে ঠেকেছে। যাই হোক, আমি ওনাকে বললাম আমার অবিশ্বাসের বিবর্তন ধারার প্রথম দিকে কারও সাথে কথা বললে, মনে একটা সুপ্ত ইচ্ছা থাকত যাতে করে কথাটা ঈশ্বর সংক্রান্ত ব্যাপার স্যাপার এ গিয়ে পৌছায়, আর বলাই বাহুল্য একগাদা যুক্তিতর্ক হাজির করতাম। কিন্তু এখন হয়েছে এমন যে এই ব্যাপারে পারত পক্ষে কারও সাথে আলোচনা করি না। যদি করি তাহলে শুধুমাত্র একটি প্রশ্ন জানতে চাই।
উনি জিজ্ঞেস করলেন, কি প্রশ্ন?
আমি বললাম, আপনার ঈশ্বরের মধ্যে যদি সামান্যতম মানবিকতা বোধ থাকে তাহলে আমাদের এই ক্ষুদ্র গ্রহে যে পরিমান দারিদ্রতা রয়েছে তা থাকত না। দারিদ্র এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব আমি পরষ্পর স্ববিরোধী বলেই মনে করি।
ভাই বললেন, আমাদের পৃথিবীর জীবনতো শুধু মাত্র একটা পরীক্ষা। তাছাড়া অভাবীদের হিসাব অনেক কম হবে ধনীদের তুলনায়।
আমি বললাম, ভাই, পরকাল আছে কি নাই আপনি কোন প্রমান দেখাতে পারবেন?
উনি বললেন, এটাত সম্পুর্ন বিশ্বাসের ব্যাপার।
আমি বললাম, দারিদ্রতা সম্পুর্নই একটা লৌকিক এবং বাস্তব একটা ব্যাপার। এর বিপরীতে একে সাপোর্ট করার জন্য অলৌকিক এবং বিশ্বাস করতে হবে এমন কোন ব্যাপার মেলানোটা কি অযৌক্তিক হয়ে যাচ্ছে না ভাই?
ভাই নিরুত্তর।
আমি আবার বললাম, আচ্ছা ধরে নিলাম পরকাল বলে কিছু একটা আছে। কিন্তু তারপরেও আপনার কথা আমার কাছে অযৌক্তিক মনে হচ্ছে।
কেন, কেন?
আচ্ছা ধরুন, রহিম খুবই দরিদ্র পরিবারের একটি সন্তান। সে জন্মগ্রহন করেছে একটি চোর পরিবারে। মানে হল এই পরিবারের জীবিকার একমাত্র উপায় হল চৌর্যবৃত্তি। ছোটবেলা থেকেই সে তার বাবা-মার কাছ থেকে এগুলোই শিখেছে। ছোট বেলায় সে এই কাজই করত এবং বড় হয়েও এই কাজই করছে। তবে হ্যা, চোর হলেও সে ঈমানদার চোর। চুরি সে ততটুকুই করে যতটুকু করলে সে ভালভাবে খেয়ে পরে বেচে থাকতে পারবে।
অন্যদিকে করিম সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম হওয়া ধনী ঘরের সন্তান। ধনী ঘরের বিধায় তার ছোট বেলায় কোন কষ্ট করতে হয়নি। বড় হয়ে সে একজন ভাল ডাক্তার হয়েছে। সে বিনামুল্যে গরীব রোগীদের চিকিৎসা করে। তার কোন উচ্চাকাংখা নেই। সে ততটূকুই আয় করে যতটূকু করলে সে ভাল ভাবে বাচতে পারবে। তার পরেও বাবার পাওয়া সম্পত্তি থেকে সে কোটিপতি।
এখন এই দুজন যদি একই দিনে জন্ম এবং মৃত্যু গ্রহন করে তাহলে তাদের ক্ষেত্রে ঈশ্বর কি ধরনের বিচার করবে বলে আপনার মনে হয়?
আপনার দেয়া যুক্তি অনুযায়ী কিন্তু করিমের হিসাব দিয়ে হবে বেশি রহিমের তুলনায়। যার জন্য রহিম কিন্তু করিমের আগে বেহেস্তে যাবে। কেননা করিম রহিমের তুলনায় বিশাল ধনী। যদি তাই হয় করিমের প্রতি কি ঈশ্বর অবিচার করল না?
উনি বললেন, যে যেমন কাজ করবে সে সেরকম বিচার বা আযাবের সম্মুখীন হবে।
আমি বললাম, যদি তাই হয় তাহলে গরীবের হিসাব কম হবে সেকথা বললেন কেন?
– কারন তাদের সহায় সম্পত্তি কম যার জন্য তাদের হিসাবও কম হবে।
আমি হেসে বললাম, আপনি কিন্তু স্ববিরোধী কথা বলছেন ভাই। যদি হিসাবের পরিমান সহায় সম্পত্তির উপর নির্ভর করে তাহলে করিমের হিসাব বেশি হবে, যা যুক্তিবিরুদ্ধ। আর যদি হিসাবের পরিমান নির্ভর করে কে কি করেছে তার উপর তাহলে কিন্তু আপনার প্রথমে দেয়া যুক্তি মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে। আর যদি এমন হয় যে, হিসাবের পরিমান নির্ভর করে উভয়ের উপর তাহলে কিন্তু রহিম এবং করিম সমান হয়ে যাচ্ছে। কেননা রহিমের সম্পত্তি নেই কিন্তু সে পাপ করেছে, অন্যদিকে করিম পাপ করে নি কিন্তু বিশাল সম্পত্তির মালিক। এখন আপনিই বলেন কোনটা হবে।
ভাইকে একটু হতভম্ব দেখাল। তারপরে বললেন, কি করবেন আল্লাহই ভাল জানেন।
আমি তখন বললাম, তারমানে হল তার গাইড লাইন কোরান তিনি হুদাই পাঠাইছেন অথবা উনি একজন একনায়ক যিনি কিনা যা ইচ্ছা তাই করেন।
ভাই এই কথায় রাজী নন। কোরান শুধু শুধু পাঠাবেন কেন, আর তিনি একানায়কই বা হবেন কেন?
