জল তার জীবনটাকে সরলভাবেই সাজাতে চেয়েছিল। কিন্তু আধুনিক জীবনের অনুসঙ্গ কত কিছু যে মনে রাখতে হয়। এক ডজন পাসওয়ার্ড। অফিসে নিজের পি সিতে লগ ইন করতে পাসওয়ার্ড, অফিসের লোটাস নোটে ইন করতে পাসওয়ার্ড।
জি মেইল ও ইয়াহু দুটোতেই একাউন্ট আছে। কাজেই লগ ইন করতে পাসওয়ার্ড। এমনকি কয়েকটি ওয়েব সাইট খুলতেও প্রয়োজন পাসওয়ার্ড। এ টি এন কার্ডে টাকা উঠাতে পাসওয়ার্ড। আধুনিক জীবন যাপনের জটিল জটে আটকে থাকা জীবন।
কাজেই নিজের একান্ত জীবনে কোন সামাজিক পাসওয়ার্ড মানতে নারাজ জল।
আর জলকে সারাক্ষণ থাকতেও হয় এ সব প্রযুক্তি নিয়ে।
বই!
না, হার্ড কপিতে জল আর নেই। সব সফট কপি। পড়ো। হয় ফাইল কর বা মুছে ফেল।
আবার দুয়েকটি ওয়েব সাইট নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে তালা বদ্ধ করে রাখে। তাদের সংকলিত উপন্যাস বা ছোটগল্প পড়া যায়, কিন্তু প্রিন্ট করা যায় না। প্রযুক্তির কতো কারসাজি। ভালোইতো, উপভোগ কর – প্রিন্ট করার মতো ফ্যাসাদে যাওয়া কেন? থাক, খাও, শোও কিন্তু কিসের ঘর বাঁধা?
প্রিন্ট নেয়ার ঝামেলা নেই। প্রমাণও নেই। প্রিন্টের জন্যে কাগজ কালির খরচ নেই। কাগজ রাখার জন্যে সেলফেরও দরকার নেই। নেই— নেই—। জলের কোন কিছুরই বোঝা নেই। আইনের বাধ্যবাধকতা নেই। তথাকথিত পারিবারিক দায়বদ্ধতা নেই। রোমান্টিক বন্ধনের বেড়াজালে আটকে থাকা নেই।
কিন্তু জল তার নিজের জীবনটা এমন হাত পা ঝাড়া আর রাখতে পারছে না বুঝি। গতানুগতিকই হয়ে যাবে কি! জীবনের আর কোন নিজস্বতা থাকবে না।
হঠাৎ করেই তরুর কাছে প্রিন্ট নেয়ার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। তার মতে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার বেহাল অবস্থায় সব সময় পি সিতে পড়ার উপায়ও নেই।বাসায় ব্রডব্যন্ডের লাইন। প্রায়শঃই ইন্টারনেটের নিশ্চয়তা থাকে না। কাজেই কিছু কিছু প্রিন্ট নেয়াই শ্রেয় বলে প্রথমে ছিল তরুর ধারণা, পরে পরামর্শ এবং এখন অনুরোধ। মাঝে মাঝে আইনের জুজুবুড়ি ভয় আর সামাজিক রীতিনীতিকেও টানছে। যদিও জল নড়ছে না।
তরুর মতে জীবনের বেলায় কোন কোন জায়গায় ছাড় দিতে হয় — আপোষ করতে হয়। আপোষ ছাড়া মা বাবা মানে না। ভাইবোনে শুনে না। অফিসে চলে না। বন্ধুরা ভিড়ে না। প্রতিবেশিরা পুছে না। আত্মীয়-স্বজন বুঝে না। এখন জল টের পাচ্ছে তরুও ছাড়তে চাচ্ছে না।
এখন কী করবে বুঝে পাচ্ছে না। পথ খুঁজে পাচ্ছে না। না আর আপোষ নয়।
কয়েক বছর আগে প্রথম বাসায় ইন্টারনেট নিয়ে দৈনিক পত্রিকা রাখা বন্ধ করে দিয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল বিভিন্ন পত্রিকার ইন্টারনেট সংস্করণ পড়বেন। মাসে ইন্টারনেট খরচের টাকার প্রায় দুইশ’ টাকা উঠে আসবে। কিন্তু মাস খানেকের বেশি চালাতে পারেনি।
বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার ও ব্রডবেন্ডের লাইন সংযোগের সমস্যা ছাড়াও আরাম পাওয়া যাচ্ছিল না। জলের এলাকার ভাষায় যাকে বলে জোত পাওয়া যাচ্ছিল না। হাতে পত্রিকা নিয়ে বসে পড়ার আরামই আলাদা। তরু এখন সে আরাম চাচ্ছে।
আজকের জোত না পাওয়াটাও ঐ সবের মতো । তবে আরও একটু কুটকুটে। কেমন যেন তাকে খুটাচ্ছে। ঘুটাচ্ছে। এ নিয়ে তরুর প্যানপ্যানানিতে অতিষ্ঠ জল।
গত সোমবার সকালে অফিসের লিফটে উঠে বেশ খানিকটা সময় পরে মনে হলো লিফটটি নড়ছে না। পরে খেয়াল হলো বাটন চাপা হয়নি। তাড়াতাড়ি চারতলায় যাবার বাটনে চাপ দিতে উদ্যোগ নিতেই দরজা খুলে তিনজন সহকর্মী ঢুকে বলল—চাপ না দিয়েই মনে হয় দাঁড়িয়েছিলেন?
হ্যাঁ, বাটনে চাপ দিতে যেতেই তো আপনারা খুলে ফেললেন।
ফোঁড়ন কাটায় অভ্যস্থ সহকর্মীটি বললেন — তাতো অবশ্যই, আপনার মতো অপেক্ষায় থাকলে তো সময় বয়েই যাবে।
সহকর্মীর ইঙ্গিত বুঝেও জল উত্তর দেয়নি।
প্রায় তিন মিনিট অনর্থক লিফটে দাঁড়িয়ে থেকে পরে জলের হুঁশ হয়েছিল। কাজেই আর কথা বাড়ায়নি। ফোঁড়ন কাটার তাৎপর্য বুঝেও না।
প্রায়শঃই এমনটি হচ্ছে। মোবাইলে নাম্বার খুঁজে বা টাইপ করে প্রায় আধা মিনিট কানে ধরে রেখে রিং টোন না শুনে মোবাইলের মনিটরে দেখে সবুজ বাটনেই চাপ দেয়নি।
আবার অফিসে পিসিতে বসে দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি লোটাস নোটে অফিসিয়েল ইমেইল করা ছাড়াও জি মেইল ও ইয়াহু দুটো একাউন্টই খোলা। বন্ধু বান্ধবকে টুকটাক উত্তর দিচ্ছে ফাঁকে ফাঁকে। ঘন্টা চারেক পর খেয়াল করে দেখে একটা জরুরী বিষয় একজনকে জানানো হয়নি তবে লেখা আছে। এরই মধ্যে কখন সেন্ড লেখায় ক্লিক না করেই জি মেইল মিনিমাইজ করে রেখে দিয়েছে।
আনমনা থাকার কারণ জলের নিজের কাছে ধীরে ধীরে পরিস্কার হচ্ছে। আঁধার কেটে ভোর হচ্ছে। হঠাৎ তরুর ঘরোয়া আকাঙ্ক্ষা জলকে আনমনা করে তুলেছিল। এখন সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে।
না সিদ্ধান্ত গ্রহণে জলের আর দেরী নয়। দ্বিধা – দ্বন্দ্ব নয়। গতানুগতিকতায় পাখা মেলবে না। নিজের জগতে একচ্ছত্রাধিপত্য করবে নিজেই। কোন রাজা প্রজার অস্তিত্ব বা ভূমিকা মানতে নারাজ জল।
তবে জল নিজের ভালোবাসায় তরুকে ভাসিয়েছে এবং নিজেও তরুর নিকশিত হেমে ভেসেছে, ডুবেছে, সাঁতরেছে। তরুর সাথে ঘুরেছে, খেলেছে, খেয়েছে, হেসেছে এবং তাকে হাসিয়েছেও। পারস্পরিক সমঝোতায় সময় বয়েছে। প্রকৃতির স্বতঃসিদ্ধ নিয়মে পাহাড়ের ঝর্ণা কলকলিয়ে সাগরে গেছে। তার আবেগে ভেসে গেছে সব কূল।
জল নিজের নাড়ির টানে এবং নিজের দায়িত্বে তার প্রজন্মকে পৃথিবী চিনাতে চায়।
জল মোটেই হতাশ নয়, অথচ তরু যেচে আশ্বাস দিচ্ছে —- ভেবো না আমি তো আছি।
অনাগতকে নিয়ে সে সুস্থির অবস্থানেই আছে, অথচ তরু বাড়তিভাবে স্বস্থির কথা বলছে—-আমি তার পিতৃত্বের ভার নেব।
জল ভাবে — ভার কেন ? জলতো কাউকে কোন ভার দিতে চায় না। অনাগত কী বোঝা যে তরু ভার বইতে চায়!
জল আবেগতাড়িত কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না, যদিও তার সাথে ঘর বাঁধতে তরু অফুরন্ত যুক্তি খাড়া করছে —- বিয়ে করতে না চাও, চলো এক বাসায় থাকি। লোকে তো আর দলিল দস্তাবেজ হাতাবে না।
নিজেদের জীবন নিয়ে তরুর লোককে এত গুরুত্ব দেয়ার কী আছে ! জল এসব বিষয়ে তরুর সাথে মতামত মিলাতে পারছে না।
আইনী বাঁধা নয়, সামাজিক রীতির অনুসরণ নয়, শুধুই একসাথে সহাবস্থান।
জল তরুর সব আশ্বাস, বিশ্বাস, নিশ্বাস ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আযৌবন পালিত ধ্যানই ধারণ করে থাকবে আজীবন। অনাগতকে আলোর মুখ দেখাবে নিজের পরিচয়ে।
একলা চলাই জলের অহংকার।
ব্রাইট স্মাইল,
জলদের সাহসী পদক্ষেপের সময় সমাগত।
ফরিদ,
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে’ তো একলাই শুরু করতে হবে।
কেয়া,
জীবন যাপনের নিজস্ব এক মহাযাত্রায় যদি বিকল্প পথে কেউ হাঁটতে যায় তবে তো চিন্তার ভারে একটু অন্যমনষ্ক হতেই পারে।
গল্পটা মন দিয়ে পড়লাম। পড়তে পড়তে বেশ হাসলাম। কারণটা বলি – যখন পাসওয়ার্ড আর টেকনোলজির কথা পড়ছিলাম ঠিক তখনি আমি এক যন্ত্র নিয়ে যন্ত্রণায় ছিলাম। এবারে বড়দিনে সান্টা ক্লজ আমায় একখানা অত্যাধুনিক ডিরয়েড ফোন দিয়েছে। সেই অবধি খুবই বিব্রতকর অবস্থায় আছি। প্রযুক্তির সাথে তাল মেলানো সহজ হচ্ছে না আমার। কেমন যেনো বন্দী মনে হচ্ছে নিজেকে।
মুল প্রসঙ্গে আসি, জলরা একলা চলতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত সমাজ তাদের কতদুর যেতে দেয় তা’ কিন্তু ভাববার বিষয়। আমার কেনো যেনো কেবলি মনে হয় বিষয়টা বোধহয় একা থাকবার বা না থাকবার নয়। মুল কথাটা বোধহয় লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে যাওয়া । সে ক্ষেত্রে জলের অন্যমনষ্কতা আমাকে ভাবায়।
এই পথ চলায় সমমনা সঙ্গী থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে কিন্তু পথ চলা আর লক্ষ্য স্থির রাখাই শ্রেয়। সহযাত্রীর উপস্থিতি কখনো জরুরী, কখনো অতি তুচ্ছ। আর জীবন যাপনই তো নিজস্ব এক মহাযাত্রা।
দিদির গল্পের সব চরিত্ররাই দেখি একলা চলতে চায়।
ভালো লাগলো পড়ে।
জলের এমন সাহসী পদক্ষেপে জলকে অভিনন্দন।