বাবা এমন হঠাৎ করে চলে যাবে তা কল্পনার বাইরে ছিল।তিনি যে আমার অস্তিত্ব এ বিষয়টা চলে যাবার পরে টের পেলাম। সেইদিন ফোন পেয়ে বিরক্ত হয়েছিলাম। কী হয়েছে বাসায়? পরক্ষনেই মনে হল মা হুট-হাট ফোন করেননা কখনও। পারতঃপক্ষে আমাকে ফোনই করে না। তাৎক্ষনিক বলি,
-মা আমি আসছি।
হঠাৎ ব্যস্ততা দেখে কিংশুক বিস্মিত হল। আমার চোখের পাতা শুকনো। কিন্তু, কোথায় যেনো বুকের মাঝে দ্রিম-দ্রিম শব্দ হচ্ছে। কিংশুকের কথার জবাব না দিয়ে বলি,
-বাচ্চাটাকে আজ তুমি রিকশা দিয়ে স্কুলে নিয়ে যাও। গাড়ি নিয়ে গেলাম।
অবিশাস্য ঘটনা! ঘোরের মাঝে গাড়ি নিয়ে ছুটে চললাম বাবার বাড়ি। রাস্তায় জ্যাম ঠেলে যেতে যেতে মোবাইলে ফোন করলাম মেজ ভাইকে,ছোট বোনকে,মেজ বোনকে। সবাই কাঁদছে। ভেবে পাইনা কাঁদছে কেনো? বাবা হয়তো বেশি শরীর খারাপ করেছে। মা ঘাবরে গিয়েছে। অসহিষ্ণূ হয়ে ড্রাইভাকে বললাম,

-আর একটু জোরে গাড়ি চালানো যায়না?

ড্রাইভার কি বুঝল কে জানে।সে ট্রাফিক জ্যামের মাঝেও ফাক-ফোকড় খুঁজতে লাগল। আসলে এই সময়টা ঢাকা শহরের সব চাইতে ব্যস্ততম সময়। মানুষজন অফিস ,ব্যাবসায়ি, স্কুলে যাওয়া অথবা মর্নিং শিফটের ছাত্র-ছাত্রীদের ফেরত আসা। এক বিশাল হুলুস্থুল অবস্থা চলে।

আজকের রাস্তা খুব দীর্ঘ মনে হচ্ছে। বাবা তো এই সে দিনও বললেন যখন আমি কোলকাতা যাবার আগে দেখা করতে গেলাম। সালাম করে বিদায় নিতে নিচ্ছি,
-তুমি ফিরে এসে আমাকে ভিসা করে দিও।

–আচ্ছা আপনি চিন্তা করবেন না। ফিরে এসেই ভিসা করে দিব। কিন্ত,আব্বা একলা যাবেন না দেশে। আমিই নিয়ে যাবো।

স্মিত হাসল। বেশ ক’বছর ধরে বাবা কেনো জানিনা খুব দেশে আসা যাওয়া করে। মাটির বাড়ি পাকা করেছে।বাথরুম পাকা করেছে। আগে দেশে বন্যা হতনা,ইদানিং বন্যা হচ্ছে। তবে বাড়িটা নাকি সুন্দরই করেছে। সেই বাড়িতে নিজের ভাগ্নী কে তার পরিবার সহ থাকতে দিয়েছে।
প্রায়শঃ দেখা যায় গ্রামের আত্মীয়-স্বজনের আনাগোনা। আমাদের বিরক্তি দেখে একদিন আমাদের নিয়ে বসল।
-জানি তোমরা বিরক্ত হও।কিন্তু মাটির টান অগ্রাহ্য করতে পারিনা।ওরা অনেক অনটনে থাকে। যদি আমার দ্বারা কিছু করা সম্ভব হয় তাই চেষ্টা করি। আর এই গ্রামের বাড়ি তোমাদের আদি পরিচয়। যদি পরের প্রজন্ম তাদের ভিটে বাড়ি দেখতে চায় সে ব্যাবস্থাই করে যাচ্ছি।

এই পর্যন্ত। আর কোনদিন কিছু জিজ্ঞেস করিনি, বাবাও কিছু বলেনি। তবে শুনেছি গ্রামে বাবার সাহায্য নেয়নি এমন মানুষ কমই আছে। বাবার বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়- আছে সবাই যে অনটনে ছিল তা নয়। অনেকে বাবাকে ঠকিয়েও টাকা নিয়েছে।

সময় আয়নার মত, নদীর মত বহতা। কিছু কিছু ছবি স্থির হয়ে থাকে সব সময়।

মফস্বল শহরে ঘু-ঘু ডাকা দুপুরে আমি ছোট ছোট হাড়ি পাতিল দিয়ে খেলতাম। কাছে বাবার অফিস। বাড়ির প্রায় লাগোয়া। ইঁট দিয়ে চুলো বানিয়ে দিতেন মা। তাই দিয়ে খড়ি জ্বালিয়ে নাকানি চুবানি খেয়ে একরকম আধা সেদ্ধ পায়েস রান্না করতাম। বাবাকে খেতে দিলে অম্লান বদনে তা খেতেন। খুশি হয়ে বলত,
-বাহ বাহ দারুণ মজা হয়েছে তো?
এমন দুপুরে বাবা খেয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে। চুপিচুপি সঙ্গীদের নিয়ে পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি করছি কতক্ষণ মনে নেই। হঠাৎ দেখি বাবা সামনে। পড়ি মরি করে দে ছুট।

ক”দিন ধরে একটা দাঁত তখন নড়বড় করছিল। বাবা আমাকে নিয়ে মানিক ডাক্তারের কাছে যাবে। মানিক ডাক্তার আমাদের পাড়াতেই থাকত। গোঁ ধরেছি যাবনা ডাক্তারের কাছে। বাবা আমাকে ধরার জন্য পাড়াময় ছুটোছুটি করল। অবশেষে খপ করে হাত ধরে বলে,
-একটুও ব্যাথা লাগবে না, দেখো।
ডাক্তারের কাছে যেতেই উনি বলল,
-দেখি মামনি হাঁ করো দাঁত দেখি। আমি দাঁত তুলবনা। মুখ চেপে বন্ধ করে আছি।তাঁর আশ্বাসে হাঁ করলাম।
-এই দাঁত? ঐ দাঁত? নাহ কোন দাঁতের সমস্যা তো দেখছিনা। মুখ বন্ধ কর।
চোখ খুলে দেখি,এক হাতে সূতোর মাঝে বাঁধা আমার দাঁত।কখন তুলেছে টেরই পাইনি।

গাড়ি কখন বাবার বাড়ি পৌঁছে গিয়েছি বুঝতে পারলাম না। আস্তে আস্তে দো’তালায় উঠলাম।মা বসে আছে শুন্য চোখে বসার ঘরে। বুকটা ধড়াস করে উঠল।তাঁর চোখে জল নেই।
কি আশ্চর্য!
আসলেই বাবা নেই।বাবা শুয়ে আছে।কি প্রশান্তিতে ভরা মুখখানি।
মানুষের জীবনে বাবা মায়ের আয়ু চিরস্থায়ী নয় কারো। বাবা, মা চিরকাল থাকাও স্বাস্থ্যকর নয়। মন সে যুক্তি মানেনা। কথা দিয়েছিলাম বাবাকে ভিসা করে দেশে নিয়ে যাব। শিশুর মতন অসহায় হয়ে উঠলাম। বাবাকে আঁকড়ে ধরলাম। শরীরে তখনও উত্তাপ আছে।

