কান টানলে মাথা আসার মতোই জনশিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও সংস্কৃতির বিষয়ে আলাচনা করতে গেলে আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিও চলে আসে। উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতির বিষয়টি এমনই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অন্যদিকে একটি অন্যটির পরিপূরকও বটে। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় বিশ্ব-বানিজ্য সংস্থার কর্মকর্তারা বিশ্বায়ন তথা মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে যে আগ্রাসন, দখলদারিত্ব ও নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে এবং যা আরও সুসংহত করতে চাইছে তারই পরিপূরক হিসাবে শিক্ষা, স্বাস্থ ও সংস্কৃতিতে প্রয়োজনীয় রদবদল ঘটাচ্ছে। শিক্ষাকে কেনা-বেচা যোগ্য পণ্যে রূপান্তর করন বা শিক্ষাখাতে যে বানিজ্যিকী করনের চেষ্টা চলছে তাও কিন্তু বিশ্ববানিজ্যসংস্থা কর্তৃক প্রণীত গ্যাটস চুক্তি সাক্ষরেরই ফল। এই গ্যাটস (GATS )কথাটার মানে হলো জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড ইন সার্ভিসেস। অর্থাৎ জনশিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য এর মত সেবাখাতসমূহকেও ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানী/সংস্থা/নিগমদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। মুনাফা শিকারী এসব নিগমরাই ঠিক করবেন কী পণ্য তারা কী দামে কার নিকট বিক্রি করবেন। দেশ-সমাজ-রাষ্ট্রের যেন এখানে করার কিছুই নেই। শিক্ষার উদ্দেশ্য কী? কী শিখলে কী হয়? পাঠক্রম কোন্ স্তরে (প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর) কী থাকবে তা কে নির্দ্ধারণ করবে? কারণ এর উপর মানব শিশুর সুস্থ মানস গড়ে উঠা অনেকটাই নির্ভর করে। বা আমরা বলতে পারি কেমন ধরনের সমাজ আমরা আগামী দিনগুলোতে দেখতে চাই তা অর্থাৎ আমাদের সন্তানেরা কেমন ধরনের মানুষ হিসাবে বেড়ে উটবে তার অনেকটাই যা এই শিক্ষাক্রম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
আর্থ-সামাজিক তথা উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে জটিল শ্রেণী বৈষম্য ব্যবস্থা বিদ্যমান তার জন্য দায়ী শাসক শ্রেণীর মুনাফামুখীনতা। এই মুনাফা মুখীনতাই আজ শাসন/বারণ করছে মানবতাকে। মুনাফার নিকট মানবতা আজ তাই পদদলিত/ভূলুন্ঠিত। মিথ্যাবলে, চুরি করে, অন্যায় করে ধরা পড়লে লজ্জিত হওয়া, অনুতপ্ত হওয়া, ক্ষমা চাওয়াতো দূরের কথা, উল্টো তাকে সত্য প্রমাণ করতে বা বৈধতা দিতে চেষ্টা করে। মুনাফার এই লোভ মানুষকে সত্য বলা থেকে বিরত রাখে ও মিথ্যা বলতে উৎসাহিত করে। আর এই মিথ্যা বলা একের প্রতি অপরের অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা তৈরী করে। অবিশ্বাস, আস্থাহীনতায় ভালবাসার সম্পর্ক তৈরী হয়না, স্থায়ী হয়না, টিকে না, টিকতে পারে না। বরঞ্চ বিপরীতটা হয়, মিথ্যা অবিশ্বাসের আর অবিশ্বাস ঘৃণার সৃষ্টি করে। ঘৃণা এক সময় হিংস্রতায় পর্যবসিত হয়। মুনাফার এই লোভ মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলিকে নষ্ট করে দেয়, সত্য-বিশ্বাস-ভালবাসা-সুন্দর-ন্যায়-সাম্য তখন মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। মানুষ তখন অনিশ্চয়তা, ভয়, দুশ্চিন্তা ও আতংকের মধ্যে দূর্বিষহ জীবন যাপন করে; যা আজকের দিনে আমরা করছি।
