ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন- [০১] [০২] [০৩]
০৪
শনিবার ১১ জুলাই ১৯৯৮
ভিক্টোরিয়া ভিস্তা হোটেল
আজ নিয়ে তিনদিন কাটলো মেলবোর্নে। তুমি এখন কী করছো? আমি সারাদিন সারাসন্ধ্যা বাইরে কাটিয়ে এখন তোমাকে লিখতে বসলাম। অবশ্য সারাদিন বলা ঠিক হচ্ছে না, বলা উচিত অর্ধেক দিন। কারণ আজ রুম থেকে বেরিয়েছি এগারোটার পর।
আজ সকালেও ঘুম ভেঙেছে টেলিফোনের শব্দে। মনে হচ্ছে এদেশে টেলিফোনগুলো এলার্মের কাজও করে দেয়। ধড়ফড় করে উঠে মাথার কাছে রাখা রিসিভারের দিকে হাত বাড়াতেই প্রচন্ড ব্যথায় চিৎকার করে উঠলাম। শুধু হাতে নয় – হাঁটুতেও প্রচন্ড ব্যথা। মাথা ঝিমঝিম করছে। আবার শুয়ে পড়লাম। দুটো রিং হয়েই ফোন অফ হয়ে গেছে। কে করেছিল কে জানে।
কাল রাতে জ্বর এসেছিল। দুটো প্যারাসিটামল খেয়েছি। কনুই আর হাঁটুতে সেভলন লাগিয়ে দিয়েছি। আর নিজেকে কষে ধমকে দিয়েছি – পৃথিবীজুড়ে কত মানুষ কত রকমের কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে টিকে থাকছে – আর আমার সামান্য এক ধাক্কাতেই গায়ের তাপমাত্রা বেড়ে গেলো? এত পুঁতু পুঁতু হলে চলবে না। কঠিনেরে ভালোবেসেছি, সুতরাং কঠিন হতে হবে আমাকে।
ডিমলাইটের আলোয় আবছা আলোছায়া রুমের ভেতর। মনে হচ্ছে- সকাল হয়নি এখনো। বালিশের নিচে রাখা হাতঘড়িটা চোখের সামনে ধরে কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম। সাড়ে দশটা বেজে গেছে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছি! বাংলাদেশে এখনো সাড়ে ছ’টা বাজে। সে হিসেবে খুব একটা বেশি নয়। জেটল্যাগ এখনো কাটেনি। জেটল্যাগের নাকি একটা নিয়ম আছে। প্রতি ঘন্টা সময়ের পার্থক্য এডজাস্টের জন্য একদিন সময় লাগে। সে অনুযায়ী কালকের মধ্যেই আমার জেটল্যাগ কেটে যাবে। সোমবার থেকে মেলবোর্নের সময় অনুযায়ীই ঘুম ভাঙবে।
এতক্ষণ ঘুমিয়েছি ভেবে অস্বস্তি লাগছে। আবার ব্যথার জন্য উঠতেও পারছি না। রুমহিটারের কারণে রুমের ভেতর আরামদায়ক উষ্ণতা। লেপের নিচে কুন্ডুলি পাকিয়ে আছি। কিন্তু না, শরীরকে এত বেশি প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হচ্ছে না। জোর করে উঠে গেলাম। নিজেকে একপ্রকার ঠেলে নিয়ে গেলাম বাথরুমে। রুমের বেসিনে হাতমুখ ধোয়া যায়, দাঁতব্রাশ করা যায়। কিন্তু টয়লেট আর শাওয়ারের জন্য বাথরুমে যেতেই হয়। করিডোরেও হিটার আছে। কিন্তু বাথরুমে কনকনে ঠান্ডা। টয়লেট পেপারে এখনো অভ্যস্ত হইনি। প্রায় আধরোল শেষ করার পরও অস্বস্তি যায় না। গরম পানির শাওয়ার নিয়ে তবে স্বস্তি। রুমে এসে ঝটপট বেরিয়ে পড়লাম। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা।
সোয়ান্সটন স্ট্রিটে বেশ ভীড় আজ। শনি রবি ছুটির দিন। তাই ছুটির আমেজে আছে সবাই। বেশ কয়েকটা ঘোড়ার গাড়ি চলছে রাস্তায়। অনেক ট্যুরিস্ট মজা করে চড়ছে ওখানে। সোয়ান্সটন স্ট্রিটের বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট ফুটপাতের উপর ঘেরা দিয়ে চেয়ার টেবিল বসিয়ে রেস্টুরেন্টের জায়গা বাড়িয়ে নিয়েছে। এর জন্য এদের কাউকে চাঁদা দিতে হয় কিনা জানি না। মনে হয় এদের পারমিশান আছে এরকম করার। অনেক ছোট ছোট নিউজ এজেন্ট দেখলাম ফুটপাতে। নানারকম ফলের দোকানও আছে কয়েকটা।
একটা রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে মেনু দেখছি। ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লেখা মেনু। ব্রেকফাস্ট মেনু, আরেকটা আছে ব্রাঞ্চ মেনু। ‘ব্রাঞ্চ’ বস্তুটা কী ঠিক বুঝতে পারছি না। ব্রাঞ্চ মানে তো শাখা। খাবার দাবারেরও শাখা-প্রশাখা আছে নাকি এখানে?
“ডু ইউ লাইক টু অর্ডার সামথিং?”
মেয়েটিকে দেখে আমার মনে প্রথম যে প্রশ্নটি এলো তা হলো – এদের কি ঠান্ডা লাগে না? এই হাড়-কাঁপানো শীতে সোনালী চুলের মেয়েটি জাস্ট একটা টি-শার্ট পরে আছে। আর কালো ট্রাউজারের উপর কোমরে বাঁধা একটি কালো এপ্রোন। ভয়ানক মোটা বলেই হয়তো তার ঠান্ডা লাগছে না। কিন্তু ঠান্ডায় আমি রীতিমত কাঁপছি। মেয়েটি হয়তো বুঝতে পেরেছে আমার অবস্থা। বললো, “ইউ ক্যান সিট ইনসাইড”।
রেস্টুরেন্টের কাউন্টারের পেছনেও ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লেখা মেনু। ইচ্ছেমত আপডেট করার জন্য ব্যবস্থাটা ভালোই। “Breakfast Special for only $3.50”- সাড়ে তিন ডলার এদের কাছে “মাত্র” হলেও আমার কাছে একশ পাঁচ টাকা। এরচেয়ে কমে এখানে আর কিছুই পাওয়া যায় না। স্পেশাল ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিয়ে দাম মিটিয়ে দেবার পর নাম্বার লেখা ছোট্ট স্ট্যান্ডের মত একটা জিনিস দেয়া হলো। ওটা নিয়ে ভেতরের একটা টেবিলে বসলাম। বাইরে ফুটপাতের চেয়ার টেবিলে ভেতরের চেয়ে বেশি ভীড়। এত ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে বসে খেতে কারো কষ্ট হচ্ছে বলে মনেই হচ্ছে না। পাশের টেবিলে চার পাঁচজন চায়নিজ ছেলেমেয়ে উচ্চস্বরে গল্প করছে। তাদের একজনের কথা কানে এলো – “ব্রেকফাস্ট প্লাস লাঞ্চ ইজ ব্রাঞ্চ”। এতক্ষণে বোঝা গেল ব্রাঞ্চ মানে কী।
“হিয়ার ইউ গো। ব্রেকফাস্ট স্পেশাল”।
বেশ বড় একটা প্লেট টেবিলে রেখে গেল বিশালদেহী মেয়েটি। প্লেটের একদিকে কাঁচা টমেটো আর শাকপাতার সাথে একটা ডিম পোজ। অন্যদিকে দু’পিস পাউরুটি আর দুই ফালি তেল জবজবে মাংস। কিসের মাংস জানি না। জানার দরকারও নেই। ডিমটা আধাকাঁচা, মাংসের অবস্থাও তথৈবচ। দেখেই গা গুলোচ্ছে আমার। কিন্তু খাবার নিয়ে এত বাছবিচার করার কোন মানে হয় না। গপ গপ করে খেয়ে নিলাম সব। এবার পেটের ভেতর যুদ্ধ শুরু না হলেই বাঁচি।
অনেকগুলো ঘোড়ার গাড়ি আজ সোয়ান্সটন স্ট্রিটে। ফুটপাতে নানা দেশের নানারকম মানুষ। শীতের পোশাকের কত রকম বৈচিত্র্য। পায়ে চাকা লাগানো জুতা পরে ফুটপাত দিয়ে প্রচন্ড গতিতে ছুটে যাচ্ছে অনেকে। একটা টু ডলার শপে ঢুকেছিলাম। সেখানে বেশির ভাগ আইটেমের দামই দুই ডলার। গত মঙ্গলবার সারাদিন রেয়াজুদ্দিন বাজারের অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে দাদা আমার জন্য ‘বিদেশী’ মোজা, টুথপেস্ট ইত্যাদি সব দরকারি জিনিস জোগাড় করেছে। এখানে দেখলাম সবগুলো জিনিসই পাওয়া যাচ্ছে – বাংলাদেশের চেয়েও কম দামে।
সোয়ান্সটন স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতেই পৌঁছে গেলাম মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে। ছুটির দিনেও ক্যাম্পাসে অনেক ছেলে-মেয়ে। ইতস্তত ঘুরলাম অনেকক্ষণ। এই বিশাল ক্যাম্পাসের পুরোটা কি কখনো দেখা হবে আমার?
গ্রাটান স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে লাইগন স্ট্রিট। রেস্টুরেন্ট পাড়া। রাস্তার দু’পাশের ফুটপাত রেস্টুরেন্টের দখলে চলে গেছে। সারি সারি চেয়ার টেবিল পাতা। প্রচন্ড ভীড় শনিবারের দুপুরে। বাইরে ঠান্ডা বাতাস থেকে বাঁচার জন্য প্লাস্টিকের তাবুর মত করা হয়েছে। বড় বড় গ্যাস হিটারের ব্যবস্থাও আছে। মনে হচ্ছে বেশির ভাগই ইতালিয়ান রেস্টুরেন্ট এখানে। মাসুদ সাহেব বলেছিলেন এদিকে কোথাও সুপারমার্কেট আছে। একজন বয়স্ক চায়নিজ ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলো। তাঁর ইংরেজিও আমার ইংরেজির মত কাঁচা।
লাইগন কোর্ট কার্লটন সাবার্বের শপিং সেন্টার। এর আন্ডারগ্রাউন্ডে সেফওয়ে সুপারমার্কেট। এমন বিশাল সুপার মার্কেট আগে দেখিনি কখনো। কয়েক শ’ মানুষ শপিং বাস্কেট হাতে নিয়ে বা শপিং ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে বাজার করছে। যার যা লাগে শেল্ফ থেকে নিয়ে কাউন্টারে গিয়ে দাম মিটিয়ে চলে যাচ্ছে। আমিও একটা বাস্কেট নিয়ে ইংলিশ মাফিন আর আপেল কিনলাম। দেখলাম ফুটপাতের দোকানের চেয়ে এখানে জিনিসপত্রের দাম অনেক কম।
কাউন্টারে দাম দিতে গিয়ে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার দেখে অবাক হলাম। এর আগে বড় দোকান বলতে রেয়াজুদ্দিন বাজারের পাইকারি দোকান দেখেছি। সেখানে ক্যাশিয়ার লম্বা কাগজে জিনিসের নাম লেখেন, দাম লেখেন আর ক্যালকুলেটর দিয়ে হিসেব করেন। এসব দেখেই আমার মনে হতো – ওরে বাবা – কত্তো কাজ! আর এখানে কাউন্টারে কম্পিউটারই সব করে দিচ্ছে। স্ক্যানার জিনিস-পত্র স্ক্যান করতেই কম্পিউটারে তার হিসেব লেখা হয়ে যাচ্ছে। আর দাম মিটিয়ে দিলে প্রিন্টার থেকে ছাপানো রসিদ বেরিয়ে আসছে। অনেকেই দেখলাম নগদ ডলারের বদলে ব্যাংক কার্ড বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন। মনে হচ্ছে আসল টাকা-পয়সার ব্যবহার আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। হাত থেকে হাতে ঘুরে বেড়ায় যে মুদ্রা – তা এখন সরাসরি একাউন্ট থেকে একাউন্টে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হোটেল রুমে চা, কফি, দুধ আর চিনি ফ্রি। চা, কফি আর চিনির অনেকগুলো ছোট ছোট প্যাকেট প্রতিদিন রেখে যায়। কেবল দুধটা নিয়ে আসতে হয় কাউন্টার থেকে। দুধ আনতে গিয়ে আজকেও দেখা হলো মাসুদ সাহেবের সাথে। কিছুক্ষণ কথা হলো। আমার একটা বাসা দরকার, পার্ট-টাইম চাকরি দরকার। কিন্তু কীভাবে পাওয়া যায় বা কীভাবে খুঁজতে হয় – কিছুই জানি না। মাসুদ সাহেব বললেন, শনিবার আর বুধবারের ‘এজ’ পত্রিকায় পার্ট-টাইম জব আর বাড়িভাড়ার অনেক বিজ্ঞাপন থাকে। আজ শনিবার। আজকের পেপারটা দেখতে হবে।
বাংলাদেশে পত্রিকা না কিনেও পড়া যায়। ফুটপাতে বসে যারা পেপার বিক্রি করে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে নিলেই হলো। এখানে সেরকম কোন ব্যবস্থা নেই। নিউজ এজেন্টে ঢুকে ম্যাগাজিনগুলো না কিনেই পড়ে ফেলা যায় আগাগোড়া। কিন্তু পেপার ওভাবে পড়ার সুযোগ নেই।
আজকের ‘দি এজ’ পত্রিকার দাম দেড় ডলার। একশ পঞ্চাশ পৃষ্ঠার শনিবারের কাগজ। খবর বলতে কিছুই নেই। প্রথম পৃষ্ঠায় বিরাট করে খেলার খবর। ভেতরের সবগুলো পাতাই নানারকম বিজ্ঞাপনে ভর্তি। ‘এমপ্লয়মেন্ট’, ‘একোমোডেশান’, ‘ড্রাইভিং’ ইত্যাদি সব আলাদা আলাদা সেকশান। একোমোডেশান সেকশানে শত শত ঘরভাড়ার বিজ্ঞাপন। সপ্তাহে একশ’ ডলারের নিচে কিছুই নেই। তদুপরি আমি তো কোন জায়গাই চিনি না এখনো। ঠিকানা দেখে বুঝতে পারছি না জায়গাটা কোথায়। সুতরাং এভাবে হবে না। আর পার্ট-টাইম চাকরির বিজ্ঞাপন যেগুলো আছে তার কোনটাই আমার জন্য নয় মনে হচ্ছে। যে সব যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে তার কিছুই তো আমার নেই। খুব একটা আশাবাদী হতে পারছি না।
আবার জ্বর আসছে। অসহ্য মাথাব্যথা। প্যারাসিটামল কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে নাকি? এখানের মেডিকেল সার্ভিস কীভাবে কাজ করে জানি না এখনো। আসার আগেই ওভারসিজ স্টুডেন্টস হেল্থ ইন্সুরেন্স বাবত ২৭৪ ডলার দিতে হয়েছে। ওটা কী কাজে লাগবে তাও জানি না। কিছুই তো জানি না আমি। বুঝতে পারছি – জ্বরের প্রভাব মাথার ভেতর ছড়িয়ে পড়ছে। কনফিডেন্স লেভেল কমে যাচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়। আত্মবিশ্বাস না থাকলে আমার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। আত্মবিশ্বাস হারালে চলবে না।
বাবার কথা মনে পড়ছে – “মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু হচ্ছে নিজের শরীর – যখন সুস্থ-সবল থাকে। আবার এই শরীরই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় শত্রু – যখন অসুস্থ হয়ে যায়”। শরীরের তাপমাত্রা ক্রমশঃ বাড়ছে। একটা লম্বা ঘুম দিলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঘুম আসছে না। চোখ বন্ধ করলেই স্মৃতির গর্ত থেকে উঠে আসছে এলোমেলো টুকরো টুকরো স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের দিনগুলো।
স্বপ্নের পরিধি আমার কখনোই খুব বেশি ছিল না। ইউনিভার্সিটির রেজাল্ট ভালো হবার পর স্বপ্ন দেখেছিলাম ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর। কোন অন্যায্য স্বপ্ন ছিলো না সেটা। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আমার অযোগ্যতা অনেক- ভুল সম্প্রদায়ে জন্ম নেয়া, কোন ধরনের রাজনৈতিক যোগাযোগ না থাকা, এবং সর্বোপরি কোদালকে কোদাল বলার স্বভাব। এই অমার্জনীয় অযোগ্যতা নিয়ে আমি অনেকগুলো ইউনিভার্সিটির অনেকগুলো সিলেকশান কমিটির মুখোমুখি হয়েছি। কমনওয়েল্থ স্কলারশিপ সিলেকশান কমিটির স্বরূপ দেখেছি, দেখেছি শিক্ষামন্ত্রণালয়ের শিক্ষাবৃত্তিগুলো পাওয়ার পরও কীভাবে হাত থেকে পিছলে বেরিয়ে যায়। বিসিএস মৌখিক পরীক্ষায় ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রসঙ্গে অপমান সইতে হয়েছে আমাকে। স্বপ্ন ভেঙেছে, কিন্তু পিছু ছাড়েনি। আবার স্বপ্ন দেখেছি – উচ্চতর শিক্ষার স্বপ্ন, নিজেকে যোগ্য করে তোলার স্বপ্ন।
কিন্তু স্বপ্নপূরণের যে রসদ লাগে তার জোগাড় যে কীভাবে হয়েছে তা কি তুমি জানো? তবুও ভালো যে চট্টগ্রাম শাহীন কলেজে চাকরিটি পেয়েছিলাম। ওটা না থাকলে দেশের বাইরের ইউনিভার্সিটিগুলোতে দরখাস্ত করার টাকা জোগাড় করতেও কষ্ট হতো আমার। টোফেল, জি-আর-ই, আই-ই-এল-টি-এস এসবের ফি-ও তো অনেক। দেশের বাইরে পড়ার খরচ যে কত বেশি তা বুঝতে শুরু করলাম – আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি থেকে ভর্তির অফার লেটারগুলো আসতে শুরু করার পর। তারা স্কলারশিপের আশ্বাস দেয়, কিন্তু অফার দেয় না। ফুল ফি পেয়িং স্টুডেন্ট হিসেবে ভর্তি হতে গেলে যা খরচ হবে তা জোগাড় করতে হলে আমার বাবার যা কিছু আছে সব বিক্রি করতে হবে। তাছাড়া ভিসা পেতে হলে নাকি পুরো কোর্সের টিউশন ফি’র চেয়ে বেশি টাকা ব্যাংকে থাকতে হয়। সুতরাং স্কলারশিপ ছাড়া দেশের বাইরে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।
আমার চারপাশে এমন কেউ নেই যার কাছ থেকে সঠিক পরামর্শ পেতে পারি। একেক জনের কাছ থেকে একেক ধরনের কথা শুনি। আমার ইউনিভার্সিটির টিচাররাও তেমন কোন তথ্য দেন না। অনেকটা অন্ধের পথ চলার মত হাতড়ে হাতড়ে এগোতে হয়েছে আমাকে। অবশেষে চার বছর চেষ্টার পর মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির রিসার্চ স্কলারশিপটি পেলাম।
স্কলারশিপের চিঠিটি পেয়ে খুশির প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কেটে যাবার পর বাস্তবতা আমাকে চুপসে দিলো আবার। এই স্কলারশিপ মানেই আমার সব সমস্যার সমাধান নয়। এই স্কলারশিপ টিউশন ফি কভার করে না। তবে এটা দিয়ে টিউশন ফি দেয়া যাবে। কিন্তু থাকা খাওয়ার খরচ পার্ট-টাইম কাজ করে জোগাড় করতে হবে। সেটা তেমন বড় সমস্যা নয়। কিন্তু প্রধান সমস্যা হলো ভিসা পাওয়া।
অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনে যোগাযোগ করলাম। স্কলারশিপ থাকাতে অনেকটা পজিটিভলি দেখা হবে আমার ভিসার দরখাস্ত। তবে তিন বছরের টিউশন ফি’র সম-পরিমাণ টাকা আমার নিজের বা আমার অভিভাবকের ব্যাংক একাউন্টে থাকতে হবে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। টাকা লাগবে না – অথচ টাকা থাকতে হবে ব্যাংকে। ব্যাংকের স্টেটমেন্ট জমা দিতে হবে ভিসার দরখাস্তের সাথে।
হাই কমিশনের বাইরে স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আসা অনেকের কথোপকথন শুনে একেবারে দমে গেলাম। ব্যাংকে নাকি তিরিশ লাখ টাকার কম থাকলে ভিসা পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই, শুধু শুধু দরখাস্ত করার টাকাটাই নষ্ট হবে। ওটাও কম নয় – নয় হাজার একশ’ টাকা। শুধু তাই নয়, ভর্তির আগেই এক সেমিস্টারের টিউশন ফি জমা দিতে হবে ৮৭৫০ ডলার, মেডিকেল ফি ২৭৪ ডলার, প্লেন ভাড়া সব মিলিয়ে নগদ সাড়ে তিন লাখ টাকা লাগবে কয়েক দিনের মধ্যেই। আমার নিজের একাউন্টে আছে মাত্র আঠারো শ’ তিন টাকা। টাকা পয়সাকে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করিনি কখনো। কিন্তু মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে এই বস্তুটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ক’দিন নিজেকে একেবারে আড়াল করে ফেললাম। কলেজ থেকে ফিরে সোজা বাসায়। আর কোথাও যাই না, কারো সাথে দেখা করি না। একা থাকার একটা বড় সুবিধে হলো কেউ কোন প্রশ্ন করে না। আমি সেই সুবিধাটুকু নিলাম কয়েকদিন। নিজেকে নিজে বললাম, “তুই নিজেকে যতটুকু বাস্তববাদী মনে করিস, আসলে তুই তা নোস। বাইরে গিয়ে পড়াশোনার স্বপ্ন দেখছিস – কিন্তু সে সামর্থ্য তোর নেই। খুব বেশী ভালো ছাত্রও তুই নোস। হলে একটা ফুল স্কলারশিপ তুই পেতি। পেয়েছিস একটা হাফ স্কলারশিপ – যেটা তোর টিউশন ফি কভার করে না। সুতরাং সে চিন্তা বাদ দে”।
বাদ দিলাম। কিন্তু দু’দিন পরেই দিদি এসে আমাকে ধরে নিয়ে গেল তার বাসায়। “কোন চিন্তা করবি না। তুই ভিসার দরখাস্ত রেডি কর। বাকিটা আমরা দেখছি”। দাদা-দিদি-উদয়দা-দিদিভাই মিলে আমার সমস্যার সমাধান করে ফেললো। দাদা তার সব সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেললো। বৌদি তার সামান্য যে ক’টা গয়না ছিল সব বিক্রি করে দিল। বাবার যেহেতু অর্থনৈতিক সামর্থ্য নেই, ভিসার দরখাস্তে দিদি হলো আমার অভিভাবক। সে আর উদয়দা তাদের নিজেদের সব সঞ্চয় ব্যাংকে জড়ো করলো, সহকর্মীদের কাছ থেকে টাকা ধার করলো, ব্যাংক থেকে চড়াসুদে ঋণ নিলো। দিদিভাই তার প্রভিডেন্ট ফান্ড উজাড় করে লোন নিলো। আমার বন্ধু অজিত সবে চাকরি শুরু করেছে, নিজের একাউন্টে যা ছিল সব দিয়ে দিলো আমাকে। ভিসার দরখাস্ত করলাম। প্রি-ভিসা হবার পর মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে এডমিশানের টাকা পাঠিয়ে দিলাম। এডমিশান কনফার্ম হলো। অজিত মেলবোর্নে ফোন করে নিজের অফিসের ফ্যাক্সে আমার এডমিশানের কাগজপত্র আনিয়ে নিলো। আমি ভিসা পেয়ে গেলাম।
সবার ভালোবাসা আর বিশ্বাসে ভর করে আমি অস্ট্রেলিয়ায় এসেছি। এখন এখানে ভালো করার দায়িত্ব আমার। ছোটখাট ব্যাপারে মন খারাপ করে, শরীর খারাপ করে পালাই পালাই করা মানে আমার আপনজনদের অপমান করা। আমি তা কিছুতেই করতে পারি না।
আসার আগে দিদি বলেছে, “মেলবোর্নে তোর অবস্থা হবে গ্রাম থেকে শহরে পড়তে আসা ছাত্রদের মত, শুরুতে যাদের কোথাও কেউ থাকে না। নানা জায়গায় ঠোক্কর খেতে খেতে একদিন যারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যায়”। ঠোক্কর খেতে খেতে উত্তর গোলার্ধ থেকে দক্ষিণ গোলার্ধ পর্যন্ত যখন আসতে পেরেছি – তখন আর সব ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে। দু’দিন আগে অথবা দু’দিন পরে। তুমি কী বলো? হবে না?
ক্রমশঃ____________
মন খারাপ হয়ে গেল আপনার বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতার পেশায় না ঢুকতে পারার কাহিনী শুনে। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম সেখানে ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কোন ভিন্নধর্মাবলম্বী ছাত্রকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়নি। কত কত ভাল রেজাল্ট করা ছাত্র যে বুকের মধ্যে জমাট বাধা কান্না নিয়ে চলে গেছে সেখান থেকে তার ইয়ত্তা নেই।
কবে যে আমরা মানুষ হব কে জানে?
@ফরিদ ভাই,
আগে তো সাচ্চা মুসলমান হোন! তাইলে মানুষ হওয়াটা ফ্রি। ইন্টেলেকচুয়াল মুস্লিমদের কথা আর কি!! :laugh:
অসাধারন।
আপনার ভাই বোন বন্ধুবান্ধব যেভাবে আপনাকে সাহায্য করেছে তা শুনলে গল্প উপন্যাসের মতই মনে হয়।