এরপরে অনেক কিছুই মনে নেই। কত মানুষ! এতো মানুষ কোথা থেকে এলো? মানুষের স্রোত বয়ে যেতে লাগল। বেশির ভাগই দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন, পাড়ার গরিব যারা বাবার কাছ থেকে নানা ভাবে সাহায্য পেত। তাদের বুক চাপড়ে কাঁদতে দেখেছি।

বাবাকে আঁকড়ে ধরে আছি তখনও। মেজ বোন চাকরি সূত্রে দূরে। ওর কি অবস্থা জানিনা। কারা যেনো আমাকে জোর করে টেনে ছিনিয়ে নিল বাবার কাছ থেকে। বলি,
-আব্বাজান কে এতো রোদে নিও না। বাবার কষ্ট হবে। বাবা যে তার নিজের বাড়ি খুব ভালোবাসেন। মেজ ভাই কাঁদতে কাঁদতে বলে,

-না আব্বাজানের কষ্ট হবেনা। মেজো ভাই কখন এলো? বাবাকে নিয়ে গেলো নিচে। আমাকে কোনদিন আর পুশচি বলে ডাকবে না। বড় ভাই বলেছিল আমি নাকি ছোট বেলায় অনেক বক-বক করতাম।তাই নাম দিয়েছিলেন বুলবুলি।
এরপরে অনেক কিছুই জানিনা। শুধু জানলাম, বাবা নেই,কোথাও নেই।

অনেক পরে বড় ভাইকে ফোন করা হল। কতোদিন দেখিনা ভাইকে। বড়ভাই ঘনঘন ফোন করল। আমাকে কোলে পিঠে মানুষ করা ভাইএর অবস্থা সেই সুদূর বিদেশে তখন কেমন কে জানে। কে তাকেই বা দুটো সান্তনার কথা বলবে। কে চোখের জল মুছিয়ে দেবে?
এমন করেই বাবা চলে গেলেন। মনে হল অনেক অনেক অভিমান নিয়ে চলে গেল।

চারদিন পর বাসায় ফিরে এলাম। বাসায় ফিরে কেমন অস্থিরঅস্থির লাগে। উদ্ভ্রান্তের মতদিন কাটতে লাগল।স্পষ্ট বুঝতে পারছি পারবারিক পরিবেশকে বিঘ্নিত করছি। বাসায় ফিরে একদিনই ডুকরে কেঁদেছি।এরপরে চুপ হয়ে গেলাম। বেছে নিলাম নিভৃত কোন। বাবার সাথে আমার চুপে-চুপে কথা শুরু হতে লাগল ডাইরি আর কলম দিয়ে। লিখে লুকিয়ে রাখতে লাগলাম এই বেদনাকে। আমার চোখে দারূণ সমস্যা হল। ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন কোনো ধরণের আঘাত লেগেছিল কিনা। আমার চোখের শিরা ছিড়ে গিয়েছিল। কী করে বলি ডাক্তারকে আমার আঘাত আসলে কোথায়।

অনেক চিকিৎসা করান হল। লাভ হলনা কিছুতেই। কোলকাতা পর্যন্ত গেলাম। সব ব্যর্থ।
এক-একদিন যন্ত্রনায় ছট-ফট করছি। বাবাগো –মাগো করে। আমার স্বামী কি করে এক ডাক্তারের সন্ধান পেল। অপারেশন করে অলৌকিক ভাবে ঠিক হল চোখ। রোজ রাতে জেগে উঠতাম যন্ত্রনায়। কী যন্রনা কাউকে বোঝাতে পারতাম না।

বাবা চলে গিয়েছিল ঠিক।কিন্তু যাবার সময় ঘুমটুকু কেড়ে নিয়ে গিয়েছে।

২ পর্ব

বিবাহিত জীবনটা বড্ড সুখের ছিল। ভাবতাম এমনই যাবে সারাটা জীবন। লেখাগুলো ইন্টারনেট এ দিতাম। সবাই বাহবা করত। লুকিয়ে রেখেছিলাম কষ্টময় স্মৃতিকে। এক সময় ওরা কিছু কবিতা ছাপালো, প্রবন্ধ ছাপালো। ইন্টারনেট জগতে আমার বেশ চাহিদা বেড়ে গেল। নিজকে লেখক ভাবতে কুন্ঠা বোধ করতাম। আবার মনে মনে স্বপ্নের জাল বুনতে লাগলাম। আমারও একদিন নাম হবে। আমি কী বোকা!
ছেলেবেলার নাচগান, সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে ঘর করতে এলাম। অথচ কী দুঃসাহস আমার ! মেয়েদের এমন সাহসী হতে নেই। স্বামীর সাথে সুখী সুখী ভাব করে বিছানায় যাবে। আর সেই মেয়ে কিনা মাথা চাড়া দিতে লাগলাম ?

ঘুরে ফিরে কেনাকাটা করা আমার একটা অভ্যাস ছিল। বাড়িতে কোন কারনে মন খারাপ হলেই খুব সেজেগুজে বেরিয়ে পড়তাম উদ্দেশ্যহীন ঘুরতাম। এদিক ওদিক। একটা রিকশা নিতাম বলতাম ঘন্টা চুক্তি ঘুরবো। জানিনা রিকশাওয়ালা আমাকে পাগল ভাবত কিনা। একদিন রাজনৈতিক কারনে দেশে খুব গোলমাল চলছে। স্বামী আজকাল দেখি অন্য মহিলাদের সাথে কথা পছন্দ করেন। তাই দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। বলি
–এত কথা বল কেন?
–তোমার ই বা কান পেতে শোনার কি দরকার ?
— তোমার কাজ সংসার সা্মলানো। আমি কি করি না করি তা নিয়ে ঘাটাঘাটি করোনা । তাতে লাভ নেই কিছু। হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম। একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে আটকে থাকল। তাই তো — তাই তো — তাই তো!

–এই রিকশা এখানে থামো। একটা ভাল শপিংমল দেখে রিকশা থামালাম।
–আফনের তো এক ঘন্টা ঘোরার চুক্তি আসিলো—রিকশাওয়ালা মনখুন্ন। আমি তাকে পুরো টাকা দিয়ে নেমে পড়লাম। পড়ন্ত বেলা আকাশটা ভীষণ লাল। কোনে একথোকা মেঘ জমেছে। মার্কেটে ঢুকলাম। উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরা। বিয়ের পর আমার স্বামী আমাকে নিয়ে কত ঘুরত ——
আমার এক বান্ধবির সাথে একদিন দেখা। জোরাজুরি করে তার বাড়িতে নিয়ে গেল।

তখন ও আমার বিয়ে হয়নি। পড়ছি ইউনিভেরসিটি তে। ও মতিঝিল এ সাবলেট নিয়ে থাকে। বাড়ী গিয়ে তার হত দরিদ্র অবস্থা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
তার স্বামী টুকটাক ব্যবসা করছে। আজকাল একটা কথা অনেকেই বলে। টুকটাক ব্যবসা। এই টুকটাক যে কী কে জানে।
–তুই সুখী?
সে সহজ ভঙ্গিতে বলে – তুই এসেছিস আমার কত্তা কে দেখে যা। HSC পাশ । –তাই নাকি ? আমি একটু অবাক।
–হ্যাঁ রে আমার সাথে প্রেম করতে গিয়ে ওর আর পড়া হলনা। খুব ভাল ছাত্র ছিল সে।
হেসে বলে – জানিস ভাল কবিতা লিখত। পড়বি তুই ? আগ্রহ তার কথায়।
ও দিকে তার সদ্য প্রসব করা বাচ্চাটা ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাদঁছে।
–এক মিনিট – সে ছুটে গেল বাচ্চাটাকে বুকের দুধ খাওয়াতে।
আমি অন্যমনষ্ক হয়ে এক চিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কতো গুলো কাকের মাংশ নিয়ে কামড়া কামড়ি দেখলাম। এক সময় এক দাঁড় কাক এসে
ছোঁ মেরে মাংশের টুকরা নিয়ে গেল।
খেতে বসে দেখলাম মুরগী রেঁধেছে, ডিমের ঝোল , পোলাউ। মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমার কারনে কতগুলো টাকা বেরিয়ে গেল। অভাবি সংসার।
ইতিমধ্যে তার স্বামী এসে গেল দুপুরের খাবার খেতে। কালো মিশ মিশে।
দাঁত গুলো চমৎকার সাদা। আমি অস্বস্তিতে পড়লাম। এঁর সাথে আমি কি কথা বলব। অল্পস্বল্প কথা বলে বিদায় নিলাম। ভদ্রলোক দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।
–আবার আসবেন।
আমি ঘাড় কাত করলাম। একটা খালি রিকশা দেখে উঠে পড়লাম। মনে নেই দীপার সাথে আর কোনদিন দেখা হয়েছিল কিনা ।

তখন আমি ইস্কুল এ পড়ি । বাবা একটা বাড়ি কিনলেন।তৈরি বাড়ি। সে সময়
বেশ সস্তায় একটা তিনতালা বাড়ি কিনে ফেল্লেন।
ভাড়া বাড়ীতে থাকি আমরা ছ’ভাই বোন। বড়ো ভাই ছিলেন কিনা মনে পড়ছেনা। বাবা বললেন — কিছু দিন বাড়ির কাজের জন্য ওখানে থাকতে হবে।

আমরা ক’ ভাই বোন মা সহ গেলাম। মেজভাই যায়নি। ও ইংজিনিয়ারিং পড়ে।
হোস্টেল থাকে। নতুন বাড়ী নতুন রঙ।চার দিক রঙের গন্ধে মৌমৌ করতে লাগল। দুপুরে বাবা ভাত ঘুম দিয়েছেন। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। এ ওকে ঠ্যালাঠেলি , কে খুলবে দরজা। আমরা থাকি তিনতলায়।
আমি মহা উৎসাহে গেলাম নিচে দরজা খুলতে। এক তালা দো তালা ভাড়া হয়ে গেছে। তাই আলাদা দরজা বাড়ীর শিড়ি ঘেঁসে। খুলে দেখলাম , আমাদের দূর সম্পর্কের মামা। লোকটাকে আমার কোন দিন ই ভাললাগে না। এক কোণ ঘেঁষে

দাঁড়ালাম। মামা দরজা বন্ধ করে বলে,
–তুই বেশ ডাগর হয়ে গেছিস। আয় কাছে।
খপ করে হাত চেপে ধরল। আমি ধস্তাধস্তি করে হাত ছাড়িয়েই দে ছুট।
উপরে এসে হাঁপাচ্ছি । মা বলে- কি রে হাঁপাচ্ছিস কেন ?

–না মা দৌড়ে এলাম তো । ভয়ে সে কথা কাউকে বলিনি। তার ছোঁয়ার মধ্যে একটা কুৎসিত লালসা ছিল । হয়ত কেও জানলে বলবে – সে কী মামা তো এ কথা বলতে নেই।
আজো সে কথা ভাবি। নিজের জন্য করুণা হয়।
এক দুলাভাই ক’দিন পরে পেছন থেকে জাপ্টে ধরে। হাতে কামড় দিয়ে পালিয়ে বেঁচেছি।
আমি তখন বুঝিনি আমার বাবা এত সচেতন কেন। এই দুই ঘটনা আমার জীবনে একটা গভীর দাগ ফেলে দিয়েছিল ।
চাচার বাড়ি বোনের বাড়ি (বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল তখন ) কোন দিন রাতে বাবা থাকতে দিত না। এই ভাবে কঠিন সংস্কারে বড় হওয়া একজন সাধারন মেয়ে আমি। স্কুলের ম্যাগাজিনে লেখা ছাপিয়ে বাবা কে তাক লাগিয়ে দিতাম ।
বাবা দুনিয়ার ভাল ভাল বই এনে আমাকে পড়তে দিত। — বলতো “ চিত্তের শান্তি
আত্মার শুদ্ধি “ ।
আজ বাবার কথা বলিনা কাঊকে। বাবার কথা একাএকা ভাবি আর কলমে কথা বলি। ক’দিন আগেই বাবার মৃত্যু বার্ষিকী গেল। আমি কাঁদিনি। ছিঁচকাদুনে মেয়ে ছিলাম। এখন চোখে জল ফেলিনা। কেবল বুকটা খাঁ খাঁ করে।

ওই চেয়ার ওই টেবিল যেখানে বাবা লিখতেন শেষ জীবনে , ওখানে গিয়ে বসে থাকি। বাবার বিছানায় শুয়ে গন্ধ নেবার চেষ্টা করি।
বাবা তুমি কেমন আছ?

বিয়ের পর একদিনের ঘটনা মনে পড়ল। সেই দিন আমার জীবনের আর একটা স্বরণীয় ঘটনার একটা ছিল।

কিছুক্ষন আগে যেন বাড়িতে এক বজ্রাঘাত হল। বুঝে উঠতে সময় লাগল বেশ কিছুক্ষন। হঠাৎ মনে হল আমার শরীরে অক্সিজেন এর অভাব। ছেলে বেলা থেকে যে পরিবেশে বড় হয়েছি তার সম্পুর্ন বিপরীত পরিবেশ। কেমন বুক চাপা লাগল। দু’চোখে অসম্ভব যন্ত্রনা , মাথাটা শুন্য মনে হল। খাটের ওপরে বসে ছিলাম । কখন যে ক্ষনিকের জন্য জ্ঞাণ হারিয়েছি জানিনা।
কে একজনের গলার আওয়াজ। মনে হল দূর থেকে আসছে
–ভাবী ওডেন , এমুন টাইমে গুমাইতে নাই –।চোখ মেলতে চাইছি পারছিনা।
আস্তে ধীরে চোখ খুললাম। ঘরে চাপা অন্ধকার ।
–কামরুন তুমি ? উঠে বসতে গেলাম , পারলাম না।
–আফনের সইল ডা দেহি বালা না
–নাহ আমি ঠিক আছি
–চা আনুম ? ব্যাকুল কন্ঠ কামরুনের। কামরুন এ বাড়ির খুব পুরাতন পরিচারিকা। কেন জানিনা আমার বিয়ের পর থেকে আমাকে বেশ পছন্দ করে ফেলল।
কামরুন আমার কপালে হাত দিয়ে উত্তাপ পরিক্ষা করে। নাহ জ্বর আসেনি তো।
আজ ভারসিটি থেকে ইমরান এসেছিল পরিক্ষা কথা জানাতে। দুপুর বেলা।
মফস্বলের নীরবতা। বসবার ঘরে আমাদের স্বামী স্ত্রীর খাট পাতা। বিয়ের পর আলাদা ঘর পাইনি। একটা সাদাকাল টেলিভিশন আছে ঘরটায়।
সন্ধ্যা থেকে সবাই টেলিভিশন দেখে। আমি নতুন বঊ। সবার সাথে টিভি দেখব কিনা বুঝতে পারিনা। মাঝে সাঝে বারান্দায় চলে যাই। বারান্দায় বসে থাকি। শাশুড়ী ডাকেন
–ও বউ দেইখা যাও টিবি
— পরে যাব আম্মা আপনারা দেখুন — । কি ভেবে ফিরে আসি। বসি, দেখি। নাহয় শুধু তাকিয়ে থাকি।
কড়া নাড়ার শব্দে আমি গিয়ে দরজা খুল্লাম—ও মা তুই ? আমি ঝলোমলো –
কি রে – একবারে ডুব দিলি ? পরিক্ষার খবর জানিস?
–না তো ? কি করব বল। এত দূর থেকে ক্লাস যেতে পারিনা – আর — মুখ নত করে থাকি ,
–আমাকে ভেতরে আসতে বলবি নাকি দাঁড়িয়ে থাকব বাইরে ?
অপ্রস্তুত ভাবে তাড়াতাড়ি বলি – আয় ভেতরে –
বেশিক্ষন বসলোনা। সনিয়া আমার ছোট ননদ। ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলাম।
পরীক্ষার তারিখ বলে চলে গেল ইমরান। খাবার ঘরে এসে দেখি ভাসুরের মুখ থমথমে। কিছু না বলে ননদের ঘরে গেলাম—কেমন দেখলে সনিয়া ?
–দেখ ভাবী এ বাড়িতে থাকতে হলে এসব চলবেনা।
–কি বলছ তুমি ?
— কী বলছি বুঝে নাও। যে সে আসবে তাকে ঘরে এনে বসাবে , এ গুলো আমরা
এলাউ করবনা ।
আমি বোকা বনে গেলাম — কন্ঠে বিষ মিশিয়ে আর এক ধাপ এগিয়ে এল আমার জা,

–কিছু মনে করনা । তোমার বড় ভাই মোটেই পছন্দ করেন না ।তাই তিনি বলছিলেন –
আর কথা না শুনে নিজের তথাকথিত শোবার ঘরে এলাম । ও দিকে কিছু তির্যক কন্ঠ কানে এল। এই প্রথম অনুভব করলাম কতটা পরাধীন আমি। কতটা শংখলাবদ্ধ আমি। নিজের পা এ নিজে বেড়ী দিয়েছি । বিষ মাখান কন্ঠ , সবার কথা সব ছাপিয়ে আমার কেন জানিনা অদ্ভুত লাগছিল ।কামরুনের ডাকাডাকিতে চোখ খুললাম। বাড়ীর শোরগোলে বুঝলাম আমি অবরুদ্ধ। পালাবার পথ নেই। যে পথ আমি নিজেই বেছে নিয়েছি।

গাছপালা ঘেরা বাড়ীটায় আকাশ ভালমত দেখা যায়না। খাবার ঘরের একদিকে জানালা। সামনে একটা ডোবা। মাঝে মধ্যেই তা থেকে কচুরিপানার দুর্গন্ধ আসে।
বেশ রাত করে এল কিংশুক। কিংশুক রাতেই আসে। সে জানে নতুন বিয়ে করা বউ। দিনের বেলা কাছে যাওয়া অসম্ভব। ছোটখাটো ব্যাবসা করে। পড়াশোনার পাঠ শেষ হয়নি। রোজই তার ঢাকা নারায়ণগঞ্জ করতে হয়। আজকেও রাত করে ফিরলো।
আমার মুখ দেখে কিছু আঁচ করতে পারলো – কী হয়েছে ? কিছু ঘটেছে ?

নিজকে সংবরন করতে পারলাম না । টলোমলো চোখের জলটা অশ্রু হয়ে ঝরে পড়লো । কিংশুকের চোয়ালটা মুহুর্তে শক্ত হয়ে গেল ।
ছিলাম ।–তুমি কিছু বলতে যেওনা । সনিয়া কে কিছু বলুক যদিও মনেমনে আমি চাইছিলাম ।
— সনিয়া ! হাঁক দিল যতো জোরে ভেবেছিলাম , তার সাথে কথা বলল ততোধিক নিম্ন স্বরে –
— তোরা কি আমায় শান্তিতে থাকতে দিবিনা ?
এটুকু ছাড়া আর কিছুই বলল না । সারাটা রাত গোপণে অশ্রুপাত করলাম । এ কোথায় এলাম ? কিংশুক কে অচেনা আলাদা জগতের মানুষ মনে হলো।

সাত সকালে ঘুম ভাঙ্গলো কিংশুকের ডাকে। ধড়মড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলাম – তোমার আব্বাকে ফোন করেছি তিনি এসে তোমাকে নিয়ে যাবেন – কি ভেবে আবার বললো – আর হ্যাঁ বড়ো ভাইএর কাছে ক্ষমা চেয়ে যেও ––
–আমি মাফ চাইবো কেন ? দোষ আমার কোথায় ছিলো ? আমার প্রতিবাদী মনটা বিদ্রোহ করে ওঠে –
–আহা উনি তো বড়ো — জানি কিছুই করনি –আমার কথায় চাইলে না হয় – –
মনে মনে বললাম – কিংশুক তুমি বদলে গেছো –
খাবার ঘরের টেবিলের পাশে চেয়ার । আমার ভাশুর এর সব সময়ের রুটিন , বাজার এনে মাঝখানের চেয়ারে বসে চা পান করেন ।
আমি চুপচাপ তার কাছে গেলাম ।
তার পা টা ছুঁতে গেলে তিনি শক্ত চোয়ালে বসে থাকেন । আমি স্পষ্ট দেখতে পাই তার পেশীবহুল ব্যায়াম করা পুরুষ্ট পা। তিনি নিরুত্তর ।
নিজের বড়ো ভাইএর চেহারা ভেসে ওঠে । কি স্নেহ ই না করে আমাকে । আজ যদি ভাই থাকতো । কোলেপিঠে মানুষ করা বোনটার এই করুণ দশা দেখে ভাইটার বুক চুরমার হয়ে যেতো । হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ ।উৎকর্ণ ভাবে অপেক্ষা করি কে আসছে ।
নাহ ! আমার শ্বশুর । খুব ভাল মানুষ। যাকে পেয়েছি বিয়ের পরে ।
পর্দাটা সরিয়ে ঘরে ঢুকলেন । তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা টেনে পায়ে হাত দিয়ে
সালাম করলাম। দ্বিতীয় বিবাহের পর তিনি গ্রামের বাড়ী থাকেন। ব্যাবসাপাতি
সব বড় ছেলেকে বুঝিয়ে দিয়ে তাঁর একরকম স্বেচ্ছা নির্বাসণ । আমার ছলোছল চোখ দেখে তিনি বলেন ,
–কি হয়েছে বউ মা ?
–কিছু না আব্বা । মাটীর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে থাকলাম ।
–বলো খুলে ? ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম । ঘটনা ব্যখ্যা করলাম।
— কিন্তু কিংশুক তার স্বশুর কে আসতে বলল কেন?
–জানিনা আব্বা –
–বউমা তুমি কান্নাকাটি করোনা একদম । বেয়াই সাহেব এলে যাও তুমি সাথে । আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসবো তোমাকে ।
বাবা এলেন । তাঁকে বলা হয়েছিল আমার শরীর বিশেষ ভালো না । আমাকে সুস্থ্য দেখে শান্তি বোধ করলেন। কিংশুককে কোথাও দেখা গেলো না। কোথায় উধাও হল কে জানে । আমি আমার বিয়ের সুটকেস টা নিয়ে বাবার সাথে রিকশায় উঠলাম ।বেশ কিছু দূর গিয়ে বাস স্টান্ড।
একটা ঢাকা গামী বাসে উঠলাম বাপ মেয়েতে । ভাগ্য খারাপ হলে যা হয় । মাঝ রাস্তায় বাসটা নষ্ট হয়ে গেল । আস্তে আস্তে সব বাস যাত্রী নেমে গেল ।
বাপ মেয়েতে নেমে পড়লাম।
এ এক অথৈ সাগর । ধু-ধু দুপুর । সব ঢাকা গামী বাসে মানুষ ভর্তি । কি ভাবে যে উঠবো – বুঝে উঠতে পারছিনা। বাবার জন্য কষ্ট লাগলো ।
অনেক কষ্টে একটা বাস এ জাগা হলো । বাপ মেয়েতে যাত্রা শুরু । এটাই ছিল আমার স্বশুর বাড়ী তে শেষ আসা । কেন জানিনা ও দিন ই বুঝেছিলাম।

আমার এক ফুপু ছিলেন। খুব ধর্ম কর্ম করতেন। পীর ফকির ,তাবিজ ,ঝাড়ফুঁক এই জাতীয় আধি-ভৌতিক কাজ করতেন। ছেলেবালায় আমার একটা বিরক্তিকর বিষয় ছিল আরবী পড়া। এই বিদেশী অদ্ভুত ভাষায় ধর্মীয় বই নাকি না শেষ করলে গুনাহ হয়। তো রোজ সকালে আরবী পড়াতেন আমার মা , কখনো বা বাবা । মাঝে মধ্যে মায়ের হাতে ছড়ি থাকতো। ভুল করলে পিঠে সপাং। একদিন ভীষন গোঁ ধরলাম আরবী আর পড়বো না। কোনমতে আমসিপারা শেষ করে কুরাণ শরীফ আর পড়া হলো না। এই নিয়ে সবার কতো আক্ষেপ । দোজখের আগুনে জ্বলবো । যদিও দোজখের আগুন দেখেছে কেউ ? কি জানি —
তো আমার ফুপু বাড়ী এলে কটমটিয়ে তাকিয়ে থাকতেন। এটাই স্বাভাবিক। অপ্রয়োজনীয় কথা বলতেন বেশী।

তাঁর ধারণা আমার স্বভাব নষ্ট হয়ে গেছে। এবং এই সমস্ত মেয়েদের বিবাহ হলেও ফায়দা হয়না। আরবী না পড়ে কি হয়েছে এতোটা বসন্ত গড়িয়ে গেল জানিনা।
ছেলেমেয়েরা এখন আমার বড়ো হচ্ছে। ওদের আবদার ,স্বামীর চাহিদা এই মিলিয়ে চারদিক এক আবেষ্টনে বন্দী আমি। এখন আমি কুরাণ পড়ি , তবে বাংলায় , হাদিস পড়ি , বুঝতে চেষ্টা করি কী আছে তাতে , কী সুখী হবার মন্ত্র ।তবু কাউকে কিছু বলিনা । বলতে নেই । মেয়েদের গলার আওয়াজ বেশী ওপরে তুলতে নেই । বাবা মারা যাবার পর একদিন ই জোরে কেঁদেছিলাম। দেখলাম স্বামী বিরক্ত , বাড়ীর সবাই বিব্রত। এক সময় চুপ হয়ে গেলাম।
একদিন প্রবল ঝড় বৃষ্টীতে আমার এক পুরনো বান্ধবী এলো। শীমুল কে ভুলেই গেছিলাম। কেননা, তার সাথে আমার ইস্কুলেই ছাড়াছাড়ি। অন্য ইস্কুলে সে চলে গেল। এমন ঘোর বর্ষণে তার আগমনে আমি খুশী হবো কিনা বুঝতে পারছিনা ।
এসেই সে ভেজা কাপড় বদল করলো। কিছু পরেই নামাজ পড়তে গেল ।
—কেমন আছো ? ওর সাথে আমি “তুমি” করেই কথা বলতাম কিনা মনে নেই ।
–ভাল নাই –
–কেনো ?
চা দিলাম। কাপে চুমুক দিতে দিতে তার অনেক কথাই শুনলাম । বড়ো বড়ো শ্বাস নিচ্ছে , হাঁপানি আছে নাকি ? কি ভেবে জিজ্ঞেস করলাম না। তার আধবুড়ো ৬০ বছরের স্বামীর সাথে বনিবনা হচ্ছেনা ।
-জানো ও আমাকে তুষ্ট করতে পারেনা ।
–কিসের তুষ্ট ?
–আহা – বিস্কুটে কামড় দিতে দিতে বলল ,— তুমি আগের মতই কিছু বোঝনা ।
তা বটে আমি এখোন ও মাকড়শা দেখলে ভয় পাই । তেলেপোকা দেখলে হুলুস্থুল করি। এই নিরীহ প্রাণীকে আমি কেনো যে ভয় পাই —
— ও আমাকে তালাক দিবে বলেছিল –
–সে কী ? চোখ কপালে তুললাম –
–হুম যদিও আমি এক ছেলের কাছে নিজের চাহিদা মেটাই –
— চাহিদা মানে ?তোমাকে ভাত কাপড় দেয়না ? তাছাড়া নিজেই যখন চাকরি কর মিমিনিয়ে বললাম –
–ধ্যাত ! তুমি যে কী মনে করো ওসব ই কি সব ?
অন্য ছেলে সাথে আমি দিনের বেলা, — মানে – বুঝতে পারছিস ?
–বলো কি ? চক্ষু আমার চড়ক গাছ । পা নাচাতে নাচাতে বলে –পেলেই বা কি ? ও আমার চাহিদা মেটাতে পারেনা সোজা অংক –
ভাবছি —স্বামী নিয়ে থাকে ।আর অন্য লোকের সাথে – তালগোল হারালো আমার। কি করে ব্যাভিচারী হল। বিবেক কী বলে ?
কিছুক্ষণ পরে চলে গেল। যাবার আগে আমাকে বারবার নামাজ পড়ার উপদেশ দিয়ে গেল – বুঝলে নামাজ হল বেহেশ্তের চাবি। বেনামাজ হওয়া ঠিক না। ও বেহেশ্তের চাবী নিয়ে চলে গেল।
আমি দরজা বন্ধ করে বিছানায় বসলাম। তীব্র একটা ভয় আমাকে আছন্ন করে ফেলল। মনে হল কেও আবার দরজা ধাক্কাবে , মাথা উঁচিয়ে ডাকলাম—
–সমিরুন – সমিরুন – কেও সাড়া দিল না। আবার বারান্দায় এসে বসলাম , হাতে ঠান্ডা পানি নিয়ে। ঝিকমিকে রাত – অপুর্ব আলো আঁধারিতে একটু আরাম পেলাম। খোলা হাওয়া এসে মনকে ঠাণ্ডা করে করে দিল।
ওর সাথে শেষ দেখা এয়ারপোর্ট এ । ওর সেই বৃদ্ধ স্বামীর সাথেই আমেরিকা যাচ্ছে। আমার আর জিজ্ঞেস করা হলনা , কেন ঐ কাজ গুলো করেছিল। এমন অনেক কথারই জানি জবাব পাবো না। জবাব মেলেনা ।
কেবল হাত উঁচু করে বিদায় জানালাম। আস্তে আস্তে তার ঘোমটা’টা মিলিয়ে গেল।
ও দিন বাড়ী ফিরে একটা কবিতা লিখে ফেললাম। মানুষ এর সুখ দুঃখের সাথী আকাশের চাঁদ। বড্ড ভাল লাগলো । কোথা থেকে একটা মিষ্টি ফুলের গন্ধ নাকে
ঝাপ্টা মারল—

বাবার মৃত্যু শোকে চল্লিশ দিন স্বামীর সাথে একবিছানায় ছিলাম না । তাই নিয়ে ননদের নানান কটুক্তি। শুনেছি কবিদের নাকি ভাত হয়না। আমার হাতে কাগজ কলম দেখলে স্বামী রেগে যান। আমাদের এসব চিন্তা করতে নেই। আমি কি বেগম রোকেয়া হতে চাই ? স্বামী পরোনারী নিয়ে আমোদ ফূর্তি করে বাড়ী এলেও তাকে হাসি মুখে সঙ্গ দিতে হবে। সুখী-সুখী ভাব করে সব বিষয়ে একজন ক্রীতদাসীর মতো থাকতে হবে। আমার নিজের কোন ঘর নেই । একটাতে স্বামী ,বাকী দুটো ঘর দুই ছেলেমেয়ের , খাবার ঘর আর আর বসার ঘর । কাজের মেয়ের ছোট একখানা ঘর আছে। আমি যে অর্ধাঙ্গিনী। আমার ঘরের দরকার কি।
এক চিলতে বারান্দায় আমি মাঝে মাঝে হাঁটি। সন্ধে হলে অন্য মহিলাদের মতো হিন্দি সিরিয়াল দেখি। আমার বিদ্যার অহংকার ধুলায় মিশিয়ে স্বামীর মুখে হাসি ফোটাই। তবু , ও আমি স্বপ্ন দেখি। এক সময়কার ছেলেদের হৃদয় কাঁপানো আমি এখনো স্বপ্ন দেখি , যদিও সব স্বপ্নই অস্পষ্ট।

৩ পর্ব

সময়টা ১৯৭১ সাল । আমরা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এলাম। তখন আমি খুব ছোট। বাবার সরকারি চাকরি। ৩/৪ বছর পরপরেই বদলী।ভাড়া বাড়ী না পাওয়ায় আমরা সবাই বড়ো বোনের বাড়ীতে উঠলাম। বড় আপার বিয়ে হয়েছে আগেই। কিছু দিন পর ভাড়া বাড়ী পাওয়া গেল। সবাই সেখানে উঠলাম। বড় আপার বাচ্চা ছোট ,তাই মা বড়ো বোন দুলা ভাই সহ একই বাড়ীতে বসবাস শুরু।
অসময়ে বদলী হয়ে আসায় আমার ইস্কুলে ভর্তি হাওয়াটা একটা হ্যাপা হয়ে গেল বাবার জন্য। তবু সরকারি অফিসারদের একটা কোটা থাকে ইস্কুলে। সে সুবাদে ভর্তি হলাম।
আমাদের বাড়ীটা ক্যান্টনমেন্ট থেকে কাছেই ছিল। আর বড়ো আপা সামরিক ইস্কুলের ইংরাজি টিচার ছিল।
বেশ গোলমাল যাচ্ছিলো কতো দিন ধরেই। নির্বাচন হবার পর থেকেই ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তান , আর পশ্চিম পাকিস্তানে লড়াই। তর্ক , বিতর্ক । বৈঠক এর পর বৈঠক।
আমি ভয়ে ভয়ে ইস্কুলে যাই আসি। মেজভাই প্রায় একটা কথা বলে চলেছে মা কে – দেখবেন মাস কীলিং হবে –
–মা মাস কীলিং কাকে বলে ?
–জানিনা , মা অন্যমস্ক হয়ে জবাব দিতেন। বড়ো ভাই ইংজিনিয়ারিং পড়ে।
হোস্টেল থাকে। ইতিমধ্যে রোজ ই দেখি মিছিল হচ্ছে। নেতারা গরম গরম বক্তৃতা দিচ্ছে। এ সব বিষয়ে যতোটা বুঝেছিলাম ( সবার বলা বলিতে ) তা হলো , পুর্ব পাকিস্তান (তৎকালীন ) এক ত্রিতিয়াংশো ভোট পেয়ে সংখ্যা গরিষ্ঠ হয়েছে। সে অণূযায়ী দেশ চালানোর ক্ষমতা পুর্ব পাকিস্তান (তৎকালীন ) থেকে যিনি নির্বাচিত হয়েছেন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। পশ্চিম পাকিস্তান তা মানতে রাজী না। এ সব অনেক আগের কথা। আজ থেকে তিরিশ বছরের বেশী।

১৯৭১ সাল ২৫ মার্চ ।

রাত ১১ টা হবে। হঠাৎ দুম দাম ,ঠাস ঠুস আওয়াজ পেলাম। বাড়ীর সবাই বুঝে উঠতে পারছে না কী হলো । দৌড়ে বারান্দায় গেলাম। আকাশ মনে হয় কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আতশ বাজীর মতো ফুল্কী থেকে থেকে আকাশে উড়ছে। চার দিক লাল আলো। জানিনা তখন গণহত্যা শুরু হয়ে গেছে। আমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দৃশ্য দেখতে লাগলাম। কারো একবার ও মনে হলো না যে বিপদ আমাদের ও আসছে।

গড়গড়িয়ে কিম্ভুতকিমাকার গাড়ী চলেছে সামনে দিয়ে। চাকার নীচে চেইন।

অনেক সৈনিক রাইফেল উঁচু করে গাড়ীর ওপরে দাঁড়িয়ে । হাত দিয়ে ইশারা করল ।সবাই আমরা ভেতরে ঢুকে পড়লাম। পরে শুনেছি গাড়ী গুলো হচ্ছে “ট্যাঙ্ক’।
মানুষ মারার যন্ত্র। বাবা রেডিও খুলে রেখেছিলেন তাতে শোনা গেলো “ কিছু লোক দেশে অরাজকতা করছে আইন মানছে না , তাদের কে দমন করতে সামরিক আইণ জারী হলো। কিছু বুঝলাম কিছু বুঝলাম না।
রাত ১২ টার দিকে আমরা মাঝখানের ঘরে সবাই। হঠাৎ দরজায় প্রচন্ড শব্দ। মনে হলো কেউ বুটের লাথি মারছে। আরো কিছু যান্ত্রিক শব্দ।
এ ওর দিকে চাওয়া চায়। কে খুলবে দরজা। বাবা দৃঢ় পায়ে দরজা খুলে দিলেন। বাবার সেই সময়কার অণূভুতি কেমন ছিল জানিনা।
হুড়মুড়িয়ে একদল সেনাবাহিনী ঢুকে গেল ঘরে। সবাই আতংকে। কেনো এলো ?
কী অপরাধ করেছে কেউ। এসেই বন্দুকের নল বাবার বুকে ঠেকালো। ধাক্কাতে ধাক্কাতে ভেতরে আনল,
–আপ সব এক লাইন পে খাড়া হো যাও –
–we have come to kill you—
–বন্দুক কাঁহা – পিস্তল কাঁহা – নিকালো নিকালো – কতো গুলো মুখ থেকে ঘড় ঘড়ে আওয়াজ বার হলো ।
— I am a government officer – বাবা বলে –
— ডান্ডি কার্ড কাঁহা ( পরিচয় পত্র) –
বাবা কার্ড বার করলেন – I am a teacher of army school .বড় আপার কন্ঠ । একজন পাঞ্জাবি (ওদের মাথা হবে) এগিয়ে এলো ।
-আপ লোগ শরীফ আদমী হ্যায় – মাগার মুঝকো ইনফরমেশন মিলা ইয়াহা বন্দুক হ্যায় – আউর কুছ হ্যায় –
বাবা তার লাইসেন্স করা শখের বন্দুকটা দিয়ে দিলেন। লাইসেন্সটা ফিরিয়ে দিলো। ভাগ্যিস লাইসেন্সটা দিলো। যা দিয়ে পরবর্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বন্দুক কিনেছিলেন । শিকার করা বাবার প্রচন্ড শখ ।
এর পর শুরু হল তল্লাশি। পুরো বাড়ীটা যেনো তছনছ করে দিলো। হারমনিয়াম দেখে তামাশা করে জিজ্ঞেস করল কে গান করে। কেউ জবাব দিলো না। বাড়ীটা তল্লাসী শেষ করলো এক এক ঘর। যাবার সময় দুলা ভাইকে নিয়ে গেলো। বলে গেলো কিছু পরেই পাঠিয়ে দেবে।

বড়ো আপা ছুটলো দুলাভাইকে আনতে। আমাদের একটা বিরাট সুবিধা হয়েছিল, আমার বাবা বোনদের অনর্গল উর্দূ বলতে পারা এবং বিশুদ্ধ ইংরাজি । বাবা দেশ ভাগের আগে যখন লক্ষণৌ চাকরী করতেন তখন থেকেই উর্দূ ভাষাতে পারদর্শি। সেই সাথে বড়ো বোনের উর্দূ একটা পড়ার সাবজেক্ট ছিল।
অনেক পরে জেনেছি মিলিটারিরা ও দিন যাদের ঘরেই ঢুকেছিলো ও বাড়ীর কেউ বাঁচেনি। ব্রাস ফায়ার করে পরিবার শুদ্ধ শেষ করে দিয়েছিলো।
যাই হোক , শেষ পর্যন্ত বড়ো আপা মিলিটারিদের কে বোঝাতে পেরেছে তার স্বামী অসুস্থ্য ইত্যাদি তাকে ছেড়ে দেয়া হোক।
দুলাভাই সহ ঘরে এলো আপা । সারারাত আমরা শুনলাম কামানের গর্জন , মেশিনগানের ঠা –ঠা- আওয়াজ। আর থেকে থেকে বোমার শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠল । রাতে কেউ তেমন খেলো না।

ধীরে ধীরে সকাল হলো।
আবিষ্কার করি সবাই যে আমরা বেঁচে আছি । রেডিওতে ঘোষনা দিলো – দু’ ঘন্টার জন্য সান্ধ –আইন শিথিল। ও দিন রাতে মিলিটারিরা বাড়ীর সমস্ত মুল্যবান অলংকার ,টাকাকড়ি লুট করে নিয়ে গিয়েছিল যাবার সময়।
সকাল হতেই দিকবিদিক মানুষ ছোটা ছুটি শুরু করলো। মা বাবা বাক্স ,প্যাঁটরা গোছালেন। কিন্তু যাবো কোথায় ?
যেখানেই হোক ,এ জাগা ছাড়তে হবে। ঐ দিন একজন বিহারী আমাদের সাহায্য করেছিল। দুলাভাই যখন পি ,আই ,এ তে (পাকিস্তান এয়ার লাইন্স ) তার থেকে জানাজানি। রাস্তায় আমাদের দেখে জলদি তাঁর গাড়িতে ওঠালেন।
হঠাৎ মনে হল ভাই কোথায় ? আমি কাঁদতে লাগলাম। বাবা রাস্তায় নেমে গেলেন ভাইএর খোঁজে।

হঠাৎ দেখি —ঐ যে ভাই ঐ — আমি আনন্দে আতংকে চিৎকার দিলাম। বড়ভাইএর খালি পা , উস্কোখুস্কো চুল , খোঁচা খোঁচা দাড়ি হেটে হেটে আসছে।
অথচ তার ইউনিভারসিটি তো কতো দূর ! ভাইকে গাড়ীতে তুলে নেয়া হল। আমার কান্দুনি তখনো থামেনি। এক হাত জড়িয়ে বড়ভাইকে।
ভাই জানালো ,তাদের হস্টেলে দু ‘চার জন ছাড়া কেউ বেঁচে নেই। ও পাঁচিল টপকে
পাশেই পলাশী কোয়াটার এ এক পরিবারের আশ্রয়ে ছিল । সকালে কারফিউ শিথিল। এরপরে হাঁটা শুরু করে। মহাখালী আমাদের বাড়ীর উদ্যেশ্যে। কিন্তু ভাই বুকের মাঝে রেডিওটা ছাড়েনি। আমরা সবাই ধানমন্ডি ২৭ নং গেলাম নানার বাড়ীতে।
যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। ৯ মাস যুদ্ধে আমরা কে কোথায় ছিলাম কি করেছি।
কোন অবস্থায় ছিলাম তা এখন বলতে পারছিনা । আবেগটা চরমে এলে ভাষা হয়ে যায় রুদ্ধ । সে সব কথা পরে এক সময়ে বলা যাবে ।
৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ , তিরিশ লাখ (আনুমানিক হিসাব ) শহীদ , ক’এক লক্ষ নারী ধর্ষণ এর বিণিময়ে জন্ম হল বর্তমান বাংলাদেশ। সব চাইতে বেশী ক্রীতজ্ঞ ভারত বর্ষের কাছে। তাদের সাহায্য (মিত্র বাহিনী ) ১ কোটি শরণার্থী কে জায়গা দেয়া , খাদ্য ,বস্ত্র , চিকিৎসার ব্যয়বহন , সামরিক সাহায্য , সব পাওয়া গেছিল সেই সময়।
এর মাঝে বাংলাদেশে যুদ্ধকালীণ অবস্থায় সরকার গঠিত হয়। যেখান থেকে বিভিন্য সময়ে সমস্ত কার্য ক্রম পরিচালনা হত। জাগাটার নাম দেয়া হয়েছিল “মুজিবনগর “।
আমাদের নিজেদের মাঝেই রাজাকার বাহিনী আলবদর , আলশামস নাম দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কে সাহায্য করেছিল। মেরেছিল অসংখ্য নিরীহ মানুষদের কে। সব যুদ্ধেই মিরজাফর থাকে।
দেশ স্বাধীন হল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ । বিধ্বস্ত বাংলাদেশ। যেনো নবজাতক শিশু ।
মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নিল বাংলাদেশ নামে একটা স্বাধীন দেশ।
যে রেডিওটা নিয়ে বড়ো ভাই হস্টেল ছেড়েছিল তা আজো আছে আমাদের শো কেস এ ।কালের সাক্ষী হয়ে ।

অবরুদ্ধ ঢাকা –

জুলাই মাস থেকে ঢাকা অবরুদ্ধ। একটা অসহায় শহর। আমরা নানার বাড়ি ছেড়েছি তার অনেক আগেই। কেননা, বাড়ীটা ছিল একদম মেইন রোডের ওপরে। সারারাত মিলিটারেদের অশ্ত্র সস্ত্র সহ ভারিভারি গাড়ি চলতো ।
এর মাঝেই শুরু হয়ে গেলো অল্প বয়সীদের যুবকদের ধরপাকড়। তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া মানেই পরিবারে ফিরে আসতোনা আর। হয়তো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে , কখনো বা দলবদ্ধ ভাবে ব্রাস ফায়ার করে করে মেরে গণ কবর দিতো ।
নানার বাড়ীতে কঠিণ আবেষ্টনীতে থাকতাম। কেননা, আমার যুবতী বোনেরা , আমার যুবক ভাইরা ছিলো। নানী সকাল থেকেই বিলাপ করতেন ।
২৭ নং ধানমন্ডির বিশাল বাড়ীতে আমরা ক’জন ছাড়া আর কেউ ছিলোনা। নানার কথা জিজ্ঞেস করতাম –
–নানাভাই নেই ? নানী কেবল অশ্রুপাত করতেন। জবাব পেতামনা।
বুদ্ধিজীবি ধরপাকড় অনেক আগেই শুরু হয়েছিল । আমরা জানতাম না । নানা ছিলেন বুদ্ধিজীবিদের একজন । যতদিন নানার বাড়ী ছিলাম , নানাভাইকে এক দিনের জন্য দেখিনি।
বৃদ্ধা নানী একলাই সব দিক সামলাতেন। বিশাল এক বিঘে জমীর বাড়ীটা , বিরাট বাগান , কেমন যেনো আস্তে আস্তে বিবর্ণ হতে শুরু করলো। নানী সবসময় আমার ভাইবোনদের কে আগলে রাখতেন। এ অবস্থায় বেশীদিন চলেনি।