আমি বললাম, আপনারা মুসলমানরা কোরান শরীফ পড়তে পড়তে ফূটা করে ফেললেন কিন্তু এটাই বলতে পারছেন না যে কার হিসাব মৃত্যুর পরে কেমন হবে। তো কোরআন কি শুধুশুধুই নাজিল করা হল না? আর আল্লাহ যদি যুক্তিতর্ক বাদ রেখে সব নিজের ইচ্ছায় করে তাহলে সে একনায়ক হয়ে গেল না?
উত্তর নাই।
আমি আবার বললাম, আপনি কিছুক্ষন আগে বললেন, পৃথিবীর জীবন নাকি একটা পরীক্ষা।
– হ্যা
বললাম, পরীক্ষাটা কার? আল্লাহর নাকি আমাদের?
ভাই কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলল, আমাদের। ( মনে হয় ধরতে পারতেছিল না গুল্লিডা কুনহান দিয়া আইব)
আমি বললাম, আচ্ছা আমরা যে ক্লাসে পরীক্ষা দেই সেখানে পরীক্ষা নেন কারা? শিক্ষকরা। কেন নেন?
দেখেন যে তাদের দেয়া পড়া আমরা ঠিকভাবে আত্নস্থ করতে পেরেছি কিনা? তাই ত?
– হুম। ভাই চিন্তিত।
এবার আমি বললাম, আল্লাহ যে আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছে, উনি আসলে কি জানতে চাচ্ছে?
ভাই বলল, আমরা কি তার দেয়া আদেশ মানছি কিনা।
বললাম, তার মানে হল আমরা কি করব আল্লাহ আসলে জানে না, যার জন্য এত বড় আয়োজন করে পৃথিবী বানিয়ে আমাদের পাঠিয়েছেন।
উনি মাথা ডানে বায়ে ঝাকাতে ঝাকাতে প্রায় ছিড়ে ফেলার উপক্রম করে বললেন, জানবে না কেন? অবশ্যই জানে।
আমি বললাম, যদি জানে তাহলে পরীক্ষার কারন কি?
ভাইয়ের মুখে কথা নাই।
এই সময়ে হঠাৎ করে ভায়ের একটা জরুরী কাজের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি আমাকে আবারও কথা বলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে গেলেন। ভাই শেষ কোন উত্তর দেন নাই। তো কি হইছে, আমার সাথে একমতও হন নাই।
আরেকটা জবাব হল মানুষ নিজে কি করেছে সেটা জানানো জন্য। যখন কেয়ামতের ময়দানে মানুষ যখন তার হিসেবের খাতা পেয়ে যাবে। তখন সে নিজেই নিরুত্তর হয়ে যাবে। এখানে রহিম যদি আল্লাহর বিধান জেনে চুরি করা থেকে বিরত থাকত। তাহলে করিমের আগে সে জান্নাতে যেত। যেখানে করিম তার অর্থের যথাযথ হিসেব দিতে থাকত। আল্লাহর এ পরীক্ষা আল্লাহর জানার জন্য নয়। মানুষকে জানিয়ে দেয়ার জন্য যে তাকে কি করতে বলা হয়েছে এবং সে কি করেছে।
ধর্মীয় দর্শনের অন্যত্ম ফাঁক হল; শুরুটা হয় বেশ জম্পেশ ভাবে। তবে যুক্তির কঠিন প্রশ্নের জবাবে একসময় না একসময় বিশ্বাসের দ্বারস্থ হতেই হয়।
তবে পরকালের বিচারের ব্যাপারটা আমি অনেকটা এভাবে বুঝি; ধরা যাক কোন বছর পরীক্ষার প্রশ্ন সহজ হল, তখন শিক্ষকেরা নম্বর দেবার বেলায় কড়াকড়ি করবেন বেশী, পাশের ন্যূনতম নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হবে। আবার কোন বছর প্রশ্ন হল কঠিন, তখন শিক্ষকেরা কঠিন চোখে খাতা দেখবেন, প্রতি প্রশ্নেই পার্শিয়াল মার্কিং করে চেষ্টা করবেন নম্বর বাড়িয়ে দিতে, ন্যূনতম পাশ নম্বরও হয়ত কমিয়ে দেওয়া হবে।
তবে কার জন্য প্রশ্ন কঠিন আর কার জন্য সহজ তা কিসের ভিত্তিতে হয় জিজ্ঞাসা করলে সেই বিশ্বাসেরই দ্বারস্থ হতে হবে।
আর রহিম যদি অমুসলিম কোনো পরিবারে জন্ম লাভ করায় অমুসলিম হত তবে নির্ঘাত তার জন্য অনন্ত দোজখ!!!!!
@সৈকত চৌধুরী,
সে আর বলতে। :laugh: