মানুষ স্বপ্ন দেখে-স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে। সুন্দর আগামীর স্বপ্ন মানুষের জীবনচলার পথে অনুপ্রেরণার অন্তহীন উৎস হয়ে আছে এবং স্বপ্নই মানুষকে তার জীবন-যুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন লড়াই চালিয়ে যেতে শক্তি ও সাহস যোগায়-পরিণামে মানুষ একদিন সফল হয়-জীবনযুদ্ধে বিজয়ী হয়। একজন ব্যক্তির বেলায় কথাটি যতটুকু সত্য, ততোধিক সত্য একটি জাতির বেলায়ও। ব্যক্তির সম্মিলিত স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা কখনো কখনো জাতীয় আকাক্সক্ষায় রূপান্তরিত হয়ে জাতীয় স্বপের ভীত রচনা করে। আবার কখনো একটি জাতির স্বপ্ন ব্যক্তিমানুষকে উদ্বুদ্ধ করে দেশ তথা দেশের মানুষের মুক্তির বেদীতে আত্ম নিবেদনে। একটি সাধারণ স্বপ্ন একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে-প্রয়োজনে লড়াই-সংগ্রামেও উদ্বুদ্ধ করে। যেমন পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে স্বাধীনতার বিজয় কেতন উড়ানোর স্বপ্ন ঔপনিবেশিক বৃটিশ আমলে বাঙালি জাতিকে বারংবার বিদ্রোহী করেছে। দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করার দুর্নিবার স্বপ্ন ক্ষুদিরাম, সূর্যসেনকে হাসি মুখে ফাঁসির যুপকাষ্ঠে ঠেলে দিয়েছে, আত্মবলিদানে উদ্বুদ্ধ করেছে প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদারকে । শতাব্দীর বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের শেষ দিকে এসে মুসলিম বাঙালিরা স্বপ্ন দেখল, ধর্মীয় দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ করে মুসলমানদের আলাদা রাষ্ট্র হলে তারা যেমন বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের নিগড় থেকে মুক্তি পাবে, তেমনি যুগপৎ মুক্তি পাবে হিন্দু জমিদার-তালুকদারদের শোষণ-নিপীড়ন থেকে। শত বৎসরের লড়াই-সংগ্রামের পর তাদের সে স্বপ্নের পথ ধরে সৃষ্টি হল পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি। কিন্তু হা-হতোস্মি ! সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে তাদের স্বপ্নভঙ্গ ঘটতে বেশী দিন লাগল না। পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পর পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী প্রথমে কেড়ে নিতে চাইল বাঙালির মুখের ভাষা। তারপর রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে শুরু করল অর্থনৈতিক শোষণ। বাঙালির বুঝতে দেরি হল না, ধর্মীয় দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানে তারা নতুন করে রাজনৈতিক শাসন ও অর্থনৈতিক শোষণের নিগড়ে আবদ্ধ হয়েছে। তারা সহসা বুঝতে পারল আকাশ পথে এগার শ মাইল দূরত্বের দু’টি ভূ-খন্ড নিয়ে, যার অধিবাসীদের ভাষা আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা কেবল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্র হতে পারে না। তারা উপলব্ধি করতে পারল, তারা প্রতারিত হয়েছে। অনেক মূল্য দিয়ে তারা বুঝল, ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা পাকিস্তানের মানুষদের একাত্ম করতে পারেনি-পারেনি একটি একক জাতি সৃষ্টি করতে। তাই হাজার বছরের বাঙালি, নতুন করে তার আত্মপরিচয়ের শিকড় সন্ধানে উদ্বুদ্ধ হল। খুঁজে নিল তার নৃতাত্ত্বিক জাতি-পরিচয়। তাদের মধ্যে নবজাগরণের শ্লোগান ওঠল তুমি কে, আমি কে-বাঙালি-বাঙালি। জাগো, জাগো, বাঙালি জাগো। নতুন এ আত্মপরিচয় ও আত্মোপলব্ধি তাদের দ্রুত ঐক্যবদ্ধ করল। ১৯৫২ থেকে ১৯৭০ সাল, মাত্র দু’দশকের মধ্যে এ ঐক্য প্রয়া সুসম্পন্ন হল। সত্তরের নির্বাচনে ৬ দফা ভিত্তিক স্বায়াত্ত্বশাসনের দাবীতে দেশের সিংহভাগ মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিল। প্রমাদ গুণল পাকিস্তানী শাসক শ্রেণী। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে চμান্ত শুরু করল তারা। এক সময়ে সশস্ত্র সেনা বাহিনী লেলিয়ে দেওয়া হল নিরীহ বাঙালির উপর। প্রতিরোধে গর্জে ওঠল বাঙালি। শুরু হল যুদ্ধ। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ! যুদ্ধ করতে করতে এবার বাঙালি আবারো স্বপ্ন দেখল আর কোন শুভঙ্করের ফাঁকি নয়, এবার স্বাধীন-বাংলায় কায়েম হবে বাঙালির শাসন। বিজাতীয় শোষণের বিপরীতে তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ হবে, সুখী, সম্মৃদ্ধশালী, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও শোষণমুক্ত একটি দেশ। নয় মাসের রক্তাক্ত যুদ্ধের পর ইতিহাসের নজিরবিহীন ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হল স্বাধীনতা। সদ্য-স্বাধীন দেশের সংবিধানে প্রতিফলিত হল জাতির সে আশা-আকক্সক্ষা। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি সংবিধানে সংযোজিত হল রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি হিসাবে। একটি আধুনিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের লক্ষ্যে গৃহীত এ সকল নীতিমালা ছিল অনন্য। কিন্তু নীতিমালার বাস্তবায়নটা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু না, সদ্য স্বাধীন দেশ জাতির আকাক্সক্ষার সাথে সমন্বয় রেখে বেশি দিন এগুতে পারলনা। ১৯৭৫ সালের আগস্টে এক রক্তাক্ত প্রতিবিপ¬ব বাঙালির স্বপ্নসাধকে যেন গুড়িয়ে দিল। বিপন্ন হল গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র তথা শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন পঁচাত্তুরের ১৫ ই আগস্ট কিছু উচ্চাভিলাসী সামরিক দুর্বৃত্ত গুড়িয়ে দিল জাতির শেষ ভরসা এক মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে। ’৭৫ এর রক্তাক্ত ও প্রতিবিপ্লবী রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে উল্টে দেওয়া হল সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত উন্নয়নের গতিপথ। আবার যাত্রা শুরু হল সেই পরিত্যক্ত পাকিস্তানী অন্ধকার যুগের দিকে। আবারও সামরিক শাসনের পাকিস্তানী ভূত সওয়ার হল বাঙালি জাতির ঘাড়ে। একজন উর্দীপরা সামরিক জেনারেল তার বেয়নেটের খোঁচায় লাখো শহীদের রক্ত দিয়ে লেখা সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদকে করলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। কী হাস্যষ্পদ ও সীমাহীন আস্পর্দা! সূদীর্ঘ দু’যুগের ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলন ও একটি রক্তাক্ত জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানের মূলনীতিমালা একজন সামরিক জেনারেলের ইচ্ছাই এভাবে মুছ ফেলা যায়? কিংকর্তব্যমিূঢ় জাতিও যেন সম্মোহিতের মত নীরবে তা মেনে নিয়ে কালাতিপাত করতে লাগল। আরেক সামরিক স্বৈরশাসক রাষ্ট্রকে খৎনা করিয়ে মুসলমান বানাল ইসলামকে করল রাষ্ট্রধর্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলুণ্ঠিত করে। ধর্ম তথা উপাসনা ধর্ম থাকে মানুষের। এখন রাষ্ট্রেরও ধর্ম হল। এবার জাতির শুধু স্বপ্নভঙ্গই ঘটল না, বরং যাত্রা শুরু হল উল্টা পথে। জাতীয় নেতা-নেত্রীরা গণতন্ত্রের জন্য আবার আন্দোলনের কথা বললেও জনগণ যেন তাদের উপর আস্থা রাখতে পারছিল না। জনগণের আস্থা অর্জন করতে আন্দোলনরত রাজনৈতিক জোটগুলো একটি কর্মসূচী জাতির সামনে তুলে ধরল যা তিন জোটের রূপরেখা নামে খ্যাত হল। নয় বছরের স্বৈরশাসনে দেওয়ালে-পিঠ-ঠেকে-যাওয়া অতীষ্ট জনগণ একসময় ঐক্যবদ্ধ হল; আবার আশায় বুক বাঁধল; আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাজুল, সেলিম, দেলোয়ার,রাউফুন বসুনিয়া, ডা. মিলন, নুর হোসেনরা রক্ত দিলÑস্বৈরাচারের পতন হল। অতঃপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হল; ক্ষমতাসীন হল জাতীয়তাবাদী দল। ক্ষমতার পাঁচ বছরে তিন জোটের রূপরেখার বিন্দু-বিসর্গও তারা বাস্তবায়ন করল না। জনগণের আবারো স্বপ্নভঙ্গ হল। জনগণ যেন মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করল কেবল ভোটে নির্বাচিত হলেই একটি সরকার গণতান্ত্রিক হয় না। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় গিয়ে মানুষের মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত করলে, সারের দাবী করায় কৃষকদের বুকে গুলি চালাল, তাদের পৃষ্টপোষকতায় নারী নির্যাতন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপকর্ম চললে সে সরকার আর গণতান্ত্রিক থাকে না বরং স্বেরতন্ত্রের চেয়ে নিকৃষ্ট হয়ে পড়ে সে সরকার। একটি নির্বাচিত সরকারের এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে জনমন যখন অতীষ্ঠ হয়ে উঠল, তখন পরবর্তী নির্বাচনী-বৈতরণী পার হওয়ার জন্য প্রণীত কারচুপির নীল নক্শা উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ল মাগুরার উপ-নির্বাচনে। তখন দাবী ওঠল, এ সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন নয়, প্রয়োজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আন্দোলন, একতরফা একদলীয় নির্বাচন, সে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ কর্তৃক সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন পাশ অতঃপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হল আওয়ামী লীগ। সুদীর্ঘ একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসল। বাঙালির স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় আশান্বিত হল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল জনগণ। তারা আবার আশায় বুক বাঁধলেন। কিন্তু সে আশা কুহকিনীÑএবারও স্বপ্নভঙ্গ। জনগণের আকাক্সক্ষার সাথে সঙ্গতি রেখে তারাও তেমন কিছু করতে পারল না। দেশে বিদ্যমান অপশাসন ও ঘুষ-দুর্নীতির বিপরীতে সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের পথে তাদের কোন সৎ উদ্যোগও পরিলক্ষিত হল না। তাদের শাসনামলেও দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চাঁদাবাজি, নারী-নির্যাতন, এমনকি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা ইত্যাদি অব্যাহত থাকল। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার প্রক্রিয়াটিও তারা শেষ করে যেতে পারল না। বরং ফেনী, চাতক, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল সহ আরো অনেক জনপদের রাজা বনে গেলেন কিছু দলীয় নেতারাÑযাদের আদেশে-নির্দেশে চলত সে সব এলাকার প্রশাসন। আবার নির্বাচনÑতত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এবার স্বাধীনতা বিরোধী জামাত-শিবির চμের পাশাপাশি আরো কিছু মৌলবাদী শক্তির সাথে আঁতাত করে ক্ষমতাসীন হল বি,এন, পি, তথা চারদলীয় জোট। দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জিতে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করল। এবার তারা যেন দেশ শাসন ও জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনের অবাধ লাইসেন্স পেয়ে গেল। ঘুণাক্ষরেও তারা ভাবতে পারল না যে, দেশে জনগণ বলে কিছু একটা আছে। তাদের এক মন্ত্রীÑদুর্নীতির অভিযোগের জবাবে প্রকাশ্যেই বললেন, ‘জনগণ আমাদের পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতা দিয়েছে (দায়িত্ব নয়, ক্ষমতা!), আমরা যেমন খুশী তেমন চালাব। কারো কিছু বলার নেই।’ আসলেই কারো কিছু বলার ছিলনা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া। তারা খেয়াল-খুশী মত দেশ চালিয়েছে পাঁচটি বছর। দেশ চালানো নয়, এ যেন লুঠপাটের মহোৎসব। চারদিকে শুধু লুঠপাট-লুঠপাট আর লুঠপাট ! হরিলুঠ বললেও সঠিক বলা হবে না। লক্ষ লক্ষ নয়, কোটি কোটিও নয়, শত শত কোটি, হাজার হাজারকোটি টাকা লুঠপাট করে তারা বিদেশে পাচার করে দিল। তাতে ও তাদের ক্ষিধে মিঠে নি। গরীবের রিলিফের টিন, শাড়ী-লুঙ্গি, বিস্কুট, বেবী-ফুড এগুলোও তারা উদরপুর্তি করল। ওয়ার্ড কমিশনার, স্থানীয় নেতা, পাতি-নেতা, সাংসদ, হুইফ, নেতা-নেত্রীদের আত্মীয়-স্বজন, পুত্র-ভাগ্নে-ভাতিজাদের বাড়াবাড়ি, মোবাইল ফোন ছিনতাই করতে গিয়ে দোকানীকে হত্যা, বাড়ি দখল, নদী দখল, হাট-বাজার-মাট-ঘাট দখল, সেতু হজম, খাস জমি, জলমহাল, হাওড়-বাওড় দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সার কেলেঙ্কারী, জঙ্গী তোষণ-পোষণ, ঘরে তালাবদ্ধ করে বাড়ি শুদ্ধ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হত্যা, নাÑফিরিস্তি শেষ করা যাবে না। কোন সেক্টরের কোন সম্পদ বাকী থাকল না এসব বুভুক্ষু নেতা-কর্মীদের লোলুপ থাবা থেকে। শুধু পুরো দেশটা তাদের নামে ছাফ-কবলা করাটাই বাকী ছিল। সেটাও হয়ত পরবর্তী মেয়াদের জন্য রাখা ছিল। স্মর্তব্য যে, এ দুর্নীতি বিএনপি শুধু একা করে নি, তার হিস্যাদার ছিল সৎ-লোকের-শাসন ও আল−াহের-আইন-কায়েম করার আন্দোলনে রত সে জামায়াতে ইসলামী দলটিও। জামায়াত এর নেতারা ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু দুর্নীতি করেছে, তার চেয়ে ঢের বেশী করেছে সাংগঠনিক দুর্নীতি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে দলীয় লোক নিয়োগ দিয়ে। ক্ষমতার সামান্য হিস্যা পেয়ে তাদের নেতাদের ব্যক্তিগত দুর্নীতির যে পরিমাণ, তাতে ঐ সমস্ত সৎ লোকদের আসল চেহারা মানুষের কাছে ফক্ফকা হয়ে গেল। অতঃপর পরবর্তী নির্বাচনেও যাতে কোন দল আর ক্ষমতায় আসতে না পারে, তার ব্যবস্থাও ষোল আনা পাকা করে ফেলা হল। কোন প্রকার রাখ-ঢাক ছাড়া দেশের সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠী দেখিয়ে, দলীয় রাষ্ট্রপতিকেই তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত করল। আর রাষ্টপতিও বা কেমন, বিশ্ব বিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী বয়োবৃদ্ধ একজন মানুষ সকল লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে, সুতার টানে পুতুল নাচের মত, নেত্রীর ইচ্ছায় সকল কর্ম করে যেতে লাগল। দেশের মানুষকে তারা ভাবল বোকারাম। এক ভাঁড় নির্বাচন কমিশণারের নেতৃত্বে, কেন্দ্র থেকে জেলা পর্যন্ত নির্বাচনী ব্যবস্থাকে দলীয় লোক দিয়ে এমনভাবে সাজানো হল, ২২ জানুয়ারী, ২০০৭ এর নির্বাচন হলে হয়ত তিনশ আসনই ৪ দলীয় জোটের দখলে চলে যেত। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের একটি মাত্র ভুল চাল, পোষা নির্বাচন কমিশনার দিয়ে এরশাদের মনোনয়ন বাতিলÑপুরো নীলনক্সাকেই ভণ্ডুল করে দিল। তা না হলেÑক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র বাসনায় অস্থির মহাজোটও চার দলীয় জোটের নির্বাচনী ফাঁদে পা দিয়েই ফেলেছিল। অতঃপর এরশাদ ইস্যূতে মহাজোটের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা, অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাচনী প্রস্তুতি, পরিণামে রাজপথে নজিরবিহীন সহিংসতা, প্রকাশ্যে দিবালোকে জীবন্ত মানুষকে পিটিয়ে হত্যা, ইত্যাদি মর্মন্তুদ ঘটনার প্রেক্ষিতে ঘটে গেল ১১ই জানুয়ারী, ২০০৭ ইং এর পট-পরিবর্তন। পুরো দৃশ্যপট গেল উল্টে। নিজেদের পাতা ফাঁদে যেন নিজেরাই ধরা পড়ে গেল। ক্ষমাতাসীন হল বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ক্ষমতায় এসেই তারা প্রথমে ঢেলে সাজাল নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশণ। শুরু করল বিচার বিভাগকে প্রশাসন থেকে আলাদা করার প্রμিয়া। নবগঠিত দুর্নীতি দমন কমিশন ও গুরুতর অপরাধ ও দুর্নীতি দমন সমন্বয় পরিষদ শুরু করল দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান। এক এক জন মন্ত্রী, সাংসদ, সাংসদ-জায়াপুত্রদের দুর্নীতির চালচিত্র, লুঠপাটকৃত সম্পদ ও টাকা উদ্ধারের অভাবনীয় টেলিফিল্ম প্রতিদিন জাতি দেখতে লাগল প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার মাধ্যমে। প্রতিদিনের চমক আগের দিনের চমককে ম্লান করে দিচ্ছিল। নেতা-নেত্রীদের ব্যক্তিগত আলিসান বাগান বাড়ি, চিড়িয়া খানাÑযে চিড়িয়াখানায় আবার বিদেশী হরিণ থেকে অজগর সাপসহ নানা দুলর্ভ প্রাণী বিদ্যমান ছিল দেখে সাধারণ মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হল। আমাদের তথাকথিত জাতীয় নেতা-নেত্রী, যাদের হাতে এতদিন ছিল আমাদের ভাগ্য নির্ধারণের ভার, তাদের সুন্দর মুখোশের আড়ালের কুৎসিত চেহারা দেখে আমজনতা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ল। প্রমবারের মত মানুষ বুঝতে পারল এবং বিশ্বাস করা শুরু করল, না, কেউ আইনের উর্ধ্বে নন। জাতির মনে একটি ক্ষীণ আশা জাগল এবার বুঝি দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, দেশ সুশাসনের দিকে এগিয়ে যাবে, ঘুষ-দুর্নীতি