সমাজ কল্যাণ, মানব কল্যাণ এর মত শব্দ-নাম-মান-ব্যানার ও আজকাল ব্যবহৃত হয় কোন ব্যবসায়িক স্বার্থে বা উদ্দেশ্যে। রাজনীতি এখন তাই নিগমদের জন-সংযোগ কর্মকর্তার ভাষ্য/বিবৃতি। সমাজের বিভিন্ন স্তরের শ্রেণী, পেশার লোকজনের সাথে কথা বলে ও অনেক নামী-দামী-সফল ব্যক্তিত্বের কার্য্যকলাপ পর্যবেক্ষন করে আমার এই ধারণা দৃঢ়মূল হয়েছে যে, এভাবে চলতে থাকলে, সচেতন না হলে, সুস্থভাবে সম্মানের সঙ্গে বাঁচাতো দূরের কথা অচিরেই আমরা জীবন সংহারী সঙ্কটের আরও গভীরে তলিয়ে যাব। ধ্বংসের এই কিনারায় পৌঁছতে বিগত কয়েক দশকের শিক্ষন-প্রশিক্ষনের স্বরূপটি বর্তমান নিবন্ধে খতিয়ে দেখব যে সমাজ মানসে এর কী প্রভাব পড়েছে। সামান্য একটা দৃষ্টটান্ত দিলেই এটি বুঝতে সহজ হবে। যেমন আমাদের দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরাই চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়। জনগণের করের টাকায় লেখাপড়া শেষ করে তারা যখন ডাক্তার বা প্রকৌশলী হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন তখন উনারা কী করেন? ডাক্তার সাহেবরা আজ আর শুধু চিকিৎসা ফি/ সরকারী বেতনে সন্তুষ্ট থাকেন না। নির্দ্দিষ্ট ফি/বেতনে সঠিক পরামর্শটি দেন না। বিভিন্ন টেষ্ট ল্যাবে পাঠিয়ে প্রয়েজনীয় /অপ্রয়োজনীয় টেষ্ট করিয়ে ৪০-৬০% কমিশন নেন। স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব এমন গর্ভবতীদের অপারেশন লাগবে বলে বাড়তি হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও অনেকের বিরুদ্ধে পাওয়া যায়। তাছাড়া নিম্ন মানের ঔষধ প্রেস্ক্রাইব করার লোভনীয় সন্মানীতো আছেই। মেধাবীদের অপর অংশ যারা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে প্রকৌশলী হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেছেন তাদের কী অবস্থা? উনারা এখন আর ঘুষ নেন না, নেন পার্সেন্টেজ। সেরা মেধাবীদের এই রকম শোচনীয় পরিণতির জন্য আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা কি কোনভাবে দায়ী?
বর্তমানে আমাদের দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে তার সূচনা করেছিল ঔপনিবেশিক অমলের ব্রিটিশ সরকার। বেনিয়া ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বানিজ্য করতে এসে দখল করে নেয় শাসন ক্ষমতা, যুক্ত হয় ব্রিটিশ রাজশক্তি। তাদের শোষণ-লুটপাট, অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিদ্রোহ দমনের জন্য যে শাসন ব্যবস্থা তারা কায়েম করে তার জন্যে প্রয়োজন হয় কিছু ইংরেজী জানা দেশী সহযোগী। যার জন্য এই শিক্ষা ব্যবস্থা, উদ্দেশ্য রক্ত-মাংসে এরা ভারতীয় থাকবে বটে তবে চিন্তা চেতনায় হবে ব্রিটিশ তথা ব্রিটিশের স্বার্থ রক্ষাকারী। প্রচারে ছিল বর্বর ভারতীয়দের শিক্ষিত-সভ্য করে তোলার জন্যই মহানুভব ব্রিটিশদের এখানে আগমন । ডান্ডা-কামান-বন্দুক-পুলিশ দিয়ে শাসন করার থেকেও মারাত্মক ছিলো প্রচারিত এই তত্ত্ব (ভারতীয়রা বর্বর আর ব্রিটিশরা সভ্য)। যার প্রভাব আমরা দেখি বরেণ্য সাহিত্যিক বঙ্কিম –রবীন্দ্রনাথদের উপর এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব গান্ধী –জিন্নাহর উপরও । জনগণ চায় শোষণ বঞ্চণা থেকে মুক্তি আর তারা চায় স্বরাজ। যদিও এই দর্শন তত্ত্ব বলয়ের বাইরেও অনেকেই ছিলেন, যাদের অনেকে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন দেশের জনগণের প্রকৃত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য। এই শিক্ষা যে তারা ব্রিটিশ প্রণীত শিক্ষা ব্যবস্থায় পাননি সেকথা বলা এখানে বাহুল্য।
তবে মূল ধারাতে এটিই ছিলো। যেমন বাল্যশিক্ষা বইয়ে বর্ণ পরিচয় ও নানা নীতিকথা শিখানোর পর শেষ পৃষ্টায় ফুল বাগান সমৃদ্ধ একটি বাড়ীর ছবি দেখিয়ে ছেলে মাকে প্রশ্ন করছে, মা ঐ বাড়ীটি কার? মায়ের উত্তর ঐ বাড়ীটি জগদীশ বাবুর। তার পিতা বড়ই দুঃখী (গরীব)ছিলেন। কিন্তু জগদীশ বাবু লেখাপড়া শিখে এখন অনেক বড়লোক (ধনী)হয়েছেন, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ছেন। যা পরবর্তিতে দার্শনিক তত্ত্ব হিসাবে দাঁড়ায় যে ‘লেখাপড়া শিখে যে গাড়ী ঘোড়ায় চড়ে সে’। শিশু-কিশোরদের কচি মনে এই দর্শনের প্রভাব পড়ে কাঁদা-মাটিতে ছাপ পড়ার মতো। বড়লোক হওয়ার অকাঙ্খাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে তার জীবন ও চিন্তা ভাবনা। কর্ম বিমুখ আয়েশী জীবনের লোভ গেঁথে দেয়া হলো তার জীবনের শুরুতেই। ব্রিটিশ চলে গেল, স্বাধীন পাকিস্তান হলো। পরবর্তিতে ইষ্ট পাকিস্তান টেক্সট বুক বোর্ড প্রণয়ন করে সবুজ সাথী বা আমার সাথী নামের প্রাথমিক পাঠের গন্থ। যাতে একটি গল্প ছিলো এমন ‘টুনাটুনির গল্প’ – টুনা কহিল টুনিরে পিঠা তৈরী কর। টুনি কহিল তবেতো চাউল, গুড়, কাঠ, অগুন, পানি এনে দাও, তবেতো পিঠা তৈরী হবে। তখন কুকুর, বিড়াল, শেয়াল, কাক সকলেই এলো, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকলে মিলে সংগ্রহ করলো। দিনশেষে সবাইকে পিঠা খাইতে আসার জন্য বলা হলো। সেই অনুসারে সকলে ভাগের পিঠা খেতে এসে দেখে টুনাটুনি লাপাত্তা। অনেক ডাকাডাকির পরও টুনাটনিকে না পেয়ে তারা সকলে ফেরৎ যেতে লাগলো। সকলে চলে যাওয়ার পর গাছের মগডাল থেকে টুনাটুনি খুশিতে টুনটুন করে উঠলো। গল্প শেষ, এখানে আমার প্রশ্ন এই খুশি, কিসের খুশি? ভাগিদার সকলকে বঞ্চিত করার খুশি! প্রতারণা করার খুশি! অন্যকে ঠকিয়ে আত্মসাৎ করার খুশি। এই গল্প পড়ে কোন শিশু যদি তার বাবার আনা দই, কাকার আনা মিষ্টি, মামার আনা চকলেটের ভাগ ঘরে আরও যে ভাইবোন, মা, দাদী, কাকী, নানি আছেন তাদেরকে না দিয়ে একা একাই খেতে চায়, তাহ’লে তাকে কি খুব একটা দোষ দেয়া যায়? স্বার্থপর, লোভী, প্রতারক, মায়া মমতাহীণ, নিষ্ঠুর মানসিকতার বীজ ঐ শিশুটির কচি মনে বপন হয়ে গেল না কি?
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় গলদের যে ইতিহাস এখানেই তার শেষ নয়। তারপর ঐ শিশুটি যখন কিশোর তখন তাকে অংক কষে লাভ-ক্ষতি শেখানো হলো। গোয়ালা ১কেজি দুধে কি পরিমানে পানি মিশিয়ে সমান দামে বিক্রি করেও এতটাকা লাভ হয়। বা সুদ কষার নিয়ম। পরবর্তিতে একজন এই তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তি সে ডাক্তার ইঞ্জিনীয়ার শিক্ষক সাংবাদিক যা ই হউক না কেন, স্বার্থপরতার, লোক ঠকানোর এই মূল মন্ত্র সে কিছুতেই ভুলতে পারে না বা বাদ দিয়ে সমাজের বেশীরভাগ মানুষের সাথে নিজের স্বার্থকে সম্পৃক্ত করতে পারে না। এরসাথে আবার যুক্ত হয় সমাজের প্রচলিত অন্ধ বিশ্বাস জাতীয় নিয়তি নির্ভর ধারণা সমূহ। সমষ্টির স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যক্তি স্বার্থপরতার যে শিক্ষা জীবনের পরতে পরতে শেখানো হয় তা ই আজ আমাদেরকে বিগত কয়েক বৎসর যাবৎ ক্রমাগতভাবে দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানের কলঙ্ক তিলক জুটিয়ে দিযেছে। আমার ধারণা পাঠকগণ একমত হবেন যে এদেশের সাধারণ মানুষ, বেশীরভাগ মানুষ, ক্ষেত-খামারে, কল-কারখানায় কাজ করা লেখা-পড়া না জানা শ্রমজীবী মানুষ কেউই এর জন্য দায়ী নয়। এরজন্য দায়ী আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তিরাই যারা সমাজের মাথা, দেশের তকমাধারী বড় বড় মানুষ, যারা আবার রাষ্ট্রেরও বড় বড় চেয়ারগুলো দখল করে রেখেছেন। তারা যে শুধু জনগণের ভাগ মেরে দিয়ে সম্পদ কুক্ষিগত করেছেন তাই নয় তারা জনগনের বিরুদ্ধে হন্তারকের ভূমিকায়ও নেমেছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য বড় ঘটনাগুলি হলো, নারায়নগঞ্জের গার্মেন্টস শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা আদায়ের দাবীতে আন্দোলনরতদের হত্যা, রাজশাহী কানসাটের কৃষকদের সেচের পাম্পে জরুরী বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবী নিয়ে আন্দোলনরতদের হত্যা, এশিয়া এনার্জির খোলামুখ কয়লা উত্তোলনের বিরুদ্ধে ফুলবাড়ির জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলনে গুলি বর্ষণ।
এসব হত্যাকান্ডের হুকুমদাতারা কোন ব্রিটিশ বা পাকিস্তানী পুলিশ ছিল না; ছিল এদেশেরই কোন মহাবিদ্যালয়/বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা তথা কথিত শিক্ষিত মানুষ। তাহ’লে কোন্ সে শিক্ষা যাতে তারা এমন হিংস্র পশু বনে গেল। বা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটিগুলোই বা কী? সে প্রশ্ন তোলা ও তার কারণ অনুসন্ধান কি আজ জরুরী নয়? শিক্ষার উদ্দেশ্য কি শুধুই সার্টিফিকেট অর্জন যার লক্ষ্য একটা চাকুরী বা টাকা রোজগার। সত্য, সুন্দর ও সাম্যসমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনাটা কি জরুরী নয়? বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন যৌক্তিক মানুষ তৈরীইতো শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। না কী কেঁচোর মতো অন্ধ কালা বোবা মেরুদন্ডহীণ প্রাণী? প্রচলিত অন্ধ বিশ্বাসের অন্ধকার থেকে মুক্তির আলো দেখানোই কি শিক্ষার উদ্দেশ্য নয়? বিবিএ, এমবিএ, কম্পিউটার সাইন্স পড়ে ডিজিটাল ডিভাইড তৈরী করবে; কর্পোরেট পুজিঁর মুনাফা অর্জনের নাট-বল্টু হবে। কর্পোরেট পুজিঁওয়ালা আধিপত্যবাদীরা তাদের হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্ট পূর্ণ করতে চায় এসব শিক্ষায় শিক্ষিত মানব সন্তান (সম্পদ) দিয়ে। তা সেই যোগান তারাই দিক তাদের প্রতিষ্ঠিত প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে। কিন্তু জনগণের করের টাকায় প্রতিষ্ঠিত পাবলিক বিদ্যালয়/বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কেন জনগণের মুক্তির আকাঙ্খাকে বাস্তব রূপ দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবে না!
যে বিধি ব্যবস্থার মারপ্যাঁচে ফেলে উৎপাদক কৃষক-শ্রমিকের পাতের ভাত কেড়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে নিয়ে আসা হয়, পরিবার পরিজন নিয়ে অভুক্ত থাকতে বাধ্য করা হয়, সেই বিধি ব্যবস্থার খোল-নলচে সহ বদলে ফেলার শিক্ষা কি আমরা চালু করতে পারি না? পারি কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থার কিছু সুবিধাভোগী মানুষের জন্য তা করা যাচ্ছেনা। এই সুবিধাভোগীদের দলে আমাদের অনেক শিক্ষকও আছেন যারা শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করতে শেখাবেন তো দূর, উল্টো কেউ প্রশ্ন করলে তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন বা অপমানজনক কথা বলে নিরুৎসাহিত করেন। তাদেরকে বলে দেয়া হয় এসব প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব (বিবর্তন তত্ত্ব) বিশ্বাস করার দরকার নেই। এগুলো কোন ব্যক্তির মতামত, না মানলেও কোন অসুবিধা নেই; তাই ক্লাসের বাইরে বাস্তব জীবনে কোন তত্ত্বের সঙ্গে যদি ধর্মীয় ব্যাখ্যার কোন বৈপরীত্ব পরিলক্ষিত হয় তথাপিও না। তাহলে এত এত পাশ দিয়ে কী পড়লাম আর কী বুঝলাম, সাত খন্ড রামায়ন পড়ে সীতা কার বাপ? শুধু কিছু শিক্ষককে দায়ী করে এ অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়। এজন্য শিক্ষানীতিরই পরিবর্তন ঘটাতে হবে, যে কাজ কেবল রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব। রাষ্ট্রের কর্তরা যে অধিপতি শ্রেণিটির স্বার্থ রক্ষা করে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আংগুলি হেলনে উঠবস করে তারা তাদের কায়েমী স্বার্থে তা কখনো করবে না। বরং উল্টোটা করবে যা গত বৎসর এডিবির অর্থায়নে তারা করতে চেয়েছিল; এবং আজও তা বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে। নয়া বিশ্ব বিধান (নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার) যারা স্থাপন করতে চায়, ২১ শতককে যারা আমেরিকান শতক বানাতে চায়, চলতি এ শিক্ষা ব্যবস্থা তারই পরিপূরক। তবে আমাদের সন্মানিত শিক্ষকবৃন্দ ছাত্রদেরকে মুক্ত চিন্তার, বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী মানুষ হতে, স্বার্থপরতার অন্ধগলি থেকে বের করে সমষ্টির কল্যাণের চেতনায় উদ্ভূদ্ধ করতে পারেন। কারণ আমাদের একথা বুঝতে হবে যে এডিবি কারা এবং এরা কাদের স্বার্থের রক্ষক। তাদের লক্ষ্য হলো র্কপোরেট পুজিঁর স্বার্থকে রক্ষা করা, জনগণকে সচেতন বা শিক্ষিত করে তোলা নয়। নীতি আদর্শে, স্বাস্থ্য সচেতনতায় বলিষ্ঠ মানুষ তৈরী হলে বরংচ তাদের ভয় আছে।
ছাত্ররাজনীতি খুব খারাপ,তাই ছাত্ররা রাজনীতি করতে পারবে না। উৎপাদন ব্যাহত হবে তাই শ্রমিকরাও রাজনীতি করতে পারবে না। বাদবাকী সাধারণ মানুষের তো নুন আনতে পানতা ফুরায় তাদের রাজনীতি করার সময় কোথায়? এভাবে নিঃরাজনীতিকরন হলো বিশ্বাধিপতি শ্রেণিটির এজেন্ডা। এডিবির অর্থায়নে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রণেতারা তাই দেখা যায় শিক্ষা ব্যবস্থা পরিদর্শনে পৃথিবীর অনেক দেশ চষে ফেললেও কিউবা নামক দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ সেখান থেকে বাদ পড়ে যায়, যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সমৃদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।
চলবে