যুদ্ধ যখন প্রচন্ড ভাবে ভয়াবহ রুপ নিলো ,তখন বাবা বাড়ী ছাড়লেন স্বপরিবারে। অনেক ভেতরে একখানা বাড়ী নেয়া হল । ওখানেও যখন নিরাপদ মনে হলো না , আবার বাড়ী ত্যাগ।
ভেতরে — আরো ভেতরে বাড়ী নিতে হবে। এইটাই বাবার ভাবনা ।
একটা বিশাল জমি সহ বাড়ী পাওয়া গেল। এর মাঝেই বাবা অফিস করতেন। সরকারি চাকরি। হাজিরা না দিলে ধরে নিয়ে যাবে ‘ মুক্তি বাহিনী “ বলে। শুরু হয়েছে সমস্ত চাকরিতে বাঙ্গালী ছাঁটাই। দুলাভাই চাকরি হারাল। তার পাকিস্তান এয়ার লাইন্স এর চাকরিটা গেল।
আমার ইস্কুল যাওয়া বন্ধ , বোনের কলেজ যাওয়া বন্ধ। সবাই আমরা বিভিষীকায়
দিন কাটাচ্ছি।
বাবা বস্তাবস্তা চাল ,ডাল , কেরসিন তেল , দেয়াশলাই , শুকনা জিনিস খাদ্য দ্রব্য
সংগ্রহ করে জমা করতে লাগলেন। কখন কী হয়।
সন্ধে হলে কারফিউ জারি হয়। নিয়ম মাফিক লাইট বাতি নিভিয়ে আমরা অন্ধকারে থাকি। হ্যারিকেনের সলতে কমিয়ে এ ঘর ও ঘর যাওয়া আসা।
রেডিওতে “ চরম পত্র” শুনতো সবাই কান লাগিয়ে। নব ঘুরিয়ে বিবিসি। আজ কি
খবর , কাল ক’জন গেরিলা (মুক্তি যোদ্ধা ) বাহিণী কোন শহর দখল করলো , এই সব শোনা মুখ্য কাজ ছিলো। যে দিন বিবিসির খবর শোনা যেতনা , হয়ত কোন যান্ত্রিক গোলযোগে সবার মন খারাপ থাকতো।
জানালার কাঁচে চারদিকে কাগজ সাঁটা আঠা দিয়ে । যেনো এক ফোঁটা আলোর রোশনী বাইরে না যায় ।

এই ভাবে চলে আমাদের দিন রাত । রেডিও তে যখন “ ও আমার বাংলা মা গো আকুল করা রূপের সূধা “ গান বাজে , বা “ মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি “ গান বাজে “স্বাধীন বাংলা বেতারে সবার চোখ ভিজে যায় ।
অনেক পরিবর্তন হতে লাগলো শহরের । চার দিক খালিখালি। দোকান পাট বেশীর ভাগ থাকে বন্ধ। ভিখারিরাও মনে হয় শহর ছেড়ে চলে গেছে।
মহিলারা বোরকা পরে চলাচল করে , তবে তাও খুব কম। বাবা মারা ধড়াধড় যুবতী মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। বিয়ে দিয়ে কি রক্ষা করতে চাইছে কেজানে।

দেখতে দেখতে নভেম্বর এসে গেলো। যুদ্ধ তখন চরমে।
ঠিক ডিসেম্বরের প্রথম দিক থেকে শুরু হলো আবার শহর ছেড়ে পালানো। আশে পাশে অনেকে চলে গেল তাদের গ্রামের বাড়ী। গ্রামের ই বা নিশ্চয়তা কী।
আমার বাবা দেশ ভাগের পর ভারতবর্ষ ছেড়ে পাকিস্তান ( তৎকালীণ ) এসেছেন।
আমরা যাবো কোথায় ? আমাদের না আছে নিজের বাড়ী না আছে গ্রামের বাড়ী।

মা বললেন ‘ যা হয় মরলে এখানেই মরবো ‘।
একদিন রাতে পাশের বাড়ী থেকে দু’জন যুবক ছেলেকে চোখ বেঁধে নিয়ে গেল মিলিটারি ।
আমাদের দুঃসময় তখন চরমে। মা যদি পারত সন্তানদের আবার পেটে ঢুকিয়ে রাখত।
শুরু হলো শেষ যুদ্ধ। ভারতীয় মিত্র বাহিণী ঢুকে গেছে বাংলাদেশে ।
আকাশ যুদ্ধ প্রথম নিজ চোখে দেখলাম। মা বারান্দা থেকে ধরে এনে খাটের তলায় ,টেবিলের নীচে ঢুকিয়ে দিল। কানে তুলো।
ভয়াবহ অবস্থা। আকাশে মিগ প্লেন একে অপরকে তাড়া কছে। কখন যে বোমা কোথায় পড়বে তার ঠিক নেই।
১৪ ই ডিসেম্বর।
সমস্ত বুদ্ধিজীবিদের তালিকা করে একে একে ধরে নিয়ে গেলো। বিভিন্ন জায়গায়। রায়ের বাজার , মীরপুরে তাদের দু’চোখ বেঁধে ব্রাস ফায়ার। লুটিয়ে পড়তে লাগল মাটিতে । বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখে মৃত্যু নিশ্চিত কিনা।

আমরা ক’জন প্রাণী একটা অবরুদ্ধ শহরে বন্দী অবস্থায় মৃত্যুর দিন গুনতে লাগলাম ।
আমরা কোথায় যাবো ?ভারতে হিন্দ মুসলিম দাংগায় বাবা দেশ ত্যাগ করেছিলেন ।এখন আমরা কোথায় নিরাপদ কেউ জানিনা ।

তাই দিন গুনতে লাগলাম মৃত্যুর। সারা পাড়াটায় একটা মৃত্যুর হীম শীতল পরিবেশ।
কোথা থেকে আগরবাতির গন্ধ নাকে আসে। মনে হয় কেউ আমাদের লাশের পাশে আগরবাতি দিয়েছে। আজো আমি আগরবাতির গন্ধ সহ্য করতে পারিনা ।
নারী নির্যাতন বিভিন্য ভাবে চলছে। যুবতী নারী ধরে নিয়ে গেছে তারা । কিছু রেখেছে ক্যাম্পে , কিছু তাদের আখড়ায় । প্রয়োজন মেটায় । সারা শরীরে বস্ত্র থাকেনা ( এ সবি পরবর্তিতে জানি ) এমন কী তাদের যৌণাঙ্গ বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে কাজ শেষে ।
এমনি যখন ধরে নিয়েছিলাম মরণ আমাদের দরজায় , আমরা সবাই প্রস্তুত ।
পুরো পাড়া খালি । কেবল আমরা ক’জন নিজেদের সমার্পণ করে দিয়েছি নিয়তির হাতে ।
ঠিক সেই সময় ১৬ ই ডিসেম্বর , ঢাকা শহর মুক্তি পেলো । পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমার্পণ করল মিত্র বাহিনীর কাছে । হেরে গেলো তারা । চুক্তি পত্রে সই করল।
কোথা থেকে দলে দলে মানুষ “ জয় বাংলা “ স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় নামল ।
কোথায় লুকিয়েছিল ওরা ? সবাই কোলাকুলি । মিত্র বাহিনীর গাড়ী দেখলে সবার হাত নেড়ে শুভেচ্ছা। দলে দলে মুক্তি যোদ্ধা যারা এতোদিন গোপনে ছিল তারা আসতে লাগল বীরদর্পে ।
এ দিকে আমরা ক’জন সবাই সবাইকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম। আমরা বেঁচে আছি। আমরা স্বাধীন দেশ দেখছি । যেখানে কেউ বলবে না উর্দুতে কথা বলতে হবে । আমরা বাঙ্গালী । তাই বাংলাদেশ আমাদের।
কী অবিশ্বাস্য! আমরা বেঁচে গেলাম কি করে ?

(চলবে)