নির্মূল হবে। অপরাধী দুর্নীতিবাজ দুর্বৃত্তদের কবল থেকে দেশের রাজনীতি মুক্ত হবে দেশের মানুষ মুক্ত হবে। কিন্তু না, বাঙালির ভাগ্যে সেটা যেন হওয়ার নয়। তাই আবার ছন্দ-পতন ঘটল! তত্ত্বাবধায়ক সরকারর হঠাৎ করে আপোষকামী হয়ে বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত নেতা-নেত্রীদের তোষামোদি মোসাহেবী শুরু করল। সরকারী ডেকোরাম ভঙ্গ করে মিডিয়ায় চেহারা দেখাতে উম্মুখ উপদেষ্টারা রীতিমত সে সকল নেতা-নেত্রীদের বাসায় বাসায় ধর্ণা দিতে লাগল, যাদের বিরুদ্ধে গুরতর দুর্নীতির অভিযোগ তারা এনেছেন। একই সাথে জোরদার হয়ে ওঠতে লাগল কারাভ্যন্তরে থাকা নেতা-নেত্রীদের মুক্তির দাবী। নিঃশর্ত মুক্তি ! কোন বিচার করা যাবেনা! এরা যেন ঈশ্বরের বরপুত্র-কন্যা! যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একজন খুনীকে ব^াঁচানোর জন্য শত কোটি টাকা ঘুষ নেয় সেও এখন রাজবন্ধী। এদেশের মানুষ রাজবন্ধী শেখ মুজিবকে দেখেছে, দেখেছে সহরোয়াদ্দী, মওলানা ভাসানী, তাজুদ্দিন, ফরহাদ-মনিসিংহ সহ আরো কত জাতীয় ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে যারা কারান্তরালে গেলেও তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা হয়েছে, তাদের নিরাপত্তা আইনে বন্ধী করা হয়েছে; কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোন অভিযোগ কখনো আনতে পারে নি সেই ঔপনিবেশিক সরকারগুলোও। আর আজ যাদের বন্ধী করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ আছে। অনেকের অভিযোগ এখনো প্রমাণিত হয়নি সত্য, হয়তবা তাদের কেউ কেউ স্বাক্ষী প্রমাণের অভাবে ছাড়াও পেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু তারা যে বিভিন্ন মাত্রায় দুর্নীতি করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন, প্রাসাদোপম অট্টালিকা নির্মাণ করেছেন, সেটা কি আদালতে প্রমাণের অপেক্ষা রাখে? কারা তাদের মুক্তি কামনায় পঞ্চমুখ হল ? নিশ্চয় যারা লুঠপাটকৃত হালুয়া-রুটির ভাগ পেয়েছেন, তারা। তারা চাইতেই পারে, কিন্তু সরকার কেন হঠাৎ করে এ সকল দুর্বৃত্তদের প্রতি সদয় হয়ে ওঠল ।
সাধারণ মানুষ কিন্তু তখনি বলাবলি শুরু করেছিল বলছিলাম না, কিছুই হবে না, যে লাউ সে কদু। সেই তোড় বড়ি খাড়া, আর খাড়া বড়ি তোড়। কারারুদ্ধ নেতা-নেত্রীরা দলে দলে ফুলের মালায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে, বিজয় সূচক ভি চিহ্ন দেখিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে আসল। খল নায়কেরা আবার নায়কের ভূমিকায় আবির্ভূত হতে লাগল। বিচারের বাণী আবারো কাঁদতে লাগল নীরবে-নিভৃতে। অনুষ্ঠিত হল সাধারণ নির্বাচন। ভোট গ্রহণ ও ফলাফল ঘোষণায় কোন কারচুপি হয়েছে সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। তবে যে কথা নির্দ্বিধায় বলা যাবে, তাহল কাল টাকার দৌরাত্য থেকে নির্বাচনকে রক্ষা করতে এবং নির্বাচনী আচরণ বিধি মেনে চলতে বাধ্য করাতে নির্বাচন কমিশন চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তবুও মানুষ ভোট দিয়েছে দলে দলে। সামনে অপর কোন বিকল্প না পেয়ে মানুষ দলে দলে ভোট দিল তথাকথিত মহাজোটকে-যে জোটে স্থান করে নিয়েছে সে পতিত স্বৈরাচারসহ কিছু ধর্মভিত্তিক দল। বিপুল ভোটে নয়, তবে বিপুল আসনে জিতল মহাজোট। মানুষ আশায় বুক বাঁধল। এবার মহাজোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের সুন্দর সুন্দর অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়ন করবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যুগান্তকারী ভাল কাজগুলোÑদুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে আরো কার্যকর করণ, নির্বাচন কমিশনকে আরো স্বাধীন ও শক্তিশালী করণ, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে সে সকল অভিযোগ স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিষ্পন্নকরণ, দলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, হলদখল, ভূমি দখল ইত্যাদি বন্ধকরণ, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি তারা করবে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারসহ সকর হত্যাকান্ডের বিচার তারা করবেন। মানুষ আবারো স্বপ্ন দেখতে লাগল।
ইতোমধ্যে মহাজোটের একবছর শাসনকাল অতিক্রম হয়েছে। একটি সরকারের এক বছর, তার কার্যক্রম মূল্যায়নের জন্য মোটেও যথেষ্ট নয় সত্যি, তবে এক বছরের কার্যক্রমে একটি সরকারের উন্নয়নের গতিপথ, তার রাজনৈতিক সদিচ্ছ বা অঙ্গীকার বুঝার জন্য কিন্তু খুব কম সময়ও নয়। কি দেখছেন জনগণ এ স্বল্প সময়ে? বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কার্যকারীতা কি আছে? দুর্নীতি দমন কমিশনের কী অবস্থা? অভিযুক্ত ব্যক্তিদেরত দলে দলে মামলা প্রত্যাহারের মাধ্যমে মুক্ত করে হিরো বানানো হচ্ছে তাও আবার সিংহভাগ সরকারী দলের। তারা বরং উল্টো তাদের বিরুদ্ধে যারা দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল তাদের বিচার দাবী করছে বুক ফুলিযে যেন চোরের মায়ের বড় গলা। পাল্টা মামলাও করছে অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে। কলেজে কলেজে আবার সে পুরানো কায়দায় অস্ত্রের মহড়া, হল দখল,খুন জখম চলছে। চলছে চাঁদাবাজি, ভূমি দখল, ঘের, হাউড়-বাউর-সমুদ্রপাড় দখল। তবে ঘটনার নায়কের অবশ্যই পরিবর্তন হয়েছে। দ্রব্যমুল্যের কি অবস্থা? এখনো কেন সিন্ডিকেটের দোহাই দেওয়া হচ্ছে? আর জাতীয় সংসদ এর কী হাল? সে পুরানো কায়দায় সংসদ বর্জন চলছে শুরু থেকেই। বৃহৎ বিরোধী দল সম্মেলনের নামে, গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে দল থেকে গণতন্ত্রকে নির্মূল করে তাদের নেত্রীর ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করেছে। দুর্নীতির জীবন্ত কিংবদন্তী রাজপুত্রকে দলের দ্বিতীয় ও ভবিষ্যতের প্রথম কর্ণধার বানিয়ে বিভিন্ন ঘোরতর অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে জানিয়ে দিয়েছে তাদের এ সকল অপকর্ম-কুকীর্তি তারা ভবিষ্যতেও ক্ষমতায় গেলে অব্যাহত রাখতে পারবে। সংসদের সামনে আসনে সারিতে বসার শিশুসুলভ আবদার নিয়ে লাগাতার বর্জন করে যাচ্ছে সংসদ। সে পুরানো খেলার রি-প্লে। তাহলে কি হবে জাতির ভাগ্যে? কতদিন চলবে জাতির স্বপ্ন নিয়ে এ লুকোচুরি খেলা? জাতি কি আবারো স্বপ্নভঙ্গের বেদনা দীর্ণ-বিদীর্ণ বক্ষে ধারণ করার মানসিক প্রস্তুতি নিবে? স্বপ্ন দেখা এবং স্বপ্নভাঙ্গাই কি জাতির একমাত্র ভবিতব্য? কি জানি? অনাগত ভবিষ্যত তার সঠিক জবাব দিবে।